১. জ্যোৎস্না রাতের প্রথম প্রহর

ট্রিবুলেশন্‌স অভ এ চাইনিজ জেন্টলম্যান – জুল ভের্ন 
অনুবাদ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

১. জ্যোৎস্না রাতের প্রথম প্রহর

বসে ছিলো ছয় জনে : সান্ধ্য ভোজ চলেছে; মারবেল পাথরের চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে পদ্মমূলের টুকরো ঠোকরাতে-ঠোকরাতে বললো একজন, যাই-ই বলো, বেঁচে থাকার মধ্যেও কিন্তু দিব্য সুখ আছে।

তা আছে বৈকি, তবে দুঃখও অনেক, হাঙরের ডানা গলায় বেঁধে গিয়ে কাশছিলো একজন, অনেক কষ্টে কাশির দমকের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সে বললো।

তাহলে দার্শনিক হয়ে যাও, এদের মধ্যে একজন ছিলো বয়স্ক, কঠোর রিম-ওলা মস্ত চশমা তার চোখে; সে উপদেশ দিলে, তাহলে দার্শনিকের মতো কোনো উচ্চবাচ্য না-করে জীবন যা দেয়, তা-ই গ্রহণ করো; আজ কেশে-কেশে তোমার দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, কাল এই সোমরসের মতো দেখবে কোথায় উধাও হয়ে গেছে সেই অস্বাচ্ছন্দ্য। জীবন এই রকমই! বলে সে আস্ত এক পাত্রভর্তি মদ ঢেলে দিলো গলায়।

আমার কথা যদি বলল, চতুর্থ একজন মন্তব্য করলে সুচিন্তিত, আমার তো বেঁচে থাকতে দিব্যি লাগে–বিশেষ করে যদি প্রচুর টাকাকড়ি থাকে, আর যদি কোনো কাজ-কারবার করতে না-হয়।

উঁহু, ঠিক তার উলটো, পঞ্চমজন তার মত ব্যক্ত করলে, সত্যিকার সুখ কিন্তু হাড়ভাঙা খাটুনি আর দিবারাত্রি অধ্যয়নের মধ্যেই; সুখ পেতে হলে তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

আর শেষকালে এই পরম দিব্যজ্ঞান লাভ হবে যে কিছুই তোমার জানা নেই।

তা এই বোধ থেকেই কি বোধির জন্ম হয় না? এটাই তো সূচনা—

এই যদি সূচনা হয় তো শেষ কোনখানে?

বোধির আবার শেষ কী? জ্ঞানের আবার কোনো সীমা আছে নাকি? চশমাধারী জানালো, তবে তোমার যদি যৎসামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে তাহলেই তৃপ্তি আর সন্তোষের অভাব থাকবে না।

আর এ-বিষয়ে আমাদের গৃহকর্তার অভিমত কী? জীবনকে তাঁর কী মনে হয়? সুখসমৃদ্ধির আনন্দমেলা, না দুঃখকষ্টের জ্বরজ্বালা? গৃহস্বামী যথারীতি টেবিলের মাথায় বসেছিলো, তাকে উদ্দেশ করে প্রথম ব্যক্তি এই প্রশ্ন রাখলো এবার।

গৃহকর্তা এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলো; একটু যেন আনমনা, এ-সব অহেতুক তর্কে তার যেন মন নেই, তরমুজের বিচি ঠোকরাতে-ঠোকরাতে সে যেন অন্য কোনো কথা ভাবছিলো এতক্ষণ। এবার সোজাসুজি তাকেই জিগেশ করায় সে কেবল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটি আওয়াজই বের করলো মুখ দিয়ে : ফুঃ!

এখন, ফুঃ শব্দটা সব ভাষারই অন্যতম মূল্যবান সম্পত্তি; এমনিতে ছোট্ট একখানা এক-অক্ষুরে শব্দ হলে কী হবে, তার থেকে অনেক রকম অর্থ বের করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এটা যেন তার পাঁচ জন অতিথির মধ্যে কোনো তুমুল তর্ক শুরু করে দেয়ার সংকেত হিশেবে কাজ করলো; প্রত্যেকেই অত্যন্ত উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে নিজের নিজের মতের সপক্ষে প্রচুর বাকতাল্লা শুরু করে দিলো, আর মাঝে-মাঝে প্রত্যেকেই একটু থেমে গিয়ে এ-বিষয়ে তাদের গৃহকর্তার মত কী জানতে চাইলো।

গৃহকর্তা অবিশ্যি বেশ কিছুক্ষণ আর-কোনো বাক্যব্যয় করা থেকে বিরত রইলো। কিন্তু অবশেষে সে এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলো যে বেঁচে-থাকা সম্বন্ধে তার কোনো বক্তব্য নেই : জীবন তারকাছে আমোদের প্রস্রবণ নয়, দুঃখের নিঝরও নয়–সুখদুঃখের কোনো অনুভূতিই জীবন তাকে দেয় না; জীবনকে তার কাছে কোনো অতিতুচ্ছ প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়; জীবনকে হাজার নিংড়েও কোনো তীব্র আনন্দের অনুভূতি ভোগ করা যাবে বলে তার নাকি মনে হয় না।

শুনে শ্রোতাদের মধ্য থেকে সমস্বরে বিস্ময়ের ধ্বনি উথিত হলো। শোনো, ওর কথা শোনো একবার! বললো একজন।

কোনো পদ্মপাতাও জীবনে যার আরাম নষ্ট করেনি, তার মুখের কথা শোনো তোমরা, আরেকজন বললে।

আর এত অল্প বয়েস তার, এখনো শুধু যে তরুণ তা নয়, দিব্য আছে–সুস্থ, ধনী, স্বাস্থ্যবান—

ঐশ্বর্যের যার কোনো পরিমাণ নেই—

বোধহয় একটু বেশি ধনী, আর তাইতেই এই গণ্ডগোল।

এবংবিধ মন্তব্য গৃহকর্তার ভাবলেশহীন মুখে স্মিত হাসির কোনো ঝাঁপশা রেখাও ফুটিয়ে তুলতে পারলো না। কেবল অসহায় ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকালো সে একবার; ভঙ্গিটা তার এ-রকম, যেন জীবনখাতার পাতার দিকে চোখ চেয়ে দেখারও মেজাজ নেই তার, যেন কোনো তাড়াও নেই পাতা উলটে হুড়মুড় করে বিষয়টা দেখে নেবার।

বয়েস তার একুত্রিশ। নিখুঁত তার স্বাস্থ্য, অজস্র তার বিত্তসম্পদ; রুচি বা সংস্কৃতির অভাব থেকে যে তার মন নিঃসাড় হয়ে গেছে তা নয়; আর যদি মেধা আর বুদ্ধির কথা ওঠে তো বলতে হয় যে সে সাধারণ লোকের চেয়ে কিঞ্চিৎ উধ্বেই সে স্থান পাবে। এই মরলোকের যাবতীয় জীবদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষ না-হবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ তার নেই।

এই হৈ-চৈ এর মধ্যে তখন দার্শনিকের গম্ভীর গলা শোনা গেলো, যেন। কোনো প্রাচীন কোরাসের মধ্যে দলনেতার গলা বেজে উঠেছে : শোনো হে ছোকরা, নিজেকে যদি তোমার সুখী বলে মনে না-হয় তো এটা জেনে নাও যে এতকাল তোমার সুখের চরিত্র ছিলো নেতিমূলক; স্বাস্থ্য, সম্পদ, ঐশ্বর্য–এ-সব ভোগ করার জন্য এক-আধবার তাদের থেকে বঞ্চিত হওয়াও ভালো। কিন্তু তোমার আবার কখনো একফোঁটাও অসুখ করেনি; দুর্ভাগ্য কাকে বলে তা তুমি জানো না; সেই জন্যেই আবারও বলছি, কোন বিপুল আশীর্বাদ তুমি লাভ করছে, তা অনুধাবন করার কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। দামি জাতের ঝলমলে শ্যাম্পেন ঢেলে গেলাশ ভরে নিলে সে, তারপর গেলাশটা তুলে ধরে বললে, বন্ধুগণ, এসো, আমরা কামনা করি, অচিরেই যেন আমাদের গৃহস্বামী কোনো দুর্ভাগ্যের কবলে পড়েন–তার ঝলমলে জীবনে শিগগিরই যেন কোনো গভীর ছায়াপাত ঘটে।

অভ্যাগতদের হাতের গেলাশগুলি নিঃশেষ হয়ে গেলো। গৃহকর্তা কেবল সামান্য মাথা হেলিয়ে তাদের কামনাকে স্বীকৃতি দিলে, তারপর আবার তার স্বাভাবিক নির্বেদে তলিয়ে গেলো।

এবার হয়তো কেউ জিগেশ করতে পারেন এই বাণীবিনিময় হচ্ছিলো কোথায়–সে কি পারীতে, লণ্ডনে, হীন-এ, না কি সেন্টপিটার্সবুর্গে? ইওরোপের কোনো রেস্তোরাঁয় বসে, না কি নতুন মহাদেশ আমেরিকার কোনো হোটেলে গিয়ে এরা উৎফুল্লভাবে পানাহার সমাধা করছিলো? একটা জিনিশ অবশ্য নিশ্চিত আন্দাজ করা যাচ্ছে; এরা কেউই ফরাশি নয়, কারণ এতাবৎকাল কেউই রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ করেনি।

কুঠুরিটা মস্তও নয়, আবার একেবারে ছোটোও নয়, মাঝারি মাপের–কিন্তু চমৎকার সাজানো। নীল আর কমলা রঙের জানলার কাঁচের মধ্য দিয়ে অস্ত সূর্যের রশ্মিগুলি ঝিলিক দিচ্ছে; তিন দিক থেকে যাতে আলো-বাতাস আসতে পারে, কুলুঙ্গিওলা তেমনি কতগুলো বিশেষ জানলা আছে ঘরটিতে; সন্ধ্যাবাতাসে কুলুঙ্গির ফুলের ঝালরগুলিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে, আর ঝাড়লণ্ঠনের ভিতর থেকে হালকা আলোর রেখা বেরিয়ে এসে দিনের শেষ আলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। জানলার উপরকাঁচের পরদার গায়ে কোনো অতিকায় ও আশ্চর্য জগতের নানান দৃশ্য আঁকা–ভাস্কর্যের নানা নিদর্শনেতে সেই অসম্ভব জগতেরই আভাস পাওয়া যায়। রেশমি কাপড়ের ঝালর ঝুলছে উপর থেকে, দেয়ালে দ্বিতল-সব আয়না বসানো। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে একটি টানা পাখা, আর অলংকৃত সেই মশলিনের পাখা ছন্দোময়ভাবে দুলে-দুলে ভ্যাপশা, বুকে-চেপে-বসা, গরমকে হঠিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।

টেবিলটি আয়তাকার, কালো লাক্ষার তৈরি; কোনো টেবিল-ঢাকনি নেই টেবিলের উপর; পোর্সেলেন আর রুপোর বাসন-কোশনের স্পষ্ট প্রতিভাস দেখা যায় টেবিলের গায়ে, যেন টেবিলটা কোনো মস্ত স্ফটিক দিয়ে তৈরি।

ন্যাপকিনের বদলে প্রত্যেককে নানা রকম ছবি-আঁকা পালা চৌকো-চৌকো কাগজের টুকরো দেয়া হয়েছে। টেবিলের চারপাশে গোল করে বসানো সব কালো মারবেল পাথরের চেয়ার; কুশান-বসানো অন্যসব লাউজের চেয়ে এখানকার আবহাওয়ায় এ-সব চেয়ারই বেশি আরামপ্রদ।

শান্ত একদল তরুণী দাঁড়িয়ে আছে আদেশের অপেক্ষায়; কালো খোঁপায় তারা খুঁজেছে লিলি আর চন্দ্রমল্লিকা; সোনার বালা আর চুড়ি পরে আছে তারা হাতে; নরম তাদের কাজ করার ভঙ্গি, স্মিতমুখে চটপট তারা থালা বা রেকাবি সরিয়ে ফ্যালে একহাতেই, যাতে আর-কেউ পাখা নেড়ে হাওয়া করতে পারে অতিথিদের।

পুরো ভোজসভাটাই যেমনভাবে সমাধা হলো তার চেয়ে সুন্দরভাবে আর কিছুতেই অতিথি-সংবর্ধনা করা যেতে পারে না। সরাইখানার মালিক বোধহয় জানতো যে সে অভিজাত ভোজনরসিকদের আপ্যায়ন করতে যাচ্ছে, তাই খাদ্যতালিকার নানা সুখাদ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে সে আজ এমনকী নিজের পূর্ব-খ্যাতিকেও ম্লান করে গেছে।

প্রথমে সে পরিবেশন করলে চিনির পিঠে, ক্যাভিয়ের, একরকম ডিমের খাদ্য, ফড়িংভাজা, শুকনো ফল, আর নিং-পো ঝিনুক। তারপরে ক্ষণিক বিরতি দিয়ে একটু পরে-পরে পরিবেশন করা হলো ঘিয়ে-সেদ্ধ হাঁস-পায়রার ডিম, ডিমের কুসুমে ভাজা সোয়ালো, মিষ্টি চাটনি-মাখানো তিমি মাছের কলজে, টাটকা জলের ব্যাঙাচি, ভাজা কাঁকড়ার দাঁড়া, চড়ুই পাখির দু-নম্বর পাকস্থলি, রশুনঠাশা ভেড়ার চোখ, দুধে-চোবানো মুলোর সঙ্গে খুবানির শাঁস, সিরাপে-ডোবানো বাঁশের মূল, আর মিষ্টি সালাদ। সব শেষে পরিবেশন করা হলো সিঙাপুরের আনারস, চিনেবাদাম, নুন-মাখা কাজুবাদাম, রসে ভরা পক আম, কোয়াংতুঙের কমলা। আর সেই সঙ্গে পানীয় ছিলো বিয়ার, শাও-শিগনের সোমরস, আর রাশি-রাশি শ্যাম্পেন। ফল-মিষ্টির পরে ভাত এলো, অতিথিরা ছোটো-ছোটো সরু-সরু কাঠের চামচে বা চপস্টিক দিয়ে তা মুখে তুললো।

ভোজপর্ব সমাধা হতে তিন ঘণ্টা লাগলো। অবশেষে খাদ্যসম্ভার শেষ হলো; ইওরোপীয় ভোজসভার মতোই, অপর্যাপ্ত, গোলাপজল পরিবেশন করা হলো কুলকুচো করার জন্য, তারপর পরিচারিকারা ভাপ-ওঠা গরম জলে চোবানো ন্যাপকিন নিয়ে এলো, আর অতিথিরা পরম পরিতোষের সঙ্গে ওই তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলো।

এর পরে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে সবাই গীতবাদ্য উপভোগ করতে বসলো। ঘরে ঢুকলো একদল সুন্দরী তরুণী, সুন্দর করে সাজা, পরিচ্ছন্ন ও রুচিমণ্ডিত-এরাই গাইবে আর বাজাবে। তাদের গীতবাদ্যে অবশ্য কোনো সমতান বা সুরলালিত্য ছিলো না; কিছু চীৎকার, স্ফুট-অস্ফুট আওয়াজ, গলাফাটা চাঁচামেচি–তাতে না-আছে ছন্দ, না-বা আছে তাল–এই নাকি তাদের সংগীত! বাদ্যযন্ত্রগুলি এই সমতানেরই যোগ্য সংগত : তার-ছেঁড়া তম্বুরা, বেসুরো বেহালা, সাপের চামড়া-ঢাকা কর্কশ গিটার, তীক্ষ্ণ বাঁশি–কোনোটার থেকেই কোনো সুরেলা আওয়াজ বেরুলো না।

তরুণীদের ঘরে নিয়ে এসেছিলো একটি লোক, সে-ই এই লাস্যময় জলশার নেতা; গৃহকর্তার হাতে প্রথমেই সে একটি প্রোগ্রাম তুলে দিয়েছিলো, আর গৃহকর্তা তাকে যথেচ্ছ প্রমোদ বিতরণের অনুমতি দিলে প্রথমেই সে তার অর্কেস্ট্রাকে দশ ফুলের তোড়া সুরটি বাজাতে বলেছিলোহালফিলের ফ্যাশান অনুযায়ী সেটাই তখন সবচেয়ে প্রিয় সুর। সেটা শেষ হলে আরো কতগুলি ওই জাতেরই হালফ্যাশানের গান শোনালে তারা, অবশেষে তাদের জলশা শেষ হলে–আগেই তাদের প্রচুর অর্থ দেয়া হয়েছিলো–শ্রোতৃগণ সোৎসাহে করতালি দিয়ে বিদায় জানালে তাদের, আর তারা, অন্য শ্রোতাদের কাছ থেকে আরো হাততালি পাবার আশায়, একে-একে প্রস্থান করলো।

জলশা শেষ হয়ে যেতেই আসন ছেড়ে উঠলো অতিথিরা, তারপর পরস্পরের মধ্যে কিছু ভদ্রতাবিনিময়ের পর আরেকটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আধডজন ঢাকনি-বসানো পেয়ালা ছিলো এই টেবিলে–প্রত্যেকটি পেয়ালাতেই বোধিসত্ত্বের প্রতিচ্ছবি আঁকা–তার সেই কিংবদন্তির চাকার উপর দাঁড়িয়ে আছেন এই বৌদ্ধ ভিক্ষু। পেয়ালা-ভর্তি ফোঁটানো জল; এবার প্রত্যেককেই চা-পাতা দেয়া হলো; যে-যার পেয়ালায় চা-পাতা দিয়ে, চিনি ছাড়াই, সেই চায়ের জল ঢোকে-ঢোকে গলাধঃকরণ করে নিলে। এ কি যে-সে চা! সরাসরি গিব, গিব অ্যাণ্ড কম্পানির গুদোম থেকে আনানো–ভেজাল মেশানো চা–এ-কথা বলার কোনো সুযোগই নেই; চায়ের রাজা বলা যায় একে; বিশুদ্ধ, বহিঃপ্রভাবহীন এই চা-পাতা–সদ্যফোঁটা দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি তুলে নেয় দস্তানা-পরা বালক-ভৃত্যেরা, আর একটি কুঁড়ি ফুটলেই সে-গাছ মরে যায় বলে এই চা অতি দুর্লভ সামগ্রী বলে গণ্য হয়।

তার সুগন্ধ আর স্বাদ দেখলে যে-কোনো লোকই অভিভূত হয়ে যেতো, কিন্তু এরা সবাই শমঝদার ভোক্তা, আস্তে এক-একটা চুমুক দেয়, সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে স্বাদ নেয় তার, আস্তে ঢোক গেলে, তারপর আবার একটা চুমুক দেয়। এরা সবাই সম্ভ্রান্তবংশের পুরুষ, আভিজাত্যমণ্ডিত; পরনে মূল্যবান হুন-শাওল বা পালা শার্ট, মা-কোয়ালা বা ছোট্ট শিরোবসন, হাওলট বা পাশে বোম-লাগানো লম্বা ঢোলা কামিজ। পায়ে হলদে চটি, আর পালা মোজা, মোজার উপর থেকে উঠে গেছে রেশমি আঁটো পাজামা, কোমরের কাছে জরির কাজ-করা রেশমি কোমরবন্ধ দিয়ে বাঁধা; আর তা থেকে ঝুলছে সুন্দর কাজ-করা নানা বর্ণ ঝালর; বুকের উপর তারা লাগিয়েছে সূক্ষ্ম কাজ-করা রেশমের উদর-বসন।

এই বর্ণনার পরে এই কথা বলা নিশ্চয়ই বাহুল্য যে এরা সেই দেশেরই বাসিন্দে যেখানে প্রতি বছর চা-বাগান থেকে সুগন্ধি পাতা তোলার উৎসব হয়। তাদের কাছে ভোজসভার খাদ্যতালিকায় হাঙরের কানকো, তিমিমাছের কলজে, ভাজা ফড়িং বা টাটকা-জলের ব্যাঙাচি কোনো নতুন সুখাদ্য নয়, এমনকী যে-রুচিসম্মত আভিজাত্যের সঙ্গে এ-সব পরিবেশন করা হয়েছে, তাও এদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু খাদ্যের রেকাবি বা ভোজসভার কোনো উপকরণেই যারা এতক্ষণ কোনো বিস্ময় প্রকাশ করেনি, গৃহস্বামী যখন বললো যে তাদের কাছে তার কিছু বক্তব্য আছে, তারাই তখন অতিমাত্রায় বিস্মিত ও উচ্চকিত হয়ে উঠলো।

পেয়ালাগুলো আবার চায়ে ভরা হলো। নিজের পেয়ালাটা মুখে তুলে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে গৃহকর্তা তার বক্তব্য শুরু করলে : আমার কথা শুনে তোমরা হেসো না, কিন্তু এবার আমি আমার জীবনে একটা নতুন উপাদান আনতে চাচ্ছি। তার ফল ভালো হবে কি মন্দ হবে জানি না, শুধু ভবিষ্যই এ-বিষয়ে কিছু বলতে পারে। সান্নিধ্য দিয়ে তোমরা আজকের যে-সান্ধ্যভোজকে অনুগৃহীত করেছো, কুমার হিশেবে এটাই আমার শেষ আমন্ত্রণ! আর পক্ষকালের মধ্যেই আমি বিয়ে করবো!

বিবাহিত আর সুখী! নরকুলের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি! অভ্যাগতদের মধ্যে যে-আশাবাদী ছিলো, সে বলে উঠলো, দ্যাখোবন্ধু, সমস্ত লক্ষণই তোমার সৌভাগ্য ইঙ্গিত করছে, আঙুল তুলে দেখালো সে কেমন করে ঝাড়লণ্ঠনের পাণ্ডুর আলোয় সব কী-রকম মোলায়েম দেখাচ্ছে, দেখালো বাঁকা জানলার কুলুঙ্গিতে ম্যাগপাইরা কেমন কিচির-মিচির করছে, আর কেমন লম্বমানভাবে চা-পাতাগুলো ভাসছে চায়ের পেয়ালায়।

পরক্ষণেই সমস্বরে অভিনন্দন জানালো সবাই; গৃহকর্তা কিন্তু অবিচল ও শান্তভাবে সব অভিনন্দন গ্রহণ করলে। এই কথাটা তার মাথায় ঢুকলো না যে মহিলাটির পরিচয় দেয়া উচিত তার, আর অন্য-কেউ তার সেই আনমনা ভাব ভাঙাবার সাহস পেলো না। কেবল দার্শনিক ব্যক্তিটিই এদের এই অভিনন্দনের ঐকতানে যোগ দেয়নি; সে চুপচাপ বসে ছিলো দু-হাত ভাঁজ করে; চোখ দুটি তার আধবোজা; ঠোঁটের ফাঁকে ব্যঙ্গের স্মিত ছোপ; যেন বিনামূল্যে এ-রকম অভিনন্দন জ্ঞাপনের বিরুদ্ধে তার কোনো বক্তব্য আছে।

গৃহকর্তা তার দিকে তাকালো একটু, তারপর নিজের আসন ছেড়ে উঠে তার দিকে এগুতে-এগুতে বললে, তোমার কি মনে হয় আমার বয়েস খুব বেশি? বিয়ে করা উচিত নয়? এতক্ষণ তার কথায় কোনো আবেগের ছাপ দেখা যায়নি, কিন্তু এবার তার গলা একটু কেঁপে গেলো।

না।

তাহলে কি বিয়ে করার পক্ষে খুব কম বয়েস?

না।

কোনো ভুল করছি নাকি তাহলে?

সম্ভবত করছে।

জানো, আমাকে সুখী করার মতো সব গুণই মেয়েটির আছে?

খুব সত্যি।

তাহলে মুশকিলটা কিসের?

মুশকিলটা তোমার নিজের মধ্যে!

আমি কি কোনো দিনই সুখী হবো না?

অসুখী হওয়া কাকে বলে তা না-জানা পর্যন্ত কোনোদিনই হবে না।

কিন্তু আমি যে দুর্ভাগ্যের চৌহদ্দির বাইরে—

তাহলে তোমার আর-কোনো উদ্ধার নেই।

বাজে কথা! সব বাজে কথা! এদের মধ্যে সব চেয়ে যার বয়েস কম, সে তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে উঠলো। ওই দার্শনিকের কথাগুলি সব তত্ত্বকথার গ্যাড়াকল! ওর মাথায় সারাক্ষণ সব তত্ত্বকথা ঘুরে বেড়াচ্ছে–আর কী সব তত্ত্বকথা–সব বাজে বস্তাপচা! বন্ধু হে, বিয়েটা করেই ফ্যালো; যত তাড়াতাড়ি পারো বিয়ে করো। আমি নিজেই করতুম অ্যাদ্দিনে, কিন্তু একবার একজনের কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলুম, তাতেই আটকাচ্ছে! আমরা তোমার স্বাস্থ্য পান করবো। তোমার সুখ-সৌভাগ্য যেন কোনোদিনই না-ফুরোয়!

আমি কেবল আমার আশাটাই ব্যক্ত করতে পারি, দার্শনিকের প্রত্যুত্তর এলো, যেন কোনো দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে অবশেষে ওর কাছে সুখ আসে।

গৃহকর্তার স্বাস্থ্য পান করলো তারা; তারপর অতিথিরা আসন ছেড়ে উঠে ঘুষি মারার ভঙ্গিতে হাত মুঠো করে মুষ্টিবদ্ধ হাত কপালে তুলে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে বিদায় নিলে।

কুঠুরিটির বর্ণনা, অদ্ভুত ভোজ্যতালিকা, আর অতিথিদের বসনভূষণ ও বিদায়গ্রহণের ভঙ্গি থেকে এটা নিশ্চয়ই চট করে বোঝা যাবে যে এখানে যে-চৈনিকদের কথা বলা হচ্ছে, তারা ঠিক সাধারণ সেইসব চৈনিক নয়, কাগজের পরদা বা পুরোনো পোর্সেলেনের বাসন-কোশন থেকে যারা হঠাৎ বেরিয়ে আসতে পারে। বরং এরা আধুনিক চিন-সাম্রাজ্যের লোক–ইওরোপের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষা, ভ্রমণ ও ভাব-বিনিময়ের মধ্য দিয়ে যারা প্রতীচীর সভ্যতার নানা আদবকায়দা গ্রহণ করে নিয়েছে। আসলে কোয়াংতুঙের মুক্তোদীর এক প্রমোদতরীর সেলুনে বসেছিলো তারা এতক্ষণ–বজরাটার মালিক বিত্তশালী কিন-ফো; দার্শনিক ওয়াং-এর সঙ্গে হরিহরভাব-অচ্ছেদ্য তাদের বন্ধুতা; এতক্ষণ তারা দুজনে তাদের ছেলেবেলার চারবন্ধুকে আপ্যায়ন করছিলো; তাদের একজন হলো পাও-শেন, চতুর্থ শ্রেণীর এক মান্দারিন, তার গাঢ়-নীল বল থেকেই তা বোঝা যায়; আরেকজনের নাম ইন-পাং অ্যাপোথেকারি স্ট্রিটের এক ধনী রেশম-বিক্রেতা সে; তৃতীয়জনের নাম টিম, ফুর্তিবাজ, হাসিখুশি, আমোদ-প্রমোদই তার সর্বস্ব; আর চতুর্থজনের নাম হো-ওয়াল কবি ও সাহিত্যিক।

এই ভাবেই চতুর্থ চাঁদের সপ্তবিংশতি দিবসের পাঁচ প্রহরের প্রথমটি কেটে গেলো, আর সন্ধ্যা ঢলে পড়লো দ্বিতীয় প্রহরে–রোমান্টিক চিনে রাত্রির দ্বিতীয় যামে।

.

২. কে, কী, কবে, কোথায়

কোয়াংতুঙে এই বিদায়ভভাজের ব্যবস্থা করার বিশেষ কারণ ছিলো কিন-ফোর। তার বাল্য ও কৈশোর কেটেছিলো কোয়াংতুঙের রাজধানীতে, আর সে ছিলো ধনী আর হাত-খোলা, ফলে তার বন্ধুসংখ্যা নেহাৎ কম ছিলো না। তার ইচ্ছে ছিলো চলে যাবার আগে বন্ধুদের সে শুভেচ্ছা জানায়। কিন্তু জীবন তার বন্ধুদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে তারা জীবিকার সন্ধানে; থাকার মধ্যে ছিলো কেবল এই চার জন, যারা তার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে। কিনফো-র বাড়ি আসলে শাংহাই; কোয়াংতুঙে সে এসেছিলো হাওয়া বদলাতে–মাত্র কয়েক দিনের জন্য; সেই রাতেই স্টিমবোটে করে তার বেরিয়ে পড়ার কথা–এই স্টিমবোট সব বড়ো-বড়ো বন্দরেই থামে–কয়েক দিন ঘুরে অবশেষে নিজের আস্তানায় সে ফিরে যাবে, এই ছিলো তার পরিকল্পনা।

স্বভাবতই দার্শনিক ওয়াং-ও তার সঙ্গী হয়েছিলো; তাকে বলা যায় কিনফোর মাস্টারমশাই, ক্কচিৎ সে তার ছাত্রকে একা রেখে বেরোয়। টিম যখন তাকে তত্ত্বকথার গ্যাড়াকল বলেছিলো তখন সে বলতে গেলে চাঁদমারিতেই তীর বিঁধিয়ে দিয়েছিলো; কারণ সুযোগ পেলে ওয়াং কিছুতেই পণ্ডিতিয়ানা দেখাতে ছাড়ে না-বড়ো-বড়ো আপ্তবাক্য আওড়ায় সর্বদা, যদিও এ-কথাটা বলা ভালো যে শান্ত গম্ভীর ও বিমনা কিন-ফোর উপর তার প্রভাব দেখা যায় যৎসামান্যই।

কিন-ফো অত্যন্ত সুপুরুষ; উত্তরের চিনে সে, তাতারদের সঙ্গে কোনোদিনই তাদের রক্ত মিশে যায়নি। তার বাবা-মার ধমনীতে একফোঁটাও তাতার রক্ত ছিলো না, যেটা দক্ষিণে একেবারেই কল্পনাতীত-দক্ষিণের লোকেরা ধনীগরিব নির্বিশেষে মাথুদের সঙ্গে দো-আঁশলা হয়ে গিয়েছিলো। কিন-ফো লম্বা ও সুগঠিত; গাত্রবর্ণ পীত নয়, বরং গৌর; চোখের উপর ভুরুযুগল যেন সমান্তরালভাবে বসানো, যদিও কপালের কাছে গিয়ে একটু উপর দিকে তাকিয়েছে; খাড়া নাক, অর্থাৎ তাকে দেখে প্রাচী ও প্রতীচীর সবাই সুপুরুষ বলতে বাধ্য হবে। মাথাটি তার ঠিক একেবারে ঘাড়ের উপর বসানো–গ্রীবা যাকে বলে তা যেন প্রায় নেই, আর এটাই বোঝায় যে সে আসলে চৈনিক; চকচকে কালো চুলের বেণী সাপের মতো পড়ে আছে তার পিঠে। আধাবৃত্তের আকারে সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা দেখা যায় তার ঠোঁটের উপর, যেন কোনো স্বরলিপির মধ্যে শমের ইঙ্গিত। আঙুলে বড়ো-বড়ো নখ, প্রায় আধ ইঞ্চি বড়ো হবে : তাকে যে নিজের হাতে কোনো কাজই করতে হয় না, নখগুলো আসলে তারই সাক্ষী; যদিও তার চেহারা দেখেই এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সে যাকে বলে মস্ত বড়োলোক।

তার জন্ম হয়েছিলো পেইচিঙে। পেইচিঙে জন্ম হলে গর্বের আর সীমা থাকে না কারু, লোকে বলে যে উপর থেকে এসেছে। ছ-বছর বয়েস পর্যন্ত পেইচিঙেই ছিলো কিন-ফো, তারপর তাদের পরিবার শাংহাই চলে আসে।

তার বাবা চুং-হৌ উত্তরের অভিজাতদের একজন, এবং স্বদেশীদের অনেকের মতোই বণিকবৃত্তিতে তার প্রবণতা ও ক্ষমতা ছিলো প্রচুর। জীবনের প্রথম ভাগে তার দেশের এমন-কোনো মূল্যবান সামগ্রী ছিলো না, যা তার ব্যাবসার অন্তর্ভূক্ত ছিলো না : সোয়াচৌ-এর কাগজ, সু-চুর রেশম, ফরমোজার চিনি, হান-কৌ আর ফু-চৌ-এর চা, হেনান-এর লোহা, ইয়েনান-এর তামা আর পিতল–সব ছিলো তার বাণিজ্যের সামগ্রী। তাঁর প্রধান কারখানা বা কং ছিলো শাংহাইতে, কিন্তু নানকিং, তিয়েনসিন, মাকাও আর হংকং-এও তাঁর শাখা-প্রতিষ্ঠান ছিলো। ইংরেজদের জাহাজে করে তার মাল সরবরাহ করা হততা, লিয়তে রেশমের আর কলকাতায় আফিমের দর কত সে-খবর তাঁর কাছে রোজ তারবার্তায় যেতো; অন্যান্য চিনে বণিকের সঙ্গে তার নানা দিক থেকে তফাৎ ছিলো; মান্দারিনের প্রভাব বা সরকারের চাপ এড়িয়ে তিনি বাষ্প ও বিদ্যুতের সাহায্য গ্রহণ করতে কশুর করেননি–কারণ তার মনে হয়েছিলো এ-কালে বাষ্প আর বিদ্যুৎই প্রগতির বাহক।

চুং-হৌ-এর ব্যবসা এত ভালো চলেছিলো যে কেবল যে চিন সাম্রাজ্যের মধ্যেই তা সীমিত ছিলো, তা নয়; শাংহাই, মাকাউ আর হংকং-এর ফরাশি, ইংরেজ, পোর্তুগিজ ও মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর লেনদেন চলতো–আর যখন ছেলে কিন-ফোর জন্ম হলো, তখন তিনি ৪০০,০০০ ডলারের মালিক। পরে আমেরিকায় কুলি চালান দেবার ভার নিয়ে এই অর্থকে তিনি তিন-ডবল করে তুলেছিলেন।

এ-কথাটা তর্কাতীত যে চিনের লোকসংখ্যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই–এত বড়ো দেশ, কিন্তু তাতেও কুলোয় না; ৩৬০,০০০,০০০-এর চেয়ে কম হবে না লোকসংখ্যা : সারা জগতের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। যদিও জগতের কাছে কোনো চিনের কামনা অতি সামান্য, তবু তাকে তো বেঁচে থাকতে হবে; আর চিনদেশে প্রচুর ধান ও অন্যান্য নানা শস্য ফললেও তা লোকের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল; বিশাল জনসমষ্টিকে ফালতু বলে মনে হয়; আর এই অতিরিক্ত লোকজনের সংখ্যা কমাবার উপায় বের করেছিলো। ইংরেজ আর ফরাশিরা-চিনের প্রাচীর পেরিয়ে সারা জগতে তাদের ছড়িয়ে দেবার নৈতিক দায়িত্ব নিয়েছিলো যেন তারা। দেশত্যাগের হিড়িক যখন পূর্ণবেগে এলো সব চেয়ে বেশি লোক গিয়েছিলো উত্তর আমেরিকায়, বিশেষ করে ক্যালিফরনিয়া অঞ্চলে; আর এত লোক সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলো যে আমেরিকার কংগ্রেস এই পীত মড়কের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য কতগুলি বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছিলো; কিন্তু শিগগিরই এই তথ্যটি আবিষ্কার হলো যে ৫০,০০০,০০০ লোকের মহাপ্রস্থানে চিন সাম্রাজ্যের যদিও বিশেষ-কিছু এসে যায় না, কিন্তু আমেরিকার মাটিতে ওই মোঙ্গোল বসতি শ্বেতাঙ্গদের রক্ত ও গাত্রবর্ণের বিশুদ্ধতা ধ্বংস করে দেবে।

কিন্তু তবু হাজার বিধিনিষেধ সত্ত্বেও চৈনিক অনুপ্রবেশ রোধ করা গেলো । সব কাজেই কুলি লাগে, আর চৈনিক কুলি অল্পেতেই খুশি : রোজ একমুঠো ভাত, এক পেয়ালা চা আর খানিকটে তামাক পেলেই তুষ্ট; তাছাড়া ক্যালিফরনিয়া, অরেগন, ভারজিনিয়া, সল্টলেকে তারা খুব কাজে এলো, শুধু তাই নয় মজুরদের পারিশ্রমিকও যথেষ্ট কমিয়ে দিলো। তাদের যাতায়াতের সুবিধের জন্য কম্পানি বসলো; চিনে বসলো পাঁচটা, আর সান ফ্রান্সিসকোয় একটা। সেই সঙ্গে আরেকটা–তিং-তোং নামে একটা ছোটো প্রতিষ্ঠানেরও জন্ম হলো, তাদের দায়িত্ব হলো এদের আবার ফিরিয়ে আনা।

এই তিং-তোং না-হলে কিছুতেই চলতো না। চিনেরা যদিও আমেরিকায় ভাগ্যান্বেষণে যেতে এক পায়ে খাড়া ছিলো, তবু এটা তারা চাইতো যে দৈবাৎ ওই বিদেশ-বিভুঁইয়ে মরে গেলে তাদের মৃতদেহ যেন স্বদেশে এনে সৎকার করা হয়। চুক্তির মধ্যে এই কথাটা না-থাকলে কেউ ছেড়ে এক পা বাড়াতে চাইতো না; আর তাই তিং-ততাং নামে মৃত্যু-প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলো, যাদের কাজ ছিলো ক্যালিফরনিয়া থেকে রাশি-রাশি মৃতদেহ এনে শাংহাই, হংকং আর তিয়েনসিনে পৌঁছে দেয়া।

এই নতুন প্রতিষ্ঠানের অর্থলাভের দিকটা প্রথম যাদের চোখে পড়েছিলো তাদের মধ্যে উৎসাহী চুং-হৌ একজন। বিপুল উদ্যমে এই ব্যাবসায় যোগ দিয়েছিলেন তিনিঃ ১৮৬৭ সালে যখন তাঁর মৃত্যু হলো তখন তিনি কোয়াং-তুং-এর তিং-তোং কম্পানিরই কেবল ডিরেক্টার নন, সান ফ্রান্সিসকোর তিং-তোং-এরও একজন পরিচালক হয়ে বসেছেন।

চুং-হৌয়ের ব্যাবসাবুদ্ধি এত প্রখর ছিলো যে তার মৃত্যুর পর কিন-ফো আবিষ্কার করলে যে ক্যালিফরনিয়ার সেনট্রাল ব্যাংকে তার নামে ৮০০,০০০ ডলার খাটছে। কিন-ফোর ব্যাবসাবুদ্ধি এটুকু ছিলো যে ওই টাকা ছোঁবার চেষ্টা সে করেনি। তার বয়স তখন মাত্র উনিশ, মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই–শুধু যে একেবারে একা হয়ে পড়তো তা নয়, বখেও যেতে হয়তো, যদি-না তার অচ্ছেদ্য বন্ধু আর গুরু ওয়াং থাকতো। শাংহাই-এ তাদের বাড়িতে সতেরো বছর ধরে বাস করেছে ওয়াং; পিতাপুত্র দুজনেরই বন্ধু ও মন্ত্রণাদাতা সে; কোত্থেকে যে তার অভ্যুদয়, আর তার পূর্ব পরিচয়ই বা কী, তা বোধহয় চুং-হৌ আর কিন-ফোই কেবল বলতে পারতো, কিন্তু এমনকী তারাও এ-বিষয়ে কদাচ টু শব্দ করেনি। বোধকরি সেই জন্যেই পরদা তুলে তার অতীতের দিকে উঁকি দেয়া ভালো হবে।

চিনদেশে এটা সবাই ধরে নেয় যে কোনো পুনরুত্থিত আত্মা বহু সহস্র লোকের হৃৎপিণ্ডে অনেক বছর ধরে বেঁচে থাকে। নামজাদা মিং রাজবংশ তিনশো বছর ধরে নানা আন্দোলনের মধ্যেও টিকে ছিলো; অবশেষে সপ্তদশ শতকে–১৬৪৪ সালে–রাজবংশের তদানীন্তন প্রতিভূ যখন আবিষ্কার করলেন যে তিনি শত্রুপক্ষের সঙ্গে একা এঁটে-ওঠার মতো বল ধরেন না, তখন তাতার সুলতানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তার সুলতান সুযোগ পেয়ে তক্ষুনি তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন, বিপ্লব প্রশমিত হলো, কিন্তু সেই দুর্বল মিং রাজকে সরিয়ে দিয়ে এই সুযোগে তিনি স্বীয় পুত্র চুন-চিকে চিন সম্রাটের সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।

সেই থেকে বহিরাগতদের হাতেই সব ক্ষমতা; মাঞ্চুরাজেরাই তারপর থেকে চৈনিক সিংহাসনে বসেছেন একের পর এক। ধীরে-ধীরে নিম্নশ্রেণীর লোকের মধ্যে দুই জাতির রক্ত মিশে গেলো, বিশুদ্ধ চৈনিক রক্তের স্থান নিলে দো-আঁশলা নতুন এক জাতি; কিন্তু উত্তরের অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে চৈনিক আর তাতারদের কিছুতেই আর মিশ্রণ ঘটলো না–বরং আরো স্পষ্ট ও দৃঢ় হলো বিভেদ; এমনকী অদ্যাবধি কোনো-কোনো প্রদেশে অপসৃত মিং রাজবংশের অনুগত পরিবার দেখা যাবে।

আর এদেরই একজন ছিলেন কিন-ফোর বাবা। বংশের ঐতিহ্য সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন তিনি; তাতারশক্তির বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ উথিত হলে তিনি নিশ্চয়ই কায়মনোবাক্যে তাকে সমর্থন করতেন। কিন-ফোও বাবার রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলো।

১৮৬০ সালে সম্রাট ছিলেন সিয়েনফোং; ফ্রান্স আর ইংলণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি; সেই বছরই ২৫শে অক্টোবর পেইচিং চুক্তির দ্বারা সেই যুদ্ধের অবসান হয়। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তিনশো বছর ধরে শাসককুলকে সব সময়ই প্রচণ্ড অভ্যুত্থানের ভয়ে-ভয়ে কাটাতে হয়েছে। চ্যাং-মৌ বা তাই-পিং বিদ্রোহীরা ১৮৫৩ সালে নানকিং দখল করেছিলো, তারও দু-বছর পরে অধিকার করেছিলো শাংহাই। সিয়েনফোং-এর মৃত্যুর পর তার তরুণ পুত্র প্রথমেই তাই-পিং বিদ্রোহীদের সম্মুখীন হয়েছিলেন; বড়োলাট লি আর ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল গরডনের সাহায্য ছাড়া যুবরাজ কং সিংহাসনে আরোহণ করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। তাতারদের জাতশত্রু তাই-পিংদের উদ্দেশ্য ছিলো সিং রাজবংশকে উৎপাটিত করে মিং রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অত্যন্ত সবল ছিলো তাই-পিঙেরা; চারটে বাহিনী ছিলো তাদের; প্রথম বাহিনী ছিলো কালো নিশেনের দল : যাবতীয় গুপ্তহত্যার ভার ছিলো তাদের উপর; দ্বিতীয় বাহিনীকে বলা হতো লালঝাণ্ডা বাহিনী : বিষয়-সম্পত্তিতে আগুন লাগিয়ে ছারখার করে ফেলার দায়িত্ব নিয়েছিলো তারা; পীত পতাকার বাহিনীর কাজ ছিলো লুঠতরাজ ও দস্যুবৃত্তি; আর চতুর্থ বাহিনীর পতাকা ছিলো শ্বেতবর্ণ, অন্য তিনটে বাহিনীর যথাযোগ্য পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো তাদের। কিয়াংসু প্রদেশে তাদের সামরিক প্রস্তুতি চলতো, শাংহাইয়ের নিকটবর্তী সু-চু আর কিয়াহিং ছিলো বিদ্রোহীদের দখলে; তুমুল যুদ্ধের পরেই সম্রাটের ফৌজ তা পুনরুদ্ধার করতে পারে। ১৮৬০ সালের ১৮ আগস্ট এমনকী শাংহাই শুদ্ৰু আক্রান্ত হয়; ঠিক সেই মুহূর্তে আরো উত্তরে সম্মিলিত ইঙ্গ-ফরাশি বাহিনী জেনারেল গ্রান্ট ও মাঁতোবার নেতৃত্বে পাই-হো নদীর কেল্লায় ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছিলো। চুং-হৌ তখন শাংহাই থাকতেন; চৈনিক এঞ্জিনিয়াররা সু-চৌ নদীর উপর যে চমৎকার সেতু নির্মাণ করেছিলো তার পাশেই ছিলো তার বাড়ি। বলাই বাহুল্য, বিদ্রোহীদের প্রতি গোপন মমতা ছিলো তার।

১৮ তারিখে সন্ধেবেলায় ঠিক যখন বিদ্রোহীরা শহর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, চুং-হৌ এর বাড়ির দরজা সশব্দে খুলে যায় এবং একটি উদ্ভ্রান্ত পলাতক এসে গৃহস্বামীর পায়ে আছড়ে পড়ে। অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই তার কাছে; চুং-হৌ যদি তাকে সম্রাটের বাহিনীর কাছে সমর্পণ করতেন, তাহলে তক্ষুনি তার প্রাণদণ্ড হতো। কিন্তু কোনো তাই-পিংকে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেবার কথা চুং-হৌ স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ভূলুণ্ঠিত আগন্তুকের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছিলেন, তোমাকে আমি মোটেই চিনি না। কোত্থেকে এসেছে বা এতকাল কী করতে, সে-সবও আমি জানতে চাই না। আমার অতিথি বলে গণ্য করতে পারো তুমি নিজেকে। এখানে। তোমার কোনো ভয় নেই।

পলাতক ব্যক্তিটি তখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, যেন একবিন্দু শক্তি নেই তার দেহে। ভাঙা-ভাঙা কথায় সে তার কৃতজ্ঞতা বর্ষণ শুরু করেছিলো, কিন্তু চুং-হৌ তাকে বাধা দিয়ে জিগেশ করেছিলেন, কী নাম তোমার।

ওয়াং, উত্তর এলো।

বাস, তাহলেই হবে! আর-কিছু আমি জানতে চাই না।

কেউ যদি জানতে পারতো যে চুং হৌ এইভাবে ওয়াং-এর প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাহলে তারও কোনো রেহাই ছিলো না। চুং হৌ এ-কথা জানতেন, কিন্তু তবু ওয়াংকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন না।

এর পর কিছুকালের মধ্যেই বিপ্লবীরা নির্মূল হয়ে গেলো; ১৮৬৪ সালে সম্রাটের বাহিনী নানকিং অবরোধ করলে তাই পিং সম্রাট বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

সেই-যে ওয়াং তার আশ্রয়দাতার বাড়িতে থেকে গেলো, তারপর আর-কোথাও গেলো না; আর কেউ তাকে তার অতীত জীবন নিয়েও কোনো প্রশ্ন করলো না। শোনা যায়, বিদ্রোহীরা নাকি অত্যন্ত নৃশংস ছিলো, নিষ্ঠুরতায় তাদের কোনো জুড়ি ছিলো না; তাই ওয়াং যে কোন পতাকার দলের লোক এটা স্পষ্ট করে না-জানাই বোধকরি সবচেয়ে ভালো তাহলে অন্তত এই আশা পোষণ করা যেতে পারে যে সে ছিলো:শ্বেতপতাকার দলের পরিচালক মণ্ডলীর অন্যতম।

তা সত্য যা-ই হোক না কেন, এটা ঠিক যে এ-রকম বাড়িতে আশ্রয় পাওয়াটা ওয়াং-এর সৌভাগ্যের নজির, আর সেও উদ্ধারকর্তাদের বদান্যতার যথা সম্ভব প্রতিদান দেবার চেষ্টা করেছে সবসময়। মিশুক, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী-বন্ধু হিশেবে তার তুলনা হয় না; তাই পিতার মৃত্যুর পর কিন-ফো তাকে নিজের অচ্ছেদ্য বন্ধু বলেই গ্রহণ করেছে। পঞ্চান্ন বছর বয়সী এই নীতিবিদ ও কাঠের দাঁড়ের চশমা-পরা দার্শনিকের মধ্যে অতীতের তাই-পিংকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; চৈনিকসুলভ একজোড়া গোঁফ আছে তার, হালকা রঙের ঢোলা আলখাল্লা পরনে, ভাবেভঙ্গিতে কেমন ঢিলেঢালা গোছের, মাথায় সূক্ষ্ম কাজ করা ফারের টুপি; সব মিলিয়ে তাকে পণ্ডিত বলে মান্য না করে যেন উপায় নেই–চিনে বর্ণমালার আশি হাজার অক্ষরই যেন তার নখদর্পণে, তাকে দেখলে এটাই মনে হয়; পেইচিঙের যে-প্রধান ফটক দিয়ে স্বর্গনন্দনদের যাবার অধিকার, সেও যেন তাদেরই একজন। হয়তো চুং হৌর শাদাশিধে ও সদয় সান্নিধ্যে এসে সেই কঠোর বিদ্রোহীটি একেবারে হারিয়ে গেছে, তার বদলে জন্ম নিয়েছে অতীব শান্ত, ভব্য, ধীরস্থির একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক।

সেদিন সন্ধেবেলায় ভোজসভা শেষ হয়ে গেলে কিন-ফো আর ওয়াং দুজনে মিলে শাংহাইতে ফিরে যাবার স্টিমারে ওঠবার জন্যে জেটির দিকে এগিয়ে গেলো। কিন-ফোকে বড্ড চুপচাপ ও বিমনা দেখাচ্ছে; ওয়াং আশপাশে উপরে-নিচে তাকিয়ে দেখছে; কখনো তার চোখে জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে চাঁদের টুকরো, কখনো তারা ঝিকিয়ে উঠছে তার চোখের তারায়; চিরশুদ্ধতার তোরণ পেরিয়ে এলো দুজনে চুপচাপ, পেরিয়ে এলো চির আনন্দের তোরণ, আস্তে চলে এলো পাঁচশো দেবতার প্যাগোডার ছায়া ঢাকা পথ দিয়ে।

পারমাটি তখন এঞ্জিন গরম করে নিচ্ছে রওনা হবে এক্ষুনি, চোঙ দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগল করে। কিন-ফো আর ওয়াং তাদের জন্য নির্দিষ্ট-করা ক্যাবিনে গিয়ে ঢুকলো–দুজনের দুটি আলাদা ক্যাবিন–তক্ষুনি, পার্ল রিভারের জল কেটে চলতে শুরু করলো স্টিমার, রোজ যার চঞ্চল স্রোতে জল্লাদের কুঠারে প্রাণ হারানো লোকেদের মড়া ভেসে যায়। ফরাশিদের কামানের গোলায় ভেঙে-যাওয়া উপকুল পেরিয়ে এলো স্টিমার, চট করে পেরিয়ে এলো নব গল্পের প্যাগোডা, পেরিয়ে গেলো জারডিন পয়েন্ট; ছোটো-ছোটো দ্বীপ আর তীরের মস্ত জাহাজগুলির মধ্যে দিয়ে পথ করে করে সে রাতে একশো মাইল অতিক্রম করে এলো স্টিমার, উষাকালে পেরিয়ে এলো বাঘের মুখ, আর সকালবেলার কুয়াশার মধ্য দিয়ে স্টিমারটির দিকে তাকিয়ে রইলো হংকং-এর ভিক্টরিয়ার ঝাপসা চুড়ো।

পথে কোনো অসুবিধাই হলো না; কিন-ফো আর ওয়াং যথাসময়ে কিয়াংনান প্রদেশের উপকূলে শাংহাইতে এসে নামলো।

.

৩. শাংহাই

চিনে ভাষায় এই মর্মে একটা প্রবাদ আছে : যখন তলোয়ারে মরচে ধরে যায় আর কুড়ুল চকচক করে, যখন জেলখানায় কেউ থাকে না আর গোলাবাড়ি থৈ-থৈ করে, যখন মন্দিরের সিঁড়ি লোকের পায়ের চাপে জীর্ণ হয়ে যায় আর আদালতের উঠোনে আগাছা গজায়, যখন ডাক্তাররা পায়ে হেঁটে বেরোয় আর রুটিওলা যায় ঘোড়ার পিঠে, তখন বুঝবে যে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রবচনে কতটা সত্য আছে কে জানে–কিন্তু এটা ঠিক যে অন্য দেশের বেলায় এই বিবরণ খাটলেও চিনের বেলায় মোটেই খাপ খায় না। চিনে বরং তলোয়ারের ফলাই ঝকমক করে সবসময়, আর কুড়ুল বা কোদালে জং ধরে থাকে; জেলখানায় তোক আঁটে না, কিন্তু গোলাবাড়ি পড়ে থাকে শূন্য; উপোশ করে মরে রুটিওলাই, ডাক্তার নয়; আর প্যাগোডায় হয়তো কতিপয় ধর্মভীরুর ভিড় লেগে থাকে, কিন্তু আদালতে কখনো অপরাধীর সংখ্যা কম থাকে না।

১,৩০০,০০০ বর্গমাইল বড়ো যে-দেশের দৈর্ঘ্য ১৪০০ মাইলেরও বেশি, আর প্রস্থ ৯০০ থেকে ১৩০০ মাইলের মধ্যে, যে-দেশে আঠারোটা মস্ত প্রদেশ রয়েছে, আর রয়েছে মোঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া, তিব্বত, টংকিং, কোরিয়া আর লু-চু দ্বীপ প্রভৃতি কতগুলি করদ রাজ্য, সে-দেশের শাসনব্যবস্থায় যে প্রচুর ত্রুটি থাকবে, তাতে বিচিত্র কী। বিদেশিদের কাছে এই অরাজক অবস্থা তো দিবালোকের মতোই স্বচ্ছ–এবং সম্প্রতি চিনেরাও এ-বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে শুরু করছে। সম্রাট তো ঈশ্বরের পুত্র, জনগণের পিতৃপ্রতিম, জমকালো প্রাসাদে একা থাকেন যিনি, ক্কচিৎ যাঁর দর্শন মেলে, যাঁর মুখের কথাই আইন, জীবমৃত্যুর উপর যাঁর ক্ষমতা চূড়ান্ত, জন্মসূত্রেই এই বিপুল রাজকর যাঁর প্রাপ্য, যাঁর চরণধূলির তলায় সব মস্তকই নত হয় তিনি–কেবল তিনিই হয়তো এই ধারণা করতে পারেন যে তার রাজ্যে সুখশান্তির অভাব নেই; তার চোখ ফোঁটাবার যাবতীয় চেষ্টাই হয়তো ব্যর্থ হতে বাধ্য; যিনি দেবপুত্র তার কি কখনো ভুল হতে পারে, না কি তার পক্ষে ভুল করা কোনো কালে সম্ভব?

কিন-ফো অবশ্য অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে চিনেদের কর্তৃত্বে বাস করার চেয়ে ইওরোপীয় আধিপত্য স্বীকার করে নেয়া অনেক ভালো; ঠিক শাংহাইতে সে থাকে না, বরং শাংহাইর যে-অংশে ইংরেজরা স্বতন্ত্র শাসনকাজ চালায় সেই জায়গাতেই সে নিজের বাড়ি করেছে।

আসল শাংহাই-র অবস্থান ওয়াং-পো বলে একটা ছোটো নদীর বাম তীরে; ঠিক সমকোণ করে এই নদী গিয়ে পড়েছে ইয়াং-সি-কিয়াং বা নীল নদীতে, তারপর পীত সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। শহরটি ডিম্বাকৃতি, উত্তরে দক্ষিণে বিস্তৃত, চারপাশে উঁচু প্রাচীর, আর প্রাচীর পেরিয়ে গেলে পড়া যায় শহরতলিতে শহরতলিতে যাবার রাস্তা পাঁচটি। সরু নোংরা গলিগুলির দশা শান-বাঁধানো পায়ে-চলার পথের চেয়ে কিঞ্চিৎ ভালো; কুলুঙ্গির মতো ছোটো-ছোটো একেকটা দোকান, লোককে আকর্ষণ করার জন্য মালপত্তর সাজিয়ে রাখার কোনো বালাই নেই, দোকানদারেরা অনেক সময়েই খালি গায়ে বসে থেকে বেচাকেনা চালায়; ঘোড়ার গাড়ি বা পাল্কি তো দূরের কথা, ঘোড়সোয়ারের দেখাই মেলে কদাচিৎ; এলোমেলো কতগুলি বৌদ্ধ মন্দির আর বিদেশী গির্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে; আমোদ-প্রমোদের জায়গা বলতে আছে একটি চা-বাগান, একটা স্যাঁতসেঁতে কুচকাওয়াজের মাঠ–আগে নাকি এখানে ধান হতো, তাই জায়গাটা অমন ভ্যাপশা আর ভিজে-ভিজে। এই হচ্ছে শহরটির বৈশিষ্ট্য; সব শুনে মনে হতে পারে লোকে এখানে থাকে কী করে, কিন্তু তবু এখানে অন্তত ২০০,০০০ লোকের বাস, আর বাণিজ্যকেন্দ্র হিশেবে তার গুরুত্বও অবহেলা করার মতো নয়।

বস্তুত নানকিং-এর চুক্তির পর শাংহাইতেই প্রথম ইওরোপীয়রা অবাধ বাণিজ্যের অধিকার পেয়েছিলো, এমনকী তাদের কুঠি তৈরিরও অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। শহর ও শহরতলির বাইরে বার্ষিক শুল্কের বিনিময়ে তিন টুকরো জমি দেয়া হয়েছিলো ইংরেজ, ফরাশি আর মার্কিনদের–আর এই শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা সেখানে দু-হাজারের কম ছিলো না।

এদের মধ্যে ফরাশিদের পাওয়া জমিটুকুই যে সবচেয়ে বাজে, এ-কথা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। শহরের উত্তরভাগে ইয়ং-কিং-পাং নদী পর্যন্ত যে-জমিটুকু আছে তারই মালিক ছিলো ফরাশিরা; ইংরেজদের এলাকা নদীর ওপারে; ল্যাজারিস্ট আর জেসুয়িটরা গির্জে বানিয়েছে এখানে, আর সেই সূত্রে শহর থেকে চারমাইল দূরে সিকাভের কলেজ খোলা হয়েছে, যেখান থেকে পাশ করে চিনেরা ডিগ্রি নেয়। বসতিটা অবশ্য এতই ছোটো যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না; ১৮৬১ সালে দশটি বাণিজ্যিক কুঠি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এখানে–এখন মাত্র তিনটিই কোনোক্রমে টিকে আছে। এমনকী একটা ব্যাঙ্ক ছিলো আগে, সেটাও এখন ইংরেজ বসতিতে গিয়ে ব্যাবসা ফেঁদেছে।

মার্কিন বসতিটা বরং উয়ো-সুং নদীর ধারে, ঠিক যেখানে সমকোণ করে ওয়াং-পো বেঁকেছে; সু-চু খাল সেটাকে ইংরেজ বসতি থেকে আলাদা করে রেখেছে, খালের উপরে রয়েছে একটা কাঠের সাঁকো। মার্কিন বসতির প্রধান দুই অট্টালিকা হলো হোটেল অ্যাস্টর আর মিশন চার্চ। এখানে অবশ্য ছোটোখাটো একটা ডক রয়েছে, মেরামতের জন্য প্রায়ই এখানে মার্কিন ও ইওরোপীয় জাহাজ আসে।

বসতি তিনটির মধ্যে সবচেয়ে উন্নতিশীল যেটি তার মালিক ইংরেজরা। নদীর ধারে-ধারে বারান্দা আর বাগানওলা সুন্দর বাংলো তুলেছে তারা; ধনী সদাগরদের বাড়ি এ-সব; একটা বাড়ি ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কের; ডেন্ট, জারডিন আর রাসেলদের প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে; আর রয়েছে ইংরেজদের ক্লাব, নাট্যশালা, টেনিস-কোর্ট, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গ্রন্থাগার–সব মিলিয়ে লোকে যাকে বলে আদর্শ বসতি। বেশ সুশৃঙ্খল সাজানো-গোছানো জায়গাটা, মঁসিয় লিয় রুসে যার মধ্যে ইংরেজ চরিত্রের গৃহিণীপনা খুঁজে পেয়েছেন।

কেউ যদি হঠাৎ ইয়াং-সি-কিয়াং নদী দিয়ে এখানে ভেলা ভাসিয়ে আসে, তাহলে তাকিয়ে দেখবে একই হাওয়ায় কেমন পৎপৎ করে উড়ছে চারটি পতাকা; তেরঙা ফরাশি নিশেন, ইউনিয়ন জ্যাক, তারা আর ডোরা-আঁকা মার্কিন নিশেন, আর সবুজ ঝাণ্ডায় হলদে ক্রুশচিন সম্রাটের পতাকা।

শাংহাইয়ের জমি সমতল, গাছপালা বিশেষ নেই; সরু পাথুরে রাস্তা, সমকোণ করে পায়ে-চলার পথগুলি একে অন্যকে কাটাকুটি করে গেছে; মস্ত সব জলাধার–ধানখেতে জলসেচের আধার এরা; অসংখ্য খাল কেটে একেবারে মাঠ পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে–অনেকটা হল্যাণ্ডে যে-রকম। আস্ত দৃশ্যটা দেখে মনে হবে ফ্রেমছাড়া একটা সবুজ ল্যাণ্ডস্কেপ বুঝি।

দুপুরবেলায় শাংহাইর পুবদিকের শহরতলিতে স্টিমার এসে জেটিতে ভিড়তেই কিন-ফো আর ওয়াং নেমে পড়লো। চারদিকে প্রচণ্ড ভিড় আর হৈ-চৈ। নদীতে জাঙ্কের সংখ্যা হবে কয়েকশো, তাছাড়া আছে প্রমোদতরী, গণ্ডোলার মতো দেখতে শাম্পান, ভেলা–যেন একটা ভাসমান নগরী। নগরীই বটে, কারণ অন্তত ৩০,০০০ লোক বাস করে এ-সব ডিঙিতে আর শাম্পানে–এরা সবাই নিচুতলার মানুষ : এদের মধ্যে সবচেয়ে যে ধনী সেও কোনোদিন ভুলেও মান্দারিন হবার স্বপ্ন দ্যাখে না। জেটিতেও, নদীর মতোই, পিঁপড়ের সারির মতো লোকের বাস; কত ধরনের যে লোক কে জানে– সদাগর, কমলাওলা, ফিরিওলা, নানা দেশের মাঝি-মাল্লা, ভিস্তিওলা, ভাবীকথক আর জ্যোতিষী, বৌদ্ধ ভিক্ষু, ক্যাথলিক পাদ্রি, সেপাই-শাস্ত্রী, কোতোয়ালির লোক, দোভাষি, ইওরোপীয় ব্যাবসাদারদের দালালকেই বা নেই!

আস্তে ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলো দুই বন্ধু। কিন-ফোর হাতে শৌখিন হাত-পাখা; উদাসীন অবহেলার ভঙ্গি তার, তারসঙ্গে এই ভিড়ের যেন কোনো যোগই নেই। ওয়াং তার ছাতা খুলে মাথায় দিয়েছে, ছাতার হলদে কাপড়ে কালোকালো দৈত্যদানোর মূর্তি-আঁকা; হেঁটে যেতে-যেতে সে কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে আশপাশের সব কিছু লক্ষ করতে ভুলছে না। পূর্ব-তোরণ পেরিয়ে আসার পর হঠাৎ তার চোখে পড়লো দশবারোটা বাঁশের খাঁচা : আগের দিন যে-সব অপরাধীর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের ছিন্নশিরে খাঁচাগুলো ভর্তি।

শিরচ্ছেদ না-করে যদি তাদের মাথায় একফোঁটা জ্ঞান ঢুকিয়ে দিতো, বিড়বিড় করে বললো সে আপন মনে।

এ-কথা কিন-ফোর কানে পৌঁছোয়নি; পৌঁছেলে হয়তো কোনো প্রাক্তন তাই-পিং-এর মুখে একথা শুনে অবাক হয়ে যেতো।

জেটি ছেড়ে, প্রাচীরের পাশ দিয়ে ঘুরে, তারা ফরাশি বসতির কাছে এসে পড়লো। লম্বা নীল আল্লখালা-পরা একটি লোক ফাঁপা একটা মোষের শিঙে ছড়ির ঘা দিয়ে লোক জড়ো করার চেষ্টা করছে-হঠাৎ তারা দেখতে পেলে।

দ্যাখো-দ্যাখো, ওয়াং চেঁচিয়ে উঠলো, একটা সিয়েন-চেং!

তো কী? জিগেশ করলো কিন-ফো।

কেন, ভালোই তো হলো। তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো–লোকটা তোমার ভবিষ্যৎ বলে দেবে! উত্তর দিলে দার্শনিক।

নিজের ভবিষ্যৎ জানার কোনো গরজ ছিলো না কিন-ফোর। তবু ওয়াং-এর কথায় সে থেমে দাঁড়ালো।

সিয়েন-চেং বলে ভাবীকথক বা গণকদের, কয়েক সাপেকের বিনিময়ে তারা বলে দেয় ভবিষ্যতের গর্তে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। চৌষট্টিটা তাশের একটা প্যাকেট থাকে তার কাছে, আর থাকে ছোট্ট খাঁচায় একটি পাখির ছানা : সুতো দিয়ে বোতামের গর্তের সঙ্গে বাঁধা থাকে খাঁচাটা, আর তাশের প্যাকেটের মধ্যে থাকে দেবতা, মানুষ আর জন্তুজানোয়ারের ছবি। চিনেরা এমনিতেই বড্ড কুসংস্কারে ভোগে, কত যে অলক্ষণ কুলক্ষণ দেখতে পায় তারা চারপাশে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই, কিন্তু কোনো সিয়েন-চেংকে দেখলে তো আর কথাই নেই, একবারে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে।

ওয়াং-এর ইঙ্গিতে লোকটা মাটির উপর এক টুকরো কাপড় বিছিয়ে দিয়ে পাখির খাঁচাটা তার উপর রাখলে। তারপর তার তাশের প্যাকেট বার করে ভালো করে ফেটিয়ে নিলে, নানাভাবে শাফল করলে, তারপর ওই কাপড়ের উপর এক-এক করে তাশগুলো উলটো করে বিছিয়ে দিলে। খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে তারপর সে একটু সরে গেলো, যাতে পাখিটা বেরিয়ে আসে। আস্তে তিড়িং একটা লাফ দিয়ে বেরুলো পাখির ছানা, একটা তাশ তুলে ধরলো ঠোঁটের ভঁজে, তারপর আবার লাফিয়ে খাঁচায় ঢুকে গেলো। দু-একটা গমের দানা বখশিশ দেয়া হলো পাখিটাকে। তারপর চিৎ করে ফেলা হলো তাশটা। তাশটায়, দেখা গেলো, একটি মনুষ্যমূর্তি আঁকা আর উত্তরের সরকারের ভাষা কুনান-রুনায় ছোট্ট একটি নীতিবাক্য লেখা তার তলায়। কুনান-রুনা জানে কেবল শিক্ষিত লোকেরা, সাধারণ লোকের কাছে এ-ভাষা ক্লাসিকাল গ্রিক ভাষার মতোই কঠিন। তাশটি তুলে নিয়ে সিয়েন-চেং এবার সরকারিভাবে দেখালো তাদের, তারপর জগৎ-জোড়া ভাবীকথকরা যে-মস্ত গল্প ফেঁদে মক্কেলকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে, তারই অবতারণা করলে : ভীষণ একটা বিপদ ঘনাচ্ছে, বিষম বিপত্তি যাকে বলে–তারপর দশ হাজার বছর ধরে সুখ শান্তি সন্তোষ।

তা খুব-একটা খারাপ নয়, কী বলো! কিন-ফো অমায়িকভাবে মন্তব্য করলে, এক-আধটা বিপত্তি আর তেমন কী! একটা তায়েল ছুঁড়ে দিলে সে শাদা কাপড়ের উপর। ক্ষুধার্ত কুকুর যেমন করে হাড়ের টুকরোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাবীকথকটি ঠিক যেন তেমনি ভাবে ওই রজত মুদ্রাটি আঁকড়ে ধরলো : কার মুখ দেখে সে উঠেছিলো কে জানে, আস্ত একটা রুপোর ঝিলিক তো আর রোজ চোখে পড়ে না।

আবার দু-বন্ধু নিজেদের গন্তব্যপথে অগ্রসর হলো। ফরাশি বসতির কাছে এগিয়ে এলো তারা। ওয়াং তখন মনে-মনে ভাবছে, কী আশ্চর্য, আমি যা বলেছিলুম তার সঙ্গে এই ভাবীকথন কেমন অদ্ভুত মিলে গেলো! এদিকে কিন-ফোর দৃঢ় বিশ্বাস যে সত্যিকার কোনো বিপত্তিতে সে পড়তেই পারে না। ফরাশি দূতাবাস পেরিয়ে গেলো তারা, পেরিয়ে এলো ইয়াং-কিং-পাঙের সরু কাঠের সাঁকোটা, ইংরেজ বসতিতে ঢুকে পড়লো তারপর, ইওরোপীয়দের প্রধান জাহাজঘাটা পর্যন্ত হেঁটে গেলো।

জাহাজঘাটায় পৌঁছুতেই বেলা বারোটার ঘণ্টা পড়লো–চিনেরা বারোটার পর আর লেনদেন করে না, সেদিনকার মতো ব্যাবসায় ইতি পড়ে সেখানেই। হঠাৎ যেন মন্ত্রবলে বিকিকিনির হৈ-চৈ আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেলো, যেন কোনো জাদুকাঠির ছোঁয়ায় ইংরেজ বসতির শোরগোল থেমে গিয়ে সব স্তব্ধ ও চুপচাপ হয়ে গেলো।

বন্দরে তখন সবেমাত্র কয়েকটা জাহাজ ঢুকেছে–বেশির ভাগ জাহাজেরই মাস্তুলে উড়ছে ইউনিয়ন জ্যাক। শতকরা নব্বইটা জাহাজই বোধহয় আফিমে ভর্তি : শতকরা তিনশো টাকা লাভ করে ইংল্যাণ্ড চিনকে এই ভীষণ নেশা সরবরাহ করে।–চৈনিক সরকার মিথ্যেই এই আফিম রপ্তানি বন্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু ইংরেজদের কিছুতেই হঠাতে পারেনি; বরং ১৮৪১ সালের যুদ্ধ আর নানকিংয়ের চুক্তির ফলে ইংরেজরা অবাধ বাণিজ্যের অধিকার পেয়েছে; পেইচিঙের শাসনদপ্তর যদিও এটা ঘোষণা করেছে যে কোনো চিনেকে যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আফিম রপ্তানির কাজে লিপ্ত দেখা যায় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, তবু একটা-না-একটা আইনের ফাঁক বের করে লোকে সহজেই শাস্তি এড়িয়ে যায়। জনরব যে শাংহাই-এর মান্দারিন রাজ্যপাল নাকি কোনো কিছু লক্ষ না করে চোখ বুজে থাকেন বলে প্রতি বছরই তার নামে নির্দিষ্ট বেতন ছাড়া আরো কয়েক হাজার পাউণ্ড ব্যাঙ্কে জমা পড়ে।

এটা অবশ্য এখানে বলা উচিত যে কিন-ফো বা ওয়াং দুজনের কেউই কোনোদিনও চণ্ডু টেনে দ্যাখেনি; আর ঘণ্টাখানেক পরে তারা দুজনে যে চমৎকার বাড়িটিতে এসে পৌঁছুলো তার অন্দরমহলে ওই ভীষণ বিষের একটি তোলাও কোনোদিন ঢোকেনি।

ভয় না দেখিয়ে দেশের লোককে বরং শেখানো উচিত!

ওয়াং কেবলই এ-কথা বলে; আগেকার দিনের তাই-পিং আদর্শকে ভুলে গিয়ে সে আরো বলে : জানি বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, কিন্তু দর্শনচর্চা তার চেয়ে ঢের ভালো!

.

৪. কিন-ফোর আলস্য

সমান্তর কতগুলো দালানের সারি পরস্পরকে সমকোণে ভেদ করে গেছে : ইয়ামেন নামের বিলাসভবনগুলি দেখতে এ-রকম। এমনিতে অবশ্য সম্রাটই স্বয়ং সবগুলি ইয়ামেনের মালিক; ধনী মান্দারিন ছাড়া আর-কারু সেখানে থাকার অধিকার নেই; কিন্তু যাদের বিস্তর টাকাকড়ি আছে, তাদেরও অবশ্যি এখানে থাকতে বাধা নেই। কিন-ফো ঠিক এমনি একটি বিলাসভবনেই বাস করে।

ভবনটির চারপাশে, বাগান আর উঠোন ঘিরে মস্ত একটা দেয়ালতোলা : কিন-ফো আর ওয়াং তারই প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকলো। কোনো মান্দারিন ম্যাজিস্ট্রেট ইয়ামেনে থাকলে, ছবি-আঁকা সুসজ্জিত দেউড়িতে মস্ত একটা ঢাক থাকতত; দিনে-রাতে যে-কোনো সময়ে যে-কোনো লোক নালিশ জানাতে আসতে পারে এখানে; এসেই প্রথমে তাকে ঢাকে কাঠি দিয়ে তার আগমন বার্তা ঘোষণা করতে হবে; কিন্তু যেহেতু এটা কোনো সরকারি চাকুরের ভবন নয়, সেই জন্য দেউড়িতে সেই ঢাকের বদলে এখন রয়েছে মস্ত সব পোর্সেলেনের জ্বালা, পথচারীদের জন্য সর্দার খানশামা একটু পরে-পরে এসে তা ঠাণ্ডা চায়ে ভর্তি করে দিয়ে যায় : কিন-ফোর এই বদান্যতার জন্য পাড়া-পড়শিরা তাকে বরং বেশ পছন্দই করে!

প্রভুর আগমন-বার্তা শুনে বাড়িশুদু লোক এই দেউড়িতে ভিড় করে দাঁড়ালো : পরিচারক, খানশামা, বাজার-সরকার, কোচোয়ান, ঘড়িবাবু, বাবুর্চি, মালি–সবাই প্রধান গোমস্তার নেতৃত্বে এসে দাঁড়ালো দেউড়িতে, তাদের পিছনে রইলো দশ-বারোটি কুলি, মাস-মাইনের কাজ করে তারা, অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজই করে থাকে তারা, কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য, মাটি কোপায়, ঘর ঝট দেয় বা ওই জাতীয় অন্যসব কাজ করে।

প্রধান গোমস্তা ওরফে নায়েব প্রভুকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলো, কিন্তু কিন-ফোন তাচ্ছিল্যভরে হাত নেড়ে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে-যেতে জিগেশ করলো : সুনকে দেখছিনে তো? সে কোথায়?

ওয়াং হেসে ফেললো। সুনের কারবারই ওই রকম! ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় যদি ওকে দেখা যাবে তাহলে ও আর সুন হবে কী করে?

কিন-ফো আবার জিগেশ করলে, সুন কোথায়!

নায়েব কেবল জানালে যে তা বলা খুবই মুশকিল–শুধু সে-ই নয়, অন্য-কেউই বোধহয় জানে না সুনের কী হয়েছে, বা সে কোনখানে রয়েছে।

সুন হলো কিন-ফোর খাশ ভৃত্য, শুধু তারই বিশেষ তদারকির জন্যে নিযুক্ত–কিছুতেই তাকে ছেড়ে-থাকার কথা কিন-ফো ভাবতে পারে না। তাই বলে ভৃত্য হিশেবে সুন কিন্তু আদৌ সেরা জাতের নয়। বরং একটা কাজ করতে গিয়ে সে আরেকটা করে আসে, একখানা দিলে তিনখানা করে আনে, তিনখানা দিলে একখানা রাখে–বাকিগুলোর কোনো হদিশই জানে না; যেমন কাজে তেমনি কথায়–কিছুই তার ঠিক থাকে না, কখনো না। লোভর একশেষ, ভিতুর হদ্দ, ভীষণ পেটুক : পরদায় কি চায়ের পেয়ালায় চিনেদের যেমন আঁকা হয়, হুবহু তারই এক জ্যান্ত সংস্করণ। এমনিতে অবশ্য তাকে বিশ্বাসীই বলতে হয়, আর তার বিশেষ-একটা মূল্যও আছে; শুধু সে-ই তার প্রভুকে নানা কাজে-কর্মে উশকে দিতে পারে। দিনের মধ্যে অন্তত বারো বার কিন-ফো সুনের উপর রেগে চ্যাঁচামেচি শুরু করে দেয়–সুন অবিশ্যি সব গালাগাল এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দেয়–কিন্তু তার ফলে অন্তত সাময়িকভাবেও যে কিন-ফো তার অনীহা ও ঔদাসীন্য থেকে জেগে ওঠে, এটাই যা মস্ত লাভ।

মাঝে-মাঝে বিবেক যখন চাড়া-দিয়ে ওঠে, তখন চিনে ভৃত্যরা প্রভুর কাছে এসে মাথা পেতে দাঁড়ায় শাস্তি নিতে : আর দিনের মধ্যে কয়েকবার সাজা নিতে না-এলে সুনের বোধহয় কোনো খাদ্যই হজম হতো না। প্রভুও এ-সব ক্ষেত্রে ভৃত্যকে যে ছেড়ে কথা কইতেন, তা নয়; ভৃত্যের পিঠে কয়েক ঘা চাবুক কশানো তো কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিরই শামিল; কিন্তু যে-শাস্তিটাকে সুন সবচেয়ে ভয় পেতো তা চাবুক নয়; বরং তার সাধের বেণীর এক-আধ ইঞ্চি খোয়া গেলেই সে একেবারে কেঁচো। অপরাধের মাত্রা প্রবল হলেই কিন-ফো কঁচি দিয়ে তার বেণী কেটে নিতে।

কোনো চিনের কাছে বেণীর চাইতে গৌরবের আর কিছুই নেই। বেণী খোয়াবার জ্বালা কি মরলেও কমে!

ছার এই জীবন, শত ধিক একে–যদি বেণীই খোয়া গেলো! চার বছর আগে সুন যখন প্রথম কিন-ফোর কাছে এসে চাকরি নেয়, আহা, তখন তার বেণী কী মস্তই না ছিলো–লম্বায় চার ফুট তো হবেই নিদেন; কিন্তু এ-ক-বছরে এত বার সে গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছে যে এখন বেচারির বেণী কিছুতেই দু-ফুটের বড়ো নয়; যদি এই হারে তার বেণী ছোটো হতে শুরু করে–কী সর্বনাশ–তাহলে অল্প দিনেই তো তার মাথায় চকচকে ঝকঝকে টাক পড়ে যাবে!

দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ি ঢুকলো কিন-ফো, বাগানও পেরিয়ে এলো–পিছনে সসম্ভ্রমে ভৃত্যরা তাকে অনুসরণ করলে। টেরাকোটা-করা মাটির টব–তাতেই গাছ পোঁতা; সবগুলি গাছই কেটে-হেঁটে কিস্তৃত মূর্তি বানানো হয়েছে–অদ্ভুত সব জন্তুজানোয়ারের চেহারা গাছগুলোর। বাগানের মাঝখানে ছোট্ট একটা ঝিল, তাতে লাল-নীল-সোনালি মাছ খেলা করে বেড়ায়; শ্যাওলা আর লাল পদ্মের পাতায় জল দেখা যায় না; পাশেই একটা দেয়ালের গায়ে ঝকঝকে রঙে কিংবদন্তির কোনো ভীষণ প্রাণীর মূর্তি আঁকা; সেটা পেরিয়ে গেলে পর মূল বাড়ির দুয়ার চোখে পড়ে।

মূল বাড়িটা দোতলা : মারবেল পাথরের সিঁড়ি ধাপে-ধাপে উঠে গেছে একতলার উঁচু বারান্দার দিকে। বেতের তৈরি পরদা ঝোলে উপরে, দরজায় আর জানলায়-যাতে গরমে বেশি কষ্ট পেতে না-হয়। বাড়িটার ছাত সমতল–আশপাশের পলেস্তরা-খশা ইটকাঠের বাড়ির কার্নিশ আর আঁকাবাঁকা টালির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না।

যে-কটা ঘরে কিন-ফো আর ওয়াং থাকে, সেগুলো ছাড়া ভিতরের বাকি ঘরগুলো মস্ত হলঘরের মতো-ঘরগুলিতে মস্ত সব দেরাজ আর সিন্দুক, তাদের কবাটের উপর কত রকম যে ছবি আঁকা :একটাতে হয়তো ফলে-ফুলে ভরা কোনো বাগানের ছবি, অন্যটায় হয়তো নানা প্রবচন আর আপ্তবাক্য খোদাই-করা-যা দেখে ধর্মভীরুরা তুষ্ট হয়। বসার ব্যবস্থা আছে যত্র ত–কোনোটা টেরাকোটা, কোনোটা পোর্সেলেনের–কাঠ বা মারবেলও বাদ যায়নি–কিন্তু তাই বলে প্রতীচীর মতো কুশান-দেয়া সোফা-সেটও কম নেই। নানা রকম লণ্ঠন ঝুলছে কড়িকাঠ থেকে, চিনে-জাপানি, কোথাও রঙিন ঝালর পরানো–কোথাও-বা ইস্পাহানিদের ঝাড়লণ্ঠন থেকে রেশমি ঝাপ্পা নেমে এসেছে নিচে। এক ধরনের আশবাবের তো বোধকরি লেখাজোখা নেই–তা হলো চা-কি-বা ছোট্ট চায়ের টেবিল–হাত বাড়ালেই যাতে একটা চা-কি মেলে, সেইজন্যেই এই ব্যবস্থা।

যে-সব টুকিটাকি জিনিশ নিয়ে ঘর সাজানো, তা-ই দেখেই হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাবে। হাতির দাঁত, মুক্তো, মিনে-করা ব্ৰঞ্জ–কত-টুকিটাকি যে ছড়িয়ে আছে কে জানে। কতরকম ধুপতি, পান্না-বসানো সোনার গন্ধদানি, তেফলা কাঁচের ফুলদানি; সব মিঙ আর সিং রাজবংশের স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে; আছে আরো দুর্লভ সামগ্রী-ইয়েন যুগের পোর্সেলেনের জিনিশ, হলদে-গোলাপি রঙের স্বচ্ছ এনামেলের শৌখিনতা-যা বানাবার কৌশল একালের লোকের কাছে অফুরান রহস্য বলে ঠেকে। চারপাশে চোখ চেয়ে দেখুন একবার, তাহলেই বুঝতে পারবেন বিলাস কাকে বলে : প্রাচীকে এ-বিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে প্রতীচীও–আরাম, সৌন্দর্য, জাঁকজমক, কিছুরই কোনো অভাব নেই এখানে।

মানুষটা কিন-ফো বেশ উদার ও প্রগতিশীল-যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে; পশ্চিমের সভ্যতার দিকে সে নাক উঁচু করে বাঁকা চোখে তাকায় না, নতুন-কোনো আবিষ্কারকে বাধা দিতে সে হচ্ছে শেষ ব্যক্তি। বিজ্ঞানের যে-কোনো প্রকাশকেই সে সমর্থন করে; বৈদ্যুতিক তার কেটে ফেলে দেয় যে-সব বর্বর, তাদের সঙ্গে তার কোনো সংস্রব নেই; সেই সব গোঁড়া প্রাচীনপন্থী মান্দারিন-যারা শাংহাই আর হংকং-এর মধ্যে জলের তলায় টেলিগ্রামের লাইন বসাতে দেয়নি–তাদের প্রতিও তার কোনো অনুরাগ নেই। বরং ফরাশি কারিগরদের পরিচালনায় ফু-চুতে ডক বানাতে যে-দল সরকারকে চাপ দিয়েছিলো, সরাসরি সমর্থন করেছিলো, কিন-ফো তাদেরই একজন। তিয়েনৎসিন আর শাংহাইয়ের মধ্যে যে চায়না স্টিমশিপ কম্পানি জাহাজ চালায়, তার অনেক শেয়ার কিনেছে সে; সিঙ্গাপুর থেকে দ্রুতগামী জাহাজে করে চারদিনে যারা পশ্চিমের সঙ্গে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করতে চায়, তাদের নতুন উদ্যমে সে প্রচুর টাকা ঢেলেছে।

এমন-কোনো আধুনিক বৈজ্ঞানিক অবদান নেই, যা সে নিজের বাড়িতে ব্যবহার করে না। টেলিফোন বসিয়েছে সে বাড়িতে, যাতে ইয়ামেনের সব অংশের সঙ্গেই সর্বদা যোগাযোগ রাখতে পারে; প্রত্যেক কোঠায় বসিয়েছে বৈদ্যুতিক ঘণ্টা; ঠাণ্ডার দিনে যখন তার চুল্লিতে গ্যাস জ্বলে, তখন তার দেশের অন্যলোকেরা লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে শীতে কাঁপে; আর আজকাল সে নিজের হাতে কিছু লেখার পরিশ্রম করতে চায় না-ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লেখার দরকার হলে কেবল এডিসনের নতুন আবিষ্কার ফোনোগ্রাফের সাহায্য নেয়।

সব সত্ত্বেও কিন্তু কিন-ফো মোটেই সুখী নয়;-মরলোকে কেউ ভোগ-বিলাসের জন্য যা-কিছু কামনা করে, সব সে জোগাড় করতে পারে। মুখের কথা খশালেই–এত তার ঐশ্বর্য–কিন্তু তবু ওয়াং তার ছাত্রকে সেই দর্শনশাস্ত্রে দীক্ষা দিতে পারেনি, যা মানুষকে সুখী করে। তার ওই জাড্য, ওই বিপুল নির্বেদ থেকে সুনের উজবুক ক্রিয়াকলাপ মাঝে-মাঝে তাকে জাগিয়ে তোলে, এটা সত্যি; কিন্তু তবু কোথায় যেন মস্ত একটা ফাঁক থেকে গেছে, যার ফলে কোনোকিছুতেই তার মন ওঠে না, সবকিছুতেই কেমন একটা অরুচির ভাব লেগেই আছে।

মস্ত একটা হলঘরে এসে ঢুকলো সে; যে-কোনো ঘরে ঢোকা যায় এ-ঘর থেকে; কিন্তু সুনের কোনো দেখা নেই। কারণটা এবার স্পষ্ট অনুমান করা যায়; নিশ্চয়ই সুন কোনো গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, আর তাই লুকিয়ে আছে, কিছুতেই দেখা দিতে চাচ্ছে না; যাতে অন্তত আরো কিছুক্ষণ সাধের বেণীটিকে প্রভুর হাত থেকে নিরাপদ রাখতে পারে!

অধীর হয়ে কিন-ফো হাঁক পাড়লে : সুন! সুন!

ওয়াংও গলা মেলালো : সুন!

এই হাঁকডাক সুনের কানে পৌঁছুলো কিনা কে জানে–তবে সে যে তার গোপন জায়গা থেকে একচুলও নড়লো না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নাঃ, লোকটা সংশোধনের অতীত, ওয়াং বললে, কোনো দর্শনই তাকে মানুষ করতে পারবে না!

কিন-ফো রেগে মাটিতে পা-ঠুকে নায়েবকে ডাক দিলে। যাও, সুনকে খুঁজে বার করো–এক্ষুনি আমার কাছ পাঠিয়ে দাও ওকে।

বাড়িশুদু লোক চঞ্চল হয়ে উঠলো : নিরুদ্দেশ ভৃত্যটির সন্ধান চাই!

ওয়াং যখন দেখলো যে ঘরে সে আর কিন-ফো ছাড়া আর-কেউ নেই, তখন সুযোগ পেয়ে পণ্ডিতিয়ানা জাহির করলে : এবার বিশ্রাম করা উচিত শ্রান্ত পথিকের : আক্কেল অন্তত তাই বলে।

হ্যাঁ, না-হলে হয়তো আক্কেলসেলামি দিতে হবে, কিন-ফো উত্তর দিলে। যে যার ঘরে গিয়ে ঢুকলো তখন।

একটা নরম কৌচের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে কিন-ফো সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করলো। আর, স্বভাবতই, যাকে সে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছে, সেই সুন্দরী ও অভিজাত তরুণীটির কথা ভাবতে শুরু করলো সে একটু পরেই। তরুণীটি থাকে পেইচিঙে। সেখানে গিয়েই মেয়েটির সঙ্গে মেলবার কথা কিন-ফোর। সে যে শিগগিরই পেইচিং যাবে, এ-কথা মেয়েটিকে জানাবে কিনা, এবার তা-ই ভাবতে বসলো কিন-ফো। তার বিরহে সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এমনি একটা ভঙ্গি করাই হয়তো ভালো; তাছাড়া সত্যি তো তার ভালোবাসা আন্তরিক ও অকৃত্রিম। অন্তত ওয়াং-এর মতো যুক্তিশীলের তো এ-বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। আর হয়তো তাকে বিয়ে করেই সে জীবনে প্রথমবার সুখী হবে–এতদিনে হয়তো জানতে পারবে সুখ কাকে বলে, বেঁচে-থাকার আনন্দ কী।

আস্তে-আস্তে তার চোখের পাতা বুজে এলো; ঝাঁপশা ও অস্পষ্ট হয়ে উঠলো তার ভাবনা; বুঝি ঘুমেই ঢুলে পড়তো, কিন্তু এমন সময় তার ডান হাতের চেটোয় কে যেন আলতো শুড়শুড়ি দিলে; চট করে হাত মুঠো করে বুঝতে পেলো যে, মুঠোর মধ্যে একটা ছড়ি চলে এসেছে। কী ব্যাপার বুঝতে তার মোটেই দেরি হলো না। তার প্রিয় ভৃত্যেরই কীর্তি এটা, পা টিপেটিপে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার হাতে একটা ছড়ি গুঁজে দিয়েছে; এবার সুনের মোলায়েম গলা শোনা গেলো; হুজুর যখন ইচ্ছে করবেন

ধড়মড় করে উঠে বসলো কিন-ফো, ছড়ি তুলে মারতে গেলো সুনকে। অমনি সুন ঘরের দামি পারস্য গালিচায় উপুড় হয়ে পড়লো। বাঁ হাত দিয়ে মাটিতে ভর রেখে ডান হাতে একটা চিঠি বাড়িয়ে ধরলো; আপনার চিঠি–আপনার নামেই এসেছে!

রাস্কেল! কোথায় ছিলি তুই এতক্ষণ!

আই-আই-ইয়া! সুন আর্তনাদ করে উঠলো, বিকেলের আগে আপনি ফিরবেন বলে ভাবিনি! মারুন আমাকে, কষে পিট্টি দিন–মাথা পেতে নেবো

আমি সব–হুঁজুর যখন ইচ্ছে করবেন–

কিন-ফো রেগে ছড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিতেই সুনের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

বল, কেন তুই পিট্টি খেতে চাচ্ছিস? কী করেছিস তুই–এক্ষুনি বল—

সুনের যেন দম ফুরিয়ে গেছে। এই চিঠিটা—

চিঠি তো বুঝলাম, কিন্তু হয়েছে কী,–বলে কিন-ফো তার হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিলো।

মনেই ছিলো না এটার কথা। কোয়াংতুং যাবার আগে আপনাকে এটা দেবার কথা ভুলে গিয়েছিলুম।

এক সপ্তাহ আগে এসেছে। তবে রে বেআক্কেলে–আয়, এদিকে আয়!

সুন প্রায় কেঁদেই ফ্যালে। আমি তো একটা কাঁকড়া মাত্র–আয় আবার একটাও দাঁড়া নেই!

আয় বলছি! কিন-ফো প্রচণ্ড ধমক দেয়।

আই-আই-ইয়া! সুন কেঁদে ফ্যালে।

এই আই-আই-ইয়া হলো চরম হতাশার অভিব্যক্তি। কিন-ফো ততক্ষণে বেচারি সুনের বেণী টেনে ধরেছে, এবার পাশ থেকে একটা ছোট্ট কচি তুলে নিয়ে কচ করে বেণীর ডগা কেটে ফেললো।

কাঁকড়াটি অবশ্যি পরক্ষণেই তার দাঁড়া দিয়ে গালিচার উপর থেকে চুলের গোছা তুলে নিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তেইশ ইঞ্চি ছিলো বেণীটা এ-ঘরে ঢোকবার আগে হায়রে, আর মাত্র বাইশ ইঞ্চি রইলো!

আবার কৌচে এলিয়ে পড়লো কিন-ফো। সুন চলে যেতেই তার সব উত্তেজনা কেটে গেছে। সুনের দায়িত্বহীনতায় বড্ড চটে গিয়েছিলো সে; চিঠিটা সম্বন্ধে এমনিতে তার কোনো কৌতূহলই ছিলো না। কোনো চিঠি নিয়ে বিচলিত হবার আবার কী আছে?

আবার ঢুলুনি এলো তার; চেষ্টা করে চোখ খুলে আনমনাভাবে সে হাতের লেফাফাটার দিকে তাকালো একবার। বড় পুরু ঠেকছে খামটা, টিকিটের রঙ লাল আর বাদামি–দুই আর ছয় সেনট্‌ করে দাম, মার্কিন চিঠি, বোঝা যাচ্ছে।

লিখেছে নিশ্চয়ই আমার সানফ্রান্সিসকোর সংবাদদাতা! খামটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিলে সোফার ওপাশে! হয়তো ক্যালিফরনিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের শেয়ারের দর চড়েছে লাভের অঙ্ক হয়তো মোটা হয়েছে, তা-ই সে জানিয়েছে! তা হোক গে–এতে আমার কিছু এসে-যায় না! কিন্তু মনে-মনে এ-কথা ভাবলেও আপনা থেকেই একটু পরে হাতটা গিয়ে পড়লো আবার চিঠির উপর। খামটা খুলে নিয়ে প্রথমে সে নিচের দস্তখটা দেখে নিলে।

যা ভেবেছিলুম!আপন মনেই বললে সে, আমেরিকার এজেন্টেরই চিঠি দেখছি! তা এ-চিঠি কাল পড়লেও চলবে।

চিঠিটা আবার সে সরিয়ে রাখতে যাচ্ছিলো, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ দায়িতা কথাটায় তার চোখ আটকে গেলো। দ্বিতীয় পাতার উপরে বড়ো-বড়ো করে কথাটা লেখা–তলায় দাগ দিয়ে আরো জোর দেয়া হয়েছে কথাটায়, দেখে তার কৌতূহল অস্বাভাবিক রকম উশকে উঠলো : পুরো চিঠিটাই সে পড়ে ফেললে এবার। পড়তে-পড়তে একবার কেবল মুহূর্তের জন্য তার ভুরু কুঁচকে গিয়েছিলো, কিন্তু চিঠিটা শেষ করার আগেই তার ঠোঁটের ভঁজে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো আবার।

সোফা থেকে উঠে সে গিয়ে টেলিফোনের সামনে দাঁড়ালো, ওয়াংকে টেলিফোনে ডাকবে ভেবে রীসিভার তুললো মুখের সামনে, কিন্তু পরক্ষণেই কী ভেবে আবার রীসিভার নামিয়ে রেখে ফিরে এসে শুয়ে পড়লো সোফায়। তারপর অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের ভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো : ফুঃ! পরক্ষণেই আবার বিড়বিড় করে নিজের মনে বললে, আমার কাছে না-হয় এর কোনো দাম নেই–কিন্তু ওর কাছে? ওর কাছে তো ওটা হেলাফেলার কিছু নয়।

আবার সে উঠে পড়লো সোফা থেকে; ছোট্ট একটা গালার টেবিলের উপর চৌকোনো একটা বাক্স ছিলো কারুকাজ-করা-কাছে গিয়ে বাক্সটা খুলতে গিয়ে ও থেমে গেলো সে, নিজের মনেই বললো, শেষ চিঠিতে ও কী লিখেছিলো আমাকে?

বাক্সের ডালা না-খুলে সে বরং তার পাশের একটা স্পিঙে চাপ দিলে, অমনি নারীকণ্ঠের মৃদু মর্মর শোনা গেলো ঘরের মধ্যে: ভাই আমার! কেমন লাগে তোমার আমাকে? প্রথমবার চাঁদের মাইহোয়া ফুলের চেয়েও সুন্দর? দ্বিতীয়ার চাঁদের আলোয় ফুলে-ওঠা খুবানির চেয়েও মিষ্টি? তৃতীয়ার চাঁদের জ্যোৎস্নার ঝলমল-করা পীচ ফলের চেয়েও মধুর? লাগে না কি? তোমার জন্যে দশ হাজার ভালোবাসা রইলো।

বেচারা! দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললে কিন-ফো। বাক্সের ডালা খুলে কতগুলো ফুটকি-বসানো টিনের পাতটা তুলে ফেলে নতুন আরেকটা টিনের চাক্তি বসালে সে। এই বাণী-মাধুরী বহন করে এনেছে ফোনোগ্রাফ, যা কিনা এডিসন সবেমাত্র এই সেদিন আবিষ্কার করেছেন।

এবার কিন-ফো নিজে এই রহস্যময় ছোট্ট কলটির উপর ঝুঁকে পড়লো। কথা বলতে গিয়ে সে যেন তখনো কিছুক্ষণ ধরে সেই স্বচ্ছ, নরম নারীকণ্ঠের মৃদু মর্মর শুনতে পাচ্ছিলো–কিন্তু তার চোখে-মুখে কোনো ভাবই ফুটলো নানা দুঃখের, না আনন্দের। কথা তার অল্পই ছিলো। কথা শেষ হতেই সে কলটা থামিয়ে দিলে; তারপর তুলে নিলে সেই টিনের চাক্তি, যার উপর ছোট্ট একটা উঁচ তার কথা গেঁথে রেখে গেছে; চাক্তিটা একটা খামে পুরে সে ডানদিক থেকে ঠিকানা লিখলো :

মাদাম লা-ও

চা-কোআ অ্যাভিনিউ

পেইচিং

বৈদ্যুতিক ঘণ্টায় চাপ দিতে না-দিতেই একটি ভৃত্য এসে ঘরে ঢুকলো। তক্ষুনি কিন-ফো তার চিঠি ডাকঘরে পাঠিয়ে দিলে!

ঘণ্টাখানেক কেটে গেলো। আবার গিয়ে শুয়ে পড়লো কিন-ফো। বেতের তৈরি চু-ফু-দজন বা ঠাণ্ডা বালিশে হাত রেখে শুয়ে পড়তেই চট করে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

.

৫. দুঃসংবাদ

এখনো আমার কোনো চিঠি আসেনি, বুড়ি-মা?

না, মাদাম, এখনো তো এলো না।

পেইচিঙের চা-কোআ অ্যাভিনিউতে নিজের ঘরে বসে সেদিন অন্তত দশবার এই প্রশ্ন করেছে সুন্দরী লা-ও, আর তার বুড়ি দাসী নান তাকে প্রতিবারই এই উত্তর দিয়েছে; নান তার দাসী হলে কী হয়, লা-ও তাকে চিনে প্রথা অনুযায়ী বুড়ি মা বলে ডাকে।

লা-ওর বয়স যখন ছিলো আঠারো, তখন ডবল বয়সী এক পণ্ডিতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিলো; সে-কো-ৎসোয়ান-চো নামে এক কোষগ্রন্থ সংকলন করছিলেন তিনি । বিয়ের তিন বছর পরেই তার যখন মৃত্যু হলো, লা-ও একেবারে একা হয়ে পড়লো।

তার কিছুদিন পরেই কী-জন্য যেন কিন-ফো এসেছিলো পেইচিঙে; ওয়াং-এর সঙ্গে তরুণী লা-ওর আলাপ ছিলো আগেই, এবার তার বন্ধু ও ছাত্রের সঙ্গে লা-ওর পরিচয় করিয়ে দিলে সে; ভালো লাগলে তাকে বিয়েও করতে পারে, এই কথাও বললে সে তার ছাত্রকে। কিন-ফোর তাতে কোনো দ্বিরুক্তি বা অসম্মতি দেখা গেলো না; তরুণীটিরও যে এতে বিশেষ অনীহা ছিলো, তাও নয়; ফলে অচিরেই, দার্শনিকের ঘটকালির দরুন, ঠিক হলো যে পেইচিং থেকে ফিরে কিন-ফো শাংহাইতে যথোচিত ব্যবস্থা করলে পর ধুমধাম করে বিয়েটা হয়ে যাবে।

চিন সাম্রাজ্যে বিধবাবিবাহ খুব-একটা হয় না; এমন নয় যে বিধবাদের বিয়ে-করার ইচ্ছে থাকে না, বরং পুরুষরাই সহজে বিধবাবিবাহে রাজি হয় না। কিন-ফো অবশ্য সেই গড্ডলিকা প্রবাহের অন্তর্ভুত নয়–তাই এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে তার একটুও দ্বিধা দেখা গেলো না। লা-ও শুধু বুদ্ধিমতীই নয়, উচ্চশিক্ষিতাও; এই-যে যুবকটি তার স্বামী হতে চলেছে, কোনো-কিছুতেই যার আগ্রহ নেই, বা রুচি নেই, তাকে কী করে সুখী করবে এটাই তার এখন একমাত্র ভাবনা।

পুনর্বিবাহের ফলে অবশ্য সাধ্বীদের সঙ্গতি তার হবে না; স্বামীর মৃত্যুর পরে যারা মৃতস্বামীর স্মৃতি বুকে করে দুঃখে কষ্টে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, সম্রাটেরা মাঝে-মাঝে চিনদেশে তার নামে পাই-লু বা স্মৃতিস্তম্ভ রচনা করে দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সুং তার স্বামীর সমাধি ছেড়ে মুহূর্তের জন্যও নড়েনি বলে তার নামে এ-রকম এক স্মৃতিফলক রচনা করা হয়েছিলো; কুং-কিয়াং নামে আরেকজন স্ত্রীলোক তার দুঃখের প্রতীক হিশেবে হাত কেটে ফেলেছিলো; ইয়েন-চিয়াং নামে আরেকজন আরো গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছিলো নিজেকে–তাদেরও সম্রাটের বদান্যতা কখনো ভোলেনি। লা-ও অবশ্য এই স্মৃতিস্তম্ভের লোভ ত্যাগ করেই পুনর্বিবাহে সম্মতি দিয়েছে। পণ্ডিত স্বামীর মৃত্যুর পর তার যে খুব সচ্ছল দিন চলে তা নয়–তবে কোনো কষ্ট হয় না, অনায়াসেই দিন কেটে যায়। চা-কোআ অ্যাভিনিউর বাড়িটা তেমন জমকালো নয়, বুড়ি নান ছাড়া আর-কোনো দাস-দাসীও নেই। এই তরুণী বিধবার প্রিয় ঘর হলো যে-ঘরে বসে সে সাজগোজ করে। দু-মাস আগেও এ-ঘরের আশবাবপত্র ছিলো নিতান্তই শাদাশিধে–কিন্তু গত দুমাস ধরে শাংহাই থেকে রোজ দামি-দামি উপহার আসছে। সম্প্রতি এসেছে প্রাচীন চৈনিক চিত্রকলার কতকগুলি ঝলমলে নিদর্শন; দেয়ালে টাঙিয়েছে লা-ও সে-সব; তাদের মধ্যে একটা ছবি হলো ওয়ান-সে-নেন-এর–চিত্রশিল্পের যে-কোনো শমঝদারই এই প্রাচীন শিল্পীর তুলির টান ও রঙের পোঁচ দেখে মুগ্ধ না-হয়ে পারবে না। আধুনিক চৈনিক চিত্রকলায় যে সবুজ ঘোড়া, বেগনি কুকুর, উজ্জ্বল নীল গাছের বিশ্রী ছড়াছড়ি, ওয়ান-সে নেন-এর যাবতীয় চিত্রকর্মেই তার সুস্নিগ্ধ বিরোধিতা। পাশেই গালার টেবিলে মস্ত প্রজাপতির পাখার মতো পড়ে আছে সোয়াটোর শিল্পবিদ্যালয়ের শৌখিন হাতপাখা। পোর্সেলেনের ফুলদানি ভরা আরব্য কাগজের ফুল : কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে এ-সব জাপানি লিলি বা চন্দ্রমল্লিকা নয়; জানলায় ঝুলছে বেতের পরদা যার ফলে ঘরের মধ্যে বেশি গরম ঢুকতে পায় না; এমনি আরো-কত ছোটোখাটো শৌখিন জিনিশের মধ্যে যে প্রবাসী প্রেমিকের ভালোবাসার ছাপ লুকিয়ে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

লা-ও কেবল লাবণ্যময়ীই নয়, সুন্দরীও–তার রূপের প্রতিভাস এমনকী ইওরোপীয়দেরও মুগ্ধ করবে। গাত্রবর্ণ স্নিগ্ধ গৌর, মোঙ্গোলদের মতো পীতবর্ণ নয়; কালো তার চোখের পাতা, দীর্ঘ, ঘন, কালো তার চুল, সবুজ পাথর বসানো চুলের কাটা দিয়ে পীচ-ফুল গোঁজা খোঁপায়; মুক্তোর মতো শাদা ছোটো-ছোটো দাঁত; তুলির সূক্ষ্ম টানে চাইনিজ ইঙ্ক দিয়ে আঁকা যেন তার ভুরু। কোনো প্রসাধন সে ব্যবহার করে না–এমনকী মধু-মেশানো এস্পানি পাউডার পর্যন্ত না; রঙ মেখে আরক্ত করে না অধর; চোখে শুমা দিয়ে দীঘল করে না কখনো; গালে-চিবুকে কোথাও ব্যবহার করে না রূজ, চিনদেশে যার জন্য কি না বছরে দশ মিলিয়ন সাপেক খরচ হয়। লা-ওর কোনো সম্বন্ধই নেই প্রসাধনের সঙ্গে। ক্কচিৎ যখন বাড়ি থেকে বেড়াতে বেরোয়, তখন প্রসাধনের কথা সে ভাবেই না একেবারো, কারণ সে জানে যে এতে তার কিছু এসে যায় না–চিনে মহিলারা যেমন লোকসমক্ষে বেরুবার সময় নিজেদের নানাভাবে জাহির করতে চান, লা-ও কখনোই সেই গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসতে চায়নি।

পোশাকও তার খুব শাদাশিধে–কিন্তু রুচি ও আভিজাত্যের ছাপ থেকে যায় যেন কোথায়। কুচি-দেয়া ঘাঘরার উপরে লম্বা জামা পরে সে, চারপাশে লেসের কাজ করা; কোমরে জড়ায় জরির ফিতে; খাটো পাজামার নিচে পরে নানকিং রেশমের পালা মোজা, দামি পাথর আর মুক্তো বসানো চপ্পল থাকে পায়ে। নরম স্পর্শভীরু তার হাত দুটি; গোলাপি নখের উপর থাকে রুপোর ছোট্ট অঙ্গুলিত্ৰাণ।

পা দুটি তার স্বভাবতই ছোটো। চিনদেশে অবশ্য সাত শতাব্দী ধরে মেয়েদের পায়ের আকার সুন্দর করে তোলবার জন্য একটা বর্বর প্রথা চলে আসছে : কোনো রাজকন্যা হয়তো একদা খুঁড়িয়ে হাঁটততা আর তার অসুখ সারাবার জন্য হয়তো প্রথম এই উপায় প্রয়োগ করা হয়–কিন্তু পরে বোধহয় কতিপয় অত্যুৎসাহী পতিদেবতার জন্য এটা একটা প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়; পদ্ধতিটা খুবই সহজ; পায়ের পাতা ভাঁজ করে পট্টি বেঁধে রাখতে হয়, যাতে গোড়ালিতে কখনো চাপ পড়ে না; কিন্তু এর ফল হয় বিষম ক্ষতিকর, কারণ শেষটায় এমনকী হাঁটা-চলার ক্ষমতাও চলে যায়; এই প্রথা অবিশ্যি ক্রমেই উঠে যাচ্ছে; আজকাল হয়তো প্রতি দশজনে মাত্র তিনজন চিনেরমণী দেখা যাবে, ছেলেবেলায় যাদের এই ভীষণ সৌন্দর্যচর্চার বলি হতে হয়েছিলো।

যাও না, বুড়ি-মা, আবার গিয়ে দেখে এসো, আরেকবার বললে লা-ও।

নান বললে, কী হবে গিয়ে?

সে-কথা তোমার ভাবতে হবে না। তোমাকে যা বলছি তা-ই করো। গিয়ে খোঁজ করে এসো একবার : আমি ঠিক জানি আজ আমার নামে একটা চিঠি আসবে।

বুড়ি নান গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

সময় কাটাবার জন্য লা-ও একটা শেলাই তুলে নিলে হাতে; কিন-ফোর জন্য সম্প্রতি একটা কাজ-করা চটি বানাচ্ছে সে। চিনদেশে সবাই শেলাই জানে, কাপড়ের উপর সুন্দর কাজ তুলতে পারে। কিন্তু একটু পরেই আবার সে কাজটা নামিয়ে রাখলো। উঠে গিয়ে ছোট্ট একটা বনবনের বাক্স থেকে কয়েকটা তরমুজের বিচি বের করে নিয়ে তার ছোটো দাঁতে খুঁটতে লাগলো। তাও যখন ভালো লাগলো না, হাতে তুলে নিয়ে একটি বই, বিবাহেচ্ছু তরুণীদের প্রতি নানা নির্দেশ আছে বইটিতে, নাম নুশুন। অন্যমনস্কভাবে উপদেশগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলো সে : বসন্তের মতো ঊষাকালই হচ্ছে কাজ করার সেরা সময়।…রাত থাকতেই উঠবে ঘুম থেকে শুয়ে কাটালে চলবে না। …উঁতগাছ, শনখেত–সবকিছুরই যত্ন নেবে। …নিজের কাপড় বুনতে ভুলবে না–তা সে সুতিই হোক আর রেশমেরই হোক। … স্ত্রীলোকের প্রধান গুণ হলো অবিশ্রাম পরিশ্রম ও মিতব্যয়িতা।

কিন্তু পড়তেও আর ভালো লাগলো না; কতগুলো হরফই কেবল চোখে পড়ছে তার–মন পড়ে আছে অন্যখানে; বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে।

কোথায় আছে ও এখন? নিজের সঙ্গেই সে বলাবলি করতে লাগলো, নিশ্চয়ই কোয়াংতুং থেকে ফিরে এসেছে এতক্ষণে; কবে আসবে ও এখানে? কোয়ানাইন–তুমি ওর চলাফেরায় দৃষ্টি রেখো-দেখো, যেন ও কোনো বিপদে না-পড়ে।

কলের পুতুলের মতো তার চোখ গিয়ে পড়লো একটা টেবিলক্লথের উপর; মোজেইক-এর মতো টুকরো টুকরো কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি টেবিল-ঢাকাটা, আর তার উপরে এক কাচ্চাবাচ্চা-সমেত রাজহাঁস আঁকা : পাতিব্রত্যের প্রতীক এই ছবি।

একটা ফুলদানির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে–চোখ বুজে ফুলদানি থেকে একটা তোড়া তুলে নিলো।

হায়রে! ভাঙা গলায় সে বলে উঠলো, ভাগ্য দেখছি বিরূপ আমার প্রতি! উইলোর ফুল তোলা উচিত ছিলো আমার : বসন্তের প্রতীক; তার বদলে কিনা হাতে উঠে এলো হলদে চন্দ্রমল্লিকা : হেমন্তের ইঙ্গিত–বিদায়ের, অবসানের প্রতীক!

এই অলুক্ষুণে ইঙ্গিতটা সে ভুলে যেতে চাইলো বলেই তার ছোট্ট সারেঙিটা তুলে নিয়ে পাণিগ্রহণের গান বাজাতে শুরু করলে, কিন্তু গানের বাণী গলায় এলো না ঠিক মতো; আর চেষ্টা না-করে সারেঙিটা সে নামিয়ে রাখলে।

আবার বললে আপন মনে, এমন তো কখনো হয় না কোনো দিনই তো ওর চিঠি আসতে এত দেরি হয় না। কী সুন্দর ওর চিঠিগুলো কী মিষ্টি; ও যা লিখে পাঠায় শুধু যে তাই, তা নয়, ওর কথাগুলোও কী মিষ্টি, আর বারেবারে শোনা যায় সেই গলা,–আপনা থেকেই তার চোখ গিয়ে পড়লো কিন-ফোর গ্রামোফোনের উপর। গলার টেবিলে বসানো চৌকো বাক্সটাই লা-ওর গ্রামোফোন; শাংহাইতে কিন-ফো যা ব্যবহার করেছিলো হুবহু তারই মতো দেখতে। এর ফলে বারেবারে পরস্পরের গলা শুনতে পারে তারা। কিন্তু কয়েকদিন ধরে–হ্যায়রে-লা-ওর গ্রামোফোন কোনো কথা বলছে না–চুপ করে পড়ে আছে।

বুড়ি নান এসে ঢুকলো ঘরে।

এই নাও তোমার চিঠি, বলে সে যেমন দুমদাম করে এসেছিলো, তেমনি দুমদাম করে চলে গেলো।

খামটার উপর শাংহাই-র ডাকঘরের ছাপ; কিন্তু বাইরেটা তাকিয়ে দেখার তর সইছে না তখন লা-ওর; ঝলমলে মুখে স্মিত হেসে সে খামের মুখটা ছিঁড়ে নিলে; সাধারণ কোনো চিঠি বেরোলো না খাম থেকে–ফুটকি বসানো গোল একটা টিনের চাক্তি বেরিয়ে এলো শুধু গ্রামোফোনে চাপিয়ে না-দিলে এই ফুটকিগুলো এইভাবে বোবা আর স্তব্ধ হয়েই থাকবে; আর ততক্ষণ সেই আশ্চর্যসুন্দর ঈষৎবিষণ্ণ স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর শোনা যাবে না কিছুতেই।

চিঠি তো নয়, চিঠির চেয়েও বেশি! লা-ও চেঁচিয়ে উঠলো যেন, ওকে কথা বলতে শুনতে পাবো আমি–

অসীম যত্নের সঙ্গে সন্তর্পণে ওই চাক্তিটা বসিয়ে দিলো গ্রামোফোনের চাক্তিতে, তারপর যেই ওটা ঘুরতে শোনা গেলো, অমনি ঘরের মধ্যে ঝমঝম করে উঠলো তার প্রেমিকের কণ্ঠস্বর :

লা-ও, বোন আমার! আমার শেষ কপর্দকটুকু পর্যন্ত হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো, একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি আমি এখন : হেমন্তের হাওয়ায় যেমন করে ঝরা পাতা উড়ে যায়, তেমনি আজ আমার সর্বস্ব হারিয়ে গিয়েছে। আমার দুঃখের, আমার কৃচ্ছতার সাথী আমি করতে পারি না তোমাকে। ভুলে যাও তুমি, চিরতরে ভুলে যাও হে হতভাগ্য আর হতাশ একজনকে তুমি জানতে, যার নাম ছিলো : কিন-ফো।

হায়রে, তার সব প্রত্যাশায় এ কী মর্মান্তিক আঘাত এসে লাগলো! আকুল হয়ে কেঁদে উঠলো তার হৃদয় : তীব্র-এক বেদনায় ভরে গেলো তার পেয়ালা, কী তিক্ত ও বিষাক্ত এই বেদনা। তবে কি কিন-ফো তাকে ত্যাগ করলো? তবে কি সে ভেবেছিলো যে শুধু ঐশ্বর্যেই মুগ্ধ হবে লা-ও-ঐশ্বর্যেই সুখী হবে, তৃপ্তি পাবে! সুতো-ছিড়ে যায় ঘুড়ির মতো আস্তে ঘুরে-ঘুরে মাটিতে নেমে এলো লা-ও!

নানকে ডাকা হলো তক্ষুনি। কিন্তু নান এলো ধীরে-সুস্থে হেলেদুলে। এসে, তার দশা দেখে, বিরক্তি ও হতাশা ভরে কাঁধ ঝকালো শুধু একবার, তার পর বাড়ির কর্ত্তীকে ধরাধরি করে তার হাং-এ শুইয়ে দিলো। কৃত্রিম উপায়ে গরম-করা বিছানাকেই হাং বলে চিনেরা। কিন্তু লা-ওর কাছে সেই উষ্ণ কোমল শয্যা ঠেকলো কনকনে পাষাণশয্যার মতো–সেই রাত্রির দীর্ঘ পাঁচটি প্রহর কাটলো বিধুর, করুণ ও তন্দ্রাহীন।