১৩. ঘটেছিল সেই অঘটন

তা শেষ পর্যন্ত ঘটেছিল সেই অঘটন।

সনৎকাকার সঙ্গে বোলপুরের পথে পা বাড়িয়েছিল বকুল।

জীবনের প্রথম বিস্ময়!

সে কী আশ্চর্য স্বাদ! .

সে কী অভাবিত রোমাঞ্চ!

আকাশে কতো আলো আছে, বাতাসে কতো গান আছে, জগতে কতো আনন্দ আছে, সে কথা আগে কবে জেনেছিল বকুল?

কিন্তু বকুল কি সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের কাছাকাছি পৌঁছেছিল? তার পায়ে হাত রেখে প্ৰণাম করেছিল? তাকে বলতে পেরেছিল আমার জীবন ধন্য হলো?

পাগল!

বকুল অনেকের ভিড়ে অনেক পিছনে বসেছিল, শুধু অন্যকে বলা কথা শুনেছিল। অথবা কথাও শোনেনি। বকুল শুধু এক রূপময় শব্দময় আলোকময় জগতের দরজায় দাঁড়িয়েছিল–সমন্ত চেতনা লুপ্ত করে।

পৌষ মেলা দেখতে মেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন সনৎকাকা।

বাধ্য হয়েই ওঁর সঙ্গে যেতে হয়েছিল বকুলকে। কিন্তু বকুলের মনে হয়েছিল কী অর্থহীন এই ঘোরা! কী লাভ ওই মাটির কুঁজো, কাঠের বারকোশ, রঙিন কুলো, মেটে পাথরের বাসন, লোহার কড়া, চাটু আর নাগরদোলা দেখায়। অবশ্য শুধু ওই নয়, মেলায় আরো অনেক আকর্ষণ ছিল, লোকেরা তো ওই মেলার মাঠেই পড়ে থাকছিল, এবং তাদের মুখ দেখে আদৌ মনে হচ্ছিল না কোনো অর্থহীন কাজ করছে। শুধু বকুলেরই মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল সেই দেবমন্দিরের দরজায় বসে থাকলেই বা কী ক্ষতি? জীবনে কি আর কখনো এ সৌভাগ্য হবে?

হয়ওনি। কতো-কতোগুলো দিন গিয়েছিল তারপর।

তারপর তো দেবতা বিদায় নিয়েছিলেন।

সনতকাকা এসে বলেছিলেন, যাই ভাগ্যিস সেদিন বাপের ভয়ে আটকে বসে থাকনি, তাই না–

কিন্তু বকুলদের সংসারে বকুলের সনৎকাকার পরিচয় কি?

মাসিক পত্রিকার সম্পাদক?

প্রেসের মালিক?

পুস্তুষ্ক প্রকাশক?

আসলে তো এইগুলোই পরিচয়ের সূত্র।

তবু আরো একটা টিকিট ছিল, যার জোরে সনৎকাকার এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার প্ৰবোধচন্দ্রের খুব দূর-সম্পর্কের মামাতো ভাই উনি। নইলে শুধু কাগজের সম্পাদক অথবা পুস্তক প্রকাশক হলে কে ডিঙোতে দিতো এ চৌকাঠ? আর কে গলাধঃকরণ করতো সেকথা–মেয়েটি যে আপনার রত্ন প্ৰবোধদা! একে আপনি বাড়ি বসিয়ে রেখেছেন? কলেজে-টলেজে পাঠালে–

কিন্তু শুধুই কি সম্পর্ক?

চরিত্র নয়?

যার জোরে জোর গলায় বলতে পারে মানুষ, আমার সঙ্গে যাবে, তবে আবার এতো চিন্তা কী?

.

অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়, হঠাৎ শম্পার প্রশ্নে যেন অন্য জগৎ থেকে ছিটকে সরে এলেন অনামিকা দেবী।

শম্পা প্রশ্ন করছে, তোমার সেই সনাতনী বাবার মেয়ে হয়েও চিরকুমারী থেকে গেলে কী করে বল তো পিসি? যা সব গল্প শুনি তোমার বাবা বুড়োর!..হতাশ প্ৰেম-ট্রেম নয় তো?

তোর বড্ডো বাড় বেড়েছে শম্পা-

আহা বাড়বৃদ্ধিই তো ভালো পিসি! বল না তোমার ঘটনা-টটনা—

তোর মত রাতদিন ঘটনা ঘটাতাম, এই বুঝি মনে হয় তোর আমায় দেখে?

মনে অবশ্যি হয় না, তবে চিরকুমারী থাকাটার কারণটাও তো জানা দরকার।

তুই থামবি? নাকি ধাড়ি বয়সে মার খাবি?

বাচাল শম্পাকে ধমক দিয়ে থামালেন অনামিকা দেবী। কিন্তু ওর প্রশ্নের ধাক্কাটাকে তখুনি থামিয়ে ফেলতে পারলেন না। সেই আর একদিনের মতই ভাবতে বসলেন, তার জীবনের এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা, এই নিজের মনে নিজের মত থেকে যাওয়া, এটা আর কিছুই নয়, তার ভাগ্যদেবতার অপার করুণার ফল। সে করুণার স্পর্শ সারাজীবনে বারেবারেই অনুভব করেছেন, তবু এটাই বুঝি সবচেয়ে বড়ো। যার জন্যে কৃতজ্ঞতার আর অন্ত নেই তাঁর ভাগ্যের কাছে।

হতাশ প্রেম?

পাগল নাকি?

এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সেই প্রথম প্রেমকে সকৌতুকে দেখে তার মূল্যায়ন করে অবজ্ঞা করছেন না অনামিকা দেবী, শুধু সেই কালের পরিপ্রেক্ষিতে তাকিয়ে দেখে বলেছেন, পাগল নাকি!

হতাশ প্রেমে কাতর হবার যার কথা, সে কী অনামিকা দেবী? সে তো বকুল!

সেই বকুলের পক্ষে কি অমন একটা অদ্ভুত কথা ভাবা সম্ভব ছিল?

বকুলের বাবা-দাদারা যদি যোগ্য পাত্ৰ যোগাড় করে এনে, সেই তরুণী মেয়েটাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিত, মেয়েটা কি এ যুগের সিনেমার নায়িকার মত বিয়ের পিঁড়ি থেকে ছিটকে উঠে, কনেচন্দন রুমালে মুছে ফুলের মালা গলা থেকে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে জমজমাট বিয়েবাড়ি থেকে উধ্বশ্বাসে পথে বেরিয়ে পড়তে পারতো, এ অসম্ভব এ অসম্ভব বলতে বলতে?

নাকি অভিভাবকদের চেষ্টার মুখে তাদের মুখের ওপর বলতে পারতো, বৃথা চেষ্টা করবেন না। যদি করেন তো নিজের দায়িত্বে করবেন।

নাঃ, এসব কিছুই করতে পারতো না সে। কেউই পারতো না তখন। বকুলরা দেবদাস পড়ে মানুষ হওয়া মেয়ে। অভিভাবকরা বিয়ে দিলে সে বর হাতিপোতার জমিদারই হোক আর মশাপোতার ইস্কুলমাস্টারই হোক, তার চাদরে গাঁটছড়া বেঁধে ঠিকই তার পিছু পিছু গিয়ে দুধে-আলতার পাথরে দাঁড়াতো।

তারপর?

তারপর সারাজীবন সেই জীবনের জাবর কাটতো, আর কখনো কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো একটা উন্মনা নিঃশ্বাস ফেলতো।

পারুলের জীবনে প্রথম প্রেম-ট্রেম কিছু নেই, তবু পারুলের জীবনটাও ওই জাবরকাটা ছাড়া আর কি? পারুলও অনেক উন্মানা নিঃশ্বাস ফেলেছে বৈকি। যে প্ৰেম জীবনে কখনো আসেনি তার বিরহেই নিঃশ্বাস ফেলেছে পারুল। হয়তো এখনো তার সেই গঙ্গার ধারের বারান্দায় পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে নিঃশ্বাসটা ফেলে পারুল সেটা তার ছেলেদের প্রতি অভিমানে নয়, সেই না-পাওয়ায় গভীর শূন্যতার।

হঠাৎ একটা কথা ভাবলেন অনামিকা দেবী, নির্মল যদি সেজদিকে ভালবাসতো!

যদিও পারুল নামের প্রখরা মহিলাটি নির্মল নামের মেরুদণ্ডহীন ভীরু ছেলেটাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, তবু এ কথাটা এতোদিন পরে মনে হলো অনামিকা দেবীর।

নির্মলের ওপর বকুল সম্পর্কে একটা প্রত্যাশা ছিল বলে পারুল হয়তো অতো ধিক্কার দিয়েছিল ছেলেটাকে। যদি সে রকম কোনো প্ৰত্যাশা না থাকত, যদি ছেলেটা তার পরিপূর্ণ জীবনের মাঝখানে বসেও পারুলের দিকে দীন-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, পারুল হয়তো সম্পূর্ণতা পেতো। পারুল সেই সঞ্চয়টিকে পরম মূল্য দিতো।

সেজদি এখনো প্ৰেম-ট্রেম ভালো বোঝে-মনে মনে বললেন অনামিকা দেবী, আমার মত এমন নীরস হয়ে যায়নি। অবিরত যতো রাজ্যের কাল্পনিক লোকের প্ৰেম-ভালবাসার কথা লিখতে লিখতে, নিজের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে আমার।

নইলে সেদিন মহাজাতি সদনে, সেই ফাংশানের দিন, কেমন করেই আমি—

হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলেন অনামিকা দেবী।

ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিও কি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো? সেই ধাক্কায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন?.

নির্মল, সুনিৰ্মল নামের সেই বড় চাকুরে ছেলেটার মধ্যেও বুঝি সব পেয়েও বরাবর সেজদির মতোই একটা না-পাওয়ার শূন্যতা ছিল।

তাই নির্মল বলেছিল, কতো গল্প লিখছো, আমাদের গল্পটা লেখো না।

তখন আর মোতিহারীতে নেই নির্মল, বদলির চাকরির সূত্রে আরো কোথায় যেন ছিল। সেখানে বাংলা পত্রিকা দুর্লভ, তবু খুঁজে খুঁজে পড়তো। আর ছুটিতে বাড়ি এলেই সেই নিতান্ত কম বয়সের মতো চেষ্টা করে করে উপলক্ষ খুঁজে অনামিকা দেবীর সঙ্গে দেখা করে যেতো।

তা তখনো উপলক্ষ খোঁজার চেষ্টা করতে হতো বৈকি।

জগৎসংসারে এতো লোক থাকতে, একজন আর একটি জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যে ব্যাকুল হচ্ছে, এটা ধরা পড়ে যাওয়া যে দারুণ লজ্জার! হোক না তাদের যতোই কেননা বয়েস, ধরা পড়লেই মারা গেলে!

আর পড়বেই ধরা।

ওই ব্যাকুলতাটা এমনি জিনিস যে সংসারের বুনো মানুষগুলো তো দূরের কথা, শিশুর চোখেও ধরা পড়তে দেরি হয় না। শিশুও বিশেষ দৃষ্টিটা যে বিশেষ তা বুঝে ফেলে কৌতূহলদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে দেখে।

অতএব নিজের ক বছরের যেন বাচ্চা ছেলেটাকেও ভয়ের দৃষ্টিতে দেখে, চেষ্টা করে করে উপলক্ষ সৃষ্টি করতে নির্মল।

তেমনি এক মিথ্যা উপলক্ষের মুহূর্তে গভীর একটু দৃষ্টি মেলে বলেছিল নিৰ্মল, এতো গল্প লিখছো, আমাদের গল্পটা লেখো না!

বকুল তো তখন অনামিকার খোলসে বন্দী, সে খোলস ভেঙে ফেলে বকুল হয়ে ফুটে উঠবার উপায় কই তার? বকুলকে তো চিরকাল ওই খোলসের বোঝাটা বয়ে বেড়াতেই হবে।

এই খোলস জিনিসটা বড় ভয়ানক, প্ৰথমে মনে হয় আমি বুঝি নিজেই গায়ে চড়ালাম ওটাকে, খুলে রাখতে ইচ্ছে হলেই খুলে রাখবো, কিন্তু তা হয় না। আস্তে আস্তে নাগপাশের বন্ধনে বেঁধে ফেলে সে, তার থেকে আর মুক্তি নেই।

অতএব অনামিকা দেবীকে অনামিকা দেবী হয়েই থাকতে হবে। আর কোনদিনই বকুল হওয়া চলবে না, অন্য আর কিছু হবার ইচ্ছে থাকলেও চলবে না।

কাজে কাজেই বকুলকে নির্মলের ওই ছেলেমানুষি কথায় হেসে উঠে বলতে হয়েছিল, আমাদের গল্প? সেটা আবার কী বস্তু?

নির্মলের সেই ছেলেমানুষ অথচ গভীর চাহনির মধ্যে আঘাতের বেদনা ফুটে উঠেছিল। নির্মল আহত গলায় বলে উঠেছিল, এখন হয়তো সে বস্তু তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে, অনেক বড় হয়ে গেছে তুমি, তবু আমার কাছে সে সমান মূল্যবানই আছে। তুচ্ছ হয়ে যায়নি।

মনকে চঞ্চল হতে দিতে নেই।

কারণ সেটা ছেলেমানুষি, সেটা ওই খোলসখানার উপযুক্ত নয়। তাই আচঞ্চল কৌতুকে বলতে হয়, ওরে বাবা! সেই তামাদি হয়ে যাওয়া দলিলটা এখনো আয়রন চেস্টে তুলে রেখেছে? তোমার তো খুব অধ্যবসায়া!

নির্মল তার প্রকৃতিগত আবেগের সঙ্গে বলেছিল, তোমার কাছে হয়তো তামাদি হয়ে গেছে বকুল, আমার কাছে নয়।

তাই তো, তাহলে তো ভাবালে!

বলে হেসে ফেলেছিলেন অনামিকা দেবী।

আর ভেবেছিলেন, মনে করি বুঝি অনুভূতির ধারগুলো সব ঘষে ঘষে ক্ষয়ে গেছে আমার, কিন্তু সত্যিই কি তাই? তাই যদি হয়, কেন তবে ওকে দেখলে ভিতর থেকে এমন একটা উথলে ওঠা আহ্লাদের ভাব আসে? কেন ওর যে কদিন ছুটি থাকে, মনে হয় আকাশ-বাতাস সব যেন আনন্দে ভাসছে? কেন ওর ছুটি ফুরোলে মনে হয়, কী আশ্চৰ্য,এরইমধ্যে এক মাস হয়ে গেল! আর কেন মনে হয়, দিনগুলো কেমন যেন একরঙা হয়ে গেল!

ভাবাতে পারলাম? নির্মল আগ্রহের গলায় কৌতুক-স্বরে বলেছিল, সেটাও আশার কথা। তা ভাবনাটাকে রূপ দিয়ে ফেলো না, লেখো না আমাদের গল্প। এতো লিখছো বানানো গল্প।

অনামিকা দেবীর ওই আবেগের দিকে তাকিয়ে মমতা হয়েছিল, হঠাৎ যেন কোথায় কোন ধুলোর স্তরের নিচে থেকে মাথা তুলে একটা বিশ্বাসঘাতক দুষ্ট চুপি-চুপি বলে উঠেছিল, বাজে কথা বলছ কেন? বুকে হাত দিয়ে বল দিকি জিনিসটা একেবারে তামাদি হয়ে গেছে, একথা তুমি নিজেই বিশ্বাস কর!

তাই অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা না হয় লিখলামই একটা সত্যি গল্প, কিন্তু তারপর?

কী তারপর?

লোকে ভুলে-টুলে গেছে, আবার তাদের মনে পড়িয়ে দিয়ে এই বুড়ো বয়সে ধরা পড়া তো? খুব তরল শুনিয়েছিল গলাটা।

নির্মলের ঝকঝকে চোখ দুটো হঠাৎ খুশির আলোয় ঝলসে উঠেছিল। নির্মল কি অনামিকার ওই তরলতার বুদবুদে বকুলের ছায়া দেখতে পেয়েছিল?

আশ্চর্য নির্মলের চোখের সেই ঝলকানিটা কোনোদিনই ম্লান হয়ে যায়নি! হয়তো এই দীপ্তিটা অন্য এক আলোর। হয়তো নির্মল তাঁর জীবনের বহিরঙ্গের সমন্ত সমারোহের অন্তরালে একটি অন্তরঙ্গ কোণে একটি অকম্প দীপশিখা জেলে, সেটিকে বিশ্বস্ততার স্ফটিকের কৌটোয় ভরে রেখেছিল, এই দীপ্তি সেই শিখার।

নির্মল সেই দীপ্তি দিয়ে বলেছিল, ধরা পড়ে যাওয়া মানে? তবে আর কিসের বড় লেখিকা? এমন কৌশলে লিখবে যে, কেউ জানতেই পারবে না এটা সত্যি গল্প!

চেনা লোকেরা পারবে।

উহুঁ। যাতে না পারে, সেইভাবে লিখবে।

হেসে উঠেছিলেন অনামিকা দেবী, তবে আর লিখে লাভ? কেউ যদি টেরই না পেলো?

বাঃ, নাই বা টের পেলো। না পাওয়াই তো চাইছি। লোকের জন্যে তো নয়, নিজেদের জন্যেই। কেউ ধরতে পারবে না, শুধু আমরা দুজনে বুঝবো। বল তো কী মজা হবে সেটা!

তা হলেও—, অনামিকা দেবী একটু দুষ্ট হাসি হেসেছিলেন, গল্পের মূল নায়িকা তো বড় জেঠিমাকেই করতে হবে!

ধ্যেৎ! ওই গল্পটা লিখতে কে তোমায় সাধছে? একেবারে আমাদের নিজেদের গল্পটা লেখো, যে গল্পটা এখনো রোজ তৈরি হচ্ছে।

লিখলে কিন্তু পাল্লা দুটো ভয়ানক উঁচু -নিচু দেখাবে! অনামিকা দেবী বলেছিলেন হেসে হেসে, একদিকে সুন্দরী স্ত্রী, সোনারচাঁদ ছেলে, মোটা মাইনের চাকরি, কর্মস্থলে প্ৰতিপত্তি, অন্যদিকে একটা অখাদ্য গল্পলেখিকা-বর জোটেনি, ঘর জোটেনি, তাই সময় কাটাতে কলম ঘষে।

নির্মলের চোখের সেই ঝকঝকানির ওপর মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল। নির্মল বলেছিল, সুন্দরী স্ত্রী, মোটা মাইনের চাকরি, সেটা বাইরের লোক দেখবে! তুমি লেখিকা, তুমিও সেটাই দেখবে?

বাঃ, লেখিকা আবার নতুন কী দেখবে?

লেখিকা দেখবে সমারোহের অন্তরালে অবস্থিত দৈন্য। দেখবে অনেক জমজমাটের ওপিঠের গভীর শূন্যতা। কিন্তু-, নির্মল মিষ্টি একটু হেসে বলেছিল, কিন্তু এ গল্পও এখন চাই না আমি। এ গল্প পরে লিখো, যখন মরে-টরে যাবো। আমি চাই সেই বোকা ছেলেমেয়ে দুটোর গল্প-যাহারা আঁকেনি ছবি, সৃজেছিল শুধু পটভূমি।

অনামিকা দেবী হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিলেন, কেন? নতুন করে অনুভব করতে, কী বোকা ছিল তারা?

তারপর বলেছিলেন, আচ্ছা লিখবো।

নির্মল বললে, ঠিক আছে! কিসে দেবে বল, সেই পত্রিকাটার গ্রাহক হবে কাল থেকে।

আরে তুমি গ্রাহক হতে যাবে কোন দুঃখে? লেখিকা নিজেই না হয় পাঠিয়ে দেবে!

নাঃ। ও মৃদু হেসে বলেছিলো, বিনা প্রতীক্ষায় পেলে সে জিনিস আর মূল্যবান থাকে না। এ বেশ প্রতি মাসে ডাকের প্যাকেটটা খোলবার সময় হাত কাঁপিবে–

অনামিকা দেবীর ভাবনা ধরে গিয়েছিল।

অনামিকা দেবীর মনে হয়েছিল, এমনি ছোট্ট ছোট্ট কথার চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নির্মল নামের ছেলেটা বুঝি অনামিকা দেবীর সেই অনেক আগে বন্ধ করে দেওয়া, অনেক নীচের পাতাল-ঘরটা খুলে ফেলতে চায়।

তাই অনামিকা দেবী খুব জোরে হেসে উঠেছিলেন, ও বাবা! বল কি? এতো?

তুমি ঠাট্টা করছো?

বাঃ, ঠাট্টা করবো কেন? এমনিই বলছি-এতো?

নির্মল উদাস হাসি হেসে বলেছিল, ঠাট্টা অবশ্য করতে পারো তুমি, সে রাইট আছে তোমার। আমার আর মুখ কোথায়?

ও কথা বোলো না নির্মলদা, বকুল তখন ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, ও কথা কোনোদিনও বলবে না। আমার মতে এটাই ভালো হয়েছে।

তাই ভাববো।

দীর্ঘনিঃশ্বাসের মত একটা শব্দ পেয়েছিলেন অনামিকা দেবী।

তারপর আবার সেই আবেগের গলায় উচ্চারিত কথা, আমি কিন্তু প্ৰতীক্ষা করবো।

বলেছিল নির্মল।

প্রতীক্ষা করবো!

কিন্তু সে গল্প লেখা হয়েছিল কোনোদিন?

কই আর?

লেখা হলে আর সেই ঘর-সংসারী বড় বয়সের মানুষটা কতোদিন পরে আবার একখানা চিঠি লিখে বসবে কেন? কই? কোথায় সেই গল্প? যে গল্প কেবল তুমি বুঝবে আর আমি বুঝবো, আর কেউ বুঝতে পারবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *