১.০৬ মহাপুরুষ

মহাপুরুষ

পাঠক! পাঠশালা যমালয় হতেও ভয়ানক—পণ্ডিত ও মাষ্টারকে যেন বাঘ বিবেচনা হচ্ছে। একদিন আমরা স্কুলে একটার সময়ে ঘোড়াঘোড়া খেলচি, এমন সময়ে আমাদের জলতোলা বুড়ো মালী বলে যে, “ভূকৈলেসে রাজাদের বাড়ী একজন মহাপুরুষ এসেছেন, মহাপুরুষ সত্যযুগের মানুষ, গায়ে বড় বড় আশেীদগাছ ও উইয়ের ঢিপি হয়ে গিয়েছে—“চোক বুজে ধ্যান কচ্চেন, ধ্যান ভঙ্গ হয়ে চক্ষু খুলেই সমুদয় ভস্ম করে দেবেন।” শুনে আমাদের বড় ভয় হলো। স্কুলে ছুটি হলে আমরা বাড়ীতে এসেও মহাপুরুষের বিষয় ভাবতে লাগলেম; লাট্টু, ঘুড্ডী, ক্রিকেট, পায়রা পড়ে রইলো—মহাপুরুষ দেখবার ইচ্ছা ক্রমে বলবর্তী হয়ে উঠলো; শেষে আমরা ঠাকুরমার কাছে গেলুম।

আমাদের বুড়ো ঠাকুরমা রোজ রাত্রে শোবার সময় ‘বেঙ্গমা-বেঙ্গুমী’ ‘পায়রা রাজা’ ‘রাজপুত্তর, পাত্তরের পুত্তুর, সওদাগরের পুওর ও কোটালের পুত্তর চার বন্ধু ‘তালপত্তরের খাড়া জাগে ও পক্ষিরাজ ঘোড়া জাগে’ ও ‘সোণার কাটী রূপার কাটী’ প্রভৃতি কত রকম উপকথা কইতেন। কবিকঙ্কণ ও কাশীদাসের পয়ার মুখস্থ আওড়াতে—আমরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তুম।–হায়, বাল্যকালের সে সুখসময় মরণকালেও স্মরণ থাকবে-–অপরিচিত সংসার—হৃদয়কমল কুসুম হতেও কোমল বোধ হতো, কলেরই বিশ্বাস ছিল, ভূত, পেৎনী ও ঠাকুর দেবতার নামে শরীর লোমাঞ্চ হতো—হৃদয় অনুতাপ ও শোকের নামও জানতো না—অমর বর পেলেও সেই সুকুমার অবস্থা অতিক্রম কত্তে ইচ্ছা হয় না।

শোবার সময়ে ঠাকুরমাকে সেই মালীর মহাপুরুষের কথা বল্লেম—ঠাকুরমা শুনে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন ও একজন চাকরকে রদিন সকালে মহাপুরুষের পায়ের ধূলো আনতে বলে দিয়ে, মহাপুরুষের বিষয়ে আরও দু-একঃগর কল্লেন।

ঠাকুরমা বললেন–বছর আশী হলে (ঠাকুরমার তখন নতুন বিয়ে হয়েচে) আমাদের বারাণসী ঘোষ কাশী যাবার সময়ে পথে জঙ্গলের ভিতর ঐ রকম এক মহাপুরুষ দেখেন। সেই মহাপুরুষও ঐ রকম অচৈতন্য হয়ে ধ্যানে ছিলেন। মাঝিরে ধরাধরি করে নৌকায় তুলে আনে। বারাণসী তাকে বড় যত্ন করে নৌকায় রাখলেন। তখন ছাপঘাটীর মোহনায় জল থাকতো না বলে, কাশীযাত্রীরে বাদাবনের ভিতর দিয়ে যেতেন আসতেন; সুতরাং বারাণসীকেও বাদ দিয়ে যেতে হলো। এক দিন বাদাবনের ভিতর দিয়ে গুণ টেনে নৌকা যাচ্ছে, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে, এমন সময়ে ঠিক ঐ রকম আর একজন মহাপুরুষ নৌকার গলুয়ের কাছে বসে ধ্যানে ছিলেন, এরি মধ্যে ডাঙ্গার মহাপুরুষও হাসতে হাসতে নৌকার উপর এসে নৌকার মহাপুরুষের হাত ধরে নিয়ে জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা হাঁ করে রইলো! বারাণসী বাদাবন তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু আর মহাপুরুষদের দেখতে পেলেন না, এরা সব সেকালের মুনিঋষি, কেউ হাজার বৎসর তপিস্যে কচ্চেন, এঁরা মনে কলে সব কত্তে পারেন!

আর একবার ঝিলিপুরের দত্তরা সোঁদরবন আবাদ কত্তে কত্তে ত্রিশ হাত মাটীর ভিতরে এক মহাপুরুষ দেখেছিল। তার গায়ে বড় বড় অশোদগাছের শেকড় জন্মে গিয়েছিল। আর শরীর শুকিয়ে চেলাকাঠের মত হয়েছিল। দত্তরা অনেক পরিশ্রম করে তারে ঝিলিপুরে আনে, মহাপুরুষও প্রায় এক মাস ঝিলিপুরে থাকেন, শেষে একদিন রাত্তিরে তিনি যে কোথায় চলে গেলেন, কেউ তার ঠিকানা কত্তে পাল্পে না!–শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

তার পরদিন সকালে রামা চাকর মহাপুরুষের পায়ের ধুলো এনে উপস্থিত কল্লে; ঠাকুরমা একটি জয়ঢাকের মত মাদুলিতে সেই ধুলো পুরে, আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন, সুতরাং সেই দিন থেকে আমরা ভূত, পেৎনী, শাঁকচুন্নী ও ব্রহ্মদত্তির হাত থেকে কথঞ্চিৎ নিস্তার পেলেম।

ক্রমে আমরা পাঠশালা ছাড়লেম–কলেজে ভর্ত্তি হলেম–সহাধ্যায়ী দু-চার সমকক্ষ বড়মানুষের ছেলের সঙ্গে আলাপ হলো। একদিন আমরা একটার সময়ে গোলদীঘির মাঠে ফড়িং ধরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় আমাদের কেলাসের পণ্ডিত মহাশয় সেই দিকে বেড়াতে এলেন। পণ্ডিত মহাশয় প্রথমে বড়মানুষের বাড়ীর রাঁধুনী বামুন ছিলেন, এডুকেশন কৌন্সেলের সুক্ষ্ম বিবেচনায়, সেন বাবুর সুপারিসে ও প্রিন্সিপালের কৃপায় পণ্ডিত হয়ে পড়েন। পণ্ডিত মহাশয় পান খেতে বড় ভালবাসতেন, সুতরাং সকলেই তাকে যথাসাধ্য পান দিয়ে তুষ্ট কত্তে ক্রটি কত্তো না; পণ্ডিত মহাশয় মাঠে আসবামাত্র ছেলেরা পান দিতে আরম্ভ কল্লে; আমরাও এক দোনা মিঠে খিলি উপহার দিলেম। পণ্ডিত মহাশয় মিঠে খিলি পছন্দ কত্তে; পান খেয়ে আমাদের নাম ধরে বলেন, “আরে হুতোম! আর শুনচো? ভূকৈলেসের রাজাদের বাড়ী যে একটা মহাপুরুষ ধরে এনেছিলো, ডাক্তার সাহেব তার ধ্যান ভঙ্গ করে দিয়েছেন;–প্রথমে রাজারা তার পায়ে গুল পুরিয়ে দেন, জলে ডুবিয়ে রাখেন, কিছুতেই ধ্যানভঙ্গ হয় নাই। শেষে ডাক্তার সাহেব এক আরক নিয়ে তার নাকের গোড়ায় ধল্লে তার চেতন হলো; এখন সেই মহাপুরুষ লোকের গলা টিপে পয়সা নিচ্ছে, রাজাদের পাখা টেনে বাতাস কচ্চে, যা পাচ্ছে, তাই খাচ্ছে, তার মহাপুরুষত্ব-ভুর ভেঙ্গে গেছে।”

পণ্ডিত মহাশয়ের কথা শুনে আমরা তাক্‌ হয়ে পড়লেম, মহাপুরুষের উপর যে ভক্তিটুকু ছিল— মরিচবিহীন কর্পূরের মত–পরহীন ইথরের মত একেবারে উবে গেল। ঠাকুরমার মাদুলিটি তার পর দিনই খুলে ফ্যালা হলো; ভূত, শাঁকচুন্নী পেৎনীদের ভয় আবার বেড়ে উঠলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *