০৩. জমিদার বাড়ির সীমানায়

জমিদার বাড়ির সীমানায় পা দেওয়ার আগে থমকে দাঁড়াল মহিম, একটু দাঁড়াও পরানদা।

কী হল?

সাঁকোটা বড় নড়বড়ে লাগছে। ভেঙে পড়বে না তো?

পরান হেসে উঠল। অত বড় চেহারার মানুষটা, কিন্তু হাসির শব্দ যেন প্রেতের খিলখিল হাসির মতো শোনাল। সরু মেয়েমানুষের গলার মতো। হেসে বললে, এ মচকায়, তবু ভাঙে না মহিম।

সরু একফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। অন্ধকারের মধ্যে ছমছমানি এনে দিয়েছে সেই একফালি চাঁদের ক্ষীণ আলো। পুবদিকটুকু ব্যতীত চারদিকে জলে ঘেরা, দীর্ঘ প্রাচীর ঘেরা বিরাট জমিদার বাড়িটি যেন মস্ত এক প্রেত, নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও জানালা দরজা জাফরি ভেদ করে এক ফোঁটা আলোর রেশ পড়ে না চোখে।

বাড়িটি সত্যই অদ্ভুত। পুবদিক ব্যতীত বাড়িটির আর তিনদিকেই অর্ধবৃত্তাকারে একটি দিঘি, তার বুকে কালো জল হাওয়ায় ঢেউ খেলছে। এ দিঘি কাটতে হয়নি। নয়নপুর খালেরই কোন এ ফ্যাড়া এককালে প্রবাহিত ছিল এখান দিয়ে। কালক্রমে তা মজে যায়। কিন্তু এ অর্ধবৃত্তাকার জায়গাটুকু আর মজেনি। সে অনেককাল আগের কথা। তখনও এই বসুবংশ ছিল না জমিদার, ওঠেনি এই চৌমহলার ইমারত।

কিন্তু যেদিন ইমারত উঠল, সেদিন এই দিঘি দেখে বোসেরা খুশিই হয়েছিলেন। বাড়ি নয়, যেন প্রাচীনকালের দুর্গ, এই বড় দিঘি তাদের প্রহরী। চারিদিক বাঁধিয়ে বাঁধ দিয়ে, জমি উঁচু করে বাড়ি উঠল; সেই সঙ্গে তিন দিকে তিনটি ছোটখাটো সাঁকোও তৈরি করে দিয়েছিল তারা। অপরের জন্য নয়, নিজেদের জন্যই। শুধু তাই নয়, কঠিন নিষেধ ছিল সর্বসাধারণের প্রতি—এ সাঁকোতে পা না দিতে। দেয়ওনি অবশ্য কেউ, নিতান্ত খেপে যাওয়া নয়নপুরের শতাব্দীর ইতিহাসে কয়েকবার ছাড়া। তখন ক্ষিপ্ত নয়নপুরের প্রতিটি আক্রমণের কেন্দ্রস্থল ছিল এই প্রাসাদ। তা ছাড়া, আমলাকামলারাও তো যাতায়াত করেছে সারাদিনই। তখন ছিল নবাবী ইতিহাসের জের, বাসি দাগ, আর নতুন বিজেতা ইংরেজের প্রখর কিরণ। আলো জ্বলত প্রতিটি গবাক্ষে দরজায়, কোলাহল ছিল প্রচুর, মারধোর, হাসি-হল্লা, গান, আর্তনাদ। সে সব অনেক কিছুই চাপা পড়ে গেছে। কারণ আর কিছু নয়। কালক্রমে বোস বংশ বাড়েনি, কমেছে আর যুগের মহিমায় রাজধানীবাসীও হয়ে পড়েছেন। জমিদারি প্রতাপ মরে যায়নি, কিন্তু মার্জিত ভদ্রলোক হয়েছেন বোসেরা।

সাঁকো পেরিয়ে পাঁচিলের গায়ে ছোট্ট দরজা দিয়ে পরানের সঙ্গে মহিম ঢুকল। ঢুকে পরান দরজাটা দিল বন্ধ করে।

মহিমের মনে হল এমন জায়গায় সে ঢুকল, যেখান থেকে নিজের ইচ্ছায় সে বেরুতে পারবে না কোনও দিন।

বাইরের মহলে আলো জ্বলছে মাঝের গলিপথের দু-পাশের দুটি ঘরে। পরান না দাঁড়িয়ে মহিমকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে চলল। প্রথম মহল পেরিয়ে বিরাট চত্বর। চত্বরের অপরদিকের মহলের সামনের ঘরগুলো অন্ধকার। নিঃশব্দ, কিন্তু মানুষের অস্তিত্ব যেন টের পাওয়া যায়।

তীব্র সুগন্ধি ও কড়া তামাকের গন্ধে দ্বিতীয় মহলের চত্বরটুকু ভরে উঠেছে। তা ছাড়া, সুখাদ্যের গন্ধও তার ফাঁকে ফাঁকে এসে লাগছে নাকে।

নীর অন্ধকারে প্রানের গতিপথ ঠিক করতে না পেরে মহিম দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল ডাকবে পরানকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি মিষ্টি মেয়েলী গলার চাপা উচ্ছসিত হাসিতে থমকে গেল সে। আশেপাশে ফিরে দেখল মহিম, কেউ নেই। উপরের দিকে তাকাল, অন্ধকারে মাথা উঁচোনো নিস্তব্ধ কালো ইমারত।

কানের পাশ দিয়ে পিঠের শিরদাঁড়া পর্যন্ত কে যেন ফুটন্ত কাশফুলের ডগা বুলিয়ে দিল মহিমের। ভয়ে কৌতূহলে ডাকতে ভুলে গেল সে পরানকে। কিন্তু হাসি আর শোনা গেল না। আশ্চর্য, ভয় পেয়েও মহিম আবার সেই হাসি শোনবার জন্য আকুল প্রতীক্ষা করছিল।

কই গো, আসো। অন্ধকার কুঁড়ে রান আবার দেখা দিল।

এই যে, তোমাকে হারিয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে আছি। বলে সে আবার পরানকে অনুসরণ করল। তার মনে হল, বাড়িটাতে পা দিয়ে পরানও যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে।

এবার আলো দেখা গেল কয়েকটা ঘরে। একটা ঘর থেকে পাতলা ধোঁয়ার আভাসেই মহিম টের পেল—তামাকসেবীর সন্ধান। সেই ঘরটাতেই পরান তাকে নিয়ে গিয়ে তুলল।

প্রকাণ্ড ঘর। বিচিত্র সব শৌখিন সামগ্রীতে ঘরটি ঠাসা। একটা পেলব শুভ্র বিছানা-সুন্দর একটি প্রাচীন পালঙ্কের উপর বিছানো। বিছানার শিয়রের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল মহিম। আকণ্ঠ একটি বুদ্ধের ধ্যানস্থ মুর্তি, পালঙ্কের গা ঘেঁষে বিচিত্র খোদাই কাঠের উপর মূর্তিটি বসানো।

পালঙ্কের পাশেই একটি আধুনিক সোফায়, আহ্বায়ক কতা বসে বসে গড়গড়া টানছেন।

পরান নিশ্চল, কী যেন ইশারা করতে চাইল মহিমকে। মহিম ফিরেও দেখল না সেই দিকে। সে একবার বুদ্ধমূর্তি আর একবার কতাকে দেখতে লাগল। কোথাও অন্য কোনও ব্যতিক্রম তার চোখে পড়ল না। কিন্তু সে তো জানে না, কত বড় একটা ব্যতিক্রম থেকে যাচ্ছে। জানতে পারলে বুঝি এই পুরনো বাড়িটার খিলান প্রাচীরেরই একটা গর্জন শুনতে পেত।

তবু, প্রণাম তো দুরের কথা, একটা সামান্য নমস্কারের কথা পর্যন্ত মনে এল না মহিমের।

এবার ঝিমুনি কাটিয়ে হঠাৎ মুখের থেকে নলটা সরিয়ে হেমচন্দ্র তাকালেন মহিমের দিকে। পরান বলল, দাশু মণ্ডলের ছেলে, মহিম।

ও! খুবই যেন শিষ্টাচারের সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠলেন হেমবাবু। কোনও রহস্য নেই, খিঁচ নেই, স্বাভাবিক সাধারণ ভদ্রলোকের মতো তিনি বললেন, ও, মহিম বুঝি তোমারই নাম? এসো এসো, বসো। পাশের একটি সোফা তিনি দেখিয়ে দিলেন মহিমকে।

মহিমেরও যেন আচমকা এতক্ষণে ঘোর কাটল। জাতপ্রথাগুলো মনে পড়ল তার। তাড়াতাড়ি একটি প্রণাম করে সোফাটাতে বসল সে।

শঙ্কিত দেখাল শুধু পরানের চোখ।

মহিম লজ্জা পেয়েছে। কিছুক্ষণ আগে—যে হাসি তার মনে এক রহস্যের সৃষ্টি করেছিল, যে ভাবগাম্ভীর্য এনে দিয়েছিল তাকে এই বাড়ি আর তার আবহাওয়া, তা কেটে উঠতে লাগল। কোনও দিনের তরে এ বাড়িতে না ঢুকলেও মহিম বাইরে থেকে দেখে দেখে বাড়িটার ভিতরটুকু যেন এমনিভাবে মনে মনে এঁকে রেখেছিল। এমন কিছু নতুন মনে হল না তার, শুধু নিস্তব্ধতা আর ওই হাসিটুকু ছাড়া।

এবার সে স্পষ্টই দেখল, মুর্তিটা যেন তার খুবই পরিচিত, ইচ্ছে করল, মুর্তিটার পেছনে শিল্পীর নামটা সে ছুটে দেখে আসে।

তাকে বার বার ওদিকে তাকাতে দেখে হেমবাবুই বললেন, কলকাতায় থাকতে তুমি ওই মূর্তি গড়েছিলে। আমাকে দিয়েছে গৌরাঙ্গসুন্দর। আমাকে দিয়েছে বললে ভুল হবে, আমার বউমাকে দিয়েছে। আমার বউমার সঙ্গে কলেজে পড়ত গৌরাঙ্গ কলকাতায়। বলে তিনি হাসলেন মহিমের দিকে চেয়ে।

গৌরাঙ্গের সহপাঠিনীর অস্তিত্ব এ বাড়িতে আছে জেনে আবার ঝাপসা হয়ে এল মহিমের এবাড়ি সম্বন্ধে ধারণা।

এই পরিবেশের মধ্যে কলকাতার কলেজে-পড়া মেয়ের আবিভব। বিয়ের কথা। অবশ্য বিস্ময় লাগে না জমিদারির স্বৈরতান্ত্রিক সুরের বদলে হেমবাবুর নিছক ভদ্রলোকের মতে অমায়িক কথা শুনলে।

মহিম বুঝল, এ স্থবির ইমারতের, আর তার ভিতরের আসবাব সামগ্রীর চেয়েও তাড়াতাড়ি যুগ এগিয়ে চলেছে। যার আবর্তে, চোখে ঠেকবার মতো না হলেও বোসেদের পরিবর্তন হয়েছে। এ প্রাসাদ প্রাণহীন, মানুষকে তার আবহাওয়া দিয়ে ঘিরে রাখতে চাইলে ও অতীত স্থবির স্বৈরতান্ত্রিক দানবটার সে ক্ষমতা নেই। যদি থেকে থাকে তবে, তাকে নতুন খোলসে নিশ্চয়ই আত্মগোপন করতে হয়েছে।

হেমবাবু আবার বললেন, সত্যি, বাংলাদেশের চাষীদের যে সমাজব্যবস্থা, তার মধ্যে তোমার এ আত্মপ্রকাশ একটা বিস্ময়েরই কথা। আশ্চর্য চাষীর ঘরের ছেলে তুমি!

এতক্ষণে মহিম বুঝতে পারে ভাল করে, সে কোথায় এসেছে। ওই চাষীর ঘর কথাটিতেই অসামাঞ্জস্য প্রকট হয়ে দেখা দিল, এমন কী সোফাটাতে বসা পর্যন্ত তার কাছে আর স্বাভাবিক ঠেকল। প্রশংসা নিঃসন্দেহে, করুণামিশ্রিত। অবজ্ঞা করতে পারলেই যেন ভাল হত হেমবাবুর পক্ষে।

ব্যাপারটা কিন্তু পূর্বজন্মের, যাই বললা? প্রতিভা নিয়েই জন্মেছ তুমি। তিনি বিশ্বাস করেন, জন্মক্ষণের আর গ্রহ-নক্ষত্রের কোনও এক বিচিত্র মিলনেই প্রতিভাবানরা জন্মান।

কিন্তু মহিমের মনে পড়ল পাগলা গৌরাঙ্গের একটি কথা যে, প্রতিভা নিয়ে কেউ জন্মায় না। যার যে বিষয়ে অনুরাগ, মানুষ যদি তার সেই অনুরাগের মূলটিকে দিনের পর দিন হৃদয় নিংড়ানো রস দিয়ে তাকে সজীব না করে তোলে, যদি বাড়িয়ে না দেয় ডালপালা আর অজ পত্রপল্লবে, যা দেখে আমরা বলব প্রতিভার বিকাশ; তবে তা দুদিনেই মরে পচে হেজে যাবে। তুমি শিল্পী হবে, এ নির্দেশ আছে তোমার অন্তরে। সে নির্দেশ মেনে যদি কাজ না করো, ইচ্ছা বলে বস্তুটা তখন খালধারের মাঠে হুঁকো নিয়ে বসার তাগিদে জমে যাবে। ঈশ্বরদত্ত বস্তুর কোনও স্থান নেই এখানে।

পাগলা গৌরাঙ্গ আর হেমবাবুর কোনও কথারই মূল্য কম নয় মহিমের কাছে, কারণ হেমবাবুর কথার মধ্যে তবু তার মনে গেড়ে বসা অনিচ্ছাকৃত সংস্কারগুলোর সমর্থন আছেতাই এটাকেও সে একেবারে মূল্যহীন বলতে পারে না। আবার পাগলা গৌরাজের কথায় আজন্ম-সালিত তার সংস্কার এমন আঘাত পায় যে, সে পুরোপুরি সেই মতবাদের দড়িটাতে দৃঢ় হয়ে ঝুলে পড়তে পারছে না। পথ তার সামনে রয়েছে, মনটা ঠিক হয়নি।

তাই হেমবাবুর কথায় সে প্রতিবাদও করল না, তর্কও জুড়ল না। সে রকম অভ্যাসও তার নেই।

হেমবাবু কথায় কথায় নিজের কথায় চলে এলেন। বেশ বোঝা গেল তিনি ভুলে গেছেন, কথা বলছেন তিনি দাশু মোড়লের ছেলের সঙ্গে, তাঁরই নগণ্য এক প্রজার সঙ্গে। কিংবা এ শুধুই তাঁর নিজের পরিচয় দানের ভূমিকা।

বিস্ময়ের ঘোর রইল শুধু পরানের চোখে। এমনটা সে আশা করতে পারেনি, এমনি করে মহিমের কাছে কতা তাঁর নিজের জীবন-প্রসঙ্গ পেড়ে বসবে, নিজের লোকের মতো। আশ্চর্য, উৎসাহও তো কম নয় বলার, আর বেশ গভীরভাবেই বলছেন।

মহিম ভাবল অনেক রকমের পরিচিত লোকের মধ্যে হেমবাবু একটা রকমই। তবু তার কাছে এটা আকস্মিক বইকী। নয়নপুরের বোসদের অন্দরমহলের ঘরে বসে কতা বলছেন তাঁর জীবনকাহিনী, এক অর্বাচীন চাষার ছেলের কাছে—এ কি বিস্ময়ের নয়? ব্যাপারটা এমনি আচমকা ঘটছে যে, পরান তাদের বাড়ি যাওয়ার আগের মুহূর্তেও যে ভাবতে পারেনি—এখানে সে আসবে, আর হেমবাবু কথা বলার আগে এও বুঝতে পারেনি—বোসেদের প্রসঙ্গে এমন করে বসিয়ে কেউ তাকে বলবে।

হেমবাবু তখন বলছেন, আমি অবজ্ঞা করতে চাই না মানুষকে, তা সে তুমি যে-ই হও। যতক্ষণ পর্যন্ত না টের পাচ্ছি তুমি আমার অশুভাকাঙ্ক্ষী, ততক্ষণ তোমাকে আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে গ্রহণ করব। তার মানে এ নয়—আমার দোষ-সমালোচনা করলেই সে আমার অশুভাকাঙক্ষী হবে।

তাই একদিন আমি আমাদের এই সমস্ত বংশের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম, এদের কাজ, কথা, চরিত্র, ব্যবহার সমস্ত কিছু আমাকে এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এ আকাশস্পর্শী ইমারত—এটাই যেন সত্য, এ স্থবির দানবটা যেন আমাকে সর্বদাই বলত তুমি আমার তাঁবে। কী রকম? আমি কি স্থবির? ইমারত আমাকে শাসন করবে? সমস্ত কিছুর বাধা ঠেলে একদিন বেরিয়ে পড়লাম—এ বাড়ি আর তার বেষ্টনী ছেড়ে। কিন্তু শান্তি কোথায়? বোসবাড়ির সেই স্থবির দানবটাই আমার পেছনে পেছনে তাড়া করে চলেছে। আমাকে পেছন থেকে টানা চড়া শুরু করেছে। টাগ অফ ওয়ার’ যাকে বলে। আমিও টানি, ও-ও টানে।

তারপর ঝাঁপ দিলাম গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। সে হল আমার কলুষ দেহটাকে পবিত্র জলে ধুয়ে নেওয়া। চোখের জলও সেদিন কম ছিল না। জেলে গেলাম। জেল থেকে বেরিয়ে নয়নপুরে এলাম। এখানেও চোখে পড়ল পরিবর্তন। জোয়ার সর্বত্র। উদ্দীপনা পেলাম। দেখলাম—ববাসবাড়ির পরিবর্তন হয়েছে। মড়ক এসেছিল কি না জানি না—দেখলাম অনেকেরই নেই পাত্তা। আর বড় শান্ত সৌম্য পরিবেশ। আমার স্ত্রীও মারা গেছেন। আছে শুধু দূর সম্পর্কের বোনের কাছে আমার একটি ছেলে আর আমার বৃদ্ধ দাদা।

মহাত্মাজির আদর্শে গড়লাম এ বাড়ির পরিবেশ। দেশি আর বিদেশি কাপড় বাতিল করে দিয়ে খাদির প্রতিষ্ঠা করলাম। তখনই তো স্থাপন করলাম তোমার এই অহিংসার দেবমুনির মূর্তি। যেদিন এ বাড়ির পরিবেশ ছেড়েছিলাম—সেদিনই আর্টের প্রতি আমার দরদ বাড়ে, বলে তিনি চুপ করলেন।

মহিম এতক্ষণে লক্ষ করে দেখল। সত্যই, কাপড়-চোপড় সবই খদ্দরের। এমন কী, ঘরের পরদা, সোফার রঙিন কাপড়গুলো পর্যন্ত।

হেমবাবু একটি শ্রদ্ধার আসনই পেলেন মহিমের মনে। কিন্তু পাগলা গৌরাঙ্গ তার হৃদয়ের যে স্থানটিতে প্রতিষ্ঠিত সেখানে এ-আসন বড়ই টলমল।

কারণ পাগলা গৌরাঙ্গ, গান্ধীজির প্রতি রুষ্ট, অত্যন্ত প্রখর ও কঠিন ভাষায় সে গান্ধীবাদকে আক্রমণ করে থাকে, যেখানে মহিম তার সমস্ত সত্তা হাতিয়েও একটা জবাব খুঁজে পায় না। গান্ধীজির ভাগবত মাহাত্ম্যকে কী তীব্র আর করুণ ভাবেই না শ্লেষ করে থাকে। যা মহিমকে সময়ে রুষ্ট করলেও, উত্তেজিত করলেও পাগলা গৌরাঙ্গের প্রতিটি যুক্তির ঝাপটায় তৃণবৎ উড়ে গেছে সে। সেই কিশোর বয়সে সে যে তর্ক করেছে, গান্ধীবাদের স্বপক্ষে আজ সুদীর্ঘ ছ বছর পরেও সে নতুন কোনও তীক্ষ্ণ যুক্তি শানাতে পারেনি।

এখানেও সেই একই কথা। এখনও সে মনস্থির করতে পারেনি। গান্ধীবাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে, শুনলে ভক্তির উদ্রেক হয় হৃদয়ে। কিন্তু যখনই মনে পড়ে পাগলা গৌরাঙ্গের তীব্র গলার রূঢ় অথচ যুক্তিতে নিশ্চিদ্র কথাগুলো, তখনই থেমে যায় সে আগে বাড়তে। সংশয় আসে মনে।

কিন্তু হেমবাবু ধরে নিয়েছেন, এতক্ষণে তিনি যত কথা বলেছেন, তার এক বর্ণও বোধ হয় মহিমের বোধগম্য হয়নি। এক পাগলা গৌরাঙ্গ আর কিছুটা অহল্যা ছাড়া, কেউই তো বুঝতে পারে না মহিমকে, কী তার চিন্তাধারা, কেমন করে সে ভাবে, আর কতখানি অগ্রগামী তার মন!

দাশু মোড়লের এই রোগা শান্ত ছেলেটি যে দুনিয়া ড়ুবে যাক’ গোছের চিন্তাধারায় গা ভাসিয়ে না দিয়ে, প্রতিটি পলে পলে, প্রতিটি ঘটনা চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে করে ভেবে ভেবে এমন একটা দীপ্ত মানবিকতার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, একথা তো কেউ বুঝতেও চায়নি। এই ছেলেটির চোখে যে পৃথিবী একটু আলাদা, না জানালে একথা জেনে নেবার সাধ কারও হয়নি আজও।

হেমবাবু তাকে জানেন শিল্পী বলে। পটুয়া কুমারের পরিমার্জিত সংস্করণ যা তাকে মুগ্ধ করেছে। তার বেশি কিছু নয়। আবার এও তিনি জানেন, শিল্পধর্ম বজায় থাকলেই হল, তার বেশি কোন বেড়া ডিঙিয়ে শিল্পী কোন্ পথের শরিক হয়েছে, তা জানবার তাঁর যেমন দরকার নেই, শিল্পীরও শিল্পরূপটুকু বজায় থাকলেই হল। শিল্পী শিল্পী, তার বেশি কিছু নয়।

নে, পরান একটু তামাক খাওয়া। কথাটা বলতে বলতেই তাঁর আবার অন্য কথা মনে পড়ে গেল। বললেন, ওহো, আর এক কথা তো ভুলেই গেছি। বউমাকে একটু ডেকে দে পরান।

পরান বেরিয়ে গেলে তিনি বললেন, এখন আমি আমার পরিবারটির জন্য সত্যই গর্বিত। ছেলে আমার বিলাতে, জানি না কী রকম হয়ে সে ফিরবে। কিন্তু আমার বউমাকে দেখলেই তুমি তা বুঝতে পারবে। তোমার ওই মূর্তি দেখে সেই প্রথম তোমাকে দেখতে চেয়েছিল, বাধ সেধেছিল গৌরাঙ্গসুন্দর। সে তোমার উপর বড় চটা হে, তোমার নাম করলেই খেপে যায়। অথচ তোমার কথা বলতে বলতে সে নিজে ঘণ্টা কাবার করে ফেলে, বলে তিনি হা হা করে হেসে উঠলেন।

হাসতে পারল না মহিম। কিন্তু হেমবাবুর বউমার আসার কথাতে অস্বস্তি লাগল তার। কথা তো মহিম বলতে পারে না। না, কারও সঙ্গে সে খুব সহজভাবে কথা বলতে পারে না, তার মধ্যে সে যদি হয় আবার অপরিচিত, তার উপর আবার শিক্ষিতা মহিলা।

হেমবাবুর বউমা এলেন—শ্রীমতী উমা। পাড়াগেঁয়ে হলেও মহিমের শালীনতাবোধের কম নেই। তবু সে তখুনি চোখ নামাতে পারল না উমার দিক থেকে। খুবই সহজ ও অনাড়ম্বর বেশে সে এল। একটি কালাপেড়ে খদ্দরের শাড়ির সঙ্গে একটি সাদা জামা। দীর্ঘ সতেজ সবল দেহ, শান্ত, কিন্তু দীপ্ত মুখ। ঠোঁট দুখানিতে মমতার আভাস আছে, কিন্তু তা যেন নিয়ত কঠিন বিদ্রূপে বঙ্কিম।

এবার আর পরানকে ইশারা করবার চেষ্টা করতে হল না। মহিম নিজেই উঠে উমাকে প্রণাম করতে গেল।

উমা বালিকার মতোই হেসে উঠে, দুহাতে মহিমের হাতটা জড়িয়ে ধরল,–ছি ছি, একী করছেন?

উমা টের পেল, মহিমের হাত কাঁপছে, হয় তো বা সর্বাঙ্গটাই। মনে মনে হেসে হাতটা ছেড়ে দিল সে।

হেমবাবু হেসে উঠলেন। এখানে ছোটবড়র কথা নেই কিনা। ওরা যে তোমার প্রজা।

বলে তিনি আবার হাসলেন। বললেন, আমদের হিরণ মহিমের থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবে। তোমারই সমবয়সী হবে হয়তো মহিম।

হিরণ তাঁর ছেলে, উমার স্বামী।

সে কথার কোনও জবাব পেলেন না তিনি। উমা তখন বিস্মিত চোখে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শিল্পীকে। খুবই ছেলেমানুষ বলে মনে হল তার আর বড় কোমল। কিন্তু দেহের কোন ভঙ্গিটাতে যে দৃঢ়তা ফুটে রয়েছে টের না পেলেও সে বুঝল শিল্পীর হৃদয়ে আছে একটা কঠিন দিক, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে সতেজ।

আর মহিম অন্য দিকে ফিরে যত চেষ্টা করল, যে মহিলাটি বিস্মিত প্রশংসায় তাকে নিরীক্ষণ করছে তার মুখটা মনে আনতে, ততই তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল এ ঘরের ওই বুদ্ধ মূর্তিটার মুখ। কেন? কোনও মিল কি সে খুঁজে পেয়েছে উমার মুখটার সঙ্গে ওই মূর্তিটার?

ভেবেছিলাম, না জানি কত বড় আপনি। উমা বলল, গৌরাঙ্গবাবুর ওখানে আপনার গড়া সব নিদর্শনগুলোই দেখে এসেছি। সত্যি, আপনি যদি কলকাতায় থাকতেন, আপনার প্রতিভা আজ জগতের একটা দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠত।

উত্তরে মহিম হাসল। লজ্জা ও সংকোচের হাসি। আর ভাবতে লাগল উমার কথাগুলো, ভদ্র মার্জিত স্পষ্ট কথা, যে কথাবার্তার সঙ্গে তার দৈনন্দিন জীবনের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। কিন্তু জমিদারের পুত্রবধূর আভিজাত্যের অহমিকা কোথাও ফুটে উঠতে দেখল না। সহজ প্রশংসা, অনাড়ম্বর গুণগান। তবু কোথায় যেন মহিমের মনে একটু খটকা থেকে যাচ্ছে। তা বোধ হয় ওই মমতা মাখানো ঠোঁট দুখানির বিদ্রূপাত্মক বঙ্কিম রেখাটি মনে করে।

গৌরাঙ্গবাবুর কাছে শুনেছি আপনার সব কথা; উমা তার শ্বশুরের পাশটিতে বসে বলল, তবু আপনার কাছ থেকেও শুনব আপনার কথা।

মহিম চকিতের জন্য তুলে ধরল তার সংশয়ান্বিত কোমল চোখ দুটো উমার দিকে। কী কথা শুনতে চায় উমা! বলবার মতো কিছু তো তার নেই, বিশেষ করে বাংলার সেরা জায়গারই এক বিদুষী মহিলার কাছে।

উমা যেন স্পষ্টই বুঝতে পারল মহিমের মনের কথা। তাই সে আবার বলল, শুনব, কেমন করে এ পথে এলেন আপনি। তখনকার যে বিচিত্র মানসিক দৃঢ়তা ভাব জ্ঞান আপনাকে এ পথে আসতে সাহায্য করেছে, তখনকার আপনার প্রতিদিনের মনের প্রতিটি সংশয় আশা ওঠা-নামা, তারই গল্প। সত্যি, যারা শিল্পী, তাদের আমি মনে করি জাদুকর। অন্য ধাতু দিয়ে গড়া মানুষ, যাদের কোনও কিছুরই সঙ্গে বুঝি আমাদের মিল নেই।

মহিমের মধ্যেকার গম্ভীর শিল্পীটি, বিনম্র হসিতে মাথা পেতে নিল উমার মধ্যেকার বিস্মিত শ্রদ্ধাটুকু। জানবার আগ্রহটা উমার খুবই প্রবল, কথাগুলো কিন্তু হালকা। কারণ শিল্পীদের সে অন্য জগতের মানুষ বলে ধরে নিয়েছে। তার কিশোর বয়সের সাধনার কথা জানতে চাইল, কিন্তু সাধক বলতে পারল না।

সহস্র সংকোচ মহিমকে এমন আবিষ্ট করে রাখল, শব্দ বেরুল না গলা দিয়ে পর্যন্ত একটা। নীরবতার তিক্ততার চেয়েও সব কিছুকেই এক অদ্ভুত সংকোচের হাসি দিয়ে নেওয়াকে মোটেই অস্বাভাবিকও ঠেকল না। হেমবাবু আর উমার কাছে তো নয়ই, মহিমের কাছেও নয়।

হেমবাবু উমার প্রতি কয়েকবার ঘন ঘন চোখে বুলিয়ে নিলেন। তাঁর মনের কোথায় যেন একটু ক্ষোভ মিশ্রিত বিস্ময়ের আঁচ লেগেছে। তা বোধ হয় উমার এ আত্মভোলা বিমুগ্ধতার রূপ দেখে। কারণ এমনটি তিনি আর কখনও দেখেছেন বলে তাঁর মনে পড়ল না, বিশেষ উমার মতো মেয়ের এ আত্মভোলা রূপ। আর এও তিনি জানেন, এমনি বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন নীরব বিস্মিত প্রশংসায় ব্যাকুল, (হা, ব্যাকুলই মনে হল তাঁর) এমন অবস্থা মানুষের জীবনে তো খুব কমই আসে। তাঁর মনে হল, এ যেন খানিকটা ভক্তের ভগবান দর্শনের মতো।

উমার বোধ করি তখনও শিল্পীকে দেখা শেষ হয়নি। সে তখনও শিল্পীকে দেখছে। চোখ সেইদিকেই, কিন্তু মনটা যে তার সেইখানেই—এমন মনে হল না। কারণ চোখে চকিতে আলোছায়ার খেলা—তার মনের প্রতিবিম্ব।

আবার মহিম সেদিকে না তাকিয়েও অনুভব করল, তার প্রতিটি লোমকূপে ওই বিমুগ্ধ দৃষ্টি যেন বিদ্ধ হচ্ছে। অবস্থাটা তার অত্যন্ত কঠিন মনে হল। এই সঙ্গে তার মনে পড়ল পাগলা গৌরাঙ্গের মুখটা, তার সেই বিস্মিত চোখ। যা দিয়ে সে পাগলের মতো দেখত, মহিমকে, আর বুকে জড়িয়ে ধরে বলত, হবে—তোমার দ্বারা হবে।

ক্ষণিকের এ স্তব্ধতা অস্বাভাবিক লাগল হেমবাবু আর মহিমের কাছে।

হেমবাবু বললেন, যাক্, এখন বলো তো, বর্তমানে কী করছ তুমি? কোনও কাজটাজ হাতে নিয়েছ নাকি?

মহিম বলল, হ্যাঁ, আরম্ভ করেছি একটা।

কী, বলো তো?

এক কথায়ই জবাব দিতে পারল না মহিম। একটু হেসে মাথা নোয়াল সে।

বলুন না। প্রশ্নটা যেন উমাই করেছে, এমনভাবে কথাটা বলল সে।

শিব আর সতীর। চোখের মধ্যে স্বপ্নের ছায়া নামল মহিমের। খানিকটা আপন মনেই বলে চলল সে, সেই খ্যাপা শিব যখন মৃতা সতীকে দাহ করতে চলেছে কাঁধে সতীকে নিয়ে—সেই মূর্তি।

অপূর্ব। বিস্মিত উচ্ছ্বাসে বলে উঠলেন হেমবাবু।

সামনের বড় টেবিল ল্যাম্পটার উজ্জ্বল নীরব শিখার মতো দীপ্ত কম্পিত মনে হল উমাকে। কথা বেরুল না তার মুখ দিয়ে।

আবার খানিকক্ষণ নীরবতায় সকলেই যেন অনুভব করল—এই মুহূর্তের গম্ভীর সুন্দর রূপটুকু।

তোমার একটা মহাত্মা গান্ধীজির প্রতিমূর্তি কিন্তু করা উচিত। ভারতের মহামানব তো তিনি। শ্রদ্ধায় ধ্যানস্থ মনে হল হেমবাবুর চোখ দুটো। তাঁরও একটা আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ় ও সততায় মানসিক চিন্তার শৌর্যতায় ভরা দিক আছে, যেদিকটাকে তিনি মনে করেন আনন্দ ও বলিষ্ঠ আদর্শে মহীয়ান, যার ভাব-গাম্ভীর্য তাঁকে আচ্ছন্ন করে।

মহিম বলল, ভেবেছি অনেকবার, কিন্তু হয়ে ওঠেনি আজও।

কিন্তু সে বলতে পারল না, সমস্ত কিছুর মূলেই যে অনুপ্রেরণা বোধ তার থাকে, সে অনুপ্রেরণা সে পায়নি। কথাটা বলে সে একবার তাকাল উমার দিকে। চমকে উঠল সে। মনে হল তার সামনে বুঝি পাগলা গৌরাঙ্গ বসে আছে, এমনিই কঠিন দৃষ্টি উমার। আর কী নির্মম শ্লেষে বেঁকে উঠেছে তার ঠোঁট দুটো। পাশাপাশি হেমবাবু আর উমার মুখের পার্থক্য যেন অবিশ্বাস্য মনে হল তার।

আমিও আপনাকে একটা অনুরোধ করব কিন্তু। আবার সহজভাবে হেসে বলল উমা।

নিঃশব্দে মহিম তাকাল উমার দিকে।

রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন আপনি?

আঘাত পেল মহিম, তৎসঙ্গে ক্ষোভ। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না। কেবল ভাবল, শহরের এ বিদূষী মহিলা তাকে কতখানি অর্বাচীন ভেবেছে। অবশ্য তাকে বেশি দোষী করার অধিকার নেই, কারণ এটা যে নয়নপুর, বাংলা দেশের লক্ষ গ্রামের একটি মাত্র। আর তারই এক অন্ধ বাসিন্দা মহিম। সত্যই, নয়নপুরে তাদের মতো মানুষ, যাদের সংখ্যাই নয়নপুরে বেশি, তাদের কজন জানে রবীন্দ্রনাথের নাম? আর পাগলা গৌরাঙ্গের বন্ধুত্বের প্রথম দিনটি থেকে, সে কত জেনেছে, শিখেছে ভাবতে, তাই বা ইনি জানবেন কী করে?

কিন্তু সে ঘাড় কাত করার আগেই উমা বলল, শুনেছেন নিশ্চয়ই। সেই কবির একখানি মূর্তি কিন্তু আপনার গড়া উচিত। বিশ্বকবি তিনি।

কথাটা আগে কখনও মনে হয়নি। উমার মুখ থেকে শুনে মনে হল, সত্যই তার শিল্পচর্চায় একটা ফাঁকই থেকে গেছে। কবি যে সত্যই তার বড় শ্রদ্ধার আর প্রিয়পাত্র, যাঁর মানবিকতা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

হেমবাবু আর উমা, দুজনের কথাতেই সে সায় দিল। কেন যেন তার মনে হল, একই বাড়িতে এই দুটি মানুষ একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। এদের কথায় এবং ব্যবহারে তফাতটাই সে আজ দেখল। শুধু তাই নয়, তার মনে হল, এ দুটো মানুষের যে চারিত্রিক প্রভাব আছে, তা দিয়ে দুজনেই যেন খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে প্রভাবান্বিত করতে চাইছে মহিমকে।

এবার কাজের কথায় আসা যাক, যেজন্য তোমাকে ডেকেছি। এতক্ষণ পরে কথাবার্তার সুরে এবং চেহারায় একটু বৈষয়িক হয়ে উঠলেন হেমবাবু। বললেন, পুজো তো এগিয়ে এল, এবার আমাদের প্রতিমার ভারটা তুমিই নেও না।

মহিম খানিকটা সংকোচের সঙ্গেই এ অনুরোধ অস্বীকার করল। বলল, সে সময়ও তো নাই, আর অত বড় কাজ আমি করতেও পারি না।

হেমবাবু অসন্তুষ্ট হওয়ার বদলে হেসে উঠলেন। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একেবারে নিরাশ করলে চলবে না। আসছে বছর তোমাকেই করতে হবে। এবারও পরিকল্পনাটা তুমিই দাও।

মহিম হাসল। বলল, আমি এবার তা হলে যাই?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাত হল অনেক। পরান, একে একটা আলো দেখা।

মহিম প্রণাম করল হেমবাবুকে, তৎসঙ্গে উমাকেও।

আশ্চর্য! উমা এবার আপত্তি করল না। কী যেন বলতে চাইল, তাও পারল না। একটু পরে বলল, ডাকলে কিন্তু আবার আসবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *