১৫. ভোর হয়েছে

ভোর হয়েছে। আমাদের ঘরগুলো যেন সূর্যমলনের মধুর সম্ভাবনায় নববধূর সলজ্জ মুখের মতো রাঙা হয়ে উঠেছে।

বোসদা দরজা খুলে দিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে চা খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। ওঁর হাসিতে সব সময়ই আমার জন্যে অনেক আশ্বাস লুকিয়ে থাকে। মনে একটু বল পেলাম।

শ্রীলেখা দেবীর ব্যাপারটা বললাম। তিনি আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ভয় কী? আমি ওঁর ঠিকানা জানি। দরকার হয় টাকা চেয়ে পাঠাব। তা অবশ্য দরকার হবে না। তিনি নিজেই চেক পাঠিয়ে দেবেন। ঠিক একই ব্যাপার আগেও হয়েছে। স্বামীর ভয়ে রাত্রে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, আবার ভোর না হতেই মিটমাট হয়ে গিয়েছে।

আমার পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বোসদা বললেন, ন্যাটাহারিবাবুর বিশ্বসংসারে কেউ নেই। তাই এখানে একলা পড়ে রয়েছেন। আমাদের পুরনো ম্যানেজারের হুকুম আছে, ওঁকে যেন কখনও চাকরি ছেড়ে চলে যেতে না বলা হয়। যত বয়সই হোক, শাজাহান হোটেলে ওঁর চাকরি চিরকাল বজায় থাকবে।

বোসদা এবার একটা কাচের গেলাস আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাথরুম থেকে গেলাসটা ধুয়ে নিয়ে এসো। একটু দেশি মতে চা খাও। গত রাত্রিটা সত্যিই তোমার খুব খারাপ কেটেছে।

বোসদার ওখানে চা খেয়ে, নিজের বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ দিবানিদ্রার সুখ উপভোগ করেছিলাম জানি না, হঠাৎ গুড়বেড়িয়ার ডাকে উঠে পড়লাম। গুড়বেড়িয়া বললে, কোন এক সায়েব বলা নেই কওয়া নেই, সোজা ছাদে উঠে এসেছেন।

দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারতেই বায়রন সায়েবকে দেখতে পেলাম। তিনি এবার আমার ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বললেন, আন্দাজ করেছিলাম তুমি এখন ঘুমোবে। তবু চলে এলাম। মার্কোর সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল।

কাল রাত্রে আপনাদের জন্যে আমরা বেশ চিন্তায় পড়েছিলাম। আমি বায়রনের জন্যে চায়ের অর্ডার দিয়ে বললাম।

বায়রন বললেন, কালকের রাত্রিটা হয়তো মার্কো এবং আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কেন? বেচারা মার্কোর অন্ধকার দাম্পত্যজীবনে কোনো আলোকপাত করতে পারলেন?

বায়রন একবার সন্দিগ্ধভাবে বাইরের দিকে তাকালেন। তারপর বিছানার উপর ভালোভাবে বসে বললেন, ব্যাপারটা তোমার সব মনে আছে? সুশান-এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের জন্যে মার্কো মনস্থির করেছিলেন। টাকা দিয়ে সুশানকে তার বিরুদ্ধে ডাইভোর্স মামলা দায়ের করতেও রাজি করিয়েছিলেন। চরিত্রহীনতার অভিযোগ প্রমাণের জন্যে লিজা বলে একটি মেয়েরও ব্যবস্থা হয়েছিল। তাকে মার্কো কয়েকটা চিঠিও লিখেছিলেন। তারপর যুদ্ধের ঢেউয়ে সেসব কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল কেউ তার খোঁজ রাখেনি।

আমি বললাম, আমার সব মনে আছে। আপনার বাড়িতে বসে মার্কোর হতভাগ্য জীবনের যে বৃত্তান্ত শুনেছিলাম তা কোনোদিনই ভুলব না।

বায়রনের মুখে আজ সার্থকতার আনন্দ দেখলাম। বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো কেবল নামে ডিকেটটিভ। পেশাদার সাক্ষী ছাড়া আমাদের বোধহয় কিছুই বলা যায় না। আমাদের ক্লায়েন্টরা সব রকম চেষ্টা করে, হতাশ হয়ে আমাদের কাছে আসেন এবং আশা করেন মন্ত্রের শক্তিতে আমরা তাদের সমস্যার সমাধান করে দেব। পুলিস আমাদের কখনও সন্দেহের চোখে, কখনও করুণার চোখে দেখে। আমরা কোনো সাহায্যই পাই না। ওরা হেসে বলে, ছাগল দিয়ে ধান মাড়ানো হলে কেউ আর বলদ কিনত না! কোনো আশাই করিনি। মার্কোকে যে সত্যিই সাহায্য করতে পারব, তা ভাবিনি।

বায়রনের জানাশোনা একজন প্রতিনিধিই খবরটা এনে দিয়েছিলেন। ছাতাওয়ালা গলির একটা অন্ধকার বস্তিতে সে একজন মেয়ের খবর পেয়েছে যে আগে নাকি রেস্তোরাঁয় গান গাইত। ছাতাওয়ালা গলির নাম শুনে আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল; ওই গলি থেকেই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট নিয়ে আমি একদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের কোম্পানি যে বাড়িতে একখানা ঘর অধিকার করে ছিলেন, তার অন্যান্য মহিলা বাসিন্দাদের জীবনধারণপ্রণালী সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণের কারণ ছিল।

এবার সত্যিই আমার অবাক হবার পালা। শুনলাম, গতকাল রাত্রে ওঁরা দুজনে সেই মহিলার খোঁজ করতে ছাতাওয়ালা গলিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহিলার ঘরে অতিথি ছিল। তারা অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, অতিথি হয়তো বেরিয়ে যাবে, তখন তারা মোলাকাত করবেন।

আমার পক্ষে এবার চুপ করে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বায়রনও যেন কিছু বুঝলেন। বাড়ির নম্বর জিজ্ঞাসা করলাম, এবং তিনি যেউত্তর দিলেন, তাতেই আমি চমকে উঠলাম।ওই বাড়িটা! ওই বাড়িটা থেকেই তো আমি ঝুড়ি নিয়ে আসতাম।দুপুরে আমাদের কোম্পানির মালিক পিল্লাই প্রায়ই থাকতেন না। কিন্তু তাতে আমার অসুবিধা হত না। বাড়ির করুণ-হৃদয় মহিলারা আমাকে সাহায্য করতেন। ঝুড়িগুলো গুনে গুনে আলাদা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতেন। আমার জলতেষ্টা পেলে তাদের কাছেই চাইতাম, তারা এনে দিতেন।

বায়রন বললেন, এখানকার কোনো খবর রাখো তুমি? কাউকে চেনো?

ও-বাড়িতে একটা মেয়েও নেই, যার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। ওঁরা আমার সহকর্মী ছিলেন। দুপুরে হেঁড়া স্কার্ট পরে, পায়ে খড়ম গলিয়ে নিচু টুলে বসে বসে তারা আমাদের বুড়িগুলো রং করে দিতেন। রংয়ের পর রোদুরে শুকোতে দিতেন। আকাশে মেঘ করলে ওঁদেরই উঠোন এবং ছাদ থেকে বাস্কেটগুলো নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করতে হত। অতি সৎ মহিলারা। বেচারা পিল্লাই-এর সময় ভালো যাচ্ছিল না, কিন্তু মহিলারা তাকে সাহায্য করতেন। যে রেটে অবসর সময়ে তারা ঝুড়ি রং করে দিতেন সে রেটে কোথাও তোক পাওয়া যেত না।

আমার সঙ্গে তারা ভালো ব্যবহার করতেন। প্রায়ই বলতেন, এই রোদে ঘুরে এসেছ, একটু বিশ্রাম নাও, তারপর আবার বেরিও। না হলে শরীর খারাপ করবে। একজন মহিলা বলতেন, আমাদের সম্বল দেহ, আর তোমাদের গতর। এ দুটোই যত্ন করে রাখতে হবে, না হলে খেতে পাবে না।

বাড়ির বাইরে ছোট্ট বোর্ডে লেখা ছিল সাড়ে দশটার পর এই বাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাউকেই ঢুকতে বা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ছাতাওয়ালা লেনের সেই অন্ধকার বাড়িটাতে আমি জীবনের আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু এখানে তার কোনো স্থান নেই, সে অন্য কোথাও হয়তো বলা যাবে।

বায়রন বললেন, একেই বলে ঈশ্বরের ইচ্ছে। ওরা নিশ্চয়ই তোমাকে চিনতে পারবে; তুমি চলল, আমাকে একটু খোঁজখবর দাও।

 

বায়রনকে নিয়ে সেদিন আমি আমার পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়েছিলাম। বায়রন সেই ভোরেই যেতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, এগারোটার আগে গিয়ে লাভ নেই, এখন ওদের দুপুর রাত। সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছ।

এগারোটার সময় আমাকে দেখে ওরা সবাই প্রায় হই-হই করে উঠেছিল। বাড়িতে ছোট ছোট গোটা পনেরো খুপরি ছিল। কয়েকটা বড় ঘরকে চাচ দিয়ে পার্টিশন করে দুখানা করে নেওয়া হয়েছে। আমার ফর্সা জামাকাপড় দেখেই ওরা বুঝেছিল, আমার জীবনে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। লটারি টিকিট পেয়েছ নাকি? ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল।

আমি বলেছিলাম, শাজাহান হোটেলে চাকরি করছি।

শাজাহান হোটেল! তারা অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওখানে নাকি সাড়ে আট টাকায় ওয়ান্ডারফুল ডিনার পাওয়া যায়? আমাদের খুব খেতে ইচ্ছে করে। টাকা থাকলে দল বেঁধে আমরা যেতাম। যুদ্ধের সময় খুব সুবিধে ছিল। যুদ্ধের পরে যারা এ-লাইনে এসেছে তারা কৌতূহলে সিনিয়ারদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তখন সোলজারদের বললেই খুশি হয়ে হোটেলে নিয়ে যেত। আর এখন একটা সিগারেট চাইলেই ভাবে ঠকিয়ে নিচ্ছে। বিল সরকারের মনোবৃত্তি নিয়ে আজকাল কলকাতার লোকরা আনন্দ করতে আসে।

বললাম, আপনারা কেউ সুশান মনরোকে চিনতেন? পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় গান গাইতেন।

এমন নাম তো আমরা কেউ শুনিনি। পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় যে গান গাইত সে কোন দুঃখে আমাদের এখানে আসবে?

আর একজন বললে, কেন? এলিজাবেথ? ও বুড়ি তো বলে, একদিন সে নাকি গান গাইত। এখন ভাগ্যদোষে এই ডাস্টবিনে এসে পড়েছে।

এলিজাবেথ কে? আমি বললাম।

কেন, মনে পড়ছে না? যে তোমার ঝুড়িগুলোর হিসেব রাখত। একদিন দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে এসে যার তোয়ালে নিয়ে তুমি গা মুছলে।

এবার মনে পড়েছে। এলিজাবেথ লিজা। কোথায় তিনি? আমি প্রশ্ন করলাম।

শুয়ে আছে। অসুখ করেছে, কে একজন বললে। দূর থেকে আমাকে একজন ঘরটা দেখিয়ে দিল। দরজাটা বাইরে থেকে ভেজানো ছিল। আমি দরজায় টোকা দিলাম। ভিতর থেকে মিহি গলার উত্তর এল, কাম ইন।

এলিজাবেথ আমাকে দেখেই চিনতে পারল। বিছানার উপর সে উঠে বসবার চেষ্টা করল। ঘরের মধ্যে সব কিছুই কেমন নোংরা হয়ে পড়ে রয়েছে। আগে এমন ছিল না। হাতটা নেড়ে লিজা আমাকে একটা টুল নিয়ে বসতে বলল। আমি বললাম, চিনতে পারছেন?

লিজা ম্লান হাসল। তা পারব কেন? তুমি চলে গেলে আর ম্যাগপিলের আয় কমে গেল। এখানকার কারবারে অনেকে ওকে ঠকালে। মাল নিয়ে গিয়ে আর দাম দিলে না। ম্যাগপিল বাধ্য হয়ে এখান থেকে চলে গেল। আমারও রোজগার কমে গিয়েছে, ঝুড়ির কাজ করে যা তোক কিছু আসত। এখন শোচনীয় অবস্থা, কমবয়সী মেয়েগুলো দয়া করে রেখে দিয়েছে তাই। ওরাই দেখাশোনা করে, ঘরটা ঝাট দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে গোবেচারা খদ্দের পেলে পাঠিয়ে দেয়।

লিজা এবার পা নাড়াবার চেষ্টা করলে।এখন আমার হাঁটবার অবস্থা নেই। শরীর ভালো, কিন্তু পায়ের কষ্ট। অনেকদিন আগে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তখন ভালো ডাক্তারকে দেখাতে পারিনি। জোড়াপট্টি দিয়ে তখন ভালো হয়েছিলাম। এখন গোঁজামিল দেবার ফল বুঝতে পারছি।

এই লিজাকে আগেও আমি দেখেছি। তার সঙ্গে বেকার জীবনে আমার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। কিন্তু বেচারা মার্কোপোলোর জীবনে অনেকদিন আগে সে-ই যে জড়িয়ে গিয়েছিল তা যদি জানতাম। আমাকে দেখে হয়তো তার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। তাই লিজা এবার গুনগুন করে গান ধরলে। হয়তো এমন কোনো গানের টুকরো যা একদিন কলকাতার প্রমোদবিলাসীদের অন্তরে সাড়া জাগাত। লিজা বললে, দাঁড়াতে পারি না। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যাই। মাঝে মাঝে সে শক্তিও থাকে না। তখন বারবারা, প্যামেলা ওরা বেপ্যানের ব্যবস্থা করে দেয়।

আমি নিশ্চল পাথরের মতো এই আশ্চর্য জীবনের দিকে তাকিয়েছিলাম। দুঃখের অনুভূতি এখন আমার মনে আর বেদনা সৃষ্টি করে না। মাঝে মাঝে যখন সত্যিই অভিভূত হই, তখন কসাইখানার কথা মনে পড়ে যায়। নিজেকে কসাইখানার প্রতীক্ষারত অসংখ্য ছাগলের একটা মনে হয়, আমাদেরই কাউকে যেন এই মাত্র সেই ভয়াবহ পরিণতির জন্যে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।

লিজা বললে, কাউকে একটু ডাকি। তোমার জন্যে পাশের দোকান থেকে চা নিয়ে আসুক। হাজার হোক তুমি এখন অতিথি।

আমি বললাম, চায়ের দরকার নেই।

আমার কথায় লিজা বোধহয় কষ্ট পেল। লিজা তার ক্লান্ত এবং স্তিমিত চোখদুটো উজ্জ্বল করবার চেষ্টা করে বললে, ভাবছ খরচা করিয়ে দিচ্ছ। আমার এখন টাকা আছে। কাল রাত্রেই বেশ কিছু রোজগার করেছি।

আমি সত্যিই যেন পাথর হয়ে গিয়েছি। আমার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছে।

কোথায় কাজ করছ? লিজা প্রশ্ন করলে।

শাজাহান হোটেলে।

শাজাহান! লিজা যেন সত্যিই খুশি হল। আহা ওদের রান্না! একবার খেলে সারাজীবন মুখে লেগে থাকে। ওদের ওমলেট শ্যামপিনো। ওরা তোমাদের বিনা পয়সায় যদি দেয় তাহলে আমাকে একদিন এক প্লেট জাম্বো গ্রীল শাজাহান থেকে এনে দিও তো।

আমি বললাম, একদিন আপনাকে খাওয়াব।

কত দাম? লিজা বিছানায় নড়ে উঠে আমাকে প্রশ্ন করলে।

টাকা সাতেক হবে, আমি বললাম।

অথচ তোমাদের পয়সা লাগবে না! লিজা বিস্মিত কণ্ঠে বললে।

আমাকে পয়সা দিয়েই কিনতে হবে। তবু চুপ করে রইলাম। টাকার কথা শুনলে বেচারা হয়তো খেতে চাইবে না।

চা-এর কাপে চুমুক দিতে কেমন যেন ঘেন্না লাগছিল। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমার কৃতজ্ঞ মন সহ্য করতে প্রস্তুত থাকলেও অসন্তুষ্ট দেহটা যেন বিদ্রোহ করে উঠছিল।

বললাম, সুশান বলে কাউকে চিনতেন আপনি?

সুশান! সুশান মনরোর কথা বলছ? যে একদিন দোকানে কেক বিক্রি করত? আমারই জায়গায় যে গান গাইতে আরম্ভ করেছিল দশ টাকা মাইনেয়? তাকে চিনি না? বলো কী গো?

আমার মনে হল লিজা সুশানকে তেমন ভালো চোখে দেখে না। লিজা হঠাৎ বললে, তুমি তাকে চিনলে কী করে?

বললাম, একসাইজ ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধুর কাছে তার গল্প শুনছিলাম। থিয়েটার রোডে ফ্ল্যাট নিয়ে সে নাকি অনেক টাকা রোজগার করেছিল।

লিজার চোখ দুটো বিদ্যুতের অভাবে ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সুশান আবার ফিরে এসেছে নাকি? মেজর স্যানন তার পিছনে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে তো। আমি তখনই বলেছিলাম, ওই রকম হবে।

অনেকদিন আগে আগ্নেগিরির প্রকোপে আটলান্টিক মহাসাগরে হারিয়ে যাওয়া এক দ্বীপ হঠাৎ যেন আমারই চোখের সামনে আবার ভেসে উঠছে। যা এতদিন অসাধ্য বলে পরিগণিত ছিল, আমিই যেন আকস্মিক তাকে খুঁজে বার করবার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেছি।

লিজা বললে, টাকা দিলে তখন সবই হত। আমেরিকান সোলজাররা টাকা দিয়ে সব করাতে পারত। না হলে পুলিসের খাতায় যার অমন খারাপ নাম, তাকে সতীসাধ্বী সাজিয়ে স্যানন কেমন করে ইলিনয়তে নিয়ে গেল?ইচ্ছে ছিল বিয়ের কাজটা এখান থেকে সেরে যায়, কিন্তু সাহস করলে না। তখনও কোর্টে ডাইভোর্স মামলা ঝুলছে। আইনের চোখ তার অন্য স্বামী রয়েছে। ইলিনয়তে সে খবর কে আর রাখছে? আর এতদিনে নামধাম পালটিয়ে সুশান মনরো যে কী হয়ে গেছে কে জানে। কিন্তু আমি তখনই বলেছিলাম, সব ভালো যার শেষ ভালো। এর শেষ ভালো হবে না।

একবার লোভ হয়েছিল, লিজাকে সব খুলে বলি। প্রশ্ন করি, মার্কোপোলো নামে কোনো বিদেশির সঙ্গে শাজাহানের ডাইনিং রুমে তার সান্ধ্যবিহারের কথা মনে আছে কিনা। কিন্তু অনেক কষ্টে সে লোভ সংবরণ করে, সেদিন লিজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছি।

আরও কিছুক্ষণ বসবার ইচ্ছে ছিল। ছাতাওয়ালা লেনে আমার জীবনের এক ফেলে-আসা অধ্যায়কে অনেকদিন পরে খুঁজে পেয়ে আবার খুঁটিয়ে দেখবার লোভ হচ্ছিল। কিন্তু বাইরে বায়রন আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। একলা রাস্তায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তিনি নিশ্চয়ই অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।

 

ইউরেকা! ইউরেকা! বায়রন সায়েব আনন্দে দিশেহারা হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ইট ওয়াজ গড় উইল। না হলে এমন হবে কেন?

হলে তুমিও বা শাজাহানে এসে ভর্তি হবে কেন? এবং তারও আগে তুমি ঝুড়ি বেচাকেনার জন্যে ছাতাওয়ালা গলিতে আসবে কেন?

একটা ট্যাক্সির দিকে বায়রন সায়েব এবার ছুটে গেলেন। বললেন, আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। এখনই শাজাহান হোটেল।

শাজাহান হোটেলে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে বায়রন উপরে উঠে গিয়েছিলেন। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে মার্কোকে সঙ্গে করে আবার বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

কাউন্টারে উইলিয়ম ঘোষ তখন ডিউটি দিচ্ছিল। সত্যসুন্দরদারও এই সময়ে থাকবার কথা ছিল, কিন্তু তাঁকে দেখলাম না। বেচারা উইলিয়ম! ওর মনটা যে বেশ খারাপ তা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম। কলের মতো সে কাজ করে যাচ্ছে। কাছে এসে বললাম, কাউন্টারে একা হিমশিম খাচ্ছেন, সাহায্য করব?

গলার টাইটা একটু টাইট করে নিয়ে উইলিয়াম বিমর্ষভাবে বললে, এবার থেকে কারুর সাহায্য না নিয়েই পৃথিবীতে চলবার চেষ্টা করব।

রসিকতা করবার জন্যে বললাম, শ্রীমতী রোজিরও সাহায্য নেবেননা?শঙ্খ এবং উলুধ্বনির মধ্যে শ্রীমতী কবে মদন দত্ত লেন বাসিনী হচ্ছেন?

উইলিয়ম এবার যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। আপনার কানে সব খবরই আসবে, সুতরাং চাপা দিয়ে লাভ নেই। এ জানলে রোজির সঙ্গে আমি ঘোরাঘুরি করতাম না। শুধু শুধুই এতদিন আপনাকে কষ্ট দিয়েছি, আপনাকে ডবল ডিউটিতে বসিয়ে রোজিকে সঙ্গে করে অন্য হোটেলে খেতে গিয়েছি।

তাতে মহাভারতের কী অশুদ্ধি হয়েছে?আমি উইলিয়মকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে প্রশ্ন করলাম।

কাজ থামিয়ে উইলিয়ম বললে, কৈশোর আর যৌবন পথে পথে কাটিয়ে, এই প্রৌঢ় জাহাজখানা শাজাহানের বন্দরে ভিড়িয়েছিলাম। আরকদিনই বা বাকি? রোজির সঙ্গে অন্তরঙ্গতার পর ভেবেছিলাম, শাজাহান আমাকে এ-লাইনে শিক্ষা দিয়েছে, আমার অন্ন দিচ্ছে এবং লাস্ট বাট দি লিস্ট আমার স্ত্রীকে দেবে। ওর সব ছেলেমানুষী, ওর সব দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি সত্যিই রোজিকে ভালোবেসে ছিলাম। এখন সে কী বলে জানেন? বলে, তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, অন্ততঃ আরও পাঁচ বছর। এর মধ্যে ওর অসুস্থ বাবা মা নিশ্চয়ই চোখ বুজবেন, ওর বোনগুলোরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে। তার আগে বিয়ে করে সুখী হবার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

রোজি! শাজাহান হোটেলের কৃষ্ণকলি টাইপিস্ট, রোজি। এতদিন ধরে আমি শুধু ঘৃণা এবং অবজ্ঞার চোখেই দেখে এসেছি। এই মুহূর্তে সে আমারই ঘরের অতি আপনজন হয়ে উঠছে।

উইলিয়ম বললে, একদিন রোজি আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি নয়, বস্তি। দেড়খানা ঘরে ওদের যা অবস্থা! সারক্ষণ তিনটে রোগী দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে রয়েছে, কাশছে, থুথু ফেলছে। যেন নরককুণ্ড। রোজির অসুস্থ বাবা-মা আমাকে দেখে বোধহয় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ভয়, মেয়ে যেন কোথাও মন দিয়ে না বসে, তাহলে তাদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে।

বস্তির অন্য লোকদেরও দেখেছিলাম। অনেকেরই কোঁকড়া চুল, একটু পুরু পুরু ঠোঁট। রোজি আমাকে সেদিনই বলেছিল, শাজাহানে যে রোজিকে দেখো, তার শিকড় রয়েছে এইখানে। রোজি আরও বলেছিল, তোমাকে আর একটা কথা জানানো উচিত। আমাকে হয়তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভাবছ, আমিও বাজারে তাই বলে বেড়াই। কিন্তু আমরা আসলে কিন্তলী। এই বস্তির প্রায় সবাই প্রাচীন কলকাতার আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বংশধর।

উইলিয়ম ঘোষ বিস্ময়ে রোজির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। রোজি বলেছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে সুদূর আফ্রিকা থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের কোমরে দড়ি বেঁধে কারা চাঁদপাল ঘাটে জাহাজ থেকে নামিয়েছিলেন, তারপর মুরগিহাটার ক্রীতদাসদের বাজারে পঁচিশ টাকা দামে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার কর্তাব্যক্তিরা তখন সবাই হাট থেকে মনের মতন ক্রীতদাসী কিনতেন। তারও অনেক পরে একদিন আইন করে ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়া হল। কিন্তু মুক্তি পেয়েও তারা আর কোথায় যাবে? এই কলকাতাতেই রয়ে গেল। তাদের আলাদা নাম ছিল না, প্রভুর নামে নাম। অনেকদিন আগে রামের ক্রীতদাসরা যা করেছিল, কলকাতার ক্রীতদাসরা তাই করল। ডিকসন সায়েবের ক্রীতদাস ডিকসন সায়েবের নাম নিলে। শেক্সপীয়র সায়েবেরা ক্রীতদাসও একদিন মিস্টার শেক্সপীয়র নাম নিয়ে বস্তিতে এসে উঠল। সেই থেকেই চলছে। এই একশ বছরেও সুদূর আফ্রিকার বিচিত্র মানুষের ধারা ভারত সমুদ্রের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হতে পারল না। দুঃখ, দারিদ্র্য, অনটন এবং সন্দেহের মধ্যে তারা আজও কিন্তলী হয়েই রইল।

উইলিয়ম বলেছিল,আমার কিছুই তাতে এসে যায় না, রোজি, আমরা সবাই তো এতদিন ক্রীতদাস হয়ে ছিলাম, আমাদের ভারতবর্ষের এই কোটি কোটি মানুষ এতবছর ধরে অন্য এক জাতের কাছে কেনা হয়ে ছিল।

রোজি বলেছিল, তুমি আমাকে আর প্রলোভন দেখিও না। তুমি দয়া করে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো। না হলে, এখনই আমার ইচ্ছে করবে তোমাকে বিয়ে করতে, আমি আর দেরি সহ্য করতে পারব না।

উইলিয়ম বলেছিল, রোজি, আর দেরি করা চলে না। আরও পাঁচ বছর পরে আমার কী থাকবে? আর তোমারও? আখের দুখানা ছোবড়ার মধ্যে বিয়ে দিয়ে কী লাভ হবে?

কাউন্টারে খাতা লিখতে লিখতে উইলিয়ম আমাকে বললে, আমাদের বিয়ে হবে না। রোজিকে বলেছিলাম, তুমি বিয়ের পরও যেমন চাকরি করছ, করো। রোজি বললে, মোটেই না। বিয়ের পর শয়তান জিমিটা আমাকে একদিনও এখানে চাকরি করতে দেবে না। আমার চাকরিটা খেয়ে ছাড়বে। ওকে তো তোমরা চেনেন না।

আমি একটুকরো পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে উইলিয়মকে দেখতে লাগলাম।

উইলিয়ম এবার গভীর দুঃখের সঙ্গে বললে, হয়তো আপনি আমাকে স্বার্থপর বলবেন। কিন্তু আমি আর ধারে ব্যবসা করতে চাই না। এখন আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স, ওর সঙ্গে পাঁচ যোগ করলে বিয়াল্লিশ। অসম্ভব। জীবনে অনেক ঠকেছি। আমি আর বোকার মতো অপেক্ষা করে ঠকতে চাই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *