১০. পরিশেষে

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

‘গুপ্ত মহলে’ নতুন ঝঞ্ঝাট, খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ডুসেলের সঙ্গে ফ্রাঙ্ক দম্পতির লেগেছে মাখনের ভাগ নিয়ে। ডুসেল ঘাট মেনেছেন। মিসেস ফ্রাঙ্কের সঙ্গে এখন ওঁর খুব ভাব, ফষ্টিনষ্টি, চুমো খাওয়া এবং অমায়িক হাসিঠাট্টা।

ডুসেল স্ত্রীলোকের অভাব অনুভব করতে শুরু করেছেন। পঞ্চম বাহিনী রোম দখল করেছে। দুই পক্ষেরই স্থল ও বিমান বাহিনী শহরটিতে ভাঙচুর করা থেকে নিবৃত্ত হয়েছে এবং তার ফলে শহর অক্ষত আছে। সব্জি আর আল শেষ হয়ে এসেছে। আবহাওয়া বিশ্রী। ফরাসী উপকূলে আর পা দে কালেতে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ হচ্ছে।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ৬ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

ইংরেজি খবরে বলা হল, ‘আজ ডি-ডে’ ঠিকই, ‘আজ সেই দিনটিই বটে। আক্রমণ শুরু।

আজ সকাল আটটায় ইংরেজরা খবর দিল–কালে বুলোন, লে হাভরে, আর শেরবুর্গ, সেই সঙ্গে পা দে কালেতে (যেমন চলছিল) প্রচণ্ড বোমা ফেলা হয়েছে।

তাছাড়া নিরাপত্তার খাতিরে সব অধিকৃত রাজ্যে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে উপকূলবর্তী সমস্ত অধিবাসীকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের ব্যাপারে তারা যেন তৈরি থাকেন। হলে, ইংজেররা এক ঘন্টা আগে ওপর থেকে বিজ্ঞপ্তি ফেলবেন।

জার্মানদের খবর অনুযায়ী, ইংরেজ ছত্রীবাহিনী ফরাসী উপকূলে অবতরণ করেছে, ইংরেজদের অবতরণকারী জাহাজের সঙ্গে জার্মান নৌবহরের লড়াই চলছে–বি.বি.সি. থেকে বলা হয়েছে।

সকাল নয়টায় ঘরোয়া প্রাতঃরাশে এই বিষয়ে আমাদের কথা হল–এটা কি দুই বছর আগে দিয়েপের মত নিছক একটা পরীক্ষামূলক অবতরণ?

দশটায় ইংল্যাণ্ড থেকে জার্মান, ডাচ, ফরাসী এবং অন্যান্য ভাষায় বলা হল–’আক্রমন। শুরু করা হল!’–তার মানে, এটা আসল আক্রমণ। এগারোটায় ইংল্যাণ্ড থেকে জার্মান ভাষায় প্রচার করা হল, প্রধান সেনাপতি জেনারেল ডোয়াইট আইজনহাওয়ার ভাষণ দিলেন।

ইংল্যাণ্ড থেকে বারোটায় ইংরেজি খবরে বলা হল–’আজই সেই দিন।’ জেনারেল আইজুহাওয়ার ফরাসী জনগণের উদ্দেশে বললেন, এবার তুমুল লড়াই হবে, কিন্তু তারপর। আসবে জয়। ১৯৪৪ সাল পুরোপুরি বিজয়ের বছর; শুভমতু।

ইংল্যাণ্ড থেকে একটায় ইংরেজিতে খবর (অনুবাদ)–১১,০০০ বিমান প্রস্তুত, এবং না থেমে যাচ্ছে আর আসছে, উপকূলে অবতরণকারী সৈন্য এবং ব্যুহের পেছন থেকে আক্রমণ চলছে; ৪০০০ অবতরণকারী জাহাজ, তার সঙ্গে ছোট ছোট জলযান–তাতে করে শেরবুর্গ আর লে হারের মধ্যে অবিরত অবতরণকারী সৈন্য আর মালপত্র নামাচ্ছে। ইংরেজ আর মার্কিন সৈন্যরা ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

জেরব্রাণ্ডি, বেলজিয়ামের প্রধান মন্ত্রী, নরওয়ের রাজা হাকন, ফ্রান্সের দে-গোল, ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং শেষে, কিন্তু সর্বোপরি, চার্চিল।

‘গুপ্ত মহলে খুব চাঞ্চল্য। এতদিন ধরে যা নিয়ে এত কথা হয়েছে, সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি, যা এখনও কিন্তু অবিশ্বাস্য, বড় বেশি কল্পিত বলে মনে হয়–সেই মুক্তি সত্যিই কি আসবে? ১৯৪৪ সালেই কি আমাদের জয়ের আশা পূর্ণ হবে?

এখনও জানি না, তবে আমাদের মনে আবার আশা জেগেছে। মনে নতুন বল পেয়ে আমরা শরীরে আবার শক্তি পাচ্ছি।

সব ভয়, সব কষ্ট আর লাঞ্ছনার সামনে আমাদের সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াতে হবে; তার জন্যে এখন আমাদের ধীর-স্থির আর অবিচলিত থাকতে হবে। এখন আমাদের আরও বেশি দাঁতে দাঁত দিয়ে থেকে কান্না চেপে রাখতে হবে। ফ্রান্স, রাশিয়া, ইত্যাদি আর জার্মানিও হাউমাউ করে সকলে তাদের আর্তির কথা জানাতে পারে শুধু আমরাই এখনও সে অধিকার। থেকে বঞ্চিত।

জানো কিটি, এই আক্রমণের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল এই যে, আমি মনে-প্রাণে বুঝছি বন্ধুরা আসছে। ঐ ভয়ঙ্কর জার্মানরা এতদিন এমন ভাবে আমাদের ওপর অত্যাচার করেছে, আমাদের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে রেখেছে যে, আজ বন্ধুদের কথা আর মুক্তির কথা ভাবতে পেরে মনের মধ্যে ভরসা জাগছে।

এটা আর এখন ইহুদিদের ব্যাপার থাকছে না; হল্যাণ্ড আর সারা ইউরোপের ভাগ্য আজ এর সঙ্গে জড়িত। মারগট বলছে, আমি হয়ত এই সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরেই আবার ইস্কুলে ফিরে যেতে পারব।

তোমার আনা।

পুনশ্চঃ আমি তোমাকে যখনই যা নতুন খবর হবে জানাব।

.

শুক্রবার, ৯ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আক্রমণের ব্যাপারে জবর খবর। মিত্রপক্ষ ফরাসী উপকূলের একটি ছোট গ্রাম বাইয়ু দখল করেছে; এখন তারা কায়েন দখল করার জন্যে লড়ছে।

এটা পরিষ্কার যে, যেখানে শেরবুর্গ অবস্থিত সেই উপদ্বীপটি তারা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় আছে। রোজ সন্ধ্যেবেলায় সামরিক সংবাদদাতারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর দেন; সৈনবাহিনীর লোকদের কী কী অসুবিধে, তাদের সাহসিকতা আর উৎসাহ উদ্দীপনা সম্পর্কে তারা বলেন।

শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না এমন সব খবর তারা যোগাড় করেন। জখম হয়ে যারা ইংল্যাণ্ডে ফিরেছে তাদেরও কেউ কেউ রেডিওতে বলেছে। আবহাওয়া খারাপ হওয়া সত্বেও বিমানবাহিনীরা সারাক্ষণ আকাশে টহল দিচ্ছে। বি.সি.সি-র খবরে শুনলাম আক্রমণ শুরু হওয়ার দিন সৈন্যদের সঙ্গে চার্চিল অবতরণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আইজহাওয়ার আর অন্য জেনারেলরা ওঁকে নিবৃত্ত করেন। বয়স সত্তর তো হবেই–বলিহারি সাহস এখনও লোকটার।

এখানে উৎসাহের ধার এখন একটু কমে এসেছে; তবু আমরা সবাই আশা করছি যে এ বছরের শেষাশেষি যুদ্ধ মিটে যাবে।

ওর কাছাকাছি সময়ই হবে। মিসেস ফান ডানের কুঁই কুঁই শুনে শুনে কান ঝালাপালা; কবে আক্রমণ হবে এই বলে বলে মাথা তো আমাদের এতদিন খারাপ করে দিয়েছেন, এবার শুরু করেছেন কী খারাপ আবহাওয়া বলে সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যান করে আমাদের মাথার পোকা বের করে ফেলা। ওঁকে যদি এক বালতি ঠাণ্ডা পানির মধ্যে বসিয়ে মক্কায় তুলে রেখে দিয়ে আসা যেত তো ভালো হত।

ফান ডান আর পেটার ছাড়া গোটা ‘গুপ্ত মহল’ তিন খণ্ডের হাঙ্গেরীয় পালা’ পড়ে ফেলেছে। এই বইটি হল সুরকার, কলাবিৎ এবং শিশু বয়সেই বিস্ময়কর প্রতিভা ফাস্। লিস্ৎ-এর জীবন ইতিহাস।

বইটা খুবই সুপাঠ্য, কিন্তু আমার মতে এতে স্ত্রীলোকদের কথা একটু বেশি। লিস্ৎ শুধু যে শ্রেষ্ঠ আর প্রসিদ্ধতম পিয়ানোবাদক ছিলেন তাই নয়, সেই সঙ্গে ছিলেন সবচেয়ে রমণীমোহন ব্যক্তি সত্তর বছর বয়স অবধি। তিনি সহবাস করেছেন রাজকুমারী মারি দাওড়, মহারাজকুমারী ক্যারোলিন সাইন-ভিটগেনস্টাইন, নর্তকী লোলা মোনেস, পিয়ানো বাজিয়ে আগৃনেস কিংওয়ার্থ, পিয়ানো-বাজিয়ে সোফি সেন্টার, মহারাজকুমারী ও ইয়ানিনা, লেডি ওল্গা মেয়েনড, অভিনেত্রী লিলা কী যেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি এতজনের সঙ্গে যে বলে শেষ করা যাবে না। বইয়ের যেসব অংশে সঙ্গীত আর শিল্পের আলোচনা আছে, সে জায়গাগুলো অনেক বেশি সুন্দর। বইতে যাদের উল্লেখ আছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন শুমান, ক্লারা ভীক, হেক্টর বেৰ্লিওৎ য়োহানেস ব্রাজু, বীঠোফেন, গোআকিম, রিভার্ড ভাগনার হান্স ফনবুলো, আন্তন রবিশতিন, ফ্লাদারিক শোপা, ভিক্তর উগো, ওনোরা দে বালজাক, হিলার, হুমেল, চেনি, রসিলি, চেরুবিনি, পাগানিনি, মেসেজোন, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

লিৎ মানুষটি ছিলেন খুব ভালো, খুব দিলদরাজ লোক। নিজের সম্পর্কে ছিলেন বিনম্র, যদিও তাঁর ছিল অত্যধিক দেমাগ। তার কাছে যে আসত তাকেই তিনি সাহায্য করতেন। শিল্পকলা ছিল তার প্রাণ, কনিয়াক আর স্ত্রীলোক বলতে তিনি পাগল, কারো চোখের পানি সহ্য করতে পারতেন না, বিলক্ষণ ভদ্রলোক ছিলেন, কাউকে কোনো উপকার করতে উনি অরাজী হতেন না, টাকাপয়সার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করতেন না, ভালবাসতেন ধর্মীয় স্বাধীনতা আর বিশ্বমুক্তি।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি, আরও একটা জন্মদিন চলে গেল। কাজেই এখন আমি পঞ্চদশী। বেশ অনেক উপহার পেলাম। প্ৰেঙারের চারুকলার ইতিহাসের পুরো পাঁচ খণ্ড, একপ্রস্থ অন্তর্বাস, একটি রুমাল, দুই বোতল দই, গুড়-আদায় তৈরি মশলাদার কেক, আর মা-মণি ও বাপির কাছ থেকে এটি উদ্ভিদতত্ত্বের বই, মারগটের কাছ থেকে জোড়া ব্রেসলেট, ফান ডানদের কাছ থেকে একটা বই, ডুসেলের কাছ থেকে নকুলদানা, মিপ আর এলির কাছ থেকে টফি আর খাতা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ক্রালারের দেওয়া বই ‘মারিয়া তেরেসা’ এবং তিন টুকরো মালাইদার পনীর। পেটারের কাছ থেকে একগুচ্ছ সুন্দর স্বর্ণালী ঝুমকো ফুল; বেচারা অনেক চেষ্টা করেছিল আর কিছু দিতে, কিন্তু ওর কপাল খারাপ।

অতি জঘন্য আবহাওয়া, থেকে থেকে দমকা বাতাস, ঝমঝম করে বৃষ্টি, ফুলে ফুলে ওঠা সমুদ্র–এ সত্ত্বেও আক্রমণ সংক্রান্ত খবর এখনও খুব ভালো।

কাল চার্চিল, স্মার্টস, আইজুহাওয়ার আর আর্নল্ড ফ্রান্সের অধিকৃত আর মুক্ত গ্রামগুলো দেখতে গিয়েছিলেন। চার্চিল যে টর্পেডো-বোটে ছিলেন তা থেকে উপকূলে গোলা ছোড়া হয়।

ওঁকে মনে হয় আরও অনেকের মতো উনি ভয় কাকে বলে জানেন না–সত্যি, দেখে আমার হিংসে হয়। এই গুপ্ত ঘরে থেকে আমাদের পক্ষে বোঝ শক্ত, বাইরে লোকে এই খবরটাকে কি ভাবে নিয়েছে।

লোকে নিঃসন্দেহে এতে খুশি যে, দীর্ঘসূত্রী(?) ইংরেজরা আস্তিন গুটিয়ে এবার কিছু একটা কাজে নেমে পড়েছে। যেসব ডাচ এখনও ইংরেজদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ইংল্যাণ্ডকে আর তার বৃদ্ধদের সরকারকে উপহাস করে, ইংরেজদের ভীতুর জাত বলে, অথচ জার্মানদের ঘৃণা করে এবার তাদের টনক নড়া উচিত। হয়ত এই ঘটনায় এবার তাদের কানে কিছুটা পানি ঢুকবে।

গত দুই মাসের ওপর আমার ঋতু বন্ধ ছিল; অবশেষে শনিবার থেকে আবার তা শুরু হয়েছে। এত সব ব্যাট আর অশান্তির মধ্যেও আমাকে যে আর হাতশায় ফেলেনি, তাতেই আমার আনন্দ।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ১৪ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এত ইচ্ছে আর এত রকমের ভাবনা, অভিযোগ আর তিরস্কার আমার মাথায় তাড়া করে ফিরছে। লোকে আমাকে যতটা মনে করে আমি সত্যিই ততটা দাম্ভিক নই। নিজের দোষত্রুটিগুলো আমি অন্যদের চেয়ে ঢের ভালো করে জানি। তবে তফাত এই, আমি এও জানি যে, আমি ভালো হতে চাই, আমি নিজেকে উন্নত করব এবং ইতিমধ্যে আমার দোষত্রুটি অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।

আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেন তাহলে প্রত্যেকে এখনও ধরে নেয় যে, আমি সাংঘাতিক ঝানু আর টাটা? আমি সত্যিই কি ঝানু? নাকি আমি সত্যিই তাই, আর ওরা হয়ত তা নয়? ব্যাপারটা যেন কেমন-কেমন, এখন মনে হচ্ছে, কিন্তু শেষ বাক্যটা আমি কাটছি না, কেননা প্রকৃতপক্ষে ওটা ততটা উদ্ভট চিন্তা নয়। প্রত্যেকেই জানে, যিনি আমার বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগকারী, সেই মিসেস ফান ডানের বুঝ-সমঝের একান্ত অভাব। আরও সরল করে বললে, বলতে হয় নির্বোধ’। অন্যেরা যদি বেশি ধারে কাটে, নির্বোধ লোকদের সেটা আবার সহ্য হয় না।

মিসেস ফান ডান আমাকে নির্বোধ ভাবেন এই কারণে যে–ওঁর মত আমার বুদ্ধিসুব্ধির অভাব নেই; উনি আমাকে ব্লাটা ভাবেন এই কারণে যে উনি এমন কি আমার চেয়েও বেশি তঁাটা। উনি ভাবেন আমার পোশাকগুলো খুব চেঁটি, তার কারণ ওঁর গুলো আরও টেটি। এবং সেই কারণেই উনি আমাকে ঝানু ভাবেন, কেননা যে বিষয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই সে বিষয়েও ফোড়ন কাটার ব্যাপারে উনি আমার ঘাড়ে হাগেন। অবশ্য আমার একটা প্রিয় প্রবচন হল, ‘ধোয়া থাকলেই আগুন থাকবে’ এবং আমি সত্যিই কবুল করছি যে, আমি ঝানু।

আমার ক্ষেত্রে দুঃখের ব্যাপার হল এই যে, অন্য যে কারো চেয়ে আমি ঢের বেশি নিজের খুঁত কাড়ি এবং নিজেকে বকি। এবং এরপর মা-মণি যখন তার ওপর তার অনুশাসনটুকু চাপান তখন শিক্ষার বোঝা এমন পর্বতপ্রমাণ হয়ে ওঠে যে, মরীয়া হয়ে আমি তখন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলি এবং উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুরু করে দিই; তখন অবশ্যই আমার গলায় পুরনো সুপরিচিত ধুয়ো শোনা যায় আমাকে কেউ বুঝতে পারে না!’ এই পদবন্ধটি আমার মনে সেঁটে যায়; আমি জানি এটা খুবই বোকার মতো শুনতে, তবু এর মধ্যে কিছুটা সত্যি আছে। অনেক সময় নিজের ওপর আমি এত বেশি দোষারোপ করি যে, তখন আমি একান্ত ভাবে এমন কাউকে চাই–যে এসে আমাকে খানিকটা সান্ত্বনাবাক্য বলবে, আমাকে ঠিক উপদেশ দেবে এবং সেই সঙ্গে কিছুটা আমার সত্যিকার ব্যক্তিত্বকে বের করে আনবে; কিন্তু হায়, আমার খোজাই সার হল, আজ পর্যন্ত তেমন কাউকে আর পেলাম না।

এটা বলতেই পেটারের কথা অমনি তোমার মনে হবে, আমি জানি। হবে না, কিটি? ব্যাপারটা এই–পেটার আমাকে ভালবাসে প্রণয়িনীর মতো নয়, বন্ধুর মতো; দিনে দিনে, ওর বন্ধুভাব আরও বাড়ছে। কিন্তু কী সেই রহস্যময় জিনিস যা আমাদের দুজনকেই ঠেকিয়ে রাখছে? আমি নিজেই তা বুঝি না। মাঝে মাঝে ভাবি ওর সম্বন্ধে আমার তীব্র বাসনার মধ্যে আতিশয্য ছিল, কিন্তু, সেটাও ঠিক নয়। কেননা দুদিন যদি আমি ওপরে না যাই, আমার মধ্যে আকুলিবিকুলি ভাব অসম্ভব বেড়ে যায়। পেটার ভালো, পেটার আমার খুব আপন; কিন্তু তাও অস্বীকার করে লাভ নেই, ওর ব্যাপারে আমি নিরাশ হয়েছি। বিশেষ করে, ধর্মের বিষয়ে ওর বিরাগ এবং খাবারদাবার আর অন্য নানা প্রসঙ্গে ওর কথাবার্তা আমার পছন্দ হয় না। তবে এ ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত যে, আমাদের মধ্যে পরিষ্কার বোঝাঁপড়া হয়ে যাওয়ায়, আর এখন আমাদের ঝগড়া হবে না। পেটার শান্তিপ্রিয় মানুষ; ওর সহ্যগুণ আছে এবং বললেই কথা শোনে। যে কথা ওর মা বললে ও কিছুতেই মানবে না, তেমন অনেক জিনিস ওকে আমি বেকসুর বলতে পারি। ওর জিনিসপত্তর সমানে ও গোছগাছ করে রাখতে পারে। এ সত্ত্বেও ও কেন ওর নিগূঢ় কথা নিজের মনের মধ্যে রাখে? কেন সেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ? মানছি, স্বভাবে ও আমার চেয়ে চাপা, কিন্তু আমি জানি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যে, কোনো-না-কোনো সময়ে সবচেয়ে মুখচোরা মানুষও এমন কাউকে ঠিক ততটাই পেতে চায় যাকে সে মন খুলে সব বলতে পারে।

পেটার আর আমি, আমরা দুজনেই আমাদের ধ্যানের বছরগুলো ‘গুপ্ত মহলে’ কাটিয়েছি। আমরা কত সময় ভবিষ্যৎ অতীত আর বর্তমান নিয়ে কথা বলি, কিন্তু, আগেই বলেছি, আদত জিনিসটা আমি যেন ধরতে ছুঁতে পারি না এবং ওটা যে রয়েছে, সেটা জেনেও।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমি ভাবি, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সব কিছু নিয়েই আমি যে এত মত্ত হয়ে পড়ি, তার কারণ নিশ্চয় এই যে, আজ দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে নাক গলানো থেকে আমি বঞ্চিত। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, একটা সময় ছিল যখন গাঢ় সুনীল আকাশ, পাখিদের কূজন, চাদের আলো আর ফুল, এর কিছুই কখনও আমাকে মুগ্ধ করতে পারত না। এখানে আসার পর সেটা বদলে গেছে।

যেমন হুইনের (ইস্টারের ছয় সপ্তাহ পরে সপ্তম রবিবার থেকে সপ্তাহকালের পরব) সময়, যখন বেশ গরম, একা একা ভালো করে চাঁদ দেখব বলে আমি ইচ্ছে করে একদিন রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগেছিলাম।

হায়, আমার জেগে থাকাই সার হল, কারণ চাদের আলো বড় বেশি জোরালো থাকায় ভয়ে আমি জানালাই খুলতে পারলাম না। আরেক বার, মাস কয়েক আগে, আমি ওপরে গিয়েছিলাম, ঘরের জানালাটা খোলা ছিল।

যতক্ষণ না জানালা বন্ধ করে দিতে হল ততক্ষণ আমি ঘর ছেড়ে নড়িনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বর্ষণমুখর সন্ধ্যে, ঝড়ো হাওয়া, হুড়মাতুনে মেঘ, সব যেন চুম্বকের মতো আমাকে ধরে রাখল, দেড় বছরের মধ্যে এই প্রথম রাতকে আমি সামনাসামনি দেখলাম। সেদিন সন্ধের পর থেকে সিঁদেল চোর, ধেড়ে ইঁদুর আর বাড়িতে পুলিসের হানা দেওয়ার ভয়ের চেয়েও আমার কাছে বড় হয়ে উঠল আবার সেই রাত দেখার তীব্র বাসনা।

আমি একা একা নিচে চলে গিয়ে রসুইঘর আর অফিসের খাস কামরার জানালা দিয়ে বাইরেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।

অনেকেই প্রকৃতি ভালবাসে, অনেকে মাঝে মধ্যে ঘরের বাইরে ঘুমোয় আর যারা জেলখানায় বা হাসপাতালে থাকে তারা দিন গোনে কবে আবার ছাড়া পেয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।

কিন্তু এমন মানুষের সংখ্যা বেশি নয় যারা, নির্ধন সবাই যার অংশীদার, সেই প্রকৃতি থেকে বহিষ্কৃত আর বিচ্ছিন্ন। যখন আমি বলি যে, আকাশ মেঘ, চাঁদ আর তারার দিকে তাকালে নিজের মধ্যে আমি পাই প্রশান্তি আর সুস্থিরতা–সেটা আমার মনগড়া কল্পনা নয়। ঘৃতকুমারী বা ব্রোমাইডের চেয়েও সেটা ভালো ওষুধ; প্রকৃতি মাতা আমাকে বিনীত হতে শেখায় এবং সাহসের সাথে প্রত্যেকটি আঘাতের মোকাবিলা করতে শেখায়।

দুঃখের বিষয়, খুব দু-একটি ক্ষেত্রে ছাড়া, আমার কপালে শুধু জুটেছে অসম্ভব ধূলিমলিন। জানালায় ঝোলানো নোংরা নেটের পর্দার ভেতর দিয়ে প্রকৃতিদর্শন। এইভাবে দেখতে আর। ভাল লাগে না, কারণ প্রকৃতি হল এই একটি জিনিস যাকে হতেই হবে নির্ভেজাল।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ১৬ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

নতুন নতুন ঝঞ্ঝাট–মিসেস ফান ডানের এখন প্রায় মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা; ঔর বুলি হল–গুলিতে ওঁর মাথা এফোঁড় হওয়া, জেল খাটা, ফাসি আর আত্মহত্যা। উনি আমাকে হিংসে করেন, কেননা পেটার ওঁকে না বলে আমার কাছে ওর মনের কথা বলে। ডুসেলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টিতে ওঁর প্রত্যাশা মতো ভুসেল ধরা না দেওয়ায় ওঁর রাগ; ওর ভয় যে ওঁর স্বামী বোধ হয় সিগারেট খেয়ে ফারকোটের জন্যে রাখা সব টাকা ঠুকে দিচ্ছেন।

মিসেস ফান ডান এই করছেন চুলোচুলি, এই করছেন গালিগালাজ, এই ফেলছেন চোখের পানি, এই গাইছেন নিজের কাঁদুনি, আবার তারপরই নতুন করে শুরু করছেন কোদল। অমন এক বোকা, ঘ্যানঘেনে মেয়েমানুষকে নিয়ে কী যে করা যায়! কেউ ওঁর কথার কোনো দাম দেয় না, ওঁর চরিত্র বলে কিছু নেই এবং সকলের কাছেই উনি গজগজ করেন। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল, তাতে পেটার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনায়; মিস্টার ফান ডানের মেজাজ তিরিক্ষে হয়, আর মা-মণি হন বিশ্বনিন্দুক।

সত্যি, এ এক জঘন্য অবস্থা! এ থেকে বাঁচার সেরা নিয়ম একটাই–সব কিছু হেসে ওড়াও এবং আর কারো ব্যাপারে থেকো না। একটু স্বার্থপরের মতো শোনালেও, নিজের মনের জ্বালা জুড়োবার এটাই একমাত্র ওষুধ।

চার সপ্তাহ ধরে মাটি খোড়ার কাজে ক্রালারের আবার তলব পড়েছে। ক্রালার চেষ্টা করছেন ডাক্তারের সার্টিফিকেট আর কোম্পানির চিঠি দেখিয়ে এ থেকে উদ্ধার পেতে, কুপহুইস চাইছেন পাকস্থলীতে অপারেশন করাতে। কাল এগারোটায় সমস্ত ব্যক্তিগত টেলিফোন কেটে দেওয়া হয়েছে।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২৩ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এখানে বলবার মতো বিশেষ কিছু হচ্ছে না। ইংরেজরা শেরবুর্গের ওপর বড় দরের হামলা শুরু করেছে। পিম আর ফান ডানের মতে, ১০ই অক্টোবরের মধ্যে আমরা নির্ঘাত মুক্তি পেয়ে যাব। এই অভিযানে রুশরা যোগ দিয়েছে এবং কাল তার ভিতে-এর কাছে আক্রমণ শুরু করেছে, আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে জার্মানরা আক্রমণ করে। আমাদের আলু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে; এখন থেকে মাথা পিছু গুনে নিতে হবে, তাহলে সবাই জানবে কে কটা পেল।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ১৯৪৪

প্রিয়তম কিটি, এখন আর মনের সে ভাব নেই; সব কিছু এখন চমৎকার চলছে। শেরবুর্গ, ভিতেব্‌স্ক্‌ আর শ্লোকেন আজ শক্র কবলমুক্ত হয়েছে। বন্দী আর দখল করা জিনিস প্রচুর। এবার ইংরেজরা তাদের চাহিদামতো সৈন্য নামাতে পারবে। ইংরেজরা আক্রমণ শুরু করার তিন সপ্তাহ পরে গোটা কোঁতার্তা উপদ্বীপে তারা একটি পোতাশ্রয় পেয়েছে।

বিরাট সাফল্য বৈকি। সেই দিনটির পর এই তিন সপ্তাহে এমন দিন যায়নি যেদিন ঝড়বৃষ্টি হয়নি, এখানেও যেমন ফ্রান্সেও তেমনই। কিন্তু এই একটু দুর্ভাগ্য ইংরেজ আর মার্কিনদের বিপুল শক্তি প্রদর্শন রোধ করতে পারেনি।

আর সে শক্তিও যেমন-তেমন নয়।

সেই যে ‘আজব অস্ত্র’ সে তো পুরোদমেই চলছে; কিন্তু ইংল্যাণ্ডে খানিকটা ভাঙচুর নিয়ে দু-একটি চুটকি আর বোশ (জার্মান ভাষায় নিরেট মাথা) কাগজে পৃষ্ঠা ভরানো–এছাড়া ওর ফল আর কতটুকু? বলতে কি, বেশ-ভূমি’তে যখন হুঁশ হবে যে, সত্যিই বলশেভিকরা আসছে, তখন ওদের আরও বেশি হাঁটু কাঁপবে।

যেসব জার্মান মেয়ে মিলিটারিতে কাজ করে না, তাদের ছেলেপুলেসুদ্ধ গ্ৰোলিজেনে, ফিজল্যাণ্ডে আর গেন্ডারল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মূসের্ট (ডাচ নাত্সী নেতা) ঘোষণা করেছে যে, ওরা যদি ঠেলতে ঠেলতে এই পর্যন্ত আসে তাহলে মূসের্ট উর্দি পরবে।

মটু বুড়োর কি ইচ্ছে খানিকটা যুদ্ধ করার? এর আগে রুশদেশে সেটা করলেই সে পারত। কিছুদিন আগে শান্তির প্রস্তাব ফিনল্যাণ্ড বাতিল করে দেয়; পরে এর জন্যে হাত কামড়াবে, বোকচন্দরের দল!

২৭শে জুলাই আমরা কত দূরে থাকব বলে তোমার মনে হয়?

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৩০ জুন, ১৯৪৪

আদরের কিটি, খারাপ আবহাওয়া, কিংবা বলা যায়–তিরিশে জুন অব্দি একটানা খারাপ আবহাওয়া (মূল ইংরেজিতে লেখা)। ভালোই বলেছি, তাই না! এর মধ্যেই ইংরেজি আমি দুই কলম শিখে নিয়েছি। আমি যে পারি সেটা দেখাবার জন্যে অভিধানের সাহায্যে আমি ‘আদর্শ স্বামী’ পড়ছি। যুদ্ধ সুন্দর ভাবে চলেছে।

বোর্‌রইয়্‌স্ক্‌, মোগিলেফ আর ওরত্রার পতন হয়েছে, বন্দী প্রচুর।

এখনকার খবর সব ভালো এবং সকলেরই মেজাজের উন্নতি হচ্ছে। যারা উগ্র আশাবাদী। ছিল, তাদের এখন জয়জয়কার। এলির চুলের ধরন পাল্টেছে। এ সপ্তাহটা মিপের ছুটি। নতুন খবর বলতে এই।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

পেটার যখন বলে এর পরে সে হবে চোর ডাকাত কিংবা যখন সে জুয়োখেলার কথা বলে, আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়; অবশ্যই ঠাট্টা করেই সে বলে, তবু আমার কেমন যেন মনে হয় নিজের দুর্বলতায় ও ভয় পায়।

মারগট আর পেটারের মুখে বার বার শুনি–হ্যাঁ, হতাম যদি তোমার মতো শক্ত আর তেজস্বী, যা চাই তা পাওয়ার জন্যে সবসময় যদি লেগে থাকতে পারতাম, আমার যদি দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার উৎসাহ থাকত, হ্যাঁ, তাহলে দেখতে…!’

আমার ওপর কারো প্রভাব পড়তে না দেওয়া, আমি ভাবি, এটা সত্যিই আমার একটা সপগুণ কিনা। প্রায় পুরোপুরি নিজের বিবেককে অনুসরণ করা, এটা কি সত্যিই ভালো?

খোলাখুলিই বলছি, আমি ভেবে পাই না কেউ কী করে বলে, আমি দুর্বল’ এবং তারপর তেমনিই থেকে যায়।

যখন তুমি জানছই, কেন তার বিরুদ্ধে লড়ো না, কেন তোমার চরিত্রকে গড়েপিটে নেবার চেষ্টা করো না? উত্তর পেয়েছিলাম না করাটা অনেক সহজ বলে। এটা শুনে আমি দমে গিয়েছিলাম।

সহজ? তার মানে, আলসেমি আর ফাঁকি দেওয়ার জীবনটা একটা সহজ জীবন? না,–এটা সত্যি হতে পারে না, সত্যি হওয়া উচিত নয়, মানুষ তাহলে সহজেই প্রলুব্ধ হবে। ঢিলেমিতে… আর টাকায়।

আমি অনেকক্ষণ বসে ভাবলাম পেটারকে আমি কী উত্তর দেব, কিভাবে ওর নিজের ওপর আস্থা আনা যায় এবং, সবচেয়ে বড় কথা নিজের চেষ্টায় কি ভাবে ও নিজেকে শোধরাতে পারে। আমি জানি না আমার এই চিন্তাধারা ঠিক না ভুল।

আগে কত ভেবেছি, একজনের পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করাটা কী সুন্দর একটা ব্যাপার; এখন সেইখানে পেীছে বুঝতে পারছি, অন্যের ভাবনা ভাবতে পারা এবং তার ঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করা কত শক্ত কাজ।

আরও এই কারণে যে, ‘সহজ’ আর টাকা’ এই বিশেষ ধারণাগুলোই আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা আর নতুন। পেটার আমার ওপর খানিকটা ঠেকা দিতে শুরু করেছে এবং এটা কোনো অবস্থাতেই হতে দেওয়া চলবে না।

পেটার জাতীয় ছেলেদের কাছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা শক্ত ঠেকে, কিন্তু তার চেয়েও শক্ত তোমার পক্ষে সচেতন, জ্যান্ত জীবন হয়ে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। কেননা তা যদি তুমি করো, তাহলে আকণ্ঠ সমস্যার মধ্যে সঠিক পথ কেটে এগোনো এবং তৎসত্ত্বেও সবকিছুর মধ্যে ধ্রুবলক্ষ্যে অবিচল থাকা–এ কাজ দ্বিগুণ কঠিন হবে।

আমি কেবল এটা সেটা করছি, দিনের পর দিন সন্ধান করছি, সেই সাংঘাতিক সহজ শব্দটার বিরুদ্ধে এমন একটা মোক্ষম যুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি, যাতে বরাবরের মতো ওটা মিটিয়ে ফেলা যায়।

কেমন করে ওকে আমি বোঝাই, যে জিনিস সহজ আর চিত্তাকর্ষক দেখায় ওকে তো এমন রসাতলে টেনে নিয়ে যাবে যেখানে না পাওয়া যাবে প্রাণের সান্ত্বনা, না বন্ধু, না সৌন্দর্য যেখান থেকে নিজেকে তোলা প্রায় অসম্ভব?

আমরা সবাই বেঁচে থাকি, কিন্তু জানি না কিসের জন্যে কি হেতু। আমরা সবাই বাঁচি সুখী হওয়ার জন্যে; আমাদের জীবন যেমন পৃথক পৃথক, তেমনই কুল্লে এক।

আমরা তিনজনে মানুষ হয়েছি ভালো সংসর্গে, আমাদের শিক্ষার সুযোগ আছে, কিছু একটা হতে পারার সম্ভাবনা আছে, আমরা প্রত্যেকেই সঙ্গতভাবে আশা করতে পারি সুখের জীবন, কিন্তু… এটা আমাদেরই অর্জন করতে হবে।

সেটা কখনই সহজ নয়। সুখ যদি অর্জন করতে চাও তো তোমাকে খাটতে হবে এবং ভালো করতে হবে; বসে থেকে বা কপাল ঠুকে তা হওয়ার নয়। কুড়েমি জিনিসটা মন ভোলাতে পারে কিন্তু কাজ করে পাওয়া যায় তৃপ্তি।

যেসব লোক কাজ পছন্দ করে না তাদের আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু পেটারের ব্যাপারটা আলাদা; পৌঁছুনোর মতো ওর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সেই সঙ্গে ও মনে করে কিছু করে ওঠার মতো ওর বুদ্ধিও নেই, মোগ্যতাও নেই।

বেচারা!

ও কখনও জানলই না অন্যদের মুখে হাসি ফোঁটালে কি রকমের অনুভূতি হয় এবং সেটা আমি ওকে শেখাতেও পারব না। ওর কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই, যীশু খ্রিষ্টকে হেসে উড়িয়ে দেয়, আর ঈশ্বরের নামে দিব্যি গালে। আমিও যে খুব নিষ্ঠাবান, তা নই; কিন্তু যখনই পেটারকে দেখি সে সকলের বার, সব সময় নাক সিটকে আছে এবং সত্যিই রিক্ত তখন। আমি মনে আঘাত পাই।

যেসব লোকের কোনো একটা ধর্ম আছে, তাদের খুশি হওয়া উচিত; কারণ স্বর্গীয় বস্তুতে বিশ্বাসী হওয়ার সুকৃতি সকলের থাকে না।

মৃত্যুর পর দণ্ডভয়ও তোমার না থাকলে চলে; অনেকে আছে যারা শুদ্ধিলোক, নরক আর স্বর্গ, এসব মানতে পারে না, কিন্তু একটি ধর্ম, তা সে যে ধর্মই হোক, মানুষকে সঠিক পথে রাখে। উপরওয়ালার ভয় নয়, সেটা আসলে নিজের ইজ্জত আর নৈতিক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।

যদি রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে লোকে একবার মনে করে দেখে সারাদিন সে কী করেছে এবং ভেবে দেখে তার মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ–তাহলে প্রত্যেকেই কত মহানুভব আর কত ভালো হতে পারে। এবং নিজের অজান্তে, তখন দেখবে রোজ রাত পোহালেই তুমি আত্মোন্নতির জন্যে চেষ্টা করছ, দেখবে কালক্রমে অনেক কিছু আলবাৎ তোমার মুঠোয় এসে গেছে। যে কেউ তা করতে পারে, এর জন্যে পয়সা লাগে না এবং নিশ্চিতভাবেই এতে কাজ সহজ হবে। যারা জানে না অভিজ্ঞতা থেকে তাদের একথা শিখতে হবে যে–’বিবেক শান্ত থাকলে মানুষের শক্তি বাড়ে।‘

তোমার আনা।

.

শনিবার, ৮ জুলাই, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এ কারবারের প্রধান প্রতিনিধি মিস্টার ব গিয়েছিলেন বেভারহিকে এবং নিলাম (হল্যাণ্ডে প্রত্যেক চাষীকে তার ফসল প্রকাশ্য নিলামে বেচতে হয়) বাজার থেকে সেই রকম জুটিয়ে এনেছেন স্ট্রবেরি।

এখানে এল যখন, একেবারে ধুলোয় ধূসর, বালিতে বালিময়, কিন্তু পরিমাণে প্রচুর। অফিসের লোকজন আর আমাদের জন্যে কম করে চব্বিশ ডালা স্ট্রবেরি। সেইদিনই সন্ধ্যেবেলায় ছয়টা বয়ামে পুরে আমরা আট পাত্র জ্যাম তৈরি করে ফেললাম। পরদিন সকালে মিপ অফিসের লোকদের জন্যে জ্যাম করতে চাইলেন।

সকাল সাড়ে বারোটায় বাড়িতে বাইরের লোক বলতে যখন কেউ নেই, দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দেওয়া হল; ডলাগুলো আনতে বলা হল; পেটার, বাপি, ফান ডান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বকবক করছেন–আনা, যাও গরম পানি আনো; মারগট একটা বালতি নিয়ে এসো; কে কোথায় আছ, দাঁড়িয়ে যাও।

পেটের মধ্যে কুঁই কুঁই করছে, রসুইঘরে গিয়ে দেখি ঠাসা লোক মিপ, এলি, কুপহুইস, হেংক, বাপি, পেটার। অজ্ঞাতবাসে থাকা পরিবারগুলো আর তাদের যোগানদার বাহিনী, সব একাকার এবং ভরদুপুরে এই ব্যাপার।

নেটের পর্দা থাকায় বাইরে থেকে কেউ ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পায় না, কিন্তু তাহলেও, এই চেঁচামেচি আর দরজা ধাক্কাধাক্কি আমাকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিল। আমরা যে লুকিয়ে আছি, এসব দেখেশুনে কি তা বলা যায়? এটা চকিতে আমার মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল। এ থেকে আমার এই অদ্ভুত অনুভূতি জাগল যে, পৃথিবীতে আবার আমি দেখা দিতে পারব।

প্যান ভর্তি হল আর আমি আবার ছুটে ওপরতলায় গেলাম। পরিবারের আর সবাই রান্নাঘরে আমাদের টেবিলে গোল হয়ে বসে বোঁটাগুলো ছাড়াতে ব্যস্ত–অন্তত সেই কাজই তাদের করার কথা; কিন্তু যত না তারা বালতিতে ফেলছিল, তার চেয়ে বেশি ফেলছিল নিজেদের মুখে। এখুনি আরেকটি বালতি লাগবে।

পেটার ফের চলে গেল নিচতলার রসুইঘরে দুই বার বেল বাজল। সঙ্গে সঙ্গে যেখানকার বালতি সেখানে রেখে পেটার ভোঁ-দৌড়। এক লাফে ওপরে এসে পেটার আলমারি জোড়া দরজায় খিল এটে দিল।

আমরা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি। আধা পরিষ্কার স্ট্রবেরিগুলো যে ধোবো, কিন্তু পানির কল যে খুলতে পারছি না। বাড়িতে কেউ এলে পানি ব্যবহার বন্ধ, কেননা, তাতে আওয়াজ হবে’–এই নিয়ম কড়াভাবে মানা হয়।

একটার সময় হেংক এসে বললেন ডাকপিওন এসেছিল। পেটার আবার একদৌড়ে নিচে। টুং টাং… বেল বাজতেই পেটার পিঠটান দিল।

আমি গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কেউ আসছে কিনা–প্রথমে আলমারিজোড়া দরজায়, তারপর সিঁড়ির মাথায় গুড়ি মেরে উঠে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমি আর পেটার একজোড়া চোরের মত রেলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে নিচের তলার হৈচৈ শোনার চেষ্টা করলাম।

সকলেরই চেনা গলা, পেটার চুটি চুপি নেমে পড়ে, আধাআধি গিয়ে থেমে পড়ে ডাকল–’এলি!’ কোনো উত্তর নেই, পেটার আবার ডাকল–’এলি!’ রসুইঘরের হৈচৈতে পেটারের কণ্ঠস্বর ডুবে গেল।

পেটার হনহনিয়ে নিচে নেমে সটান রসুইঘরে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। এক্ষুনি ওপরে চলে যাও, পেটার! অ্যাকাউন্টেন্ট এসেছে, পালাও!’ কুপহুইসের গলা।

পেটার হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে এল, আলমারি জোড়া দরজা সপাটে বন্ধ হল। শেষমেষ ক্রালার এসে গেলেন দেড়টায়। ওঃ, প্রাণ গেল, যেদিকে তাকাই শুধু স্ট্রবেরি আর স্ট্রবেরি, সকালের খাবারে স্ট্রবেরি, মিপের করা স্ট্রবেরির দমপূক্ত, আমার গা দিয়ে বেরোচ্ছে স্ট্রবেরির গন্ধ, এ থেকে জিরেন চাই, যাচ্ছি ওপরেকি সব ধোয়াধুয়ি হচ্ছে, এখানে… মরেছে, এখানেও স্ট্রবেরি।

বাকিগুলো বোতলে ভরা হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলায়–দুটো বয়াম খোলা হল। বাপি চটপট তা দিয়ে জ্যাম বানিয়ে ফেললেন। পরদিন সকালে আর দুটো খোলা হল এবং বিকেলে চারটি। ফান ডান ওগুলোতে নির্বীজাণুকরণের উপযোগী তাপ দিতে পারেননি। আজকাল বাপি রোজ সন্ধ্যেবেলায় জ্যাম তৈরি করছেন।

এখন আমরা ডালিয়ার সঙ্গে স্ট্রবেরি খাই, সর-তোলা দুধ খাই স্ট্রবেরি দিয়ে, স্ট্রবেরি মাখিয়ে রুটিমাখন খাই, শেষ পাতে খাই স্ট্রবেরি, চিনিপাতা স্ট্রবেরি, বালি কিচকিচ স্ট্রবেরি। দুদিন ধরে স্ট্রবেরি, শুধুই স্ট্রবেরি; তারপর স্ট্রবেরির যোগান বন্ধ বা বোতলবন্দী হল এবং আলমারিতে তালা পড়ল।

মারগট চেঁচিয়ে বলে, শোন্ আনা, মোড়ের তরিতরকারির দোকানদার আমাদের কিছু মটরশুঁটি দিয়েছে, উনিশ পাউণ্ডের মতো। আমি জবাব দিই, লোকটা খুব ভালো বলতে হবে। ভালো নিশ্চয়ই, কিন্তু দম নিলে যাবে… বাপরে!

টেবিলে সবাই এসে বসলে মা-মনি ডেকে বললেন, শনিবার সকালে মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানোর কাজে তোমাদের সবাইকে হাত লাগাতে হবে।’

যে কথা সেই কাজ। আজ সকালে কানায় কানায় ভর্তি বিরাট এক এনামেলের প্যান যথানিয়মে এসে গেল।

মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানো বিরক্তিকর কাজ, কিন্তু একবার দানাগুলোর খোসা ছাড়িয়ে দেখো। খোসাটা ছাড়িয়ে ফেললে দেখবে দানার ভেতরের শাঁসটা কী নরম আর সুস্বাদু আমার মনে হয় অনেকেই সেটা জানে না। তার চেয়েও বড় সুবিধে হল, শুধু মটরদানা হলে একজন যতটা খাবে, এতে তার তিনগুণ সে খেতে পারবে।

মটরদানার খোসা ছাড়ানোর কাজটা খুব ধীরে ধীরে সাবধানে করতে হয়। দিগগজ দাঁতের ডাক্তার বা মাছিমারা কেরানীর পক্ষে হয়ত ঠিক আছে, কিন্তু আমার মতো ছটফটে নাবালিকার পক্ষে এ কাজ ভয়ঙ্কর।

আমরা বসেছি সাড়ে নটায়, আমি উঠেছি সাড়ে দশটায়, তারপর আবার এসে বসেছি সাড়ে এগারোটায়।

এই ধুয়োটা এখনও আমার কানে গুনগুন করে বাজছে–আগা নোয়াও, খোসা ধরে টানো, শিরা বাছো, উঁটি ছাড়িয়ে ফেল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমার চোখের সামনে সব নাচছে, সবুজ, সবুজ, সবুজ। কৃমিকীট, শির, পচা শুটি, সবুজ, সবুজ, সবুজ।

কিছু একটা তো করতে হবে, তাই সারা সকাল বকর বকর করি, আগডুম বাগডুম যা মনে আসে বলে যাই, প্রত্যেককে হাসাই আর কান ঝালাপালা করে দিই। প্রত্যেকটা শির ধরে টানতে টানতে এ বিষয়ে মন বেঁধে নিই যে, জীবনে কক্ষনো আমি নিছক গৃহকর্মী হতে চাই না।

শেষ অব্দি আমরা প্রতিঃরাশ করলাম বারোটায়।

সাড়ে বারোটা থেকে সোয়া একটা আবার মটরশুঁটি ছাড়ানো। যখন হাত দুটো থামে, মাথাটা টলমল করে অন্যদেরও খানিকটা তাই। উঠে পড়ে চারটে অবধি ঘুম লাগাই। কিন্তু তাও ঐ অখাদ্য মটরটিগুলো এখনও আমাকে বড়ই বিপর্যস্ত করে রেখেছে।

তোমার আনা।

.

শনিবার, ১৫ জুলাই, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

লাইব্রেরি থেকে আমরা একটা বই পেয়েছিলাম, বইয়ের নামটাতে একটা যুদ্ধংদেহি ভাব; কমবয়সী আধুনিক তরুণীদের সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?’ আজ এই বিষয়টা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই।

বইটির লেখিকা ‘আজকের তরুণ সমাজ’-কে আগাপাছতলা ধুনেছেন–অবশ্য তাই বলে একথা বলেননি যে, তরুণদের সবাই ‘ভালো কিছু করতে অপারগ।’ বরং বলেছেন এর ঠিক উল্টো।

তার মতে, তরুণ-তরুণীরা যদি ইচ্ছে করে তাহলে তারা এর চেয়ে বড়, এর চেয়ে সুন্দর এবং এর চেয়ে ভালো দুনিয়া গড়তে পারে–সে ক্ষমতা তাদের মুঠোর মধ্যেই আছে; কিন্তু তারা সত্যিকার সৌন্দর্যের বিষয়ে না ভেবে ওপরকার জিনিসগুলো নিয়েই ব্যস্ত।

রচনার কোনো কোনো অংশে মনে হয়েছে লেখিকার সমালোচনার লক্ষ্য যেন আমি; তাই আমি তোমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে একবার খুলে ধরতে চাই এবং এই আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাই।

যে আমাকে কিছুকালও দেখেছে, তারই চোখে না পড়ে পারে না–আমার চরিত্রের এক অসামান্য গুণ হল আমার আত্মজ্ঞান। ঠিক একজন বাইরের লোকের মতোই আমি নিজেকে আর আমার ক্রিয়াকলাপগুলোকে নিরীক্ষণ করতে পারি।

কোনোরকম পক্ষপাত ছাড়াই, তার হয়ে কোনোরকম সাফাই না গেয়েও, প্রতিদিনের আনার মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারি; এবং তার মধ্যে কী ভালো আর কী মন্দ তা লক্ষ্য করতে পারি।

এই ‘আত্মচেতনা’ সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং যখনই আমি মুখ খুলি, কথা বলমাত্র আমি জানি ওটা না বলে অন্য কিছু বলা উচিত ছিল’ কিংবা ‘ওটা ঠিকই বলা হয়েছে। আমার মধ্যে এত কিছু আছে যা আমার চোখে খারাপ ঠেকে; সে সব বলে ফুরোবে না। আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝছি বাপির সেই কথাগুলো কত ঠিক–সব শিশুকেই তার মানুষ হওয়ার দিকে নজর দিতে হবে।’

বাপ-মা-রা শুধু সদুপদেশ দিতে পারেন অথবা তাদের সঠিক পথে এনে দিতে পারেন কিন্তু কারো চরিত্র চূড়ান্তভাবে কী রূপ নেবে সেটা নির্ভর করে তাদের নিজেদের ওপর।

এর ওপর আমার আর যা আছে তা হল মনের জোর; সবসময় নিজেকে আমার খুব শক্তসমর্থ বলে মনে হয় এবং মনে হয় আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। নিজেকে ঝাড়া হাত-পা আর নবীন বলে মনে হয়।

প্রথম সেটা জানতে পেরে আমি কী খুশি হয়েছিলাম; কেননা যখন প্রত্যেকের ওপর অনিবার্যভাবে ঘা এসে পড়বে, আমার মনে হয় না, আমি সহজে সে আঘাতে ভেঙে পড়ব।

কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আগেও আমি অনেকবার বলেছি। এবার আমি ‘বাপি আর মা-মণি আমাকে বোঝে না’ অধ্যায়টিতে আসব।

বাপি আর মা-মণি বরাবর পুরোপুরিভাবেই আমার মাথাটি খেয়েছেন; ওঁরা সবসময় আমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করেছেন, আমার পক্ষ নিয়েছেন, এবং মা-বাবার পক্ষে সম্ভবপর। সবকিছুই আমার জন্য করেছেন।

তবু আমি দীর্ঘ সময় ধরে কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ বোধ করেছি এবং নিজেকে পরিত্যক্ত, উপেক্ষিত আর লোকে আমাকে ভুল বুঝেছে বলে মনে হয়েছে। বাপি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন আমার বিদ্রোহী ভাব ঠেকাতে, কিন্তু ফল হয়নি; আমার নিজের আচরণে কী ভুল তা দেখে এবং সেটা নিজের চোখের সামনে তুলে ধরে আমি নিজেকে সারিয়ে তুলেছি।

এই বা কেমন যে, আমার লড়াইতে আমি বাপির কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাইনি? তখন তিনি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছেন, কেন তিনি তখনও সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন?

বাপি এগিয়েছিলেন ভুল পথ ধরে, উনি সবসময় আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হবে আমি যেন এমন এক শিশু যে কষ্টকর অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা অদ্ভুত ঠেকবে, কারণ বাপিই হলেন একমাত্র লোক যিনি আমাকে বিশ্বাস করে সবকিছু বলতেন; এবং আমি যে সুবোধ মেয়ে, একটা বাপি ছাড়া আর কেউই আমাকে মনে মনে বুঝতে দেয়নি। কিন্তু একটা জিনিস বাদ পড়েছিল; তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারেননি যে, আমার পক্ষে অন্য সবকিছুর চেয়ে ঢের বেশি জরুরী হল চরম উৎকর্ষে পৌঁছুবার লড়াই। তোমার বয়সে এটা হয়; বা অন্য মেয়েরাবা ‘এটা আপনা থেকে আস্তে আস্তে কেটে যাবে’–এ ধরনের কথা আমি শুনতে চাইতাম না; আমি চাইনি আমার সঙ্গে ব্যবহার করা হোক আর পাঁচটা মেয়ের মতো ব্যবহারটা হওয়া উচিত আনা যা তার সেই নিজের গুণে। পিম সেটা বোঝেননি। সেদিক থেকে কাউকেই আমি মনের কথা বলতে পারি না, যদি না তারা নিজেদের সম্বন্ধে বিস্তর কথা আমাকে বলে। যেহেতু পিম সম্পর্কে আমি খুব সামান্যই। জানি। আমি মনে করি না তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি খুব ঘনিষ্ঠ জায়গায় পা ফেলতে পারি। পিম সবসময় বয়োবৃদ্ধের, পিতৃসুলভ মনোভাব নেন; বলেন এক সময়ে তারও এই ধরনের ঝোক হয়েছিল। তবে ওসব বেশিদিন থাকে না। হাজার চেষ্টা করেও আমার সঙ্গে আজও বাপির মনের তার ঠিক বন্ধুর মতো এক সুরে বাজে না।

এই সবের দরুন, জীবন সম্বন্ধে আমার মতামত অথবা আমার সুচিন্তিত তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর কথা আমি আমার ডায়েরির পাতায় এবং মাঝে মাঝে মারগটকে ছাড়া কখনও কারো কাছে গুণাক্ষরেও বলি না। যেসব জিনিস আমাকে বিচলিত করছিল, তার পুরোটাই আমি বাপির কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম; আমি কখনই বাপিকে আমার আদর্শের অংশীদার করিনি। এটা আমি মনে মনে বুঝছিলাম যে, আমি তাকে আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। অন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি সবকিছুই পুরোপুরি আমার অনুভূতি অনুযায়ী করেছি, কিন্তু করেছি এমনভাবে যা আমার মনের শান্তি রক্ষার সবচেয়ে অনুকূল। কারণ, এ অবস্থায়, আমি যদি আমার অর্ধসমাপ্ত কাজের সমালোচনা মেনে নিই, তাহলে নড়বড় করতে করতে যে স্থিরতা আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছি–আমাকে তা সম্পূর্ণভাবে খোয়াতে হয়। পিমের কাছ থেকে এলেও আমি তা মানতে পারি না, যদিও কথাটা কঠিন শোনাবে, কেননা পিমকে আমি আমার গূঢ় ভাবনার অংশীদার তো করিইনি, উপরন্তু আমার রগচটা মেজাজের সাহায্যে অনেক সময় নিজেকে তার কাছ থেকে আরও বেশি দুরে ঠেলে দিয়েছি।

এই বিষয়টা নিয়ে আমি বিলক্ষণ ভেবে থাকি–পিমের ওপর কেন আমি চটি? এতই চটি যে, আমাকে ওঁর জ্ঞান দিতে আসাটা আমি সহ্যই করতে পারি না, ওঁর সস্নেহ ভাব ভঙ্গিগুলো আমার কাছে ভান বলে মনে হয়, আমি চাই একা শান্তিতে থাকতে এবং ওঁর হাত থেকে একটু রেহাই পেলেই বরং খুশী হই, যতক্ষণ ওঁর প্রতি আমার মনোভাব ঠিক কী সেটা নিশ্চিতভাবে না বুঝতে পারছি। কারণ, উত্তেজিত হয়ে যে যাচ্ছেতাই চিঠিটা দম্ভ করে ওঁকে আমি লিখেছিলাম, তার কুরে কুরে খাওয়া অপরাধবোধ এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। সবদিক দিয়ে প্রকৃত বলিষ্ঠ আর সাহসী হওয়া, ইস, কত যে শক্ত।

তবু এটাই আমার সবচেয়ে বড় আশাভঙ্গ নয়। না, বাপির চেয়ে আমি ঢের বেশি ভাবি পেটারের কথা। আমি ভালো করেই জানি, আমি ওকে হার মানিয়েছিলাম, ও আমাকে নয়। ওর সম্পর্কে আমি মনের মধ্যে একটা ভাবমূর্তি খাড়া করেছিলাম। শান্ত সংবেদনশীল মিষ্টিমতো একটি ছেলের–যার দরকার স্নেহ-ভালবাসা আর বন্ধুত্ব। আমার প্রয়োজন ছিল জীবন্ত কোনো মানুষের–যাকে আমি প্রাণের সব কথা খুলে বলতে পারি; আমি চেয়েছিলাম এমন একজন বন্ধু, যে আমাকে এনে দেবে ঠিক রাস্তায়। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি এবং আস্তে আস্তে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তাকে আমি নিজের কাছে টানলাম। শেষ পর্যন্ত, যখন তাকে আমি বন্ধুভাব বোধ করাতে পারলাম, তখন আপনা থেকে তা এমন এক মাখামাখিতে গিয়ে গড়াল যে, পুনর্বিবেচনায় বুঝলাম, সেটা অতটা হতে দেওয়া আমার উচিত হয়নি।

আমরা কথা বলেছি যারপরনাই ব্যক্তি বিষয়ে, কিন্তু আজ অবধি আমাদের কথাবার্তায় আমরা সেইসব বিষয়ের ধারকাছ দিয়েও যাইনি যে বিষয়গুলো সেদিন এবং আজও আমার হৃদয়মন ভরে রেখেছে। আমি এখনও পেটারের ব্যাপারটা ভালো জানি না ওর কি সবই ওপরসা? নাকি ও এখনও লজ্জা পায়, এমন কি আমাকেও? কিন্তু সে কথা থাক, সত্যিকার বন্ধুত্ব পাতানোর অধীর আগ্রহে আমি ভুল করে বসেছিলাম। দুম করে সরে গিয়ে ওকে ধরার চেষ্টায় আমি গড়ে তুললাম আরও মাখামাখির সম্পর্ক। সেটা না করে আমার উচিত ছিল অন্যান্য সম্ভাবনাগুলো বাজিয়ে দেখা। পেটার হেদিয়ে মরছে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে এবং আমি দেখতে পাচ্ছি ও ক্রমবর্ধমানভাবে আমার প্রেমে পড়তে শুরু করেছে। আমাদের দেখাসাক্ষাতে ও তৃপ্তি পায়; অথচ আমার ওপর এসবের একমাত্র ক্রিয়া হয় এই যে, আমার মধ্যে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার বাসনা জাগে। এ সত্ত্বেও যেসব জিনিস দিনের আলোয় তুলে ধরার জন্যে আমি আকুলিবিকুলি করছি, কেমন যেন মনে হয় আমি সে বিষয়গুলো টুতেই পারি না। পেটার যতটা বোঝে, তার চেয়েও ঢের বেশি আমি ওকে আমার কাছে টেনে এনেছি। এখন ও আমাকে আঁকড়ে ধরেছে; আপাতত ওকে ঝেড়ে ফেলার এবং ওকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর আমি কোনো রাস্তা দেখছি না। যখন আমি বুঝলাম ও আমার বোধশক্তির উপযোগী বন্ধু হতে পারবে না, তখন ঠিক করলাম আমি অন্তত চেষ্টা করব ওর মনের এঁদো গলি থেকে ওকে তুলে আনতে এবং এমন ব্যবস্থা নিতে যাতে ওর যৌবনটা দিয়ে ও কিছু করতে পারে।

কারণ, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে যৌবন বার্ধক্যের চেয়েও নিঃসঙ্গ। এটা আমি কোনো বইতে পড়েছিলাম এবং বরাবর স্মরণে আছে; দেখেছি কথাটা ঠিক। তাহলে কি এটা ঠিক যে, আমাদের চেয়েও আমাদের গুরুজনদের এখানে থাকা ঢের বেশি কষ্টকর? না। আমি জানি, এটা ঠিক না। বয়সে যারা বড়, সব কিছু সম্পর্কে তাদের মতামত তৈরি হয়ে গেছে। কোনো কিছু করতে গিয়ে তাদের দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয় না। আজ যখন সমস্ত আদর্শ ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, যখন লোকে তাদের সবচেয়ে ওঁছা দিকটা চোখের সামনে তুলে ধরছে এবং সত্য, ন্যায় আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে কিনা তাও জানে না–তখন নিজের কোট বজায় রেখে নিজের মতামত ঠিক রাখা, আমাদের ছোটদের পক্ষে, তো আরও দ্বিগুণ শক্ত।

কেউ যদি, সে যেই হোক, দাবি করে যে এখানে গুরুজনদের থাকতে বেশি কষ্ট হয়, তাহলে বলব সে মোটেই বোঝে না কী পরিমাণ ভারী ভারী সমস্যা আমাদের ঘাড়ের ওপর; এসব সমস্যা সামলাবার পক্ষে আমরা হয়ত খুবই ছোট, কিন্তু তাহলেও ক্রমাগত তার চাপ। তো আমাদের ওপর পড়ছে; হতে হতে একটা সময় আসে, আমরা তখন ভাবি, যা একটা। সমাধান পাওয়া গেছে–কিন্তু সে সমাধান তো প্রকৃত ঘটনাগুলোকে ঠেকাতে পারে না, ফলে। আবার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এমন দিনে এই হল মুশকিল–আমাদের ভেতর আদর্শ, স্বপ্ন আর সাধ আহ্লাদ মাথা তোলে, তারপরই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখে পড়ে সেসব খান খান হয়ে। যায়। এটা খুব আশ্চর্য যে, আমি আমার সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিইনি; কেননা সেগুলো অযৌক্তিক এবং কাজে খাটানো অসম্ভব, এ সত্ত্বেও আমি সেগুলো রেখে দিয়েছি, কারণ, মানুষের ভেতরটা যে সত্যিই ভালো, সবকিছু সত্ত্বেও আমি আজও তা বিশ্বাস করি। আমি এমন ভিত্তিতে আমার আশাভরসাকে দাঁড় করাতে পারি না যা বিশৃখল, দুঃখদৈন্য আর মৃত্যু দিয়ে তৈরি। আমি দেখতে পাচ্ছি পৃথিবী ক্রমশ জঙ্গল হয়ে উঠছে, আমি কেবলি শুনতে পাচ্ছি আসন্ন বজ্রনির্ঘোষ, যা আমাদেরও ধ্বংস করবে, আমি অনুভব করতে পারি লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা এবং এ সত্ত্বেও, আমি দিবালোকের দিকে মুখ তুলে তাকাই, আমি ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে, এ নিষ্ঠুরতারও অবসান হবে এবং আবার ফিরে আসবে শান্তি আর সুস্থিরতা।

যতদিন তা না হয়, আমি আমার আদর্শগুলোকে উঁচুতে তুলে ধরব, কেননা হয়ত এমন দিন আসবে যখন আমি সেই আদর্শগুলোকে কাজে খাটাতে পারব।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২১ জুলাই, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

এখন আমার সত্যিই আশা জাগছে, এখন সব কিছুই সুভালাভালি চলছে। হ্যাঁ, সব ভালো চলছে। সবার বড় খবর। হিটলারকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল এবং এবার যে করেছিল সে এমন কি না ইহুদী কমিউনিস্ট, না ইংরেজ পুঁজিবাদী বরং যে করেছিল সে একজন জার্মান সেনাপতি, এবং তদুপরি একজন কাউন্ট, এবং বয়সেও যথেষ্ট তরুণ। ফুরার প্রাণে বেঁচেছে দৈবক্রমে, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, দু-চারটে আঁচড় আর পোড়ার ওপর দিয়ে ফুরারের ফাড়া কেটে গেছে। সঙ্গে যে কয়জন অফিসার আর জেনারেল ছিল, তারা কেউ খুন, কেউ জখম হয়েছে। যে প্রধান অপরাধী, তাকে গুলি করে মারা হয়।

যাই হোক, এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, প্রচুর অফিসার আর জেনারেল যুদ্ধের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ এবং তারা হিটলারকে জাহান্নামে পাঠাতে পায়। হিটলাকে সরিয়ে দিয়ে, তাদের লক্ষ্য সে জায়গায় এমন একজন সামরিক একনায়ককে বসানো, যে মিত্রপক্ষের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করবে; এরপর তারা চাইবে পুনরাস্ট্রীকরণ করে বিশ বছরের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ ডেকে আনতে। দৈবশক্তি বোধহয় ইচ্ছে করেই হিটলারকে সরিয়ে ওদের পথ পরিসর করার ব্যাপারটা একটু দেরি করিয়ে দিয়েছেন, কেননা নিচ্ছিদ্র জার্মানরা তাহলে নিজেরা নিজেদের মেরে মিত্রপক্ষের কাজ অনেক সহজ এবং ঢের সুবিধাজনক করে দেবে। এতে রুশ আর ইংরেজদের কাজ কমে যাবে এবং ঢের তাড়াতাড়ি তারা নিজেদের শহরগুলো পুনঃনির্মাণের কাজে হাত দিতে পারবে।

কিন্তু তবু, আমরা অতদূর এখনও এসে পৌঁছাইনি, এবং সময় হওয়ার এত আগে সেই গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর কথা আমি বিবেচনা করতে চাই না। তবু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, এ সমস্তই ঠাণ্ডা মাথার বাস্তব এবং আজ আমি রয়েছি, আটপৌরে গদ্যের মেজাজে; এই একটিবার উচ্চ আদর্শ নিয়ে আমি বকবক করছি না। আরও কথা হল, হিটলার এমন কি বারি কৃপা পরবশ হয়ে তার বিশ্বস্ত ভক্তজনদের জানিয়ে দিয়েছে যে, সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকে অতঃপর গেস্টাপোকে মানতে বাধ্য থাকবে; এবং হিটলারকে হাজার নীচ, কাপুরুষোচিত প্রচেষ্টায় জড়িত ছিল জানলে যে কোনো সৈনিক তার সেই উপরওয়ালাকে যেখানে পারে সেখানেই, কোট-মার্শাল ছাড়াই গুলি করে মারতে পারবে।

এবার যা একখানা নিখুত খুনের খেল শুরু হবে। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে সেপাই জনির পা ব্যথা করেছে, উপরওয়ালা অফিসার দাঁত খিচিয়েছে। আর যায় কোথায়–জনি অমনি তার রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুঙ্কার দেবে—‘ফ্যুরারকে বড় যে মারতে গিয়েছিলি, এই নে ইনাম।’ গুড়ুম! ব্যস, সেপাই জনিকে ধমকানোর স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে নাক-তোলা ওপরওয়ালা চলে গেল চিরন্তন জীবনে (নাকি সেটা চিরন্তন মৃত্যু?)। শেষকালে, কোনো অফিসার যখনই কোনো সেপাইয়ের মুখোমুখি হবে, কিংবা তাকে সবার আগে পিঠে রেখে দাঁড়াতে হবে, দুর্ভাবনায় সে তার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। কেননা সেপাইরা যা বলতে সাহস পায় না সে সবই তারা বলবে। আমি যা বলতে চাইছি, তার খানিকটা কি তুমি ধরে নিতে পারছ? নাকি আমি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে লাফ দিয়ে দিয়ে যাচ্ছি? লাফ না দিয়ে উপায় নেই; আসছে অক্টোবর ইস্কুলের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে পারি, এই সম্ভাবনায় মন খুশিতে এত ভরে উঠেছে যে, যুক্তিতর্ক সব চুলোয় গেছে। এই মরেছে দেখ, এক্ষুনি তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে, আমি খুব বেশি আশাবাদী হতে চাই না? আমার ঘাট হয়েছে, সাধে কি ওরা আমার নাম দিয়েছে ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবা, ১ আগস্ট, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

‘টুকটুকে বিরোধের পুঁটুলি’–এই বলে ইতি করেছিলাম আমার শেষ চিঠি এবং সেই একই কথা দিয়ে শুরু করছি এটা। ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’! আচ্ছা বলতে পারো এটা ঠিক কী? বিরোধ বলতে কী বোঝায়। অন্য অনেক কথার মতো এতে দুটো জিনিস বোঝাতে পারে বাইরে থেকে বিরোধ আর ভেতর থেকে বিরোধ।

প্রথমটা হল মামুলি সহজে হার না মানা, সব সময় সেরা বিশেষজ্ঞ বলা, মোক্ষম কথাটা বলে দেওয়া’, সংক্ষেপে, যে সব অপ্রিয় বপণের জন্যে আমি সুবিদিত। দ্বিতীয়টা কী কেউ জানে না, ওটা আমার নিজের গোপন কথা।

এর আগেই তোমাকে আমি বলেছি যে, আমার রয়েছে যেন এক দ্বৈত ব্যক্তিত্ব। তার একার্থ ধারণ করে আছে। আমার আল্লাদে আটখানা ভাবি, সবকিছু নিয়ে মজা করা, আমার তেজস্বিতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, যেভাবে সমস্ত কিছু আমি হালকাভাবে নিই। প্রেমের ভান দেখে নারাজ না হওয়া, চুমো, জড়িয়ে ধরা, অশ্লীল রসিকতা–সব এর মধ্যে পড়ে। এই দিকটা সাধারণত ওৎ পেতে থাকে এবং অন্য যে দিকটা ঢের ভালো, ঢের গভীর, ঢের বেশি খাঁটি–সেই দিকটাকে দুম করে ঠেলে সরিয়ে দেয়। তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে, তুলনায় আনার সেটা ভালো দিক সেটার কথা কেউ জানে না এবং সেইজন্য অধিকাংশ লোকের কাছে আমি অসহ্য।

এক বিকেলে আমি হই অবশ্যই এক মাথাঘোরানো ভাড়; ব্যস, আর একটা মাস ওতেই ওদের চলে যাবে। গভীর চিন্তাশীল লোকদের পক্ষে যেমন প্রেমমূলক ফিল্ম–নিছক চিত্তবিনোদন, মজাদার শুধু একবারের মতো। এমন জিনিস যা অল্পক্ষণ পরেই ভুলে যাওয়া যায়, মন্দ নয়, তবে নিশ্চয়ই ভালো বলা যায় না। সত্যি বলতে, এও ঠিক তাই। তোমাকে এসব বলতে খুবই খারাপ লাগছে; কিন্তু যাই হোক এ জিনিস যখন সত্যি বলে জানি, তখন বলব নাই বা কেন? আমার যে দিকটা হালকা ওপর, সেটা আমার গভীরতর দিকের তুলায় সব সময়ই বড় বেশি প্রাণবন্ত মনে হবে এবং তাই সব সময়ই কিস্তি মাত করবে। তুমি ধারণা করতে পারবে না ইতিমধ্যেই আমি যে কত চেষ্টা করেছি। এই আনাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে, তাকে পঙ্গু করে দিতে, কেননা, সব সত্ত্বেও, যাকে আনা বলা হয়, সে হল তার অর্ধেক মাত্র; কিন্তু তাতে কাজ হয় না এবং আমি এও জানি, কেন তাতে কাজ হয় না।

অষ্টপ্রহর আমি যা সেইভাবে যারা আমাকে জানে, পাছে তাদের চোখে পড়ে যায় আমার অন্য দিক, যেটা সূক্ষ্মতর এবং অনেক ভালো। তাই আমি বেজায় ভয়ে ভয়ে থাকি। আমার ভয়, ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, মনে করবে আমি উপহাসযোগ্য আর ভাবপ্রবণ। আমাকে ওরা গুরুত্ব দিয়ে নেবে না। গুরুত্ব দিয়ে না নেওয়াতে আমি অভ্যন্ত; কিন্তু তাতে অভ্যন্ত এবং তা সইতে পারে তো শুধু ফুর্তিবাজ আনা; সিকিভাগ সময়ের জন্যে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াতে আমি যদি সত্যিকার বাধ্যও করি, তাহলেও মুখ থেকে কথা বের করতে গিয়ে সে একেবারে কুঁকড়ে যায় এবং শেষে পয়লা নম্বর আনাকে তার জায়গায় দাঁড়াতে দিয়ে, আমি বুঝবার আগেই, সে হাওয়া হয়ে যায়।

সুতরাং লোকজন থাকলে ভালো আনা কখনই সেখানে থাকে না, এ পর্যন্ত একটিবারও সে দেখা দেয়নি, কিন্তু আমরা একা থাকলে প্রায় সব সময়ই সে এসে জাকিয়ে বসে। আমি ঠিক জানি, আমি কি রকম হতে চাই, সেই সঙ্গে আমি কি রকম আছি… ভেতরে। কিন্তু হায়, আমি ঐ রকম শুধু আমারই জন্যে। হয়ত তাই, না, আমি নিশ্চিত যে, এটাই কারণ যে জন্যে আমি বলি আমার হাসিখুশি স্বভাবটা ভেতরে এবং যে জন্যে অন্য লোকে বলে আমার হাসিখুশি স্বভাবটা বাইরে। ভেতরের বিশুদ্ধ আনা আমাকে পথ দেখায়, কিন্তু বাইরে আমি দড়ি ছিঁড়ে নেচেদে বেড়ানো ছাগলছানা বৈ কিছু নই।

যেটা আমি আগেই বলেছি, কোনো বিষয়ে আমি আমার আসল অনুভুতির কথা কখনও মুখ ফুটে বলি না এবং সেই কারণে আমার নাম দেওয়া হয়েছে ছেলে-ধরা, ছেনাল, সবজান্তা, প্রেমের গল্পের পড়ুয়া। ফুর্তিবাজ আনা ওসব হেসে ওড়ায়, ধ্যাষ্টামো করে জবাব দেয়, নির্বিকারভাবে কাঁধ ঝাড় দেয়, কেয়ার না করার ভাব দেখায়, কিন্তু হায় গো হায়, মুখচোরা আনার প্রতিক্রিয়া এর ঠিক উল্টো। যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে স্বীকার করব যে, এতে আমার প্রাণে আঘাত লাগে, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি নিজেকে বদলাতে, কিন্তু আমাকে সর্বক্ষণ লড়তে হচ্ছে ঢের জবরদস্ত এক শত্রুর বিরুদ্ধে।

আমার মধ্যে একটি ফোঁপানো কণ্ঠস্বর গুনি–’ও ঈশ্বর, শেষে তোমার এই হাল হয়েছে; কারো ওপর মায়াদয়া নেই, যা দেখ তাতেই নাক সিটকাও, আর তিরিক্ষে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর উপদেশে কান দিতে চাও না।‘ আমি কান দিতে চাই গো, চাই কিন্তু ওতে কিছু হয় না; যদি আমি চুপচাপ থেকে গুরুতর কোনো বিষয়ে মন দিই, প্রত্যেকে ধরে নেয় ওটা কোনো নতুন রঙ-তামাসা এবং তখন সেটাকে হাসির ব্যাপার করে তুলে তা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়। আমার নিজের পরিবারের কথাই বা কী বলি–ওঁরা নির্ঘাৎ ভেবে বসবেন আমার ঘাড়ে মাথায় হাত ঠেকিয়ে দেখবেন, আমার গায়ে জ্বর আছে কিনা জিজ্ঞেস করবেন। শরীর খারাপ, মাথাধরা আর স্নায়বিক রোগের ওষুধের বড়ি গোলাবেন, জিজ্ঞেস করবেন আমার কোষ্ঠবদ্ধতা হয়েছে কিনা এবং তারপর আমার মেজাজ ভালো নেই বলে আমাকে চোখে চোখে রাখা হয়, আমি শুরু করি খেকি হতে, তারপর অসুখী এবং সবশেষে আমার অন্তঃকরণে মোচড় দিই, যাতে খারাপটা বাইরে পড়ে আর ভালোটা থাকে ভেতরে এবং সমানে চেষ্টা করতে থাকি রাস্তা খোজার, যাতে হওয়া যায় যা হতে চেয়েছি এবং যা হতে পারি, যদি… পৃথিবীতে আর কোনো জনপ্রাণী বেঁচে না থাকত!

-তোমার আনা।

.

পরিশেষে

আনার ডায়েরি এইখানে শেষ। ৪ঠা আগস্ট, ১৯৪৪–এইদিন সবুজ উর্দি-পরা পুলিস ‘গুপ্ত মহলে’ হানা দেয়। ওখানকার সব বাসিন্দাদের, ক্রালার আর কুপহুইস সমেত, গ্রেপ্তার করে এবং জার্মান আর ডাচ বন্দী নিবাসে পাঠিয়ে দেয়।

গেস্টাপো ‘গুপ্ত মহল’ লুট করে। মেঝের ওপর ফেলে দেওয়া পুরনো বই, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজের ডাঁই থেকে মিপ আর এলি খুঁজে বের করেন আনার ডায়েরিটা। পাঠকের দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় সামান্য কিছু অংশ বাদে মূল লেখাঁটি এই বইতে ছাপানো হয়েছে।

আনার বাবা ছাড়া ‘গুপ্ত মহলে’র আর কোনো বাসিন্দাই ফিরে আসতে পারেননি। ক্রালার আর কুপহুইস ডাচ বন্দীনিবাসে দারুণ কষ্টভোগ করে স্বগৃহে নিজের নিজের পরিবারে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।

হল্যাণ্ডের মুক্তির দুই মাস আগে ১৯৪৫ এর মার্চ মাসে বেরজেন-বেলসেন বন্দীনিবাসে আনার মৃত্যু হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *