• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • কৌতুক
  • লিরিক
  • ডিকশনারি
  • PDF

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

১.৩-৪ টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » প্রবেশ নিষেধ » ১.৩-৪ টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে

০৩.

টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এল রানা হোটেলে। সোজা ভেতরে না ঢুকে সাইড স্ট্রীট ধরে চলে এল ফায়ার এসকেপের সিঁড়ির কাছে। ঠিক এক মিনিট পর ছাতের দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। কেউ নেই ছাতে। প্যারাপেট ডিঙিয়ে শুয়ে পড়ল সে কার্নিসের ওপর। মাথা বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করল ওর কামরার পেছনের ব্যালকনিটা।

প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না রানা, কিন্তু গন্ধ পেল ধোয়ার। সিগারেটের নয়–গাঁজার। প্যারাপেটের গায়ে পা বাধিয়ে যতদূর সম্ভব। সামনের দিকে ঝুঁকে প্রায় পড়ি পড়ি অবস্থায় দেখতে পেল সে রেলিঙের ওপর। একজোড়া জুতোর চকচকে মাথা। পরমুহূর্তে দেখা গেল একটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো বাকা হয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। ব্যালকনির গায়ে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে অপেক্ষা করছে কেউ ওর জন্যে।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল রানা, পা টিপে চলে এল ফায়ার এসকেপের কাছে, কয়েক ধাপ নেমে আস্তে করে খুলল সাততলার দরজাটা। করিডরে কাউকে না দেখে সোজা এসে দাঁড়াল সে নিজের স্যুইটের দরজার সামনে। কান পেতে কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না ভিতর থেকে। কোমরে জড়ানো ক্যানভাস বেল্ট থেকে নকল চাবির গোছা বের করে নম্বর মিলিয়ে নিয়ে আলগোছে খুলল দরজার তালা। চট করে ভিতরে ঢুকেই বন্ধ করে দিল সে দরজাটা আবার, কেননা হাওয়া লেগে সিগারেটের ধোয়া দুলে উঠলে লোকটার সতর্ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু সতর্কতার মুডে নেই লোকটা। কয়েক পা এগিয়ে দেখতে পেল রানা একটা চেয়ারে বসে চোখ বুজে সুখটান দিচ্ছে সে মারিজুয়ানা পোরা সিগারেটে। পা দুটো নাচাচ্ছে ব্যালকনির রেলিঙের ওপর তুলে দিয়ে। সেই ফ্লোর ওয়েটার। ডানহাতটা কোলের ওপর, হাতে পিস্তল।

নিশ্চয়ই ঝাঁ ঝাঁ করছে ওর মাথার ভিতরটা কারণ, রানার উপস্থিতি কিছুই টের পেল না সে। চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়াল রানা, লোকটার কানের কাছে পিস্তল ধরে বামহাতটা আলগোছে রাখল ওর কাঁধের ওপর। চমকে উঠে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে চাইবার চেষ্টা করল লোকটা, পিস্তলের মাথা দিয়ে ডান চোখে গুতো খেয়ে বিদঘুটে এক শব্দ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ব্যথা পেয়ে দুই হাতই চোখের কাছে চলে এল ওর নিজেরই। অজান্তে। কোলের ওপর থেকে টপ করে পিস্তলটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেলল। রানা। পরমুহূর্তে ওর থুতনির নিচটা গলা ধাক্কার ভঙ্গিতে ধরে জোরে এক. ঠেলা দিল পেছন দিকে। চেয়ার, উল্টে ডিগবাজি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফ্লোর ওয়েটার মেঝের ওপর, জোরে ঠুকে গেল মাথার পেছনটা। দশ সেকেন্ড ঝিম ধরে পড়ে রইল লোকটা মেঝেতে, দিশে হারিয়ে ফেলেছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। তারপর উঠে বসল ধড়মড়িয়ে। রানাকে চিনতে পেরেই হিংস্র জানোয়ারের মত ছোট্ট একটা গর্জন ছাড়ল লোকটা, ঠোঁট দুটো সরে গিয়ে। নিকোটিনের দাগ লাগা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, দুই চোখের তীব্র দৃষ্টিতে ঘৃণার। বিষ। চাপা গলায় গোটাকয়েক ডাচ গালি দিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। ভাঙা ইংরেজিতে বলল, কি চাও তুমি? মারপিট? শক্তি পরীক্ষা?

মারপিট? অবাক হলো রানা। আরে না। অত তাড়াহুড়ো নেই আমার। ওসব হবে পরে। যদি দেখি কথা বেরোচ্ছে না তোমার মুখ থেকে।

বাঁকা এক টুকরো হাসির আভাস খেলে গেল লোকটার ঠোঁটের কোণে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সোজা হয়ে যখন দাঁড়াল রানার মাথা ছাড়িয়ে আরও আধ হাত উঠে গেল ওর মাথাটা। শুধু লম্বায় নয়, চওড়াতেও লোকটা। রানার দেড়গুণ। পেটা শরীর। রানার মুখের কথাগুলো তাই হাস্যকর শোনাল। ওর কাছে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা গ্রহণ করাই স্থির করল লোকটা। ঘাড়টা সামান্য, একটু কাত করে ফাঁইটিং পিকচারের দস্যু-সর্দারের ভঙ্গিতে বলল, কি ব্যাপারে কথা বের করতে চাও?

এই ধরো, আমার ঘরে তুমি কি করছ…সেটা দিয়ে শুরু করা যায়। তারপর আলাপ করা যেতে পারে কে তোমাকে পাঠিয়েছে, কেন পাঠিয়েছে সে সব বিষয়ে।

বিষণ্ণ হাসি হাসল লোকটা। এসব চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, মিস্টার। একটা কথাও বের করতে পারবে না আমার মুখ থেকে। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে পুলিস, একটা শব্দও বের করতে পারেনি। আইন আমার ভাল করেই জানা আছে। আমাকে দিয়ে কোন কথা বলাতে পারবে না। আইন বলে, কোন কথা প্রকাশ করা বা না করার অধিকার রয়েছে আমার।

দরজার ওই ওপাশ পর্যন্ত এসেই দাঁড়িয়ে গেছে আইন, বলল রানা। এপাশে তুমি আমি দুজনেই রয়েছি আইনের আওতার বাইরে। এখানেও একটা আইন অবশ্য রয়েছে…জঙ্গলের আইন। হয় মারো, নয় মরো।

রানার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই ডাইভ দিল লোকটা। নিচু হয়ে পিস্তলের লাইন অফ ফায়ার বাঁচাল ঠিকই, কিন্তু রানার হাঁটুর নিচে চিবুক নামাতে পারল না লোকটা। বিদ্যুৎবেগে এক পা এগিয়ে প্রচণ্ড এক গুতো। লাগাল রানা হাঁটু দিয়ে ওর থুতনি বরাবর। তীক্ষ্ণ ব্যথা বোধ করল রানা হাঁটুতে। সেই হিসেবে আধঘণ্টার জন্যে শুয়ে পড়বার কথা লোকটার, কিন্তু আশ্চর্য সহ্য ক্ষমতা ওর, মোক্ষম আঘাত পেয়েও রানার বাম পা ধরে হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে ভারসাম্য টলিয়ে দিল রানার। হুড়মুড় করে দুজনেই পড়ল মেঝের ওপর। হাতু থেকে খসে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে পড়ল রানার পিস্তলটা। পরবর্তী আধ মিনিট যুদ্ধরত বন্য জন্তুর মত গড়াগড়ি খেলো ওরা মেঝের। ওপর-একবার এ ওপরে, একবার ও। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বেগে ঘুসি চালাচ্ছে দুজন একে অপরের ওপর। লোকটার শারীরিক ও মানসিক বল অবাক করল রানাকে। বল প্রয়োগ না করে কৌশল প্রয়োগ করছে রানা এখন। মারিজুয়ানা টেনে স্বাভাবিক রিফ্লেক্স হারিয়ে না ফেললে কি ঘটত বলা যায় না, কারণ আনআর্মড কমব্যাটে সে কোন অংশে কম যায় না রানার থেকে, তার ওপর ওর গায়ে রয়েছে রানার দ্বিগুণ শক্তি। ঠিক আধ মিনিট পর দুজনেই যখন উঠে দাঁড়াল আবার, দেখা গেল বামহাতে চেপে ধরে আছে রানা লোকটার ডান হাত, হাতের কব্জি মুচড়ে ঠেলে তুলে এনেছে ওটাকে একেবারে শোলডার ব্লেডের কাছে।

কব্জিটা আরেকটু ওপরে তুলতেই, গোঙানির মত শব্দ বেরোল লোকটার মুখ থেকে, কিন্তু অভিনয় করছে কিনা সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আরও খানিকটা উঁচু করল রানা হাতটা। পিঠের কাছে কড়কড় আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারল সে, আর খানিকটা তুললেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে হাত। এইবার ঠেলে নিয়ে এল সে লোকটাকে ব্যালকনির রেলিঙের ধারে। রেলিংটা ওর পেটে বাধিয়ে ঠেলে শূন্যে তুলে ফেলল ওর শরীরের নিম্নাংশ। বাম হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু বেকায়দা অবস্থায় ধরতে পারল না শক্ত করে, পেছন থেকে সামান্য একটু ধাক্কা দিলেই সোজা নেমে যাবে সে সত্তর ফুট নিচের রাস্তায় মাথা নিচু পা উঁচু অবস্থায়।

তুমি পুশার না অ্যাডিক্ট? কানের কাছে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা।

জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল লোকটা, চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে আরেকটু চাপ দিল রানা ওর মুচড়ে ধরা হাতে, তারপর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল, চিৎকার করে লোক ডাকবার সুযোগ পাবে। না। উত্তর দাও।

পুশার। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। বিক্রি করি।

কে পাঠিয়েছে তোমাকে এখানে?

সেটা কিছুতেই বলব নাঃ যা খুশি তাই..উহ।

শেষ পাঁচটা সেকেন্ড একটু ভেবে দেখো। সিদ্ধান্ত তোমার। উত্তর না দিলে ঠেলে ফেলে দেব। ফুটপাথের দিকে একবার চেয়ে দেখো…ওই ওখানটায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকবে তোমার লাশ, মুখের গন্ধ শুকেই পুলিস বুঝে নেবে কেন তোমার হঠাৎ উড়বার শখ হয়েছিল।

খুন! কঁকিয়ে উঠল লোকটা। শুধু এই খবরটার জন্যে মানুষ খুন করতে পারো না তুমি।

পারি। সহজ কণ্ঠে বলল রানা। তোমরা সে অধিকার দিয়েছ। আমাকে। আজই বিকেলে তোমাদের লোক খুন করেছে আমার এক লোককে, বিনা অপরাধে। কেবল তোমাদেরই হত্যা করবার অধিকার আছে, আর কারও নেই? তাছাড়া এটা হত্যা কোথায়? চেয়ে দেখো, মাত্র সত্তর ফুট, পাঁচ সেকেন্ডও লাগবে না তোমার পৌঁছতে কারও বুঝবার ক্ষমতা নেই যে আমিই দায়ী এজন্যে। দেখো।

উরু দিয়ে ঠেলে রেলিঙের ওপর দিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে দিল রানা ওর শরীর ফুটপাথটা দেখবার সুবিধের জন্যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে ডানহাতে কলার খামচে ধরে টেনে আনল আবার।

কি দেখলে? কথা বলার ইচ্ছে আছে?

গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করল লোকটা। রেলিঙের ওপর থেকে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে এল রানা ওকে ঘরের মাঝখানে।

কে পাঠিয়েছে তোমাকে?

লোকটা খুবই টাফ, টের পেয়েছে রানী, কিন্তু ঠিক কতটা তা কল্পনাও করতে পারেনি। এই অবস্থায় ব্যথায় আর ভয়ে আধমরা হয়ে যাওয়ার কথা লোকটার, কিন্তু কোথায় কি–পাই করে ঘুরল সে ডানদিকে, এক ঝটকায়। ছাড়িয়ে নিল হাতটা। পরমুহূর্তে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। যাদুমন্ত্রবলে দশ ইঞ্চি লম্বা একখানা ক্ষুরধার ছুরি চলে এসেছে ওর বাম হাতে। সেকেন্ডের চারভাগের একভাগ সময়ের জন্যে হকচকিয়ে গিয়েছিল রানা, সেই সুযোগে ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে ওর বুকের কাছে নিয়ে এল সে ছুরিটা। কিছুমাত্র চিন্তা করবার সময় পেল না রানা, আত্মরক্ষার তাগিদে খপ করে দুই হাতে ধরে ফেলল। লোকটার কব্জি, ধরেই শুয়ে পড়ল পেছন দিকে, হাত ধরে জোরে টান দিল। নিচের দিকে, সেইসঙ্গে ডান পা-টা ওর তলপেটে বাধিয়ে প্রাণপণে লাথি দিল। ওপর দিকে। রানার শরীরের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল লোকটা ঘরের কোণে, মাথা নিচু, পা উঁচু অবস্থায় দড়াম করে ধাক্কা খেলো দেয়ালের গায়ে, তারপর চারফুট উঁচু থেকে হুড়মুড় করে পড়ল মেঝের কার্পেটের ওপর। কেপে উঠল সারাটা ঘর। সঙ্গে সঙ্গে কড়াৎ করে বিশ্রী একটা শব্দ এল রানার কানে।

লোকটাকে মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েই তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রানা আক্রমণের মোকাবিলার জন্যে, আওয়াজটা শুনেই বুঝতে পারল তাড়াহুড়োর আর কোন দরকারই নেই। দেয়াল বরাবর শুয়ে আছে লোকটা, মাথাটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে টেনে বসাবার চেষ্টা। করল রানা লোকটাকে। মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের কাছে। কব্জি টিপে পালসটা দেখে নিয়েই ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। দুঃখ হলো লোকটা কোন তথ্য না দিয়েই বেরসিকের মত টপ করে মরে যাওয়ায়।

লোকটার পকেট থেকে নানান ধরনের জিনিস বেরোল রুমাল, চিরুনি, হাতে তৈরি গাঁজার সিগারেট, আইডেন্টিটি কার্ড, বলপয়েন্ট কলম, অর্ডার লিখবার স্ক্র্যাপ প্যাড, ইত্যাদি হরেক রকম আইটেম। প্রত্যেকটা ভালমত পরীক্ষা করে রেখে দিল রানা যথাস্থানে, শুধু স্ক্র্যাপ প্যাডের মাঝামাঝি জায়গা। থেকে খসিয়ে নিল একটা কাগজ। কাগজের ওপর লেখা MOO 144, তার। নিচে আরও দুটো নম্বর 910020 আর 2797.

এসব লেখার মানে কিছুই বোধগম্য হলো না রানার কাছে, তবে কিছু একটা অর্থ থাকতে পারে মনে করে রেখে দিল সে কাগজের টুকরোটা প্যান্টের এক গোপন পকেটে। এক মিনিটের মধ্যেই ঘরটা গোছগাছ করে নিল রানা–ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন রইল না আর। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের পিস্তলটা বের করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল সে; খাল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। সেটা বাম দিকে; কয়েক সেকেন্ড পর হালকা একটা ঝপাং আওয়াজ পেয়ে ফিরে এল আবার ঘরে। জানালাগুলো খুলে ফ্যান চালিয়ে দিল ফুলফোর্সে। সিটিংরূমে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। করিডরের দরজা ফাঁক করে চোখ রাখল, কেউ নেই কান পাতল, পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না কারও। দ্রুতপায়ে লিফটের সামনে চলে এল রানা, বোতাম টিপে দাঁড়িয়ে রইল। খালি লিফট এসে থামল রানার সামনে। ভিতরে না ঢুকে পকেট থেকে একটা ম্যাচবাক্স বের করল রানা, দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ম্যাচবাক্সটা গুঁজে দিল দুই দরজার ফাঁকে। ইলেকট্রিক্যাল। সারকিট কমপ্লিট করতে না পেরে আবার দুপাশে খুলে গেল দরজাটা, আবার ফিরে এল, ম্যাচবাক্সের গায়ে বাধা পেয়ে আবার হাঁ হয়ে গেল খুলে। একছুটে নিজের কামরায় ফিরে এল রানা, টেনেহিঁচড়ে লাশটা নিয়ে গিয়ে পুরে দিল। লিফটের মধ্যে। ম্যাচবাক্সটা বের করে নিতেই এবার ক্লিক করে লেগে গেল দরজা। লেগে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেটা যেখানে ছিল সেখানেই। নিচে থেকে কেউ বোম না টিপলে থাকবে ওটা ওখানেই।

বাইরে থেকে নিজের কামরায় নকল চাবি দিয়ে তালা মেরে আবার ফায়ার এসকেপের মধ্যে গিয়ে ঢুকল রানা, দ্রুতপায়ে নেমে এল নিচে। এপাশ ১ ওপাশ দেখে নেমে পড়ল রাস্তায়। লম্বা পা ফেলে মেইন রোডে বেরিয়ে এল রানা, সদর দরজা দিয়ে ঢুকল এবার হোটেলে।

সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে আরও দুজন ইউনিফরম পরা সহকারী ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে। বেশ জোরে হাঁক ছাড়ল রানা, ছশো বাইশ।

রানার দিকে পেছন ফিরে ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সঁই করে ঘুরল গলার আওয়াজ পেয়ে। চট করে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল, সামলে নিল। তারপর রানার দিকে চেয়ে হাসল ওর ঝকঝকে হাসি।

মিস্টার রানা, আপনি বাইরে গিয়েছিলেন, জানতাম না?

মনে মনে রানা বলল ঠিকই জানতে চাঁদ, এক্ষুণি ফ্লোর ওয়েটারকে সাবধান করতে যাচ্ছিলে। কিন্তু মুখে বলল, এই খানিক ঘুরে ফিরে হেঁটে এলাম আর কি। খিদে বাড়িয়ে আনলাম।

চাবিটা নিয়ে ধীরে সুস্থে লিফটের দিকে এগোল রানা। বেশিদূর যেতে হলো না, অর্ধেক পথ গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে সাইরেনের মত তীক্ষ্ণ চিৎকারে। পাঁচ সেকেন্ড পর থামল সাইরেন, তিন সেকেন্ড চারপাশে পিন। পতন স্তব্ধতা, পুরো দম নিয়ে আবার খিচে আর্তনাদ ছাড়ল লিফটের সামনে দাঁড়ানো মহিলা। রঙচঙা কাপড় পরা মাঝবয়সী মহিলা, দুই চোখ বিস্ফারিত, মুখের গোল হাঁ দিয়ে পুরো একটা দুটাকা দামের রসগোল্লা ঢুকিয়ে দেয়া যায়। অনায়াসে। মহিলাকে থামাবার চেষ্টা করছে তার পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক ভদ্রলোক, কিন্তু বেচারার নিজের অবস্থাও মহিলার চেয়ে কোন দিক থেকে ভাল নেই, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে এপাশ ওপাশ চাইছে বৎসহারা গাভীর মত। দেখে মনে হচ্ছে, সেও খানিক চিৎকার করতে পারলে বেঁচে যেত।

রানাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার লিফটের দরজার কাছে। রানাও চলল পেছন পেছন। লিফটের মুখে পৌঁছে দেখল মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে লোকটা বিবর্ণ মুখে। একবিন্দু রক্ত নেই চেহারার কোথাও।

ইয়াল্লা! বলল রানা চোখ কপালে তুলে। লোকটা অসুস্থ মনে হচ্ছে?

অসুস্থ? কী বলছেন অসুস্থ? কটমট করে চাইল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানার দিকে। ওর ঘাড়টা দেখে বুঝতে পারছেন না? মারা গেছে।

সত্যিই তো! খোদা! ঠিকই বলেছেন মনে হচ্ছে। সামনে ঝুঁকে এসে ভাল করে দেখবার ভান করল রানা। লোকটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?

আপনার ফ্লোরের ওয়েটার ছিল ও। কথাটা বলতে বলতে চোখজোড়া ছোট হয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের। কিছু একটা যেন বুঝত্বে শুরু করেছে সে।

তাই বলুন, সোজা হয়ে দাঁডাল রানা। সেইজন্যেই চেনা চেনা লাগছিল। আহা, অল্প বয়সেই বেচারী দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। রেস্তোরাঁটা কোনদিকে?

আকাশ থেকে পড়ল নোকটা রানার নির্বিকার প্রশ্ন শুনে।

কি বললেন? রেস্তোরাঁ…

ঠিক আছে, আমিই খুঁজে নেব। হাত নেড়ে আশ্বস্ত করবার ভঙ্গিতে বলল রানা। বুঝতে পারছি, খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন আপনি।

.

হোটেল কার্লটনের রেস্তোরাঁর খ্যাতি শুনেছে রানা আগেই, আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে স্বীকার করে নিল, এখানকার বাবুর্চির রান্নার তুলনা হয় না। ক্যাভিয়ার থেকে শুরু করে অসময়ের তাজা স্ট্রবেরী পর্যন্ত নিখুঁত, অপূর্ব। সোহানা আর মারিয়ার কথা একবার মনে হলো ওর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে গিয়ে। সামান্য একটু হাসির আভাস খেলে গেল ওর ঠোঁটে। নরম সোফায় হেলান দিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসটা তুলল সে ওপর দিকে, হাসিমুখে বলল, অ্যামস্টার্ডাম!

অ্যামস্টার্ডাম! বলল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। সিটি পুলিসের ডেপুটি হেড কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড মিনিট পাঁচেক হলো বিনা আমন্ত্রণেই এসে যোগ দিয়েছে রানার সঙ্গে। রানার সামনে একটা বড়সড় চেয়ারে বসেছে লোকটা, কিন্তু বসার পর মনে হচ্ছে চেয়ারটা ছোট। ভদ্রলোকের দৈর্ঘ্য মাঝারি, কিন্তু প্রস্থ বিশাল। চুলগুলো লোহাটে সাদা, চোখেমুখে নিভকি একটা ভাব, সেইসঙ্গে রয়েছে একটা ক্ষমতার বিচ্ছুরণ–এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, কেবল উচ্চপদস্থ কর্মচারীই নয়, ভদ্রলোক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং যোগ্য। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, বেশ আমোদেই আছেন দেখছি, মেজর রানা? এতকিছু ঘটার পরও। ভাল, ভেরি গুড।

হেসে নাও, দুদিন বই তো নয়। কিন্তু…এতকিছু কি ঘটল?

রানার এই হালকা ভাবটা পাত্তা দিল না কর্নেল। ধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওই ইসমাইল আহমেদ সম্পর্কে কোন কিছুই জানা গেল না।

কোন ইসমাইল আহমেদ? শিফল এয়ারপোর্টে যে খুন হয়েছিল, সেই লোকটা?

হ্যাঁ। শুধু এইটুকু জানা গেছে–মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে এসেছিল লোকটা, উঠেছিল হোটেল স্কিলারে, কিন্তু এক রাত্রি ওখানে থাকার পর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আর কোন খোঁজ ছিল না। যতদূর মনে হয়, আপনি যে প্লেনে এসেছেন সেই প্লেনের কোন যাত্রীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়েছিল লোকটা শিফল এয়ারপোর্টে। একজন বাঙালী এয়ারপোর্টে গেল কাউকে রিসিভ করতে, খুন হয়ে গেল, দেখা যাচ্ছে সে প্লেনের একমাত্র বাঙালী যাত্রী পিছু ধাওয়া করছে খুনীর, অথচ নিহত লোকটার। সঙ্গে পরিচয় ছিল বলে স্বীকার করছে না-এসব থেকে আপনার কি মনে হয়?

আমার মনে হয় লোকটা আমার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিল শিফল. এয়ারপোর্টে, বলল রানা। কারণ আগে হোক আর পরে থোক, ইসমাইলের পরিচয় বের করে ফেলবে ডি গোল্ড। আমারই লোক।

আশ্চর্য ব্যাপার, বলল ডি গোল্ড মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, কিন্তু। একবিন্দুও অবাক হয়েছে বলে মনে হলো না তার চেহারা দেখে। দেখুন। মেজর রানা, এটা বড়ই অন্যায় কথা। আমার দেশে আপনার লোক অপারেট করবে, অথচ আমি তার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানব না…তাহলে কাজ চলবে কি করে?.আমাদের আগেই জানানো উচিত ছিল ওর কথা। এই যেমন আপনার। ব্যাপারে ইন্টারপোল থেকে ইনস্ট্রাকশন পেয়েছি আমরা, সব রকমে আপনাকে সাহায্য করবার অনুরোধ জানানো হয়েছে আমাদের। আপনার কি মনে হয় না, এই রকম পারম্পরিক সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে কাজ করলে আমাদের সবার জন্যেই মঙ্গল হয়? সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন, তাই না? ব্র্যান্ডির। গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিল ডি গোল্ড। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চাইল রানার চোখে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, জরুরী কোন তথ্য ছিল এই লোকটার কাছে গেল এখন সব। অথচ আমাদের যদি অ্যালার্ট করা হত, ব্যাপারটা নাও ঘটতে পারত।

হয়তো। বলল রানা। ঠিক আছে, আপনার তরফ থেকে আমাকে খানিকটা সাহায্যের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা শুরু করা যেতে পারে। আপনাদের ফাইলটা একটু দেখে আমাকে জানাতে পারবেন মিস বিট্রিক্স শেরম্যানের নামে কিছু এন্ট্রি আছে কিনা? মহিলা একটা নাইট-ক্লাবে কাজ করে।

এয়ারপোর্টে যাকে ধাক্কা মেরেছিলেন? কি করে জানলেন ও নাইট-ক্লাবে কাজ করে?

ও নিজেই বলেছে আমাকে। চোখের পলক না ফেলে ঝাড়া মিথ্যে কথা বলল রানা।

ভ্রূ কুঁচকাল ডি গোল্ড। কিন্তু এয়ারপোর্ট অফিশিয়ালরা তো এই ধরনের কোন মন্তব্য করেনি তাদের রিপোর্টে?

ওদের এফিশিয়েনসি লেভেল খুব একটা উঁচু বলে মনে হয়নি আমার কাছে।

ঠিক বলেছেন। কথাটা পছন্দ হয়েছে কর্নেলের। যাই হোক, এ খবরটা বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আপনার আর কোন তথ্য দরকার?

না। আপাতত এই। ধন্যবাদ।

আর একটা ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করলাম না আমাদের দুজনের কেউই।

বলুন। কোন ঘটনা?

সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের কথাটা। দুধে ধোয়া লোক নয়–বেশ। কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে ওর আমাদের সঙ্গে, আমাদের ফাইলের দুটো পৃষ্ঠা জুড়ে ওর নানান কীর্তিকলাপের বর্ণনা রয়েছে। এই লোকটাও আপনার। নিজস্ব লোক নয়তো?

বলেন কী, কর্নেল। আকাশ থেকে পড়ল রানা।

না, না। আমি একবারও ভাবিনি ও আপনার লোক। বরং ভেবেছি ও আপনার বিরুদ্ধ পক্ষের লোক হওয়া সম্ভব। জানেন, ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়েছে লোকটাকে?

তাই নাকি? বেকায়দা পড়ে গিয়েও ঘটতে পারে ব্যাপারটা। সত্যিই, খুবই দুঃখজনক।

ব্র্যান্ডির গ্লাসটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল কর্নেল।

আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার কোনদিন, হয়নি, মেজর রানা। কিন্তু আপনার কর্মপদ্ধতির অনেক খবরই আমরা রাখি। কয়েক হাত ঘুরে হলেও আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই এসেছে আমাদের ফাইলে। এই সুযোগে আপনাকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেব পালারমো, মার্সেই বা ইস্তামবুলে যে রীতি, চলে, অ্যামস্টার্ডামে সেটা প্রয়োগ করতে যাওয়া ভুল হবে।

আমার সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন দেখছি।

সেজন্যেই সাবধান করা দরকার বলে বোধ করছি। অ্যামস্টার্ডামে আমাদের সবাইকে আইনের আওতার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। আমাকেও। আপনিও এর রাইরে নন। সরাসরি চাইল আবার সে রানার দিকে। এখানে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না আপনি।

তা তো বটেই। আমি সাবধান থাকতে চেষ্টা করব। পারস্পরিক সহযোগিতার কথাটাও মনে রাখব। এবার যে কারণে আমার এখানে আসা। কখন, কোথায় আলোচনায় বসা যায়?

কাল সকাল দশটায়। আমার অফিসে। নিরুৎসুক দৃষ্টি বুলাল কর্নেল রেস্তোরাঁর চারপাশে। এটা আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। রানাকে জ্বজোড়া উঁচু করতে দেখে বলল, গোপন আলোচনা আড়ি পেতে শোনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে হোটেল কার্লটনের।

অবাক করলেন। মুচকে হাসল রানা।

ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, হাসিটা আর একটু বিস্তৃত হলো রানার। ভাবল–তাই যদি না হবে, তাহলে আর এই হোটেল বাছাই করলাম কেন? কর্নেল কি ভেবেছে না জেনেই ভুল করে ঢুকে পড়েছি। আমি বাঘের গর্তে?

.

০৪.

কর্নেল ডি গোল্ড বসে আছে টেবিলের ওপাশে নিজের সীট ভর্তি করে, এপাশে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রানা। মস্ত বড় ঘরটা, অফিসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ছিমছাম আমি কায়দায় সাজানো–আরাম আয়েশের কোন বন্দোবস্ত নেই। আসবাব বেশির ভাগই স্টীলের। দেয়ালের গায়ে একসারি ফাঁইলিং ক্যাবিনেট, স্টীলের টেবিলের ওপাশে গোটা কয়েক স্টীলের আলমারি। সমস্ত ঘরেই একটা কাজ কাজু ভাব। চেয়ারগুলোও বোধহয়, কর্নেলের ইচ্ছে ছিল স্টীল। দিয়ে তৈরি করবার, কিন্তু এখানে অনেক ধরনের বিশিষ্ট লোকের আগমন হয়। বলে ততদূর যেতে পারেনি–তবে চেয়ারের সীটগুলো এমনই শক্ত করে বানানো হয়েছে, যে স্টীলকেও হার মানায়। কেউ যে এখানে আরাম করে বসে। দুটো সুখ দুঃখের কথা বলবে তার উপায় নেই, কাজের কথা সেরেই বাধ্য, হয়ে উঠে পড়তে হবে চেয়ার ছেড়ে।

রানার সুবিধের জন্যেই অল্প দুচার কথার পরই কাজের কথায় চলে এল কর্নেল।

সব ধরনের ড্রাগের ব্যাপারেই আমরা আগ্রহী-ওপিয়াম, ক্যানাবিস, অ্যামফিটামিন, এল, এস ডি, এস টি পি, কোকেন, অ্যামিল অ্যাসিটেট, সব। এদের প্রত্যেকটাই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। হয় ধ্বংস করে, নয়তো মানুষকে টেনে। নিয়ে যায় ধ্বংসের মুখে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাজের সুবিধের জন্যে আপাতত এদের মধ্যে ভয়ঙ্করতম যেটা, সেই হেরোইনের ব্যাপারেই আমরা আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। রাজি?

রাজি। গভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার কাছ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে না দেখল একহারা লম্বা, সুপুরুষ চেহারার এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজার গোড়ায়, পরনে চমৎকার কাটের স্যুট; বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যে, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ, মুখে একটা অমায়িক ভাব, কিন্তু বোঝা যায় পান থেকে চুন খসলেই মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে এই লোক অধঃস্তন কর্মচারীর ওপর। হ্যাঁ এক নজরেই চেনা যায় কোন পেশায়। রয়েছে লোকটা-পুলিস। শুধু পুলিস নয়, দায়িত্বপূর্ণ পদের পুলিস।

দরজা বন্ধ করে হাসিমুখে এগিয়ে এল লোকটা, হাত বাড়াল সামনের দিকে। আমি ভ্যান ডি মাগেনথেলার। আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি, মেজর মাসুদ রানা।

কথাটা পছন্দ হলো না রানার। কোথায় ওর সম্পর্কে কি শুনেছে জানবার আগ্রহ হলো, কিন্তু আপাতত কোন মন্তব্য না করাই স্থির করে হাসল, ঝাঁকিয়ে দিল মাগেনথেলারের বাড়িয়ে ধরা হাতটা।

আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেল। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। হচ্ছেন আমাদের এখানকার নারকোটিক ব্যুরোর হেড। আপনার কাজে সব রকম সাহায্য করবেন ইনি। আপনার যখন যা প্রয়োজন, শুধু মুখে উচ্চারণ করবেন, প্রয়োজন হলে সাগর সেঁচে মুক্তো তুলে আনবে মাগেনথেলার আপনার জন্যে।

সত্যিই সুখী হব, বলল মাগেনথেলার, যদি আমরা দুজন মিলে কিছু একটা কিনারা করতে পারি। চেয়ারে বসে রানার দিকে ঝুঁকে এল। আমরা জানি, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে এসেছেন আপনি আসলে। যদিও ফিলিপ কার্টারেটের ছত্রছায়ায় এসেছেন আপনি এখানে, আমরা ধরে নিচ্ছি আপনার আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ট্রাফিক বন্ধ করা। কাজেই। একেবারে গোড়া থেকে আমাদের আলোচনা শুরু হলেই সব দিক থেকে মঙ্গল। শোনা যাক, বাংলাদেশে ঠিক কতটা অগ্রসর হয়েছেন আপনারা। সাপ্লাই রিঙ ব্রেক করবার পর্যায়ে পৌঁছেছেন?

বেশ কয়েক মাস আগেই। বলল রানা। ট্রাফিক চ্যানেল সম্পর্কে মোটামুটি জানা আছে আমাদের, অত্যন্ত সংঘবদ্ধ একটা ডিসট্রিবিউশন পাইপ লাইনেরও সন্ধান পেয়েছি।

কোনদিকে ইন্টারেস্ট আপনাদের ট্রাফিক চ্যানেল নাকি ডিসট্রিবিউশন পাইপ লাইন?

সত্যি কথা বলতে কি, বার্মা, ভারত আর নেপাল থেকে কিভাবে, কাদের মাধ্যমে বিরাট সব কনসাইনমেন্ট চালান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে সেটা আমরা জানি–অর্থাৎ, ট্রাফিক চ্যানেল আমাদের সমস্যা নয়। আমরা জানি এই মাল কোথায় যাচ্ছে। আমরা জানি ফিনিশড গুড হিসেবে এই মালের বিরাট এক অংশ আবার ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশে। যারা ডিসট্রিবিউট করছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের গতিবিধি আমাদের নখদর্পণে। অনেক কিছুই জানা আছে, কিন্তু আমরা যেটা জানি না সেটা হচ্ছে বাইরে থেকে কোন পথে, কিভাবে ঢুকছে ফিনিশড় গুড় আমাদের দেশে; জানি না, কে বা কারা কলকাঠি নাড়ছে গোটা ব্যবসাটার মাথায় বসে।

আপনি বলতে চান বাংলাদেশ হয়ে যে কাঁচামাল বাইরে যাচ্ছে সে ব্যাপারে আপনারা পূর্ণ ওয়াকিফহাল? অবাক হলো ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। এমন কি ফিনিশড গুড যারা ডিসট্রিবিউট এবং বিক্রি করছে তাদেরও কারও কারও গতিবিধি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে আপনাদের? তাই যদি হয়। তাহলে চুপচাপ বসে আঙুল চুষছেন কেন? টপাটপ সবটাকে ধরে ফেললেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না?

মাথা নাড়ল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, তাতে কি লাভ হবে, ইন্সপেক্টর? আমরা একটা রিঙ ব্রেক করব, একটা মাস অচল হয়ে যাবে ওদের সবকিছু, কিন্তু একমাসের মধ্যেই আরও আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও সাবধানে চালু হয়ে যাবে আরেকটা রিঙযাদের খুঁজে বের করা আরও মুশকিল হবে। আমরা যতবার ভাঙব, ততবারই ওরা আরও নিত্য নতুন কৌশলের আশ্রয় নেবে। আমরা গোড়াটা ধ্বংস করতে চাই। শুধু কিভাবে পাঠানো হচ্ছে। আমার দেশে হেরোইন সেটা জানলেই চলবে না, আমরা জানতে চাই কে পাঠাচ্ছে ওসব।

আপনার অনুমান–অবশ্য তা নইলে এখানে এসে হাজির হতেন না আপনি যে হেরোইনের সাপ্লাইটা যাচ্ছে এখান থেকে, কিংবা আশেপাশেরই কোন জায়গা থেকে?

আশেপাশের কোন জায়গা থেকে নয়। যাচ্ছে এখান থেকেই। আর এটা অনুমান নয়। আমার ধারণা। আমি জানি। আমরা যাদের গতিবিধির ওপর নজর রেখেছি, তাদের শতকরা নব্বই ভাগেরই যোগাযোগ রয়েছে এদেশের সঙ্গে আরও স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, অ্যামস্টার্ডামের সঙ্গে। নব্বই ভাগই তাই। এখানে হয় আত্মীয়স্বজন আছে, নয়তো বন্ধুবান্ধব আছে; হয়। বিজনেস কন্ট্যাক্ট আছে, নয়তো নিজেদের ব্যবসা আছে, অথবা ছুটি কাটাতে। আসে এখানে প্রায়ই। গত একটা বছর ধরে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তৈরি করেছি। আমরা ওদের ডোশিয়ে।

অর্থাৎ, আপনারা সেন্ট পার্সেন্ট শিওর? জিজ্ঞেস করল কর্নেল।

ফাইভ হানড্রেড পার্সেন্ট।

মাগেনথেলার জিজ্ঞেস করল, ওই ডোশিয়ের কপি আছে?

আছে। একটা।

আপনার কাছে?

 হ্যাঁ।

 আপনার সঙ্গেই আছে?

হ্যাঁ। অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায়। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে দেখাল। রানা।

খুবই নিরাপদ জায়গা, সন্দেহ নেই, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। মাথা আঁকাল। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার এমন লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে যে কিনা আপনারই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানে অভ্যন্ত।

আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কর্নেল।

জটিল ধাঁধা আর রূপকে কথা বলা আমার একটা বদভ্যাস, অমায়িক ভঙ্গিতে বলল কর্নেল, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠিক আছে, স্বীকার করে নিচ্ছি। সবদিক থেকে আঙুল দেখাচ্ছে সবাই এখন নেদারল্যান্ডের দিকে। আমাদের এই দুর্নামের কথা আমরা যে জানি না তা নয়। আমরাও জানি। এই দোষারোপ যদি অসত্য হত, সূখী হতাম। কিন্তু আমরা জানি, বিরাট সব। কনসাইনমেন্ট আসছে বার্মা, ভারত, নেপাল আর টার্কি থেকে। আমরা জানি, পপি রূপান্তরিত হচ্ছে হেরোইনে আমাদের এখানেই; জানি, এখান থেকে। আবার ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়াময়–শুধু জানি না কোথায়, কিভাবে কি হচ্ছে।

অথচ এটা আপনাদের এলাকা। নরম গলায় বলল রানা।

অর্থাৎ?

আইন রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর।

এই দোষারোপের সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই, মেজর মাসুদ রানা। জ্ব কুঁচকে বলল মাগেনথেলার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যে আমরা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারছি না সেটাও বহুবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমাদের বহু দেশ। কিন্তু দোষারোপ করে কি বন্ধুত্ব অর্জন সম্ভব?

আমি এখানে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে আসিনি, ইন্সপেক্টর। ইন্টারপোল। থেকে দায়িত্ব নিয়ে এসেছি কাজে।

ঠিক বলেছেন, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। আপনার কাজটা হচ্ছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করছে তাদের ধ্বংস করা। আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি আমরা। আপনার সম্পর্কে চমৎকার একটা ভোশিয়ে রয়েছে আমাদের কাছে। দেখতে চান?

অতীত ইতিহাস ঘাটতে আমার ভাল লাগে না।

সেটাই স্বাভাবিক। ঘন ঘন মাথা দোলাল কর্নেল। তবে একটা কথা আপনাকে আমি বলব, মেজর রানা। পৃথিবীর সেরা পুলিস ফোর্সও কোন না কোন সময় দুর্লংঘ প্রাচীরের সম্মুখীন হতে পারে। আমরা শ্রেষ্ঠ-সে দাবি করছি না, কিন্তু তেমনি বাধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। শুধু একটা লীড দিন। আমাদের, সামান্য একটা ছিদ্র দেখিয়ে দিন; তারপর দেখুন আমাদের ক্ষমতা। হয়তো এ ব্যাপারে সাহায্য করবার মত কোন প্ল্যান বা তথ্য রয়েছে আপনার। হাতে?

এত তাড়াতাড়িই? হাসল রানা। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের কাছে। পাওয়া স্ক্র্যাপ প্যাডের পাতাটা বের করে এগিয়ে ধরল কর্নেলের দিকে। মাত্র গতকাল বিকেলে পৌঁছেচি আমি এখানে এসে। আচ্ছা, দেখুন তো, এই অক্ষর আর নম্বরগুলোর কোন অর্থ আপনার মাথায় খেলে কিনা?

কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে কটমট করে চাইল কর্নেল ওটার দিকে, যেন ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে নম্বরগুলোকে; উজ্জ্বল ডেস্কল্যাম্পের আলোর নিচে উল্টেপাল্টে দেখল কাগজটা, তারপর নামিয়ে রেখে মাথা নাড়ল। নাহ।

সত্যিই কোন মানে আছে কিনা বের করার ব্যবস্থা করতে পারেন?

তা পারা যায়। এসব ব্যাপারে যোগ্য লোক আছে আমাদের। আগামী কাল জানাতে পারব আপনাকে। যাই হোক, কোথায় পেলেন এটা?

একজন দিয়েছে।

তার মানে কারও কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন আপনি এটা।

দুটো কথায় তফাৎ আছে?

অবস্থা বিশেষে আকাশ পাতাল তফাৎ হতে পারে, মেজর রানা। ডেস্কের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড বক্তব্যের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে। শুনুন মেজর রানা, আমরা আপনার টেকনিকের কথা জানি। আমরা জানি, মানুষকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলে কাজ উদ্ধার করেন; জানি, প্রয়োজন মনে করলে আইনের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে আপনার বাধে না…

এসব কী বলছেন, কর্নেল।

 যা বলছি, জেনেশুনেই বলছি। আমরা জানি, আপনার এই মেথডে অনেক দ্রুত কাজ হতে পারে, কিন্তু এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। প্রতিপক্ষকে চরম ভাবে উত্যক্ত করলে, তাকে একের পর এক অসুবিধেয় ফেললে, প্রোতভাকেট করলে, শো-ডাউনটা এগিয়ে আসে কয়েক ধাপ সামনে, তা ঠিক; কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ, মেজর রানা, দয়া করে এখানে বেশি লোককে প্রোভোকেট করতে যাবেন না। রিপিট করছি–এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। অ্যামস্টার্ডামে খালের সংখ্যা অনেক।

 ঠিক আছে, কর্নেল। কাউকে প্রোডোক করব না। সাবধানে থাকব। যতদূর সম্ভব।

দ্যাটস গুড। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল কর্নেল। এবার মাগেনথেলার হয়তো আপনাকে খানিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু দেখাতে চাইবে।

বেশ অনেক কিছুই দেখাবার রয়েছে মাগেনথেলারের, বোঝা গেল। মানিক্সস্ট্রাটের পুলিস হেডকোয়ার্টার থেকে, মাগেনথেলারের কালো ওপেলে। চড়ে সিটি মরচুয়ারীতে পৌঁছল রানা। বিশাল এক ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল অ্যাটেনড্যান্ট আর ইন্সপেক্টরের পিছু পিছু। ঘরের মাঝখানে লাইন দিয়ে সাজানো রয়েছে দুই সারি সাদা স্ল্যাব, দুটো মাত্র খালি-বাদবাকি সবকটার। ওপর সাদা কাপড় ঢাকা লাশ শুয়ে আছে টান টান হয়ে। চারপাশের দেয়াল। জুড়ে ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের মত অসংখ্য স্টীলের ড্রয়ার। রানা জানে, এইসব। ড্রয়ারের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লাশ, রেফ্রিজারেটেড। ডিজিনফেক ট্যান্টের তীব্র গন্ধে নাক কুঁচকাল সে। ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে দেয়ালের গায়ের একটা স্ল্যাব টেনে বের করল অ্যাটেন্যান্ট ক্যাচ সরিয়ে। সাদা কাপড়ে ঢাকা রয়েছে লাশটা আপাদমস্তক।

ক্রোকুইস্কেড ক্যানেলে পাওয়া গেছে এটা, বলল মাগেনখেলার চেষ্টাকৃত নিরুত্তাপ কণ্ঠে। হ্যাঁন্স গার্বার। বয়স উনিশ। না দেখাই ভাল, বেশ। কয়েকদিন পানিতে ছিল বলে ওটা আর দেখার যোগ্য নেই। তবে হাতটী। দেখতে পারেন।

 চাদরটা সামান্য উঁচু করতেই একটা ফোলা হাত দেখতে পেল রানা। মনে হচ্ছে কেউ যেন মোরব্বার মত কেচেছে হাতটা কাটাচামচ দিয়ে, কিংবা স্পাইক লাগানো জুতো পায়ে আচ্ছামত মাড়িয়েছে ওটাকে। লাল, নীল, সবুজ-নানান রঙ দেখা যাচ্ছে ক্ষতচিহ্নগুলোর আশে পাশে। কোন মন্তব্য না; করেই হাতটা ঢেকে দিয়ে পিছন ফিরল মাগেনথেলার। হড়হড় করে ঢুকিয়ে। দিল অ্যাটেনড্যান্ট স্ল্যাবটা।

খানিক বাঁয়ে সরে আর এক সারি স্ল্যাবের সামনে দাঁড়াল মাগেনথেলার। বলল, এরও মুখটা দেখাতে চাই না আমি আপনাকে। একশ বছরের এক তরুণের মুখ যদি সত্তর বছরের বুড়োর মত দেখতে হয়, সেদিকে তাকানো যায় না। অ্যাটেনড্যান্টের দিকে ফিরল। তেষটি নম্বরটা খোলো। কোথায় পাওয়া গিয়েছিল এটাকে?

উস্টারহুকে। একটা কয়লার বার্জে। ক্যাচ সরিয়ে হ্যাঁচকা টান দিল লোকটা হ্যাঁনডেল ধরে।

মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার। ঠিক। সঙ্গে বোতল ছিল একটা। খালি বোতল। জিনের। আধ বোতল জিন পাওয়া গিয়েছিল ওর পেটে। হেরোইনের। সঙ্গে জিনের সম্পর্কটা জানা আছে আপনার? রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে সাদা কাপড় সরিয়ে এরও হাতটা দেখাল সে কয়েক সেকেন্ড। দার্শনিক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, হত্যা-না আত্মহত্যা?

একটু খোঁজ নিলে হয়তো বের করতে পারতেন আসল ব্যাপারটা।

কিভাবে? বোতলটা কার কেনা সে খবর সংগ্রহ করে?

হ্যাঁ। ওর নিজের কেনা হলে এটা হবে হয় আত্মহত্যা, নয়তো দুর্ঘটনা। কেউ যদি আধ বোতল জিন ওর হাতে তুলে দিয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা হত্যা। ঠিক এই ধরনের একটা কেস হয়েছিল মাস ছয়েক আগে আমাদের বাংলাদেশে চট্টগ্রামে। তিনদিনের মধ্যে অ্যারেস্ট করেছিল পুলিস। খুনীকে।

আমরাও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বোতলে কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি••এমন কি এই ছেলেটিরও না। ব্যাচ নাম্বার মিলিয়ে যে খোঁজ করব, তারও উপায় ছিল না। লেবেলই ছিল না বোতলে।

এবার ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চলে এল ওরা। মার্বেল পাথরের মত দেখতে একটা সাদা স্ল্যাবের ধারে দাঁড়িয়ে মুখের কাপড় সরাল এবার মাগেনথেলার একটা লাশের। অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে মনে হচ্ছে ঠিক ঘুমিয়ে আছে। একগোছা সোনালী চুল লেপটে আছে চিবুকের কাছে।

সুন্দর না? জিজ্ঞেস করল মাগেনথেলার। ওর কণ্ঠস্বরে শীতল একটা উন্মা টের পেল রানা। একটী রেখা নেই, নিপাপ, পবিত্র মুখটা। রোজমেরী ডুনিং। আমেরিকান। বয়স–ষোলো। আর কিছুই জানা যায়নি এর সম্পর্কে।

কি হয়েছিল?

সাততলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল নিচে ফুটপাথের ওপর।

চট করে হোটেলের ফ্লোর ওয়েটারের কথা মনে পড়ে গেল রানার। হয়তো ওকেও পাওয়া যাবে এই মরচুয়ারীর কোন না কোন স্ল্যাবের ওপর। জিজ্ঞেস করল, নিজেই, নাকি ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করেছিল কেউ?,

নিজেই। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হচ্ছে হিপ্লিদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল মেয়েটা, বাডির জন্যে মন টেনেছিল, হঠাৎ ছাতের প্যারাপেটের। ওপর লাফিয়ে উঠে উড়ে চলে যেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে। ভাগ্যিস ফুটপাথের ওপর তখন আর কেউ ছিল না। আরও দেখবেন কয়েকটা? কাল। রাতে কার্লটন হোটেলে মারা পড়েছে একটা জাংকি দেখবেন ওটাকে?

যথেষ্ট হয়েছে, বলল রানা। এসব আমার কাছে নতুন নয়। এই একই দৃশ্য দেখে এসেছি আমি ঢাকার মর্গে। তারচেয়ে কোথাও বসে একটোক বাভি খাওয়া যাক বরং•• কি বলেন?

ঠিক বলেছেন। এসব দেখার চেয়ে ব্র্যান্ডি অনেক ভাল। হাসল। মাগেনুথেলার, কিন্তু সে হাসিতে রসকষ নেই-নিপ্রাণ, নিষ্প্রভ। আমার বাসায় চলুন। বেশি দূরে না। আপনাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার আরও একটা কারণ আছে।

 কারণ?

চলুন, দেখবেন।

 বাইরে বেরিয়ে রানা দেখল, আঁধার হয়ে এসেছে আকাশটা আজ সকাল সকালই। পুবদিকটা ধূসর মত দেখা যাচ্ছে। খানিক বাদেই বৃষ্টি নামবে বড় বড় ফোঁটায়। সারা আকাশ জুড়ে মলিন বিষণ্ণতা। মনে মনে ভাবল সে, বহুদিন পর মনের ভাবের সঙ্গে প্রকৃতির মিল পাওয়া গেল। ভারাক্রান্ত মনে কালো ওপেলে গিয়ে উঠল সে মাগেনথেলারের পিছু পিছু।

« পূর্ববর্তী:
« ১.১-২ বিশাল ডানা মেলে
পরবর্তী: »
১.৫-৬ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরুমে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ

Return to top