১০. হিরে খনির পাহারাদার উইপোকা

১০. হিরে খনির পাহারাদার উইপোকা

হ্যাঁ, নিছক উইপোকা। তাদের চক্ষু নামক ইন্দ্রিয়া নেই। কিন্তু নিশ্চয় অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি আছে, নইলে পাথরের মতো কঠিন কংক্রিট ভেদ করে খুঁজে খুঁজে ঠিক পুস্তক নামক সম্পদের সন্ধান পায় কী করে?

আমি, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, বিষমভাবে ললনা-বৈরাগী। তাই আমাকে টলানো যায় না। এমনকী কল্পনার মতো কুহকিনীও আমার মনের আকাশে আর ধমনীর প্রবাহে সুনামি-নৃত্য জাগাতে পারেনি তার কামনা জাগানো চাহনি দিয়ে, তার সবুজ চোখের সেক্সি দ্যুতি দিয়ে, তার পোর্সিলেন প্রতিম ত্রিবর্ণ দিয়ে, সবার ওপরে—তার নিখুঁত ছাঁদের সঠিক স্থানের উচ্চাবচ দেহরেখা দিয়ে…।

ঘুরে ফিরে কল্পনা চলে এল উইপোকা কাহিনি বলতে গিয়ে। কেন এল? হে পাঠক এবং পাঠিকা, সর্বত্র সঞ্চার করবার ক্ষমতা আপনাদের আছে, আপনারা। অবশ্যই অবহিত হয়ে গেছেন অকস্মাৎ মনের কোণ থেকে কল্পনা কেন বেরিয়ে এল উইপোকারা মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠতেই?

হ্যাঁ, মশায় হ্যাঁ, উইদের মতোই ওর যেন একটা অতীন্দ্রিয় নয়ন আছে। কার পিছনে ওর ওই সবুজ চোখের দ্যুতি লেলিয়ে দিলে হীরকদ্যুতির খনি-খোঁজ পাওয়া যাবে, ও তা জানে। এটা ওর একটা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা। তাই ঠিক বেছে বেছে, বহু প্রলুব্ধ পুরুষকে বাতিল করে পাকড়াও করেছিল রবি রে’কে…

রবি রে…হির পাগল রবি রে…উইপোকাদের সাম্রাজ্য যে অতুলনীয় হীরক-ভাণ্ডার মানুষের ধারণার বাইরে রেখে দেওয়ার জন্যে, সে খবর সঠিক সময়ে এসে গেছিল ওর কাছে…।

শুধু কি উই…কঙ্করাকীর্ণ সেই পার্বত্য এলাকায় থুক খুক করছে অস্ত্র পাহাড়ি কঁকড়া বিছে…তারা লুকিয়ে থাকে পাহাড়ের অন্দরে কন্দরে…কিন্তু পিল পিল করে বেরিয়ে আসে মানুষের গন্ধ পেলেই আনেক…অনেক বছর আগে পেশোয়ারের পাষণ্ডরা প্রাণদণ্ড দিতে গ্রহণ করেছিল এহেন নিষ্ঠুর উল্লাসের পন্থা…গর্দান না নিয়ে শুধু গর্দান আর মুণ্ডটুকু বের করে রেখে বাকি শরীরটা পুঁতে রাখত মাটির মধ্যে… পিল পিল করে ধেয়ে যেত লোহিত বর্ণের বিভীষিকা জাগানো কঁকড়া বিছে…

বীভৎসর বর্ণনায় আর যেতে চাই না। ফিরে আসা যাক উইপোকা রক্ষিত হীরক ভাণ্ডারের রোমাঞ্চ জাগানো কাহিনিতে।

 

ফিকে সবুজ রঙের পাথর-পাঁচিল মাথা তুলে খাড়া ছিল পথের দু’পাশে…পাহাড় দুর্গের এমন রঙের প্রাচীর স্বয়ং প্রকৃতি নির্মাণ করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে…রবি রে আর মাহী বেঞ্জামিনের ট্রাক নাচতে নাচতে ধেয়ে যাচ্ছিল এহেন উপল সমাকীর্ণ পথের ওপর দিয়ে…

মাহী এই অভিযানের পথপ্রদর্শক এবং নেতা। তার একটা গালভরা পদও আছে—মিনারেল রিসোর্স ম্যানেজার…সরল বাংলায় যার অর্থ-রত্নসম্পদ ম্যানেজার। খনিজ সম্পদ বললে যথার্থ হয়। কিন্তু এ খনিতে আছে যে শুধু রত্ন।

রবি রে’র সঙ্গে তার দোস্তি যে সব কারণে, তার সবিস্তার বর্ণনা এ কাহিনিতে নিষ্প্রয়োজন—অতএব তা উহ্য থাকুক।

ওরা চলেছে জবানেঙ্গ রত্ন-গহুরের একদম তলদেশ অভিমুখে। হ্যাঁ, ধরণীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্নময় খনি এই জবানেঙ্গ খনি। যার ভাণ্ডারে থরে থরে সঞ্চিত রয়েছে অতুলনীয় হীরক সম্পদ-মা-পৃথিবী বানিয়েছেন বহু সংহারক তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে…সযত্নে সঞ্চয় করে রেখেছেন নিজের গভীর গোপন জঠরে…

কিন্তু ধূর্ত মানুষ সন্ধান পেয়েছে সেই জঠর-গহ্বরের, উইয়ের দৌলতে…অযুত নিযুত বছর ধরে ছোট ছোট ডালিম দানার মতো বজ্র মণিদের জুড়ে জুড়ে বৃহৎ সুবৃহৎ প্রকাণ্ড মণি বানিয়েছেন প্রকৃতি-জহুরি, লোহা-টাইটানিয়াম-অক্সিজেনের সমাহারে নির্মাণ করে গেছেন কৃষ্ণকায় খনিজ পাথর ইলমেনাইট-যে সবের মধ্যে গেঁথে চোথে লুকিয়ে রেখেছেন হিরে…হিরে…হিরে…পুঁতে রেখেছেন একশো বিশ ফুট গভীরের বালি আর পাথরের মধ্যে…লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কল্পনাতীত সেই ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের দিকে ধেয়ে চলেছে হীরক-অন্বেষীদের এই ট্রাক…

হীরক উত্তোলন অতিশয় ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। ফি বছরে নব্বই বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করে যেতে হয় এই খনির পিছনে। এই খনি, সেই সঙ্গে আবও দু’টো খনির সন্ধান পাওয়া গেছে প্রথম কিমবারলাইট পাইপ আবিষ্কৃত হওয়ার পর… ১৯৭৩ সালে…তারপর থেকেই আফ্রিকার মানুষদের কপাল ফিরে গেছে…তাদের জীবনযাপনের মান এখন চোখ টাটানোর মতো।

স্রেফ হীরক ভাণ্ডারের দৌলতে! হিরে-নিহিত আগ্নেয়-পাথর কিমবারলাইট সেই ভাণ্ডার…হীরক ভাণ্ডার…দক্ষিণ আফ্রিকার কিমবারলি অঞ্চলে যে হীরক শিরার আবিষ্কার ঘটে সর্বপ্রথম।

 

ট্রাক থেকে নেমে খনির তলদেশে পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল রবি রে—

অবিরাম বিস্ময়ের চোটপাট আঘাতে যে কি না বিস্ময় কি বস্তু, তা একেবারেই ভুলে মেরে দিয়েছিল। গহ্বরের দেওয়াল হাজার ফুট উঠে গিয়ে ছাদ নির্মাণ করেছে অনেক উঁচুতে। হেঁট হয়ে মেঝে পরখ করবার অছিলায় যখন বুট জুতোর ফিতে বাঁধছিল রবি রে, মাহী গর্জে উঠেছে কানের কাছে—খবরদার! মেঝেতে হাত দেবেন না।

কেন? ধরণী স্পর্শ তে নিষিদ্ধ নয় কোনও দেশেই?

মানুষ মাত্রই একদিন না একদিন ধরণীর ধুলোয় মিশে যায়, তাহলে ধরণী স্পর্শ নিষিদ্ধ হতে যাবে কেন?

প্রশ্নটা রবি রে’র দুই চোখে নৃত্য করে ওঠার আগেই ‘কেন’র উত্তর জুগিয়ে গেছিল হীরক-প্রহরীদের সর্দার মাহী বেঞ্জামিন।

পাথরের এই সমুদ্রে এক পিস হিরে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। পঞ্চাশ লক্ষ পিস সমান সাইজের নুড়ি ঘাঁটলে পাবে এক পিস হিরে। তা সত্ত্বেও সিকিউরিটি বড় সজাগ। রিমোট ক্যামেরা নজর রাখছে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে। আসবার সময়ে তোমাকে যতটা সার্চ করা হয়েছে, এখান থেকে বেরোনোর সময়ে তার চেয়ে বহুগুণ সার্চিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এক রতি হিরে নিয়েও এ তল্লাট থেকে বেরোনোর হিম্মৎ কারও নেই। পুরো কমপ্লেক্সটাকে কিভাবে উঁচু বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, তা তো নিজের চোখেই দেখে এলে আসবার সময়ে।

হেঁয়ালির ঢঙে বলেছিল রবি রে, কেন, বন্ধু, কেন? অনেক সিকিউরিটি পেরিয়ে এলাম-চোর যে নই, ওপরওলা তা জানে। তবে কেন এত অবিশ্বাস, এত অপমান?

কারণ, হিরে পেলেই মানুষ মাত্রই তা কাছে রাখে। এই স্বভাব রয়েছে যে প্রতিটি মানুষের মধ্যে। হিরে হাতছাড়া কেউ করে না…কেউ করে না।

রবি রে কি তা জানে না? হিরের টানকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হিরের দামকে আকাশছোঁয়া করে দিয়ে–দামের এহেন উত্থান কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি করা। আসল দাম যা হওয়া উচিত, নকল দাম তার চেয়ে ঢের বেশি করে রাখা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে—হীরক বাণিজ্যের ঘুঘু বণিকরা জানে, কীভাবে হিরে লোভীদের চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়ে টাক থেকে টাকা খসিয়ে আনতে হয়।

এবং সেটা হয় কিভাবে?

ডিম্যাণ্ড আর সাপ্লাইয়ের মধ্যে ফারাক রেখে দিয়ে। যে জিনিস যত কম পাওয়া যায়, সেই জিনিসের জন্যে মন বেশি লালায়িত হয়। সিম্পল থিওরি।

রবি রে কি তা জানে না? হিরে বাণিজ্যের অবিশ্বাস্য কেনাবেচার খবর-টবর নিয়েই তো অনেক কলকাঠি নেড়ে ঢুকতে পেরেছে পাতাল প্রদেশের এই হীরক ভাণ্ডারে। খনি থেকে তোলা হিরের থলি রাখা হয় মাত্র একশো পঁচিশ জন হীরক-সওদাগরের সামনে। তামাম দুনিয়া ঘেঁচে বেছে নেওয়া হয় এই একশো পঁচিশজনকে–অনেক রকমভাবে হুঁশিয়ার হয়ে। হিরে বেচা আর আলু-পটল বেচা, এক জিনিস নয়। হিরে যে বেচবে, সে খুঁটিয়ে খবর নেয় হিরে যে কিনবে–তার সম্পর্কে। তারপর, তাদের জড়ো করা হয় বছরে একবার—দু’জায়গায়-লণ্ডনে আর জোহান্নে সবার্গে। তারপর, হলুদ রঙের একটা প্লাস্টিক ব্রিফকেস আনা হয় তাদের সামনে, যার মধ্যে থাকে একটা প্লাস্টিক জিপ ব্যাগ। হিরে ভর্তি। আকাটা হিরে।

উপুড় করে দেওয়া হয় একশো পঁচিশ জোড়া হীরক চক্ষুর সামনে। হিরে দেখে তারা নয়ন সার্থক করবে, মনে মনে দাম যাচাই করে নেবে, কিন্তু মুখে দাম হাঁকতে পারবে না। কেনাবেচার হাটে এ-এক কিম্ভুত ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থার অন্যথা হয়নি আজও।

কী সেই ব্যবস্থা?

দাম হাঁকবে হিরের মালিক। খনি ছেচে হিরে তুলে এনেছে যে, সে। হিরে নিতে হবে সেই দামেই। দরদামের কারবার নেই। নিতে হয় নাও, নইলে যাও! এই নিয়ম শিথিল হয় শুধু একটি ক্ষেত্রে। বড় হিরের ক্ষেত্রে। যে হীরক-খণ্ডদের ওজন ১০.৮ ক্যারাটের চেয়ে বেশি।

 

থ’ হয়ে শুনছিলাম হীরক-বাণিজ্যের থরথর কাহিনি। সকৌতুকে আমার মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হিরে-ধারালো গলায় বলেছিল রবি রে, কি রে ইন্দ্র, চোখ যে ছানাবড়া করে ফেললি!

স্রষ্টানামক ভদ্রলোক আমার চোখেও নাকি দু’খণ্ড কমল হিরে বসিয়ে দিয়েছেন-আমাকে নিয়ে আবোল-তাবোল গল্প লেখবার সময়ে বন্ধুর মৃগাঙ্ক প্রায়শ সেই উপমা টেনে আনে। আর, ওর বউ, দাপুটে কবিতা বউদি, তো যখন-তখন পিছনে লাগে আমার এই হিরে চোখের জন্যে। বলে, জলুস দিয়ে। মেয়ে টানা হচ্ছে, আবার যাচাই করাও হচ্ছে-কাচ, না, পাথর!

আমি, সেই ইন্দ্রনাথ রুদ্র, মূক হয়ে রইলাম হীরক সওদাগরি বৃত্তান্ত শুনে।

তারপর, বোধহয় মিনমিন করেই, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু এই প্রথা যারা ভঙ্গ করে? হেঁকে হেঁকে দাম তোলে?

একশো পঁচিশ জনকে একসঙ্গে না ডেকে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। এক-একজনকে ডেকে নিজের জিনিস বেচা অন্যায় তো নয়।

ইন্দ্র, হীরক বাণিজ্যে সেটা ঘোরতর অন্যায়। অলিখিত এই কানুন যে ভাঙে, অতিলোভী সেই হীরক-সওদাগরের কপালে লেখা থাকে অনেক শাস্তি।

কীভাবে?

হাতে মেরে নয়, ভাতে মেরে।

কীভাবে? কীভাবে? সেটা হয় কীভাবে?

একটা পন্থা হলো, বাছাই করা হিরের স্রোতে বাজার ভাসিয়ে দিয়ে।

যাতে দর ভোলা হিরের দর পড়ে যায়?

হ্যাঁ, বন্ধু, হ্যাঁ। অভিনব পন্থা। হিরের দাম ফেলে দিয়ে হিরে লোভীর সর্বনাশ করে দেওয়া।

থ’ হয়ে গেছিলাম শাস্তি দেওয়ার পন্থা-প্রকরণ শুনে। হিরে একটা সর্বনাশা পাথর। হিরের মধ্যে আছে ধরিত্রীর অভিশাপ। আমার মূল কাহিনি তার প্রমাণ। কলম ধরেছি তো সেই কথা বলবার জন্যেই।

অনিক্স পাথরের ডিমের মধ্যে ছিল সেই অভিশাপ। যে অভিশাপকে টেনে এনেছিল সবুজ চক্ষু কল্পনা চিটনিস। গায়েব হয়েছিল তার চোখের মণি-পেটের ছেলে–সোমনাথ।

বাজারে হিরে পাথরের ঢল নামিয়ে দাম ফেলে দেওয়ার ফিকির আমাকে চমৎকৃত করেছিল বিলক্ষণ। তাই প্রশ্নাকারে ঔৎসুক্য ঠিকরে এসেছিল মুখ দিয়ে

রবি, এত হিরে আসত কোত্থেকে? কার হিরের গুদাম থেকে?

ঈষৎ হাস্য করে জবাব দিয়েছিল রবি—ডি বিয়ার্স নামক এক হীরক বণিকের কিংবদন্তীসম একটা হিরের গুদোম আছে লণ্ডনের হেড কোয়ার্টারে। কখনও-সখনও হিরের ঢল নামানো হতো এই গুদাম থেকে বাছাই করা হিরের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো হীরক-মার্কেট—কেঁপে যেত দুনিয়া।

শুধু একটা গুদোম থেকে? আমতা আমতা করেছিলাম আমি—তা কি করে হয়? লণ্ডনের এত ক্ষমতা?

ইন্দ্র, ইংরেজরা জাত বণিক! বণিকে মানদণ্ড—

ছেঁদো কথা রাখ। প্রতিদ্বন্দ্বী দড়ায়নি? পালটা হিরে গুদোম?

পয়েন্টে চলে এসেছিস। হ্যাঁ, দাঁড়িয়েছে–কালক্রমে। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কানাডায়। বিশেষ করে ইজরায়েলের এক জহুরি-চক্র তাসখন্দ থেকে হিরে-ভেলকি দেখিয়ে কোণঠাসা করে এনেছে লণ্ডনের হিরে জাদুকরদের। রুশ হিরের নিয়ন্ত্রণ এখন তাসখন্দের মুঠোয়।

রবি, আমার মস্তক ঘূর্ণিত হচ্ছে।

বেচারা বাঙালি। গোয়েন্দাগিরিই তোর দৌড়। হিরে-দৌড়ে পাল্লা দেওয়া তোর কম্মো নয়। মাই ডিয়াব ডিটেকটিভ, হিবের সঙ্গে সোনা আর রূপোর কোনও তুলনাই হয় না। বাজার এক্কেবারে আলাদা। এক দামে হিলে কিনে সেই জহুরির কাছেই সেই একই দামে হিরে বেচা যায় না, জহুরি তার প্রফিট রাখবেই। সোনার দোকানে ঝোলে দৈনিক সোনার দাম, দৈনিক হিরের দাম ঝোলে না কোথাও। সেই দাম থাকে হুরির পেটের মধ্যে। ঝোপ বুঝে কোপ মারে। হিরে সেই কারণেই স্রেফ অমূল্য।

অ-মূল্য!

আজ্ঞে। ইরান বিপ্লবের দুঃসময়ে মুহূর্তের নোটিশে দেশ ছেড়ে পয়াকার দেওয়ার সময়ে এক ব্যক্তি কি করেছিলেন? বাড়ি বিক্রি করবার সময়ও পাননি, ব্যাঙ্কে যাওয়ার সময়ও ছিল না—সঙ্গে নিয়েছিলেন শুধু পাথর ভর্তি ব্যাগ।

হিরে পাথর?

হ্যাঁ। যার দাম তিরিশ মিলিয়ন ডলার।

আমি নির্বাক থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলাম। তিরিশ মিলিয়ন ডলার মানে যে কত কোটি রজত মুদ্রা, সে হিসেব সেই মুহূর্তে ভোঁ ভোঁ মাথায় আসেনি।

আমার হতভম্ব মুখভাব তারিয়ে তারিয়ে নিরীক্ষণ করে নিয়ে মুচকি হেসে বলেছিল হিরে-ধুরন্ধর রবি রে, হিরে এক রকমের কারেন্সি। পত্রমুদ্রা, মানে নোট, রজতমুদ্রা, স্বর্ণমুদ্রার মতো হিরেও একটা মুদ্রা। এ মুদ্রার দাম নির্দিষ্ট হয় জহুরির চাতুরির দৌলতে-গভর্নমেন্টের কোনও হাত নেই হিরের দাম বেঁধে দেওয়ার। হে বন্ধু, তাই মনে রেখ, যার হিরে আছে, তার সব আছে। দুনিয়া তার মুঠোয়। ইণ্টারন্যাশনাল কর্জ, দেনা শোধ, ঘুষ দেওয়া, অস্ত্রশস্ত্র কেনা—এই ধরনের বহু ব্যাপারে অন্য যে-কোনও মুদ্রার চেয়ে বেশি কাজ দেয় হিরে-মুদ্রা।

আমার চক্ষুযুগল নিশ্চয় বিলক্ষণ বিস্ফারিত হয়ে গেছিল হীরক-কীর্তন শুনতে শুনতে। দুই মণিকায় কৌতুক নৃত্য জাগ্রত করে বিষম আমোদে তা নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিল হিরে পাটোয়ার রবি রে।

কিন্তু রবি চলে ডালে ডালে, আমি চলি শিরায় শিরায়। মৃগাঙ্ক লিখিত মদীয় কাহিনি সমুচয়ে নিশ্চয় আমার এই মূল মস্তিষ্ক ক্ষমতাটা যথাযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। যতই ছাইপাশ লিখুক না কেন মৃগাঙ্ক, চরিত্রের মূল সুর ও ঠিক ধরতে পারে। আমি যে কি মাল, তা কিন্তু জানা ছিল না রবি রে’র কথার স্রোতে ওকে ভাসিয়ে রেখে, কিছুমাত্র বুঝতে না দিয়ে, কথার উপলখণ্ডে ঠোক্কর খাইয়ে নিয়ে এসেছি এমন একটা বিন্দুতে, যা এই হিরে নিয়ে তথ্যভিত্তিক রহস্য কাহিনির মূল উপপাদ্য…

কেন্দ্রবিন্দু।

আমতা আমতা ঢঙে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রবি, আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবর রাখি না।

সবেগে মস্তিষ্ক চালনা করে রবি বলেছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোর মুরোদ এই বেঙ্গলে-যত্তোসব ছিচকে কেস নিয়ে মস্তানি দেখিয়ে–

নিমেষে চলে এলাম সার কথায়। বললাম, ভিজে বেড়ালের মতো, একট। গুজব কানে এসেছে, উদ্ভট গুজব…স্রেফ গুজব…পাকা খবর নয়…আনকনফার্মড রিপোর্ট।

ঝেড়ে কাশলেই তো হয়। তেলাচ্ছিস কেন?

চতুর এবং চতুর্মুখ রবি রে বুঝতেই পারেনি ওটা আমার অভিনয়। সাধে কি কবিতা বউদি আমার পেছনে লাগে। মিনমিন করে বলেছিলাম, পাছে অপযশ করা হয়ে যায়, তাই কাউকে বলতে পারি না…সাংবাদিকদের কানেও কথাটা গেছে কি না জানি না…

অসহিষ্ণু স্বরে বলেছিল রবি রে, কথাটা কী?

ইয়ে, মানে, ওসামা বিন লাদেনের টেররিস্ট অরগানাইজেশন–

আল কায়েদা?

হ্যাঁ, হা, এরা নাকি এই অপারেশনে আছে? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের মার্চ, ২০০২ সংখ্যার ২০ পৃষ্ঠায় ২০ এই সংবাদের আভাষ দেওয়া হয়েছে।

অমনি সতর্ক হয়ে গেছিল বকমবাজ রবি রে। ওম হয়েছিল মিনিটখানেক। তারপর বলেছিল হুঁশিয়ার স্বরে—ইন্দ্র, তুই আদার ব্যাপারি, আমি হিরের ব্যাপারি—ওষুধের জগত থেকে হিরের জগতে চলে এসেছি স্রেফ জ্ঞানবান হওয়ার জন্যে…যে জ্ঞান আখেরে কাজ দেবে…কিন্তু গুপ্ত সংগঠনের ব্যাপার-ট্যাপার—

গুপ্তই থাকুক, ঝটিতি বলেছিলাম আমি। কেন না আমার যা জানবার, তা জানা হয়ে গেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *