০৮. লরি বোঝাই হিরে

০৮. লরি বোঝাই হিরে

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আমার কোষ্ঠীতে লেখা নেই। আমি যে ইন্দ্রনাথ রুদ্র! চমক দিয়ে যাই, নিজে চমকাই না। কিন্তু সেইদিন, বন্ধুবর রবি রে’র অতি অদ্ভুত জীবন কাহিনি শুনতে শুনতে বিষম চমক খেয়েছিলাম।

বলে কি রবি! সাগর গর্ভ থেকে স্রেফ জঞ্জাল তুলেছে হিরে তুলতে গিয়ে! বিপুল অর্থ ব্যয় করে! বলেছিলাম, নুড়ির মধ্যে থেকে হিরে খুঁজতে?

ও বলেছিল, সত্যিই তাই। ইন্দ্র। আমরা এই ঘরকুনো তাস, দাবা, পাশা বিলাসী বঙ্গতনয়রা এই জাতীয় অ্যাডভেঞ্চারাস সওদাগরি ভেঞ্চার কল্পনাতেও আনতে পারব না–

প্রতিবাদ জানাচ্ছি, আমি বলেছিলাম, এই বাংলার বণিকরা একদা সপ্ত ডিঙা ভাসিয়ে সপ্তদ্বীপে বাণিজ্য করেছে—

সে সব দিন গেছে। এইভাবে হিরে তোলার ভাসমান খনি ভাসিয়েছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু আমি যে সেই অ্যাডভেঞ্চারের পিপাসা নিয়েই দেখতে গেছিলাম। হিরে চিরকাল রমণী নয়নে মোহ বিস্তার করেছে, আমি সেই হিরে নিয়ে মেতেছিলাম…।

একটু বাগড়া দিয়েছিলাম, কল্পনার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে?

কথাটা বলেছিলাম কিঞ্চিৎ হাস্য সহকারে। হাস্য বিবিধ প্রকারের হয়–এক চিলতে হাসি দিয়ে হাজার কথা বলে ফেলা যায়-মুখে উচ্চারণ না করে হাসি-বিজ্ঞানের এই তত্ত্ব রসিক পাঠক এবং সুরসিকা পাঠিকার অজ্ঞাত নয়।

আমার বহু অর্থব্যঞ্জক টিপ্পনি যেন কানেই তুলল না চৌকস রবি রে। বললে, রমণীগণ মুগ্ধ হন বলেই তো পুরুষ মহাশয়রা জীবন বিপন্ন করে সাগর ঘেঁচে আব পাতাল খুঁজে হিরে খুঁড়ে, হিরে খুঁজে বেড়ান। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হা-কল্পনা আমাকে ইন্সপায়ার করে গেছে। তাই অত ঝুঁকি নিয়েছিলাম। কল্পনার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড করে গেছিলাম। সেটা শুধু হিরের লোভে নয়, টাকার খোঁজে নয়—

জানি, কণ্ঠস্বর থেকে পরিহাসকে নির্বাসন দিয়ে শুধিয়েছিলাম, কল্পনার মনের পটে হিরে নয়, হিরে নক্ষত্র হতে। সে কথা থাক। প্রেম পুরুষমাত্রকেই ভেড়া বানায়। তাই আমি ওই বস্তুটাকে পরিহার করি। কিন্তু এবার বল, সাগর ঘেঁচা জঞ্জাল নিয়ে কী করা হলো?

লরিতে তোলা হলো। পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের জড়োয়া-জঞ্জাল।

আমি ইন্দ্রনাথ রুদ্র, মূক থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলাম সেই মুহূর্তে এক বিলিয়ন মানে মিলিয়ন মিলিয়ন। এক মিলিয়ন মানে দশ লক্ষ। কত লক্ষ, কত কোটি মুদ্রা মূল্যের জঞ্জাল নিয়ে লরি বোেঝাই করা হয়েছিল, বিপুল বেগে মস্তিষ্ক চালনা করতে করতে সেই হিসেব করবার ব্যর্থ প্রয়াসে নিমগ্ন হয়েছিলাম। বিশেষ করে হিসেব এবং অঙ্কশাস্ত্রে আমি যখন নেহাতই কাঁচা।

আমার মুখভাব নিশ্চয় বিহুল আকার ধারণ করেছিল। রবি রে তা অবলোকন করে বিলক্ষণ প্রীত হয়েছিল। সহাস্যে বলে গেছিল, ইন্দ্র, হিরে নামক পাথরটা পাথর-হৃদয় ললনাদের প্রাণাধিক প্রিয় দোস্ত হতে পারে, কিন্তু হিরে ব্যবসায়ীরা ওই কুহাকে ভোলে না। তারা চলে সরল পাটিগণিতের হিসেবে। প্রতি বছর পৃথিবীর বুক খুঁড়ে তোলা হয় একশো কুড়ি মিলিয়ন ক্যারাট ওজনের আকাটা হিরে। রাফ ডায়মণ্ড।

একটু থ’ হলাম। কিন্তু মুখে সেই ব্যঞ্জনা আনলাম না। সপ্রতিভ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কত টন বল, মাথায় ঢুকবে।

চব্বিশ টন।

এবার ঢোঁক গেলার প্রবল ইচ্ছেটাকে প্রবলতর সংযম সহকারে সামলে নিয়ে বললাম, চব্বিশ টন! হিরে!

আজ্ঞে! যা ধরে যায় একটা মাত্র ট্রাকে। এক ট্রাক হিরে-জঞ্জাল বিক্রি হয় কিন্তু মাত্র সাত বিলিয়ন ডলারে। যে জঞ্জাল তুলতে খরচ হয়েছে দু’বিলিয়ন ডলার বেচে লাভ হয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। লাভের অঙ্কটা কী মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো নয়?

আমি, চৌকস নামে পরিচিত এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ভ্যাবাচাকা ভাবটাকে ম্যানেজ করে নিয়ে বলেছিলাম সপ্রতিভ স্বরে, খদ্দেরদের কাছে, মানে, হিরে-চোখো মেয়েগুলোর কাছে এই হিরে যখন ঝকঝকে চকচকে হয়ে গিয়ে পৌঁছয়, তখন কামায় কত ডলার?

বেশি না, মুচকি হেসে বলেছিল রবি রে, পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার। অলঙ্কার-টলঙ্কারে সেটিং হয়ে যাওয়ার পর।

এইবার আমার মাথা ঘুরে গেছিল। বুরবক মেয়েগুলোর জন্যেই চলছে হিরে নিয়ে এলাহি কারবার। এক লরি হিরের জঞ্জাল মেয়েদের মানিব্যাগ থেকে বের করে আনছে পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার।

মাই গড!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *