০৯. নবম অধিবেশন

নবম অধিবেশন

ক্লেশ পাওয়ার জন্যেই মানুষের জন্ম। জগৎ এক কারাগার।

কে আপনি? হে দার্শনিক?

আপনাকে তো এর আগের কোনও অধিবেশনে দেখিনি। হঠাৎ কোথা থেকে এলেন?

আমি সেই কৃষ্ণ। যে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের রথের সারথি হয়েছিল। যে কৃষ্ণ গীতা আওড়ে ছিল। যে বই পৃথিবীর মাস্টার পিস। সর্বকালের বেস্ট সেলার। আজ পর্যন্ত কারুর বাপের ক্ষমতা হল না ওই রকম দ্বিতীয় আর-একটি রচনা করার। গীতা বিক্রি করে যে রয়্যালটি বিভিন্নকালের মুদ্রায় পাওয়া গেছে সেই টাকায় অ্যামেরিকা আধখানা কিনে ফেলা যায়।

আপনি কবে ছাড়া পেলেন প্রভু!

কোথা থেকে মাই ডিয়ার স্যার?

উন্মাদ আশ্রম থেকে?

ছাড়া তো পাইনি ভাই। উন্মাদ আশ্রমেই তো রয়েছি। এই সংসারটাই তো সেই বিশাল পাগলাগারদ। আমারই এক খেলার খুঁটি সেই কতকাল আগে লিখে গেছে–হতেছে পাগলের মেলা খেপাতে-খেপিতে মিলে। এই সংগীত আগে কখনও কখনও সকালে তোমাদের বেতার তরঙ্গে প্রচারিত হতো। এখন আর হয় না। এখন তার বদলে এসেছে হামতুম এক কামরেমে বন্ধ হ্যায়, আর চাবি খো যায়। ওই একই ব্যাপার, একই মানে। বিশ্ব কারাগারে কোটি-কোটি পাগল মত্ত মার্তণ্ডের মতো হুটোপাটি করে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে আমি যখন দেখি, তখন দেখি…

কতদূর থেকে প্রভু!

পার্সপেকটিভে যখন পৃথিবীকে দেখি, তখন দেখি, মহাশূন্যে একটি গোলক ঘুরছে, তার আষ্টেপৃষ্ঠে পোকার মতো কিলবিল করছে মানুষ। আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, খাবলাচ্ছে, খোবলাচ্ছে, উঠছে, পড়ছে, মরছে, জন্মাচ্ছে। আহা কি সুন্দর খেলা।

এ কি বলছেন প্রভু! আপনি তো বলেছিলেন, আমাদের জন্ম নেই মৃত্যু নেই, শুরু নেই, শেষ নেই, আমি নেই, তুমি নেই, শুধু তিনি আছেন, যাঁকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, মারা যায় না, শেষ করা যায় না। এখন যে অন্য কথা বলছেন?

ঠিকই বলেছি। তোমরা বুঝতে ভুল করেছ। সেটা হল ভৌতিক অবস্থা। মানুষ মরে ভূত হতো। ভূত সর্বশক্তিমান। ভূতের বিনাশ নেই। কারণ ভূতের দেহ নেই। এই দেহ, এই দেহটাই শালা যত ক্লেশের কারণ।

শালা বলছেন স্যার?

কেন? শালা শব্দ শুনে আঁতকে উঠছ কেন? বহু ভালো জিনিসের সঙ্গে শালা যুক্ত আছে যেমন যজ্ঞশালা, কর্মশালা, ধর্মশালা, পাঠশালা, গোশালা, পাকশালা। শালা বললেই বউয়ের ভাই মনে করছ কেন? দেহ একটা শালা। এবং সেই ভগবান, সেই আল্লা, সেই গড, যিনি এই মনুষ্য দেহের ভাস্কর তিনি একটা বোগাস, ওয়ার্থলেস থার্ডক্লাস কারিগর। যে লোকটা কাঁচ তৈরি করেছিল, তার চেয়েও অপদার্থ। মানুষের উচিত আর দেরি না করে ভগবানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা। এই ডিফেকটিভ মেকানিজম চলবে না চলবে না।

সভায় একটা গুঞ্জন উঠল। সভাপতি বললেন, আমরা যে কত বড় পাগল তা প্রমাণ করার জন্যেই এই ছত্রধারীর আবির্ভাব। তবে যা বলছে শোনা যেতে পারে। সেই এক কথাই তো বলবে ইট ইজ এ টেল টোলড বাই এন ইডিয়ট সিগনিফাইং নাথিং। সেই ইডিয়েট হলেন ভগবান।

সভাপতির কথা বক্তা বোধহয় শুনে ফেলেছেন। মৃত্যু হেসে বললেন,

ভগবান নয় শয়তান। আমি তার রাইভ্যাল। গীতায় আমি অর্জুনকে সেইজন্যে ক্যাটেগোরিক্যালি বলেছিলুম–মামেকং শরণং ব্রজ। অ্যান্ড হি ডিড দ্যাট। সে তাই করেছিল এবং যুদ্ধ জিতেছিল। ইউ অল নো দ্যাট। এখন অবশ্য অ্যাটম বোমার যুগ। কুরুক্ষেত্র আর হবে না। এক্সপার্টরা বলছেন– হলে বড়জোর বর্ডার ওয়ার হবে। কোলড ওয়ার হবে। যাক ওটা আলাদা ব্যাপার। আসল ব্যাপার হল, এই সৃষ্টি রহস্য অনেকটা গোয়েন্দা কাহিনির মতো। সামওয়ান অফ ইউ বলেছিলেন শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে! শেষটা অবশেষে জানা গেছে। রহস্য এখন পরিষ্কার। শয়তানকেই আমরা ভগবান ভেবে বসে আছি। শয়তান তৈরি না করলে মানুষের মতী একটা জীব হতো না। ভগবানকে সাজা দেওয়ার জন্যেই ভগবান মেরে মানুষ তৈরি হয়েছে।

এ কথাটার মানে কি?

মানে খুব সহজ। ভগবান টুকরো-টুকরো হয়ে গেছেন। রোজই হচ্ছেন। প্রতিদিন কোটি কোটি টুকরো হয়ে যাচ্ছেন।

সে আবার কি?

বিশ্বজুড়ে রোজই কয়েক কোটি মানুষ জন্মাচ্ছে। এত মানুষ আসছে কোথা থেকে! সবই ভগবানের টুকরো। ভগবান যত টুকরো হচ্ছেন ততই তার শক্তি কমে যাচ্ছে। এ্যাজ ফর একজাম্পল, গ্রহ ভেঙে উপগ্রহ হয়। উপগ্রহ ভেঙে উল্কা হয়। উল্কা পুড়ে ছাই হয়। মানুষও সেইরকম বিশালের কুঁচো, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ভগবান এত টুকরো হচ্ছেন কেন?

শয়তানের কারসাজি। সেই আদম আর ইভের গল্প। লোভের আপেল। আপেলের লোভ। জন্ম মানেই ক্ষয়। প্রজননের ইচ্ছেই হল পাপ। ভগবানের মনে পাপ ঢুকে নারীলোলুপ করে তুলেছে। সেই লালসা থেকেই প্রতি মুহূর্তে মানবশিশু ট্যাঁট্যাঁ করে উঠছে। লালচ বড় বালাই। এক শক্তিমান। ভগবান এখন পিলপিলে ভগবান, কীটাণু কীট। পতঙ্গের মতো আসছেন আর ধেড়িয়ে মরছেন। ভগবান নিজেই চিৎকার করছেন–নো মোর নো মোর।

ভগবান চিৎকার করছেন?

অবশ্যই। বিবেকের কণ্ঠস্বর হল ভগবানের কণ্ঠস্বর। এখনই নয়, দুয়ের বেশি কখনও নয়। ডোন্ট মালটিপ্লাই। পোস্টার হোর্ডিং বিবিধভারতী। কে কার কথা শোনে। শয়তান সাহিত্যে, শয়তান সিনেমায়, নাটকে। শয়তান ক্যাবারেতে, মদে, মাংসে, আহারে, বিহারে। ভগবান সংযম হারিয়ে শয়তানের ফাঁদে।

তাহলে, কি হবে স্যার?

নিয়তি, বৎস নিয়তি। ভগবানের কোনও আকার আকৃতি ছিল না। তিনি ছিলেন, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত। লালসায় তার একটা মাথা গজালো গোল ফুটবলের মতো। দুটো গোলগোল চোখ। দুটো লগবগে হাত বেরোল। দুটো লিকপিকে ঠ্যাং। একটা বেয়াড়া আকৃতি। অকেজো শরীর। ভেতরে জটিল যন্ত্রপাতি। লিভার, পিলে, ফুসফুস, হৃদয়, মাইলের-পর-মাইল স্নায়ু, জড়ানো পাকানো, টুকরো টুকরো হাড় জুড়ে একটা কাঠামো। একটু বেকায়দায় হলেই খিল খুলে যায়, ভেঙে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। মাথায় ঘিলু। একটু ধাক্কা লাগলেই ছলকে যায়। একটু চাপ পড়লেই বিগড়ে যায়। এক মাথার মেকানিজমেই ভগবান কাত। খেপে গেলে কারুর কিছু করার নেই। উলঙ্গ হয়ে ঘোরে। টিউমার হলে ভেলোরে ছোটে। তোমরাই বলো পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণীর এত দুর্বল, এত সূক্ষ্ম শরীর? খুব লম্ফঝম্প। এ ওকে তড়পাচ্ছে, ও তাকে তড়পাচ্ছে, হঠাৎ ওগো আমার পেট ব্যথা করছে গো বলে দাঁত চিরকুটে ফ্ল্যাট। নিজের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। বোলাও ডাক্তার। ডাক্তারের জ্ঞানও তেমনি। এখানে টেপে ওখানে টেপে। বুকে নল লাগায়। পেটে তবলা বাজায়। জিভ টেনে বের করে। চোখ উলটে দেখে। রায় দেয় পেটে বায়ু, বুকের দিকে ঠেলে উঠছে অম্বল। শেষে দেখা গেল ক্যানসার। ভগবান ফেঁসে গেলেন। ডাক্তার ভগবান ফি পকেটে পুরে সিমলায় বেড়াতে চলে গেলেন।

মানুষকে তাহলে ভগবান বলছেন?

অণু ভগবান। বহুর মধ্যে সেই এক দানা-দানা, কণা-কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। অপলকা, অপটু একটা খোলে ঢুকে আমার নাম জপছে তরস্বরে–হে কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কি করবে? ওই খোলে ঢুকেছিস কেন শালা! যে খোল পচে যায়, ধসে যায়। যে খোলের আবরণের কোনও শক্তি নেই। হাড়। হাড়ের ওপর চর্বি, চর্বির ওপর মাংস, মাংসর ওপর নুনছাল, তার ওপর ছাল। ভেতরে ব্যাজ-ব্যাজ করছে রক্ত। শরীরের নীচের দিকে সেপটিক ট্যাঙ্ক। তার আবার ধারণ ক্ষমতা এতই কম, রোজ সকালে সবেগে দুর্গন্ধময় মাল বেরিয়ে আসে। কোনও ভগবানের একবার, কারুর বারবার। থেকে-থেকে জল বিয়োগ। শরীর মানেই মল, মূত্র, কফ, পিত্ত, স্বেদ, শোণিত। ঘর্মাক্ত ভগবানের দুর্গন্ধে অন্য ভগবান তিষ্ঠতে পারে না। গায় ফাঁস-ফাস করে গন্ধ দ্রব্য স্প্রে করে সামাল দিতে হয়। এই যদি ভগবতী তনু হয় তাহলে এই শরীরের সৃষ্টি কর্তাকে কি বলতে ইচ্ছে করে? তোমরাই বলো। মানুষ ভগবানের সৃষ্টি নয়। সৃষ্টি হল শয়তানের। একজন এই রহস্য, এই সিক্রেট ডিজাইনটা ধরতে পেরেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। সব গুলিয়ে ফেলে একটা পৌরাণিক গল্প ফেঁদে বসল।

সেটা কি?

সেই গল্প। আদম আর সাপ। শয়তানরূপী সাপ বলছে, তুমি বড় নিঃসঙ্গ। কতকাল এইরকম একা-একা থাকবে? তুমি তোমার একটি প্রতিমূর্তি তৈরি করো। তোমার একজন সঙ্গী চাই। ইভের আবির্ভাব। শয়তানের কারসাজি সফল হল। শক্তির বিভাজন। পরা প্রকৃতি, পরা শক্তি। শয়তান আরও একধাপ এগোল। রমণ কর। পরাশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করো! কোন শক্তি? যে শক্তি শয়তানের আপেল খেয়ে চৈতন্যময়ী নয় লাজময়ী। বিশাল শক্তি, বিশাল জলধি আবদ্ধ হতে হতে ছোট-ছোট ডোবায় পরিণত হল। শয়তান চারপাশে মায়া সৃষ্টি করে কাল থেকে কালান্তরে জন্মের চাকায় ঘুরিয়ে মারছে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে। শয়তান বলছে জন্মেই তুমি পরাভূত, মৃত্যুর দাস। তুমি আমার পরিকল্পনায় ক্রীতদাস। শয়তানের পেপার ওয়েটের তলায় ভগবানের পাতলা কাগজ বিবেকের হাওয়ায় প্রতিটি মনে ফড়ফড় করে উড়ছে। প্রতি মুহূর্তে অনুশোচনা, এ কি করছি, এ কি করে ফেলেছি। এ কি করে বসে আছি। একই দেহে ভগবান আর শয়তান। ত্যাগ ভোগ প্রেম, নিষ্ঠুরতা, সত্য, মিথ্যা, রক্ষক, ভক্ষক, দাতা, প্রবঞ্চক। তোমাদের শহরের তলায় পয়ঃপ্রণালী। খাবার জল, নদৰ্মার নোংরা জল পাশাপাশি বইছে। তোমরা জানো, তাই বলো ম্যান ইজ এ বান্ডল অফ কনট্রাডিকশানস। একই শরীরে হিরো আর ভিলেন। একই ইতিহাসে জয় আর পরাজয়। পালাবার পথ নেই, শান্তি নেই। শুধু ক্ষয়ে যাও, শুধু জ্বলে যাও। চিতা দহতি নির্জীব, চিন্তা দহতি সজীব। চিতা চৈতন্যময়ী।

তবে উপনিষদে যে বলা হয়েছে অমৃতস্য পুত্রা।

ওটা ধারণা মাত্র। সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠেছিল, শুনেছ তোমরা। দেবতারা যদি দেবতাই হবে, সর্বশক্তিমান হবে, তাহলে অমৃত খেয়ে অমর হতে চাইবে কেন? অমরেও আবার অমরত্বের বাসনা কীসের? আসলে দেবতা একটা ভাওতা, একটা ধাপ্পা। পুরাণজুড়ে দেবতাদের কেচ্ছা। দুর্বলতা, ভীরুতা, কামকতা, তঞ্চকতা। শয়তানের চরিত্র অনেক বলিষ্ঠ। তার লক্ষ অনেক স্পষ্ট। শয়তান হল শক্তি। সে প্রভুত্ব করতে চায়, অধিকার করতে চায়, খর্ব করতে চায়, খর্বিত হতে চায় না। অসীম তার শক্তি। সে যে কত শক্তিমান পৃথিবীই তার প্রমাণ। পৃথিবীর তিনের চার ভাগ জল একের চার ভাগ স্থল। জল মানে অজ্ঞাত এলাকা, রহস্যময় এলাকার পরিধি অনেক-অনেক বেশি। অন্ধকার আলোর চেয়ে শক্তিশালী। পৃথিবী যদি শয়তানের সৃষ্টি না হতো তাহলে দিন রাত্রির এই ভাগাভাগি হতো না। প্রকাশ করে প্রচ্ছন্ন করে দাও। রাতের পাপ দিনের আলোতে স্পষ্ট। প্রাণীজগৎ ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে থাকে মানুষ, তার চিন্তা নিয়ে, দেহ নিয়ে, পাপ নিয়ে। ভগবানের সৃষ্টি হলে পৃথিবীর চেহারা অন্য হতো। স্থলভাগ হতো তিনের চার, জলভাগ একের চার। অজানা বলে কিছু থাকত না। ম্যান পোপিং ইন ডার্কনেস। সীমহীন অন্ধকারে মানুষ নিজেকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। উঃ কি দেই ফেলেছে ভগবানকে! পৃথিবী এক ভয়াবহ জায়গা। মহাশূন্যে ভাসমান এতটুকু একটা ফুটবল। এই তো শরীর! চতুর্দিকে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, প্যারাসাইটস। জঠর থেকে মুক্তির সঙ্গে-সঙ্গেই আক্রান্ত। জন্মেই প্রথম সংগ্রাম অসুখের সঙ্গে, তারপর শয়তানের প্ল্যানে তৈরি মানুষের পরিবেশ। বিশাল বিশাল যন্ত্র, ইঞ্জিন, মোটরগাড়ি, অস্ত্র-শস্ত্র, বিমান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া বাহিনী। সৃষ্টিই স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে চাইছে। মানুষের অধিকাংশ সৃষ্টিই সংহার মূর্তি ধারণ করে মানুষের পেছনে তাড়া করেছে। এই প্রক্রিয়াকে আর থামানো যাবে না কারণ শয়তান তাই চায়। নিজেদের কবর নিজেরা খোঁড়। প্রতিপদে তোমরা পরাজিত। প্রতিটি জন্ম সেই পরাজয়ের এক-একটি মেডেল। শয়তান চেয়েছিল সেই নিরাকার নির্গুণ সত্তাকে একটা খোলে ভরতে। খোলাটা কেমন, যন্ত্রণাকাতর ক্ষয়িষ্ণু ষড় রিপুর বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের দাস। আমি যদি থেকেও থাকে, সে আমি হল দাস আমি–স্লেভ আই। জোনাকি গোবরে পড়েছে। আমি হল দেহের দাস, আমি তারপর জগতের দাস, ডবল দাসত্ব। লোহার বাঁধনে বেঁধেছে সংসার দাসখত লিখে নিয়েছে হায়।

জন্মের ওপর দেবতার কোনও হাত নেই। তিনি সোনার পালঙ্কে আসতে পারেন, ছেঁড়া কাঁথায় এসে চিতপাত হতে পারেন, ফুটপাতেও গড়াগড়ি দিতে পারেন। জন্মের ওপর কোনও কনট্রোল নেই। কামার্ত হয়ে যে যাকে জড়িয়ে ধরবে সেইখানে ভগবান দেহ ধারণ করবেন। তারপর শুরু হবে তার দাসত্ব। সবরকমের নিপীড়ন, উৎপীড়ন। অন্য প্রাণী কত মানুষের মতো এমন জন্মেই দাসত্ব করে না। বাঘ, সিংহ, গণ্ডার। পরাভূত হয়, দাস হয় না। এই হল শয়তানের প্ল্যান। দেহভূত ভগবান রোগ শোক, জুরা ব্যাধি নিয়ে চলেছে-তো-চলেছেই। মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান। শয়তানের তৈরি আখ মাড়াই কলে দেহী ভগবান ছিবড়ে হচ্ছে। সেই কল চলছে শয়তানের অর্ডারে, মানুষ বা ভগবানের তত্ত্বাবধানে।

স্টেট চায় বশ্যতা। ওসব ডেমোক্রেসি-ফেমোক্রেসি চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যাপার। সংঘ, সংগঠন হল কিছুর ওপর কিছুর লাঠি ঘোরানো। এ ওকে চেপে রাখছে, ও তাকে চেপে রাখছে। সংসারে, সমাজে, সেরেস্তায়, রাজদ্বারে সর্বত্রই সেই নিষ্পেষণ। টর্চারের কল চলেছে। হাঁটু মোড়ো, হাত জোড় করে বলো, দাস আমি, প্রভু তুমি, হে মনুষ্যভূত দেবতা তোমার সামনে আমি নতজানু। তুমি যা বলবে তাই বলব। যেমন করে বলাবে তেমন করেই বলব, আমার কোনও স্বাধীনতা নেই। তুমি ভাতে মারতে পারো, তুমি হাতে মারতে পারো। আমি আমার দেহকে ভয় পাই, তোমার নিপীড়নকে ভয় পাই। তোমার প্রসাদে আমার এই অস্তিত্ব!

বক্তা ছাতি বগলে নেমে পড়লেন।

আপনি কে? পরিচয়, পরিচয়?

আমি এক বুদ্ধিজীবী মানুষ। কেরানি। গুডবাই ফ্রেন্ডস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *