• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • কৌতুক
  • লিরিক
  • ডিকশনারি
  • PDF

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

১.৭-৮ অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » প্রবেশ নিষেধ » ১.৭-৮ অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল

০৭.

অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল থেকে আধ মাইল খানেক দূরে সরে এল। রানা হেঁটে, তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফিরে এল নিজের হোটেলে। ওভারকোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে পেছন ফিরতেই চোখ পড়ল ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে রানার দিকে চেয়ে।

য্যানডাম থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?

মাঝ রাস্তায় মনে পড়ে গেল বাথরূমের চেইন টানা হয়নি, তাই ফিরে এলাম, বলল রানা। না, না, এক্ষুণি চাবি লাগবে না, আপাতত বারে যাচ্ছি।

হুইস্কির গ্লাস সায়া নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা। কি তথ্য সংগ্রহ করেছিল ইসমাইল যার জন্যে প্রাণ দিতে হলো ওকে? নাকি এটা ওর প্রতি সাবধানবাণী? ইসমাইলকে ব্যবহার করা হয়েছিল শুধু ওকে চিনে নেয়ার। জন্যে? গোপনে ঘর সার্চ করছে, হোটেল থেকে বেরোলেই অনুসরণ করছে, সর্বক্ষণ ওর ওপর নজর রাখছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর সেই সঙ্গে আরও কজন কে জানে, পুতুলের পেছনে দেখা যাচ্ছে একজোড়া চোখ, ইন্সপেক্টরের। ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে তার পালিতা মেয়েকে হেরোইন সাপ্লাই দিয়ে, অথচ ধরা যাচ্ছে না কাউকে সব মিলিয়ে কি দাঁড়ায়? সবকিছু জগাখিচুড়ি পাকিয়ে মস্ত একটা ঘোড়ার ডিম হয়ে যাচ্ছে না?

একমাত্র ভরসার কথা, রানার ওজন এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি ওরা। সেইজন্যেই দ্বিধা করছে ওকে সাফ করে দেয়ার ব্যাপারে। আর কোন কারণ থাকতে পারে না ওকে এভাবে অবাধে ঘুরতে ফিরতে দেয়ার, বাঁচিয়ে রাখার। এখনও ওদের যথেষ্ট পরিমাণে উত্যক্ত করতে পারেনি সে, এমন কিছু করতে পারেনি যাতে ওদের পিলে চমকে যেতে পারে। যতক্ষণ না সেটা ঘটছে, ভদ্রতার মুখোশ খসাবে না ওরা-কদিন রাডহাউন্ডের মত হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে হতাশ হয়ে যদি সে ফিরে যায় দেশে, সেটাই তো লাভ। ওদের চমকে দিতে হলে গভীর রাতে আজ আর একবার যেতে হবে ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে একা। সোহানাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলে চলবে না। অন্য কোন লাইন যখন খুলছে না, এইদিকেই। আর একটু চাপ দিয়ে দেখতে হবে ওদের প্রতিক্রিয়া। ঠিক কটার সময় রওনা হলে ভাল হয় ভেবেচিন্তে স্থির করবার চেষ্টা করছিল রানা, এমনি সময়ে হঠাৎ চোখ তুলে চাইল সে সামনের আয়নার দিকে। ই এস পি বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা ওই জাতীয় কিছু নয়, পরিচিত একটা গন্ধ নাকে আসতেই কৌতূহলী চোখ তুলল সে গন্ধের উৎসটা দেখবার জন্যে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আবছাভাবে পাচ্ছিল সে গন্ধটা, হঠাৎ বুঝতে পারল ওটা চন্দন কাঠের গন্ধ, চট করে মনে পড়ল এর আগে কোথায় পেয়েছিল সে এই গন্ধটা–তাই এই ঔৎসুক্য।

রানার ঠিক পেছনের টেবিলেই বসে রয়েছে মেয়েটা, টেবিলের ওপর। একটা ডিস্ক, হাতে খবরের কাগজ। আয়নার দিকে চোখ তুলেই রানার মনে হলো, ওর দিকেই চেয়ে ছিল মেয়েটা, ও চোখ তুলতেই চট করে নামিয়ে নিল দৃষ্টি। অল্পবয়সী মহিলা, সবুজ একটা কোট পরনে, সোনালী চুল এতই আধুনিক ফ্যাশানে কাটা যে রানার মনে হলো ফুল বাগানের ডাল ছাটবার কাঁচি দিয়ে পাগলের হাতে ছাঁটা হয়েছে চুলগুলো।

আরেক পেগ হুইস্কি চাইল রানা, শেষ হয়ে যাওয়া গ্লাসটা তুলে নিয়ে নতুন একটা গ্লাস নামিয়ে রাখল ওয়েটার টেবিলের ওপর। দ্বিতীয় গ্লাসটা স্পর্শ না করেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে, ধীরপায়ে এগোল হোটেলের সদর দরজার দিকে। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওর দিকে একবার চাইল না পর্যন্ত–এতই চিন্তাময় ভঙ্গি রানার। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে ব্যস্ত। হয়ে উঠতে দেখে সান্তনার ভঙ্গিতে হাত তুলল রানা, বলল, বেশি দূরে। কোথাও যাচ্ছি না, দুই মিনিটেই ফিরে আসছি। ঘাবড়াবার কিছুই নেই।

রাস্তায় নেমে দ্রুতপায়ে চলে এল রানা বিশগজ দূরে মোডের পাবলিক টেলিফোন বুদে। রিঙ করল সোহানাদের হোটেলের নাম্বারে। পুরো দুই মিনিট লাগল ওর রিসিপশনের বুড়িকে বোঝাতে যে সোহানাকে চায় ও। আরও তিন। মিনিট পর ধরল সোহানা।

হ্যালো, কে বলছেন?

বস্। মাসুদ রানা। এই মুহূর্তে রওনা হয়ে যাও তোমরা আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে।

এখন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সোহানা। শ্যাম্পু করছিলাম…

ঠিক আছে, চুল মুছে নেয়ার জন্য দুই মিনিট সময় দেয়া গেল। দুই মিনিটের মধ্যে রওনা হয়ে যাও। মারিয়া কোথায়?

ঘুমোচ্ছে।

তোলো ওকে। ওরও আসতে হবে। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছবে এখানে এসে। ভেতরে ঢুকবে না। সদর দরজা থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে অপেক্ষা করবে কোথাও।

কিন্তু বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে আবার। বৃষ্টি নামলে?

ভিজতে না চাইলে ছাতা আনবে সঙ্গে। শোনো, কিছুক্ষণের মধ্যে। একটা মেয়ে বেরিয়ে আসবে এই হোটেল থেকে। তোমার সমানই লম্বা, তোমারই বয়স, তোমারই মত ফিগার–শুধু চুলটা সোনালী।

কমপক্ষে দশ হাজার মেয়ে আছে এই শহরে ঠিক এই রকম।

উঁহু। এই মেয়েটা সুন্দরীও। তোমার মত অতটা না, তবে সুন্দর। সবুজ একটা কোট থাকবে মেয়েটার গায়ে, সবুজ একটা ছাতাও থাকবে সঙ্গে, স্যান্ডাল উড পারফিউম মেখেছে, যদি কাছে থেকে লক্ষ করবার সুযোগ হয়–দেখবে বামদিকের জুলফির কাছে কায়দা করে ঢাকা-একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। গতকাল বিকেলে আমার সাথে এক সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে ওই ক্ষতচিহ্ন।

তোমার সাথে সংঘর্ষ! মেয়েমানুষের? আজকাল সুন্দরী মেয়েদের সাথেও মারামারি করছ এ খবরটা তো জানা ছিল না? আমাদের জানাবার। প্রয়োজন বোধ করোনি নিশ্চয়ই?

প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি কথা মনে রাখা এবং অধীনস্থ কর্মচারীদের জানানো আমার জন্যে ফরজ নয়। মেয়েটাকে অনুসরণ করতে হবে তোমাদের। কোথায় যায় দেখবে, একজন পাহারায় থাকবে, আরেকজন ফিরে এসে রিপোর্ট করবে আমার কাছে। না–এই হোটেলে ঢুকতে পারবে না। রেমব্রান্টপ্লেইনের শেষ মাথায় ওল্ডবেল নামে একটা পা আছে–ওখানেই। পাবে আমাকে প্রায় মাতাল অবস্থায়। বোঝা গেছে? ওভার।

দ্রুতপায়ে ফিরে এল রানা। সবুজ কোট পরা মেয়েটা তেমনি বসে আছে সেই টেবিলে, ডুবে আছে খবরের কাগজে। রিসিপশন ডেস্ক থেকে গোটাকয়েক সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে ফিরে এল রানা নিজের টেবিলে, এবার একটু কাত হয়ে বসল, যেন ওর কার্যকলাপ সহজেই লক্ষ করতে পারে। মেয়েটা।

গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে ওয়ালেট থেকে গত রাতের ডিনার বিলটা বের করে টেবিলের ওপর বিছাল রানা, তালু দিয়ে ঘষে সমান করল, তারপর একটা বলপয়েন্ট পেন বের করে সাদা কাগজের ওপর নোট লিখতে শুরু করল। খানিকক্ষণ নোট করবার পর বিরক্ত হয়ে পেনটা নামিয়ে রাখল সে টেবিলের ওপর, কাগজটা দলা-মোচড়া করে ফেলে দিল কাছেই একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আবার লিখতে শুরু করল আরেকটা কাগজে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আবার অসন্তোষ ফুটে উঠল ওর চোখেমুখে, ভঙ্গিতে। এই কাগজটাও দলা পাকিয়ে ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করল। বারকয়েক এইভাবে হিসেব মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল সে পাঁচমিনিট। একটা সিগারেট শেষ হয়ে যেতেই ধরাল আরেকটা, যেন অত্যন্ত জটিল কোন সমস্যার সমাধান বের করবার চেষ্টা করছে সে, ডুবে আছে গভীর চিন্তায়। আসলে সময় পার করছে রানা। দশ মিনিটের মধ্যে আসতে বলেছে সে। সোহানাকে, কিন্তু আরও অন্তত দশটা মিনিট সময় দেয়া দরকার ওদের হাজার হোক মেয়ে, তৈরি হয়ে নিয়ে বেরোতে একটু দেরি হবেই।

খানিকক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থেকে আবার লেখায় মন দিল রানা-কয়েক মিনিট। ধরে লেখে, কয়েক মিনিট সেটা পড়ে, তারপর কাগজটা লাড্ড পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। এইভাবে বিশ মিনিট পার করে হতাশ। ভঙ্গিতে উঠে পড়ল রানা প্লাসের অবশিষ্ট তরল পদার্থ গলাধঃকরণ করে, বারম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল বার থেকে। বেরিয়ে গেল মানে, প্লাশ কার্টেনের আড়ালে গিয়েই থেমে দাঁড়াল। পর্দার আড়াল থেকে সাবধানে চোখ রাখল মেয়েটার ওপর। উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, বার কাউন্টারের কাছে গিয়ে অর্ডার দিল আরেকটা ড্রিঙ্কের, তারপর যেন কোন চেয়ারে। বসেছিল ভুলে গিয়েছে এমনি ভঙ্গিতে বসে পড়ল রানার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে। কেউ লক্ষ করছে কিনা দেখবার জন্যে সহজ দৃষ্টিতে এপাশ-ওপাশ চাইল, তারপর আলগোছে তুলে নিল একটা দলা পাকানো কাগজ।

নিঃশব্দে এগোল রানা মেয়েটার দিকে। কাগজটা সোজা করেই কেমন একটু বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েটার চেহারা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে সে। লেখাগুলোর দিকে। কাগজের ওপর বড় হাতের অক্ষরে লেখা রয়েছে বোকা মেয়ে। কেমন জব্দ?

আর সব কাগজেও এই একই গোপন বার্তা রয়েছে, বলল রানা। গুড ইভনিং, মিস শেরম্যান।

মেয়েটা এত জোরে পাশ ফিরল যে কড়মড় করে পিঠের হাড় ফুটল। রানার মুখের দিকে চেয়েই দপ করে নিভে গেল ওর চোখের জ্যোতি। প্রথমে একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তারপরেই লাল হয়ে উঠল ওর মুখটা। লজ্জায়।

বাহ! খুব কম মেয়েই পারে এত সুন্দর ব্লাশ করতে।

আমি দুঃখিত। ইংরেজি বলতে পারি না।

হয় এরকম, সমব্যথীর মত বলল রানা। একে বলে কংকাসিভ অ্যামনেশিয়া। অনেকে বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই, সেরে যায় এ রোগ সহজেই। আলতো করে তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করল, রানা মেয়েটার জুলফির কাছে। জখমটা এখন কেমন, মিস শেরম্যান?

বলছি তো, আমি দুঃখিত, আমি…।

ইংরেজি বলতে পারো না। শুনেছি। কিন্তু বুঝতে তো কোন অসুবিধে আছে বলে মনে হচ্ছে না? বিশেষ করে লিখিত ইংরেজি। ইংরেজি কথায় লজ্জা পেয়ে লাল হতেও কোন অসুবিধে নেই।

উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। হাতের পত্রিকাটা গোল করে জড়াচ্ছে, আবার খুলছে নিজের অজান্তেই। শত্রুপক্ষের। মেয়ে, সন্দেহ নেই। রানার বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এয়ারপোটে ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে রানাকে বাধা দিয়ে খুনীকে। পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, তাও ভাল করেই জানা আছে রানার। কিন্তু। তবু কেন যেন কৃপা হলো রানার মেয়েটির প্রতি। কেন করছে মেয়েটা এই কাজ? স্বেচ্ছায়, না বাধ্য হয়ে? হাবভাব, চালচলনে তো পাজি মেয়ে বলে মনে  হয় না। তাহলে? ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে ওকে? যাই হোক, মেয়েটা শত্রুপক্ষের হোক আর যাই হোক, ওকে এই অপ্রস্তুত, অসহায় অবস্থায় ফেলে মনে মনে খুশি হতে পারল না রানা। তবু তির্যক ভঙ্গিতে বলল, বাকি কাগজগুলো দেব? দেখবে? ইচ্ছে করলে নিতে পারো তুমি ওগুলো, আমার আপত্তি নেই।  

ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের দিকে চাইল মেয়েটা। আমতা আমতা করে। বলল, ওগুলো নিয়ে আমি কি…

হুম। ইংরেজি বলবার ক্ষমতা ফিরে আসছে আবার। দেখেছ? বলেছিলাম না?

আরও লাল হয়ে উঠল মেয়েটা ইংরেজিতে কথা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে। প্লীজ, আমি

পরচুলাটা সরে গেছে একপাশে, মিস শেরম্যান।

চট করে হাতটা উঠল ওর চুলে, ঠকানো হয়েছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে নামাল হাতটা, নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছে দাঁত দিয়ে, খয়েরী চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। এই কাজটা করে নিজের ওপর বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট হতে পারল না। রানা, বরং অনুশোচনা হলো।

প্লীজ। যেতে দিন আমাকে। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল মেয়েটা।

যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলতে পারে এখন, সেই ভয়ে চট করে সরে দাঁড়াল রানা মেয়েটার পথ ছেড়ে। এত সহজে ছাড়া পেয়ে যাবে সেটা হয়তো আশা করেনি, কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দ্রুতপায়ে। বেরিয়ে গেল মেয়েটা হোটেল ছেড়ে। ধীর পায়ে পিছন পিছন এসে দাঁড়াল রানা দরজার সামনে। বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। ছাতাটা খুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে রওয়ানা হয়ে গেল বিট্রিক্স শেরম্যান ক্যানালের দিকে। বিশ সেকেন্ড পর দেখতে পেল রানা ছাতা মাথায়, ভিজে সপসপে অলেস্টার গায়ে ওই একই দিকে চলেছে সোহানা আর মারিয়া–একবারও চাইল না ওরা হোটেলের সদর দরজার দিকে।

খুব একটা সুখী বলে মনে হলো না ওদের মুখের দিকে চেয়ে।

আবার গিয়ে ঢুকল রানা বারে। অপেক্ষা করতে হবে ওকে আরও অন্তত আধঘণ্টা।

.

০৮.

লোকজনের কথাবার্তায় আর গ্লাসের টুংটাং শব্দে সরগরম ওল্ডবেলে দরজার দিকে মুখ করে বসল রানা একটা টেবিলে। দরজার দিকে পিঠ ফিরে বসবার ব্যাপারে কোন কুসংস্কার বশে নয়, সোহানা বা মারিয়া যেই হোক পৌঁছলে যেন চট করে দেখতে পায় সেইজন্যেই দরজার দিকে মুখ করে বসল সে এক মগ বিয়ার নিয়ে। বিশ মিনিট অপেক্ষার পর ঢুকল মারিয়া। স্কার্ফ আর ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভেজা চুল গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে ওর।

খবর সব ভাল? জিজ্ঞেস করল রানা।

সামনের চেয়ারে বসে পড়ল মারিয়া। বার দুয়েক লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল, চুপচুপে হয়ে ভেজাটা যদি ভাল মনে করেন, তাহলে খবর খুবই ভাল।

মৃদু হেসে একটা শেরির অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা, আর সোহানা?

সেও ভাল আছে। শেরিতে চুমুক দিল মারিয়া।

এবার তৃতীয়জনের কথা শোনা যাক। যাকে অনুসরণ করছিলে। তার খবর কি? কোথায় ও এখন?

গির্জায়।

কী?

মাথা দুলিয়ে হাইম গাইছে।

 মাশাল্লা। আর সোহানা?

সেও গির্জায়।

ও-ও কি গান গাইছে?

হাসল মারিয়া। তা বলতে পারব না। আমি ভেতরে ঢুকিনি।

 সোহানারও বোধহয় না ঢোকাই উচিত ছিল, ভুরু কুঁচকে বলল রানা।

 গির্জার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর আছে কোথাও?

তা ঠিক। ঠিকই বলেছ। মুখে বলল ঠিকই, কিন্তু কেন যেন ভিতর ভিতর একটা অস্বস্তিবোধ খোঁচাতে শুরু করল ওকে।

রানার মনের ভাবটা আঁচ করে নিয়ে মারিয়া বলল, আমাদের একজনকে থেকে যেতে বলেছিলেন না?

বলেছিলাম।

সোহানা বলল, গির্জার নামটা শুনলে নাকি অবাক হবেন আপনি।

অবাক হব? নাম শোনার আগেই অবাক হলো রানা। গির্জার নাম শুনে অবাক হওয়ার•• থেমে গেল রানা। বিস্ফারিত চোখে চাইল মারিয়ার মুখের দিকে। দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি? মারিয়াকে মাথা নাড়তে দেখে একলাফে উঠে দাঁড়াল রানা। এতক্ষণে বলছ সেকথা! উঠে পড়ো। আমি বিলটা দিয়ে আসছি, চট করে শেষ করে ফেলো গ্লাসটা।

কি ব্যাপার, মেজর রানা? গির্জার কথা শুনে…

মারিয়ার কথা শেষ হওয়ার জন্যে আর অপেক্ষা করল না রানা, কাউন্টারে গিয়ে দাম চুকিয়ে এল চট করে। বাইরে বেরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল মারিয়া, এত ব্যস্ত হওয়ার কি ঘটেছে?

আজ সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিল, কি কি ঘটেছে, কিছুই বলেনি তোমাকে সোহানা?

বলবার সুযোগ পায়নি, বলল মারিয়া। ও যখন ফিরে আসে, আমি তখন। ঘুমে। রাস্তায় চলতে চলতে শুনছিলাম। সবিস্তারে। কিন্তু ও যখন সেই ভয়ঙ্কর গলিতে দাঁড়িয়ে আপনার কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে ঠিক সেই সময় গির্জার মধ্যে ঢুকে পড়ল সামনের মেয়েটা। ওল্ডবেলে ফিরে গিয়ে আপনাকে খবরটা জানাতে বলেই ঢুকে গেল সেও গির্জার মধ্যে।

হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি ডাকল রানা। দশ মিনিট পর একটা গলির মুখে। ছেড়ে দিল ট্যাক্সিটা। সেই গলি ধরে ডাইনে বয়ে কয়েকটা বাঁক নিতেই হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া আশ্চর্য! কোন রাস্তায় কিভাবে এলাম? ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে গির্জাটা!

গজ পঞ্চাশেক দূরে খালের ধারে দেখা যাচ্ছে বিমর্ষ চেহারার এক গির্জা। একেবারে ঝুরঝুরে। দেখলে মনে হয় যে কোন সময়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। রানা আন্দাজ করল, বয়স এটার অন্তত চারশো বছর তো হবেই। একমাত্র বিশ্বাসের জোরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও। এতদূর থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, গির্জার মাথায় চৌকোণ টাওয়ারটা অন্তত পাঁচ ডিগ্রী হেলে রয়েছে খালের দিকে মনে হয় জোরে একটা ধমক দিলেই গোটা গির্জাটা ঝপাৎ করে ডাইভ দিয়ে পড়বে খালে। অল্পদিনেই ফান্ড, সংগ্রহের কাজে। নামতে হবে হিউগানট সোসাইটিকে গির্জাটা সম্পূর্ণ ধসিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে গড়ার জন্যে।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে রানা বুঝতে পারল, কেবল গির্জাটাই নয়, পুরো এলাকার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িই তৈরি হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। খালের। ধারে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর। মস্ত লম্বা বুমসহ প্রকাণ্ড এক ক্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে পরিষ্কার করা জায়গার ঠিক মাঝখানে। বুমটা এতই উঁচু যে অন্ধকারে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ওটার শেষ মাখা। খুব দ্রুত কাজ চলছে বলে মনে হলো–একপাশে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার। করে ফাউন্ডেশন পর্যন্ত উঠে পড়েছে গোটা কয়েক হবু মাটিস্টোরিড বিল্ডিং।

ক্যানেলের ধার ঘেষে এগেল ওরা ধীর পায়ে। কিছুদূর এগিয়েই কানে। এল অর্গানের বাজনা, সেইসাথে মহিলা কণ্ঠের গান। গানের সুরে মধুর একটা নিরাপদ শান্তির বাণী টের পেল রানা–ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়ে গেল ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের সেই নিঃসঙ্গ গির্জাটার কথা; ব্রাদার জুড, ব্রাদার লিগোরির কথা, ধনাইয়ের কথা; ছাতখোলা ল্যাট্রিনের নালায় নিমের বীচি আর প্রস্রাবের ঝাঝের কথা; টিফিন আওয়ারে গোল্লাছুটের কথা, কবে এই ধরাবাঁধা নিয়ম আর উঁচু পাঁচিলের বেড়া ডিঙিয়ে বেরোতে পারবে সেই ভেবে বড় হওয়ার তীব্র বাসনার কথা; ধনাইয়ের বাজানো ঢং ঢং ছুটির ঘণ্টার কথা; স্কুল-মাঠের ওপর দিয়ে সুতো ঝুলিয়ে কাটা-ঘুড়ি উড়ে যাওয়ার কথা।

কি ভাবছেন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

না, কিছু না। ভাবছি, সার্ভিস চলছে এখনও…তুমি বরং এক কাজ করো, ভেতরে গিয়ে… বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রানা। সাদা রেনকোট পরা কালো চুলের এক মেয়েকে ওদের পাশ কাটিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে গির্জার দিকে এগোতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর ডাকল, এ্যাই

নির্জন রাস্তায় পুরুষকণ্ঠে এই ধরনের ডাক এলে কি করতে হয় ভালমতই জানা আছে মেয়েটার-ঝট করে একবার রানার দিকে চেয়েই ঝেড়ে দৌড় দিল সে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই ভেজা কাকরে পা পিছলে হোঁচট খেলো, সামলে নিয়ে আরও দুই কদম যেতে না যেতেই ধরে ফেলল ওকে রানা। কয়েক সেকেন্ড ধস্তাধস্তি করেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা, দুই হাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা। কাছে এসে দাঁড়াল মারিয়া। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখটা।

পরিচিত কেউ? জিজ্ঞেস না করে পারল না সে।

আজই সকালে পরিচয় হয়েছে। এর কথা বলেছি তোমাকে মারিয়া, এরই নাম ইরিন। ইরিন মাগেনথেলার।

ও। ইরিনের বাহুর ওপর হাত রাখল মারিয়া, কিন্তু ওকে তেমন পাত্তা দিল না ইরিন, আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে, ঠিক চার ইঞ্চি দূর থেকে।

তুমি খুব ভাল, দ্বিতীয়বার ঘোষণা করল ইরিন। আমি তোমাকে ভালবাসি।

হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। সকালেই বলেছ তুমি আমাকে। মুসিবত!

 কি করা যায় এখন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

সেটাই ভাবছি। তুমি চিনতে পারবে না, আমারই পৌঁছে দিতে হবে। ওকে বাড়িতে। ট্যাক্সিতে তুলে দিলে প্রথম ট্র্যাফিক লাইটে পৌঁছেই ভাগবে। গাড়ি থেকে নেমে। খুব সম্ভব নাক ডাকাচ্ছে বুড়িটা, সেই সুযোগে পালিয়েছে ও বাড়ি থেকে। ওর বাপ হয়তো এতক্ষণে চষে বেড়াচ্ছে সারা শহর।

 বেশ কিছুটা জোর খাটিয়েই গলা থেকে ইরিনের একটা হাত খসাল রানা, আস্তিন তুলে ফেলল ওপরে। হাইপোডার্মিকের খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত। হাতটার দিকে চেয়ে নিজের অজান্তেই ইশশ বলে উঠল মারিয়া। গাল দুটো– কুঁচকে গেছে ওর হাতের অবস্থা দেখে। আস্তিনটা টেনে নামিয়ে দিল রানা। সকালের মত কান্নায় ভেঙে না পড়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল খিল করে। হাসতে শুরু করল ইরিন, যেন খুব মজার কাণ্ড হচ্ছে একটা। বামহাতটাও পরীক্ষা করে দেখল রানা, নামিয়ে দিল আস্তিন।

নতুন কোন দাগ নেই, বলল রানা।

হাতে নেই, বলল মারিয়া। অন্য কোথাও থাকতে পারে।

তাই বলে এতবড় মেয়েকে তো আর রাস্তার ওপর ন্যাংটো করে দেখা যায় না। দাঁড়াও, কথা বোলো না, ভাবতে দাও আমাকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ওদের কেউ তোমাকে দেখেছে? গির্জায় যারা আছে, তাদের কেউ?

মনে হয় না।

কিন্তু সোহানাকে নিশ্চয়ই দেখেছে ওদের অনেকেই।

দেখেছে হয়তো, কিন্তু আবার দেখলে চিনতে পারবে, এমন কথা হলপ করে বলা যায় না। স্কার্ফ জড়ানো রয়েছে ওর মাথায়, তার ওপর কোটের হুড রয়েছে। তাছাড়া দরজার বাইরে থেকে দেখেছি, ছায়ার মধ্যে আড়াল হয়ে বসেছিল ও।

ওকে বাইরে নিয়ে এসো। সার্ভিস শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরে কোথাও অপেক্ষা করো। শেরম্যান বেরোলে ওকে অনুসরণ করবে তোমরা। আর চেষ্টা করবে ওদের মধ্যে যতগুলো সম্ভব চেহারা মনে রাখতে।

সেটা সহজ হবে না। মাথা নাড়ল মারিয়া।

কেন?

সবাই ওরা একই রকম দেখতে।

তার মানে?

বেশির ভাগই নান। হাতে বাইবেল, কোমরে রশি, মাথা ঢাকা–চুল দেখবার উপায় নেই, সব কজনের লম্বা কালো কাপড়, আর সাদা…

নানরা কি পোশাক পরে আমার জানা আছে। একটু কঠোর শোনাল রানার গলা।

তা ঠিক। কিন্তু একটা কথা আপনার জানা নেই–এদের প্রত্যেকেই কমবয়সী, প্রত্যেকেই সুন্দরী। কয়েকজন তো রীতিমত

নান আর স্কুল মিস্ট্রেস হলেই যে বুড়ি আর কুৎসিত হতে হবে তার। কোন মানে আছে? অসম্ভব কিছু করতে বলছি না আমি তোমাদের যতদূর সম্ভব, মনে রাখার চেষ্টা করবে ওদের চেহারাগুলো। শেরম্যানকে অনুসরণ করে যেখানে গিয়ে পৌঁছবে সে ঠিকানাটা ফোন করে জানাবে তোমাদের। হোটেলে। বলে রাখবে, আমি ফোন করলে যেন জানানো হয় আমাকে। বোঝা গেছে? চলো ইরিন। বাড়ি।

নিতান্ত বাধ্য মেয়ের মত রানার হাত ধরে এগোল ইরিন, কিছুদূর হেঁটেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল ওরা, গাড়িতে উঠে আবোল-তাবোল শিশুর প্রলাপ বকে গেল ইরিন, নিজের চিন্তায় ডুবে রইল রানা। মাগেনথেলারের দোরগোড়ায়। ট্যাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকল সে ইরিনকে নিয়ে।

ছেলেপিলের ব্যাপারে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা থেকে হঠাৎ মুক্তি পেলে বাপ-মা। যেমন স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে এবং ঠিক যতটা কটু ভাষায় বকাবকি করে, তাই জুটল ইরিনের কপালে মাগেনথেলার আর মারগ্রিয়েটের কাছ থেকে। ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে। ঝটপট দুটো গ্লাসে খানিকটা করে হুইস্কি ঢালল মাগেনথেলার, বসবার জন্যে অনুরোধ করল রানাকে। মাথা নাড়ল রানা।

বাইরে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। কর্নেল ডি গোল্ডকে এখন ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? একটা গাড়ি ধার নিতে চাই ওর কাছ থেকেফাস্ট কার।

মুদ হাসল মাগেনখেলার। কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু কোন প্রশ্ন করব না। আমি। কনেলকে অফিসেই পাবেন, আজ অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করবেন। উনি অফিসে। গ্লাসটা উঁচু করল সে। আপনাকে লক্ষ-কোটি ধন্যবাদ। কতটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম, বোঝাতে পারব না আমি আপনাকে।

পুলিস অ্যালার্টের ব্যবস্থা করেছিলেন?

করেছিলাম–কিন্তু আন-অফিশিয়াল পুলিস অ্যালার্ট। মান হাসল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। কারণটা বলেছি আপনাকে। বিশ্বস্ত কয়েকজন। বন্ধুকে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু অ্যামস্টার্ডামের নয় লক্ষ লোকের মধ্যে থেকে, একজনকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

আচ্ছা, বলুন তো, বাড়ি থেকে অতটা দূরে কেন গিয়েছিল ও?

প্রায়ই তো যায় ওখানে ও মারগ্রিয়েটের সঙ্গে। গির্জায়। হাইলার দ্বীপের যত লোক এখানে আছে, সবাই যায় ওটাতে। ওটা একটা হিউগানট চার্চ, হাইলারেও আছে একটা। মারগ্রিয়েটের সঙ্গে মাঝে মাঝে দ্বীপেও যায় ইরিন। চার্চ অ্যাটেন্ড করতে। গির্জা আর ভভেল পার্ক-এই দুটোই তো বেচারীর একমাত্র আউটিং।

বিশাল বপু নিয়ে কামরায় ঢুকল মারগ্রিয়েট, উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইল মাগেনথেলার ওর দিকে। হাসিহাসি মুখে মাথাটা এপাশ-ওপাশ নেড়ে বেরিয়ে গেল মারগ্রিয়েট ঘর থেকে। মস্ত হাঁপ ছেড়ে রানার দিকে ফিরল ইন্সপেক্টর।

থ্যাঙ্ক গড। নতুন কোন ইঞ্জেকশন পড়েনি। একঢোকে গ্লাসটা শেষ। করে বলল, অন্তত আজকের মত নিশ্চিন্ত।

গ্লাসটা শেষ করেই বিদায় নিল রানা। ট্যাক্সি. সোজা এসে থামল মানিক্সস্ট্রাটে। আগেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছে মাগেনথেলার, কাজেই রানার অপেক্ষাতেই বসে রয়েছে কর্নেল ডি গোল্ড। রানা ঢুকতেই ফাইল থেকে চোখ তুলল, খোলা পাতার ওপর একটা অ্যাশট্রে চাপা দিয়ে বন্ধ করে দিল। ফাইলটা।

বেশ অনেকদূর এগিয়েছেন আশা করলে কি ভুল হবে?

হবে।

বলেন কি? আপনার ওপর অনেক আশা করে রয়েছি আমি। কিছুই এগোতে পারেননি?

অতি সামান্য। উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়।

গাড়ির ব্যাপারে কি যেন বলছিল ইন্সপেক্টর ফোনে?

হ্যাঁ। একটু দরকার হয়ে পড়েছে।

কি দরকার জিজ্ঞেস করতে পারি?

ওটা চালাব। বলেই হাসল রানা। তবে কেবল ওই কারণেই আসিনি আমি আপনার কাছে।

আমি জানি, নিশ্চয়ই আরও কোন ব্যাপার আছে।

একটা সার্চ ওয়ারেন্ট দরকার।

কিসের জন্যে?

সার্চ করার জন্যে। আবার হাসল রানা। ব্যাপারটাকে আইনসঙ্গত করবার জন্যে সঙ্গে যদি কোন সিনিয়র অফিসার দিতে পারেন, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।

কোথায় সার্চ করতে হবে?

ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী। সুভ্যেনিরের ওয়েরহাউজ। ডকের পাশ দিয়ে যেতে হয়, পুরানো শহরে-ঠিকানাটা বলতে পারব না।

ঠিকানা বের করে নিতে অসুবিধে হবে না। নামটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মাথা ঝাঁকাল ডি গোন্ড। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে কোনদিন কোনকিছু শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আইনের চোখে টিকবে, এমন কোন চার্জ আছে। আপনার ওদের বিরুদ্ধে?

না। তা নেই।

তাহলে বিশেষ করে ওদের সম্পর্কেই আপনার এই কৌতূহল কেন?

তা বলতে পারব না। কসম। আমি আসলে জানতে চাই, কেন এই কৌতূহল জাগছে আমার মধ্যে। আজ সন্ধের পর গিয়েছিলাম আমি ওদের ওখানে…

বন্ধ দেখে ফিরে এসেছেন।

না ফিরে আসিনি। আবার হাসল রানা। একগোছ চাবি বের করে কর্নেলের নাকের সামনে দোলাল।

 বিপদে ফেলবেন দেখছি! খেপে গেল কর্নেল। আপনি জানেন, এ ধরনের যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখা আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ?

চট করে পকেটে ফেলল রানা স্কেলিটন চাবির গোছা। কোন ধরনের যন্ত্রপাতি, কর্নেল?

 না, কিছু না। দৃষ্টিবিভ্রম। চোখ দুটো ছোট হয়ে এল কর্নেলের।

সিগারেট ধরাল রানা। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে ছাতের দিকে ছাড়ল। তারপর অনেকটা আপন মনে বলল, ওদের অফিসঘরের স্টীলের দরজায় টাইম লকের ব্যবস্থা কেন করা হলো জানবার কৌতূহল বোধ করছি। আমার কৌতূহল ওদের কাছে বাইবেলের স্টক কেন। ক্যানাবিসের গন্ধ আর পুতুলের আড়ালে সজাগ দুটো চোখের কথা চেপে গেল সে। কিন্তু আমার আসল কৌতূহল ওদের সাপ্লায়ারদের সম্পর্কে। ওদের লিস্ট অভ সাপ্লায়ার হাতে পেতে চাই আমি।

ঠিক আছে। সার্চ ওয়ারেন্ট একটা যে কোন প্রিটেক্সটে তৈরি করে নেয়া যাবে। আমি নিজে যাব আপনার সঙ্গে। কাল সকালে। কিন্তু আপনার এই কৌতূহল সম্পর্কে আরও কিছু জানাতে হবে কাল। এবার গাড়ির প্রসঙ্গে আসা যাক। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার চমৎকার এক সাজেশন দিয়েছে। স্পেশাল এঞ্জিন লাগানো একটা পুলিস-কার আছে আমাদের, হ্যাঁন্ডকাফ থেকে শুরু করে টু-ওয়ে রেডিও পর্যন্ত সবই রয়েছে ওটাতে–কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ একটা ট্যাক্সি। দুই মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ওটা। তবে ট্যাক্সি চালানোর ব্যাপারে রাস্তায় কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হেসে ফেলল রানা। বুঝলাম। বাড়তি কিছু রোজগার করি, সেটা। আপনার সহ্য হচ্ছে না। যাই হোক, আমার জন্যে আর কোন খবর আছে?

আসছে। দুই মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। আপনার ওই গাড়িতে করেই আসছে সংবাদ রেকর্ড অফিস থেকে।

ঠিক দুই মিনিট পর একটা ফাইল দিয়ে গেল একজন সেপাই কর্নেলের ডেস্কের ওপর। মুহূর্তে ওটার মধ্যে ডুবে গেল ভ্যান ডি গোল্ড, কয়েকটা পাতা উল্টে চোখ তুলল।

বিট্রিক্স শেরম্যান। ডাচ ফাদার, গ্রীসিয়ান মাদার। ওর বাপ ছিল এথেন্সের ভাইস কনসাল–মারা গেছে। মা কোথায় কি অবস্থায় আছে, জীবিত কি মৃত জানা যায় না। বয়স চব্বিশ। ওর সপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কিছুই নেই। আমাদের হাতে। ফাইলের পাতায় চোখ রেখে গড়গড় করে বলে চলল কর্নেল। তরে ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ কিছুটা আবছা বলে মনে হচ্ছে আমার। ব্যালিনোভা নাইট ক্লাবে কাজ করে হোস্টেসের, থাকে কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে। আত্মীয় বলতে একজনই আছে ওর হেনরী, ছোটভাই, বয়স বিশ। এই দেখুন, এতক্ষণে একটু জমে উঠছে বলে মনে হচ্ছে–ভাইটি ছমাসের জন্যে জেলের ভাত খেয়েছেন।

কি ব্যাপারে? ড্রাগস?

 অ্যাসল্ট এবং অ্যাটেম্পটেড রবারী। অ্যামেচারিশ প্রচেষ্টা। ভুল করে বেচারী এক সাদা পোশাক পরা গোয়েন্দা পলিসকে পাকড়েছিল শিকার হিসেবে। স্বীকার যায়নি, কিন্তু পুলিসের সন্দেই–ছোকরা অ্যাডিক্ট। ড্রাগস। কেনার পয়সার জন্যে ডাকাতি করবার চেষ্টা করেছিল। ব্যস। এই হচ্ছে। বিট্রিক্স শেরম্যান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। কয়েকটা পাতা উল্টে আরেক পৃষ্ঠায় স্থির হলো কর্নেলের দৃষ্টি। আর ওই যে নম্বর দিয়েছিলেন অর্থ উদ্ধারের জন্যে…একটা নম্বরের মানে বের করা গেছে। MOO144 হচ্ছে বেলজিয়ান কোস্টার মেরিনোর কল-সাইন। আগামীকাল এসে ভিড়বে আমাদের ঘাটে। বেশ কিছু কাজের লোক আছে আমার, কি বলেন?

হ্যাঁ। কখন পৌঁছবে মেরিনো?

দুপুরে। সার্চ করতে হবে ওটাকে?

সার্চ করে কিছু পাবেন না। কাজেই দয়া করে ওটার কাছেও যাবেন। আমার কাজের অসুবিধে হবে তাহলে কর্নেলকে ফাইল বন্ধ করে দিতে দেখে জিজ্ঞেস করল রানা, বাকি দুটো নম্বর থেকে কিছু বের করা গেল?

উহু। কিছুই বোঝা যায়নি… আবার ফাইলটা খুলল কর্নেল। কত যেন ছিল নম্বরগুলো? নাইন ওয়ান ডাবল জিরো টু জিরো, আরেকটা টু সেভেন। নাইন সেভেন। আচ্ছা! ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল ডি গোল্ড। শেষেরটা সেভেন নাইন সেভেনের ডবল না তো? দেখুন তো, সেভেন নাইন সেভেন সেভেন নাইন সেভেন-নম্বরটা পরিচিত মনে হয়?

মাথা নাড়ল রানা।

ড্রয়ার টেনে একটা টেলিফোন ডাইরেকটরি বের করল কর্নেল, কিন্তু আবার ওটা রেখে দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার কানে তুলে নিল। একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, লিখে নাও। সেভেন নাইন, ডাব- সেভেন নাইন। সেভেন। টেলিফোনটা কার নামে আছে বের করে জানাও আমাকে। এক্ষুণি।

ঠিক বিশ সেকেন্ড পর বেজে উঠল টেলিফোন। রিসিভারটা কানে তুলে চুপচাপ তিন সেকেন্ড শুনে নামিয়ে রাখল কর্নেল। রানার দিকে চাইল হাসিমুখে।

বালিনোভা নাইট-ক্লাব।

সত্যিই এফিশিয়েনসি আছে আপনাদের, স্বীকার করতেই হয়, বলল রানা মুখে। মনে মনে বলল তবু কি করে বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে। যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এক গুপ্ত দল আপনাদের নাকের ডগায় বসে? কেন আমাকে আসতে হচ্ছে সুদূর বাংলাদেশ থেকে?

এই বার? কি বুঝছেন?

বুঝতে পারছি, এই নাইট-ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ছিল কার্লটন হোটেলের সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের।

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। বুঝতে পেরেছে, নম্বরগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল রানা, কিভাবে সংগ্রহ করেছিল সেটাও আঁচ করে নিতে অসুবিধে হলো না তার। পনেরো সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। বড় বিপজ্জনক খেলায় নেমেছেন, মেজর মাসুদ রানা।

উঠে দাঁড়াল রানা। হাত বুলাল নিজের গালে। অনেক লোকেরই চেনা। হয়ে গেছে মুখটা। ছদ্মবেশের কিছু মালমশলা পাওয়া যাবে না, আপনাদের। হেডকোয়ার্টারে?

ছদ্মবেশ! চোখ মিটমিট করল কর্নেল। হেসে ফেলল। ওহ্ নো! এই যুগে? শার্লক হোমস মারা যাওয়ার এত বছর পরেও?

শার্লক হোমসের অর্ধেক বুদ্ধি যদি থাকত আমার মাথায়, তাহলে ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজনই পড়ত না। কথাটা বলল রানা এমন সুরে, যাতে শ্রোতার বিশ্বাস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে। এছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখতে পাচ্ছি না।

অল রাইট, বলল কর্নেল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

দরকারটা আমার এক্ষুণি।

বিশাল শরীরটা টেনে তুলল কর্নেল চেয়ার থেকে।

বেশ। আসুন আমার সঙ্গে।

« পূর্ববর্তী:
« ১.৫-৬ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরুমে
পরবর্তী: »
১.৯-১০ অবিকল একটা ট্যাক্সি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ

Return to top