১৩. মনের সঙ্গে যখন পা দুটার সংযোগ

মনের সঙ্গে যখন পা দুটার সংযোগ থাকে না, তখন তাহারা স্বেচ্ছামত নিজের পরিচিত পথে চলে। বিনয়বাবুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়াই কী এক নেশায় বুঁদ হইয়া কিশোর পথ চলিয়াছিল; কোথায় যাইতেছে কোন খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ সজাগ হইয়া দেখিল, তাহার কলেজের সম্মুখে। দাঁড়াইয়া আছে।

রাত্রি দশটার সময় কলেজের অন্ধকার প্রকাণ্ড বাড়িখানার দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া তাহার ভারি হাসি পাইল। নিজ মনে হাসিতে হাসিতে সে আবার বাড়ির দিকে ফিরিল।

যে আনন্দের সংবাদটা সমস্ত জগৎ ভুলাইয়া তাহাকে অকারণে অভ্যাসবশেই এতদূর টানিয়া আনিয়াছিল, বৌদিদির কাছে সেই কথাটি ব্যক্ত করিবার জন্য তাহার প্রাণ ছটফট করিতে লাগিল। আজ একাদশী, তাই সে সন্ধ্যার পূর্বেই রাত্রির মত আহারাদি শেষ করিয়া লইয়াছিল। বৌদিদি হয়তো এতক্ষণ উদ্বাসক্লিষ্ট দেহে শয্যায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন, এই ভাবিয়া সে জোরে জোরে পা। চালাইয়া ছিল।

বৌদিদি কিছুই জানেন না, সন্দেহও করেন নাই। হঠাৎ অপূর্ব সংবাদ শুনিয়া তিনি কিরূপ চমকিত ও আনন্দিত হইয়া উঠিবেন, উৎসুকভাবে কী কী প্রশ্ন করিবেন, সে তাহার কী কী উত্তর দিবে, এই সব ভাবিতে উল্লাসে উত্তেজনায় তাহার মন ভরিয়া উঠিল। সে ভাবিতে লাগিল, তাহার মত ভাগ্যবান পৃথিবীতে আর নাই; একদিকে বৌদিদির মত স্নেহপরায়ণা ভগিনী, আর একদিকে সুহাস। এমন ভাগ্য আর কাহারও হয়? সৌভাগ্যগর্বে তাহার হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিল।

কিন্তু–হঠাৎ কিশোর রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়াইয়া পড়িল। বৌদিদি যদি সুহাসের সহিত বিবাহের সংবাদে সুখী না হন? তিনি কিশোরের সংসারে সর্বময়ী কত্রী, সুহাসকে তিনি জানেন না,যদি কোনরূপ অমূলক আশঙ্কা করিয়া তিনি মনে কষ্ট পান? কিন্তু না, এ হইতেই পারে না। বৌদিদির, সম্বন্ধে এরূপ স্বার্থপরতার কথা চিন্তা করাও অপরাধ। নিজের হৃদয়ের অপরিসীম স্নেহ যিনি নিঃস্ব হইয়া তাহার মাথায় ঢালিয়া দিয়াছেন, তাহার এত বড় সুখে তিনি অসুখী হইবেন, ইহা কল্পনা করাও মহাপাপ।

এই সঙ্গে আর একটা চিন্তা আসিয়া জুটিল। কিশোরের হৃদয়ের অভ্যন্তরে দুইটি মাত্র নারী প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছিল,—একটি বিমলা, অপরটি তাহার সদ্যোলব্ধ সুহাসিনী। ইহাদের একজনকে বাদ দিলেও তাহার জীবন পঙ্গু হইয়া যাইবে, ইহা নিশ্চিত, বিমলার স্নেহ বা সুহাসের ভালবাসা কোনটাই সে স্বেচ্ছায় ছাড়িতে পারিবে না। কিন্তু এই দুইটি রমণী যদি ভবিষ্যতে পরস্পরকে প্রীতির সহিত গ্রহণ করিতে না পারে? যদি সাংসারিক ক্ষুদ্র প্রবেশ করিয়া তাহার অকলঙ্ক জীবনযাত্রাকে লাঞ্ছিত করিয়া তোলে? তাহার প্রাণ দুরদুর করিয়া একবার কাঁপিয়া উঠিল। সে প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া মনে মনে বলিল—না, বৌদিদি ও সুহাস কি সাধারণ সামান্য স্ত্রীলোক? সে যখন তাহাদের দুইজনকেই ভালবাসিয়াছে, তখন তাহারাও পরস্পরকে ভালবাসিবেই। ইহার মধ্যে কণামাত্র সংশয় থাকিতে পারে না।

বাড়ি পৌঁছিয়া সোজা বিমলার ঘরের দ্বারের কাছে গিয়া সে ডাকিল, বৌদি, আসব?

এসো। এত দেরি যে, কোথায় ছিলে?

কিশোর ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, প্রদীপের সম্মুখে মেঝেয় বসিয়া বিমলা একখানা পুঁথি পড়িতেছিল, বই মুড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম বৌদি, তাই দেরি হল। বলিয়া কিশোর হাসিতে লাগিল।

ভুরু তুলিয়া বিমলা বলিল, এগারোটা বাজে, এত রাত্তিরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলে কোন সুখে বলো তো?

জোর করিয়া মুখ গম্ভীর করিয়া কিশোর বলিল, বলছি। কিন্তু তার আগে একবার তোমার পায়ের ধুলো নিই। বলিয়া হেঁট হইয়া বিমলার পদধুলি গ্রহণ করিল।

বিমলা কিশোরের মাথায় হাত রাখিয়া প্রসন্ন কণ্ঠে বলিল, বেঁচে থাকো। কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গেল?

কী? কী ঠিক হবে? কিসের কথাবার্তা?

সেকথার জবাব না দিয়া মৃদু হাস্যে বিমলা জিজ্ঞাসা করিল, আর সুহাস কী বললে?

বিস্মিত পুলকিত হইয়া কিশোর বিমলার মুখের পানে চাহিয়া রহিল! তারপর দুই হাত বাড়াইয়া বিমলার দুটা বাহু চাপিয়া ধরিয়া বলিল, অ্যাঁ—বৌদি, তুমি জানো?

না গো মশাই—তা কি আর জানি। তোমরা দুজনেই কত সাবধানী। বিমলা হাসিয়া ফেলিল, তবু তোমার মনের কথা আঁচে আন্দাজে বুঝতে হয়, সে হুঁড়ির মুখের দিকে একবার তাকালে আর কছু বুঝতে বাকি থাকে না। আচ্ছা ঠাকুরপো, এত লুকোচুরি কিসের? প্রেমিক-প্রেমিকাদের বুঝি খোলাখুলি কিছু করতে নেই। সবই মনে মনে গোপনে গোপনে? কিন্তু লুকিয়ে যখন রাখতেও পার না, তখন চেষ্টা করাই বা কেন? সেদিন সুহাসের কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক।

সুহাসিনীর সহিত বিমলার পরিচয় হইয়াছে, এ খবর কিশোর জানিত না। সে আশ্চর্য হইয়া বলিল, তার সঙ্গে তোমার ভাব হয়ে গেছে? আমাকে বলনি কেন?

কেন বলব? তুমি আমার কাছে লুকোতে পার, আর আমি পারি না? আমার বুঝি রাগ হয় না? লো নেই কওয়া নেই, হৃদয়খানি যে আর একজনকে দিয়ে এলে, বলি, বৌদিদির অনুমতি নিয়েছিলে কি?

অদূরে তক্তপোশের উপর সাদা ধবধবে বিছানা পাতা ছিল, কিশোর তাহার উপর গিয়া বসিল। পাশের স্থানটা হাত দিয়া চাপড়াইয়া বলিল, বোসো এসে এখানে। এইবার বলো, কবে তোমাদের ভাব হল, কী কথা হল, এই সব।

সম্মুখে গলির দিকের জানালাটা খুলিয়া দিয়া বিমলা বিছানায় আসিয়া বসিল। গালে হাত দিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ঠাকুরপো, মাত্র দুদিন সুহাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কিন্তু এই দুদিনের দেখাতেই বুঝতে পেরেছি যে, এমন জিনিসটি লাভ করা যে কোন পুরুষমানুষের পক্ষে ভাগ্যের কথা। মনে আছে সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলুম, যে বিন্ধিবে লভিবে সে কৃষ্ণা গুণবতী? তার একটা কথাও মিথ্যে নয়! অমন মেয়েকে স্বয়ম্বরসভায় লক্ষ্যভেদ করে নিজের গুণপনা দেখিয়ে তবে লাভ করবার অধিকার জন্মায়। ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিতে লাগিল, দেখ, আমি পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, আঠারো-উনিশ বছরের আইবুড়ো মেয়ে দেখা আমার অভ্যাস নেই, এতদিন ও জিনিসটাকে মনের মধ্যে ঠিকভাবে নিতে পারতুম না। কিন্তু সুহাসের সঙ্গে ভাব হবার পর থেকে সে ভুল আমার ভেঙে গেছে। শুচিতা কৌমার্য যে মনের সম্পদ, বয়সের নয়, তা বুঝতে পেরেছি। সুহাসের মধ্যে কী আছে জানি না, কিন্তু ওর মুখের দিকে চেয়ে ওকে না ভালবেসে থাকা যায় না। বিদ্যাবুদ্ধির কথা বলছি না, সে তো আজকাল অনেক মেয়েরই আছে। কিন্তু সুহাসের মধ্যে সত্যিকারের ভাল আছে ঠাকুরপো,—সেই ভাল যা ভগবান নিজের হাতে দেন, যা চেষ্টা করে হওয়া যায় না। এত মিষ্টি নরম ওর স্বভাব, এমন লাজুক মন,.যেন রাত-দিন বুক দিয়ে ঘিরে রাখতে ইচ্ছা করে।

কিশোর মুষ্টির উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল। তাহার তগত মুখের দিকে স্নেহ-নিষিক্ত দৃষ্টিপাত করিয়া বিমলা বলিল, কিন্তু তাও বলি, তোমার মত বর না হলে ও মেয়ের মর্যাদা আর কেউ বুঝত না। আমার মনে বড় ভয় ছিল ভাই, কী জানি তুমি একদিন কী রকম একটি বৌ ঘরে নিয়ে আসবে, হয়তো সে তোমাকে চিনতে পারবে না, আমাকেও ভুল বুঝবে—আর তোমার প্রাণের ঐ তপোবনের মত শান্তি ঘুচে যাবে! কিন্তু সে ভয় আর আমার নেই; যিনি আসছেন তাকে বিধাতা তোমারই মনের মত করে নির্জনে বসে গড়েছিলেন।

কিশোর নড়িয়া-চড়িয়া বসিল, একবার কী বলিতে ইচ্ছা করিল, তারপর আবার চুপ করিয়া বসিয়াই বৌদিদির অমৃতমধুর বাণী শুনিতে লাগিল।

বিমলা একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, কিন্তু আর না, বেশী প্রশংসা করলে তোমার আবার জাঁক হবে। তার চেয়ে সুহাসের কথাই বলি,-কেমন? সেদিন দুপুরবেলা আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলুম, তারপর ও আর একদিন এ বাড়িতে এসেছিল।

আনন্দে কণ্টকিত হইয়া কিশোর বলিল, সুহাস এসেছিল?

হ্যাঁ গো, এসেছিল। যদি তার রকম দেখতে, এখনও মনে হলে আমার হাসি পায়। এক পা করে এগোয় আর যেন চমকে চমকে ওঠে, মুখ এই লাল, এই ফ্যাকাসে—ঠিক যেন চুরি করতে ঢুকেছে, ধরা পড়বার ভয়েই জড়সড়। আমি হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে তোমার বিছানার উপর বসিয়ে দিলুম।

কিশোর রুদ্ধ নিশ্বাসে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, পাছে নড়িলে-চড়িলে বা নিশ্বাস ফেলিলে এই কাহিনীর সূক্ষ্ম সূত্রটি ছিন্ন হইয়া যায়। বিমলাও সেদিনকার কৌতুকপূর্ণ স্মৃতিটা মনে মনে আলোচনা করিতে করিতে স্মিতমুখে জানালার দিকে চাহিয়া রহিল।

তারপর?

হাসিয়া উঠিয়া বিমলা বলিল, তারপর আর কী? সব কথাই তোমাকে শুনতে হবে না কি?–কিন্তু ভারি মজার জিনিস একটি লক্ষ্য করলুম, তখনও সে নিজের মন বুঝতে পারেনি। তা যদি পারত, তাহলে আমার কাছে কথায় কথায় ধরা পড়ে যেত না। একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া কতকটা নিজমনে বলিল, কী সুন্দর এই সময়টি।

মিনতি করিয়া কিশোর বলিল, আমাকে আর পাগল করে দিও না, বৌদি। সুহাস আর কী করলে বলো।

কী আবার করবে? তোমার ল্যাবরেটরি দেখলে, বইগুলো ঘাঁটলে, টেবিলের এটা-ওটা নাড়লে, কলম দিয়ে লিখলে, তারপর বিছানায় বসে তোমার মাথার বালিশটা কোলে নিয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে তোমার কথা শুনতে লাগল। তোমার কথা শোনবার এত কী খিদে বাপু, কিছুতেই যেন মিটতে চায় না!—এ দিকে তোমারও তো সেই দশা দেখছি। কিন্তু আর না, এবার ওঠো। আজ রাত্রে কী ঘুমোবার দরকার নেই? বিমলা উঠিয়া দাঁড়াইল।

হাত ধরিয়া তাহাকে পুনরায় বসাইবার চেষ্টা করিয়া কিশোর বলিল, বোসো না বৌদি, তারপর–

কৃত্রিম রোষে তর্জনী তুলিয়া বিমলা কহিল, আবার তারপর? সারারাত শুধু সুহাসকথামৃত শুনবে—আমাকেও ঘুমোতে দেবে না। আজ একাদশী তাও ভুলে গেলে?

অনুতপ্ত কিশোর তৎক্ষণাৎ উঠিয়া পড়িল, লজ্জিত হইয়া বলিল, না না বৌদি, এবার তুমি শুয়ে পড়ো, আমি যাচ্ছি।

বাইরে ঝিমঝিম করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছিল, ঠাণ্ডা ভিজা বাতাস গায়ে লাগিতেছিল, বিমলা সম্মুখের জানালাটা আবার বন্ধ করিয়া দিতে লাগিল।

কিশোর বলিল, আচ্ছা বৌদি, সেদিন—

আবার! আমি আর পারি না ঠাকুরপো, তোমার সুহাসের গল্প বলতে। ঐ শোনো, বারোটা বাজল। নাও ওঠো, আর আমি তোমার সঙ্গে রাত জাগতে পারব না। আসল জিনিসটা তো পেয়ে গেছ, এখন আর গল্প শুনে কী হবে? যাও, শুয়ে পড়োগে।

কিশোর দ্বারের কাছে তবু একটু ইতস্তত করিয়া নিজের ঘরে সেই পরম পবিত্র শয্যার দিকে—যে শয্যার মাথার বালিশটি সুহাসের অঙ্গ-স্পর্শে ধন্য হইয়াছে—সেই বিছানার ক্রোড়ে রাত্রির মত বিশ্রাম লইতে গেল।

.

নিজের ভালবাসা লইয়াই সুহাস তন্ময় হইয়া ছিল, এই নবাগত দেবতাটিকে লইয়া কী করিবে, কোথায় রাখিবে, ভাবিয়া পাইতেছিল না। অন্য পক্ষের মনের ভাব কিরূপ তাহা চিন্তা করিয়া দেখিবার তাহার অবসর হয় নাই, সেকথা মনে উদয়ও হয় নাই।

তাই, কিশোর যখন নিজের হৃদয়ের পরিচয় দিয়া তাহার হাত দুইটা একবার চাপিয়া দিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল, তখন বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উপর চন্দ্রোদয়ের মত তাহার অন্তর অপরিমিত আনন্দ-আবেগে মথিত হইয়া উঠিল। তাহার মনে হইল এইটুকু হৃদয়ের মধ্যে বুঝি এতখানি সৌভাগ্যকে ধরিয়া রাখিবার স্থান নাই, এখনই উহা ভাঙ্গিয়া শতখণ্ডে চুরমার হইয়া যাইবে।

পাশের ঘর হইতে দীনবন্ধু ও বিনয়বাবুর কণ্ঠস্বর শুনা যাইতেছিল, সুহাস পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে উঠিয়া গেল।

স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় রাত্রির আহারাদি সম্পন্ন করিয়া যখন সে নিজের ঘরে আসিয়া ঢুকিল, তখন ঘরের স্বচ্ছ তরল অন্ধকার যেন বাহু বাড়াইয়া তাহাকে কোলে টানিয়া লইল। আলো না জ্বালিয়াই সিঙার মেঝের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে কাপড়-চোপড় ছাড়িতে লাগিল।

এমনই ভাবে সুখের স্বপ্নে কতক্ষণ কাটিয়া গিয়াছিল সে জানিতেও পারে নাই; বাইরের বৃষ্টিপতনের শব্দে চেতনা হইল যে, ঘরের জানালাগুলা বন্ধ থাকায় একটু গরম বোধ হইতেছে। সে গিয়া গলির দিকের জানালাটা উন্মুক্ত করিয়া দিল।

বাহির দিকে চোখ পড়িতেই সে দেখিল, গলির অপর পারে খোলা জানালার সম্মুখে অস্পষ্ট আলোতে দুটি লোক বিছানার উপর বসিয়া আছে। ক্ষীণ আলো সত্ত্বেও চিনিতে কষ্ট হইল না যে, একজন কিশোর ও অন্যজন বিমলা। সুহাস তাড়াতাড়ি জানালা ছাড়িয়া চলিয়া আসিতেছিল, কিন্তু পারিল না; কে যেন জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিল। কিশোর ও বিমলার কথার গুঞ্জনটুকুই সে শুনিতে পাইতেছিল, একবার বিমলার অনুচ্চ একটুখানি হাসি তাহার কানে পৌঁছিল। অন্ধকারে দাঁড়াইয়া সুহাস বিহুলের মত সেই দিকে তাকাইয়া রহিল।

বিমলা জানালা বন্ধ করিতে উঠিলে তাহার দুএকটা অসংলগ্ন কথা তাহার কানে গেল—…বারোটা বাজল—তোমার সঙ্গে রাত জাগতে…শুয়ে পড়ো—জানালা বন্ধ হইয়া গেল!

সুহাস ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া নিজের বিছানায় বসিল। এতদিন যাহা সে অবহেলা করিয়াই লক্ষ্য করে নাই, সেই অজ্ঞাত বিষয়টি আজ সবেগে আসিয়া তাহাকে আঘাত করিল। ইহারা দুইজন স্ত্রী-পুরুষ এক বাড়িতে থাকে, রাত্রিতে তৃতীয় ব্যক্তিটি পর্যন্ত নাই। ইহাদের মধ্যে সম্বন্ধ কী? বন্ধুর স্ত্রী, স্বামীর বন্ধু। দুইজনেরই যৌবনের মধ্যাহ্ন। স্ত্রীলোকটি বিধবা, অপূর্ব রূপসী! রাত্রি বারোটার সময় ইহারা এক বিছানায় ঘেঁষাঘেঁষি বসিয়া নিম্নকণ্ঠে সিগল্প করে, তারপর সাবধানে বাহিরের জানালা বন্ধ করিয়া দেয়। কোন লৌকিক বাধাবিঘ্নের বালাই নাই।

আর একদিনের আর এক দৃশ্যের স্মৃতি এই সঙ্গে আজ দ্বিতীয়বার তাহার চোখের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল। সে-ও এমনই বাধা-বন্ধনহীন! এবং অনুপমের যে তীক্ষ কথাগুলার অস্পষ্ট ইঙ্গিত অসভ্য বর্বরতা বলিয়াই আজ সন্ধ্যাবেলা সুহাসিনীকে কিশোরের দিকে ঠেলিয়া দিয়াছিল, সেগুলা এখন একে একে মনে পড়িয়া বিষাক্ত কাঁটার মত তাহাকে বিধিতে লাগিল।

সুহাসিনীর সমস্ত দেহ শিথিল হইয়া এলাইয়া পড়িল, বুকের ভিতরটা যেন একেবারে খালি হইয়া গেল। সে অস্ফুট একটা শব্দ করিয়া বিছানায় মুখ খুঁজিয়া শুইয়া পড়িল।

কিছুক্ষণ এইভাবে পড়িয়া থাকিবার পর সে মাথা তুলিয়া আবার ভাবিতে লাগিল, দোষ কী? সে নিজের মনের ক্ষুদ্রতা দিয়াই ইহাকে বিকৃত করিয়া দেখিতেছে, নহিলে দুইজন স্ত্রী-পুরুষের রাত্রিকালে নিভৃত আলাপ দৃষণীয় কেন? সে নিজেও তো কত দিন অনুপমের সঙ্গে একাকিনী বসিয়া গল্প করিয়াছে! ইহাতে নিন্দনীয় কী আছে? তাহার মন মন্দ, তাই সে অন্যকে মন্দ দেখিতেছে, নিজের অন্তরের কলুষ অন্যের দেহে নিক্ষেপ করিতেছে। বিমলাকে সে জানে, বিমলার প্রতি তাহার আন্তরিক শ্রদ্ধা জন্মিয়াছে—তিনি সর্বাংশে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার যোগ্য। আর কিশোর? তাহার মত নির্মল চরিত্র আর সে কোথায় দেখিয়াছে? তাহার চাহনি পর্যন্ত যে পবিত্র! তবে ইহাদের চরিত্রের তুলনায় কি আজিকার এই অবস্থা-সংযোগকেই বড় করিয়া দেখিতে হইবে? নিজের মনকে পঙ্কিল অশুচি বলিয়া সুহাসিনী বারংবার ধিক্কার দিতে লাগিল।

এইভাবে নানা তর্কযুক্তির দ্বারা নিজের অবুঝ মনকে বুঝাইতে বুঝাইতে শেষরাত্রির দিকে সে ঘুমাইয়া পড়িল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও একটা অব্যক্ত বেদনা তাহার অচেতন দেহকে নিপীড়িত করিয়া অশ্রুধারায় উপাধান সিক্ত করিয়া দিল।

পরদিন সকালে দেরি করিয়া উঠিয়া ক্লান্ত-দেহে যখন সে নীচে নামিয়া গেল তখন নিজের মানসিক অবস্থা নিজেই সে ঠিক বুঝিতে পারিল না। শুধু, গত রাত্রে তাহার অন্তলোকে দক্ষিণা বাতাস লাগিয়া যে আনন্দের ফুলটি ফুটিয়াছিল, তাহা যে অকালে শুকাইয়া মলিন হইয়া গিয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ রহিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *