০৭. আঁচল ডুবিয়ে নাড়া

আঁচল ডুবিয়ে নাড়া দিয়ে দিয়ে তলার জল ওপরে আর ওপরের জল তলায় করছিল ওরা তপ্ত জল শেতল করতে। বেলা পড়ে এসেছে, তবু পুকুরের জল টগবগিয়ে ফুটছে, এ জলে নেমে ঝাপাই বুড়িলে গা ঠাণ্ডা হবার বদলে দাহই হয়, তবু জলের আকর্ষণ তাই বেলা পড়তেই জলে পড়া চাই পাড়ার নবীনাকুলের।

চাটুয্যে-পুকুরের জল তোল মাটি ঘোল করছিল পুণ্য টেঁপি পুঁটি খেঁদি প্রমুখ নবীনারা। সত্য কেন এখনো এসে হাজির হয়নি। তাই ভাবছে ওরা আর অনুপস্থিত সত্যর সন্তোষ বিধানের জন্যেই বোধকরি জল শেতল করার অভিযানটা এত জোর কদমে চালাচ্ছে। সত্য ওদের প্রাণপুতুল।

সত্য কি শুধুই তাদের দলনেত্রী?

ভগবান জানেন কোন গুণে সত্য সকলের হৃদয়নেত্রীও। সত্য-বিহীন খেলা ওদের শিবহীন দক্ষযজ্ঞেরই সামিল। পুকুরে ঝাপাই ঝোড়ার ব্যাপারে সত্যই রোজ অগ্রণী, তাই ওরা বার বার ফুটন্ত জলকে তলা-ওপর করতে করতে এ ওকে প্রশ্ন করছিল, সত্যর কি হল রে? ঘরে তো দেখলাম না? বলেছিল তো ঠিক সময়ে দেখা হবে। বাগানে কোথাও আছে নাকি এখনো? দূর, একা এক কি আর বাগানে ঘুরবে? বেওলা মেয়ে, ভয় নেই পরাণে? ভয়! সত্যুর আবার ভয়! দেখিস ও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাউড়ী পিসশাউড়ীকেও ভয় করবে না। তা আশ্চয্যি নেই, ও যা মেয়ে!

সত্য যে তার সমস্ত সখী-সঙ্গিনীদের প্রাণের দেবতা তার প্রধান কারণ বোধ হয় সত্যর এই নিভীকতা। নিজের মধ্যে যে গুণ নেই, যে সাহস নেই, সে গুণ সে সাহস অন্যের মধ্যে দেখতে পেলে মোহিত হওয়া মানুষের স্বভাবধর্ম। নিভীকতা ব্যতীত ও আরও কত গুণ আছে সত্যর। খেলাধূলোর ব্যাপারে সত্যর উদ্ভাবনী শক্তির জুড়ি নেই, বল আর কৌশল দুই-ই তার অন্যের চাইতে বেশি একশ গুণ। মোটাসোটা একটা গাছের কাটা গুড়িকে দড়ি বেঁধে একা আনা সত্যবতীর পক্ষে আদৌ অসম্ভব নয়, আবার সেই গাছের গুড়িকে গড়িয়ে পুকুরের জলে ফেলে ডিঙি বানানোও সত্যর কৌশলেই সম্ভব।

এর ওপর আবার পয়ার বাঁধা!

পয়ার বাঁধার পর থেকে পাড়ার সমস্ত ছোট ছেলে-মেয়েই তো সত্যর পায়ে বাঁধা পড়েছে।

সেই সত্যর জন্য জল শেতল করছে ওরা এ আর বেশী কথা কী! কিন্তু সত্যর এত দেরি কেন? এদিকে যে এদের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ঠাকুমা-পিসিমা একবার চৈতন্য পেয়ে খোঁজ করলেই তো হয়ে গেল!

নেহাৎ নাকি ঠিক এই সময়টুকুই অভিভাবিকদলের কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রার সময়, তাই এদের এই অবাধ স্বাধীনতা। হ্যাঁ, এই পড়ন্ত বেলাতেই গিন্নীরা একটু গড়িয়ে পড়েন। সারা বছর তো নয়, (মেয়েমানুষের দিবানিদ্রার মত অলুক্ষ্মণে ব্যাপার আর কি আছে সংসারে?) নেহাৎ এই আমের সময়টা।

আমের যে একটা নেশা আছে।

গিন্নীরা বলেন, আমের মদ।

আম খাও বা না খাও, এ সময়ে শরীর টিস টিস করবেই। অবশ্য না খাওয়ার প্রশ্ন ওঠেই না। আম-কাটাল আবার কে না খায়? হরু ভট্টচায্যের মার মত কে আর আম-হেন বস্তুকে জগন্নাথের নামে উৎসর্গ করতে পারে? হরু ভট্টচায্যের মা সেবার শ্ৰীক্ষেত্তর গিয়ে এই কাণ্ড করে এসেছেন, ক্ষেত্তর করার পর জগন্নাথকে ফল দিতে হয় বলে আম ফলটি দিয়ে এসেছেন। মনের আক্ষেপে সেবার হরু ভট্টচায। আমবাগান বেচে দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মার ভোগেই যদি না লাগল। তো, আমবাগানে আমার দরকার? তা ভট্টচায্যের মা ছেলেকে হাতে ধরে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছিলেন, বলেছিলেন, বাবা, আজন্মকাল তো খেয়ে এলাম। তবু খাওয়ার লালসা ঘোচে না, তাই বলি যে দব্যিতে এত আসক্তি, সেই দিব্যিই জগন্নাথকে উছুগু্য করব। তাই বলে তুই বাগান নষ্ট করবি? ছেলে।পুলে খাবে না?

ছেলেপুলে বুড়ো যুবো। আমের ভক্ত সবাই। আমের মরশুমে দিনে এককুড়ি দেড়কুড়ি আম খাওয়া তো কিছুই না

অবশ্য সব আমি সবাই খায় না।

অর্থাৎ পায় না।

সংসারের সদস্যদের শ্রেণী হিসেবেই আমের শ্রেণী হিসেব করে ভাগ হয়। কর্তাদের নৈবেদ্যে লাগে জোর কলম গোলাপখাস, ক্ষীরসাপাতি, নবাব পছন্দ, বাদশা ভোগ, ঢাউশ ফজলী ইত্যাদি, গিন্নীদের জন্যে সরানো থাকে। পেয়ারাফুলি, বেলসুবাসী, কাশীর ছিনি, সিঁদুরে মেঘ।

আর বৌ ঝি ছেলেপুলেদের ভাগ্যে জোটে রাশির আম। তা রাশি রাশি না পেলে যাদের আশ মিটবে না। তাদের জন্যে রাশির বরাদ্দ ছাড়া আর কি বরাদ্দ হতে পারে? বাড়ির ঝুঁড়ি-ঝুড়িতেই কি ওদের আশা মেটে? দু বেলাই জলখাবার ঝুড়ি ঝুড়ি তো পায়, কারণ গিন্নীরা প্রকৃতির এই দাক্ষিণ্যের সময় মুড়ি ভাজা পর্বটি থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই নেন। কিন্তু হলে কি হবে, বাড়ি থেকে মধুকুলকুলি আমের পাহাড় শেষ করেই ওরা তক্ষুণি ছোটে হয়তো বা বৌ পালানে কি বাঁদর ভ্যাবা-চ্যাঁকা আমের বাগানে। বাঘা তেঁতুলের বাবা জাতীয় সেই আমগুলি পার করার সহায় হচ্ছে মুঠো মুঠো নুন অবশ্যি তুচ্ছ হলেও বস্তুটা সংগ্ৰহ করতে বালক-বাহিনীকে বিশেষ বেগ পেতে হয়, কারণ ওর আশ্রয়স্থল যে একেবারে রান্না-ভাঁড়ারে। যা নাকি সম্পূর্ণ গিন্নীদের এলাকা। আর যে গিন্নীরা হচ্ছেন একেবারে সহানুভূতিহীনতার প্রতীক। ছেলেপুলেদের সব কিছুতেই তো তাঁরা খড়গহস্ত। নুন একটু চাইতে গেলেই প্রথমটা একেবারে তেড়ে মারতে আসবেন জানা কথা! তবে নাকি ছেলেগুলোর খুব ভাগ্যের জোর যে প্রায় সব সময়ই ওরা ওনাদের অস্পৃশ্য। কাজেই মারতে আসলেও মারতে পারেন না। তার পর বহুবিধ কাকুতি-মিনতির পর যদি বা দেবেন। তো, সে একেবারে সোনার ওজনে। দেবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন যাচ্ছিস তো টক বিষ আমগুলো গিলতে? ঘরে এত খায়। তবু আশ মেটে না গা! কী রাক্ষুসে পেট গো, কী লক্ষ্মীছাড়া দিশে! মরবি মরবি, রক্ত-আমাশা হয়ে মরবি। সবগুলো একসঙ্গে মনসাতলায় যাবি। যত সব পাপগুলো একত্তর জুটেছে।

গালমন্দ-বিহীন লবণ?

সে ওরা কল্পনাও করতে পারে না।

তবে সত্য আগে আগে চরণ মুদির দোকান থেকে বেশ খানিকটা সংগ্রহ করে আনতে পারত, কিন্তু ইদানীং অর্থাৎ বড় হয়ে ইস্তক মুদির দোকানে ভিক্ষে করতে যেতে লজ্জা করে। বড় জোর দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিতান্ত একটা শিশুকে লেলিয়ে দেয়।

কবরেজের মেয়ে বলে সমাজে সত্যর কিছুটা প্ৰতিষ্ঠা আছে।

সে প্রতিষ্ঠার মর্যাদাটাও তো রাখতে হয়?

আজি দুপুরে আমবাগান-পর্বে সত্য ছিল, তার পর কখন একসময় যেন বাড়ি চলে গিয়েছিল।

খেঁদি একটু কল্পনা-প্রবণ, তাই সে বলে, সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আসে নি তো?

দূর! শ্বশুরবাড়ি থেকে আবার শুধু শুধু কেউ আসবে কেন? আর আসেও যদি, সত্যর সঙ্গে কি? যে আসবে সে তো চণ্ডীমণ্ডপে বসবে।

সহসা পুঁটি চেঁচিয়ে ওঠে, আসছে আসছে!

আসছে! বাবা, ধড়ে পেরাণ পাই।

এত দেরি কেন রে সত্য? আমরা সেই কখন থেকে জল ঠাণ্ডা করছি!

সত্য বিনাবাক্যে গম্ভীর ভাবে ঘাটের পৈঠের ভাঙাচোরা বাঁচিয়ে জলে নামে।

কি রে সত্য, মুখে কথা নেই যে? বাবা, আজ এত পায়া-ভারী কেন রে তোর?

সত্যি একমুখ জল নিয়ে কুলকুচো করে ঠোঁট বাকিয়ে বলে পায়া-ভারী আবার কী! মনিষ্যির রীত-চরিত্তির দেখে ঘেন্না ধরে গেছে!

ওমা, কেন রে? কাকে দেখে? কার কথা বলছিস?

সত্য জ্বলন্ত স্বরে বলে, বলছি আমাদের জটাদার বৌয়ের কথা। গলায় দড়ি! গলায় দড়ি! গলায় দড়ি মেয়েজাতের কলঙ্ক!

সত্যের বয়েস ন বছর, অতএব সত্যর পক্ষে এ ধরনের বাক্যবিন্যাস অসম্ভব, এমন কথা ভাববার হেতু নেই। শুধু সত্য কেন-নেহাৎ ন্যাকাহারা মেয়ে ছাড়া, সে আমলে আট-ন বছরের মেয়েরা এ ধরনের বাক্যবিন্যাসে পোক্তই হত! না হবে কেন? চার বছর বয়স থেকেই যে তাকে পরের বাড়ি যাওয়ার তালিম দেওয়া হত, আর বয়স্কদের মহলেই বিচরণের ক্ষেত্র নির্বাচন করা হত। সে ক্ষেত্রে শিশু বলে কোন কথাই বাদ দেওয়া হত না তাদের সামনে।

কাজেই সত্য যদি কারো উপর খাপাপা হয়ে তাকে মেয়েজাতের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে। থাকে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

পুণ্যি তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে ওঠে, কোন রে, কি হয়েছে?

যম জানে! বলে প্রথমটা খানিকক্ষণ যমের উপর ভার ফেলে রেখে, অতঃপর সত্য মুখ খোলে, জন্মে আর ওর মুখ দেখছি না! ছি:। ছি! গেছলাম! বলি আহা, সোয়ামীর শাউড়ীর ভয়ে রোগের ওষুধ টুকু পর্যন্ত খেতে পায় না, যাই একবার দেখে আসি কেমন আছে। সেজপিসী তারকেশ্বর গেছে শুনেছি, মনটা তাতেই আরও খোলসা ছিল। ওমা, গিয়ে ঘেন্নায় মরে যাই, কী দুষপিবিত্তি, কী দুষপিবিত্তি!

এরা শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে, না জানি কোন ভয়ঙ্কর কাহিনী উদঘাটন করে বসে সত্য।

শুধু পুণ্য ভয়ে ভয়ে বলে, কি দেখলি রে?

কি দেখলাম? বললে পেত্যয় করবি? দেখি কিনা ঘরে জটাদা বসে, আর বৌ। কিনা তাকে পান সেজে দিচ্ছে, আর হাসি-মস্করা করছে।

জটাদা?

খেঁদি পুঁটি সকলে একযোগে বলে ওঠে, ও হরি! এতেই তোর এত রাগ! শাউড়ী বাড়ি নেই, তাতেই বুকের পাটাটা বেড়েছে আর কি।

বুকের পাটা বেড়েছে বলে পান। সেজে খাওয়াবে? হাসি-মস্করা করবে? সত্য যেন ফুলতে থাকে।

পুণ্যি আরও ভয়ে বলে, তা পরপুরুষ তো আর নয়? নিজের সোয়ামী—

নিজের সোয়ামী! সত্য ঝট্‌পট্‌ বার-দুই কুলকুচো করে বলে, খ্যাংরা মারো অমন সোয়ামীর মুখে! যে সোয়ামী লাথি মেরে যমের দক্ষিণ দোরে পাঠায় তার সঙ্গে আবার হাসি-গপপ? গলায় দিতে দড়ি জোটে না? আবার আমায় কি বলেছে জানিস? আমার সোয়ামী আমায় মেরেছে, তোমায় তো মারতে যায় নি। ঠাকুরঝি? তোমার এত গায়ে জ্বালা কেন যে ছড়া বেঁধে গালমন্দ করতে আস? এর পর আবার আমি ওর মুখ দেখব?

আঁচলটাকে গা থেকে খুলে জোরে জোরে জলের ওপর আছড়াতে থাকে সত্য।

সখীবাহিনী কিঞ্চিৎ বিপদে পড়ে।

ওরা অভিযুক্ত আসামিনীকে খুব একটা দোষ দিতে পারে না, কারণ স্বামী একদা একদিন বেদম মেরেছে বলে যে জন্মে আর সে স্বামীকে পান সেজে খাওয়ানো চলবে না, এতটা কঠোর ক্ষমাহীন মনোভাব তাদের পক্ষে আয়ত্ত করা শক্ত। অথচ সত্যর কথার প্রতিবাদ চলে না, সত্যর কথায় সমর্থন না করলে চলে না।

কিন্তু ও কি! ও কি! ও কিসের শব্দ!

হঠাৎ বুঝি ওদের বিপদে রক্ষা করলেন মধুসূদন। পুকুরপাড়ের রাস্তায় তালগাছের সারির ওদিকে যেন অশ্বক্ষুরধ্বনি ধ্বনিত হল।

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ না?

ঘোড়ায় চড়ে কে আসে?

পুণ্যি তড়বড় করে ঘাটে উঠে এগিয়ে দেখে পড়ি তো মারি করে ছুটে আসে, এই সত্য, মেজদা!

মেজদা!

অর্থাৎ রামকালী!

সত্য অবিশ্বাসের হাসি হেসে মুখ ভোঙিয়ে বলে ওঠে, স্বপ্ন দেখছিস নাকি? বাবা না জিরেটে গেছে?

আহা, তা সেখেনে তো আর বাস করতে যায় নি? আসবে না?

ইত্যবসরে ক্ষুরধ্বনি একবার কিছুটা নিকটবর্তী হয়েই ক্রমশ দূরবতী হয়ে যায়।

সত্য গলা বাড়িয়ে একবার দেখতে চেষ্টা করে, তারপর নির্লিপ্তভাবে বলে, যেমন তোমার বুদ্ধি! বাবা বুঝি ঘোড়ায় চড়ে জিরেটে গেছল? নাকি পালকিটা মাঝরাস্তায় ঘোড়া হয়ে গেল!

পালকি! তাও তো বটে! পুণ্যি দ্বিধাযুক্ত স্বরে বলে, আমি কিন্তু সদ্য দেখলাম মেজদা আর মেজদার ঘোড়াটা। বাড়ির দিকেই তো গেল।

তা গেল বটে। তবে কি হঠাৎ জীরেটের সেই রুগীর নেয়-দেয় অবস্থা ঘটেছে! তাই হঠাৎ কোন মোক্ষম ওষুধের দরকার পড়েছে? যার জন্যে পালকি রেখে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসতে হয়েছে চিকিৎসক রামকালীকে?

খেঁদি বলে, যাই হোক বাপু সত্য, তুই বাড়ি যা। কবরেজ জ্যাঠা ভিন্ন এ গোরামে ঘোড়াতেই না চড়বে কে?

এ কথাও খাঁটি।

ঘোড়া আর আছেই বা কার? এ অঞ্চলে কালেকস্মিনে বর্ধমান রাজের কোন কর্মচারী কি কোম্পানির কোন লোক ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসে, নইলে ঘোড়া কে কোথায় পাচ্ছে?

ঘাট থেকে উঠে পড়ে সত্য-বাহিনী।

এখন প্রথমটা সকলেরই সত্য-ভবনে অভিযান। কারণ ঘোড়া-রহস্য ভেদ না করে কে স্থির থাকতে পারবে?

ভিজে কাপড়ে জল সপৃসপিয়ে আর মিলের গোছা বাজিয়ে ওরা রওনা হল, কিন্তু এ কী তাজ্জব! এ যে একেবারে রূপকথার গল্পর মত!

সত্যদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতে হাঁ হয়ে দেখে ওরা রামকালী ফের ফিরে যাচ্ছেন ঘোড়া হাঁকিয়ে, শুধু এবারে বাড়তির মধ্যে তাঁর পিছনে পিঠ আঁকড়ে আর একজন বসে।

সে জনটি হচ্ছে, সত্যর বড়দা।

রামকালী চাটুয্যের বৈমাত্র ভাই কুঞ্জবেহারীর বড় ছেলে রাসবিহারী।

পুণ্যির কথাই সত্যি বটে। অশ্বারোহী ব্যক্তি রামকালীই। কিন্তু এ নিয়ে এখন আর বাহাদুরি ফলায় না পুণ্যি, শুধু হাঁ করে অনেকক্ষণ ঘোড়ার পায়ের দাপটে ঠিকরে ওঠা ধুলোর ঝড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ব্যাপার কি বল তো?

আমিও তো তাই ইনতাম করছি। সত্য অবাক ভাবে বলে, ওষুধ নিতে আসবে। যদি বাবা, তো বড়দাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে যাবে কেন?

সেই তো কথা!

প্ৰচণ্ড গরম, তবু সপ্তসাপে ভিজে কাপড়ের ওপর হাওয়ার ডানা বুলিয়ে যাওয়ার দরুন গা-টা কেমন সিরসির করে এল। সত্য এবার হা করে ভাব করে বিচক্ষণের সুরে বলে, নে নে চল, দোরে দাঁড়িয়ে গুলতুনি করে আর কি হবে? বাড়ি গেলেই টের পাব, কি হয়েছে! তোরা যা, ভিজে কাপড় ছেড়ে আয়। আমি দেখি গিয়ে কি হয়েছে!

কি হয়েছে!

যা হয়েছে তা একেবারে সত্যর হিসেবের বাইরে। শুধু সত্যর কেন, সকলেরই হিসেবের।ংরে। ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে এসে সমগ্র সংসারটার উপর যেন প্ৰকাণ্ড একখানা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফের ফিরে গেছেন রামকালী। সেই পাথরের আঘাত সহজে কেউ সামলাতে পারছে না।

সত্য ভেতরবাড়ির উঠোনে ঢুকে দেখল, উঠোনের মাঝখানে বসানো মরাই দুটোর মাঝখানে যে সরু জমিটুকু, সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে বড়জেঠী, ঠিক যেন কাঠের পুতুলটি, আর দাওয়ায় পৈঠেয় গলে হাত দিয়ে কাঠ হয়ে বসে তার ঠাকুমা। এবং দাওয়ার ওপর জটলা বেঁধে বাড়ির আর সবাই। শুধু যা পিসঠাকুমাই অনুপস্থিত।

অবশ্য সেটাই। স্বাভাবিক, কারণ তিনি এই যবনাচারী দাওয়ায় কখনো পা ঠেকান না। এ দাওয়ায় রাস্তা-বেড়ানো ছেলেপুলে ওঠে, কর্তাদের খড়ম ওঠে।

পিসঠাকুমা না থাক, আর সবাই তো জটলা করছে। কেন করছে? অথচ কারো মুখে বাক্যি নেই কেন? ফিসফিস কথা, ঘোমটার ভেতর হাত-মুখ নাড়ানাড়ি। সত্য ঠাকুমার যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে গা ঘেঁসে বসে পড়ে সাবধানে ইশারায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে গো ঠাক্‌মা?

দীনতারিণী নীরব।

অতঃপর সত্য সরব।

ও ঠাকমা, বাবা আমন করে ছুটে এসেই আবার কোথায় গেল?

কী গেরো! কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন গো? ও ঠাকমা, বাবা জীরেট থেকে আমন হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া ছুটিয়ে এলই বা কেন, আবার ছুটিলই বা কেন? অ ঠাকমা, বলি তোমাদের সব বাক্যি হরে গেল কেন?

একবারও দীনতারিণীর ঠোঁট নড়ে না, তবে ঠোঁট নাড়েন তাঁর সেজজা শিবজায়া। শুধু ঠোঁট নয়, সহসা পা মুখ সব নড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, বাক্যি হরে যাবার মতন কাণ্ড ঘটলে আর হরবে না? তোর বাবা যা অভাবনী কাণ্ড করে গেল?

বাবা বাবা, খুলেই বল না। স্পষ্ট করে! বাবা জীরেট থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেই তক্ষুনি আবার কোথায় গেল?

অ, তবে তো দেখেইছিল। তবে আর ন্যাকা সাজছিল কেন? রাসুকে নে গেল তোর বাবা বে দিতে।

বে দিতে! ধ্যেৎ! সত্য পরিস্থিতির মর্যাদা ভুলে হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে আহা, আমায় যেন ন্যাক পেয়েছে। সেজঠাকুমা, তাই পাগল বোঝাচ্ছে। বড়দার বুঝি বে দিতে বাকি আছে? বলে ছেলের বাবাই হয়ে গেল বড়দা!

গেল তায় কি? এবার হঠাৎ দীনতারিণী মৌন ভঙ্গ করে নাতনীকে ধমকে ওঠেন, বড্ড তো দেখছি ট্যাকটেকে কথা হয়েছে তোর? ছেলের বাবা হলে আর বে করতে নেই? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?

সত্য উত্তর দেবার আগে শিবজায়াই সাংসারিক মাৎস্যন্যায় ভুলে ফস করে বড়জায়ের মুখের ওপর বলে বসেন, মহাভারত অশুদ্ধর কথা হচ্ছে না দিদি, তবে এও বলি রামকালী যে একেবারে কাউকে চোখে কানে দেখতে দিলে না, চিলের মত ছোঁ। মেরে নে গেল ছেলেটাকে, বালস-পোয়াতি বেঁটা, যাত্রাকালে সোয়ামীকে একবার দূর থেকে চোখের দেখাটুকু পর্যন্ত দেখতে পেল না, এটা কি ভাল হল?

কখন যে ইতিমধ্যে মোক্ষদা এসে দাঁড়িয়েছেন এপাশের বেড়ার দরজা দিয়ে, এবং আলোচনার শেষাংশটুকু শুনে নিয়েছেন, সে আর কেউ টের পায় নি। মোক্ষদার থান ধুতি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তোলা, কাঁধে গামছা অর্থাৎ স্নানে যাচ্ছেন মোক্ষদা। অবিশ্যি স্নানে যাচ্ছেন বলেই যে এই ভেতর বাড়ির অর্থাৎ শয়নবাড়ির উঠোনে তিনি পা দিতেন তা নয়, তবে আজকের কথা স্বতন্ত্র। আজকের উত্তেজনায় অত মরণ-বাচন জ্ঞান রাখলে চলে না, আজ নয় ঘাটে দু-দশটা ড়ুব দিয়ে ফের দীঘিতে ড়ুব দিতে যাবেন, তবে এদের মজলিশে যোগ দেওয়াটা দরকার।

মোক্ষদা সেজভাজের কথাটুকু শুনতে পেয়েছেন, এবং তাতেই সমগ্ৰ নাটকটি অনুধাবন করে ফেলেছেন। তাই তিনি তিন আঙুলে হেঁটে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে বলে ওঠেন, কী বললে সেজবৌ, কী বললে? আর একবার বল তো শুনি?

শিবজায়া অবশ্য আর একবার বললেন না, শুধু মাথার কাপড়টা অল্প টেনে মুখটা একটু ফেরালেন।

মোক্ষদা একটু বিষ-হাসি হেসে বলেন, বলতে অবিশ্যি আর হবে না, কানে প্রবেশ করেছে সবই। তবে ভাবছি। সেজবৌ তুমি হঠাৎ এমন ভট্টচায্যি হয়ে উঠলে কবে থেকে? যাত্রাকালে রাসুর আমাদের পরিবারের সঙ্গে চোখাচৌখি হয় নি এই আক্ষেপে মরে যোচ্ছ তুমি? কলি আর কত পুন্ন হবে? চারকাল হয়ে তো কলি এখন উপচোচ্চে। শুভকাজে যাত্রাকালে লোকে ঠাকুর-দেবতার পট দেখে বেরোয়, গুরুজনের চরণ দর্শন করে বেরোয় এই তো জানি, জেনে এসেছি। এতকাল। পরিবারের বদন দর্শন না করে বেরোলে জাত যায়, এটা তুমিই প্রেথম শোনালে সেজবৌ।

শিবজায়া ননদকে ভয় করলেও এতজনের মাঝখানে হেরে যেতে রাজী হন না, তাই বলে ওঠেন, রাসুর কথা আমি বলি নি ছোট্ৰঠাকুরঝি, বড় নাত-বৌয়ের কথা বলছি। আবাণী জানল না। শুনল না। আচমকা মাথায় পাহাড় পড়ল, আপনার সোয়ামী একা আপনার থাকতে থাকতে একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলে না; সেই কথা হচ্ছে।

মোক্ষদা সহসা খলখলিয়ে হেসে ওঠেন, অ সেজবৌ, আর কেন ঘরে বসে আছ? যাত্রার পালা বঁধ না। সত্য পয়ার বেঁধেছে—তুমিই বা বাকি থাক কেন? যা তোমাদের মতিগতি দেখছি, এ আর গোরস্ত-ঘরের যুগ্যি নয়। বুড়ো-মাগী তুমি, চারকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, লজ্জা এল না ও কথা মুখে আনতে? সোয়ামী কি মণ্ডা মিঠাই, যে একলা আস্তটা না খেতে পেলে পেট ভরবে না, ভাগ হয়ে গেলে প্ৰাণ ফেটে যাবে? ছিঃ ছিঃ! একটা ভদরলোকের কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ছুটীল রামকালী, আর তার কাজের কিনা ব্যাখ্যানা বসেছে!

বড়দের এই বাকযুদ্ধের মাঝখানে সত্য হাঁ করে তাকিয়েছিল, মোক্ষদার কথা শেষ হতেই হঠাৎ ঠাকুমার কোলের গোড়া থেকে উঠে সরে এসে বলে বসে, সেজ ঠাকুমা তো ঠিকই বলেছে পিসঠাকুমা। নিয্যসি বাবার অন্যাই হয়েছে।

বাবার অন্যায়! সন্দেহযুক্ত নয়, একেবারে নিয্যস!

উঠোনে কি বাজ পড়ল!

কলিকাল শেষ হয়ে কি প্ৰলয় এল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *