১৪. হিরে। হিরে! হিরে! আসছে সুদিন ফিরে!

১৪. হিরে। হিরে! হিরে! আসছে সুদিন ফিরে!

হিরের কথায় এমনই আবিষ্ট হয়ে গেছিল রবি রে যে, আমি শ্রীহীন ইন্দ্রনাথ রুদ্র মুখ খোলবার কোনও চান্সই পাচ্ছিলাম না।

দম নেওয়ার জন্যে ও বোধহয় সেকেণ্ড খানেক বিরতি দিয়েছিল। আর ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ফেটে পড়েছিল আমার কৌতূহল।

রবি, ইণ্ডিয়া কি হিরে-কাটিং শিল্প চাতুর্যে আজও জগত সেরা?

দু’চোখ প্রায় কপালে তুলে ফেলে বলেছিল অসাধারণ স্মার্ট রবি-ইণ্ডিয়ার আর্টিস্ত্রি, এক কথায়, তুলনাবিহীন। বেস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। জিন এফেক্ট! জিন এফেক্ট! জহুরিদের জিন এফেক্ট যাবে কোথায়?

বলে, চোখের ফ্ল্যাশ মেরে চেয়ে রইল আমার কথার ফ্ল্যাশ শোনবার জন্যে। আমি কিন্তু উসকে দিয়েই বোবা মেরে গেছিলাম।

হিবে জিনিসটা সত্যিই একটা উত্তেজক পদার্থ। নইলে রবির মতো ধীর স্থির বচন দক্ষ পুরুষ এত কথা খরচ করতে যাবে কেন আমার মতো হিরে-আকাটে মানুষের কাছে?

ইন্দ্র, সুরাটের জহুরিরা দিনে ক’ঘণ্টা হিরে-পালিশ করে জানিস? লেবার-ল অনুসারে তো আট ঘণ্টা কাজ করার কথা। ওরা খাটে ক’ঘণ্টা? জানিস না। জেনে রাখ। টানা দশ ঘন্টা। বিশ্বাস না হয়, দেখে আয় সুরাটের বুস্টার প্ল্যান্টে। বেঙ্গল পিছিয়ে যাবে না কেন? ওয়ার্ক কালচার নিয়ে খালি লেকচার মারলেই হয় না।

এই রে! এ যে পলিটিক্স এনে ফেলছে! ওতে আমি নেই। এক্কেবারে সাইলেন্ট হয়ে রইলাম।

হিরের নেশায় তড়বড় করে বলে গেল রবি-আট লাখ… শুনছিস? আট লাখ ইণ্ডিয়ান ডায়মণ্ড কারিগর এখন অতি পুঁচকে হিরে কেটেও খাসা হিরে বানিয়ে দিচ্ছে। খুদে খুদে হীরক-কণাদের গায়ে ৫৮টা দিক তুলে তবে ছাড়ছে।

কথাটা আমার কর্ণকুহরের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে কুহক সৃষ্টি করে গেছিল আমার মগজের কোষে কোযে। যে হিরক-কণা সাইজে প্রায় বালুকদানার মতো, তার গায়ে আটান্নটা দিক খুদে খুদে তোল তো আলিবাবার আশ্চর্য প্রদীপের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়! একি জাদুবিদ্যা!

আমার মনের প্রশ্নটা টেলিপ্যাথি দিয়ে জেনে নিয়ে মুখে মুখে জবাব দিয়ে গেছিল রবি-জহর বিদ্যা… জহর বিদ্যা… একেই বলে ইণ্ডিয়ান হিরে কাটিং! ফলটা কি হয়েছে জানিস? ওয়ার্ল্ডের নানান অঞ্চল থেকে, এমনকী আমেরিকা থেকেও ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মণ্ড নামে বাতিল হিরে চলে আসছে ইণ্ডিয়ায়-খুবসুরৎ হয়ে ফিরে যাচ্ছে জড়োয়ার জেল্লা বাড়াতে।

আমি চুপ।

রবি বলছে, ইন্দ্র, এই হিরে জিনিসটার সঙ্গে শনি গ্রহের কোনও সম্পর্ক আছে। কি না, সেটা নিয়ে ভাবতে পারিস। না, না, তুই জ্যোতিষী নস, কিন্তু তুই ডিটেকটিভ। ডিটেকশনের ডিডাকটিভ মেথড প্রয়োগ করে ভেবে দেখতে পারিস, মস্ত গ্রহের অশুভ আকর্ষণ কেন মন্দ ভাগ্য রচনা করে যায় মানুষের জীবনে। জ্যোতিষশাস্ত্র একেবারে উড়িয়ে দিসনি। যা জানা নেই, তার অস্তিত্ব নেই–এমন ধারণা মাথার মধ্যে পোষণ করলে বিজ্ঞান আজ অদৃশ্য জগতের অনেক রহস্যময় শক্তির হদিশ পেত না।

আমি মুখ খুলেছিলাম রবি যেই একটু আনমনা হয়েছে—হিরের প্রতাপ অদৃশ্য অবস্থায় শক্তি খাটিয়ে তোকে নিয়ে এল সুরাটে। তারপর?

সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল রবি। এতক্ষণ যেন ঘোরে ছিল—হিরের ঘোর। সত্যিই একটা আশ্চর্য পাথর। এমন মোহ সৃষ্টি করতে পারে…

রবি বললে, হিরেময় ধুলো ইণ্ডিয়ার প্রাচীন যে শহরের গলিতে উড়ছে, পদার্পণ করলাম সেই শহরে! হিরেময় ধুলো!

আজ্ঞে! পুরনো সুরাটের বিশেষ কয়েকটা গলির মধ্যে ঢুকলে ঠিক এই রকমটাই তোর মনে হবে। ধুলো পর্যন্ত হীরকিত… বিশেষণটা বাংলায় নতুন… তাই না? হোক। সরু রাস্তায় পা দেওয়ার জায়গা অথচ কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়ে চলেছে নিমেষে নিমেষে। বহু রঙের, বহু চেহারার হিরে ঝকমকিয়ে যাচ্ছে সেখানে পলকে পলকে। মানুষে মানুষে গিজগিজে সেই সব গলিতে চার চাকার গাড়ি ঢোকা বন্ধ সরকারি নির্দেশে। আমি, এই ছাপোযা বাঙালি, ঢুকেছিলাম সেই হিরের গলিতে। শুনেছিলাম হিরে কিনিয়ে গুজরাতিদের র্যাপিড-ফায়ার গুজরাতি বুকনি। দেখেছিলাম, এক ভিখিরি ছেলে কিভাবে গলির ধুলো বুরুশ দিয়ে চেঁচে তুলছে কৌটোর মধ্যে যদি আসমান প্রসন্ন হয়, কুচো হিরে পেয়ে যেতে পারে-হাত ফসকে পড়ে যাওয়া হিরের কণা।

হিরে পাথরটার সত্যিই বোধহয় একটা অদৃশ্য প্রভাব আছে। মেপে আর ওজন করে কথা বলার পারিপাট্যে যাকে জহুরি বিশেষ বলা যায়, সেই রবি’র সেদিনকার আচ্ছন্ন অবস্থা দেখে আমি আব বাগড়া দিইনি।

হিরে-জ্বর বড় ভয়ানক জিনিস। নইলে বাক্য-বিশারদ রবি এত কথা সেদিন বলবে কেন? বলেছিল বলেই অবশ্য এই রহস্য উপাখ্যানের মূল সূত্রটা ধরে ফেলেছিলাম।

হিরের গলিতে সেদিন কত রকমের আর চেহারার হিরে ঝলসে উঠেছিল রবির চোখের সামনে, সে সব কাহিনী রোমাঞ্চকর নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই না। পাতলা কাগজের মতো কালো হিরেও নাকি ও দেখেছিল—অবিশ্বাস্য কাটিং দেখে ওর চোখ ঠিকরে গেছিল। দেখেছিল ক্যানারি হলুদ হিরে। গুঞ্জন শুনেছিল পিছনে গুজরাতি ভাষায়—হুঁশিয়ার! এ যে ঝেটিয়ে হিরে কিনতে এসেছে!

রবি তখন গুজরাতিতেই বলেছিল, ঝেটিয়ে কিনতে আসিনি। হলুদ হিরে, কালো হিরে, কমলা হিরে, লাল-বেগুনি-সবুজ হিরেতে আমার দরকার নেই।

তবে কি দরকার?

ছোট হিরে! খুব ছোট সাদা হিরে!

বালুকা-সদৃশ আশ্চর্য হীরক কণিকাদের দর্শন পেয়েছিল রবি তখনই। জহরি দণ্ডপথের দৌলতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *