১. প্লেটোর মতবাদগুলোর উৎস

প্লেটোর ইউটোপিয়া অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

প্লেটোর মতবাদগুলোর উৎস

প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ও আধুনিক-সব দার্শনিকের মধ্যে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল অধিক প্রভাবশালী। আর এ দুজনের মধ্যে যার প্রভাব উত্তরকালীন বিভিন্ন যুগে সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন প্লেটো। দুটি কারণে এ কথা বলছি; এর একটি হলো অ্যারিস্টটল হলেন প্লেটোরফসল আর অন্যটি হলো এয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন যে কোনো বিবেচনায় যতটা অ্যারিস্টটলীয় ছিল, তার চেয়ে অধিক মাত্রায় ছিল প্লেটোনিক। সে জন্য প্লেটোকে এবং কিছু কম মাত্রায় অ্যারিস্টটলকে দার্শনিক চিন্তার ইতিহাসে তাদের পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের চেয়ে অধিকতর পূর্ণাঙ্গভাবে বিচার করা একান্ত প্রয়োজন।

প্লেটোর দর্শনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো-এক, তার ইউটোপিয়া, যা তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে সর্বপ্রথম, একেবারে শুরুর দিকের; দুই. তাঁর ভাবগুলোর তত্ত্ব (Theory Of Ideas), যা এখন অবধি সমাধান-না-হওয়া সার্বিকগুলোর (universals) সমস্যা মোকাবিলার একটা পথিকৃৎ প্রয়াস ছিল; তিন, অমরত্বের পক্ষে তার যুক্তিগুলো; চার, তাঁর সৃষ্টিতত্ত্ব; পাঁচপ্রত্যক্ষণ নয়, পূর্বস্মৃতি হিসেবে জ্ঞানের ধারণা। অবশ্য এ বিষয়গুলোর কোনো একটা নিয়ে বলার আগে আমি প্লেটোর জীবন-পরিবেশ এবং তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতামতগুলোর ওপরে যেসব প্রভাব পড়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলব।

প্লেটো পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের প্রথম দিকে, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮-৪২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিত্তবান অভিজাত ছিলেন, তিরিশ স্বৈরশাসকের শাসনের সঙ্গে যুক্ত নানা রকম লোকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। তিনি ভূমিকা রেখে থাকতে পারেন এথেন্সের যখন পতন ঘটে তখন তিনি যুবক এবং গণতন্ত্রের পরাজয়ে; তার সামাজিক অবস্থান ও পারিবারিক যোগসূত্র এমন ছিল যাতে তিনি গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। তিনি সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন, আর সক্রেটিস গণতন্ত্রের হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। সক্রেটিসের জন্য প্লেটোর ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবসা। তাই এটি বিস্ময়কর মনে হয় না যে তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রের আভাস দিতে স্পার্টার পক্ষ নেবেন। উদারপন্থী পরামর্শগুলোকে এমনভাবে অলংকৃত করার ক্ষমতা প্লেটোর ছিল যে পরবর্তী সময়কে তা ভুল পথে নিয়ে গেছে। প্লেটোর এই শৈল্পিক গুণের কারণেই তার রিপাবলিক প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু রিপাবলিকের প্রস্তাবগুলোতে আসলে কী ছিল সে ব্যাপারে প্রশংসাকারীরা কখনোই অবগত হয়নি। প্লেটোকে সর্বদাই ঠিকভাবে প্রশংসা করা হয়েছে কিন্তু তাকে উপলব্ধি করা হয়নি। বড় বড় মানুষের এই হলো সাধারণ নিয়তি। আমার উদ্দেশ্য বিপরীত। আমি তাকে বুঝতে চাই, অবশ্য তাকে একটু শ্ৰদ্ধার সাথেও দেখতে চাই, যেন তিনি সমকালীন একজন ইংরেজ বা আমেরিকান, যিনি স্বৈরশাসনের ওকালতি করছেন।

এমনটা অনুমান করা যায় যে, প্লেটোর ওপর বিশুদ্ধ দার্শনিক প্রভাবগুলোও এমন ছিল যে তিনি স্পার্টার পক্ষ নেবেন। এককথায় বলা যায়, এইসব প্রভাব ছিল-পিথাগোরাস, পারমিনাইডিস, হেরাক্লিটাস ও সক্রেটিসের প্রভাব। প্লেটো তার দর্শনে পিথাগোরাস থেকে (সক্রেটিসের মাধ্যমে, অথবা নয়) পেয়েছেন অর্ষিক উপাদানগুলো : ধর্মীয় প্রবণতা, অমরত্বে বিশ্বাস, পরজাগতিকতা, পুরোহিতের মেজাজ এবং সেই গুহাটির উপমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছু। তাছাড়া গণিতের প্রতি তার অনুরাগ এবং বুদ্ধি ও মরমিবাদে তার একান্ত মাখামাখি। পারমিনাইডিস থেকে তিনি পেয়েছেন এই বিশ্বাস যে, বাস্তবতা শাশ্বত ও সময়হীন এবং যৌক্তিক ভিত্তিতে সব পরিবর্তনই ভ্রমাত্মক। হেরাক্লিটাস থেকে তিনি পেয়েছেন এই নেতিবাচক মত যে, ইন্দ্রিয়জগতে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। এই মতের সঙ্গে পারমিনাইডিসের মত যুক্ত হয়ে এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে ইন্দ্রিয় থেকে জ্ঞান পাওয়া যায় না, বরং শুধু বুদ্ধির সাহায্যেই জ্ঞান অর্জিত হয়। এটা পরে বেশ ভালোভাবে সামাঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে পিথাগোরাসবাদের সঙ্গে। সক্রেটিসের কাছ থেকে তিনি সম্ভবত নৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে নিমগ্ন হবার এবং জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে যান্ত্রিক নয়, বরং উদ্দেশ্যবাদী (teleological) ব্যাখ্যা অন্বেষণের প্রবণতা পান। প্লেটোর চিন্তায় সক্রেটিস-পূর্বদের চেয়ে ভালোর চিন্তার প্রাধান্য বেশি এবং এর কারণ হিসেবে সক্রেটিসের প্রভাবকে দায়ী না করা বেশ কঠিন। এই সবকিছু রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত?

প্রথমত, ভালোত্ব এবং বাস্তবতা সময়হীন বলে সর্বোত্তম রাষ্ট্রটি হবে সে রকম একটি রাষ্ট্র, যা হবে স্বর্গীয় মডেলের সবচেয়ে কাছাকাছি অনুকরণ; সেখানে থাকবে একেবারেই ন্যূনতম পরিবর্তন এবং স্থির উৎকর্ষের সর্বোচ্চ মাত্রা এবং সে রাষ্ট্রের শাসকরা হবেন তারাই, যারা শাশ্বত ভালোকে বোঝেন সবচেয়ে ভালোভাবে।

দ্বিতীয়ত, সব মরমিবাদীর মতো প্লেটার বিশ্বাসগুলোর মধ্যে নিশ্চিতবোধের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে, যা একটি জীবনযাপন প্রণালি ছাড়া অপরকে জানাবার বা প্রদানের অযোগ্য, অনিবেদ্য। পিথাগোরাসবাদীরা দীক্ষাদানের একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং এটাই, গোড়াতে প্লেটোর আকাঙ্ক্ষা ছিল। একজন ভালো রাষ্ট্রনেতা হতে হলে একজন মানুষকে অবশ্যই ভালোকে জানতে হবে। এটা তিনি করতে পারেন শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শৃঙ্খলার সংযুক্তির দ্বারা। যারা এই রকম শৃঙ্খলার অভিজ্ঞতা লাভ করেনি তারা যদি শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে তারা অবধারিতভাবে শাসনকার্যকে কলুষিত করবে।

তৃতীয়ত, একজন ভালো শাসক তৈরি করতে প্লেটোর নীতিমালা বিষয়ে প্রচুর শিক্ষা-দীক্ষা প্রয়োজন। সিরাকুজের স্বৈরশাসক কনিষ্ঠ ডাইয়োনিসাসকে ভালো রাজা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাকে জ্যামিতি শিক্ষা দেয়ার ওপরে জোরারোপ আমাদের কাছে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্লেটোর দৃষ্টিকোণ থেকে তা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। এই অর্থে তিনি যথেষ্ট পিথাগোরাসবাদী ছিলেন যে, তিনি মনে করতেন গণিত ছাড়া প্রকৃত প্রজ্ঞা অসম্ভব। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয় এই দৃষ্টিভঙ্গি।

চতুর্থত, প্রজ্ঞার জন্য অবসর অপরিহার্য; অধিকাংশ গ্রিক দার্শনিকের মতো প্লেটো এই মত পোষণ করতেন। এ কারণেই যেসব লোক জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য, তাদের মধ্যে প্রজ্ঞা দেখা যায় না; যাদের জীবিকার স্বাধীন উপায় আছে বা রাষ্ট্র যাদের জীবনযাপনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছে, তাদের মধ্যেই শুধু প্রজ্ঞাবানদের দেখা মেলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত অভিজাততান্ত্রিক।

প্লেটোর বিরোধে আধুনিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে দুটি সাধারণ প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমটি হলো : প্রজ্ঞা বলতে কোনো জিনিস কি আছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো : সে রকম একটি জিনিস ধরে নেয়া হলো আছে, কিন্তু এমন কোনো সংবিধানের কথা কল্পনা করা যায় কি, যা সেই জিনিসটাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দেবে? যে অর্থে প্রজ্ঞা শব্দটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে তা এমন কোনো বিশেষ দক্ষতা নয়, যা একজন মুচি বা চিকিৎসক বা সামরিক কৃৎকৌশলীর আছে। তা এর চেয়ে অবশ্যই আমরা সাধারণীকৃত কিছু একটি, কেননা যিনি এই জিনিসের অধিকারী তিনি এর গুণেই বিচক্ষণতার সাথে শাসন করতে সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে। আমার মনে হয় প্লেটো এ ব্যাপারে বলতেন যে প্রজ্ঞা হলো ভালো সম্পর্কে জ্ঞান এবং এই সংজ্ঞার সাথে সক্রেটিসের এই মত জুড়ে দিতেন যে, কোনো মানুষ সজ্ঞানে পাপ করে না; যার অর্থ দাঁড়ায় : যে ব্যক্তি জানে ভালো কী, সে সঠিক কাজটি করে। আমাদের কাছে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরবর্তী বলে মনে হয়। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে বলব যে বিভিন্নমুখী আগ্রহ মানুষের কাছে এবং রাষ্ট্রনেতাকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমঝোতায় পৌঁছুতে হবে। একটি শ্রেণি বা একটি জাতির সদস্যদের একটি সাধারণ স্বার্থ থাকতে পারে; কিন্তু সেই স্বার্থ সাধারণত অন্যান্য জাতি বা শ্রেণির স্বার্থগুলোর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ নয়। সন্দেহ নেই, সমগ্র মানবজাতির কিছু সাধারণ স্বার্থ আছে, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেগুলো যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে কোনোকালে হয়তো তা হতে পারে, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত অনেক সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকছে তত দিন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই তা হবে না। এমনকি তখনো সাধারণ স্বার্থগুলোর অন্বেষণের সবচেয়ে কঠিন অংশটা নিহিত থাকবে পরস্পরবিরোধী বিশেষ স্বার্থগুলোর মধ্যে আপোস-সমঝোতায় পৌঁছানোর মধ্যে। কিন্তু যদি আমরা মনে করি যে প্রজ্ঞা বলে একটি জিনিস আছে, তাহলে এমন ধরনের কোনো সংবিধান কি আছে যা জ্ঞানীদের হাতে শাসন ক্ষমতা দেবে? এটা পরিষ্কার যে, সাধারণ পরিষদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠরা ভুল করতে পারে এবং বাস্তবে ভুল করেছে। অভিজাতরা সবসময় জ্ঞানী হয় না; রাজারা প্রায়ই মূঢ়; পোপরা অভ্রান্তিসত্ততা সত্ত্বেও নিদারুণ ভুল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বা ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিতদের হাতে শাসনকার্য আস্থাভরে ন্যস্ত করার পক্ষে কি কেউ ওকালতি করবেন অথবা সেসব মানুষের হাতে, যারা গরিব হয়ে জন্ম নিয়ে বিরাট ভাগ্য নির্মাণ করেছেন? এটা পরিষ্কার যে, বাস্তবে সমগ্র জাতির চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী আইনগতভাবে সংজ্ঞাযোগ্য নাগরিকদের মনোনয়ন হতে পারে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের দ্বারা মানুষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারে, এ রকম মনে করা যেতে পারে। কিন্তুএই প্রশ্নটা তাহলে উঠবে যে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কী? এবং এটা হয়ে দাঁড়াবে একটি দলীয় প্রশ্ন।

একদল জ্ঞানী মানুষ খুঁজে পাওয়া ও তাদের হাতে শাসনভার ন্যস্ত করার সমস্যাটা তাই একটি সমাধানাতীত সমস্যা। গণতন্ত্রের চূড়ান্ত কারণ হলো এটাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *