১৮. সপরিবার তুষ্টু গয়লা

সপরিবার তুষ্টু গয়লা মাঠে এসে বুক চাপড়াচ্ছে আর পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। তুষ্টুর পরিবার জলে পড়ে কি আগুনে পড়ে এইভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে এখান থেকে ওখান।

একরাশ লোক চারিদিকে ভিড় করে হা-হুতাশ করছে, আর কে কবে কোথায় ঠিক এই রকম অথবা এই ধরনের ব্যাপার দেখেছে তারই আলোচনায় বাতাস মুখর করে তুলেছে।

আশ্বিনের রোদে সর্দি-গর্মি হবার কথা নয়, কিন্তু সময়টা বড্ড কড়া। একেবারে ভরদুপুর বেলা। আর ভিজে পান্ত কটা পেটে ঢেলেই মাঠে-জঙ্গলে ঘোরা। মায়েরা তো এটে উঠতে পারে না ছেলেগুলোকে।

ছেলেটা তুষ্টু গয়লার নাতি রঘু। সমবয়সের দাবিতে নেড়ু কোম্পানির দলের একজন। আশ্বিনে আখের ক্ষেত রসে ভরভর, ছেলেগুলোর তাই দ্বিপ্রহরিক খেলা আখ চুরি। উপকরণের মধ্যে একটুকরো ধারালো লোহার পাত। তার পর ক্ষেত থেকে আনার পর তো দাঁতই আছে।

দাঁত দিয়ে ভোলা ছাড়িয়ে মাথাপ্রমাণ লম্বা লাঠিগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে রসগ্রহণ করেছে সকলেই, হঠাৎ রঘুর যে কি হল! বুড়ো বটগাছটার তলায় যেখানে বসেছিল সবাই, সেখানেই ধুলো-জঞ্জালের ওপর শুয়ে পড়ল রঘু, যেন নেশাচ্ছন্নের মত।

ছেলেরা প্রথমটা খেয়াল করে নি, আগামী কাল আবার কখন অভিযান চালানো হবে সেই আলোচনাতেই তৎপর হয়ে উঠেছিল, চোখ পড়ল উঠে পড়বার সময়।

কী রে রঘু, তুই যে দিব্যি ঘুম মারছিস? বলল একজন হি-হি হাসির সঙ্গে ঠেলা মেরে। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিমুখটা কেমন শুকিয়ে উঠল তার। রঘুর দেহটা যেন শক্ত কাঠমত, রঘুর ঠোঁটের কোণে ফেনা।

এই, রঘুটার কি হয়েছে দেখ তো!

কি আবার হল? বেপরোয়া ছেলেগুলো রঘুর গায়ে হাত দিয়ে প্রথমটা হাসির ফোয়ারা ছোটাল, দেখছিস চালাকি, কি রকম মটকা মেরে পড়ে আছে! এই রঘু, গায়ে কাঠপিঁপড়ে ছেড়ে দেব, ওঠ বলছি!

শুধু গায়ে কাঠপিঁপড়ে নয়, কানে জল, পায়ে চিমটি ইত্যাদি করে ঘুম ভাঙ্গাবার সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করার পর বেদম ভয় ঢুকল ওদের। নিশ্চিত হল, এ ঘুম আর ভাঙবে না রঘুর, এ একেবারে ‘মরণ-ঘুম’। নইলে অমন হলদে রংটা ওর এমন বেগুনে হয়ে উঠবে কেন?

চল পালাই। বলল একজন।

পালাব? নেড়ু রুখে দাঁড়ায়।

পালাব না তো নিজেরাও রঘুর সঙ্গে যমের দক্ষিণ দোরে যাব নাকি? কর্তারা কেউ দেখ আস্ত রাখবে আমাদের?

যা বলেছিস। তুষ্ট ঠাকুর্দা ওই দুই দুধের বাঁক দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবে।

বাঃ, আমাদের কি দোষ? আমরা কি মেরে ফেলেছি?

তা কে মানবে? বলবে তোদের সঙ্গে খেলছিল, তোরাই কিছু করেছিস। চল্ চল্, কে কমনে দেখে ফেলবে!

নেড়ু ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, খুব ভাল কথা বলেছিস! বলি রঘু আমাদের বন্ধু না? ওকে শ্যাল-কুকুরে খাবে, আর আমরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাব?

রঘু বন্ধু, এ কথা সকলের মনেই কাজ করছিল, কিন্তু ভয় কাজ করছিল তার চাইতে অনেক বেশী। কাজেই আর একজন বাস্তববাদী এবং ঈশ্বরবাদী বালক উদাসমুখে বলে, ভগবান ওর কপালে যা লিখেছে তাই হবে। আমাদের কি সাধ্যি যে খণ্ডাই!

আর রঘুর মা যখন বলবে, তোদের সঙ্গে খেলতে গেছল রঘু, সে তো বাড়ি ফিরল না। কোথায় সে গেল বাবা? তখন কি বলবি?

বলব আজ রঘু আমাদের সঙ্গে খেলতে যায় নি।

মিছে কথা বলবি?

তা কি করব? বিপাকে পড়লে স্বয়ং নারায়ণও মিছে কথা বলে।

বলে! তোকে বলেছে! নেড়ু তীব্রকণ্ঠে বলে ওঠে, পাহারা দে তোরা ওকে, আমি দেখি গিয়ে মেজকাকা আছেন নাকি!

আর মেজকাকা! যমে ওকে গ্রাস করেছে রে নেড়ু!

তাতে মেজকাকা ডরায় না। জটাদার বৌ তো মরে গেছল বাঁচান নি? কত লোককেই তো বাঁচান। আমি যাব আর আসব। তবে কপালক্রমে যদি দেখা না পাই, তাহলেই রঘুর আশায় জলাঞ্জলি।

অগত্যা রঘুর বাস্তববাদী বন্ধুরা ‘য পলায়তি’ নীতি ত্যাগ করে রঘুর মৃতদেহ পাহারা দিতে সম্মত হল। মায়া কি তাদেরই করছিল না? কিন্তু কি করবে?

.

তারপর এই জলন্ত আগুনের মত সংবাদটাই আগুনের মতই এখান থেকে ওখানে, এঘর থেকে ওঘর, দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিয়ে গ্রামসুদ্ধ সবাইকে টেনে এনেছে এই বুড়ো বটতলায়।

তারপর চলছে জল্পনা-কল্পনা।

সর্দি-গর্মি?

শরৎকালে?

তা হবে না কেন? শরতের রোদই তো বিষতুল্য। গণেশ তেলির শালীর ছেলেটা সেবার ঠিক এই রকম করে

আর জীবন স্যাকরার ভাইপোটা?

নেপালের ভাগ্নীটাও তো।

আরে বাবা, সে এ নয়, সে অন্য ঘটনা!

আমার পিসশ্বশুরের দেশেও একবার কাঁদের নাকি বুড়ো বাপ ঘাট থেকে আসতে গিয়ে-

সহসা সমুদ্র কল্লোলে স্তব্ধ হয়ে গেল।

কবরেজ মশাই আসছেন!

বাড়ি ছিলেন না, কোথা থেকে যেন ফিরেই শুনে পালকি করেই বুড়ো বটতলায় এসে হাতি হয়েছেন।

শায়িত বালকের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন রামকালী, চমকে বললেন, কখন হয়েছে এ রকম?

নেড়ুর দিকে তাকিয়েই বললেন।

নেড়ু সভয়ে ঘটনাটা বিবৃত করল। রামকালী নিচু হয়ে ঝুঁকে ছেলেটার হাতটা তুলে ধরে নাড়ী পরীক্ষা করে নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আস্তে মুখ তুলে বললেন, কাদের ক্ষেতের আঁখ খেয়েছিলি?

অন্য সব বালকরাই নাগালের বাইরে, নেড়ুই রাজসাক্ষী, তাই নিরুপায় স্বরে গুপ্তকথা প্রকাশ করে, ইয়ে–বসাকদের।

কিছু কামড়েছে বলে চেঁচিয়ে ওঠে নি একবারও?

না তো! নেড়ু অবাক হয়। সমগ্র জনসভা একটি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে চিত্রাপিত পুত্তলিকাবৎ দণ্ডায়মান। এমন কি তুষ্টরা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গেছে, হাঁ করে তাকিয়ে আছে, বোধ করি কোনও একটু ক্ষীণ আশায় বুক বেঁধে।

সর্দি-গর্মি নয়। নিষ্ঠুর নিয়তির মত উচ্চারণ করেন রামকালী, সাপের বিষ!

সাপের বিষ!

একটা সমস্বরে চিৎকার উঠল, কোথায় কোথায় কেটেছে?

কাটে নি কোথাও, সে তো ওর সঙ্গীরাই বলছে। রামকালী নিঃশ্বাস ফেলেন, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে বিষ প্রবেশ করেছে। একটু আগে যদি হাতে পেতাম, চেষ্টা দেখতাম, এখন আর কিছু করবার নেই।

কবরেজ মশাই! হাহাকার করে পায়ে আছড়ে পড়ল তুষ্টু, জগতের সবাইকে জীবন দিচ্ছেন কবরেজ-ঠাকুর, আর আমার নাতিটাকে কিছু করবার নেই বলে ত্যাগ দিচ্ছেন!

রামকালী ডান হাতটা তুলে একবার আপন কপাল স্পর্শ করে বলেন, আমার ভাগ্য।

আপনার পায়ে ধরি ঠাকুরমশাই, ওষুধ একটু দ্যান।

এবার আছড়ে এসে পড়েছে বুড়ী। তুষ্টুর বৌ।

রামকালী কোন উত্তর দেন না, লক্ষ্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জনতার দিকে।

.

কিন্তু সাপের বিষ মানে কি?

আহারের সঙ্গে সাপের বিষ আসবে কোথা থেকে?

সহসা এ কি আকাশ থেকে পড়া বিপর্যয়ের কথা বলছেন কবরেজ মশাই!

তুষ্টুর মত নির্বিরোধী নিরীহ মানুষটার এত বড় মহাশত্রু কে আছে যে, তার বংশে বাতি দেবার সলতেটুকু উৎপাটিত করবে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করবে!

গুঞ্জন উঠছে জনতা থেকে।

কবরেজ মশাই, সাপের বিষের কথা বলছেন? এত বড় শত্রু কে আছে তুষ্টুর?

কেন, ভগবান! তীক্ষ্ণ একটা ব্যঙ্গ-তিক্ত হাসির সঙ্গে কথাটা শেষ করেন রামকালী, ভগবানের বাড়া পরম শত্রু আর মানুষের কে আছে তুষ্ট?

কিন্তু এত সংক্ষিপ্ত ভাষণ বোঝে কে?

বিশদ না শুনতে পেলে ছাড়বেই বা কেন তোক? শুধু সাপের বিষ ফতোয়া জারি করে নিষ্ঠুরের মত নীরব হয়ে থাকলে প্রশ্ন-বিষের দাহে যে ছটফট করবে লোক!

বলতেই হবে রামকালীকে, সাপে কাটল না, তবু তার বিষ এল কোথা থেকে?

কিন্তু উত্তর দিয়ে যে রামকালী বাকশক্তিরহিত করে দিলেন সবাইকে! এ কী তাজ্জব কথা!

আখের ক্ষেতে সাপের গর্ত ছিল, থাকেই এমন।

ঠিক যে আখ গাছটার গোড়ায় সে বিষের থলি, সেই আখটাই তুলে খেয়েছে হতভাগ্য ছেলেটা।

এ কি বলছেন কবিরাজ মশাই!

যা সত্য তাই বলছি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন রামকালী, গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, নিয়তির উপর হাত নেই, আয়ু কেউ দিতে পারে না। তবু তক্ষুনি টের পেলে বিষ তোলার চেষ্টাটা অন্তত করতাম। কিন্তু তা হবার নয়, অদৃশ্য নিয়তি অমোঘ নিষ্ঠুর।

অমোঘ নিয়তি!

তবু উৎসাহী কোন এক ব্যক্তি সাপের বিষ শোনা মাত্রই হাড়িপাড়ায় ছুটে গিয়ে ডেকে এনেছে বিন্দে ওঝাকে।

বিন্দে এসেও ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।

অর্থাৎ সেই এক কথা–আর কিছু করবার নেই!

কিন্তু মরাকে বাচাতে না পারুক, জ্যান্তটাকে তো মারতে পারে বিন্দে। সেই মূল যমটাকে মন্ত্রের জোরে শেষ করে দিক সে। জনমত প্রবল হয়ে ওঠে।

হয়তো এই তীব্র বাসনার মধ্যে অন্য একটা প্রচ্ছন্ন বাসনাও সুপ্ত হয়ে রয়েছে। সন্দে নেই রামকালী কবিরাজ দেবতা, তার বিচার নির্ভুল, কিন্তু এ হেন কৌতূহলোদ্দীপক কথাটার একটা ফয়সালা হওয়া তো দরকার।

বিন্দেকে ঝুলোঝুলি করতে থাকে সবাই।

রামকালী সামান্য বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেন, যাচাই করতে চাও?

হায় হায়, আজ্ঞে এ কী কথা! কী বলছেন ঠাকুরমশাই!

যা বলছি তাতে ভুল নেই বাবা সকল। যা হোক, একটা কথা কেউ বললেই সেটা বিশ্বাস করে নিতে হবে, তার কোন হেতু নেই। কিন্তু হতভাগার দেহটার যথাযথ একটা ব্যবস্থা আগে না করে—

বিন্দে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে বিষহরির পো যখন কাটেন নি, তখন ওতে আমার কিছু করার নেই। ও আপনার সহজ মিত্যুর হিসেবেই যা করবার করতে হবে।

কিন্তু দেখছ তো বিষে একেবারে নীল হয়ে গেছে!

তা অবিশ্যি দেখছি আজ্ঞে। একেবারে কালকেউটে দংশনের চেহারা। তবু যা কানুন!

বাবা সকল, তোমরা তবে আর বৃথা ভিড় না করে কাজে লাগো। শিথিল স্বরে বলেন রামকালী। রঘুর দিকে আর যেন তাকাতে পারছেন না তিনি। কিন্তু কে এখন কাজে লাগতে যাবে?

এত বড় একটা উত্তেজনা তাদের অধীর করে তুলেছে। সকলে বিন্দেকে ঘিরে ধরে চেঁচাচ্ছে, কড়ি চাল তুই, কড়ি চা! হারামজাদা বেটা সুড়সুড় করে এসে তোর ঝাপিতে ঢুকুক। তারপর তুই আছিস আর তোর বিষপাথর আছে। আছড়ে মেরে ফেল।

তোমরা এত ছেলেমানুষি করছ কেন? সাপটাকে ঠিক পাওয়াই যাবে তার নিশ্চয়তা কি?

পাওয়া যাবে না মানে? আপনি যখন বলছেন–

বিষ তো ঠিক, কিন্তু আখের ক্ষেতটা আমার অনুমান মাত্র, তার আগে জলটল কিছুই যখন খায় নি বলছে–তাই। কিন্তু এখন বিন্দের কীর্তি নিয়ে পড়লে তোমরা তো।

কিন্তু যে যতই ভয়-ভঙ্কিত করুক রামকালীকে, আজকের উত্তেজনা তাকে ছাপিয়ে উঠেছে। যদি আখের গাছের গোড়ায় সাপের বাসা থাকে, সেই খেয়ে জলজ্যান্ত একটা ‘সাদস্যি’ গোয়ালার ছেলে এক দণ্ডে মরে যাবে? তা যদি হয়, সেটা চোখের সামনে যাচাই হোক!

সাপের গর্ত আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত কেউ নড়বে না।

অতএব সমস্ত দৃশ্য যথাযথ রয়ে গেল, রঘুর ব্যবস্থায় কেউ গাও দিল না, বিন্দে ওঝা মহাকলরবে সাপ চেলে আনার মন্ত্র আওড়াতে শুরু করে দিল।

রামকালী চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন, হয়তো বা শেষ অবধি দাঁড়িয়েই থাকতেন, হয়তো বা একসময় চলেই যেতেন, কিন্তু সহসা সেজখুড়ো এসে হাজির হয়ে চাপা গলায় ডাক দিলেন, রামকালী!

খানিক আগে গ্রামের আরও অনেক কাজের লোকের মত সেজকর্তাও একবার এখানে এসে ঘুরেফিরে নানা মন্তব্য করে চলে গেছেন। আবার ফিরে এলেন কোন বার্তা নিয়ে?

না, বার্তাটা বলতে রাজী নন সেজকর্তা।

তবে জরুরী দরকার।

বাড়ি যেতে হবে রামকালীকে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন আর করলেন না রামকালী, ধীরে ধীরে সরে এলেন বুড়ো বটতলা থেকে। অকর্মা একদল লোক তখন বিন্দেকে ঘিরে উন্মত্ত হট্টগোল করছে।

ভাবলেন মৃত্যুর কারণ না বললেই হত। মৃত্যু মৃত্যুই। মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারলেই কি তুই নাতিকে ফিরে পাবে? নাকি আততায়ীকে শেষ করে ফেললেই পাবে?

তা পায় না।

তবু মৃত্যুর পর মৃত্যুর কারণ নিয়ে মাথা ঘামায় লোকে। আর খুন হলে নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীর ফাঁসি ঘটাবার জন্যে মরণ-বাচন পণ করে লড়ে।

.

আকাশ আর পাতাল, পাহাড় আর সমুদ্র।

কোন পরিবেশ থেকে কোন পরিবেশ।

কিন্তু ঘটনা যাই হোক, রামকালীর অন্তঃপুরেও প্রায় শোকেরই দৃশ্য। দীনতারিণী চোখ মুছছেন, চোখ মুছছেন কাশীশ্বরী, ভুবনেশ্বরী মূৰ্ছাতুরার মত পড়ে আছে একপাশে, মোক্ষদা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং সেজখুড়ী, কুঞ্জর বৌ, আশ্রিতা অনুগতা প্রভৃতি অন্যান্য নারীকুল নিম্নস্বরে রামকালীর জেদ তেজ ও অদূরদর্শিতার নিন্দাবাদ করছেন।

শুধু সারদা সেখানে নেই, সে তদব্যস্তে কুটুমবাড়ির লোকের আহার-আয়োজনে ব্যাপৃত আছে।

তুষ্টু গয়লার নাতির ব্যাপার নিয়ে সারা গ্রাম আজ তোলপাড়, তবে বাইরের কোনো হুজুগে এ বাড়ির অন্তঃপুরিকাঁদের উঁকি দেবার অধিকার নেই, বাদে মোক্ষদা।

মোক্ষদা একবার দেখে এসে স্নান করেছেন, আর যাবেন না। গিয়ে করবেনই বা কি?

সত্যর শ্বশুরের প্রেরিত চিঠি কুঞ্জবিহারী পড়ে দিয়েছেন, আর তার পর থেকেই বাড়িতে এই শোকের ঝড় বইছে।

জামাইয়ের মা-বাপ যদি ছেলের আবার বিয়ে দেয়, মেয়ের মৃত্যুর চাইতে সেটা আর কম কি! পরের মেয়ে-বৌকে উদারতার উপদেশ দেওয়া যায়, তার মধ্যে সতীনের হিংসের পরিচয় পেলে নিন্দে করা যায়, কিন্তু ঘরের মেয়ের কথা আলাদা।

সারাদিনের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ আর তুষ্ট্রর নাতির ওই শোচনীয় পরিণামে ক্লিষ্ট মন নিয়ে বাড়ি ঢুকেই ঘটনাটা শুনলেন রামকালী।

তীক্ষ্ণ তীব্র দুই চোখের মণিতে জ্বলে উঠল দু-ডেলা আগুন। মনে হল ফেটে পড়বেন এখুনি, ধৈর্যচ্যুত হয়ে চিৎকার করে উঠবেন, কিন্তু তা তিনি করলেন না, শুধু ভয়াবহ ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন, কে এসেছে চিঠি নিয়ে?

এ সময় মোক্ষদা ভিন্ন আর কার সাধ্য আছে সামনে এগিয়ে যাবার? তিনিই গেলেন। বললেন, এনেছে ওদের ওখানে এক আচায্যিদের ছেলে। গোপেন আচায্যি না কি বলল।

কোথায় সে? চণ্ডীমণ্ডপে?

.

না, খেতে বসেছে।

ঠিক আছে খাওয়া হলে আমার সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়ে দিও। চণ্ডীমণ্ডপে আছি আমি।

মোক্ষদা প্রমাদ গুনে বলেন, তা তুমিও তো আজ সারাদিন নাওয়া-খাওয়া কর নি!

যাক বেলা পড়ে এসেছে, একেবারে সন্ধ্যাহ্নিক সেরে যা হয় হবে।

লোকটা একটু রগচটা আছে, একটু বুঝেসুঝে কথা কয়য়া তার সঙ্গে।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বললেন, লোকটা একটু কি আছে?

বলছিলাম রগচটা আছে।

মোক্ষদাকে অবাক করে দিয়ে সহসা হেসে ওঠেন রামকালী, তাতে কি? আমি তো আর রগচটা নই!

.

তা বলেছিলেন রামকালী ঠিকই।

রগ মাথা সবই তিনি খুব ঠাণ্ডা রেখেছিলেন; বুঝিবা অতি মাত্রাতেই রেখেছিলেন; গোপেন আচায্যিকে ডেকে বেয়াইবাড়ির কুশলবার্তা নিয়ে হাস্যবদনে বলেছিলেন, শুনলাম নাকি বেয়াই মশাইয়ের ছেলের বিয়ে! বলো শুনে খুব আনন্দিত হয়েছি। নেমন্তন্ন পেলে উচিতমত লৌকিকতা পাঠিয়ে দেব।

গেজেল গোপেন আচায্যি কটুকাটব্য দূরের কথা, কথা কইতেই ভুলে গেল, হাঁ করে চেয়ে রইল।

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তোমার?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আজ রাতে তো আর ফিরছ না?

আজ্ঞে না।

বেশ। সকালে জলটল খেয়ে যাত্রা করো।

আজ্ঞে মেয়ে তা হলে পাঠাবেন না?

মেয়ে? কার মেয়ে? কোথায় পাঠাবার কথা বলছ হে?

গোপেন এবার সাহসে ভর করে বলে ওঠে, আজ্ঞে, আজ্ঞে আপনার মেয়ের কথা ছাড়া আপনাকে আর কার কথা বলতে আসব? মেয়ে তাহলে পাঠাবেন না?

আরে বাপু, কোথায় পাঠাব তাই বলো? ভদ্রলোকের মেয়ে ভদ্রলোকের ঘরেই যেতে পারে, যেখানে সেখানে তো যেতে পারে না?

গোপেনের শীর্ণ মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে, বেশ, তবে পত্রে তাই লিখে দিন।

আবার পত্র লিখতে হবে? এই তুচ্ছ কথাটুকু তুমি বলতে পারবে না?

আজ্ঞে না। আমি গেঁজেল-নেশেল মানুষ, আমার কথায় বিশ্বাস করে না করে! এসেছি যখন পাকা দলিলই নিয়ে যাবো/

হুঁ। বলে মিনিটখানেক ভুরু কুঁচকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন রামকালী, তার পর বলেন, আচ্ছা তাই হবে। পত্র লিখে রাখব, কাল সকালে রওনা দেবার আগে নিও।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তবু ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লেন রামকালী।

না, সন্ধ্যাহ্নিকের পূর্বে হাতমুখ ধুতে ঘাটে গেলেন না, গেলেন বুড়ো বটগাছতলার দিকে। কি করল ওরা দেখা যাক। এতক্ষণ পরে আবার রঘুর চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।

উঃ, নিয়তি কী অকরুণ।

.

বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন রামকালী।

চলচলিয়ে চোটপায়ে আসছে কে অন্ধকারে? সত্যবতী না?

তুই এখানে একলা যে?

একলা নয় বাবা, নেড়ু এসেছিল, তা ও এখন ফিরল না।

এসেছিলি কেন?

কেন, সেকথা আর শুধোচ্ছ কেন বাবা? সত্য বিষণ্ণ হতাশ কণ্ঠে বলে, রঘুটাকে একবার শেষ দেখা দেখতে।

এভাবে এসে ভাল কর নি। সেজঠাকুমার সঙ্গে এলে পারতে।

সেজঠাকুমার তো আটবার ডুব দেওয়া হয়ে গেছে, আর আসত?

আচ্ছা বাড়ি যাও।

যাচ্ছি।…বাবা—

কি হল? কিছু বলবে?

বলছি—

কি? কি বলতে চাও বলো?

বলছি কোথা থেকে যেন একটা লোক এসেছে না পত্তর নিয়ে?

রামকালী মেয়ের মুখে এ প্রসঙ্গে শুনে অবাক হন। তার পর ভাবেন, মেয়েটা তো চিরকেলে বেপরোয়া। শ্বশুরবাড়ি যাবার ভয়ে বাপের কাছে আর্জি করতে এসেছে। তাই সস্নেহে বলেন, হ্যাঁ,এসেছে তো। তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে। তার কি?

বলছিলাম কি– সত্যবতীর কথা বলার আগে চিন্তা আশ্চর্য বটে!

রামকালী মনে মনে হাসেন, শ্বশুরবাড়ি শব্দটাই মেয়েদের এমন!

বলো কি বলছ?

আচ্ছা এখন থাক। তুমি ঘুরে এসো। গুছিয়ে বলবার কথা। রঘুটার মিতদেহ দেখে অবধি মনটা বড় ডুকরোচ্ছে। বাড়ি ফিরে একটু জিরোই।

আচ্ছা। বলে চলে যান রামকালী।

এই অবোধ মেয়ে–একে এক্ষুনি শ্বশুরবাড়ি পাঠানো চলে? অসম্ভব!

.

পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে!

বহু কণ্ঠের একটা উন্মত্ত উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে কবরেজবাড়ির দিকে, কবরেজ মশাই, পাওয়া গেছে!

কী পেল ওরা? কিসের এত উল্লাস? কোন পরম প্রাপ্তিতে মানুষ এমন উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে? চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়া থেকে নেমে এলেন রামকালী। তবে কি হতভাগ্য রঘুর প্রাণটাই ফিনে পাওয়া গেল তুষ্টুর পূর্বজন্মের পুণ্যে? কলিযুগেও ভগবান কানে শুনতে পান?

রঘু কি শুধু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল?

মৃত্যুর কাছাকাছি অচৈতন্যতার যে গভীর স্তর, সেখানে ডুবেছিল? জটার বৌয়ের মত? রামকালীর নির্ণয় ভুল? তাই হোক, তাই হোক। হে ঈশ্বর, একেবারের জন্য অন্তত তুমি রামকালীর গর্ব খর্ব করো, একবারের মত প্রমাণ করো রামকালীর নির্ণয় ভুল!

.

নাঃ, কলিযুগে ভগবান হাবা কালা ঠুঁটো। রামকালীর গর্ব খর্ব করবারও গরজ নেই তার। রঘুর প্রাণটা ওরা ফিরে পায় নি, পেয়েছে তার প্রাণঘাতককে! ওঝার মন্ত্রচালনার গুণে সাপটা এসে লুটিয়ে পড়েছে মুখে ফেনা ভেঙে। আশ্চর্য! এ এক পরম আশ্চর্য!

সাপটাকে নাকি নিতে চেয়েছিল ওঝা, কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল, এমন জাতপাত দৈবাৎ মেলে! কিন্তু জনতার আক্রোশ থেকে রক্ষা করতে পারে নি তার জাতসাপকে। লাঠি দিয়ে আর বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে তার গোল চকচকে দেহটাকে ছেচে কুটে চ্যাপটা করে দিয়েছে সবাই।

অপরাধ নিও না মা জগদগৌরী! বলেছে আর পিটিয়েছে।

এখন লম্বা একটা বাঁশের আগায় সেই মরা সাপটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে ওরা এসেছে রামকালীর জয়গান করতে। ওঝা বুড়োও তার নিকষ-কালো গুলি পাকানো বেঁটে শরীরটাকে নিয়ে আসছে ছুটে ছুটে বকশিশের আশায়। মোটা বকশিশ কি আর না দেবেন রামকালী? ওঝার সাফল্য যে রামকালীরও সাফল্য!

উল্লাস-চীৎকার-রত এই লোকগুলো যেন একটা অখণ্ড বর্বরতার প্রতীক। ঘৃণায় ধিক্কারে মনটা বিষিয়ে গেল রামকালীর, হাত তুলে ওদের থামতে নির্দেশ দিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন, কী হয়েছে কী? এত স্ফূর্তি কিসের তোমাদের? রঘু বেঁচে উঠেছে?

বেঁচে উঠবে! একজন মহোৎসাহে বলে ওঠে, ভগবানের সাধ্যি কি ওকে বাঁচায়! একেবারে কালনাগিনীর বিষ! কিন্তু ধন্যি বলি কবরেজ মশাই আপনার শিক্ষা! কামড়ায় নি, শুধু

থামো! ধমকে ওঠেন রামকালী, তা ওই নিয়ে এত হৈ-চৈ করছ কি জন্যে? একটা বালক এখনো মরে পড়ে রয়েছে!

সহসা একটা প্রবল আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে রামকালী চাটুয্যের, যেমনটা তার বড় হয়। রঘুর এই শোচনীয় মৃত্যুটা বড় লেগেছে রামকালীর। বার বার মনে হচ্ছে, হয়তো সময় থাকতে রামকালীর হাতে পড়লে বেঁচে যেত ছেলেটা।

ভাবতে চেষ্টা করছেন, নিয়তি অমোঘ আয়ু নির্দিষ্ট, এ চিন্তা মূঢ়তা, তবু সে চিন্তাকে রোধ করতে পারছেন না। বিষ-নিবারক ওষুধগুলো তাদের নাম আর চেহারা নিয়ে অনবরত মনে ধাক্কা দিচ্ছে।

আজ্ঞে কর্তা, মা বিষহরি নিলে কে কি করতে পারে? তবে কীর্তি একটা দেখালেন বটে! বলে ওঠে ওঝা বুড়ো, তবে আমাকেও মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয়েছে কত্তা! বেটী কি আসতে চায়? একেবারে মোক্ষম মন্তর ঝেড়ে তবে–।

বেশ, শুনে সুখী হলাম। যাও, তোমরা এখন ওটার একটা সঙ্গতি করো গে। সাপ মারলে তাকে শাস্ত্রীয় আচারে দাহ করা নিয়ম, সেই কথাই উল্লেখ করে কথাটা বলেন, তার পর ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলেন, আর সেই হতভাগাটারও একটা গতির ব্যবস্থা করোগে। তুষ্টুর একার ঘাড়ে সব দায়টা চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থেকো না।

জনতার উল্লাসটা একটু ব্যাহত হয়। এটা কী হল! এমনটা তো তারা আশা করে আসে নি। ভেবেছিল, সাপটা আবিষ্কৃত হয়েছে দেখে নিঃসন্দেহে উফুল্ল হবেন রামকালী, কারণ এটা তার জয়পতাকা বলা চলে। অনেকের মধ্যেই তো একটা অবিশ্বাস উঁকি দিয়েছিল, কবরেজ মশাইয়ের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস সত্ত্বেও।

একেবারে একটা অসম্ভব কথাই যে বলেছিলেন রামকালী। অসম্ভবও যে সম্ভব হয়, এ কথা প্রমাণ করত কে এই সাপটা ছাড়া? অথচ রামকালী যেন নির্বিকার।

ক্ষুব্ধ হল, আহত হল ওরা।

সে ব্যবস্থা কি আর না হচ্ছে কবরেজ মশাই, ওরা বলে, এতক্ষণে বাঁশ কাটা হয়ে গেল বোধ হয়। তবে কথা হচ্ছে সাপের মড়া, ওকে তো ভাসাতে হবে!

না। ভারী গলায় বলেন রামকালী, সাপে কাটে নি। যথারীতি দাহর ব্যবস্থাই করো গে। কতগুলো হৈ-চৈ করো না।

বাঁশ ঘাড়ে করে চলে গেল ওরা, তার পিছনে গ্রাম-বেঁটানো ছেলেমেয়ে ইতরভদ্র। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল রামকালীর, এরা আমাদের আত্মীয়। এই আমাদের প্রতিবেশী! বুনো জঙ্গলে কোন সাঁওতালদের থেকে এমন কি উন্নত এরা? বর্বরতার সুযোগ পেলেই তো মেতে উঠতে চায় সেই বন্য বর্বরতায়! মৃত্যুকে যে একটু শ্রদ্ধা করতে হয়, শ্রদ্ধার লক্ষণ যে নীরবতা, এ বোধের কণামাত্র ও তো নেই এদের মধ্যে।

কর্তা আমার বকশিশটা?

নিকটে সরে এসে হাত কচলায় বিলে বুড়ো।

বকশিশ? রামকালী ভুরুর তীক্ষ্ণতায় কপালে রেখা এঁকে বলেন, বকশিশ কিসের?

আজ্ঞে কত্তা-!

বলছি বকশিশ কিসের? ছেলেটাকে বাঁচিয়েছ?

সে আজ্ঞে মৃত্যুর পর আর বাঁচাবে কে?

হ্যাঁ, আমি তা জানি। শুধু এটাই বুঝতে পারছি না, বকশিশ পাবার দাবিটা কখন হল তোমার?

বেশ, বকশিশ না দ্যান, মজুরিটা তো দেবেন আজ্ঞে! ওঝা এবার রুখে ওঠে।

সেটা দেবে যারা ডেকে এনেছে– শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেন রামকালী, আমি তোমায় ডেকে আনি নি।

দশজনের মধ্যে কাকে ধরতে যাব কত্তা, বিন্দে বেজার মুখে বলে, না দ্যান তো চলে যাব। গরীব মানুষ

দাঁড়াও। রামকালী বেনিয়ানের পকেট থেকে নগদ দুটি টাকা বার করে ওর হাতে দিয়ে আরও গম্ভীর গলায় বলেন, শুধু তোমার মজুরি নয়, একটা সাপেরও দাম। দামী সাপটা গেল তোমার!

বুড়ো বিহ্বল দৃষ্টি মেলে অভিভূত কণ্ঠে বলে, আজ্ঞে কী বলছ কত্তা?

যা বলছি ঠিকই বুঝেছ। যাও

কত্তা!

কটা সাপ তোমার ঝাপিতে ছিল বুড়ো? নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রামকালী আস্তে উচ্চারণ করেন কথাটা।

সে দৃষ্টির সামনে কেঁপে ওঠে লোকটা, কাঁদো কাদো গলায় বলে, কত্তা, তুমি অন্তরযামী

বিশ্বাস করছ সে-কথা? আচ্ছা যাও, ভয় নেই।

টাকা অভয় দুটো জিনিস পেয়ে গেছে লোকটা, অতএব আর দাঁড়ায় না। কি জানি ‘অগ্নিমুখ দেবতা’ এক্ষুনি যদি মত পাল্টায়!

রামকালী অদ্ভুত একটা ক্ষোভের দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন। এদের তো নিজেদের অজ্ঞতার শেষ নেই, বুদ্ধিহীনতার চরম প্রতীক, তবু অপরের অজ্ঞতা আর মূঢ়তাকে উপজীবিকা করে চালিয়েও চলেছে দিব্যি!

সাপটা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু ধারণা করেন নি লোকটা এত সহজে স্বীকার পাবে, এক কথায় এমন গুটিয়ে কেঁচো হয়ে যাবে!

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে একটা বিষণ্ণ বেদনায়। দেহের রোগ সারাবার ভার চিকিৎসকের হাতে, কিন্তু মনের রোগ কে সারাবে? কুসংস্কার, অজ্ঞতা, বোকামি–অথচ তার সঙ্গে সোল আনা কুটিল বুদ্ধি। আশ্চর্য!

.

অন্ধকার হয়ে গেছে। আহ্নিকের সময় উত্তীর্ণ প্রায়, তবু সেই দাওয়ার ধারেই জলচৌকিটার ওপর বসে আছেন রামকালী। খড়মটা পায়ে পরা নেই, পা দুটো আলগা তার ওপর চাপানো। অন্ধকারে খড়মের রূপোর ‘বৌল’ দুটো ঈষৎ চকচক করছে।

বাবা!

চমকে উঠলেন এই অপ্রত্যাশিত ডাকে।

সত্য! তুমি এখানে? ও, আহ্নিকের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাই বলতে এসেছ? যাও মা, তুমি ভেতরে যাও।

আমি সে কথা বলতে আসি নি বাবা!

সে কথা বলতে আস নি! তা হলে?

বলছিলাম প্রায় মরীয়ার মতন বলে ফেলে সত্য, বারুইপুরের লোককে, হ্যাঁ করেই দাও না বাবা।

বারুইপুরের!

রামকালী অবাক হয়ে বলেন, হ্যাঁ করে দেব? কি হ্যাঁ করে দেব?

তুমি তো বুঝতেই পারছ বাবা–সত্য কাতর সুরে বলে, আমি আর নিলুজ্জর মত মুখ ফুটে কি বলব!

রামকালী মেয়ের মুখটা দেখতে পান না অন্ধকারে, কিন্তু স্বরটা ধরতে পারেন, তবু বুঝতে সত্যিই পারেন না, সত্য কি বলতে চায়? বারুইপুরের লোকটার চলে যাওয়ার ব্যাপারে হ্যাঁ করতে বলতে চাইছে নাকি? রামকালী তো সে রায় দিয়েছেন। তবে? বাড়ির মেয়েরা বোধ হয় এখনো জেব টানছেন!

সান্ত্বনার গলায় বলেন, ভয় পেও না, শ্বশুরবাড়ি তোমায় যেতে হবে না এখন।

সত্য বোঝে বাবা তার আবেদন ধরতে পারেননি, আর পারার কথাও নয়। সত্যর মতন কোন মেয়েটা আর নিজের গলা নিজে কাটতে চায়? কিন্তু সত্য যে সাতপাঁচ ভেবে তাই চাইছে। হাড়িকাঠের নিচে গলাটা বাড়িয়েই দিচ্ছে। পিসঠাকুমার দল সশব্দে ঘোষণা করেছেন, অহঙ্কারে ধরাকে সরা দেখে রামকালী মেয়ের আখের ঘোচালেন! কুটুমরা রক্তমাংসের মানুষ বৈ তো কাঠ পাথরের নয় যে এত অপমান সহ্য করে বসে থাকবে! ছেলের আবার বিয়ে দেবেই নির্ঘাত, আর রামকালী চিরকাল মেয়ে গলায় করে বসে থাকবেন! গলায় পড়া মেয়ে মানেই হাতেপায়ে বেড়ি!

সত্য ভেবে ঠিক করেছে, বাপ-মায়ের হাতে-পায়ে বেড়ি হয়ে থাকাটা কোন কাজের কথা নয়। তার চাইতে বাপের সুমতি করানোই ভাল।

কিন্তু বাবা তার বক্তব্যই ধরতে পারছেন না।

অতএব আর লজ্জার আবরণ রাখা চলল না। সত্য সকালবেলার চিরেতার জল খাওয়ার মতই চোখ-কান বুজে বলে ফেলল, সে ভয়কে আমি মনে ধরাচ্ছি না বাবা, বরং উল্টো কথাই বলছি। ও তুমি পাঠাবার মন করেই দাও, আমার কপালে মরণ-বাচন যা আছে হবে।

রামকালী স্তম্ভিত হলেন।

এযাবৎ মেয়ের বহু দুঃসাহসের পরিচয় তিনি পেয়েছেন, সে দুঃসাহস পরিপাকও করেছেন। কারণ তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করেছেন, কিন্তু এটা কি? নিজে সেধে শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছে সে?

বয়স্থা মেয়ে নয় যে এ চাওয়ার অন্য অর্থ করবেন, তবে?

কণ্ঠস্বর গম্ভীর হল, হয়তো বা একটু রূঢ়ও, তুমি ইচ্ছে করে শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছ?

যেতে চাইছি কি আর সাধে! বাবার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার আভাস সত্যর চোখে প্রায় জল এনে ফেলেছে, চাইছি অনেক ভেবেচিন্তে। কুটুমকে চটিয়ে শুধু গেরো ডেকে আনা বৈ তো নয়!

রামকালী বুঝলেন, বাড়িতে এই ধরনের কথার চাষ চলেছে। অবোধ শিশু শিখবেই তো। কিন্তু তাই বলে এতই কি অবোধ যে, বাপের সামনে কোন্ কথা বলতে হয় তা বোঝে না?

কঠিন স্বরে বললেন, আমার গেরোর কথা আমিই বুঝব সত্য, তুমি ছেলেমানুষ, এ নিয়ে ভাববার বা এসব কথায় থাকবার দরকার নেই। এটা বাচালতা।

কিন্তু সত্য তো দমবে না!

হাত ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সত্যর কোষ্ঠীতে লেখে নি। তাই ম্লান হলেও জোরালো স্বরে বলে, সে তো বুঝছিই বাবা, বাচালতা নির্লজ্জতা, কিন্তু উপায় কি? সমিস্যে যে প্রবল। এর পর যখন তোমাকে আমায় নিয়ে ভুগতে হবে, তখন যে মরেও শান্তি পাবে না। ওরা ছেলের আবার বিয়ে নাকি দেবে বলেছে! সেটা তো অপমান্যি! তুশ্চু একটা মেয়েসন্তানের জন্যে কেন তোমার উঁচু মাথাটা হেট হবে বাবা!

রামকালীর মনে হল প্রচণ্ড একটা ধমকে মেয়েটার বাচালতা ঠাণ্ডা করে দেন, কিন্তু পরক্ষণেই একটা বিপরীত ভাবের ধাক্কা এল! মেয়েটার মনের মধ্যে আছে কি? এতটুকু মেয়ে এত কথা ভাবেই বা কেন? আর এতখানি দুর্জয় সাহসই বা সংগ্রহ করল কোথা থেকে?

বাপের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আলোচনা ভূ-ভারতে আর কোনো মেয়ে করেছে কখনো? তাও রামকালীর মত রাশভারী বাপ! মা দীনতারিণী পর্যন্ত যার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলেন! তা ছাড়া শ্বশুরবাড়ি শব্দটাই তো মেয়েদের কাছে সাপখোপ বাঘ ভাল্লুক ভূত চোর সব কিছুর চাইতেও ভয়ের। সে ভয়কে জয় করেছে সত্য কোন নির্ভয় মন্ত্রের জোরে?

ঠিক করলেন ধমকে ঠাণ্ডা করবেন না, শেষ অবধি ধৈর্য ধরে শুনবেন ওর কথা। দেখবেন ওর মনের গতির বৈচিত্র্য। রাগের বদলে একটা বিস্মিত কৌতূহল জাগছে।

শান্তগলায় বললেন, মেয়েসন্তান যে তুশ্চ এটা তো তুমি কখনো বলো না?

বলি না, অবস্থাই বলাচ্ছে বাবা। তুশ্চ না হলে আর তাকে সাত-তাড়াতাড়ি পরগোত্তর করে দিতে হয়? একটা সন্তান বলে কথা, তাও তো ঘরে রাখতে পার নি, তবে আর মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে কি হবে বাবা? সেই পরগোত্তরই যখন করে দিয়েছ, তখন আর কি? আজ না হয় কাল  পাঠাতে তো হবেই, বলতে তো পারবে না দেবনা আমার মেয়ে, তবে?

পাঠাবার একটা সময় আছে, নিয়ম আছে, সে তুমি এখন বুঝবে না। ও নিয়ে মিছে মাথা খারাপ করো না। যাও ভেতরে যাও।

ভেতরে নয় যাচ্ছি, কিন্তু মনের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে বাবা। রঘুর মৃত্যু আজ আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। ভগবানের রাজ্যেই যখন সময় বাঁধা নেই, নিয়ম নেই, তখন মানুষের থাকবে কি? এই আজ আমাকে পরের ঘরে পাঠাতে বুক ফাটছে তোমার, এক্ষুনি যদি মৃত্যু এসে দাঁড়ায় দিতেই তো হবে তার হাতে তুলে? সহসা আঁচলের কোণ তুলে চোখটা মুছে নেয় সত্য, তার পর ভারী গলায় বলে, তখন তো বলতে পারবে না এখনও সময় আসে নি, নিয়ম নেই? ও শ্বশুরবাড়ি আর যমের বাড়ি দুই যখন সমতুল্যি, তখন আর মনে খেদ রেখো না। পাঠিয়ে দিয়ে মনে করো সত্য মরে গেছে।

আর বোধ করি শক্ত থাকতে পারে না সত্য, নিজের সেই কাল্পনিক মৃত্যুর শোকেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

স্তব্ধ রামকালী সেই ক্রন্দনবতীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কি শুধুই শেখা বুলি কপচে যায় না সত্যিই এমনি করে ভাবে?

খানিকক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভেঙে বলেন, মন-কেমনের কথা আমি ভাবি না সত্য, তুমি বড়দের মত কথা বলতে শিখেছ তাই বলছি, তোমায় পাঠালে আমার মান থাকবে না।

সত্য গভীর দুঃখে হতাশ স্বরে বলে, বুঝি বাবা, বুঝি না কি? কিন্তু এ তো তবু শুধু ওদের কাছে মান থাকা মান যাওয়া! গলবস্তর হয়ে যেদিন ওদের ঘরে মেয়ে দিয়েছ, মান তো সেদিনই গেছে। কিন্তু ওরা যদি তোমার মেয়েকে ত্যাগ দেয়, তা হলে যে দেশসুদ্ধ লোকের কাছে হতমানি। দু’ দিক বিবেচনা করো বাবা।

রামকালীর গলা দিয়ে বুঝি আর শব্দ বেরোয় না, ভাষা স্তব্ধ হয়ে গেছে তার। মেয়েটা কি সত্যি বালিকা মাত্র নয়, ওর মধ্যে কি কোন শক্তির “ভর” হয়? বুদ্ধির শক্তি, বাক্যের শক্তি?

আচ্ছা তুমি যাও, আমি ভেবে দেখছি।

ভাবো। যা পারো আজ রাত্তিরের মধ্যে ভেবে নাও। ওই হতচ্ছাড়াটা তো রাত পোহাতেই বিদেয় হবে।

ছি মা, শ্বশুরবাড়ির লোকের সম্পর্কে কি এভাবে বলতে আছে?

নেই তো জানি বাবা, কিন্তু দেখে যে অপিরবিত্তি আসছে। কুটুমবাড়িতে পাঠাবার যুগ্যি একটা লোকও জোটে নি!

রামকালী ঈষৎ তরল কণ্ঠে বলে উঠেন, তুই তো আমার মুখ হেঁট হবার ভয়ে সারা, কিন্তু শ্বশুররা ত্যাগ না দিয়ে কি ছাড়বে তোকে? দুদিন ঘর করেই তো ফেরত দেবে। তোকে নিয়ে কে ঘর করবে সত্য? এত বাক্যি কে সইতে পারবে?

সত্য সগৌরবে মাথা তুলে বলে, সে তুমি নিশ্চিন্দি থেকো বাবা, সত্যকে দিয়ে তোমার মুখ কখনো হেট হবে না।

রামকালী গভীর স্নেহে মেয়ের পিঠে একটু হাত রাখেন।

মেয়েটা যে কি, তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। থেকে থেকে সে যে তীক্ষ্ণ একটা প্রশ্নের মত তার সামনে এসে দাঁড়ায়। যে কথাগুলো বলে, সব সময় সেগুলো মেয়ের শেখা কথা বলে উড়িয়ে দেওয়াও শক্ত। সে সব কথা চিন্তিত করে, বুঝিবা ভীতও করে। তবু রামকালী ওকে বুঝছেন, কিন্তু পৃথিবী কি ওকে বুঝবে?

ও কেন সাধারণ হল না?

পুণ্যির মত, বাড়ির আর পাঁচটা মেয়ের মত? রামকালী তাহলে ওর সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতেন। সুখী হতেন।

কিন্তু?

সত্যিই কি সুখী হতেন? সত্য সাধারণ হলে, বোকা হলে, ভোতা হলে? সত্যকে যে তার একটা দামী জিনিস বলে মনে হয়, সেটা কি হত তাহলে? (কবলমাত্র স্নেহের ওজন চাপিয়ে পাল্লাট। এত ভারী করে তুলতে পারতেন?

যাও মা ভেতরে যাও, আহ্নিক করব এবার।

যাচ্ছি– উঠে দাঁড়িয়েই রামকালীর অসাধারণ মেয়ে সহসাই একটা হাস্যকর সাধারণ কথা বলে বসে, ভেতর-দালান পর্যন্ত একটু এগিয়ে দেবে বাবা?

এগিয়ে দেব? কেন রে?

রঘুর দিশ্যটা দেখে অবধি গা-টা কেমন ছমছম করছে বাবা। মেলাই অন্ধকার ওখানটায়।

হ্যাঁ হ্যাঁ চল, যাচ্ছি আমি। কেন যে তুমি গেলে সেখানে! ভাল করো নি। রামকালী কি একটু আশ্বস্ত হলেন? তাঁর নির্ভীক মেয়ের এই ভয়টুকু দেখে?

.

মেলাই অন্ধকারটা পার হয়ে এসে সত্য একবার থমকে দাঁড়াল, তার পর ঝপ করে বলে উঠল, ভাবতে ভুলে যেও না বাবা!

ভাবতে? কি ভাবতে? ও! অন্যমনস্কতা থেকে সচেতনতায় ফিরে আসেন রামকালী, ভেবেছি। পাঠিয়েই দেব তোমায়।

সহসা কান্নায় উথলে উঠল সত্য, আমার উপর রাগ করলে বাবা?

না, রাগ করি নি।

আবার আনবে তো? কান্না অদম্য হয়ে ওঠে।

ওরা যদি পাঠায়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন রামকালী।

পাঠাবে না বৈকি, ইস্! মুহূর্তে কান্না থামিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সত্য, তুমি ওদের মান রাখছ, আর ওরা তোমার মান রাখবে না? পাছে কুটুম্বর সঙ্গে ‘অসরস’ হয়, আসা-যাওয়া বন্ধ হয়, এই ভয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে তবু যেতে চাইছি আমি, বুঝবে না তারা সে কথা?

রামকালী আর একবার চমৎকৃত হলেন।

অতটুকু মগজে এত তলিয়ে ও ভাবে কি করে? তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন, বোঝবার কথা যদি সবাই বুঝত?

মেয়ের বিয়ে দেবার সময় জামাইয়ের রূপ দেখে নেওয়া যায়, কুল দেখে নেওয়া যায়, অবস্থা দেখে নেওয়া যায়, কিন্তু তার সংসারসুদ্ধ পরিজনের প্রকৃতি তো আর দেখে নেওয়া যায় না!

.

মেয়েকে রামকালী গৌরীদান করেছেন।

পাত্র খোঁজার সময় দীনতারিণী বলেছিলেন, তোমার মোটে একটা মেয়ে, পরের ঘরে কেন দেবে? একটি সোন্দর দেখে কুলীনের ছেলে নিয়ে এসে ঘরজামাই রাখো।

ভুবনেশ্বরীও স্পন্দিতচিত্তে শাশুড়ীর অন্তরালে বসে রায় শোনবার জন্যে হাঁ করে ছিল, কিন্তু রামকালী তাদের আশায় জল ঢাললেন। বললেন, ঘরজামাই? ছি ছি ছি!

কেন? দীনতারিণী বুকের ভয় চেপে জেদের সুরে বলেছিলেন, লোকে কি এমন করে না? লোকে তো কত কি করে মা!

তা বৌমার যে আর ছেলেপুলে হবে এ আশা দেখি না, কুষ্টিতেও নাকি আছে এক সন্তান। তালে তোমার বিষয়-আশয় তো জামাই-ই পাবে, ছোট থেকে গড়েপিটে তৈরি না করলে

রামকালী তীব্র প্রতিবাদে মাকে নির্বাক করে দিয়েছিলেন, রাসু থাকতে, তার ভাইয়েরা থাকতে জামাই বিষয় পাবে এ কথা তুমি মুখে আনলে কি করে মা? ছি ছি।

সত্য কেন বাপের ভাত খেতে যাবে? এমন পাত্রে দেব, যাতে জামাইকে শ্বশুরের বিষয়ে লোভ করতে না হয়।

তা সে কথা রামকালী রেখেছিলেন।

মেয়ের যা বিয়ে দিয়েছিলেন, শ্বশুরের সম্পত্তিতে লোভ করার দরকার তাদের নেই।

বিষয়–আশয় ঢের, সে-ও বাপের এক ছেলে।

শুনেছেন বাপ একটু কৃপণ, তা সে আর কি করা যাবে? সব নিখুঁত কি হয়?

তেমনি যে চাঁদের মত জামাই!

তা ছাড়া পরম কুলীন।

এর বেশী আর কি দেখা যায়?

কিন্তু লোভ কি মানুষ দরকার বুঝে করে? রামকালী কি স্বপ্নেও ভেবেছেন তাঁর পরম কুলীন বেহাই শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে আছেন তার বিষয়ের দিকে? এমন তীব্র লোভ যে রামকালীর অবর্তমান অবস্থাটাই তার একান্ত চিন্তনীয় বিষয়?

রামকালীর চাইতে বছর দশেকের বড় হয়েও, নিজে তিনি চিরবর্তমান থাকবেন এমনই আশা।

এসব জানেন না রামকালী।

শুধু জামাই পাঠচর্চা করছে এটা জেনেছেন, জেনে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

ম্লেচ্ছ বিদ্যা বলে হেয় করবেন, এমন সংস্কারাচ্ছন্ন রামকালী নন। শিখুক, ভালই। ম্লেচ্ছদেরই তো রাজত্ব চলছে এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *