০৯. কালাহারি মরুভূমির হিরের খনি

০৯. কালাহারি মরুভূমির হিরের খনি

বিচিত্র এবং অতীব বিস্ময়কর এই হীরক আখ্যায়িক পঠন নিরত অবস্থায় গৃহলক্ষ্মীরা অবশ্যই ভ্র-কুঞ্চন এবং বিবিধ আপত্তিকর মন্তব্যের সমাহার ঘটিয়ে চলেছেন। কাহিনির পত্তন ঘটেছিল কল্পনা চিটনিসের পুত্র অপহরণ দিয়ে… অপহৃত সেই বালকের পুণরুদ্ধার কাহিনির মধ্যে না গিয়ে বেরসিক এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র সহসা হীরক-অবর্তে ঘূর্ণমান হচ্ছে কেন—নাসিকাকুঞ্চন সহকারে এইটাই তো অভিযোগ?

বিশ্বের বিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই একটি পরম সত্যে অবহিত থাকেন। মা লক্ষীরা বড় ধৈর্যহীনা। ধৈর্য, তিতিক্ষা, সহিষ্ণুতা—এই তিন মহাগুণ থেকে এ বপিত। ঈশ্বর ইভ সৃষ্টিকালে ধরণীর প্রথম রমণীকে বহুবিধ রঞ্জণী বস্তু দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন—কিন্তু ভূলক্রমেই হোক বা ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই হোক—এই মহাগুণত্রয়ের সন্নিবেশ ঘটাননি জিন গঠনে।

আমি টের পাচ্ছি, আমার এই লতায় পাতায় পল্লবিত কাহিনি পড়তে পড়তে এই এঁরা বিবিধ প্রকার ভ্রূ-ভঙ্গিমা দেখিয়ে চলেছেন এবং সরস বঙ্কিম কটুক্তি বর্ষণ করে চলেছেন।

কিন্তু হে মা-বোনেরা, আমি নিরুপায়। এ যে ভর পাওয়া কাহিনি। হিরের আত্মা ভর করেছে আমার এই লেখনীতে। হিরে নিয়েই তো যত বিভ্রাট এই দুনিয়ায়। সেই প্রহেলিকাই প্রভঞ্জন আকারে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ভাঙা কলমটাকে। আপনারা স্বচ্ছন্দবোধ করুন, এই আমার মিনতি, কল্পনা চিটনিসের বিচ্ছু পুত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসব যথাসময়ে…।

রবি রে বললে আমার দিকে অপাঙ্গচাহনি নিক্ষেপ করে, ইন্দ্র, তুই অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, কিন্তু কালাহারি মরুভূমিতে হিরে খোঁজের অ্যাডভেঞ্চারে অবশ্যই যাসনি। ঠিক বলছি?

আমি অনুক্ষণ সময় ব্যয় না করে বলেছিলাম, না যাইনি। তুই গেছিস?

শ্ৰীযুক্ত রবি রে তখন শুরু করেছিল অত্যাশ্চর্য সেই উপাখ্যান-ইন্দ্র, পেশোয়ারের পাথরের কথা তোকে একটু আগেই বলছিলাম। এই প্রসঙ্গে পরে তোকে আরও কিছু বলব। এখন শুধু জেনে রাখ, হিরের বাজারে দর তোলবার জন্যে হিরে-কারবারিরা মাঝে মাঝে হিরে লুকিয়ে রাখে…কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে…কোল্ডস্টোরেজে সবজি রেখে দেওয়ার কায়দায়…পেশোয়ারের সেই বন্ধ্যা অঞ্চলে পাহাড় দিয়ে ঘেরা পাহাড়ি দুর্গের গোপন ধনাগারে এইভাবেই হিরে জমানো থাকে। যেমন থাকে এই পৃথিবীর আরও কয়েকটা জায়গায়…নামগুলো। পরে শুনিস।

কল্পনা…কল্পনা আমাকে ওর চোখের হিরের জাদু দিয়ে টেনে এনেছিল এই লাইনে। কল্পনা সুন্দরী ওর একটু চাপা আর টানা ছোট চোখের জন্য…নাক মুখ ঠোঁট সবই ডানাকাটা পরীদের মতো…আশ্চর্য…এত লাবণ্য আর কোনও মেয়ের মুখে তো দেখিনি…তা ওর চাহনি…হিপনোটিক. সত্যিই সম্মোহনী। ঠাট্টা করে আমাকে একদিন বলেছিল, কামরূপের মেয়ে আমার মা, বিয়ে করেছিল। ইস্পাহানের বাবাকে…জন্মেছি আমি সিকিমের মাটিতে…তাই আমি সিকিমি মেয়ে…গ্যাংটকের রূপসী…ওগো আমার প্রিয়…আমার আসল রূপ কোথায় জান? এই চোখে .এই চোখে…এই চোখে…আমি যে ত্রাটক যোগে যোগিনী… মায়ের কাছে রপ্ত করা এই গুপ্ত বিদ্যার বলে আমি বশে আনতে পারি মনের মতো মানুষকে…তুমি থাকবে চিরকাল আমার পাশে…আমার এই চোখের। টানে…মদনের বান যে আমার এই চোখ!

ইন্দ্র, কল্পনার চোখের চাহনির মধ্যে সত্যিই অসাধারণ কিছু আছে। এাটক যোগ কী বিদ্যা জানতে চেয়েছিলাম। হেসে গড়িয়ে পড়ে কল্পনা বলেছিল, সেকালের মুনিঋষিরা বনের পশুদেরও বশে রাখত মনের যে শক্তি দিয়ে…চোখের যে চাহনি দিয়ে…ত্রাটক যোগ অভ্যেসে তা এসে যায়। আমার অসমিয়া মা আমাকে তাই শিখিয়েছে…তাই তোমার মতো বুনো আমার চোখের টানে বাধা পড়েছ…প্রিয়তম রবি, তুমিই এখন সূর্য আমার এই জগতে, আমি তোমার গ্রহ…

আমি বলেছিলাম, গ্রহ না, গ্রহণী।

কল্পনার বাংলা জ্ঞান তেমন উত্তম নয়। জাদু চোখ নাচিয়ে বলেছিল, তা তো বটেই…তা তো বটেই…মেয়ে গ্রহরা তো গ্রহণীই হবে।

বেচারা কল্পনা! ঠাট্টাও বোঝেনি। আমিও বোঝাইনি। গ্ৰহণী যে একটা উদরাময় রোগ, ক্ষুদ্রান্ত্রের ব্যায়রাম, তা ও জানবে কী করে? আমি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, শারীরস্থান রপ্ত করেছি…আমি জানি।

 

এই পর্যন্ত শুনে, কল্পনা-সঙ্গীত শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে আমি, শ্রী ইন্দ্রনাথ রুদ্র বলেছিলাম, কী মুশকিল! হচ্ছিল হিরে কাহিনি, চলে এল খণ্ডকাব্যকল্পনা…কল্পনা…কল্পনা!

তখন কি জানতাম, খণ্ডপ্রলয়ের আভাস পেয়েছিলাম সব কিছুর নিয়ামক নিয়তির নিয়মে!

কল্পনার ইস্পাহানি চোখ আর নাক-ঠোঁটের বাঙালিয়ানা মাদকতা প্রসঙ্গে আসবো পরে। কঠিন ঠাঁই এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র যে অনেক গভীর জলের মাছ… আরাবল্লী-বিদ্যাধরী-গন্ধর্ব কন্যারাও বঁড়শিতে গাঁথতে পারেনি যাকে…সে ছিল কি মতলবে?

ইন্দ্রনাথ রুদ্র যখন মতলববাজ হয়, তখন সে রূপময় পাঁকাল!

কিন্তু কল্পনা যে আমার কলমে ভর করেছে। ঘুরে ফিরে কল্পনা কাহিনি চলে আসছে কলমের ডগায়! ওর ওই চোখ আর নাক-ঠোঁট-চিবুকের গঠনের মধ্যে যে জাদুকরী মিশেল আছে, তা আমার রহস্যসন্ধানী চক্ষু যুগলের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে ঔৎসুক্য সঞ্চার করে গেছে বরাবর। আমি মানব প্রত্নবিদ নই, তবে সাংস্কৃতিক নৃবিদ্যা নিয়ে মস্তিষ্কচর্চা না করে পারি না মানুষের মুখ, করোটি আর শরীরের গঠন দেখলেই! তাই কল্পনার চোখ নাক চিবুক হনু আমার মনে ঔৎসুক্য জাগিয়েছিল। যার মুখাকৃতির মধ্যে বংশছবি বিধৃত রয়েছে এরকমভাবে, তার পদবি চিটনিস কেন?

চিটনিস তো ষোলআনা সিকিমি পদবি। তাহলে?

আমার গোয়েন্দা কৌতূহল মিটিয়ে দিয়েছিল কল্পনা নিজেই। ওর বাবা ইস্পাহানি যাযাবর, মা অসমিয়া—কামরূপ কন্যা। বিয়ে-থা করে নিবাস রচনা করেছিল সিকিমে; কিন্তু পদবি পাল্টে নিয়েছিল। কেউ কারও পদবীকে প্রাধান্য দেয়নি। নতুন রূপের নতুন মানুষ এই কন্যা মিশে যাক সিকিমি সংস্কৃতিতে। তবে, রক্তে বহন করুক ইস্পাহানি উদ্দামতা আর কামরূপী ছলনা…ললনাদের যা সহজাত।

ঘুরে ফিরে কল্পনা প্রসঙ্গ চলে আসছে কাহিনির মধ্যে। সব সঙ্গীতের মূল সুর যেমন একটাই থাকে, বিষম বিচিত্র এই কাহিনির মূল সুরও যে কল্পনা। হিরের ফ্রমে বাঁধানো একটা ছবি-কল্পনা যার নাম। সুন্দরী, তুমি শুকতারা!

কিন্তু আমার মাথায় কালাহারি মরুভূমিতে হিরের খোঁজে যাওয়ার কাহিনি-বীজ বপন করে দিয়েই উদ্দাম গুরের সেই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যেন ঘোরের মাথায় বলে গেছিল বন্ধুবর রবি রে।

ফিকে সবুজ পাথরের পাহাড় উঁচিয়ে দু’পাশে! মাঝে কঙ্কর-আকীর্ণ পথ। যদিও পথ তাকে বলা যায় না। নেচে নেচে ট্রাক চলেছে এই পথে। খনিজ সম্পদের ম্যানেজার মহাভি রয়েছে রবির সঙ্গে। ট্রাক ঢুকছে বিবর পথে—চলেছে বিবরের একদম তলার দিকে। এই বিবরেরনাম জবানেঙ্গ-কালাহারি মরুভূমির বোটসওয়ানা অঞ্চলের একদম শেষের অঞ্চল। হিরের খনি রয়েছে এইখানেই। ধরণীর সবচেয়ে রমণীয় ভূ-সম্পত্তি এই অঞ্চল। ধূসর মরু তার ভয়াবহতা দিয়ে আগলে রেখেছিল হাজার হাজার বছর ধরে। এখন তার গোপন দ্বার দু’হাট হয়ে গেছে হিরে-সন্ধানীদের উৎপাতে।

কিমবারলাইট ঠাসা একটা শিরা পাওয়া গেছিল এখানে ১৯৭৩ সালে। পাইয়ে দিয়েছিল ধরণীর নিকৃষ্টতম এক পোকা। উইপোকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *