১৪. পরান সঙ্গে ছিল না

পরান সঙ্গে ছিল না। মহিম প্রথম মহল পেরিয়ে কাছারিবাড়ির ভিতর দিয়ে আসবার সময় কে একজন হেঁকে বলল, কে যায়?

মহিম বলল, আমি মহিম।

আমলা দীনেশ সান্যাল বেরিয়ে এসে বলল, দাশু মোড়লের শেষ্ণপক্ষের ছেলে না তুই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এদিকে থেকে কোথায়?

মহিম জবাব দেওয়ার আগেই পেছন থেকে পরান বলে উঠল, বউমার কাছে আসছিল।

অ! একটা অর্থজ্ঞাপক শব্দ করে মশমাটা তুলে দিয়ে দীনেশ সান্যাল বলল, কোনও পুতুল টুতুলের ফরমাশ ছিল বুঝি?

মহিম পরানের দিকে ফিরে তাকাল। পরান বলল, সে খোঁজে কী দরকার তোমার, স্যানেলবাবু। ওরে যেতে দাও।

বোঝা গেল, আমলা কর্মচারীদের কাছে পরানের মান অনেকখানি। দীনেশ সান্যাল বলল, তোমার যেমন কথা পরান, আমি কি আটকেছি না কি। দেখে নিলাম, দাশুমোড়লের ছেলের কপালটা সত্যিই বড় চকচক করছে। হুঁ!

কথাটার মধ্যে কী যেন ছিল। মহিম মুখ ফিরিয়ে এগুল। যেতে যেতে শুনতে পেল, চাষার বেটা নাকি আবার আর্টিস্ট হয়েছে। আঁটি বাঁধা ছেড়ে এবার আমের আঁটির ভেঁপুকুঁকে বেড়াচ্ছে।

কানের মধ্যে পেরেক ফুটিয়ে দেওয়ার মতো কথাগুলো বিধল মহিমের কানে। তাড়াতাড়ি এ বাড়ির সীমানা পেরোতে পারলে যেন সে বাঁচে। এখানকার সবই অপমানকর ভীতিপ্রদ এবং অস্বাভাবিক যেন।

 

কাছারিবাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণে অর্জুন পালকে হুঁকা টানতে দেখে মহিম তাড়াতাড়ি পায়ের ধুলো নিল। মহিমের গুরু অর্জুন পাল। অর্জুন পাল বুড়ো হয়েছে এখন। লোক দিয়ে কাজ করায় কিন্তু নিজেও হাজির থাকে সব জায়গায়। চোখে মোটা পাথরের চশমা সুতো দিয়ে বাঁধা। মহিমের চিবুকে হাত বুলিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলল, মহী, নাকি গো? ভাল আছ তো বাবা? বসো।

মহিম বলল, ভাল থাকবার কী যযা আছে পালকাকা।

তা বটে। মহিমের গায়ে হাত দিয়ে বলল অর্জুন, গাঁয়ে ঘরে তোমার বড় নাম হইছে। শোনলাম, বাবুরা তোমারে দিয়া কাজ করাতে চায়। তুমি নাকি গররাজি?

পালকাকা গুরুর ভাত মারা বিদ্যা মোর জানা নাই। গুরুর দরকার পড়লে ছুটে আসব, সেখানে রাজা-মহারাজার কথা মোর কাছে তুচ্ছ।

সে কী কথা বাবা, সে কী কথা। বলল বটে তাড়াতাড়ি অর্জুন পাল কিন্তু বোঝা গেল, বুকটা তার ভরে উঠেছে খুশিতে। তারপর খানিকটা আত্মগতভাবে ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, সকলে বলে, বড় জবর শিষ্য হইছে তোমার পাল। সবদিকে দুরস্ত। মুই বলি, ওটা ভগমানের ছিষ্টি, মহীরে মুই কোনও দিন হাতে ধরে শিখাই নাই কিছু।

মহী বলল, তা বললে, মুই শোনব না পালকাকা। আপনার কাজ, ধৈর্য দেখেই মুই শিখছি।

অর্জুন পাল হা হা করে হেসে উঠল। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলল, পেথম পেথম মোরে কতজনায় কত কী বলছে। পাগল বামুন যখন তোমায় কলকাতা নিয়ে গেল, পরানটা মোর হুতোশে ঠেসে রইল। লোকে বলল, ওই পালপাড়াই ছোঁড়ার মাথাটা খাইছে। আর তুমি যেদিন ফিরা আসলা—

মহিম বলল, আপনি মোরে বুকে তুলে নিলেন।

পাল আবার হেসে উঠল। বলল, কিন্তু বাবা, বার বার বলছি, আবার বলি অহঙ্কার করিস না কখনও। বাবুরা তোরে ডাকছে, শুনে মোর বুক দশ হাত। মোদের কাজ আলাদা, তুই রাজা-মহারাজার ঘরে তাদের শখের কাজ করবি, রাজবাড়ি সাজাবি। তোর মান আলাদা।

দুজন কারিগর প্রতিমা গড়ছিল। একজন বলে উঠল মহিমকে লক্ষ করে, কুমোর হইলেও তোমার কাজ বিশ্বকর্মার।

আর একজন হেসে হুঁকো দেখিয়ে ইশারায় ডাকল মহিমকে। মহিম মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। তার পর প্রণাম করল আবার পালকে। আমি যাই তা হইলে পালকাকা? পাল যেন কী ভাবছিল। বলল, হ্যাঁ, আসসা গিয়া। একটু তামাক খাবে না?

এ হলো এক মস্ত সম্মান। যুবক পড়শি হোক আর শিষ্য হোক, বুড়োমানুষের এ আমন্ত্রণ বড় কম নয়। বলল, ওটা আর ধরি নাই।

বেশ করছ বাবা, বেশ করছ। এ-সব যত না ধরা যায় ততই ভাল। মোদের বাড়ি এসো না কেন একবার?

যাব।

আমলা দীনেশ সান্যালের কথার পর পালের সাক্ষাৎ যেন সদ্য ঘায়ে মলমের প্রলেপের মতো শান্তি পেল সে।

 

বেলা গড়িয়ে গেছে একেবারে। সন্ধ্যা নামে।

 

সাঁকো-পথে না গেলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয় জমিদারবাড়ি থেকে মহিমদের পাড়ায়। বাড়ি আসতে একটু দেরিই হল তার। বাড়ির মুখেই ভরতের সঙ্গে দেখা হলো মহিমের।

ভরত বলে উঠল, অ্যাই যে, বাবু আসছেন। যাও, ওদিকে আবার ভাবনায় আঁড়ি ফাটছে।

অর্থাৎ অহল্যার দুশ্চিন্তা। হঠাৎ কেমন রাগে মহিমের ভূ জোড়া কুঁচকে উঠল। বলল, মুই কি ছেলেপান যে ভাবনায় তোমাদের হাঁড়ি ফাটে কেবলি?

ভাবনা যে ভরতেরও একেবারে না ছিল তা তো নয়। তবু সে নিজের কথা না বলে বলল, যার ফাটছে তারে গিয়া বল, মোরে নয়। থেমে বলল, তা তুই চটিস কেন?

সত্যই, চটবার কী আছে! তবু মহিম বলল, চটব না। বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই তোমাদের ভাবনা, আর মোর ভাল লাগে না বাপু।

কী তোর ভাল লাগে তবে শুনি? ভরত বলল, কিছু মোটা টাকার ফরমাশ পেলি নাকি জমিদারের ছেলের বউয়ের কাছ থেকে, অত মেজাজ দেখাচ্ছিস্?

থমকে গেল মহিম। এ কথার থেকে যে ভরত একেবারে এ কথায় আসবে সে তা ভাবতেই পারেনি। বলল, তা হইলেই তুমি তুষ্ট হও, না? টাকা ছাড়া কিছু কি চিনো না?

ভরত অত্যন্ত রুক্ষ হয়ে উঠল। বলল, চিনি কি না চিনি, সে কথা তোরে বলতে চাই না। চাষার ছেলে পুতুল গড়ি। অকম্মার ধাড়ি, এ কথা বলতে তোর লজ্জা করে না?

জীবনে যা কোনওদিন বলেনি, আজ হঠাৎ এ অবুঝ রাগে মহিম তীব্র গলায় বলে উঠল, গরিবের ছটাক কাচ্চা জমির পানে শনির মতো নজর দিয়ে বেড়ানোর চেয়ে সেই মোর ভাল।

ভরত দারুণ রোষে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল মহিমের গালে। হারামজাদা, মোরে তুই শনি বলিস। জমিদারবাড়ির ছোঁয়া নিয়া আসছ তুমি মোর কাছে তেল দেখাতে?

অহল্যা ছুটে এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়াল। উৎকণ্ঠায় ত্রাসে কাঁপছে সে। ভরতকে বলল, ছি ছি, এ কী করলা তুমি, ঠাকুরপোরে মারলা?

চুপ কর তুই! ধমকে উঠল ভরত! তুই মাগী লাই দিয়ে ছোঁড়ার মাথা খেয়েছিস। ফের দেওর-সোহাগ দেখাতে এলে তোরে টুণ্ডা করব আমি।

তার পর বাড়ির ভিতর গিয়ে নিজের মনেই সে বলতে লাগল, হা রে ভ্যালা তোর। ভাল কথা বললাম তো উনি চোট দেখাতে আসলেন। তোর চোটের কি ধার ধারি রে আমি। আমি কি কারও পিত্যেশ করি। সোজা কথা জেনে রাখছি, মোর কেউ নাই। কেউ না।

স্তব্ধ নির্বাক একটুখানি দাঁড়িয়ে থেকে মহিমকে ঘরে যেতে দেখে অহল্যা দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন মুখে গেল রান্নাঘরে।

মহিম টলতে টলতে নিজের ঘরে উঠে এল। গালের জ্বালার চেয়েও বুকের মধ্যে একটা দারুণ বেদনায় মুচড়ে উঠল তার। কী যেন একটা ঠেলে আসতে চাইছে গলার কাছে। দক্ষনিধনের শিবের গায়ে দু-হাত রেখে সে বার বার মনে মনে বলতে লাগল, আমি ছেড়ে দেব একাজ, ছেড়ে দেব। পুতুল আমি গড়ব না আর। এ মোর কাজ নয়। মাঠ মোর জায়গা। আমি আর তোমাদের গড়ব না।…

চোখের কোল ছাপিয়ে জল এল তার। শিবের গা বেয়ে পড়ল সেই জল।

 

খাওয়ার আগে সারাক্ষণটি ভরত বকবক করল। কখনও দুঃখে কখনও রাগে। খেতে বসে খেতে পারল না সে। মনটায় শুধু অশান্তি নয়, মহিমের মুখটা বারবারই মনে পড়তে লাগল তার। ছোঁড়ার যেন কী হয়েছে। কই, এমন করে তো আগে কখনও বলেনি সে ভরতকে। হয় তো জমিদারবাড়ি থেকে দুঃখ পেয়ে ফিরে এসেছে কোনও কারণে। শত্ৰুপুরী যে! আর ভাই কি না তার বলে ভাবনা করো না তোমরা।…

কিন্তু মহিমকে ডাকতে যেতে পারল না সে। বলল অহল্যাকে, ছোঁড়ারে ডেকে এনে খাওয়াও। বলে সে শুতে চলে গেল।

অহল্যা এসে দেখল মহিম বেড়ায় হেলান দিয়ে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। ডাকল, ঠাকুরপো! মহিম মুখ তুলল। চোখ লাল, কান্নার আভাস তাতে। কেঁদেছে বুঝি। অহল্যার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সমস্ত ঘটনাটার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হল তার। কেন সে ভরতকে জানাতে গিয়েছিল মহিমের জমিদারবাড়িতে যাওয়ার কথা, কেন বা দুভাবনায় খোঁজ করতে বলেছিল স্বামীকে। কিন্তু, মহিমেরই বা কী হয়েছে আজ। ভাবনায় হাঁড়ি ফাটে কী আর কিছু ফাটে সে কথা জানে অহল্যাই। তা বলে অহল্যার দুভাবনায় মহিমের এত রাগ বিরাগের কথা তো সে জানত না। আর সেই কথাই অহল্যার মনে দম-ফোলানো ফানুসের মতো কান্নায় আর অভিমানে বিরাট হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে নতুন এক রুদ্ধশ্বাস দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে, না জানি মহিম এর পর কী করবে। যদি ছেড়ে যেতে চায়!

সে ডাকল, ঠাকুরপো, খাবে চলো।

নির্বিকারভাবে বাধ্য ছেলের মতো তাকে উঠতে দেখে অহল্যার দুশ্চিন্তা গভীর হয়ে উঠল। এত নির্বিরোধী মহিম, এ ঘটনার পর এক কথায় খেতে উঠল!

খেতে বসে কয়েক গ্রাস খেয়েই মহিম উঠে পড়ল। অহল্যাও উঠল।

মহিম বলল, খাবে না তুমি?

মোর জন্য ভেবো না। কিন্তুক, এই কি তোমার খাওয়া?

দিন তো সব সমান নয়, অনিচ্ছাও তো হয় মানুষের। তুমি উপোস থাকবে ভেবেই বসছিলাম।

মোর উপপাসের জন্য? হাহাকার করে উঠল অহল্যাকে বুকের মধ্যে। কান্না চেপে বলল সে, তাই যদি, তবে চলো দুটো কথা বলে আসি, পরে ভাত খাব।

মহিম হাত মুখ ধুয়ে এল। অহল্যাও এল। বলল, তুমি ছেলেপান নও জানি, কিন্তুক মোর ভাবনায় যে তোমার এত রাগ, তা তো জানতাম না?

মহিম নীরব। অহল্যা আবার বলল, জেনে রাখলাম সে কথা। তবে সে ভাবনা মোর, মোরে বললেই এ অঘটন ঘটত না। মোর কাছে যে কথা, তা তুমি আর কাকপক্ষীরেও বলল না। আর এক কথা—

কিন্তু কথা আটকায় অহল্যার গলায়, বুক ফাটে। বলল, এ নিয়ে যদি তোমার দু-ভায়ে বাড়াবাড়ি করো, তবে গলায় দড়ি দিতে হবে মোরে। তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাকো।

মহিম বলল, থাকব। কাল থেকে মুই মাঠে যাব, মোরে কাজ ধরতে হবে।

কী বললা? গলার স্বর অহল্যার ছিঁড়ে গেল। বলল, যা নয় তা বলল না।

দাদা, তাই বলছে।

বলুক। অহল্যার যেন আসল মূর্তি খুলে গেল। বলল, যার যা, তার তা। মূর্তি তোমারে গড়তেই হইবে। তেমন দিন আসলে এই করেই খেতে হইবে তোমারে। এ ছাড়া তোমার পথ নাই।

আশ্চর্য! মহিম জানত এমন কথা পাগলা গৌরাঙ্গই বলতে পারত। কিন্তু পরমুহূর্তেই অহল্যার চোখে হু হু করে অশ্রুর বন্যা এল। এমন বুদ্ধি তুমি ছাড়ো ঠাকুরপো। এতে তুমি নিজেরে ভাঙবে, অপরকে মারবে। এ যে তোমার সাধনা! এ কি তুমি ছাড়তে পারো? তার পর চোখের জল মুছে বলল, তেমন দিন যদি ভগবান দেয়, তবে তোমারে ভিক্ষে করে খাওয়াব আমি।

এবার স্তম্ভিত বিস্ময়ে নির্বাক মহিম অহল্যার দিকে তাকিয়ে রইল। সে শিল্পী, তার সাধনা আছে। কিন্তু তার সাধনার পেছনে এত বড় একটা শক্ত খুঁটি আছে, তা বুঝি সে জানত না।

কয়েকটা দিন এমনি কাটল। মহিম মাটির কোনও কাজেই হাত দিল না। সেই সকাল হলেই বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে প্রায় বেলা শেষে। কোনওরকমে দুটি খায় আবার বেরোয়। অহল্যা খবর, নিয়ে জেনেছে মহিম রীতিমতো মাঠে যাতায়াত করছে, চাষের খবর নিচ্ছে। মাঠে তো এখন বিশেষ কোনও কাজ নেই, ধান পাকার সময় এখন। বিকালে বেরিয়ে অনেক রাত্রে বাড়ি আসে সে।

পরিণামে তার নিজের প্রতি পীড়ন যে আর একজনের প্রতি দ্বিগুণ প্রতিক্রিয়া করছে এ কথা সে বোধ হয় জানত না। শুধু তাই নয়, ব্যাপারটা অহল্যার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। করল। এমন কী, একদিন জমিদারবাড়ি থেকে পরান উমার ডাক নিয়ে এসেও ফিরে গেল। মহিম শুনল, কিন্তু গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *