০৮. মূল্যবোধ ও কল্পনা প্রসূত পরিকল্পনা

মূল্যবোধ ও কল্পনা প্রসূত পরিকল্পনা
VALUES AND VISION
সঠিক উদ্দেশ্যে সঠিক কাজ করা
Doing the right thing for the right reason
অধ্যায় -৮

মহাত্মা গান্ধীর মতে ৭টি মারাত্মক পাপ হল–

সম্পদশালীর কর্মহীনতা, বিবেকহীন আনন্দ উপভোগ, চরিত্রহীন জ্ঞান, নীতিবোধহীন ব্যবসা, মানবিক চিন্তা বিহীন বিজ্ঞান, আত্মত্যাগ বিহীন ধর্ম এবং নীতিহীন রাজনীতি।

একটি শিশুর জন্ম হলে কারা আনন্দ করেন? বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব। কিন্তু শিশুটি কাঁদে। আমরা যখন মারা যাই ঠিক উল্টোটাই হওয়া উচিত। আমাদের আনন্দ হবে এই ভেবে যে, আমরা পৃথিবীতে কিছু অবদান রেখে যাচ্ছি এবং যে অবস্থায় পৃথিবীকে দেখেছিলাম, তার থেকে ভালো অবস্থায় রেখে যাচ্ছি। সবাই এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করুক যে, পৃথিবী একটি সৎ ব্যক্তিকে হারিয়ে দরিদ্রতর হয়ে গিয়েছে।

আমরা কেবল নিইনি, কিছু দিয়েছি।

শেষবার যখন প্রশংসাত্মক উক্তি শুনেছেন, সেই সময়ের কথা ভাবুন। মানুষ শ্রদ্ধা জানানোর সময় জীবদ্দশায় যে সব ছোট ছোট দাক্ষিণ্য দেখিয়েছেন সেই ঘটনাগুলির উল্লেখ করে। দয়া ও সহানুভূতি মাথা ছোট্ট ঘটনাগুলি কখনও দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।

বস্তৃত পক্ষে কোনও ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর সেগুলি বেশি করে স্মরণে আসে। সেই সময়েই মানুষ বুঝতে পারে যে ছোটখাট দয়া ও দাক্ষিণ্যের গুরুত্ব তাদের কাছে কত বেশি।

মানুষ যা পেয়েছে, তার জন্য তাকে সম্মান জানানো হয় না, মানুষ পৃথিবীকে যা দিয়েছে তার জন্যই তার সম্মান।-Calvin Coolidge

মূল্যবোধ কিভাবে বিচার করবেন? (How do we judge our value system?)

আমাদের মূল্যবোধের ব্যবস্থাটিকে কিভাবে পরীক্ষা করবেন? আমার বিশ্বাস দুভাবে পরীক্ষা করা যায়। চুড়ান্ত যে পরীক্ষা তার নাম। MAMA TEST আপনি যখন যে কাজ করেন বাড়িতে কিংবা কর্মস্থলে, একা কিংবা অন্য কারো সঙ্গে সেই কাজ সম্পর্কে যদি মূল্যবোধের প্রশ্ন ওঠে- তাহলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, আমার মা যদি আমি এখন যা করছি তাই দেখতেন, তাহলে কি তিনি আমার সম্পর্কে গর্বিত হতেন অথবা লজ্জায় তার মাথা হেঁট হোততা? এতে আপনার মূল্যবোধ তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়ে যাবে। যদি এই MAMA পরীক্ষায় পাশ করেন এবং অন্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, তাহলে আপনার মূল্যবোধের পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছেন বলে মনে করতে পারেন।

কিন্তু যদি আপনি মাতৃ-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন কিন্তু অন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তাহলেও আপনার মূল্যবোধ বিপর্যস্ত বলে ধরে নিতে হবে।

এই পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে চিন্তা করুন। যখনই মূল্যবোধের ওপর কেন নিদিষ্ট ধারণা পাওয়ার দরকার হবে, তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যা করছি তা যদি মা দেখতেন তাহলে তিনি গর্বিত হতেন, না লজ্জায় মাথা নত করতেন। আপনার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মেঘ দ্রুত কেটে যাবে এবং আপনার জবাব পেয়ে যাবেন।

যদি মাতু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হন তাহলে আর একটি পরীক্ষার কথা বলব, তার নাম BABA TEST অথবা পিতৃ-পরীক্ষা। যখন যেখানে যা কিছু করছেন সেই সময় নিজেকে প্রশ্ন করুন, যদি আমার ছেলেরা আমাকে এই কাজ করতে দেখত, তাহলে কি, তাদের এই কাজ দেখাতে পারতাম, অথবা সজ্জিত বোধ করতাম?

পুনরায় সন্দেহের মেঘ, আপনার মন থেকে দ্রুত সরে যাবে এবং আপনি প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।

যদি এই দুটি পরীক্ষা মানুষের মূল্যবোধের সমস্যাটিকে পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে সেই ব্যক্তি মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার অনুপযুক্ত, তার বিবেক বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।

কিভাবে আমাদের মূল্য বোধের কাঠামোটি পরিবর্তিত হয়?
(How does our value system Change?)

ক্রমাগত বাইরের জগতের সংস্পর্শ এলে যা অস্বচ্ছ তাও গ্রহণীয় বলে মনে হয় এবং ধীরে ধীরে অসহ্য অবস্থাও গ্রহণযোগ্য হঘে উঠে। যখন ধীরে ধীরে এই ভাবে পরিবর্তনের পথ দিয়ে যায়, তখন যথার্থতা গড়ে ওঠে।

সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে (Times are changing)

আমরা নতুন প্রজন্মের কথা বলি, তাদের পরিণতি কী? তাদের মূল্যবোধ কিরূপ? তাদের দোষ দেওয়ার পূর্বে আমরা কি বিচার করে দেখি দোষটা প্রকৃত পক্ষে কার?

আমাদের স্মরণ করা উচিত যে, মূল্যবোধ এবং সব গুনাবলী বংশানুক্রমিক নয়। সেগুলি শিখতে হয়।

আমাদের অগ্রাধিকার গুলিকে যথাযথ ভাবে বিন্যাস করা দরকার।

আমরা জীবিকার জন্য কী করি? আমরা জীবিকার বিষয়টি কি ভাবে দেখি? (What we do for a living versus what we do with a living)

সমস্তরকম কাজের অর্থমূল্য নির্ধারণ করা যায় না। মাতা-পিতা যখন শিশুদের বড় করেন তখন তারা অর্থ-মূল্যের প্রত্যাশা করেন না। অনেক অর্থবান ব্যক্তি কিন্তু মনের দিক থেকে দরিদ্র। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, আমাদের অর্থ সম্পদ থাকবে কিন্তু মানসিক দিক থেকেও ধনী হবো।

অর্থের প্রভাব যখন প্রবল হয়, তখন সত্যের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। জীবনে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, উপার্জন না করে লোকে অর্থ পেতে চায় অর্থ উপার্জন করা অপেক্ষাকৃত সহজ কিন্তু অর্থ রাখা খুব কঠিন।

পৃথিবীর সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতম সব কিছুই স্পর্শ ও দৃষ্টির অতীত। সেগুলি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা উচিত। -Helen Keller

কঠোর শ্রম মানুষকে অর্থের মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে। এই কারণেই অল্পবয়সীদের পিতা-মাতার পক্ষে তাদের সন্তানদের এই শিক্ষা দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্মের যারা

আমাদের উত্তরাধিকারী হয়েছে অথচ সম্পদের অর্থ বোঝেনি, তাদের জন্য দুঃখ হয়। শিক্ষা

পাওয়ার ফলে নতুন প্রজন্মের তরুণ সমস্ত কিছু অর্থমূল্যে নির্ধারণ করে। তারা ভাবে যে সব জিনিসই কেনা যায় বা বিক্রয় করা যায়-অবশ্যই এটা সত্য নয়। মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের কোন অর্থমূল্যে কেনা যায় না, এবং তারাও তাদের ওপর কোনও মূল্য আরোপ করেন না।

চরিত্র অমূল্য (It is priceless-character)

Indecent Proposal নামে একটি চলচ্চিত্র এই ব্যাপারটিকে পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

একটি ব্যভিচারের ঘটনার জন্য ১০ লক্ষ ডলার অর্থ মূল্যদিতে হয়।

লোকে বিবেককে বিসর্জন দিয়ে রাতারাতি সাফল্য লাভ চায়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। সত্যিকারের মূল্যবোধ অমূল্য। যখন অর্থের বিনিয়ে মূল্যবোধকে নষ্ট করা যায় বা কেনা যায় তখন মূল্যবোধ অর্থহীন হয়ে যায়। কোনও আর্থিক লাভে দ্বারা এই ক্ষতিপূরণ করা যায় না।

অর্থসঙ্গতি অবশ্যই ভালো কারণ অর্থের ক্রয়ক্ষমতা আছে। কিন্তু অর্থ উপার্জনের জন্য আমরা এমন জিনিস নষ্ট করতে চাই না যা অর্থের দ্বারা ক্রয় করা যায় না। অর্থের ক্রয় ক্ষমতা নির্দিষ্ট বস্তুতেই সীমাবদ্ধ। বস্তৃতপক্ষে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসই অর্থের দ্বারা কেনা যায় না।

অর্থের দ্বারা কী কেনা যায় না? (What money wont buy?)

জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুগুলি অর্থের দ্বারা কেনা যায় না। সচরাচর শোনা যায় যে, প্রত্যেক মানুষেরই একটি মূল্য আছে। যে সব মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন, তারা নিজেদেরকে বিক্রয়যোগ্য বলে মনে করেন।

চরিত্রবান, সৎ এবং যথার্থমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষকে অর্থের দ্বারা কেনা যায় না।

অর্থের দ্বারা কেনা যাবেঃ

  • আমোদ প্রমোদ কিন্তু সুখ নয়।
  • বিছানা কিন্তু দ্রিা নয়।
  • পুস্তক কিন্তু প্রজ্ঞা নয়।
  • ঘড়ি কিন্তু বেশি সময় নয়।
  • সহচর কিন্তু বন্ধু নয়।
  • মূল্যবান জিনিস কিন্তু সৌন্দর্য নয়।
  • খাদ্য কিন্তু ক্ষুধা নয়।
  • বাড়ি কিন্তু গৃহ নয়।
  • ওষুধ কিন্তু স্বাস্থ্য নয়।
  • আংটি কিন্তু বিবাহ নয়।

জীবনে দুধরনের হতাশাজনিত দুঃখ আছে (There are two kinds of tragedies in life)

১। আমরা যা চাই তা না পাওয়ার দুঃখ (Not getting what we want)

যারা দুঃখ ভোগ করেছে, তাদের প্রার্থনা
(A creed for those who have suffered)

আমি ঈশ্বরকে বললাম শক্তি দাও, আমি যেন সাফল্য লাভ করতে পারি কিন্তু তিনি আমাকে করলেন দুর্বল ফলে আমি বিনম্রচিত্তে আদেশ পালন করতে শিখলাম আমি চাইলাম সুস্বাস্থ্য, যেন আমি কঠিন কাজের উপযুক্ত হতে পারি। কিন্তু আমি পেলাম অশক্ত শরীর ফলে উন্নততর কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে পারলাম না। আমি সম্পদ চাইলাম যাতে আমি সুখী হতে পারি, আমি পেলাম দারিদ্র, যা আমাকে দিল গভীর জ্ঞান, আমি চাইলাম ক্ষমতা, যাতে অনেক মানুষের সপ্রশংস দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ হয়। আমি পেলাম দুর্বলতা, যার ফলে আমি সর্বদাই ঈশ্বরের প্রয়োজন অনুভব করি। জীবনকে উপভোগের জন্য আমি সমস্ত কিছুই চাইলাম আমি পেলাম জীবন, যার ফলে আমি সব জিনিস উপভোগ করি। আমি যা চেয়েছিলাম, তা কিছুই পাইনি, কিন্তু আমি যা পেলাম তার প্রত্যেকটি আমি আশা করেছিলাম। আমার অনুচ্চারিত প্রার্থনা ঈশ্বর পূর্ণ করেছেন, সব মানুষের মধ্যে আমি সবথেকে উত্তম আশীর্বাদ ধন্য।

–অনামা কবি।

২. আকাঙিক্ষত প্রাপ্তি ঘটার দুঃখ (Getting what we want)

যখন আমাদের মূল্য-বোধের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়, তখন আমরা যা চাই তা পাওয়া গেলেও সেটি বড় রকমের হত্যাশার দুঃখে পর্যবসিত হতে পারে। রাজা মিডাসের গল্প এই অবস্থার উদাহরণ।

মিডাসের স্পর্শ (The Midas touch)

লোভী রাজা মিডাসের অনেক ধন-দৌলত ছিল, কিন্তু যা ছিল, তার থেকেও বেশি পাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তার ধনাগারে অনেক সোনা জমিয়ে রেখেছিল এবং প্রত্যেকদিন ধনগারে বসে সঞ্চিত সোনার হিসাব করত। একদিন ধনাগারে বসে হিসাব করছিল, তখন হঠাৎ একজন অপরিচিত ব্যক্তি আবির্ভূত হয়ে বললেন, তিনি একটি বর দিতে চান। রাজা খুশি হয়ে বললেন, তহালে এই বরদিন, আমি যা স্পর্শ করব তা সোনা হয়ে যাবে। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সত্যই এই বর চাও? রাজা বললেন, হ্যাঁ। তখন আগন্তুক বললেন যে, কাল সকালে সূর্যের আলোতে তুমি স্পর্শের দ্বারা সোনা করার ক্ষমতা লাভ করবে।

রাজা ভাবলেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন, এ সত্য হতে পারে না। কিন্তু পরদিনই যখন তিনি শয্যা, বস্ত্র, এবং আরও অন্যন্য জিনিস স্পর্শ করলেন তখনই তা সোনা হয়ে গেল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন তার মেয়ে বাগানে খেলা করছে। ভাবলেন মেয়েকে তার ক্ষমতা দেখিয়ে আশ্চর্য করে দেবেন। কিন্তু বাগানে যাওয়ার আগে তিনি একটি বই পড়তে শুরু করলেন, কিন্তু স্পর্শ করা মাত্র বইটি সোনা হয়ে গেল। তিনি বইটি পড়তে পারলেন না। তারপর তিনি প্রাতরাশের জন্য বললেন কিন্তু যখনই জল বা জলের পাত্র স্পর্শ করলেন তখনই তা সোনা হয়ে গেল।

ক্ষুধার্ত রাজা মনে মনে ভাবলেন, আমি তো আর সোনা খেতে বা পান করতে পারি না, ঠিক সেইসময়ে তার মেয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল এবং সঙ্গে সঙ্গে বালিকাটি একটি সোনার মূর্তিতে পরিণত হোল। তারপর রাজার মুখে আর কোন হাসি রইল না। রাজা মাথা নিচু করে কাঁদতে শুরু করলেন।

সেই অপরিচিত ব্যক্তি পুনরায় আবির্ভূত হয়ে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্পর্শে সোনা হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা পেয়ে রাজা খুশি হয়েছেন কিনা? রাজা বললেন যে পৃথিবীতে তার থেকে দুঃখী লোক আর কেউ নেই। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করলেন, এখন আপনি কী চান? আপনার খাদ্য, প্রিয় কন্যা অথবা সোনার তাল ও কন্যার স্বর্ণমূর্তি।

রাজা আকুল হয়ে, কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইলেন, তিনি বললেন, আমি আমার সব সোনা বিলিয়ে দেব, কারণ মেয়েকে হারালে, আমার জীবনের কোনও অর্থ থাকবে না।

আগন্তুক রাজাকে বললেন, আগের থেকে তুমি জ্ঞানবান হয়েছে। এই বলে তিনি সেই যাদুশক্তি প্রত্যাহার করে নিলেন। রাজা তার মেয়েকে ফিরে পেলেন এবং এমন একটি শিক্ষা পেলেন যা জীবনে কোনও দিন ভুলবেন না।

এই গল্পটির নীতিশিক্ষা কী?

(১) বিকৃত মূল্যবোধ গভীর দুঃখের পথে নিয়ে যায়।

(২) কখনও কখনও আকাক্ষিত বস্তুর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির থেকে বেশি দুঃখের কারণ হয়।

(৩) ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়দের পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু জীবনের খেলার কোন পরিবর্তন বা পুনরাবৃত্তি চলে না। আমরা জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ নাও পেতে পারি যাতে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে, যেমন রাজার ক্ষেত্রে হয়েছিল।

আপনি কিভাবে স্মরণীয় হতে চান? (How would you like to be remembered?)

একশত বছর আগে এক ব্যক্তি সকালবেলার খবরের কাগজে শোক-সংবাদে নিজের নাম দেখে বিস্মিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। খবরের কাগজ ভুলক্রমে ভুল লোকের মৃত্যুর খবর ছাপিয়েছে। তিনি কিন্তু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিহল হয়ে পড়লেন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি? আত্মসংবরণ করার পর তার দ্বিতীয় চিন্তা হোল তার মৃত্যুসংবাদ পাঠ করে তার সম্পর্কে লোকে কী ভাবছে।

খবরের কাগজে প্রকাশিত তার মৃত্যুসংবাদটির শিরোনাম ছিল, ডাইনামাইটের রাজা মারা গেছেন। তার সম্পর্কে আরও ছিল। তিনি ছিলেন মৃত্যুব্যবসায়ী। এই ভদ্রলোকই ডাইনামাইটের আবিষ্কর্তা এবং যখন তিনি দেখলেন যে তাকে মৃত্যব্যবসায়ী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি নিজেকে জিজ্ঞেসা করলেন, এই ভাবেই কি আমি মানুষের কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকব?

এই চিন্তা তাকে ব্ৰিত করে তুললো এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই ভাবে তিনি মানুষের মধ্যে স্বরণীয় হবেন না। সেই দিন থেকেই তিনি পৃথিবীতে শান্তির জন্য চেষ্টা শুরু করলেন। তার নাম ছিল এ্যালফ্রেড নোবেল বর্তমানে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য স্বরণীয় হয়ে আছেন।

যে ভাবে এ্যালফ্রেড নোবেল তার অন্তরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করতে গিয়ে মূল্যবোধকে নৃতন ভাবে বিন্যস্ত করলেন আমাদেরও সেই ভাবে শান্ত চিত্তে চিন্তা করে ঐরকম করা উচিত।

পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আপনি কী রেখে যাচ্ছেন?

আপনি কিভাবে স্মরণীয় হতে চান? লোকে কি আপনাকে ভালো বলবে? তারা কি আপনাকে ভালোবাসা এবং সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করবে? আপনার অভাব কি তার অনুভব করবে? ছোট ছোট জিনিসই বৃহৎ পার্থক্য তৈরি করে (It is the little things that make a big difference)

সমুদ্রের তীরে এক ব্যক্তি প্রাতঃভ্রমণ কালে দেখলেন যে সকালের ঢেউ এর সঙ্গে শতশত তারামাছ বেলাভূমিতে চলে আসে এবং ঢেউ চলে গেলে বেলাভূমিতে গড়াগড়ি দেয়। তারপর রোদের তাপে তারা মরে যায়। লোকটি যখন এই দৃশ্য দেখেন; তখন তারা মাছগুলি জীবিত ছিল। তিনি একটি তুলে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দিলেন।

এই ভাবে বেশ কয়েকটিকে জলে ছুঁড়ে বাঁচিয়ে দিলেন। তার পিছনেই ছিল আরও এক ব্যক্তি, যিনি লোকটির কান্ড বুঝতে পারছিলেন না। তিনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কী করছেন? বেলাভূমিতে শত শত তারা-মাছ পড়ে আছে, আপনি কয়টিকে এইভাবে সাহায্য করতে পারেন। এতে কি ক্ষতিবৃদ্ধি পাবে? সেই ব্যক্তি কোনও জবাব পিলেন না, এগিয়ে গিয়ে আরও ১টি তারা-মাছ তুলে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দিলেন এবং বললেন, অন্তত ১টির ক্ষেত্রে তফাৎ তো হল।

আমরা কী তফাৎ করছি?

ছোট হোক বড় হোক যদি প্রত্যেকেই কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করে তাহলে সম্মিলিত ভাবেই একটি বড় ভালো কাজ হয়ে যায়। সেই চেষ্টা করা কি আমাদের উচিত নয়?

আপনার জীবন কি না করার উপযুক্ত? (ls your life worth saving?)

নদীতে ডুবে ডুবে যেতে একটি বালক চিৎকার করে সাহায্য চাইল। এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি নদীতে ঝাপিয়ে বালকটির প্রাণ বাঁচালেন। তারপর যখন ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন, তখন বালকটি বলল, ধন্যবাদ। ভদ্রলোক বললেন, কিসের জন্য? বালকটি বললো, আমার জীবন রক্ষা করার জন্য।

ভদ্রলোক বালকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাছা! তুমি যখন বড় হবে, তখন তোমার জীবন এমনভাবে গড়ে তুলবে, যেন মনে হয় তোমার জীবন বাঁচাবার উপযুক্ত ছিল।

এখন চিন্তা করার সময় এটি কেবল জাগিয়ে দেওয়ার আহান। পরিপূর্ণতা ছাড়া সাফল্য অর্থহীন। অর্থ এবং উদ্দেশ্য যদি না থাকে, জীবন শূন্য এবং অসুখী হয়, তা যতই সম্মান, অর্থ এবং উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি থাকুক না কেন?

যখন আপনি আপনার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সম্পদ সমাজ, পরিবার এবং সাফল্যের দর্শন তৈরি করেন তখন থেকেই আপনার সাফল্যের সূচনা। একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং দর্শন আপনাকে পরিচালিত করবে। সেইটি ছাড়া জীবন অবশ্যই চিন্তা দিয়ে পরিচালিত হয়। মানুষ যদি সাফল্যের দর্শনের সুনিদিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে না পারে তাহলে সাফল্যের দর্শনের অভাবই হবে অসাফল্যের সূচনা।

অনেক সময় আমরা কোন কোন জিনিস অগ্রাহ্য করি যা অগ্রাহ্য করা উচিত নয় আবার যা অগ্রাহ্য করা উচিত তাকে অগ্রাহ্য করি না।

একটি উন্নত মূল্যবোধের ধারণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে জীবনের মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।

অঙ্গীকারবদ্ধতা(Commitment)

যখন আমাদের মূল্যবোধ খুব পরিষ্কার তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া সোজা হয়ে যায়-উদাহরণ?

শত্রুর কাছে দেশের গোপন তথ্য পাচার করে দেওয়ার পর আপনি দেশের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারেন না। আপনার বন্ধু বিশ্বাস করে যে কথা বলেছে, তা অপরের কাছে বলে দেওয়ার পর বন্ধুত্ব রাখতে পারেন না।

কোনও কাজে স্বল্প সময় ব্যয় করে আপনি কাজের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতা দেখাতে পারেন না।

যদি অঙ্গীকার ঠিকমত রাখা না হয়, তাহলে তাকে বলা যায়-অসাধু ব্যবহার। ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত কোনও সম্পর্কই যথাযথভাবে ফলপ্রসূ হবে না যদি লোকে বলে

  • আমি চেষ্টা করব, কিন্তু আমি কথা দিতে পারছি না।
  • আমি কাজটি করব কিন্তু আমার ওপর নির্ভর করবেন না।
  • আমি ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করব কিন্তু আমার ওপর বেশি আশা রাখবেন না।
  • যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ভালো করছ, ততক্ষণ আমি তোমার সঙ্গে আছি।
  • অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু না পাওয়া পর্যন্ত আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো।

যদি নিম্নলিখিত পারস্পরিক সম্পর্কগুলি নির্ভরযোগ্য না হয় তাহলে পৃথিবীতে কোন কিছু সম্পর্কই কাজে লাগবে না :

  • পিতা-মাতা / সন্তান • খরিদ্দার / বিক্রেতা • ছাত্র/শিক্ষক • বন্ধু / বন্ধু
  • নিয়োগকর্তা / কর্মচারী • স্বামী / স্ত্রী।

সম্পর্কের অনিশ্চয়তা উম্মাদ করে দিতে পারে।

আমাদের সম্পর্কের দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আজকাল পতিজ্ঞাভঙ্গ করাকে একটা বৃহৎ বিচ্যুতি বলে মনে করা হয় না।

অঙ্গীকারবদ্ধতা না থাকলে সমস্ত সম্পর্কের মধ্যেই তিক্ততা জন্মায়।

অঙ্গীকারবদ্ধতার অভাবে কোনও সম্পর্কই সুস্থির হয় না এবং পারস্পরিক নিরাপত্তার অভাববোধ সৃষ্টি করে। কেউই বুঝতে পারে না পরস্পরের ওপর নির্ভর করা যায় কিনা।

অঙ্গীকারবদ্ধতার অর্থ

(১) নির্ভরশীলতা (২) বিশ্বাস যোগ্যতা (৩) অনুমান সাধ্য (৪) সঙ্গতি (৫) যত্নশীলতা (৬) সহমর্মিতা (৭) কর্তব্যবোধ (৮) আন্তরিকতা (৯) চরিত্র (১০) নৈতিক বিশুদ্ধতা (১১) আনুগত্য।

এর মধ্যে যে কোনও একটি উপাদান না থাকলে অঙ্গীকারবদ্ধতার শক্তি নষ্ট হয়।

যখন কোন ব্যক্তি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তখন সে মনে মনে এই কথাই বলে, যাই ঘটুক না কেন তুমি আমার ওপর নির্ভর করতে পারো এবং তোমার যখনই প্রয়োজন হবে, আমি ৩খনই উপস্থিত হবো। নিঃস্বার্থভাবে যে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, সে মনে মনে বলে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে তোমার প্রতি আমার ব্যবহার অনিশ্চিত নয়।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না কেন?

  • আপনার জীবনে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে।
  • আমার জীবনে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে।
  • বাহ্যিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
  • অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও যিনি অঙ্গীকারবদ্ধ হন, তিনি মনে মনে বলেন, আপনি আমার সাহায্যে ভরসা করতে পারেন।

যিনি অঙ্গীকারবদ্ধ হন, তিনি অনেক কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। কিসের জন্য?

উত্তর খুব সহজ : এই ত্যাগের পুরস্কার খুবই মূল্যবান হতে পারে। অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষ বলেন :

১। আমি ত্যাগ করতে প্রস্তুত কারণ আপনার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিই।

২। আমি একজন নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি, আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

৩। আমি আপনাকে বিপন্ন করব না।

৪। কষ্ট হলেও আপনার পাশে থাকব।

৫। সুসময়ে কিংবা দুঃসময়ে আমি আপনাকে বিপন্ন করবো না।

অঙ্গীকার আইনী চুক্তির মত নয়, একে বিধি অনুযায়ী কার্যকর করা যায় না। স্বাক্ষরিত কোন চুক্তি এর ভিত্তি নয়। এর ভিত্তি চরিত্র, নীতিবোধ এবং সহমর্মিতা।

অঙ্গীকারের অর্থ অনন্যোপায় হয়ে কাউকে সাহায্য করা নয়। অঙ্গীকারের অর্থ বিশেষ মাথা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগ না নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে গিয়ে বিপন্নকে সাহায্য করা।

উপরোক্ত উপাদানগুলি ছাড়া, অপরের প্রতি কোন দীর্ঘমেয়াদী অঙ্গীকার করা উচিত নয়।

কি কারণে অঙ্গীকার রক্ষা করা উচিত?

অঙ্গীকার রক্ষা করলে :

  • ব্যবহার অনুমান করার ক্ষমতা বাড়ে।
  • নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
  • ব্যক্তিগত উন্নতি ঘটে।
  • ব্যক্তি এবং সমাজের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
  • স্থায়ী পেশাগত ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়।

এমনকি গুন্ডা দলের সর্দার কিংবা জুয়াচোররাও অঙ্গীকারবদ্ধ সহচরের সন্ধান করে বেড়ায়।

অঙ্গীকার একটি জঙ্গলের মধ্যে একখন্ড সবুজ ঘাসের জমির মত একটি নিরাপত্তার আশ্রয় সৃষ্টি করে। অঙ্গীকারের অর্থ আমাদের ব্যক্তিগত অভাববোধকে দুরে সরিয়ে রেখে অন্য একজন মানুষের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা।

স্মরণ রাখবেন প্রয়োজন অভাবের থেকেও শক্তিশালী; অঙ্গীকারবদ্ধতা মানুষের সম্পর্ককে দৃঢ় নিবদ্ধ করে। অঙ্গীকারের অর্থ স্বেচ্ছায় নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে দুঃখ বরণ করা।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়—

১। বন্ধুত্বের প্রতি অঙ্গীকারের অন্তর্নিহিত অর্থ বিশ্বাস রক্ষা করা।

২। খরিদ্দারের প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ, ভালো পরিসেবার ব্যবহার করা।

৩। বিবাহের প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ পারস্পরিক বিশ্বস্ততা রক্ষা করা।

৪। বার্জিত রুচির প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ অমার্জিত ব্যবহার থেকে দূরে থাকা।

৫। দেশ প্রেমের প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ আত্মত্যাগ।

৬। নিজের কাজের প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ সততা।

৭। সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের অর্থ দায়বদ্ধতা। অঙ্গীকার মানুষ হিসাবে পূর্ণতা প্রাপ্তির লক্ষণ। অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তি সমস্যার সূচনাতেই পালিয়ে যায় না, যার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধতা আছে তারাই সবল সমাজ গড়তে পারে।

বিভিন্ন মানবিক সম্পর্ক কেবলমাত্র নৈকট্য ও সৌহার্দ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনা, অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠ হলেই কিন্তু পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতা জন্মায় না। মূল্যবোধ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে অঙ্গীকারহীন সম্পর্ক গড়ে ওঠাকে ভালো মনে করেন। অনেকে কোন বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে ইচ্ছুক নন, কারণ তাদের ধারণায় তারা প্রস্তুত নন। অথচ ইতিমধ্যে বছরের পর বছর অনেক জিনিস পরস্পর ভাগাভাগি করে নেন এবং এক সঙ্গে ব্যবহার করেন। তাদের অজুহাত হোল, আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আগে পরস্পরকে বিচার করে দেখেছি। কিন্তু যা তারা কয়েক দিনে, কয়েক মাসে বা কয়েক বছরে বিচার করে উঠতে পারেন না তারা আর কিভাবে বিচার করবেন?

যখন সব কিছু ভালোভাবে চলে তখন যারা নিজের কোলে বেশি ঝোল টানতে যান, তারা আমার মতে, স্বার্থপর পরোপজীবী তারা কেবলমাত্র নিতেই জানে এবং কালক্রমে সমাজের কাছে দায় স্বরূপ হয়ে ওঠে। অনেকেই অঙ্গীকার এবং স্বার্থ চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ হওয়া-এই দুই এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলে।

মানবিক সম্পর্কে কেবলমাত্র ভালোবাসা এবং আবেগ নয়, অঙ্গীকারও সহমর্মিতার জন্য স্থায়ী হয়।

অঙ্গীকারের অর্থ হোল অপরের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের আগে স্থান দেওয়া। কখনও কখনও সৎ উদ্দেশ্য সম্পন্ন ভালো লোকেরা পরস্পর বিরোধী অঙ্গীকারের সম্মুখীন হন।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় :

(১) একজন পুলিশ কর্মচার মত্যুশয্যায় শায়িতা তার স্ত্রীর সেবা শুশ্রষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু হঠাৎ খবর এলো যে শহরের অন্য প্রান্তে ১০ জনের জীবন হানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে সেই অবস্থার মোকাবিলা করতে হবে। সে তখন কী করবে?

(২) একজন শল্য চিকিৎসক তার কন্যার স্নাতক হওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অনুষ্ঠানের সমস্ত অতিথিরা এসে গেছেন। কিন্তু শুরু হওয়ার আগে খবর এলো, দুর্ঘটনায় পতিত এক ব্যক্তির জরুরী অপারেশন করা দরকার। তিনি তখন কোনটি বেছে নেবেন?

দুইটির মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার অর্থ এই নয় যে অন্যটির প্রতি তার কোন অঙ্গীকারবদ্ধতা নেই। এই ধরনের বেছে নেওয়ার পিছনে অগ্রাধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ কাজ করে।

একটি অঙ্গীকার ছেড়ে অন্যটি পালন করলে নিজেকে দোষী বোধ করার কোন কারণ নেই। শল্য চিকিৎসকের সম্ভবত তার কন্যার স্নাতক হওয়ার অনুষ্ঠানটিতে যোগদান করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি কী চাইছিলেন সেটি বড় কথা নয়, অঙ্গীকারের অন্তর্নিহিত অর্থ হিসাবে আমরা যে ১১টি উপাদানের কথা বলেছি, সেগুলি নিয়েই বিচার করতে হবে। অঙ্গীকার রক্ষা চরিত্রের দৃঢ়তা প্রকাশ করে। আপন আপন আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজনের মধ্যে দ্বন্দ উপস্থিত হয়, তখন মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের অগ্রাধিকার ঠিক করে নিতে হয়।

বিবাহের সম্পর্কের মধ্যে দুজন মানুষ পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। ধরুন একজন ১ বৎসরের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ল তাহলে কি অপরজন মনে করবে যে তাকে ঠকানো হয়েছে? অথবা তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই কারণে সে কি অভিযোগ করবে?

অন্যজনকে তার জীবন নষ্ট করার জন্য দায়ী কবে?

এটি অঙ্গীকারবদ্ধতার লক্ষন নয়। এটি ফেসব স্বার্থপরতা। সম্পর্ক বিছিন্ন হয়ে যাওয়াটাই অঙ্গীকারের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক। যদি কোন ত্রুটি বিচ্যুতির ফলে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলেও অঙ্গীকার নষ্ট হয় না। ক্ষমা এবং সহানুভূতির সঙ্গে এটিকে বিচার করা প্রয়োজন। কী কাজ করার ফলে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার মূল্যায়ন করা উচিত।

কোনও কাজের ফলে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলে বলা যায়, তুমি আমাকে একর ঠকিয়েছে, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত, আমাকে দুবার ঠকালে লজ্জা আমারই। যে ভাবেই হোক নিজের স্বার্থে ক্ষমা করাই একমাত্র পথ। বলা হয়ে থাকে, আঘাতের ক্ষত শুকিয়ে যায়, কিন্তু ক্ষত চিহ্ন থেকে যায়।

ক্ষমা ছাড়া অঙ্গীকারকে রক্ষা করা কঠিন হয়। উদাহরণ-মিথ্যা কথা বলে কিংবা চোখে ধুলো দিয়ে একটি ছেলে তার বাপ মায়ের বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারে। লোকে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত থাকে কারণ অনেক সময় তাদের দৃষ্টি অল্প সময়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।

আমাদের মহত্তম অঙ্গীকার কী? (What is our greatest commitnient?)

যদি আমাদের মূল্যবোধ ও বিবেকের বিরুদ্ধে অবিবেচনা প্রসূত এবং অনৈতিক ভাবে কোনও ভুল অঙ্গীকার করে থাকি তাহলে কী হবে? সেই সময় আমাদের পূর্ণ মূল্যায়ন করা aft যে, আমরা অঙ্গীকার মত অগ্রসর হব কিনা।

মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার (Commitment to values)

আনুগত্য কেনা যায় না, অর্জন করতে হয়। এবং আমরা কার প্রতি অনুগত থাকব? না : প্রতি না সংস্থার প্রতি।

উত্তর হচ্ছে কারুর প্রতি নয়। আমরা মূল্যবোধের প্রতি অনুগত থাকব।

পরস্পর বিরোধী মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ একই বাড়িতে বাস করতে কিংবা একই সংস্থায় কাজ করতে পারে না।

যখন কোনও ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তি বা সংস্থার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করে তখন সে মনে মনে বলে, আমি তোমার পাশেই থাকব, কারণ তুমি যা বিশ্বাস কর, আমিও তাই বিশ্বাস করি। যার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ-তিনি নেহাত পত্নী, নিয়োগকর্তা মনিব, অধস্তন কর্মচারী হাত পারেন-যদি তিনি শক্রদেশের গুপ্তচর হন? অঙ্গীকারবদ্ধ বলেই কি আমি তাকে সমর্থন করব? কখনই নয়। আমি অনৈতিক এবং বেআইনি কাজ সমর্থন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ নই।

অঙ্গীকার রক্ষা না করলে–

  • পরিবার ভেঙ্গে যায়।
  • ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের সঙ্গলাভে বঞ্চিত হয়।
  • পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
  • মানসিক চাপ খুব বেড়ে যায়।
  • অপরাধবোধ জন্মে।
  • অতৃপ্ত জীবন-যাপন করতে হয়
  • ব্যবসায়ে ক্ষতি হয়।
  • নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।
  • মানসিক অবসাদ বাড়ে। অঙ্গীকার করুন এবং অঙ্গীকারবদ্ধ থাকুন নৈতিক সততা (Ethics)।

মূল্যবোধ ও নৈতিক সততা কেবল সুসময়ে অনুসরণ করার জন্য নয়- এর দ্বারা দুঃসময়কেও প্রতিহত করা যায়। এটি একটি সুশাসিত দেশের আইনের মত যার সাহায্যে শুধু শিষ্টের পালন নয়, দুষ্টের দমন করা যায়।

অনেক পছন্দই নৈতিকতার ভিত্তিতে পছন্দ নয়। যেমন কী পোশাক কেনা হবে। কিংবা কোন টিভি-এগুলি ব্যক্তিগত সুবিধার ভিত্তিতে পছন্দ করা হয়। কেউ হয়ত বেশি অর্থব্যয় করতে পারবে না বলে সোনির বদলে প্যানাসনিক টিভি কেনে। এগুলি নৈতিকতার ভিত্তিতে পছন্দ নয়। ব্যক্তিগত পছন্দ সব সময়েই আত্মবাদী বস্তুগত নয়। এর ধ্যে যদিও কোন নৈতিকতা নেই কিন্তু একটা দায়িত্ববোধ সব সময়েই কাজ করে। নৈতিক পছন্দ ভালো মন্দ নিরপেক্ষ।

এই জন্যই, যখন আমরা কোনও অনৈতিক পছন্দ করি তখন আমাদের বিবেক পীড়িত হয়; কিন্তু যখন ভুল ব্যক্তিগত পছন্দ করি তা বিবেক ক্লিষ্ট হয় না। ব্যক্তি পছন্দ করে বলে পছন্দকে ব্যক্তিগত বলা হয়-কিন্তু পছন্দটি ভালো কী মন্দ তা ব্যক্তি নিরপেক্ষ।

অঙ্কের পরীক্ষায় যেমন, পরীক্ষার্থীদের উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সঠিক উত্তর একটাই এবং উত্তরটা কেউ পছন্দ করেছে বলে সঠিক নয়- সঠিক উত্তর পছন্দ নিরপেক্ষ।

এটা অবশ্য ঠিক যে, নৈতিক পছন্দ অঙ্কের উত্তরের মতো নয়; একজন ভদ্রমানুষ সৎ ও নৈতিকবোধ সম্পন্ন মানুষ নাও হতে পারেন। সামাজিকতার দিক থেকে দেখলে একজন মানুষ বেশ সদাশয় হতে পারে, কিন্তু সে আসলে হয়ত একজন প্রতারক ও মিথ্যাবাদী, লোকটি আসলে সদাশয় কিন্তু অনৈতিক। সদাশয়তা তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় দেন, কিন্তু একজন ভালো লোক বলে মেনে নেওয়া যায় না।

বস্তুতপক্ষে আজকাল আমাদের সমস্ত পছন্দই নির্ভর করে :

১. আমাদের সুবিধা, স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দের উপর।

২. যা ভালো মনে কর তাই কর-এতে ভালো হবে, এই বোধের উপর। এই বিচারের মান হচ্ছে ভালো মনে করা, দায়িত্বপূর্ণ কাজ করা নয়।

৩. প্রত্যেকেই সামাজিক খেয়ালীপনাও প্রচার করে; সুতরাং আমিও করব।

সাধারণত এই ধারণা আছে যে নৈতিক সততা ও নৈতিক পছন্দের বিষয়টি বিভ্রান্তিকর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কারা এটিকে বিভ্রান্তিকর মনে করে। যাদের মনে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট।

অবস্থাগত নৈতিকতা (Situational ethics)

যারা মনে করেন যে নৈতিকতার বিষয়টি সর্বজনীন নয়, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, তারা অবস্থান্তরে তাদের নৈতিক অবস্থারটির পরিবর্তন করে এটিই হোল অবস্থাগত নৈতিকতা।

এটি সুবিধার নৈতিকতা, নৈতিকতায় বিশ্বাস নয়। পরিমাপের মানদণ্ড (Benchmarks)

মানদণ্ড থাকে কেন? কারণ তা দিয়ে পরিমাপ করা যায়। ইউরোপের এক মিটার, এশিয়ারও এক মিটার। সবজায়গাতেই এক কিলোগ্রাম ময়দা এক কিলোগ্রামই হবে। যে সব মানুষ নৈতিকতার মানদণ্ড অনুসরণ করতে চায় না, তারা নৈতিকতার সংজ্ঞাকে বারে বারে বদলান এবং বলেন ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই; মানুষ ব্যাখ্যা করে ভালো মন্দ তৈরি করেছে। তারা বলেন,  আমার ব্যবহার ঠিক আছে আপনার ব্যাখ্যাই গুলিয়ে ফেলেছেন।

যেমন হিটলার মনে করতে পারত যে সে যা করেছে তা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি সঠিক কাজ করেছিলেন? ক্ষুধার্তকে খাবার কেনার পয়সা দেওয়া সঠিক; কিন্তু মাদক কেনার জন্য পয়সা দেওয়া ঠিক নয়। সর্বজনীনতাই মানদণ্ড তৈরি করে; অবস্থা তার ব্যতিক্রম মাত্র। যেমন নবহত্যা গর্হিত কাজ। এটি একটি সাধারণ কথা ও সর্বজনীন সত্য এবং এটিই নৈতিক মানদণ্ড।

আত্মরক্ষার জন্য না হলে নরহত্যা সম্পর্কে এই মানদন্ডটিই গ্রাহ্য। অবস্থান্তরে এই মানদণ্ডের পরিবর্তন হয় না; অর্থাৎ আজ আবহাওয়া ভালো সুতরাং আজ নরহত্যা ঠিক আছে; কিন্তু আজ নরহত্যা করার ইচ্ছা হচ্ছে। কোনও ব্যক্তি, তার পেশা ছাড়া অন্য বিষয়ে বিশেষ আগ্রহের মধ্যে তার সত্তাটি প্রকাশিত হয়। যে ভাবে তিনি তার অবসর সময় যাপন করেন, তার প্রভাব পরে তার পেশার ওপর। যিনি মাদকাসক্ত নন, তার চেয়ে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির টাকার অভাবে বেশিরভাগ সময়েই অফিসের তহবিল ভাঙ্গার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

আমরা যে উপদেষ্টা নিয়োগ করি, যে সরবরাহকারী আমাদের জিনিসপত্র সরবরাহ করে কিংবা যে সমস্ত খরিদ্দারের সঙ্গে ব্যবসা করি তাদের মধ্যেও আমাদের নৈতিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার মধ্যে মতামতের পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু কতকগুলি মূল্যবোধ যেমন

ন্যায়পরায়ণতা, সুবিচার, নৈতিক সততা এবং অঙ্গীকারবদ্ধতা সর্বজনীন এবং চিরন্তন। ভিন্ন ভিন্ন সাংকৃতিক আবহাওয়ার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। কোন সমাজেই কখনও কাপুরুষতা সাহসের উপরে স্থান পায় না। নীতিবোধ এবং সুবিচারের মধ্যে আছে–

  • সহমর্মিতা • ন্যায়পরায়নতা • আহত ব্যক্তির প্রতি মমতা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ।

কেবলমাত্র সংখ্যাধিক্য ব্যক্তি কোন বিষয়ে একমত হলেই বিষয়টি নীতিগতভাবে ঠিক বলে গ্রহণ করা যায় না। যেমন: যদি ১০ জন বেকারগ্রস্ত ব্যক্তি ১ জন নিরীহ ব্যক্তিকে প্রহার করার ন্যায় মর্ষকামী কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে সেই কাজটিকে সঠিক বলা যায় কি না। মাধ্যাকর্ষনের নিয়মের মত নীতিশাস্ত্রের সূত্রগুলিও সর্বজনীন। যেমন শৃঙ্খলাবোধ ছাড়া স্বাধীনতা ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তেমনি, আদর্শ ছাড়া সমাজও আত্মকেন্দ্রিক হত, তাহলে কোন অপরাধী জেলে যেত না, তাহলে পুলিশ-বাহিনীরও কি দরকার হোত?

সমাজ ভালো না খারাপ তা নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের মূল্যবোধের উপর। নৈতিক মূল্যবোধই সমাজকে শক্তি দেয়। কিছু লোক মাদক গ্রহণ উপভোগ করে। তারা এতে আনন্দ পায়। তাতে কি সমাজের ভালো হয়?

যারা আপেক্ষিক তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তারা বস্তুতপক্ষে নিজেদের আত্মবিরোধীতায় আটকে পড়েন। তারা বলেন প্রত্যেক জিনিসই আপেক্ষিক।

এটিই ধ্রুব সত্য। এটি পরস্পরবিরোধী। ভালো ও মন্দের, সততার ও অসততার মধ্যে তফাৎ আছে আর তার দ্বারাই বোঝা যায় যে সততা অসততা দুইই আছে। কোন একটি বিষয় বোঝাতে এক শব্দের বদলে অন্য শব্দ বসালে তার অর্থ ও বদলে যায় না। যেমন লেভেল বদলালে ভিতরের বস্তুটির পরিবর্তন হয় না।

মানুষ নৈতিক মূল্যবোধকে নতুন নাম দিয়ে পরিবর্তণ করতে চাইছে এবং সংবাদ মাধ্যম সেগুলিকে আকর্ষণীয় করে তুলছে। মিথ্যাবাদীকে বলা হয়, কল্পনাশক্তি সম্পন্ন বহির্মুখ ব্যক্তি। ১৯৯৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মাইকেল সোভার্ন যখন পদত্যাগ করলেন, একজন সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কি কোন কাজ অসমাপ্ত রেখে যাচ্ছেন।

হ্যাঁ সোভার্ন জবাব দিলেন – আত্মসন্তুষ্টির মত শোনালেও আমি বলব,

কেবল একটি কাজ বাকি আছে।

তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টিতে শিক্ষাদানের অভাব আছে।

গড়পড়তা প্রাক – স্নাতক শ্রেণীর ছাত্ররা এই বিষয়ে কোন শিক্ষা পায়না। অধিকাংশ শিক্ষক এই বিষয়টি আলোচনা করতে ভয় পান। কার ফল হল যে দেশে যে সব যুবকদের নৈতিক প্রশিক্ষণের দরকার বেশি তারা এ বিষয়ে অনেক কম প্রশিক্ষন পাচ্ছে। নীতি এবং মূল্যবোধ ধর্মের সঙ্গে সমার্থক নয়। নীতি এবং মূল্যবোধ সৎ ব্যবহারের যুক্তিগ্রাহ্য এবং বোধগম্য তত্ত্ব যা শান্তিপুর্ণ সমাজের পক্ষে অপরিহার্য।

নৈতিকতা এবং বৈধতা (Ethics and fegality)

অনেকেই মনে করেন যে নৈতিকতা এবং বৈধতা এক জিনিস নয়। নৈতিকতা অনেক সময় আইন-সম্মত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আবার আইন অনেক সময় নীতিসম্মত হতে পারে বা নাও পারে।

১. একজন জীবনবীমার দালাল বেশি কমিশন পাবার জন্য পৃষ্ঠপোষকদের কাছে ভুল পলিসি বিক্রি করেছে। এটি আইনসম্মত হতে পারে কিন্তু অনৈতিক।

২. একটি কোম্পানী একজন তরুণ কর্মকর্তা গতিসীমার বেশি গতিতে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাবার চেষ্টা করছিল, কারণ তার গাড়িতে একটি আহত বাচ্চা ছিল; তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তিকরার দরকার ছিল। এই প্রসঙ্গে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে আইন ভাঙার প্রশ্ন কেউ তুলবেন না। আইন ভাঙলেও চিকিৎসক ব্যবস্থা করে বাচ্চাটির জীবন বাঁচাবার চেষ্টা না করলেই তা অনৈতিক হোত।

বৈধতা একটি নূ্যনতম মান নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু নীতি এবং মূল্যবোধ এই মানকে ছাড়িয়েও অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। নীতি এবং মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই মূল্যবোধ কাউকে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট করার জন্য নয়-এই মূল্যবোধ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য।

জীবনের উদ্দেশ্য (Purpose of life)

অনেক রকমের আকাঙ্ক্ষা আছে। সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা, আমোদ-প্রমোদ বিসর্জন দিয়ে কর্তব্য পালনের আকাঙ্ক্ষা। উদ্দেশ্যপূরণ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা-জীবনকে যা অর্থপূর্ণ করে তোলে তার জন্য মৃত্যু বরণও করা যেতে পারে। কী লাভ হবে যদি, সমস্ত পৃথিবীটাই লাভ করি, কিন্তু নিজের বিবেক বিসর্জন দিতে হয়? উদ্দেশ্যবিহীন জীবন জীবম্মতের ন্যায়।

জীবনের লক্ষ্য কী? যদি জীবনের উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে উদ্দেশ্য সিদ্ধির আবেগও থাকবে। সুতরাং আগে একটি উদ্দেশ্য স্থির করুন, তারপর আবেগ ও অধ্যবসায় নিয়ে লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হন। প্রত্যেকদিন নিজেকে এই প্রশ্ন করার দরকার, আমি কি জীবনের লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছি? আমি কি এই পৃথিবীকে উন্নততর বাসভূমি হিসাবে তৈরি করতে পারছি

উত্তর যদি না হয়, তাহলে আমি জীবনের ১টি দিন নষ্ট করেছি। আমাদের অবদান অনুপাতে আমরা জীবনের কাছ থেকে পুরস্কার পাব।

যত তাড়াতাড়ি জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করা যায় ততই ভালো। দেখা যায় যে, জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করতে গিয়ে যে অন্তহীন অনুসন্ধান করতে হয় তাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা কেবল ব্যক্তিগত নয়, পরিবারের, সংস্থার এমনকি দেশেরও। একবার আমাদের উদ্দেশ্য এবং মূল্যবোধ স্পষ্ট হয়ে গেলে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থর মধ্যে একটা নৈতিক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া যায়। কখন আমাদের একটি অবস্থান নিতে হবে সেই বিষয়ে সচেতন হই। তখনই স্বল্প মেয়াদী লাভের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী লাভের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করি।

পরিণত বুদ্ধি বিজ্ঞতা এবং পরিণত বুদ্ধি প্রধান সমস্যাগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে।

এমনভাবে অধ্যয়ন করবে, যেন তোমার সময়াভাব নেই, তুমি চিরজীবী। এমনভাবে জীবন যাত্রা নির্বাহ করবে, যেন মনে হয় তুমি আগামীকালই মারা যাবে!-Mahatma Gandhi

অপরকে সাহায্য না করলে, নিজেদের কে সাহায্য করা যায় না,

অপরের জীবনকে ঐশ্বর্যশালী না করতে পারলে, নিজেদের জীবনকেও ঐশ্বর্যশালী করা যায় না।

অপরকে সম্পদশালী না করে আমরা নিজেদের সম্পদশালী করতে পারি না।- Jenette Cole. Spellman College

জ্যানেট কোল একবার বলেছিলেন,  আমাকে একজন লোক দেখান যে নিজেকে সাধারণ লোক বলে মেনে নিয়েছে, এবং আমি আপনাকে একজন লোক দেখাবো যার ভাগ্যে অসাফল্য সুনিশিত।

জীবন দর্শকদের সামনে দেখানো খেলা নয়। আমরা শুধু বসে বসে যা ঘটছে তা দেখতে পারি না। জীবনকে অর্থময় করার জন্য একটি উদ্দেশ্যের অনুসন্ধান করতে হয় এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য চেষ্টা করতে হয়।

আমরা সকলেই একটি লক্ষ্য সাধনের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছি। আমরা একটি বির অংশ, কিন্তু কম লোকই জীবনের বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের জীবনের লক্ষ্য আবিষ্কার করতে পারে। আমাদের মধ্যে অনেকেই শুধু দিন গুনে জীবন যাপন করি।

ডঃ এ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি। তিনি জবাব দিলেন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি যদি আকস্মিকতা হয়, আমরাও তাই। কিন্তু যদি এই মহাবিশ্বের কোন অর্থ থাকে তাহলে আমাদের অস্তিত্বেরও কোন অর্থ আছে। এবং তিনি আরও যোগ করলেন, আমি যতই পদার্থবিদ্যা পড়ছি, ততই আমি দর্শনের দিকে আকষ্ট হচ্ছি।

যে লক্ষ্য শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হবে, সেই লক্ষ্যে আমি প্রাথমিকভাবে সফল হওয়ার থেকে, যে লক্ষ্য শেষপর্যন্ত সফল হবে, সেই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হওয়াকে আমি বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। -woodrow wilson

আমরা কোথা থেকে আমাদের মূল্যবোধ শিখি? (Where do we learn our values from?)

নিউ জার্সির টিনেক-এর একটি হাইস্কুলে একজন শিক্ষক মূল্যবোধ ব্যাখ্যা করে একটি ক্লাস নিচ্ছিলেন। ক্লাসের একটি মেয়ে ১০০০ ডলার সমেত একটি টাকার পলি কুড়িয়ে পেয়ে সেটি তার মালিককে ফিরিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী জানালো যে মেয়েটি বোকামো করেছে। অনেক ছাত্র বললো যে কেউ অমনোযোগী হলে তার শান্তি পাওয়া উচিত। শিক্ষকটিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হোল যে তিনি ছাত্রদের কী বলেছিলেন, তিনি জানালেন, আমি অবশ্য কিছু বলিনি। কাজটির ভালো-শব্দ বিচার করা আমার পক্ষে উচিত হবে না, কারণ আমি তো তাদের উপদেষ্টা নই। আমার মত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারিনা।

যদি আমরা আমাদের মাতা-পিতা এবং শিক্ষকের কাছে মুল্যবোধ না শিখি, তাহলে কার কাছে শিখব? এবং যখন তারা মূল্যবোধ শেখান না, তখন টেলিভিশন বা এই ধরনের অনভিপ্রেত সূত্র থেকে মূল্যবোধ আহরণ করতে হয়। নিঃসন্দেহে এর ফলে মুল্যবোধের বিকৃতি ঘটে। উপরের উদাহরণের বিকৃত মূল্যবোধ সম্পন্ন যে শিক্ষকটির কথা বলা হোল, যে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত নয়।

বিজয় বনাম বিজয়ী (Vinning versius winners) বিজয় এবং বিজয়ী হওয়া এই দুই-এর মধ্যে তফাৎ কী?

বিজয় একটি ঘটনা। বিজয়ী হওয়া একটি মানসিক অবস্থা বিজয়ীরা মূল্যবোধকে ভিত্তি করেই জয়ী হতে পারে।

৩ জন প্রেরণাদায়ক বিজয়ী (Three inspirational winners)

১. অলিম্পিক খেলাধুলা জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা। লরেন্স লেমিক্স ইয়ট প্রতিযোগিতায় বিপদগ্রস্ত এক প্রতিযোগীকে সাহায্য করার জন্য থেমে গিয়েছিলেন। সমস্ত পৃথিবী তা দেখেছিল।

জেতার ইচ্ছা থেকে অপরের জীবনরক্ষা করা তার কাছে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছিল। যদিও তিনি সেই প্রতিযোগিতায় জিততে পারেন নি, কিন্তু এক দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বিজয়ী। পৃথিবীর অনেক রাজা-রাণী তাকে সম্মান জানিয়েছিল। কারণ তিনি অলিম্পিক

খেলাধুলার আদর্শকে জাগ্রত রেখেছিলেন।

২. র্যাকেটবল প্রতিযোগিতা ফাইনালে রুবেন গঞ্জালেস বিশ্ব খেতাবের জন্য খেলছিলেন। যখন ম্যাচ জিততে আর ১টি পয়েন্ট বাকি, তখন গঞ্জালেস একটি খবু ভালো শট খেলেন। রেফারী এবং লাইনম্যান দুজনেই জানালেন যে শটটি খুব ভালো হয়েছে এবং গঞ্জালেসকে জয়ী বলে ঘোষণা করলেন। গঞ্জালেস একটু ইতস্ততঃ করে তার  প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ওই শট ভুল ছিল। ফলে তিনি সেই শটটি হারলেন এবং শেষপর্যন্ত ম্যাচেও পরাজিত হলেন। প্রত্যেকেই বিস্ময়ে স্বঙ্কিত হয়ে গেল। কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল, যখন জেতা তার হাতের মুঠোয় এবং আইনত সব সিদ্ধান্তও তার পক্ষে তখন সে নিজেই নিজের ভুল ধরিয়ে হেরে যাবে।

তিনি কেন এরকম করলেন জিজ্ঞাসা করাতে গঞ্জালেস বললেন, আমার নৈতিক সততা রক্ষা করার জন্য এটি আমাকে করতে হয়েছে। তিনি ম্যাচটি হারলেন, তবুও কিন্তু বিজয়ী রইলেন।

৩. একদল বিক্রেতা একটি সভায় যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে তাদের পরিবারকে এই বলে বেরিয়েছিলেন যে শুক্রবার সন্ধায় বাড়ি ফিরে রাতের কাবার খাবেন। কিন্তু মিটিং এ যা হয়, এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে আলোচনা চলে যায়, ফলে সময়ে মিটিং শেষ হল না। খুব দেরী হওয়ার জন্য বিমানে ফেরার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হলেন। শেষ মুহূর্তে বিমান বন্দরে পৌঁছে, বিমানে ওঠার জন্য দৌড়ে বিমানের দিকে এগিয়ে গেলেন। দৌড়াবার সময় একজনের সঙ্গে একটি টেবিলে ধাক্কা লেগে টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে ফল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আঘাত পেলেও তাদের থামার সময় ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিমানে উঠে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু একজন উঠে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিমান থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর তিনি যা দেখলেন তাতে তার আনন্দ হলো এই ভেবে যে তিন তার বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এসেছেন। তার ধাক্কায় যে টেবিলটি উল্টে গিয়েছিল তার পেছনে বসে ১০ বছরের একটি অন্ধ মেয়ে ফল বিক্রি করছিল; এই ফল বিক্রি করেই সে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। সে বলল, আশা করি তোমার ফুল বিক্রি একেবারেই নষ্ট হবে না। পকেট থেকে একটি দশ ডলারের নোট বার করে মেয়েটিকে দিয়ে বলল,  এতেই তোমার ক্ষতিপূরণ হবে এই বলে সে চলে গেল। মেয়েটি কিছুই দেখতে পেল না, শুধু শুনলো পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে সে তখন পিছন থেকে চিৎকার করে বলল,  তুমি কি ঈশ্বর?

লোকটি সেই বিমানে যেতে পারল না। কিন্তু তবুও সে বিজয়ী। মেডেল না পেয়েও কেউ বিজয়ী হতে পারে। আবার মেডেল পেলেও সে পরাজিত বলে গণ্য হতে পারে; যদি জয় সঠিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে না পাওয়া যায়।

জয় একটি ঘটনা; কিন্তু বিজয়ী হওয়া একটি মানসিক অবস্থা (winning is an event, being a winner is a spirit)

কয়েকশ প্রতিযোগীর সঙ্গে ৩ ব্যক্তি ম্যারাথন দৌড় দৌড়েছিল, মেডেল পেলেন একজন চতুর্থ ব্যক্তি। কিন্তু তার মানে কি এই যে এই তিনজনই হেরে গিয়েছিলেন? না-তা নয়। তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন। একজন গিয়েছিলেন শ্রম সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করার জন্য এবং দৌড়ের শেষে তিনি বুঝতে পারলেন যে তার শ্রম সহিষ্ণুতা তার প্রত্যাশার থেকে উন্নত হয়েছে।

দ্বিতীয়জন তার আগের বারের থেকে উন্নতি করতে চেয়েছিলেন, এবং তিনি তা করেছেন।

তৃতীয়জন কখনও জীবনে ম্যারাথন দৌড়ে দৌড়াননি। তার লক্ষ্য ছিল দৌড় শেষ করা এবং সমাপ্তি রেখায় পৌঁছানো। তিনি তা করেছিলেন।

এতে কী বলা হোল?

৩ জনই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে দৌড়ে যোগ দিয়েছিলেন সুতরাং তারা সবাই বিজয়ী, মেডেল যিনিই পান না কেন। মার্ক টোয়েন বলেছিলেন যোগ্য না হয়ে যোগ্যতার সম্মান পাওয়া থেকে, যোগ্য হয়ে যোগ্যতার সম্মান না পাওয়া ভালো। কারণ প্রাপ্তিতে নয়, যোগ্য হওয়াতেই আছে প্রকৃত মর্যাদাবোধ।

যদি জেতাই একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে মানুষের অন্তরের মধ্যে যে পুরস্কারের আশা থাকে, সেগুলি থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সম্মানের সঙ্গে, যোগ্যতার সঙ্গে জয় করা কেবলমাত্র জয় করার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

অসততার পদ্ধতিতে সফল হওয়ার থেকে সম্মানের সঙ্গে হেরে যাওয়া ভালো। সম্মানের সঙ্গে হেরে গেলে হয়ত প্রস্তুতির অভাব বলে মনে হবে, কিন্তু অসৎ পদ্ধতিতে জিতলে চরিত্রহীনতাই প্রমাণিত হবে। কোনদিন ধরা পড়বে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর একজন মানুষ কী করবে আর কী করবে না, এটাই হচ্ছে তার চরিত্রের প্রকৃত পরীক্ষা। নৈতিক সততার সঙ্গে সমঝোতা করে পথ সংক্ষিপ্ত জয় লাভ করা উচিত নয়। আপনি ট্রফি জিততে পারেন কিন্তু যখন আপনি সত্য জানবেন তখন আপনি সুখী হবেন না। ট্রফি জেতার থেকে একজন ভালো মানুষ হওয়া অনেক গুরুত্ব পূর্ণ।

বিজয়ীরা এমনভাবে সর্বান্তকরণে অনুশীলন এবং জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন, মনে হয় যেন সেই দিনটি তার জীবনের শেষ দিন। কারণ একদিন না একদিন শেষ দিন আসবে। আমরা জানিনা কবে আসবে সেই শেষ দিন, যেদিন তারা চলে যান, তারা বিজয়ী হিসাবেই চলে যান।

কোনও কোনও পরাজয় জয়ের থেকে বেশি বিজয়োল্লাসের কারণ হয়। -Michel de Montaighc বিজয়ীরা উদারচিত্ত (Winners are gracious)

মনে রাখবেন বিজয়ীরা সব সময় উদার চিত্ত। তারা নিজেদের সম্পর্কে অহঙ্কার করেন না। তারা তাদের দলের সদস্যদের শুধু নয় প্রতিযোগীদেরও সম্মান এবং গুণের কদর করেন।

অনেকেই জানেন কিভাবে সফল হতে হয়; খুব কম লোক জানেন সাফল্যলাভের পর কিভাবে আচরণ করতে হয়। সবসময়ই একজনের সাফল্য কিছু ব্যক্তিকে অসুখী করে।

সাফল্যের পরিকল্পনা (Bluprint for success)

সাফল্যের পরিকল্পনা শীর্ষক একটি ৩দিনের আন্তর্জাতিক সেমিনার আমরা পরিচালনা করেছি। সেমিনারটিতে অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা এবং সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের উপযোগী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। যে তত্ত্বের উপর আলোচনা হয়েছিল সেটি হোল, বিজয়ীরা ভিন্ন ধরনের কাজ করেন না, তারা একই কাজ ভিন্নভাবে করেন।

এই তত্ত্বটি নিম্নেদ্ধৃত তত্ত্বটির বিরুদ্ধ তত্ত্ব হিসাবে এসেছিল; তত্ত্বটি হোল,  বিজয়ই সব কিছু নয়, এটি একমাত্র লক্ষ্য। দ্বিতীয় তত্ত্বটিকে যারা সত্য বলে বিশ্বাস করেন তাদের নৈতিক সততা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এই তত্ত্বটি হত্যাকারীর সহজাত প্রবৃত্তি ঐ কথাগুলির বিকৃত অর্থ করে।

যদি যে কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন,  হত্যাকারীর সহজাত প্রবৃত্তি কথাটির অর্থ, জবাব দেবে, ছলে বলে কৌশলে আপনাকে জিততে হবে। এটি হত্যাকারীর সহজাত প্রবৃত্তি এই কথার প্রকৃত অর্থ নয়, এটি নিভেজাল অসততা। একজন ভালো খেলোয়াড়ের কাছে, হত্যাকারীর সহজাত প্রবৃত্তি কথাটির অর্থ ১। শতকরা একশ ভাগ নয়, শতকরা দুশ (২০০) ভাগ আত্মনিয়োগ করা।

২. জিততে হলে প্রতিপক্ষের ভুলের সুযোগ নিতে হবে। এই সুযোগ না নেওয়া ভুল। যাই হোক না কেন অন্যায়ভাবে খেলে জেতাকে হত্যাকারীর সহজাত প্রবৃত্তি বলে না, এটা নির্ভেজাল অসততা। অন্যায়ভাবে জেতা সাময়িক সাফল্য দিতে পারে, কিন্তু তাতে কোন সিদ্ধিলাভের আনন্দ পাওয়া যায় না।

বাস্তবে জীবন একটি প্রতিযোগিতা এবং এতে অংশ গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিযোগীরা বেড়ে ওঠে। প্রশ্নাতীতভাবে লক্ষ্য হচ্ছে জেতার কিন্তু সেই জয় হবে ন্যায়সঙ্গত পথে, নির্ভুলভাবে শোভনতার সঙ্গে এবং নিয়মকানুন মেনে।

বিজয়ীরা উত্তরাধিকার রেখে যায় (Winiers leave a legacy)

মহান ব্যক্তিরা অনেক কিছু রেখে যান। বিজয়ীরা একথা মানেন যে কোন ব্যক্তি এককভাবে বিজয়ী হতে পারেন না। চ্যাম্পিয়ানরা যদিও পদক পান, তারা একথা জানেন যে তাদের সাফল্যের পিছনে অনেক লোক থাকে এবং সেই সব ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া সাফল্য সম্ভব হোত না। তাদের শিক্ষক, প্রশিক্ষক, পিতা-মাতা, উৎসাহী সমর্থক এবং বিজ্ঞ পরামর্শদাতা যারা বিজয়ীদের সাহায্য করেন তাদের ঋণ শোধ করা যায় না। সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখাবার একমাত্র পথ হচ্ছে, যারা বিজয়ীর পথ অনুসরণ করেছেন তাদের সাহায্য করানীচের কবিতায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে।

সেতু নির্মাতা (The Bridge builder)

এক বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ চলেছিলেন রাজপথ ধরে ক্লান্ত, শীতার্ত হয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছলেন এক গভীর প্রশস্ত যাদের কিনারায় যাদরে অন্ধকারে বয়ে চলেছিল এক বিরূপ জলস্রোত, গোধূলির মৃত আলোকে বৃদ্ধ নদী পার হয়ে গেল, সেই বিরূপতার স্রোতধারা তাকে ভয় ধরিয়ে দিতে পারল না; কিন্তু ওপারে নিরাপদে পৌঁছে সে ফিরে দাড়ালো এবং স্রোতের ওপরে একটি সেতু তৈরি করল। একজন সঙ্গী তীর্থযাত্রী কাছে এসে বলল,  হে বৃদ্ধ তুমি এখানে সেতু তৈরি করতে গিয়ে শান্তি নষ্ট করছ, দিন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার যাত্রাও শেষ হবে, এই পথে তুমি আর কোনদিন ফিরে যাবে না। তুমি এই প্রশস্ত গভীর খাদ পার হয়ে এসেছো এখন সন্ধ্যায় এপারে এসে কেন তেরি করছ এই সেতু! ধীরে ধীরে তার পুরোনো পাকা মাথা তুললো, সেই সেতু নির্মাণকারী বৃদ্ধ বললেন, যে পথে আমি এসেছি, সেই পথ দিয়ে আমার পরে আজকেই আসছে একটি তরুণ যে এই পথই অতিক্রম করে যাবে। এই খাদ, যা আমাকে বাধা দিতে পারে নি, সেই সুকেশ যুবকের হয়ত পদস্খলন ঘটাবে। এই গোধূলির মান আলোয় সেও তো এই খাদ পার হবে; হে বন্ধু! আমি তার জন্যই এই সেতু তৈরি করছি।–Will Allen Dromogoole

সক্রেটীস প্লেটোকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্লেটো এ্যারিস্টটলকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ব্যারিস্টটল মহান আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। জ্ঞানযদি একজন থেকে আরেক জনে প্রবাহিত না হয়, তাহলে তা শুকিয়ে শেষ হয়ে যায়।

আমাদের মহত্তম দায়িত্ব হচ্ছে যে আগামী প্রজন্মকে এমন একটি উত্তরাধিকার দিয়ে ও, যায় জন্য তারা গর্ব বোধ করবে।

পরিবর্তিত মূল্যবোধ-বর্তমানের মূল্যবোধ (Changing valuesTodays values)

পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, আমরা চাই বা না চাই পরিবর্তন আসবেই। আমাদের প্রজন্মের অনেক দেখা হয়ে গেছে এবং অবস্থানির্ভর মূল্যবোধের ফলে ক্ষমতাবান গোষ্ঠিগুলির ক্ষতি হয়েছে। অন্যায় করে ধরা পড়লে দুঃখিত হয়, কিন্তু অন্যায় করার জন্য অনুশোচনা করে না।

১৯৫৮ সালে আমেরিকার উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের মধ্যে একটি সমীক্ষায় এই প্রশ্ন করা হয়েছিল–

আপনার ছাত্রদের প্রধান সমস্যাগুলি কী কী?

উত্তর ছিল—

(১) বাড়িতে যা কাজ দেওয়া হয়, তা করে না।

(২) জিনিসপত্রের প্রতি কোন মমতা নেই, যেমন- বই ছুঁড়ে ফেলে।

(৩) ঘরের আলো জ্বেলে রাখে, দরজা-জানালা খুলে রাখে।

(৪) ঘরে থুথু ফেলে।

(৫) ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে।

৩০ বছর (এক প্রজন্ম) পরে ১৯৮৮ সালে এই সমীক্ষার একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরগুলি আশ্চর্যজনকভাবে ভিন্ন। বর্তমানে উচ্চ বিদ্যালয়গুলির প্রধান সমস্যাগুলি এরূপ

(১) গর্ভপাত

(২) এইডস (AIDs)

(৩) ধর্ষণ

(৪) মাদকাসক্তি।

(৫) হিংসাত্মক মৃত্যুর আতঙ্ক, হত্যা, বন্দুক এবং বিদ্যালয়ের মধ্যে ছোরা-ছুরির অবাধ চলাচল।

সকল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করার থেকে বরং মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো। –Albert Einstein

পুরোনো মূল্যবোধ অপ্রচলিত হয়ে যায় নি (Old values are not obsolete)

কেউ কেউ মনে করেন যে দায়িত্ব জ্ঞান, নৈতিক সততা, অঙ্গীকার বদ্ধতা, দেশপ্রেম, এই মূল্যবোধগুলি পুরোনো হয়ে গেছে। এগুলি পুরোনো, কিন্তু অপ্রচলিত নয়। এই মূল্যবোধগুলি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এবং চিরকাল মানুষের সমাজে প্রচলিত থাকবে। এই মূল্যবোধগুলির নিউ ইয়র্ক, নিউ দিল্লী অথবা নিউজিল্যান্ড সর্বত্রই একই অর্থ। এগুলি সর্বজনীন। ইতিহাসের এমন সময় বা সভ্যতার কথা জানা নেই, যখন এই মূল্যবোধগুলিকে শ্রদ্ধা করা হয়নি।

মূল্যবোধ সর্বকালের তুলনায় এখন নীচে নেমে গেছে (values are at an all-time low)

যে কোন সমাজে অসততা এবং অবিচার হতাশার সৃষ্টি করে। যারা মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ তারা লোভী এবং অবিবেচকদের অনৈতিক কাজকর্ম ও আমোদ-প্রমোদকে বন্ধু করবে। আমরা পরিবর্তনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি।।

যে সমাজ তার নৈতিক চরিত্র হারিয়েছে, সে সমাজ ধ্বংসের পথে চলেছে। ইতিহাসের সমস্ত পতনই হচ্ছে নৈতিক পতন।

অর্ধশতাব্দী আগে আমেরিকাতে বাজারে চলছিল বিপজ্জনক মন্দা। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থ সম্পদ উবে গেল। ভারী শিল্প শতকরা ৭৭ ভাগ কমে গেল। শ্রমিক শ্রেণীর এক-চতুর্থাংশ বেকার হলো। অনেক শহরে স্কুল-কলেজও খুলে রাখা সম্ভব হোল না। নিউ ইয়র্কের শতকরা ২০ ভাগ ছাত্রছাত্রী অপুষ্টিতে আক্রান্ত হোল। এক সময়ে ৩০ মিলিয়ন পুরুষ মহিলা এবং আধবয়সীদের কোন আয় ছিল না। এই নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও দেশে যখন ব্যাঙ্ক বন্ধু, লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে এবং চারিদিকে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির মিছিল তখন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট জাতির উদ্দেশ্য একটি বেতার বক্তৃতায় বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাদের দুঃখ কষ্ট কেবল পার্থিব বস্তুর অভাবের জন্যই।

গুনবত্তা কী? (What is goodness?)

যদি আমরা একটি সমীক্ষায় মানুষকে একটি প্রশ্ন করি, আপনি কি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, আপনি কি ভালো লোক? অধিকাংশ লোক বলবে,-হ্যাঁ। তাদের জিজ্ঞাসা করুন, আপনি কিসের জন্য ভালো?

উত্তর হবে- আমি ঠকাই না সেই জন্য ভালো। • আমি মিথ্যা কথা বলি না।

  • আমি চুরি করি না।

উপরের যুক্তিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এগুলির মধ্যে কোন সার বস্তু নেই। শুধু মনে করে দেখুন, যে ব্যক্তি বলছে আমি ঠকাই না, তার দ্বারা এই বোঝা যার যে লোকটি প্রতারক নয়। এবং যে দুজন বলছে যে তারা মিথ্যা কথা বলে না এবং চুরি করে, তার অর্থ কেবল এই যে তারা মিত্যুক বা চোর নয়। কিন্তু তার দ্বারা তারনা গুণবান হোল না। একজন লোক গুণবান হতে পারেন, যখন তিনি গর্হিত কাজ না করার থেকে প্রকৃতপক্ষে ভালো কাজ করেন। মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি বলা যাবে তাকে যার ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, সাহস, নৈতিকতা, সততা সহমর্মিতা, বিনয়, আনুগত্য এবং ভদ্রতাবোধ এই গুণগুলি আছে।

এই গুণগুলি থাকলে সেই ব্যক্তি ভালো লোক হবে কেন? কারণ এই গুণগুলি থাকলে তারা এমন মানুষ হন, যার ওপর নির্ভর করা যায়, সুবিচারের জন্য অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে, দুঃস্থকে সাহায্য করে, নিজেদের এবং আশেপাশে যারা থাকেন তাদের জীবনকে উন্নত করেন।

গুণবত্তাকে চিনতে হলে আমাদের মানদন্ড এবং পরিমাপক প্রয়োজন। মানদণ্ড নৈতিক কিংবা আইনানুগ হতে পারে কিম্বা কখনও কখনও দুটিরই সময় হতে পারে। নৈতিক মানদণ্ড কখনও কখনও ভালো এবং আরও ভালো, খারাপ এবং আরও খারাপের মধ্যে যে অস্পষ্ট জায়গা আছে সেই জায়গারও পরিমাপ করে।

আমাদের নৈতিক মান কতটা উচু? How high are our ethical standards?)।

নিম্নলিখিত অবস্থায় আপনি কী করবেন?

(১) আপনি জানেন যে আপনার বাড়ি থেকে বিমান বন্দরে যাওয়ার ট্যাক্সী ভাড় ৬৪ ডলার। আগে আপনি এই ভাড়াই দিয়েছেন এবং জানেন এইটিই সঠিক। এই সময় ট্যাক্সি চালক ৩২ ডলার চাইল। আপনি কী করবেন?

(২) আপনি একটি রেস্তরাঁতে যেতে গিয়েছেন, আপনি চার ধরনের খাবার দিতে বললেন পরিচারক চার ধরনের খাবারই দিল, কিন্তু বিলে ভুল করে তিন ধরনের খাবারের দাম চাইল! আপনি কী কবে?

(৩) আপনার প্রিয়তম বন্ধু মত্যুশয্যায়। এবং আপনি জীবন বীমার এজেন্ট। বন্ধুর পরিবার ১ লক্ষ ডলারের বীমা করতে চাইলেন। কেউ জানে না এবং জানতেও পারবে না যে আপনার বন্ধু মৃত্যুশয্যায়। আপনি কি তাকে ১ লক্ষ ডলারের বীমা করে দেবেন?

আইন করে নৈতিক সততা নিশ্চিত করা যায় না। ওপরের বর্ণিত অবস্থাতে পড়লে আপনার সন্তানদের কী উপদেশ দেবেন?

আপনি যে উপদেশ দেবেন, আপনার ব্যবহার কী সেই উপদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? জন্মের পর আমরা নৈতিকতার শিক্ষা শুরু করি সারা জীবন চলে।

আমরা কি আমাদের নৈতিক ব্যবহার বদলাতে পারি?

হ্যাঁ পারি, তার জন্য আমাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। কী নৈতিক মূল্যবোধকে বিকৃত করে?

  • লোভ • ভয় • মানসিক চাপ।

কাজ করার জন্য যে মানসিক চাপ দেওয়া হয়, সেই চাপ অর্থনৈতিক কাজকর্মের অজুহাত নয়। ন্যায় সঙ্গত ব্যবহার এবং সমান ব্যবহার এক জিনিস নয়।

ব্যবসায়ে নৈতিকতা (Ethics in business)

নৈতিকতা কিংবা নৈতিকতার অভাব সমস্ত পেশাতেই আছে। লোভী ডাক্তারেরা অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। কখনও কখনও অপ্রয়োজনীয় হলেও অপারেশন করে। আইনজীবিরা সত্যকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে দেয়। বাবা-মা ও তাদের সন্তান-সন্ততি মিথ্যে কথা বলে। হিসাবরক্ষক এবং কোম্পানীল সেক্রেটারীরা অনেক সময় মিথ্যে রিপেটি লেখে।

যখন আমরা আমাদের চারিপাশের লোকেদের প্রতারণা করি, আমরা কিন্তু তখন নিজেদের প্রতারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত করছি।

সমৃদ্ধি আনে দায়িত্ববোধ।

নৈতিকতা ও সমাজিক সম্পর্ককে নষ্ট করে শিল্প ও পরিকাঠামো তৈরি করা যায় না। নৈতিক ব্যবহারের সূত্রগুলি অনুসরণ না করলে যে ফল ভোগ করতে হয়, আইনগত ব্যবহারের সূত্রগুলি অনুসরণ না করলে একই ধরনের ফল ভোগ করতে হয়। কিছু লোক আছেন যারা নৈতিকতার কোন মূল্য দেবেন না। তারা মনে করেন সহজ পথে হাঁটছেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই দুর্গম পথ।

আপনি কি নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারেন আপনার মক্কেলের জন্য যা করা উচিত তা যফি না করে থাকেন?

আপনি কি বাচ্চাদের কাছে বড়াই করার পর স্বচ্ছন্দ বোধ করেন? তা যদি না হয়, তাহলে আপনার ব্যবহার অনৈতিক।

নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং হাস্যরসবোধ মানুষকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।

কল্পনাশ্রিত দূরদৃষ্টি (vision)

মানুষ কাজে উৎকর্ষ লাভ করতে পারে না কেন? এর বড় কারণ হোল কল্পনাপ্রসূত দৃষ্টির অভাব অর্থাৎ সীমিত দৃষ্টি। যা সম্ভাব্য তার থেকেও বড় স্বল্প দেখা প্রয়োজন। আমরা আজ যা দেখছি, তা বাস্তব হওয়ার আগে এগুলি স্বপ্নই ছিল।

উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা, নির্দিষ্ট সুনিশ্চিত যাত্রাপথ এবং উৎসাহ নিয়ে জীবনের পথে অগ্রসর হোন।

আপনার কি স্বপ্ন আছে? সেই স্বপ্ন কী জীবনের এক একটি দিন গত হলে, আপনি কি সেই উদ্দেশ্যের কাছাকাছি হচ্ছেন। অসফল ব্যক্তির কাছ থেকে নয়, সফল ব্যক্তির কাছ থেকে উপদেশ নিন। তিনিই আপনাকে বলবেন কিভাবে সফল হতে হয়।

যখন আপনার দৃষ্টি এক বছর পর্যন্ত প্রসারিত
তখন ফুলের চাষ করুন,
যখন দৃষ্টি দশ বৎসর পর্যন্ত প্রসারিত
তখন গাছ লাগান,
যখন আপনার দৃষ্টি অনন্ত কালে প্রসারিত
তখন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। (প্রাচ্য প্রবচন)

স্মরণ রাখবেন বিজয়ীরা ভিন্ন কাজ করেন না, তারা একই কাজ ভিন্ন ভাবে করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *