১৯. পরদিন সকালে চা জলযোগ ইত্যাদি

পরদিন সকালে চা জলযোগ ইত্যাদি সমাপ্ত হইবার পর সকলে অলসভাবে বসিয়া মোগলসরাই স্টেশনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। মোগলসরাই পৌঁছিতে আর বিলম্ব নাই। স্থির ছিল, প্রমদাবাবুরা কাশী পর্যন্ত ট্রেনে না গিয়া এইখানেই নামিয়া যাইবেন এবং মোটরে কাশী পৌঁছিবেন। আগে হইতে যানবাহনের বন্দোবস্তও করিয়া রাখা হইয়াছিল।

করবী ও বিমলা গাড়ির একটি কোণে বসিয়া ছিল, কখনও নিম্নস্বরে গল্প করিতেছিল, কখনও বা বাহিরের শীত-প্রভাতের শিশির ঝলমল দৃশ্য নীরবে দেখিতেছিল। করবী তাহার স্বভাবসুলভ ছেলেমানুষী ও অকপট সরলতার দ্বারা সহজেই বিমলার হৃদয় জয় করিয়া লইয়াছিল; তাহাদের পরিচয় এই অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন একটা স্তরে গিয়া পৌঁছিয়াছিল—যেখানে পাশাপাশি বসিয়াও নিরবচ্ছিন্ন বাক্যালাপের প্রয়োজন হয় না।

গাড়ি উধ্বশ্বাসে একটা কঙ্করময় স্টেশনকে দলিত বিধ্বস্ত করিয়া চলিয়া গেল। প্রমদাবাবু পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া দেখিয়া বললেন, আর কুড়ি মিনিট। ঠিক টাইমে যাচ্ছে।

কিশোর উঠিয়া পড়িল; রাত্রির ব্যবহৃত বিছানাপত্র তখনও ইতস্তত ছড়ানো ছিল, গোছগাছ করা হয় নাই। কিশোর সেগুলিকেও গুছাইয়া লইবার উপক্রম করিতেই প্রমদাবাবু বলিলেন, থাক না হে, অত ব্যস্ত হবার প্রয়োজন কি? পাশের গাড়িতে আমার আদালী আছে, গাড়ি থামলে সে-ই ঠিকঠাক করে নেবে অখন।

কিশোর বলিল, তা হোক। তাড়াতাড়িতে সে হয়তো পেরে উঠবে না, আমিই ঠিক করে নিচ্ছি।

করবী বিমলার গা টিপিয়া বলিল, আপনি ঠিক বলেছিলেন বৌদি। বিমলা হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

কিশোর তাহাদের কথা শুনিয়াও শুনিল না, গম্ভীর মুখে কাজ করিতে লাগিল। সকলে সকৌতুকে দেখিতে লাগিলেন।

প্রমদাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল কথা, তোমারা কাশীতে উঠছ কোথায় শুনলুম না তো! কোন আত্মীয় আছেন বুঝি?

কিশোর মুখ তুলিয়া একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, না, আত্মীয় কেউ নেই। কোথায় উঠব এখনও কিছু ঠিক করিনি। যেখানে হোক ওঠা যাবে, দিন তিন-চার বৈ তো নয়। শুনেছি, এ দিকের ধর্মশালাগুলো বেশ ভাল।

প্রমদাবাবু চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন, বল কি হে! সঙ্গে স্ত্রীলোক রয়েছেন, ধর্মশালায় উঠবে কি? আমি ভেবেছিলুম তোমার বুঝি একটা আস্তানা আছে—তাই এতক্ষণ খোঁজ করিনি। বেশ যা হোক।

উৎসুক গলা বাড়াইয়া করবী বলিয়া উঠিল, বাবা, তাহলে–

প্রমদাবাবু বলিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে আর বলতে। এক জায়গাতেই সকলে মিলে ওঠা যাবে। কিন্তু কি ছেলেমানুষী বল দেখি। ভাগ্যিস জিজ্ঞাসা করেছিলুম, নইলে তো ধর্মশালাতেই গিয়ে উঠতে।

কিশোর অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া বলিল, না না, সে আপনাদের বড় কষ্ট হবে। আমরা যেখানে হোক—

প্রমদাবাবু বলিলেন, বিলক্ষণ! কষ্ট কিসের? আমার শালাদের প্রকাণ্ড বাড়ি, দুজন অতিথি বেশী হলে তাদের কোনও কষ্ট হবে না। তা ছাড়া করবীর মা যদি শোনেন যে, তোমাদের ধর্মশালায় পাঠিয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি এসেছি, তাহলে আমাদেরও হয়তো সেই ব্যবস্থা করতে বলবেন। তাঁর ভায়েদের বাড়ি-বুঝছ না? বলিয়া হাসিতে লাগিলেন।

করবী বলিল, কিশোরবাবু, কোন আপত্তি শোনা হবে না। আপনাদের যেতে হবে।

কিশোর বিমলার দিকে চাহিয়া বলিল, বৌদি, কিন্তু এটা কি উচিত হবে?

করবী বিমলার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, আপনি কিন্তু অমত করতে পারবেন না, তা বলে দিচ্ছি।

বিমলা সহাস্যে বলিল, অমত করব কেন–বেশ তে। এ তো বরং ভালই হল। আর অসুবিধে যদি হয়, সে তো আমাদের হবে না, তোমাদেরই হবে। তা সে অসুবিধে যখন তোমরা স্বীকার করে নিচ্ছ, তখন আর আমাদের আপত্তি কি?

নিজের জন্য যতটা নয়, বিমলার কথা ভাবিয়াই কিশোর করবীদের বাড়ি আতিথ্য স্বীকার করিতে অনিচ্ছা জানাইয়াছিল। বিমলা শুদ্ধাচারে থাকে, তাহার জপতপ স্নানাহারের নানা হাঙ্গামা আছে, পরের বাড়িতে উঠিয়া হয়তো এ সকলের কোন সুব্যবস্থা হইবে না; হয়তো তাঁহারা সাহেব লোক, একঘড়া গঙ্গাজলও তাঁহাদের বাড়িতে পাওয়া যাইবে না; বিমলা হাসিমুখে সমস্ত অসুবিধা ভোগ করিলেও ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাইবে, এই সব নানা কথা ভাবিয়া কিশোরের মন কিছুতেই এ প্রস্তাবে সায় দিতেছিল না। কিন্তু বিমলা যখন কোন অনিচ্ছাই প্রকাশ করিল না, বরং সহজেই রাজী হইয়া গেল তখন কিশোরের নিজের পক্ষ হইতে একটা অজ্ঞাতনামা আপত্তি মাথা তুলিবার চেষ্টা করিল। প্রমদাবাবু ও তাঁহার পরিবারবর্গের সংসর্গ অপ্রীতিকর নহে, এ কথা বলাই বাহুল্য; কিন্তু তবু অন্ধকার রাত্রিতে অজানা পথে চলিতে চলিতে গভীর খাদের কিনারায় আসিয়া পড়িলে অজ্ঞাত আশঙ্কায় যেমন ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া হইয়া উঠে, তেমনই একটা নামহীন দুর্দৈবের পূর্বাভাস কিশোরের মনটাকে যেন শঙ্কায় কণ্টকিত করিয়া তুলিল এবং মনে হইল ইহাদের সঙ্গ ছাড়িয়া পলাইতে পারিলেই যেন সব দিক দিয়া ভাল হয়।

অথচ এরূপ সহৃদয় নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া শহরের পান্থ-নিবাসে আশ্রয় লওয়ার মত অশিষ্টতা অতি অল্পই আছে; তাই কুণ্ঠিতভাবে রাজী হওয়া ছাড়া তাহার গতি রহিল না। প্রমদাবাবু ও করবী অকপটভাবে খুশি হইয়াছেন বুঝিয়াও সে মনের মধ্যে প্রসন্নতা লাভ করিতে পারিল না। বাকী পথটা একটা অস্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর দিয়া প্রায় নীরবেই কাটিয়া গেল।

যথাসময়ে মোগলসরাই স্টেশনে নামিয়া সকলে মোটর-যোগে কাশী পৌঁছিলেন। কাশীতে করবীর মামার বাড়ি দশাশ্বমেধ ঘাটের নিকটেই। তাঁহারা মোটেই সাহেব নহেন, বরঞ্চ কিছু অতিরিক্ত মাত্রায় হিন্দু দেখিয়া কিশোর বিমলার বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হইল। করবীর মা আগন্তুকদের পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। বিমলাকে হাত ধরিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া গিয়া ভ্রাতৃবধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়া দিলেন। বেলা হইয়াছিল, অল্প দুই-চারিটা কথাবার্তার পর বিমলা গামছা কাঁধে ফেলিয়া স্নানাগারে প্রবেশ করিল এবং অল্পক্ষণ পরেই স্নান সারিয়া পূজার ঘরে ঢুকিল।

পূজা শেষ করিয়া যখন সে বাহির হইল, বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে। বাড়ির মেয়েরা সকলেই  তাহার জন্য অভুক্ত রহিয়াছেন দেখিয়া সে লজ্জিত হইয়া বলিল, কেন আমার জন্য আপনারা কষ্ট করলেন? আমি তো বিশ্বনাথ দর্শন না করে মুখে জল দিতে পারব না। আমারই অন্যায় হয়েছে, আগে বলা উচিত ছিল। কিন্তু আপনারা আর দেরি করবেন না, খেয়ে-দেয়ে নিন। আর যদি সুবিধা হয়, একজন লোক আমার সঙ্গে দিয়ে আমাকে বিশ্বনাথ মন্দিরে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। ঠাকুরপোকে সঙ্গে নিতে পারতুম, কিন্তু সমস্ত রাত গাড়িতে এসে তিনি ক্লান্ত হয়েছেন।

করবী বিস্ফারিত নয়নে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আর আপনার শরীরে বুঝি ক্লান্তি নেই? কাল গাড়িতে ওঠার পর থেকে আজ এই বেলা পর্যন্ত আপনাকে মুখে এক ফোঁটা জল দিতে দেখলুম না! ক্ষিদের কথা ছেড়ে দিই, কিন্তু তেষ্টাও কি আপনার পায় না, বৌদি?

বাড়িতে অন্য কোন বিধবা ছিলেন না, তাই বিমলার জন্য আলাদা হবিষ্য রাঁধিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। করবীর বড় মামী বলিলেন, আপনার রান্নার উযুগ সব আমি করে রেখেছি, শুধু আমাদের হাতে খাবেন কিনা তাই রান্না চড়াতে পারিনি।

বিমলা হাসিয়া বলিল, সে কি কথা, খাব বৈকি।

বড় মামী বলিলেন, তাহলে আপনার রান্না আমিই চড়িয়ে দিই; বিশ্বনাথ তো কাছেই, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসতে পারবেন। করবী, দুবেকে ডেকে বলে দে তো মা, মোটরকারে করে এঁকে যেন বিশ্বনাথ দর্শন করিয়ে আনে। আর সুরেনের তো স্কুল নেই, সে সঙ্গে যাক—

করবী বলিল, কিন্তু খেয়ে-দেয়ে গেলেই তো ভাল হত।

বিমলা জিভ কাটিয়া বলিল, তা কি হয় ভাই, কাশীতে এসে বিশ্বনাথের মাথায় জল না দিয়ে কি খেতে আছে।

করবী বলিল, কেন খেতে নেই? আমি তো এসেই চাহালুয়া খেয়েছি।

বিমলা হাসিয়া উঠিল, শোন কথা। তুমি আর আমি কি সমান? তা ছাড়া উপোস করতে আমাদের কষ্ট হয় না—

করবী রাগিয়া উঠিয়া কী একটা প্রতিবাদ করিতে যাইতেছিল, তাহার বড় মামী বাধা দিয়া বলিলেন, তর্ক করিসনি, করবী। দ্যাখ সুরেন কোথায়, সে আবার এখনই হয়তো কোথাও বেরিয়ে যাবে। আর গাড়ি সামনে আনতে বলে দে।

করবী চলিয়া গেলে বিমলা মৃদু হাসিয়া বলিল, একেবারে ছেলেমানুষ।

গাড়ি অন্দরের দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাতে উঠিতে উঠিতে বিমলা বাড়ির বধুদের অনুনয় করিয়া বলিল, দোহাই, আপনারা আমার জন্যে যেন আর না খেয়ে বসে থাকবেন না—তাতে কেবল আমার অপরাধ বাড়বে। বরং খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমার জন্যে দুটো আলোচাল ফুটিয়ে রাখবেন; আমার ফিরতে আজ তিনটে বাজবে।

বিমলা চলিয়া গেল। এই অপরূপ সুন্দরী বিধবাকে দেখিয়া বাড়ির মেয়েরা সকলেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন; কিন্তু এত অল্পবয়সে তাহার এই কঠিন নিষ্ঠা ও ব্রহ্মচর্য দেখিয়া তাঁহাদের মনে হইল, যেন হিন্দু-বিধবার অবশ্যপালনীয় বিধি-বিধানের সীমা কঠোর তপস্যার বলে সে বহুদূর অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার সহিত ব্যথায় তাঁহাদের মন পূর্ণ হইয়া গেল।

সেদিন বিকালবেলাটা ক্লান্তিবিনোদনেই কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার পর বাড়ির পুরুষরা বৈঠকখানায় আসর জমাইয়া তুলিলেন। করবীর অনেকগুলি মামা। যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি প্রায় প্রমদাবাবুর সমবয়স্ক বহুদিন পরে শালা ও ভগিনীপতির সাক্ষাতে হাসি-তামাশা ও বাক্যবাণের অবাধ বিনিময় চলিতে লাগিল। বাহিরের লোক কিশোর ছাড়া আর কেহ ছিল না, তাই করবীও এক সময় তাঁহাদের মধ্যে আসিয়া বসিল। মামার বাড়ির পদাপ্রথা করবী মানিত না; মামারা যদিও ইহা পছন্দ করিতেন না , তথাপি আদরিণী ভাগিনেয়ীকে কিছু না বলিয়া ভগিনীপতির উপর ঝাল ঝাড়িতেন। শ্বশুরবাড়িতে প্রমদাবাবুর সাহেব ডাকনাম শ্লেষ হইতে উদ্ভূত হইয়া ক্রমে স্থায়ী হইয়া পড়িয়াছিল।

বৈঠকের লক্ষ্যহীন আলোচনা প্রসঙ্গ হইতে প্রসঙ্গান্তরে সঞ্চারিত হইয়া ক্ৰমে একটা জটিল আইনের প্রশ্নে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কিশোর নীরবে বসিয়া শুনিতেছিল। করবী কিছুক্ষণ মন দিয়া শুনিবার চেষ্টা করিয়া শেষে কিশোরের দিকে একটু সরিয়া আসিয়া চুপিচুপি বলিল, কিশোরবাবু, কাল খাওয়া-দাওয়া করে সারনাথ দেখতে যাব ঠিক হয়েছে। আমি, আপনি আর বৌদি আর কেউ নয়।

কিশোর স্মিতমুখে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা।

করবী আর কিছু না বলিয়া এক সময় পা টিপিয়া টিপিয়া উঠিয়া গেল। তাহার আগমন ও প্রস্থানে বৈঠকের আলোচনা তিলমাত্র ক্ষুণ্ণ হইল না বটে, কিন্তু কিশোরের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া চুপিচুপি কথা কহিয়া উঠিয়া যাইবার দৃশ্যটা কাহারও দৃষ্টি এড়াইল না।

রাত্রিতে আহারাদির পর করবীর জ্যেষ্ঠ মাতুল প্রমদাবাবুকে নিভৃতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সাহেব, মেয়ের বিয়ের কী করছ?

কিছুই তো এখনও করিনি।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু করার সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে। করবীর বয়স কত হল—সতেরো? বাঙালীর ঘরের মেয়ে, আর বেশী দিন ঘরে রাখা তো চলবে না। মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে আরম্ভ করো।

সে হবে এখন, এত তাড়াতাড়ি কিসের?

দেখো, ঐ কথাগুলো আমার ভাল লাগে না। মেয়ের সতেরো বছর বয়স হল, এখনও তাড়াতাড়ি কিসের? অন্য বিষয়ে সাহেবিয়ানা করো ক্ষতি নেই, কিন্তু এ দিকে যা রয় সয় তাই ভাল। তুমি না পার, আমিই পাত্র দেখছি।

আরে অত চটছ কেন? মনের মত পাত্রও তো পাওয়া চাই।

অপাত্রে মেয়ে দিতে তো বলছি না। কিন্তু মনের মত পাত্রও জগতে দুর্লভ নয়—খুঁজলে পাওয়া যায়।

প্রমদাবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। বড় মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, আচ্ছা, এই কিশোর ছোকরার সঙ্গে তোমাদের কদ্দিনের আলাপ?

বেশী দিন নয়,—মাস চার-পাঁচ।

ওর সঙ্গে আজ কথা কইছিলুম—বেশ ছেলে, তোমাদের পালটি ঘর। ওর কথা কখনও ভেবে দেখেছ?

দেখেছি। সব দিক দিয়েই সুপাত্র। কিন্তু করবীর মনের ভাব না বুঝে তো স্থির করা যায় না।

সাহেব, সে আমি জানি। মেয়েকে যখন ইংরাজী স্কুলে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছ, তখন তার অমতে কিছু হবে না। কিন্তু একদিন দেখেই আমার যা ধারণা হয়েছে, তাতে করবীর বিশেষ অমত হবে বলে বোধ হয় না, বরং খুব বেশী রকম মত হবে বলেই আন্দাজ হচ্ছে। তুমি তো অনেক দিন ধরেই দেখছ, তোমার কিছু সন্দেহ হয় না?

ভাই, এ সব আঁচ-আন্দাজের কথা নয়, পরিষ্কারভাবে জানা দরকার। বুঝছ না, আমাদের আন্দাজ ভুলও হতে পারে।

বেশ, সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করেই দেখো না?

তা জিজ্ঞাসা করতে পারি, কিন্তু তাতে অনিষ্ট হতে পারে। এখন কিছু না বলাই ভাল, সময় উপস্থিত হলে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করবার দরকার হবে না।

দেখো, আমি সেকেলে লোক, এই সব মেলামেশা পছন্দ করি না। আমার মনে হয়, ও জিনিসটাকে বিনা বাধায় অগ্রসর হতে দিলেই অনিষ্টের সম্ভাবনা। আমার এ একটুও ভাল বোধ হচ্ছে না। শেষকালে হয়তো এমন জট পাকিয়ে যাবে যে, জট ছাড়াতেই প্রাণান্ত হয়ে পড়বে।

অতঃপর আর কোন কথা হইল না। রাত্রিতে শয়নকালে প্রমদাবাবু অন্যান্য কথার পর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিশোর সম্বন্ধে করবীর মনে কিছু আছে তোমার মনে হয়? করবীর মা বলিলেন—হয়। করবী আগে অনেক ছেলেমানুষী করেছে, কিন্তু এবার বোধ হয় সত্যি সত্যি

সুহাসিনীর বিষয়ে সব কথাই তো জানে?

জানে। তার মুখেই তো আমরা শুনেছি।

হুঁ, বলিয়া প্রমদাবাবু পাশ ফিরিয়া শুইবার উপক্রম করিলেন। নিদ্রা সহসা আসিল না,  ঘুরিয়া-ফিরিয়া শ্যালকের সুস্পষ্ট আশঙ্কার কথাই তাঁহার মনে জাগিতে লাগিল। কিশোরের সহিত অবাধে করবীকে মিশিতে দিয়া ভুল করিয়াছেন কিনা, ভাবিতে ভাবিতে অনেক রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *