০৫. পেশোয়ারের পাথর

০৫. পেশোয়ারের পাথর

আমার এই ভাঙা কলম উসখুস করছে আমার কথা জবানিতেই লেখার জন্যে। মৃগাঙ্ক বলে বটে, কলম নাকি নিপ্রাণ থাকে না কাগজে চরণ ছোঁয়ালেই। আরবি অশ্বের মতে তখন কলম ছোটে, সূক্ষ্মজগত থেকে অযুত শক্তি এসে কলমে ভর করে। কলমকে প্রাণময় করে দিয়ে তারা লিখিয়ে নেয় অনেক…অনেক মহাসত্য—যা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। লেখনীমনস্ক মানুষরা তাই প্রপঞ্চময় দুনিয়া সৃষ্টি করে যায় অনায়াসে–নিজেদের অজান্তে।

ও একটু বাড়িয়ে বলে, একটু কেন, বেশ বাড়িয়ে বলে। যে যার নিজের কোলে ঝোল টানে। তবে হ্যাঁ, মৃগাঙ্ক যখন লেখে, তখন দেখেছি, ও যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। আমাকে চিনতে পারে না, নিজের অমন দশরূপা বউকে চিনতে পারে না-আমি তো ছার।

যে দশা এই মুহূর্তে আমার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমি তো কলমবাজ কস্মিনকালেও ছিলাম না। বকমবাজ আর বন্দুকবাজ বলে বিস্তর দুর্নাম আছে বটে, বউদি কবিতা আমাকে যখন তখন আর একটা বিষয়ে বিষমবাজ বলে—সে শব্দটা ‘মা’ অথবা ‘মা’ দিয়ে শুরু। শরৎ সাহিত্যে এই শব্দটা যখন তখন এসে গেছে। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে তা অচল। অশ্লীল। দরকার কি? বিশেষ করে, বিশেষণটা যখন সর্বৈব মিথ্যে! বউদিরা স্নেহের দেওরদের অমন বচন বিশেষণে যখন তখন। ভূষণ পরায়।

সত্যিই আমি অ-লেখক। কি লিখতে বসে, কি লিখছি। একেই বলে কুণ্ড রচনা।

হিরে নিয়ে রবি রে মেতেছিল বোম্বাইয়ের হিরের বাজারে ঘুর ঘুর করার সময়ে। ওর ব্যক্তিত্ব আছে, বাহাদুরি আছে, কোথাও সুঁচ ঢোকানো ছিদ্র পেলেও অনুসন্ধিৎসার আকর্ষণে নিমেষে অন্দরে প্রবিষ্ট হয়ে যেতে পারে।

এইভাবেই পেশোয়ারের পাথরের সন্ধান ও পেয়েছিল।

সে পাথর হিরে পাথর। আফগানিস্তানের বর্ডারে, পেশোয়ারের রুক্ষ পর্বতময় এক পরিত্যক্ত দুর্গ প্রাসাদে পড়ে থাকা এক কাঁড়ি আকাটা হিরে পাথর! ধূমল পাহাড়ের বিবর থেকে তুলে এনেছিল নক্ষত্রপ্রতিম পাথরদের।

গায়ের রক্ত চনমনে করে তোলার মতো সেই কাহিনি রবি রে আমাকে শুনিয়েছিল এই কলকাতায় বসে—যখন আর একটা সজীব পাথরের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে রয়েছে। কল্পনা…কল্পনা যে কি বস্তু—তা আগের অধ্যায়ে লেখবার চেষ্টা করেছি। মাকবর হিরে ওকেই প্রথম দেখিয়েছিল ময়দানের ঘাসের কার্পেটে বসে। বুকের পাটা আছে বটে। যে মরুদ্যান ময়দানে চোর-ছ্যাচোড় খুক খুক করছে, সেই ময়দানে বসে প্রেমিকার চোখে কীর্তিমান হওয়ার জন্যে ফস করে দেখিয়ে ফেলেছিল মাকবর হিরে।

সে যাক, প্রেমে পড়লে সব পুরুষই গর্দভ হয়ে যায়। আমি বাদে। আমি কখনও প্রেমে পড়িনি। পড়িয়েছি অনেককে। কার্যসিদ্ধির জন্যে। যেমন এই কল্পনা চিটনিসকে। বিশেষ মতলবে। এবং তা ক্রমশ প্রকাশ্য।

এই মুহূর্তে আসা যাক হিরের জগতে।

রবিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম–তুই চিরকাল মারকাটারি মানুষ, তা আমি জানি। কিন্তু লোভী নোস। হিরের টানে হঠাৎ পাগল হয়ে গেলি কেন? ছিলিস তো ওষুধ নিয়ে–

রবি রে ওর সেই বিখ্যাত খলিফা হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে এনে বলেছিল, ইন্দ্র, আমি চাই অজানাকে জানতে। আমি চাই অ্যাডভেঞ্চার। হাজার হাজার বছর ধরে হিরে রয়েছে অনেক…অনেক অ্যাডভেঞ্চারের মূলে। অনেক চক্রান্ত, অনেক যুদ্ধ, অনেক যশ, অনেক অর্থ, অনেক অনর্থর মূলে। হিরে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি টানে—

আমি হেসে বলেছিলাম, বুঝেছি।

রবি শক্ত চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। ওর র্যামবো মার্কা ফিগারে চোখ দুটো যেন দু’টুকরো পাথর। সেই পাথরে প্রাণের আভাস নেই। চেহারাখানা জাঁদরেল। কুস্তি, যোগব্যায়াম, যুযুৎসু, সাঁতার—এইসব করে ছেলেবেলা থেকেই নিজেকে জ্যান্ত কৃপাণ বানিয়ে রেখেছে। ও বেপরোয়া, মরণের ভয় নেই, কিন্তু জানার স্পৃহা অফুরন্ত।

তাই শক্ত চোখে আমার দিকে যখন চেয়ে রইল, আমার মনে হল, হিরে-পিপাসার শেকড়টা রয়েছে অন্যত্র—নিছক রূপসী আকর্ষণের জন্যে নয়।

চোখে চোখে চেয়ে বলেছিলাম, সোজা কথায় বল, ওষুধের মার্কেট ছেড়ে হিরের মার্কেট ধরলি কেন?

সেই প্রথম হিরের ঝলক দেখলাম ওর চোখে।

বললে, মার্কেট? দ্যাটস দ্য ওয়ার্ড! মার্কেট! ইন্দ্র, তুই অনেক জানিস, কিন্তু জানিস না, কি বিরাট মার্কেট গড়ে উঠেছে এই হিরে নিয়ে। হিরে নাকি অভিশপ্ত। হোক। কিন্তু হিরে আনে টাকা। টাকার ডোবা নয়, পুকুর নয়, হ্রদ নয়—টাকার সমুদ্র। আমি সেই সমুদ্র রচনা করতে চাই এই দেশে—এই গরিব ভারতে—যে ভারতের সম্পদ শুষে আজ অন্য দেশগুলো ধনী হয়েছে।

ওর গলা কাঁপছিল। চোখ জ্বলছিল। আমি চুপ মেরে গেছিলাম। উসকে তো দিয়েছি।

আত্মগতভাবে বলে গেছিল রবি-পেশোয়ারের পাথর! পেশোয়ারের পাথর। রুক্ষ পাহাড়ি জায়গায় ভাঙা কেল্লার পাথর চাপা গুহায় আকাটা হিরের স্তুপ। ভাবা যায়?

টুকুস করে বলেছিলাম—গুপ্তধন?

কথার রাশ টেনে ধরেছিল রবি তৎক্ষণাৎ। বুদ্ধদেব স্টাইলে অর্ধনিমীলিত নয়নে আমার দিকে চেয়েছিল। তারপর বলেছিল—সেই প্রসঙ্গে আসবার আগে তোকে বলব, শুধু তোকে বলব, আমি কী দেখে এসেছি, কী শিখে এসেছি—গোটা পৃথিবীটায় চক্কর দিয়ে।

ডেঞ্জারাস ডায়মণ্ড দুনিয়ার অতি শ্বাসরোধী কাহিনি বলে গেছিল তার পবেই।

ডায়মণ্ড! ডায়মণ্ড! ডায়মণ্ড! নিছক কয়লা থেকে তো তোমার জন্য ধরিত্রীর জঠরে, কিন্তু কল্পনাতীত একী সাম্রাজ্য রচনা করেছ তোমার একল্পনীয় ঐশ্বর্য দিয়ে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *