১১-১৫. ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর

ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে বোম্বেটেদের “এমেলিয়া” জাহাজখানা। এডমন্ড ইতিমধ্যেই ভিড়ে গেছে তাদের দলে। তার জাহাজী-জ্ঞান ও জাহাজ চালাবার অভিজ্ঞতা দেখে বোম্বেটেরা খুশি হয়েছিল।

ওরা চলেছিল ফ্রান্সের সীমান্তে–জাহাজের বে-আইনী মালগুলো কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিতে। কয়েকদিন চলবার পর এডমন্ড একদিন দেখতে পেলো যে জাহাজখানা একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ওটা কোন দ্বীপ বুঝতে না পেরে জাহাজের কাপ্তেনকে সে জিজ্ঞাসা করলো–ওটা কোন দ্বীপ কাপ্তেন?

–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ।

–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ!

কাপ্তেনের মুখে এই কথা শুনেই এডমন্ডের বুকের ভিতর হঠাৎ যেন আলোড়ন আরম্ভ হয়ে গেল।

অতি কষ্টে মনের ভাব চেপে রেখে সে বললো–চলুন না, ওখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করে যাই!

কাপ্তেন হেসে বললো–খুব জায়গায় বিশ্রাম নেবার কথা বলেছো ভায়া! ওখানে কি মানুষ আছে নাকি?

–তার মানে?

–মানে, ঐ দ্বীপে আজ পর্যন্ত মানুষের বসতি হয়নি। তবে হ্যাঁ, শিকার যদি করতে চাও তাহলে যেতে পারি। প্রচুর শিকার পাওয়া যায় ওখানে।

জ্যাকোপো নামে ওদের মধ্যেকার একজন বোম্বেটে বলে উঠলো এইসময়–কথাটা মন্দ বলেননি। অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি; চলুন দ্বীপে নেমে কিছু শিকার করে নেওয়া যাক।

কাপ্তেন বাধা দিলো না এই সাধু প্রস্তাবে।

জাহাজের গতি পরিবর্তিত হলো মন্টিক্রিস্টো দ্বীপের দিকে।  

তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙর ফেলা হলো। জল কম বলে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বোম্বেটেরা তখন একখানা বোটে করে চলতে লাগলো তীরের দিকে। বোটে উঠবার আগে তারা প্রয়োজনীয় গুলি, বারুদ, বন্দুক, কুড়ল, কাটারি, রান্না করবার বাসনপত্র আর মশলাপাতি তুলে নিলো বোটে। বলা বাহুল্য, এডমন্ড চললো তাদের সঙ্গে। তারপর তীরে নেমে কথা হতে লাগলো, কে শিকার করতে যাবে।

এডমন্ড বললো–আমি যাব।

জ্যাকোপো বললো–আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

এডমন্ডের ইচ্ছা ছিল, সে একাই যাবে, তাই জ্যাকোপো যেতে চাওয়ায় সে একটু বিরক্তই হলো মনে মনে। কিন্তু মনের বিরক্তি মুখে প্রকাশ না করে সে যেন খুব খুশি হয়েছে এই রকম ভাব দেখিয়ে জ্যাকোপোর সঙ্গে এগিয়ে চললো।

কিছুদূর যাবার পর একটা নধর পাঁঠা দেখতে পেয়ে এডমন্ড গুলি করে মেরে ফেললো সেটাকে। জ্যাকোপো মনের আনন্দে ছুটে গিয়ে পাঁঠাটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে বললো– চলো ভাই, আর শিকারের দরকার হবে না।

এডমন্ড বললো–না ভাই, তুমি বরং এটাকে নিয়ে গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করো। আমি দেখি আরও দু’ একটা পাই কি না। খাওয়ার আগে আমি যদি না এসে পৌঁছাই তাহলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করো। বন্দুকের আওয়াজ শুনলেই আমি চলে আসবো। জ্যাকোপোর তখন জিভ দিয়ে জল পড়ছে। কতক্ষণে পাঁঠাটাকে রোস্ট করা হবে, তার মনে তখন কেবল সেই চিন্তা। সে তাই আনন্দের সঙ্গেই রাজী হলো এডমন্ডের প্রস্তাবে।

জ্যাকোপো চলে যেতেই এডমন্ড চললো পুবের দিকে। পুবের ঐ পাহাড়টার উপরে যেতেই হবে তাকে। পাহাড়ের কাছে হাজির হয়ে এডমন্ড লক্ষ্য করলো যে, একটা শুকনো খাল এঁকে-বেঁকে চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। খালটি দেখে এডমুন্ডের মনে হলো যে একসময় হয়তো ওটা নদী ছিল। মহাকালের হস্তক্ষেপে আজ শুকিয়ে গেছে। নদীর ধার দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলতে লাগলো সে।

অনেকক্ষণ চলবার পর পাহাড়ের নিচে এসে গেল এডমন্ড। এইবার শুরু হলো চড়াই। কোথাও খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে, গাছের ডাল লতা গুল্ম ধরে, কোথাও বা হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলো সে। চড়াই শেষ হতেই আরম্ভ হলো উতরাই। এইভাবে বহু চড়াই-উতরাই ভেঙে পাহাড়ের চূড়াগুলি গুনতে গুনতে চলেছে সে। তার লক্ষ্য কুড়ি নম্বর চূড়ার দক্ষিণ দিকের সেই গুহাটি–যার মধ্যে সঞ্চিত আছে স্পাডা পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যরাশি।

কিন্তু এখনও যে দশটি চূড়াও পার হয়নি সে! এইভাবে চললে কুড়ি নম্বর চূড়ায় পৌঁছাতে বেলা শেষ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই! ওদিকে তার দেরি দেখে তার সঙ্গীরা হয়তো খুঁজতে আসবে তাকে! তারা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্যের কথা তাহলে সব পণ্ড হবে।

এইসব কথা চিন্তা করে এডমন্ড ফিরে আসাই ঠিক করলো তখনকার মতো। সে ভাবলো সঙ্গীদের কোন রকমে এখান থেকে বিদায় করতে পারলে হয়।

যাবার সময় সে পথের দুই দিকে চিহ্ন রাখতে রাখতে চললো। কোথাও পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে, কোথাও গাছের ডাল কেটে পথে রেখে নিশানা ঠিক করে রাখতে লাগলো সে।

অনেকক্ষণ চলবার পর সমুদ্রের দিকের প্রথম চুড়াটার উপর উঠে সে দেখতে পেলো তার সঙ্গীদের। তারা তখন খাবার ব্যবস্থায় উন্মত্তপ্রায়। হঠাৎ জ্যাকোপো তার বন্দুকটা আকাশের পানে তুলে ধরে একটা আওয়াজ করলো। এডমন্ড বুঝতে পারলো, খাবার তৈরি হয়ে গেছে, তারই সংকেত করলো জ্যাকোপো। এডমন্ড পাহাড়ের উপর থেকে হাত তুলে ইশারায় উত্তর দিল–সে আসছে।

জ্যাকোপো দেখতে পেলো তাকে। সেও হাত তুলে ইশারা করলো।

এডমন্ড তখন লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগলো সেই চুড়া বেয়ে।

হঠাৎ তার সঙ্গীরা দেখলো যে এডমন্ড পড়ে গেল। হয়তো পা পিছলে পড়ে গেছে, হয়তো খুব আঘাত পেয়েছে সে–এই ভেবে চারজন লোক ছুটে আসতে লাগলো সেই পাহাড়ের দিকে।

কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডকে দেখতে পেলো তারা। পাহাড়ের উপরে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে ছিল সে।

ওরা তখন এডমন্ডের কাছে গিয়ে তাকে ধরে তুলবার চেষ্টা করতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো সে।

জ্যাকোপো বললো–খুব লেগেছে বুঝি?

যন্ত্রণাকাতর-কণ্ঠে এডমন্ড বললো–হ্যাঁ!

–যেতে পারবে না?

–না। আমার পাজরার হাড় বোধ হয় ভেঙে গেছে। আমাকে তোমরা ঐ গুহাটার ভিতরে নিয়ে চলো। এই বলে পাশের একটি গুহা দেখিয়ে দিল সে।

ওরা তখন এডমন্ডকে ধরাধরি করে সেই গুহার ভিতরে নিয়ে নামিয়ে রাখলো। যতক্ষণ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ততক্ষণই এডমন্ড চিৎকার করছিলো।

গুহার ভিতর নামিয়ে রাখতেই এডমন্ড বললো–আমার আর এখান থেকে নড়বার উপায় নেই ভাই।

তোমরা বরং আমার খাবার এখানেই এনে দাও। জ্যাকোপো বললে–কিন্তু ভাই আমাদের যে আজই রওনা হতে হবে। আজ রওনা না দিলে নির্দিষ্ট সময়ে জায়গামত পৌঁছাতে পারব না আমরা।

এডমন্ড বললো–তোমরা যাও ভাই। আমাকে বরং ফিরবার পথে তুলে নিয়ে যেও।

জ্যাকোপো বললো–তা কি করে হয়? তোমাকে একা এই দ্বীপে ফেলে রেখে আমরা যাই কি করে?

এডমন্ড বললো–কিন্তু উপায় তো নেই ভাই। কাপ্তেনকে বলে আমার জন্য কিছু বিস্কুট, এক কলসী জল, একটা কুড়ুল, একটা গাঁইতি আর কিছু গুলিবারুদ নিয়ে এসো। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো।

জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা তখন কাপ্তেনের কাছে ফিরে গিয়ে এডমন্ডের অবস্থার কথা বলতেই সে বললো–বেশ! তবে তাই হোক। না গিয়ে যখন উপায় নেই আমাদের, তখন এ ছাড়া আর উপায় কি?

কাপ্তেনের আদেশে তখন এডমন্ডের জন্য দিন সাতেকের মত খাবার, আর তার চাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে চললো জ্যাকোপো আর তিন-চারজন লোক। বলা বাহুল্য পাঁঠার রোস্টও নিয়ে যাওয়া হলো এডমন্ডের জন্য।

এডমন্ড জিনিসগুলো পেয়ে মনে মনে খুশি হলেও মুখে বললো–তাহলে এসো ভাই, তোমাদের আর আটকে রাখতে চাই না। আমি এইখানেই অপেক্ষা করবো তোমাদের জন্য। ফিরবার পথে আমাকে তুলে নিয়ে যেও কিন্তু।

জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা সাশ্রনয়নে বিদায় নিলো এডমন্ডের কাছ থেকে।

ঐদিনই ‘এমেলিয়া’ জাহাজখানা চলে গেল ওখান থেকে।

.

১২.

আসলে এডমন্ডের আঘাতটা সাংঘাতিক কিছু হয়নি। সঙ্গীদের ওখান থেকে বিদায় করবার জন্যই সে ঐভাবে অভিনয় করছিল। তাই জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা চলে যেতেই সে উঠে বসলো।

উঠে বসে মনের আনন্দে পেট ভরে পাঁঠার রোস্ট খেয়ে আবার সে শুয়ে পড়লো সেই গুহার মধ্যে। সে ভাবলো যে, আজ আর কিছু করা হবে না। জাহাজ চলে গেলে কাল যা হয় করা যাবে।

সে-রাত্রি ঐ গুহার মধ্যে শুয়েই কাটলো তার।

পরদিন সকালে উঠেই সে তৈরি হয়ে নিলো। বন্দুকটা এক কাঁধে ঝুলিয়ে, বারুদের থলেটাকে আর এক কাঁধে। তারপর কুড়ুল আর গাঁইতি হাতে নিয়ে এগিয়ে চললো সে।

আবার সেই মরা নদী। আর সেই পার্বত্য পথ।

গতকালের নিশানা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো সে।

একে একে উনিশটি পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে সে যখন এসে পৌঁছলে বেলা তখন প্রায় দুপুর। কুড়ি নম্বর চূড়ার কাছে এসে দক্ষিণ দিকে চললো সে। একটু যেতেই সে দেখতে পেলো পাহাড়ের গায়ে একখানা বিরাট পাথর আটকে আছে। পাথরখানা দেখে তার মনে হলো যে ওখানা কেউ টেনে এনে রেখেছে সেখানে, কারণ পাহাড়ের সঙ্গে ঐ পাথরখানার কোনো সম্বন্ধ নেই। ওখানা একখানা বিচ্ছিন্ন, পাথর। কিন্তু অতবড় একটা বিরাট পাথর কে টেনে আনলো ওখানে? এ যে একটা হাতির পক্ষেও সম্ভব নয়! সে তখন পাথরের অবস্থানটা ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলো।  তার মনে হলো পাথরখানা উপর থেকে গড়িয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো এখানে কোন কিছু দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে গড়ানো পাথরখানাকে আটকে ফেলা হয়েছিল।

নিশ্চয়ই তাই!

সে তখন পাথরখানার অবস্থান আর একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। তার মনে হলো যে পাথরখানাকে যদি কোন রকমে একটু সরানো যায় তাহলে নিশ্চয়ই ওখানা নিচে গড়িয়ে পড়বে।

এই কথা ভেবে সে নিকটস্থ একটা গাছ থেকে একখানা সরু অথচ মজবুত ডাল কেটে এনে সেই ডাল দিয়ে চাড় দিতে চেষ্টা করলো পাথরখানাকে।

কিন্তু মুস্কিল হলো এই যে, ডালখানা পাথরের নিচে ঢোকাতে পারা গেল না।

এডমন্ড তখন গাঁইতি দিয়ে পাথরের কিনারে কোপাতে আরম্ভ করলো। মিনিট কয়েক কোপাতেই গাঁইতিখানার মুখ হঠাৎ একটা ফাঁপা জায়গার মধ্যে ঢুকে গেছে বলে মনে হলো তার। এই ব্যাপার দেখে তার বুঝতে দেরি হলো না যে ঐ পাথরের নিচেই আছে সেই গুহার মুখ। সে তখন গাছের সেই ডালখানাকে সেই ছিদ্রপথে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে চাড় দিতে লাগলো। কিন্তু চাড় দিলে কি হবে, পাথরখানা একটুও নড়লো না।

শত শত বৎসর পাথরখানা ওখানে থাকার ফলে তার চারিদিকের মাটি এমন শক্তভাবে এঁটে ছিল পাথরখানার গায়ে যে এডমন্ডের পক্ষে সম্ভব হলো না ওখানাকে স্থানচ্যুত করতে।

এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়লো থলের বারুদের কথা। সে ভাবলো যে খানিকটা বারুদ পাথরের নিচে ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে হয়তো কাজ হবে।

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।

সে তখন গাঁইতির সাহায্যে পাথরের নিচে একটা গর্ত তৈরি করে তার মধ্যে বারুদ ঢুকিয়ে ভাল করে চাপা দিল। তারপর থলে থেকে একগাছা দড়ি বের করে পলতের মত ঢুকিয়ে সেটাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল।

একটু পরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো সেই পাথরের নিচে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরখানা নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

পাথরখানা সরে যেতেই এডমন্ড দেখলো যে একটা গুহার মুখ বেরিয়ে পড়েছে তার নিচে থেকে।

সে তখন এগিয়ে গেল সেই গুহার দিকে। কিন্তু কি সর্বনাশ! ওটা কি?

এডমন্ড দেখলো, একটি বিরাট অজগর সাপ এঁকে বেঁকে বেরিয়ে আসছে সেই গুহার ভিতর থেকে। এত বড় সাপ এডমন্ড জীবনেও দেখেনি। ভয়ে তার কপাল ঘেমে উঠলো। গুহার মধ্যে ঢুকতে সাহস হলো না তার।

তার আরও মনে হলো যে সাপ না থাকলেও এই তিন শ’ বছরের চাপা গুহার মধ্যে যে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে আছে, সেই গ্যাস নাকে ঢুকলে অবধারিত মৃত্যু।

এডমন্ড তখন অপেক্ষা করতে লাগলো ঐ গ্যাস বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। সে ভালো করেই জানতো যে বাতাসের স্পর্শ পেলেই গ্যাস উপরের দিকে উঠতে থাকে।

.

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে সে ভগবানের নাম নিয়ে ঢুকে পড়লো সেই গুহার মধ্যে!

গুহাটা খুব বড় নয়। সে দেখতে পেলো এক কোণে একটা কাঠের বাক্স তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ করা রয়েছে।

সে তখন তার বন্দুকের নল দিয়ে তালাটার গায়ে আঘাত করতেই সেটা গুঁড়ো হয়ে গেল।

তালাটা গুঁড়ো হয়ে যেতেই সে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেললো। বাক্সের ভিতরটা ছিল তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে রাশীকৃত সোনার বাট, দ্বিতীয় ভাগে সোনার মোহর, আর তৃতীয় ভাগে হীরে চুনী পান্না প্রভৃতি মহামূল্য মণিমুক্তা।

ওরে বাপরে! এ যে রাজার ঐশ্বর্যের চেয়েও বেশি!

উত্তেজনায় এডমন্ডের কপাল দিয়ে টস টস করে ঘাম ঝরতে লাগলো।

এই বিপুল ঐশ্বর্য হাতে পেয়ে তার মাথা ঘুরে উঠলো। প্রথমেই তার মনে হলো কি উপায়ে এগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়।

অনেক চিন্তা করে সে দেখলো যে এখন বেশি কিছু নিতে গেলে বিপদ হবে। যদি তার সঙ্গীরা ঘুণাক্ষরেও এই গুপ্তধনের কথা জানতে পারে তাহলে বন্ধু বলে তারা তাকে রেহাই দেবে না। তাকে হত্যা করে ঐ ধনরত্ন কেড়ে নেবে তারা।

সে তখন দুই মুঠো ভরতি করে হীরে-জহরত তুলে তার বেল্টের সঙ্গে সংলগ্ন থলেয় ভরতি করে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো।

তারপর সে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার সঙ্গীদের জন্য।

.

১৩.

ছয়দিনের দিন ‘এমিলিয়া’ জাহাজখানা আবার ফিরে এলো। এডমন্ডকে সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাপ্তেন বোট পাঠিয়ে দিল তাকে নিয়ে আসতে।

এডমন্ড জাহাজে উঠলে কাপ্তেন বললো–তোমাকে এখানে রেখে গিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কেমন আছ এখন?

এডমন্ড বললো–ভাল।

এই সময় জ্যাকোপো কাপ্তেনকে বললো–কিন্তু কাপ্তেন, এবারের টাকার ভাগ তো আমাদের বন্ধুরও পাওয়া উচিত। কাপ্তেন বললো–ও যদি আমাদের সঙ্গে যেতো তাহলে পেতো বৈ কি।

কাপ্তেনের এই কথায় জ্যাকোপো বললো–কিন্তু ও তো এখানে নিজের ইচ্ছায় থাকেনি, তাই আমার ইচ্ছা, ওকেও সমান ভাগ দেওয়া হোক। তবে আপনি যদি নিতান্তই ভাগ দিতে রাজী না হন, তাহলে আমিই আমার ভাগের টাকার অর্ধেক ওকে দেবো।

কাপ্তেন হেসে বললো–তোমার ভাগের অর্ধেক আর দিতে হবে না। ওকে সমান অংশই দেওয়া হবে।

এই বলে পকেট থেকে এক গোছা নোট বের করে তা থেকে পঞ্চাশ পিয়েস্তা এডমন্ডকে দিয়ে সে বললো–এই নাও বন্ধু তোমার ভাগ।

এডমন্ড নিঃশব্দেই নোটগুলো নিয়ে পকেটে ফেললো। তারপর সে জিজ্ঞাসা করলো–এবার কোন দিকে যাওয়া হচ্ছে বন্ধু?

কাপ্তেন বললো–লেগহর্ন বন্দরে।

***

লেগহর্ন বন্দর।

জাহাজীদের ফুর্তির সব রকম ব্যবস্থাই এখানে আছে। অনেক দিন জাহাজে আটকে থেকে নাবিকরা সবাই উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। কথা হলো, জাহাজ এখানে কিছুদিন থাকবে। সবাই নেমে পড়লো বন্দরে।

সবাই যে যার মত ছুটলো আনন্দের শিকার খুঁজতে। এডমন্ড বেরিয়ে পড়লো পথে। তার পকেটে তখন ছোটখাট রাজার দৌলত।

রাস্তায় এক ইহুদী মণিকারের দোকানে ঢুকে পড়লো সে। বুড়ো দোকানদার তার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলো–কি চাই মঁসিয়ে?

এডমন্ড বললো–দোকানের মালিকের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বৃদ্ধ বললো–কি কথা আছে বলুন? আমিই এই দোকানের মালিক।

এডমন্ড বললো–আমি কিছু হীরে বিক্রি করতে চাই। আমার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি।

বৃদ্ধ বললো–সঙ্গে আছে?

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা ভিতরে আসুন।

এডমন্ড দোকানের ভিতরে যেতেই বৃদ্ধ তাকে সঙ্গে করে তার খাস কামরায় নিয়ে গেল।

খাস কামরায় গিয়ে এডমন্ড পকেট থেকে চারখানা হীরে বের করে বৃদ্ধের সামনে টেবিলের উপরে রেখে বললে–দেখুন তো, কি দাম পাওয়া যেতে পারে এর!

তার ভয় হতে লাগলো যে ইহুদী বুড়ো হয়তো তাকে জেরা করতে আরম্ভ করবে।

 বৃদ্ধ কিন্তু জেরার ধারে কাছেও গেল না। সে হীরে ক’খানাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–এক এক খানার দাম পাঁচ হাজার ফ্রাঁ করে দিতে পারি আমি।

এডমন্ড আর দরকষাকষি না করে বিশ হাজার ফ্রাঁতেই* [বিশ হাজার ফ্রাঁ আমাদের দেশের প্রায় তিন লাখ টাকা] দিয়ে দিল হীরে চারখানা। ইহুদী বুড়োও এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করলো না। কারণ সে জানতো যে ঐ হীরেগুলো বেচে কম করেও চার হাজার ফ্র লাভ করবে সে।

পরদিন জ্যাকোপোকে একান্তে ডেকে এডমন্ড বললো–তুমি যদি আমার হয়ে একটা কাজ করে দাও তাহলে বড় উপকার হয়।

–কি কাজ?

–মার্সেঈ বন্দরে গিয়ে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের লুই দান্তে নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের খবর এনে দিতে হবে।

–আর?

–আর কাটালান গ্রামের মার্সেদেস নামে একটি মেয়ের খবর।

–আর কিছু।

–না।

–কিন্তু আমি যাব কি করে সেখানে?

–সে জন্য তোমাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আমি একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিচ্ছি তোমাকে, আর তোমার পারিশ্রমিক বাবদ এক শ’ ফ্ৰাঁ অগ্রিম দিচ্ছি।

এই বলেই পকেট থেকে এক গাদা নোট বের করে তা থেকে এক শ’ ফাঁর নোট জ্যাকোপোর হাতে দিল সে।

জ্যাকোপো আশ্চর্য হয়ে বললো–এত টাকা তোমার কাছে! কি ব্যাপার?

এডমন্ড মৃদু হেসে বললো–হ্যাঁ ভাই, আমি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছি। এখানে আমার এক আত্মীয় থাকতেন। আমি ছাড়া তার আর কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় তিনি মারা যাবার সময় তার যা কিছু সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। কাল সেখানে যেতেই আমি জানতে পারি এই খবর।

জ্যাকোপো অবিশ্বাস করলো না তার কথা। আর অবিশ্বাস করবেই বা কি করে! নিজের চোখেই তো দেখতে পেলো, যে এডমন্ডের পকেটে কমপক্ষে হাজার ফ্রাঁর নোট।

এর পর জ্যাকোপোকে সঙ্গে করে জাহাজঘাটে গিয়ে একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিয়ে বললো–তুমি ফিরে এসে আমাকে দেখতে না পেলে জাহাজঘাটের কাছে ঐ হোটেলে অপেক্ষা করো, কেমন?

জ্যাকোপো বললো–তুমি এখন কি করবে বন্ধ?

–কিছুই ঠিক নেই, তবে ‘এমিলিয়া’ জাহাজে চাকরি করবো না যে, এটা ঠিক।

ঐ দিনই জ্যাকোপো রওনা হয়ে গেল মার্সেঈ-এর পথে।

এদিকে এডমন্ড জাহাজে গিয়ে তার হঠাৎ বড়লোক হওয়ার কথা বলে বিদায় চাইলো সবার কাছে। জাহাজ থেকে চলে আসার সময় প্রত্যেক লোককে সে এক শ’ ফ্রাঁ করে পুরস্কার দিয়ে এলো।

কাপ্তেনের কাছে বিদায় নিতে গেলে সে এডমন্ডের সঙ্গে করমর্দন করে বললো–দরকার হলে ‘এমিলিয়া’ জাহাজের এই গরীব কাপ্তেনকে ভুলো না বন্ধু।

.

এর দু’দিন পরে সমুদ্রে একখানা সুন্দর ছোট জাহাজ দেখে এডমন্ড খোঁজ নিয়ে জানলো যে ঐ জাহাজখানা একজন ইংরেজ ভদ্রলোক চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কিনেছেন। জাহাজখানার গঠন ও সৌন্দর্য দেখে এডমন্ডের ইচ্ছা হলো ওখানা কিনে নিতে। সে তখন সেই জাহাজের মালিকের সঙ্গে দেখা করে ষাট হাজার ফ্ৰাঁ দরে কিনতে চাইলো জাহাজখানা। চল্লিশ হাজার ফ্রাতে জাহাজ কিনে দু’দিনেই বিশ হাজার ফ্রাঁ লাভ পেয়ে জাহাজের মালিক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। এডমন্ড তখন এক বড় মণিকারের দোকানে গিয়ে আরও কয়েকখানা হীরে বিক্রি করে সেই দিনই জাহাজখানা কিনে ফেললো।

জাহাজ কেনা হয়ে গেলে সেই ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন– আপনার যদি ক্রু আর খালাসী দরকার হয় তাহলে আমার লোকদের রাখতে পারেন আপনি।

এডমন্ড বললো–তার দরকার হবে না। আমি একাই পারবো এই জাহাজ চালিয়ে যেতে। একা একা ইচ্ছামত সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবার জন্যই আমি জাহাজখানা কিনলাম।

ইংরাজ ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেলেন এডমন্ডের কথায়। শুধু তিনি কেন, লেগহর্নের বহু লোকই অবাক হয়ে গিয়েছিল, যখন তারা দেখলো যে জাহাজের মালিক কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই চালিয়ে যাচ্ছেন তার জাহাজখানা। এখানে একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। কথাটা হচ্ছে এই যে জাহাজখানা কিনবার পরেই এডমন্ড তার নিজস্ব কেবিনে তিনটি খোপওয়ালা একটা বড় সিন্দুক তৈরি করে নিয়েছিল।

কয়েকদিন পরেই আবার ফিরে এলো এডমন্ড। এ ক’দিন সে জাহাজ নিয়ে কোথায় গিয়েছিল কেউই তা জানতে পারলো না।

বন্দরে এসে এডমন্ড দেখতে পেলো যে জ্যাকোপো ফিরে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

এডমন্ড তাকে জিজ্ঞাসা করলো–কি বন্ধ, খবর পেলে তাদের?

জ্যাকোপো বললো–বৃদ্ধের খবর পেয়েছি। তিনি মারা গেছেন।

–আর সেই মেয়েটি?

–তার কোন খোঁজ পেলাম না। ওখানকার কোন লোকই বলতে পারলো না তার কথা।

হঠাৎ চোখে জল এসে পড়লো এডমন্ডের।

জ্যাকোপো জিজ্ঞাসা করলো–কি হলো বন্ধু?

এডমন্ড বললো–কিছু না। তুমি যে খবরটা এনে দিলে এর জন্য আমার ধন্যবাদ নাও। আর সেই সঙ্গে বন্ধুর কাছ থেকে সামান্য কিছু প্রীতি উপহার…।

এই বলে পকেট থেকে এক শ’ ফাঁর নোট বের করে জ্যাকোপোর হাতে দিয়ে সে আবার বললো–বিদায় বন্ধ! জীবনে আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু তোমাকে আমি কোন দিনই ভুলবো না।

.

১৪.

টাকা থাকলে দুনিয়ায় অনেক কিছুই সম্ভব হয়; তাই এডমন্ড দান্তেও টাকার জোরে লর্ড উইলমোর হয়ে গেল। এই নামেই ‘পাসপোর্ট’ও বের করে নিল সে। কোথাকার লর্ড, কি তার বংশ-পরিচয়–এসব কোন প্রশ্নই বাধা হয়ে দাঁড়ালো না তার পাসপোর্ট যোগাড় করবার ব্যাপারে। সবাই ভাবলো–যাঁর পকেটে সব সময় কয়েক লাখ ফ্রাঁর নোট থাকে, তিনি লর্ড ছাড়া আর কি হবেন?

এইভাবে নিজেকে লর্ড তৈরি করে এডমন্ড ভাবলো যে লর্ডের মত চালে থাকতে হলে তার কিছু আয়ের পথ তৈরি করা দরকার। অন্তত লোক দেখানোর জন্যও তার এমন কোন সম্পত্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তগত করা দরকার যাতে কারো মনেই কোন রকম সন্দেহ আসতে না পারে। এই সব কথা চিন্তা করে এডমন্ড সোজা চলে গেল রোমে। এডমন্ড যখন ফারাওঁ জাহাজে চাকরি করত, সেই সময়েই সে জানতো যে রোমের বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান “মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সঙ্গে “মোরেল” কোম্পানির লেনদেন আছে।

এই “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নাম জানতো না, সে রকম লোক ইউরোপে তখন খুব কমই ছিল।

এডমন্ড সোজা গিয়ে সেই কোম্পানির মালিকের সঙ্গে দেখা করে কোম্পানিটা তাকে বিক্রি করে দিতে অনুরোধ জানালো। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মালিক একজন অপরিচিত লোকের মুখে এইরকম অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–”টমসন এন্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সুনামের (Goodwill) দাম কি রকম হতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণা আছে কি?

এডমন্ড হেসে বললো–কিছু কিছু আছে বৈ কি? কিন্তু যে দামই আপনি চান, আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি, আর চান তো দামটা আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে প্রস্তুত।

মালিক তখন আগন্তুকের আর্থিক অবস্থা বুঝবার জন্য একটা অবিশ্বাস্য অঙ্ক দাবি করে বসলেন।

দাবির অঙ্কটা শুনে এডমন্ড কিন্তু মোটেই ঘাবড়ালো না। একটু হেসে সে বললো–টাকাটা কি এখনই চান?

–এখনই চাই! তার মানে? আপনি এত টাকা পকেটে করে নিয়ে এসেছেন নাকি?

এডমন্ড তখন তার হাতের ছোট্ট অ্যাটাচি কেসটা খুলতে খুলতে বললো–এই সামান্য টাকাও যদি সঙ্গে না থাকে, তাহলে কি “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মত বিখ্যাত কোম্পানি কিনতে সাহসী হই?

এই বলে সত্যি সত্যিই সে এক গাদা নোট বের করে মালিকের টেবিলের উপর রেখে বললে–গুনে নিন।

ঐ দিনই লেখাপড়া হয়ে গেল। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নতুন মালিক হলেন লর্ড উইলমোর।

এর কয়েকদিন পরে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের একখানা চারতলা বাড়ির দরজার সামনে একজন ইংরেজ ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো–কাকে চান আপনি?

ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন–এই বাড়ির চারতলায় লুই দান্তে নামে একজন বৃদ্ধ থাকতেন; তার কোন খবর আপনারা জানেন কি?

–লুই দান্তে! না মশাই, ওরকম নামেরই কোন লোক এ বাড়িতে ছিলেন কিনা বলতে পারি না। আপনি বরং চারতলায় যে ভদ্রলোক আছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

ইংরেজ ভদ্রলোক তখন চারতলায় উঠে গিয়ে একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে কি ভাবলেন, তারপর ঘরের বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বললেন–ভিতরে কে আছেন, দয়া করে একটু বাইরে আসবেন কি?

একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন–কি চাই আপনার?

–না, চাইনে কিছু, এই ঘরে অনেকদিন আগে আমার এক আত্মীয় থাকতেন কিনা!

–কি নাম আপনার আত্মীয়ের?

–লুই দান্তে।

–লুই দান্তে!

–হ্যাঁ, লুই দান্তে, তার কি হয়েছে বলতে পারেন কি?

–তা তো জানি না। আপনি বরং বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

–বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা আমি আগেই করেছিলাম। আপনি জেনে রাখুন, এ বাড়ির মালিক এখন আমিই।

–আপনি! আপনিই কি লর্ড উইলমোর?

–হ্যাঁ, লোকে ঐ নামেই আমাকে ডাকে বটে।

ভাড়াটে ভদ্রলোক তখন সঙ্কোচে জড়সড় হয়ে গেলেন লর্ড উইলমোরের সামনে। তিনি বললেন–আমার প্রতি কোন আদেশ আছে কি স্যর?

–আদেশ নয়, অনুরোধ। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে আমার।

–কি অনুরোধ, বলুন?

–আপনাকে এই ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য এর পরিবর্তে আর একটা ফ্ল্যাট আপনাকে দিতে রাজী আছি আমি। আমার এই অনুরোধটা যদি আপনি রাখেন, তাহলে নতুন ফ্ল্যাটের দরুন আপনাকে কোন ভাড়া দিতে হবে না। এরকম লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, এরকম বেকুব ভাড়াটে দুনিয়ার কোথাও থাকতে পারে না। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন।

লর্ড বললেন–তাহলে আর দেরি করবার দরকার নেই, আজই আপনি তেতলার খালি ফ্ল্যাটটাতে চলে যেতে পারেন। আরামের দিক দিয়ে ঐ ফ্ল্যাটটি এর থেকে অনেক বেশি কাম্য।

ভাড়াটে ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জিনিসপত্র তেতলার ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করে ফেললেন। লর্ড উইলমোর তখন চারতলার সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বালকের মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন,–“বাবা! বাবা!”

.

১৫.

কয়েক দিন পরের কথা।

সেদিন কাদারুজ তার রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছিল, কোন খদ্দের আসে কি না।

সকাল থেকে একজন খদ্দেরও আসেনি সেদিন। আর আসবেই বা কেন? কী আছে কাদারুজের রেস্তোরাঁয়? ভাল ভাল খাবার ওখানে মোটেই তৈরি হয় না। তাছাড়া মদও বেশি থাকে না ওখানে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথাই চিন্তা করছিল সে। ভিতরের ঘর থেকে তার রুগণা স্ত্রীর খনখনে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–ওগো! কোথায় গেলে?

কাদারুজ উত্তর দিলো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার দিকে চেয়ে। তার দৃষ্টি তখন উদাস…করুণ।

এই সময় হঠাৎ তার নজরে পড়লো একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে তার রেস্তোরাঁর দিকে আসছে। লোকটিকে দেখে ধর্মযাজক বলে মনে হলো কাদারুজের।

একটু পরেই সেই ধর্মযাজক মহাশয় তার সামনে এসে ঘোড়াটাকে দাঁড় করালেন।

জিজ্ঞাসা করেন–কিছু খাবার পাওয়া যাবে কি এখানে?

কাদারুজ খুশি হয়ে উঠলো এই মহামান্য অতিথির আগমনে। মনে মনে ভাবলো, নাঃ! ভগবানের দয়া আছে। বলতে হবে।

মুখে বললো–নিশ্চয়ই, দয়া করে ভিতরে আসুন।

ধর্মযাজক ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তারপর ঘোড়াটাকে বেড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে ভিতরে এলেন।

ধর্মযাজক ভিতরে ঢুকে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন–মঁসিয়ে কাদারুজ নামে কোন লোক এখানে থাকেন কি?

–আমারই নাম কাদারুজ।

 এরপর একটু বিস্মিত হয়েই সে আবার বললো–কিন্তু আমার নাম আপনি জানলেন কি করে ধর্মাত্মন?

–অনেক খোঁজ করে আপনাকে আমি বের করেছি। যাই হোক, সেসব কথা পরে বলাও চলবে, আগে কিছু খাবার আর এক গ্লাস ভাল মদ এনে দিন তো! বড্ড খিদে পেয়ে গেছে আমার।

কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে উঠলো ধর্মযাজকের এই কথায়! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে ঐদিনের যা কিছু ভাল খাবার ছিল প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। এক গ্লাস মদও নিয়ে এলো সে এই মান্যবর অতিথির জন্য।

খেতে খেতে ধর্মযাজক বললেন–এইবার শুনুন, কি জন্য আপনার কাছে এসেছি আমি।

কাদারুজ একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধর্মযাজকের পাশে বসে বললো–বলুন।

ধর্মযাজক বললেন–এডমন্ড দান্তে বলে কোন লোককে আপনি চিনতেন কি?

–চিনতাম বৈকি! এডমন্ড আমার বিশেষ বন্ধু ছিল! সে কোথায় আছে এখন, বেঁচে আছে তো?

–না, সে মারা গেছে।

–মারা গেছে? কবে? কোথায়?

–অনেকদিন আগে, স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারে।

এই কথা শুনে কাদারুজের মুখখানা হঠাৎ যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বললো–বেচারা এডমন্ড! কোন অপরাধ না করেও কারাগারে মৃত্যু হলো তার, অথচ তার শত্রুরা আজ—

এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ চুপ করে গেল সে।

ধর্মযাজক বললেন–’শত্রুরা’ কি বলছিলেন?

অতি কষ্টে আত্মদমন করে কাদারুজ বললো–ও কিছু না। যাই হোক! এডমন্ড সম্বন্ধে কি জানতে চান আমার কাছে?

–জানতে চাই অনেক কথাই। মৃত্যুকালে সে আমাকে একটা অনুরোধ করেছিল। মৃত্যুপথযাত্রীর সেই শেষ অনুরোধ রক্ষা করতেই আমি এসেছি।

–কি অনুরোধ করেছিল সে, জানতে পারি কি?

–নিশ্চয়ই পারেন। সে আমার হাতে একখানা দামি হীরে তুলে দিয়ে অনুরোধ করেছিল, ঐ হীরেখানা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা পাঁচজন লোকের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিতে হবে। এই পাঁচজনের মধ্যে আপনিও একজন।

কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে বললো–হীরে! এডমন্ড হীরে কোথায় পেলো?

ধর্মযাজক হেসে বললেন–সে এক কাহিনী। এডমন্ড মারা যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল সে কথা। সে বলেছিল যে ঐ হীরেখানা ধর্মযাজক ফারিয়া মরবার সময় তাকে দিয়ে যান।

–ধর্মযাজক ফারিয়া! জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ফারিয়ার কথা বলছেন কি আপনি?

–হ্যাঁ, তিনিই। শুনেছেন, বোধ হয়, রাজদ্রোহের অপরাধে তাকে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হীরেখানা এডমন্ডের হাতে দিয়ে যান।

এই বলে পকেট থেকে ছোট একটা চামড়ার বাক্স বের করে সেটাকে খুলে ফেললেন তিনি।

কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, বাক্সের মধ্যে বড় একখণ্ড মিছরির টুকরোর মত একখানা হীরে জ্বলজ্বল করছে।

অত বড় হীরে কাদারুজ জীবনেও দেখেনি, তাই সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–কত দাম হবে হীরেখানার?

–তা পঞ্চাশ হাজার ফ্ৰাঁ তো বটেই!

–কি বললেন? প-ঞ্চা-শ-হা-জা-র-ফ্রাঁ!

ধর্মযাজক বললেন–তা তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। যাই হোক, এইবার শুনুন এডমন্ডের কথা।

কাদারুজের দৃষ্টি তখনও সেই হীরেখানার দিকে। অতি কষ্টে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে এনে সে বললো–বলুন!

ধর্মযাজক বলতে আরম্ভ করলেন–জেলখানার কয়েদীদের মৃত্যুর পূর্বে ধর্মযাজকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। আমারই উপর পড়েছিল তার শেষ যাত্রার পথ সুগম করবার ভার! আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন তার মৃত্যুর আর বেশি দেরি ছিল না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বাইবেল পাঠ শেষ হয়ে গেলে সে আমাকে এই হীরেখানা দিয়ে অনুরোধ করলো–”এই হীরেখানা বিক্রি করে আমার পাঁচজন আত্মীয় বন্ধুর মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেবেন।” এই পাঁচজনের মধ্যে প্রথমেই ছিল লুই দান্তের নাম।

কাদারুজ বলে উঠলো, তিনি আজ আর বেঁচে নেই, শেষ সময়টা খুবই দুঃখকষ্টে কেটেছে তার।

–তার কি কোন অসুখ করেছিল?

ধর্মযাজকের এই প্রশ্নে ম্লান হেসে কাদারুজ বললো–অসুখ! হ্যাঁ, অসুখ একটা কিছু নিশ্চয়ই করেছিল। তবে আমি যতদুর জানি, তিনি না খেতে পেয়ে মারা গেছেন।

–কি বললেন! না খেতে পেয়ে মারা গেছেন তিনি!

ধর্মযাজকের কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন কান্নায় অবরুদ্ধ হয়ে এলো। তার হঠাৎ ঐ রকম ভাবান্তর দেখে কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।

ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!

কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।

আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।

–কী বললেন? মার্সেদেস? হা, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?

–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।

–কাউন্টেস-দ্য-মারকা! কে এই কাউন্ট?

–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।

বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।

ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!

কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।

আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।

–কী বললেন? মার্সেদেস? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?

–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।

–কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ! কে এই কাউন্ট?

–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।

কাদারুজের এই কথায় ধর্মযাজক হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন। তারপর অতি কষ্টে মনের ভাব গোপন করে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন–এই কাউন্টের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ের ইতিহাসটা দয়া করে বলবেন কি?

–বলবো বৈকি? আগেই বলেছি ঐ কাউন্টের নাম ছিল ফার্নান্দ। সে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এডমন্ড বাইরে থাকতেই।

–তারপর?

–মার্সেদেস কিন্তু মোটেই আমল দিত না তাকে। সে মনেপ্রাণে এডমন্ডকেই ভালবাসতো।

কাদারুজের এই কথায় ধমর্যাজক হেসে উঠে বললেন–হ্যাঁ, মনেপ্রাণে ভালবাসার নমুনাই সে দেখিয়েছে বটে!

ধর্মযাজকের এই কথায় আহত হয়ে কাদারুজ বললো–এ কথা বলবেন না ধর্মাত্মন! আমি জানি এডমন্ডকে সে কতখানি ভালবাসতো! এডমন্ডের জেল হবার পর ফার্নান্দ তার কাছে বহুবার বিয়ের প্রস্তাব করে, কিন্তু প্রতিবারই সে ঘৃণার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় তিনটি বৎসর। সে অপেক্ষা করেছিল এডমন্ড ফিরে আসবে এই আশায়। কিন্তু শেষ যখন তার মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায় ফার্নান্দ, তখন সে একেবারে ভেঙে পড়ে।

–মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায়! কী ব্যাপার বলুন তো?

–ঠিকই বলছি। ফার্নান্দ তাকে প্রকিওরার-এর সইকরা একখানা চিঠি দেখায়। ঐ চিঠিতে লেখা ছিল যে এডমন্ড জেলখানায় মারা গেছে।

–তারপর?

–তারপরও ফার্নান্দকে বিয়ে করতে সে চায় না। কিন্তু ক্রমে তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে ওঠে যে, নিতান্ত বেঁচে থাকবার প্রয়োজনেই সে ফার্নান্দকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

–কিন্তু ফার্নান্দ কাউন্ট হলো কি করে?

–সে এক লম্বা ইতিহাস। নেপোলিয়ান যখন এলবা থেকে ফিরে আসেন, সে তখন তাঁর সেনাদলে যোগ দেয়। তারপর ওয়াটারলুর যুদ্ধের কিছুদিন আগে সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার শত্রুপক্ষে যোগ দেয়, ফলে তার পদোন্নতি হয়। ফার্নান্দ জাতিতে ছিল স্পেনিস। স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যখন যুদ্ধ বাধে সেই সময় সে (স্পনের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করে। যে সেনাধ্যক্ষের অধীনে সে কাজ করতো, সে তখন জেনিনার সুলতান আলী পাশার সেনাপতি হয়ে জেনিনায় চলে যায়। ফার্নান্দও যায় তার সঙ্গে। সেখানে গিয়ে ফার্নান্দ ক্রমে সেনাপতির পদ পায়। তারপর গুপ্তঘাতকের হাতে আলী পাশা নিহত হবার পর ফার্নান্দ আবার ফ্রান্সে ফিরে আসে। সেনাপতির পদমর্যাদা এবং প্রচুর অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসার ফলে এখানেও সে রাজসম্মান লাভ করে। রাজা তাকে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।

এই সময় ধর্মযাজক বললেন–কিন্তু এডমন্ডের ইচ্ছা অনুসারে এই ফার্নান্দকেও যে হীরে বিক্রির টাকা থেকে এক ভাগ দিতে হবে! তার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে ফার্নান্দও একজন, আর দুজনের মধ্যে একজন আপনি, আর একজনের নাম ড্যাংলার।

কাদারুজ বললো–কি বললেন! ফার্নান্দ আর ড্যাংলার এডমন্ডের বন্ধু! হায় ভগবান!

ধর্মযাজক আশ্চর্য হয়ে বললেন–আপনি কি তাহলে বলতে চান যে ওরা এডমন্ডের বন্ধু নয়?

কাদারুজ ম্লান হেসে বলে উঠলো–ওরা তার মহাশত্রু। বেচারা এডমন্ড যদি জানতো যে, ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল, তাহলে বোধ হয় ঘৃণায় ওদের নামও সে মুখে আনতো না।

–ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল! বলেন কি মঁসিয়ে কাদারুজ!

–ঠিকই বলছি। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না সে কথা। হয়তো জানতোও আর কেউ যদি আপনি হঠাৎ তার খবর নিতে না এসে পড়তেন।

এই বলে কাদারুজ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলো বহুদিন আগের সেই রেস্তোরাঁর ঘটনা। নিজের কথা গোপন রাখলো না, সে ধর্মযাজকের কাছে।

সব কথা বলা হয়ে গেলে সে বললো–এইবার বুঝলেন তো, কি রকম বন্ধু ওরা এডমন্ডের!

ধমর্যাজক এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলেন সেই জঘন্য চক্রান্তের কাহিনী। সব শুনে তিনি বললেন–ওরা তো বড় ভয়ানক লোক দেখছি। এ সব কথা জানবার পর আমি কিছুতেই এই হীরের অংশ ওদের দিতে পারি না। এ হীরে আমি আপনাকেই দান করলাম। আমার মনে হচ্ছে এডমন্ডের পরলোকগত আত্মা এতে সন্তুষ্টই হবে।

এই বলে তিনি হীরেখানা কাদারুজের সামনে ঠেলে দিলেন। কাদারুজ হীরের বাক্সটা টেনে নিল। আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

তার চোখে জল দেখে ধমর্যাজকের চোখেও জল এসে পড়লো। তিনি বললেন–আমি বুঝতে পারছি, মঁসিয়ে কাদারুজ, এডমন্ডকে আপনি খুবই ভালবাসতেন।

কাদারুজ চোখের জল মুছে বললো–অভাব আর সংসারের চাপে তাকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে সে মৃত্যুর সময়েও ভোলেনি। আমি পাষণ্ড, সব জেনেও আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করিনি; আমি…

কাদারুজের কথায় বাধা দিয়ে ধর্মযাজক বললেন–ও সব কথা তুলে দুঃখ পাবেন মঁসিয়ে। নিয়তির উপর কারো কোন হাত নেই। এই বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন–আচ্ছা, মঁসিয়ে মোরেলের খবর কিছু জানেন কি?

–মঁসিয়ে মোরেলের খবর? তা জানি বৈকি! তিনি আজ দেনায় ডুবতে বসেছেন। আগের দিনের সেই সম্মান ও প্রতিষ্ঠা আজ আর তার নেই। শুনতে পাই, এখানকার মেয়র নাকি অনেক টাকা পান তার কাছে। আমার মনে হয়, মেয়রের কাছে গেলেই তাঁর সম্বন্ধে সব খবর পেয়ে যাবেন।

ধর্মযাজক তখন কাদারুজকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লেন ওখান থেকে।

কাদারুজ দরজা পর্যন্ত এসে তাকে বিদায় দিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *