০৬. উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলন

উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো।

তিনদিন ব্যাপী অধিবেশনের প্রথম দিনেই অধিবেশনের মধ্যকালে প্রধান অতিথির ভাষণ উপলক্ষ করে উদ্দাম এক হট্টগোল শুরু হয়ে সভা পণ্ড হয়ে গেল।

আর শুধু যে সেদিনের মতই গেল তা নয়, আগামী কাল পরশুর আশাও আর রইল না। কারণ পরিস্থিতি শোচনীয় তো বটেই, আশঙ্কাজনকও। এই সামান্য সময়েরই মধ্যেই সভা-সজ্জা ভেঙেচুরে পুড়ে এমনই তছনছ হয়ে গেছে যে, তার থেকে সম্মেলনের ভবিষ্যৎ ললাটলিপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ভয়ঙ্কর হৈ-চৈটা কমলে দেখা গেল সভায় সাজানো ফুলদানি ভেঙেছে, মঙ্গলঘট ভেঙেছে, বরেণ্য মনীষীদের ছবি ভেঙেছে, কাঁচের গ্লাস ভেঙেছে, সেক্রেটারীর বাড়ি থেকে সভাপতি প্রধান অতিথি আর উদ্বোধকের জন্য আনীত চেয়ার টেবিল ভেঙেছে এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙেছে।

পুড়েছে প্যাণ্ডেলের বাঁশ, ডেকরেটারের পর্দা চাঁদোয়া, স্থানীয় এক তরুণ শিল্পীর বহু যত্নে তৈরী মণ্ডপের রূপসজ্জা এবং পরোক্ষে সম্মেলন আহ্বানকারীদের কপাল। এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে অর্থ এবং সামর্থ্য তো কম ব্যয় করেননি তারা।

আয়োজনে ত্রুটিমাত্র ছিল না।

বিশেষ আমন্ত্রিতদের সময় ও শ্রম বাঁচাতে, এরা তাদের কলকাতা থেকে আনার জন্যে আকাশযানের ব্যবস্থা করেছিলেন, আকাশ থেকে ভূমিষ্ঠ হবামাত্র উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির ব্যবস্থা রেখেছিলেন, মাল্যে চন্দনে তিলকে ভূষিত করে সসম্মানে গাড়িতে তুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিশ্রাম নিকেতনে।

তাদের শ্রম না হলেও শ্রম অপনোদনের প্রচুর বাবস্থা ছিল, আর তার সঙ্গে ছিল কৃতকৃতার্থের ভঙ্গী।

বাংলা সাহিত্যের ওই শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ দিকপালেরা যে নিজ নিজ বহু মূল্যবান সময় ব্যয় করে উত্তর বাংলার এই সাহিত্য-সম্মেলনকে গৌরবান্বিত করতে এসেছেন এতে স্থানীয় আহ্বানকারীদের যেন কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

প্রধান অতিথিই অবশ্য মধ্যমণি, বাকিরাও সঙ্গগুণে প্ৰাপ্যের অতিরিক্তই পেয়েছেন। অন্ততঃ অনামিকা দেবী তাই মনে করেছেন—এ নৈবেদ্য অমলেন্দু ঘটকের জন্যে—আমরা সর্বদেবতার একজন।

তা সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস, এ তো শাস্ত্রের বচন।

অনামিকা দেবী নিজে একথা ভাবলেও স্থানীয়রা তাকে অমলেন্দু ঘটকের থেকে কিছু কম ন্তব করছিল না। বিশেষ করে মহিলা-পাঠিকা কুল। অনামিকা দেবীর লেখায় নাকি তারা অভিভূত, বিচলিত, বিগলিত। তিনি নাকি মেয়েদের একেবারে হৃদয়ের কথা বুঝে লেখেন। মেয়েদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-হতাশা, ব্যর্থতা-সার্থকতা অনামিকা দেবীর লেখনীতে যেমন ফোটে তেমন বুঝি আর কারো নয়।

উচ্ছাসের ফেনাটা বাদ দিলেও, এর কিছুটা যে সত্যি, সে কথা অনামিকা দেবী কলকাতার বাইরে সুদূর মফঃস্বলে সভা করতে এসে অনুভব করতে পারেন। যারা দূর থেকে শুধু লেখার মধ্যে তাঁকে চিনেছে, ভালবেসেছে, তাদের ভালবাসাকে একান্ত মূল্য দেন অনামিকা দেবী।

কলকাতায় থাকেন, সেখানেও অজস্র পাঠিকা, কে বা তাকে দেখতে আসে, কিন্তু এসব জায়গায় যেন এরা তাঁকে একবারটি শুধু চোখে দেখবার জন্যেই পাগল।

এই আগ্রহে উৎসুক মুখগুলির মধ্যেই অনামিকা দেবী তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সার্থকতা খুঁজে পান। মনে মনে বলেন, হ্যাঁ আমি তোমাদের লোক। তোমাদের নিভৃত অন্তরের কথাগুলি মেলে ধরবার জন্যেই আমার কলম ধরা। আমি যে দেখতে পাই ভয়ঙ্কর প্রগতির হাওয়ার মধ্যেও জায়গায় জায়গায় বন্দী হয়ে আছে সেই চিরকালের দুৰ্গতির রুদ্ধশ্বাস। দেখতে পাই আজও লক্ষ লক্ষ মেয়ে-সেই আলোহীন বাতাসহীন অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এদের বাইরের অবগুণ্ঠন হয়তো মোচন হয়েছে, কিন্তু ভিতরের শৃঙ্খল আজও অটুট।

কলকাতার বাইরে আসতে পেলে খুশী হন অনামিকা দেবী।

কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অন্য হয়ে গেল।

অবশ্য সভায় এসে বসা পর্যন্ত যথারীতিই সুন্দর সৌষ্ঠবযুক্ত পরিবেশ ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে আলাদা আলাদা গাড়িতে করে উদ্বোধক, প্রধান অতিথি এবং সভানেত্রীকে আলাদা আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সভানেত্রীকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির বাড়িতে, উদ্বোধককে একটি বিশিষ্ট স্কুলবাড়িতে এবং প্রধান অতিথিকে স্বয়ং সেক্রেটারীর বাড়িতে!

আলাদা আলাদা করে রাখার কারণ হচ্ছে সম্যক যত্ন করতে পারার সুযোগ পাওয়া! ভা সারাদিন যত্নের সমুদ্রে হাবুড়ুবুই খাচ্ছিলেন অনামিকা দেবী। বাড়ির একটি বৌ কলকাতার মেয়ে, সে এতো বেশী বিগলিত চিত্তে কাছে কাছে ঘুরছিল, যেন তার পিত্ৰালয়ের বার্তা নিয়েই এসেছেন অনামিকা দেবী।

উত্তরবঙ্গে ইতিপূর্বে আসেননি অনামিকা দেবী, ভালই লাগছিল বেশ। অধিবেশনের পালা চুকলে যথারীতি আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে বহির্দৃশ্য দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে। সেটাও ভাল লাগছিল।

মোট কথা, কলকাতা থেকে আসার সময় যে ক্লান্তি এবং অবসাদ ধরনের একটা অনিচ্ছা গ্ৰাস করেছিল, এখানে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সহসা অন্তৰ্হিত হয়ে ভালই লাগিছিল আগাগোড়া। আর অবিরত একটা কথা মনে হচ্ছিল-কতখানি আগ্রহ আর উৎসাহ থাকলে এমন ভাবে হরিদ্বার-গঙ্গাসাগর এক করে এহেন একটি সম্মেলনের আয়োজন ঘটিয়ে তোলা সম্ভব হয়!

সেই আয়োজন ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় তছনছ হয়ে গেল।

এ নিষ্ঠুরতা কার?

মানুষের?

না ভাগ্যের?

গোলমাল শুরু হওয়ার প্রথম দিকে সম্পাদক এবং স্বয়ং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিও, একে একে মাইকে মুখ দিয়ে অমায়িক কণ্ঠে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন, আপনারা ক্ষান্ত হোন, আপনারা শান্ত হোন। আপনাদের যা বক্তব্য তা বলবার সুযোগ আপনাদের দেওয়া হবে। প্রতিনিধি স্থানীয় কেউ মঞ্চে উঠে আসুন।

কিন্তু সে আবেদন কাজে লাগেনি।

বাঁধ একবার ভেঙে গেলে কে রুখতে পারে উদ্দাম জনস্রোতকে?

প্রধান অতিথির ভাষণের সুরে ক্ষিপ্ত হয়ে যারা সভায় একটা ঢিল নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠেছিল, বন্ধ করে দেওয়া হোক, বন্ধ করা দেওয়া হোক, এ কথা চলবে না। তারা ছাড়াও তো আরো অনেক ছিল। যাদের বক্তব্যও নেই, প্রতিবাদও নেই, আছে শুধু দুৰ্দম মজা দেখার উম্মাদ উল্লাস।

ভাঙবার এবং পোড়াবার কর্তব্যভার এরাই গ্রহণ করেছিল।

হয়তো বরাবর তাই করে।

এ দায়িত্ব এরাই নেয়।

সাদা-পোশাক-পরা পুলিসের মতো সর্বত্রই বিরাজ করে এরা শান্ত চেহারায়। প্রয়োজন না ঘটলে হয়তো দিব্য ভদ্রমুখে তারিয়ে তারিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করে অথবা যন্ত্রসঙ্গীতে তাল দেয়। বড়জোর কোনো গায়িকার গানটা ভাল লাগলে, ভিড়ের মধ্যে থেকে-আর একখানা হোক না দিদি-বলে চেঁচিয়ে উঠেই ঝুপ করে আবার বসে পড়ে। এর বেশী নয়।

কিন্তু প্রয়োজন ঘটলে?

বাধা ভাঙলে?

মুহূর্তে ওদের কর্তব্যবোধ সজাগ হয়ে ওঠে। ওরা সেই ভাঙা বাঁধ আরো ভেঙে বন্যার স্রোতকে ঘরের উঠোনে ডেকে আনে। রেলওয়ে স্টেশনের কুলিদের মতো নিজেরাই হট্টগোল তুলে ঠেলা ঠেলি গুতোগুতি করে এগিয়ে যায় চেয়ার ভাঙতে, টেবিল ভাঙতে, মণ্ডপে আগুন ধরাতে।

ও রাস্তা শুধু ওই প্রথমটুকুর।

সেটুকু করেছিল বোধ হয় অতি প্ৰগতিবাদী কোনো দুঃসাহসিক দল। তারপর যা হবার হলো।

মাইকের ঘোষণা, করজোড় প্রার্থনা কিছুই কাজে লাগলো না, ঢিলের পর ঢিল পড়তে লাগলো ঠকাঠক।

অতএব উদ্যোক্তারা তাদের পরম মূল্যবান অতিথিদের নিয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন। সেক্রেটারীর বাড়ি মণ্ডপের কাছে, সেখানে এই বিশেষ তিনজন এবং অবিশেষ কয়েকজন এসে আশ্রয় নিলেন, এবং সেখান থেকেই মণ্ডপের মধ্যেকার কলরোল শুনতে পেলেন।

যাঁরা অনেক আগ্রহ নিয়ে, অনেক আয়োজন করে হয়তো দূর-দূরান্ত থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন, শিশু বৃদ্ধ মহিলা নির্বিশেষে দিগ্বিদিকে ছুটলেন।

কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙা-পর্ব শেষ করে জ্বালানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল তারা।

যাদের মাইক তারা বেগতিক দেখে দড়িদড়া গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়ছিল, তাদেরই একজনের হাত থেকে একটা মাইক কেড়ে নিয়ে কোনো একজন কর্তব্যনিষ্ঠ তারস্বরে গান জুড়েছিল, জীর্ণ প্ৰাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো…আগুন জ্বালো।

এখান থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল সে গান।

অমলেন্দু ঘটক ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ সকলের, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। …সকলের জন্যেই তিনি গান রেখে গেছেন।

তাড়াতাড়ি মঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে কোঁচায় পা আটকে হোঁচট খেয়ে তাঁর চশমাটা ছিটকে কোথায় পড়ে গিয়েছিল, তাই চোখ দুটো তার কেমন অদ্ভুত অসহায়-অসহায় দেখতে লাগছে।

উদ্বোধক বললেন, আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণ পলিটিক্‌স।

সেক্রেটারীর কান এবং প্ৰাণ সেই উত্তাল কলরোলের দিকে পড়েছিল, তবু তিনি এদের আলোচনায় যোগ দেওয়া কর্তব্য মনে করলেন। শুকনো মুখে বললেন, ঠিক তা মনে হচ্ছে না। পাড়ায় কতকগুলো বদ ছেলে আছে, তারা বিনে পয়সায় জলসার দিনের টিকিট চেয়েছিল, পায়নি। শাসিয়ে রেখেছিল, আচ্ছা আমরাও দেখে নেব। সভা করা ঘুচিয়ে দেব।—তখন কথাটায় গুরুত্ব দিইনি, এখন বুঝছি শনি আর মনসার পুজো আগে দিয়ে রাখাই উচিত।

সম্মেলনে আগত কয়েকজন কিন্তু ব্যাপারটাকে পাড়ার কতকগুলো বদ ছেলের অসভ্যতা বলে উড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না, তারা এর থেকে শৌলমারীর গন্ধ পেলেন, নকশালবাড়ির পদধ্বনি আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে জুড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না তারা।

সেক্রেটারীর বড় বাড়ি, দালান বড়।

অনেকেই ঢিল থেকে আত্মরক্ষা করতে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ আলোচনার ধারা অন্য খাতে বাওয়ালেন।

গলার স্বর নামিয়ে বলাবলি করতে লাগলেন তারা, প্রধান অতিথি অবিমৃষ্যকারিতা করেছেন, এরকম সভায় ফট করে আধুনিক সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হয়নি ওর। মৌচাকে ঢিল দিতে গেলে তো ঢিল খেতেই হবে, সাপের ল্যাজে পা দিলে ছোবল।…

আরে বাবা বুঝলাম তুমি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, বাজারে তোমার চাহিদা আছে, যথেষ্ট নামডাক আছে, মানে মানে সেইটুকু নিয়ে টিকে থাকো না বাবা! তা নয়—তুমি হাত বাড়িয়ে হাতী ধরতে গেলে! যুগকে চেনো না তুমি? জানো না এ যুগ কাউকে অমর হতে দিতে রাজী নয়, সবকিছু ঝেঁটিয়ে সাফ করে নিজের আসন পাতবার সংকল্প নিয়ে তার অভিযান?

অনামিকা দেবী ঘরের ভিতরে বসেছিলেন ভি আই পি-দের সঙ্গে, তিনি বাইরের ওই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন না। তিনি শুধু ওই রাজনীতিই শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, আগুন ধূমায়িত হয়েই আছে, যে কোনো মুহূর্তে জ্বলে ওঠবার জন্যেই তার প্রস্তুতি চলছে, শুধু একটি দেশলাই-কাঠির ওয়াস্তা।

হয়তো ওই প্ৰস্তুতিটা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আগুন যখন জ্বলে ওঠে তখন সব আগুনের চেহারাই এক।

সেই ভাঙচুর, তছনছ।

কার জিনিস কে ভাঙছে, কে কাকে ক্ষতিগ্রন্ত করছে, হিসেবও নেই তার।

হঠাৎ এই সময় ওই খবরটা এসে পৌঁছলো। মাইকের ডাণ্ডা ঠুকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির নাকের হাড় ভেঙে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *