• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • কৌতুক
  • লিরিক
  • ডিকশনারি
  • PDF

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

০৩. এ কাজ কেন করলুম

লাইব্রেরি » নারায়ণ সান্যাল » অলকনন্দা (উপন্যাস) » ০৩. এ কাজ কেন করলুম

এ কাজ কেন করলুম? আমার মনে তো কোনো পাপ ছিল না। তাহলে সমস্ত কথা অকপটে স্বীকার করলুম না কেন? নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছি। মিথ্যা জিনিসটা খারাপ, সত্য গোপন করাও অন্যায়, কিন্তু সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বলার মতো পাপ বোধকরি আর নেই। আমি সত্যের পোশাকে মিথ্যাকে সাজিয়েছি! যদি খোলাখুলি বলতে পারতুম-হ্যাঁ, মিস্ রয়কে সঙ্গে করেই আমি রাত্রের শোতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম, তা হলেই সত্যরক্ষা হত। ধর্মপত্নীকে অকপটে সত্য কথা বলাই আমার উচিত ছিল—কারণ আমার মন ছিল নিষ্কলুষ। হোরেস মান এক জায়গায় ভারি সুন্দর একটি কথা বলেছেন—ইউ নিড নট টেল অল দ্য ট্রুথ আনলেস টু দোজ হু হ্যাভ এ রাইট টু নো ইট অল। বাট লেট অল ইউ টেল বি-টুথ। অর্থাৎ সমস্ত সত্যি কথাটা তাদেরই খুলে বলবে যাদের গোটা সত্যটা জানবার অধিকার আছে। তবু যেটুকু বলবে তা সত্যি করেই বল। আমার বিষয়ে সব কথা জানবার অধিকার আছে নন্দার। সে আমার জীবন-সঙ্গিনী। সুতরাং কী অবস্থায় সে রাত্রে পর্ণাকে নিয়ে সিনেমা যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, সে কথা খুলে বলা উচিত ছিল আমার। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তটিতে কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল। এমন পি. সি. সরকারি ঢঙে চট করে টিকিট দুটো আমার নাকের ওপর মেলে ধরল না যে, আমি নার্ভাস হয়ে পড়লুম। তাড়াতাড়ি সাড়ে ছয়ফুট লম্বা আমার কাল্পনিক বন্ধু নিকলসের আড়ালে আত্মগোপন করে বসলুম। নাঃ! কাজটা ভালো করিনি।

অথচ ঈশ্বর জানেন, আমার মনে কোনো পাপ ছিল না।

কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি, আমাদের কারখানায় যেন কোনো অদৃশ্য ধূমকেতুর করাল ছায়াপাত ঘটেছে। শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা আমাদের নিষ্কলুষ। মিলেমিশে কাজ করছি আমরা, বাবার আমল থেকে। কোনোদিন ওরা বিদ্রোহ করেনি–ধর্মঘট হয়নি। এমন কি আজও পর্যন্ত শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠেনি এ কারখানায়। ওরা দিব্যি যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়, টিকিট পাঞ্চ করায়, সপ্তাহান্তে প্রাপ্য নিয়ে ফিরে যায় বস্তিতে। বিড়ি ফোঁকে, তাড়ি খায়, বউ ঠ্যাঙায়, আর মন দিয়ে কাজ করে কারখানায় এসে। হঠাৎ এ তাসের দেশে এসে পৌচেছে কোনো সাগরপারের ঢেউ। চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মানুষগুলো। স্পষ্ট কিছু দেখতে পাই না-কিন্তু অনুভব করি, ভেতরে ভেতরে কী যেন একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। বড় পুকুরে বেড়া জাল পড়লে মাছেরা তা দেখতে পায় না, কিন্তু যখন জাল ক্রমশ গুটানো হয় তখন তারা কেমন যেন অসোয়াস্তি বোধ করে, জল যেন ভারী ভারী লাগে। আমারও অবস্থাটা হয়েছে ঐ রকম। শ্রমিকদের মুখে কেমন একটা উদ্ধত বিদ্রোহের ছায়া লক্ষ্য করছিলাম কদিন ধরে। কে তার ইন্ধন জোগাচ্ছে তা টের পাই না কিন্তু পরিবর্তন একটা যে হয়েছে তা অনুভব করতে পারি। সেই ধূমায়িত বিদ্বেষবহ্নি হঠাৎ একদিন প্রকাশ্য রূপ নিল একজন ফোরম্যানের অবিমৃশ্যকারিতায়। নিঃসংশয়ে ফোরম্যান সেনগুপ্তই দোষী; কিন্তু ফ্যাটারির অলিখিত আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হল শ্রমিকটিকেই। একজন সামান্য মেহনতি মানুষ যদি ফোরম্যানের গায়ে হাত তোলে তবে শাস্তি না দিয়ে কী করি? এ না করলে ডিসিপ্লিন থাকে না। সেনগুপ্তকেও কঠিন ভাষায় ধমকে দিলুম। ফের যদি কুলি বস্তিতে গিয়ে মেয়েছেলেদের দিকে নজর দেয় তাহলে বরখাস্ত করতে বাধ্য হব আমি।

কিন্তু আশ্চর্য! পাথরে-কোঁদা কালো কালো মানুষগুলো আমার বিচারে সন্তুষ্ট হল না। ওরা দল পাকাল। জোট বেঁধে আমাকে এসে জানাল, আমার বিচার তারা মেনে নিতে রাজি নয়। নন্দ মিস্ত্রির জরিমানা মাপ করতে হবে এবং সেনগুপ্তকে তাড়াতে হবে! আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। এ যে নতুন কথা! শ্রমিকেরা দাবির একটা লম্বা ফিরিস্তি দাখিল করল। সে আবেদনপত্রের ভাষা দেখেই বুঝতে পারি ভিতরে বাইরের লোক আছে। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা পরামর্শ দিলেন—দৃঢ় হাতে বিদ্রোহ দমন করতে হবে। আমি কিন্তু জানতুম, বাধা দিতে গেলেই সংঘাতটা বিরাট আকার ধারণ করবে। অঙ্কুরেই একে বিনাশ করতে চাই। বাধা দিয়ে নয়, দরদ দেখিয়ে। উইথ কাইন্ডনেস হি ইজ টু বি স্লেন! কারখানায় আমার কয়েকজন ইনফর্মার ছিল—যেমন সব কারখানাতেই থাকে। তারা খবর আনল যে, একজন শ্রমিকনেতাকে ওরা কোথা থেকে ধরে এনেছে অবশ্যম্ভাবী ধর্মঘট পরিচালনার জন্য। একখণ্ড ছাপানো কাগজও এনে দিলে তারা! সাপ্তাহিক পত্রিকার একটা সংখ্যা। নাম দেওয়ালের লিখন। এ কাগজের নামই জানতুম না। তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমার কারখানার ব্যাপারটা ফলাও করে ছাপা হয়েছে। ফোরম্যান সেনগুপ্তের ঘটনাটা আনুপূর্বিক বর্ণনা করে সম্পাদক আমায় বাপান্ত করেছেন। স্থির করলুম, আর অগ্রসর হতে দেওয়া নয়। শ্রমিকদলের তিনজনের ডেপুটেশনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে রাজি হয়ে গেলুম।

তিনজন শ্রমিক প্রতিনিধি যেদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল সেদিন লক্ষ্য করে দেখি, ওদের ভেতর একজন আমার অচেনা। তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই অন্য একজন বললে—উনি স্যার একজন শ্রমিক-নেতা, আমাদের তরফ থেকে উনিই কথাবার্তা চালাবেন।

আমি বলি—কিন্তু এ কথা তো ছিল না। শ্রমিক-মালিকে বোঝাপড়ার মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির তো থাকার কথা নয়।

ভদ্রলোক বলেন—এটাই কিন্তু প্রচলিত রীতি মিস্টার মুখার্জি। এরা শ্রমিক আইনের খুঁটিনাটি জানে না, কিসে তাদের ভালো হবে তাও সব সময় বোঝে না। আপনার তরফে কোনো আইনের প্রশ্ন উঠলে আপনি সলিসিটারকে জিজ্ঞাসা করতে ছুটবেন–ওদের তরফেও কেউ উপদেষ্টা থাকলে আপনার আপত্তি কেন?

বললুম–বেশ, ওরা যদি চায় তবে আপনিও থাকুন। কিন্তু একটা কথা, আলোচনার আগেই আমি ওদের দুজনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেতে চাই যে, আপনি ওদের হয়ে যে-সব কথা দেবেন তা মানতে ওরা বাধ্য থাকবে।

বাকি দুজন সমস্বরে বলে ওঠেনিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

তারপরই আলোচনা শুরু হয়ে যায়।

দেখলুম ভদ্রলোক তীক্ষ্ণধী। কথা বলতে জানেন। শুনতেও। সমস্ত সমস্যাটা সহজ কথায় গুছিয়ে উপস্থাপিত করলেন। সমাধানের ইঙ্গিত দিলেন স্পষ্ট ভাষায়।

একটু পরে আমি বলি–আলোচনায় যে সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমার মনে হয়, সেগুলি এখনই লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। আপনি কী বলেন মিস্টার–

—ব্যানার্জি। সে তো ঠিক কথাই।

—তাহলে আমার স্টেনোকে ডাকি?

–ডাকুন।

বিজলী বোতাম টিপতেই বেয়ারা এসে দাঁড়াল। তাকে পাঁচ প্লেট খাবার আর কফি আনতে বলি—আর ডেকে দিতে বললুম স্টেনোকে। অল্প পরেই মিস্ রয়ের আবির্ভাব ঘটল দ্বারপথে।

ডিটেশনের খাতা-পেন্সিল হাতেই সে এসেছে—কিন্তু নিজের আসনে এসে বসল না। সুইং ডোরের এপারে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে শ্রমিকনেতা মিস্টার ব্যানার্জির দিকে।

লক্ষ্য করলাম, মিস্টার ব্যানার্জি এতক্ষণ তাকে দেখতে পাননি। চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক চমকে ওঠেন। অজান্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। অস্ফুটে তার অধরোষ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে একটি মাত্র শব্দ—পর্ণা!

মুহূর্তমধ্যে দুজনেই আত্মসংবরণ করে। পর্ণা এগিয়ে এসে বসে তার নির্দিষ্ট আসনে।নতনেত্রে খাতা খুলে পেন্সিল হাতে প্রতীক্ষা করে। যেন কিছুই লক্ষ্য করিনি আমি, এইভাবে ঘূর্ণমান বিজলী পাখাটার দিকে তাকিয়ে বলে গেলুম-দি ফলোয়িং ডিসিশস্ ওয়্যার মিউঁচুয়ালি এগ্রিড আপন ইন এ জয়েন্ট ডিস্কাশন হেল্ড ইন দি চেম্বার অব…

লক্ষ্য করলুম, দীর্ঘ দেড়ঘন্টার কনফারেন্সে দুজনের মধ্যে আর দৃষ্টি বিনিময় হয়নি। মিটিং শেষ হল। বেয়ারাকে ডেকে বলি—এঁদের পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।

শ্রমিক নেতা ব্যানার্জিকে বলি–আপনারা ও ঘরে একটু অপেক্ষা করুন। এটা টাইপ হয়ে গেলে সই করে এক কপি দিয়ে যাবেন, আর এককপি নিয়ে যাবেন।

নমস্কার বিনিময়ের পালা সাঙ্গ হলে ওরা চলে গেল।

পর্ণাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বলে—ক কপি ছেপে আনব?

সে কথার জবাব না দিয়ে বলি—আপনি মিস্টার ব্যানার্জিকে চিনতেন?

একটু ইতস্তুত করে পর্ণা স্বীকার করে।

–কী সূত্রে ওঁর সঙ্গে আলাপ?

—আমরা একই কলেজে পড়তাম।

—আই সী! তাহলে বন্ধু বলুন!

পর্ণা হেসে বলে-হা; খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম এককালে।

–তারপর দীর্ঘদিন অসাক্ষাতে সে বন্ধুত্বের ওপর মরচে পড়েছে, কেমন?

পর্ণা হাসল। জবাব দিল না। আগের প্রশ্নটাই করল আবার—ক কপি ছেপে আনব স্যার?

আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা খেলছে। পর্ণা বলেছে, এককালে ওরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সুনন্দা বলেছে, ওর সঙ্গে কলেজে একটি ছেলের খুব মাখামাখি হয়েছিল। এই কি সেই? একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বলি–বসুন।

পর্ণা আবার বসে পড়ে তার আসনে। আমার চেয়ার থেকে অদূরে। আমি জানলার বাইরে তাকাই। বর্ষার আকাশে মেঘ করেছে, এলোমেলো বাতাস বইছে। এখনই হয়তো বৃষ্টি নামবে। আমার কিন্তু তখন সেদিকে নজর নেই—আমি শুধু ভাবছিলুম, এই মেয়েটিকে কাজে লাগানো যায় না? মাতাহারিকে আমি দেখিনি, কিন্তু তারও নিশ্চয় ছিল এমন ঈগলদৃষ্টি-দগ্ধকারী চাহনি। দেখাই যাক না। বললুম—দ্য লস্ অব এ ফ্রেন্ড ইজ লাইক দ্যাট অব এ লিম্ব; টাইম মে হীল দ্য অ্যাঙ্গুইশ অব দ্য উন্ড, বাট দ্য লস্ ক্যানট বি রিপেয়ার্ড!—কে বলেছেন বলতে পারেন?

দাঁত দিয়ে পেনসিল কামড়াতে কামড়াতে ও বলে—পারি! সাউদে।

চমকে উঠি! একবারে এমন নির্ভুল উত্তর কখনও শুনিনি। সুনন্দা এতদিনেও একটি নির্ভুল উত্তর দিতে পারেনি। বরং প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয়। মনে মনে মেয়েটির ওপর খুশি হয়ে উঠি। সে ভাব গোপন করে বলি—তাহলে বন্ধুটিকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিচ্ছেন কেন?

মিস রয় মিটিমিটি হেসে বলে–তাহলে আমিও একটা প্রশ্ন করব স্যার? বলুন এটা কার কথা—ইফ এ ম্যান ডাজ নট মেক নিউ ফ্রেন্ডস অ্যাজ হি পাসেস থু লাইফ, হি উইল সুন ফাইন্ড হিমসেলফ লেট অ্যালোন।

উৎসাহের আতিশয্যে পেন্সিল-সমেত পর্ণার ডান হাতখানা চেপে ধরে বলি–প্লেন্ডিড! ডক্টর জনসন।

পরমুহূর্তেই হাতটি ছেড়ে দিয়ে বলি-আয়াম সরি!

পর্ণা একটু লাল হয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বলে–না, না, দুঃখিত হবার কী আছে?

আমি গম্ভীর হয়ে বলি—আছে, মিস রয়। উৎসাহের আতিশয্যে আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছিলুম। ব্যাপারটা কী জানেন? কোটেশান-খেলা আমার একটা হবি। এমন একটা অ্যাপ্ট কোটেশন পেলে আমি একবেলা না খেয়ে থাকতেও রাজি আছি। কিন্তু তাহলেও, আই মাস্ট অ্যাডমিট, এতটা আপসেট হওয়া উচিত হয়নি আমার।

পর্ণা ধীরে ধীরে বলে—আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা প্রভু-ভূতের—কিন্তু একটা জায়গায় দেখছি আমাদের অদ্ভুত মিল আছে। সময়োপযোগী কোটেশান পেলে আমিও অনেক কিছু না পাওয়ার দুঃখ ভুলে থাকতে পারি। সুতরাং সামাজিক ব্যবধান সত্ত্বেও

আমি বাধা দিয়ে বলি-বার বার ও কথা কেন? আপনি বলতে চাইছেন কমন হবির সূত্র ধরে উই মে বি ফ্রেন্ডস্।

পর্ণা বলে-—অবশ্য আপনার তরফে বাধা থাকতে পারে।

—কী বাধা?

-প্রাচ্যের একজন পণ্ডিত বলেছেন, নেভার কনট্যাক্ট ফ্রেন্ডশিপ উইথ ওয়ান দ্যাট ইজ নট বেটার দ্যান দাইসেলফ!

এবার আর কোনো সংকোচ না করে ওর হাতখানি ধরে আমি বলেছিলুম-কনফুশিয়া।

পর্ণার হয়তো ধারণা তার উদ্ধৃতি-পটুতায় খুশি হয়ে আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছি। সুনন্দা শুনলে নিশ্চয়ই একটা মারাত্মক কদৰ্থ করত। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল আরও গভীর। নন্দাকে প্রশ্ন করে জেনেছি, কলেজ জীবনে যে-ছেলেটির সঙ্গে পর্ণার মাখামাখি হয়েছিল তার নাম গৌতম ব্যানার্জি। অতএব পর্ণাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করলে গৌতমবাবু যে সহজেই কাত হয়ে পড়বেন এটা অনুমান করতে পারি। ভয় ছিল, পর্ণা যদি রাজি না হয়। খুব কৌশলে ঘুরিয়ে প্রস্তাবটা উত্থাপন করলুম পর্ণার কাছে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝে নিল আমার মতলব। রাজি হয়ে গেল এককথায়। আমিও নির্বোধ নই। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের দাবিতেই এ কাজ করতে সে সম্মত হয়নি। সে জানে, আমাকে খুশি করতে পারলেই তার উন্নতি। মসীজীবী একটি অনুঢ়া মেয়ের পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। চাকরির উন্নতিতেই ওদের চতুর্বর্গ! কয়েকদিনের ভেতরেই সে শ্রমিক-নেতা ব্যানার্জির সঙ্গে পুরাতন বন্ধুত্বটা ঝালিয়ে নিল। শ্রমিক নেতার গতিবিধি, ওপক্ষের যাবতীয় সংবাদ সে আমাকে গোপনে সরবরাহ করে। সাতদিনের ভেতরেই সে এমন কয়েকটি গোপন খবর আমাকে এনে দিল যে আমি স্তম্ভিত। সেদিন একখণ্ড লম্বা কাগজ এনে আমার হাতে দিয়ে বলে-দেখুন স্যার।

–কী এটা?

—গ্যালি প্রুফ। আগামী সপ্তাহে এটা ছাপা হবে দেওয়ালের লিখনে।

আমাকে ন্যাকা সাজতে হয়–দেওয়ালের লিখন আবার কী?

–শ্রমিক নেতা ব্যানার্জির সাপ্তাহিক।

–উনিই সম্পাদক?

—হুঁ।

–আপনি এ লেখা কোথায় পেলেন?

—কেন? ওর কাগজের অফিসে।

আশ্চর্য ধূর্ত মেয়ে। কী কৌশলে হস্তগত করেছে কাগজখানা! ভারি সুবিধা হল সেখানা পেয়ে! তাড়াতাড়ি শুধরে নিলুম ত্রুটি। এমনকি পরের সপ্তাহে লেখাটি বারই হল না ওই পত্রিকায়। তার আগেই আমরা সামলে নিয়েছি।

স্থির করলুম, ওকে তৎক্ষণাৎ পুরস্কৃত করতে হবে। তাকে ডেকে বলি—এই অফিস-অর্ডারটা টাইপ করে দিন।

পর্ণা অর্ডারটা পড়ছিল। তার কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে কর্তৃপক্ষ তার বেতন আরও পঞ্চাশ টাকা বৃদ্ধি করে দিচ্ছেন। ভেবেছিলুম, ও খুশিয়াল হয়ে উঠবে। কিন্তু সে রকম কোন লক্ষণই লক্ষ করি না।

আদ্যন্ত পাঠ করে সে আমাকে কাগজখানা ফিরিয়ে দিল। বললে–এটা আপনি করবেন না স্যার। র

-কেন?

—এটা করলেই গৌতম সতর্ক হয়ে যাবে। ওর ধারণা, আপনি আমার ওপর খুশি নন। তাই বিশ্বাস করে অনেক কথা সে আমাকে বলে। ধর্মঘট ভেঙে যাবার পর কার কার বেতন বৃদ্ধি হল, সে খবরটা কি ওরা পাবে না ভেবেছেন?

ওর বুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়ে গেলুম। এতটা দূরদৃষ্টি ওর থাকতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। সুনন্দা হলে নিশ্চয় খুশির পাখনা মেলত। তাই বললুম–কিন্তু আপনি আমাদের এত উপকার করলেন, আমরা কি কিছুই প্রতিদান দিতে পারব না?

–আপনাদের উপকার করবার জন্য তো আমি এ কাজ করছি না—

—তবে সংবাদগুলি সংগ্রহ করে আনছেন কেন?

–আপনি চাইছেন বলে।

–বন্ধুকৃত্য?

—বন্ধু বলে আর স্বীকার করে নিলেন কই?

—নিইনি?

–কই নিয়েছেন? আজও আপনি আমাকে আপনি বলে কথা বলেন।

হেসে বলি—বেশ, এবার থেকে আর তোমাকে আপনি বলব না পর্ণা। কিন্তু তাহলে তোমাকেও যে তুমি বলতে হয়।

পর্ণা মুহূর্তকাল কী ভাবল, তারপর বলে–সে হয় না। আপনি অফিস-বস। আপনাকে সবার সামনে তুমি বললে অন্য সবাই কী ভাববে?

আমি নিম্নস্বরে বলি–বেশ, সবার সামনে না হয় নাই বললে। আড়ালে অন্তত বল।

হঠাৎ কী-জানি-কেন পর্ণা ভীষণ লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় আসন ছেড়ে। বলে–আমি যাই।

কালো মেয়েও যে ব্লাশ করে এই প্রথম দেখলুম। আমি চট করে ওর হাতটা ধরে বলি— কই, তুমি বলবে কিনা বলে গেলে না?

পর্ণা এবার একঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। দ্রুতচ্ছন্দে আঁচল সামলে ঘর থেকে চলে গেল। দ্বারের কাছে একবার থমকে দাঁড়ায়, সুইং-ডোরের ওদিকে মুখ বাড়িয়ে কী দেখে আমার দিকে ফিরে যাবার সময় বলে গেল—বলব গো, বলব।

পর্ণা চলে গেল। আমি চুপ করে বসে রইলুম। মনের মধ্যে কেমন যেন তোলপাড় করে ওঠে। কাজটা কি অন্যায় হচ্ছে? আমি কি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছি? অফিসের মালিক ও কর্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক থাকার কথা, আমি কী তার সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছি? আমার অন্তরে কি পর্ণা সত্যিই কোন আলোড়ন তুলেছে? অসম্ভব। আমার মনে কোনও কুচিন্তা নেই। নন্দা আমার মনপ্রাণ ভরে রেখেছে। সেখানে অপর কারও প্রবেশাধিকার নেই। পর্ণা যদি পুরুষমানুষ হত, তাহলে তার সঙ্গে এই বন্ধুত্বে তো কোনো আপত্তির কথা উঠত না। ওকে আমি শুধু অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছি। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে বয়ে গেছে আমার। কিন্তু সে যাই হোক, আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। পর্ণা না শেষ পর্যন্ত আমাকে ভুল বোঝে। আমার নিজের দিক থেকে অবশ্য আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কিন্তু পর্ণা তো এর অন্য অর্থ করে বসতে পারে। সুতরাং সাবধানের মার নেই।

যা আশা করেছিলুম তা হল না। বিদ্রোহের আগুন সাময়িকভাবে চাপা পড়েছিল। শ্রমিক-ঐক্য সম্বন্ধে যথেষ্ট আস্থা না থাকায় ওপক্ষ সাময়িক সন্ধি করেছিল মাত্র। খবর পেলুম, ওরা আবার গোপন পরামর্শ শুরু করেছে।

প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পূজার দিন আমাদের কারখানায় একটা বার্ষিক উৎসব হয়। অফিসারেরা বড় রকম চাদা দেয়, কোম্পানিও কিছু দেয়। প্রাঙ্গণে ম্যোরাপ বেঁধে কর্মীরা অভিনয় করে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসেন, প্রেস-রিপোটাররা আসেন। এ বছরও সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। নিমন্ত্রণপত্র পর্যন্ত বিলি হয়ে গেছে। ওরা বোধহয় এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। মনে হয় বিশ্বকর্মা পূজার আগেই ওরা ধর্মঘট ঘোষণা করে আমাদের অপদস্থ করতে চায়! সংবাদটা গোপনে পেলুম। পর্ণাকে সংবাদ সংগ্রহের কাজে লাগালুম; কিন্তু সে এ বিষয়ে কোনো খবর আনতে পারল না। তার ধারণা, ওরা তাকে আর বিশ্বাস করছে না। তার বেতনবৃদ্ধির একটা প্রস্তাব যে হয়েছিল,—এ খবর নাকি ওপক্ষ জানতে পেরেছে।

এরকম অবস্থায় সচরাচর হয়—আমার কাজকর্ম হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। অফিসের পরেও অনেক চিঠিপত্র লিখতে হয়। পর্ণাকে আটকে রাখতে বাধ্য হই। দেওয়ালেরও কান আছে। এ অবস্থায় আর কাউকে বিশ্বাস করতে সাহস হয় না। বিশ্বস্ত দু-একজন কর্মচারীও থাকে। আর থাকে পর্ণা। একের পর এক ডিটেশন দিয়ে যাই। বাড়ি ফিরতে কোনোদিন দশটা কোনোদিন এগারোটা বেজে যায়।

গত বৃহস্পতিবারের কথা। সমস্ত দিন ছোটাছুটি করে অফিসে এসে যখন পৌঁছালুম তখন পাঁচটা বেজে গেছে। অফিসের ছুটি হয়ে গেছে। কর্মচারীরা কেউ নেই—ঝাড়ুদার ঘরগুলি ঝাট দিচ্ছে আর দারোয়ান দোবেজী এক গোছা চাবি হাতে নাকে পাগড়ির একপ্রান্ত চেপে ধরে অপেক্ষা করছে। পর্ণার সঙ্গে লিফটের মুখেই দেখা হয়ে গেল। ও বাড়ি যাচ্ছিল। ওকে বললুম–একবার অফিসে যেতে হবে। খানকয়েক জরুরি চিঠি আছে।

পর্ণা মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে নিয়ে বলে—কাল ফার্স্ট-আওয়ারে করে দেব।

-না না, কাল দশটার মধ্যে সে চিঠি বিলি হওয়া চাই। চল চল।

পর্ণা বলে—আজ আমারও একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে স্যার। আজ ছেড়ে দিন।

আমি কণ্ঠস্বর নিচু করে বলি–ছেড়ে দিন কেন? বল, ছেড়ে দাও; কিন্তু ছেড়ে দিতেই যদি বলবে তবে ধরা দিলে কেন?

পর্ণা কুঞ্চিত করে বলে–হাশ! দ্য লিটম্যান!

তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে আমার সঙ্গে লিফ্ট-এ উঠে পড়ে।

লিটম্যান লোকটা বিহারি, সম্ভবত সে আমাদের কথোপকথনের অর্থ বোঝেনি। তবু মনে হল, এতটা অসতর্ক হওয়া আমার উচিত হয়নি।

লিফটটি আকারে খুবই ছোট। পর্ণার এলো খোপাটি আমার টাইয়ের গায়ে লাগছে। ও কি ক্যান্থারাইডিন মাখে? মাথাটা আমার নাকের খুব কাছে। গন্ধ পাচ্ছি একটা। সেটা প্রসাধনের, না— ব্রাউনিঙের একটা লাইন মনে আসছিল—কিন্তু তার আগেই লিফটটা এসে থামল নির্দিষ্ট স্থানে। নামতে হল।

পর্ণাকে ডিকটেশন দিলুম। অনেকগুলি চিঠি ও রিপোর্ট। কাজ শেষ করতে রাত আটটা বাজল। লিফট তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জনবিরল ডালহৌসী-স্কোয়ার। পর্ণা তার কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ল। আমরা সিড়ি দিয়ে পাশাপাশি নেমে আসি। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বললুম—চল, তোমাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। কোথায় তোমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না?

ও বলে—অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সন্ধ্যা ছটায়, এখন আর কী হবে?

বললুম-আমি দুঃখিত। এতে তোমার কোনো ক্ষতি হল না তো? আশা করি কাল আবার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা হতে পারবে?

-না, কাল আর হবার উপায় নেই। কাল সে এখানে থাকবে না।

—এখানে থাকবে না? কোথায় যাবে?

—বিলেতে।

আমি সত্যিই দুঃখিত হলুম। বলি-এ কথা আগে বলনি কেন পর্ণা?

ও হো-হো করে হেসে ওঠে,বলে, অত রোম্যান্টিক কিছু নয়। কাল বিলেতে ফিরে যাবে ফল অব বার্লিন ছবিটা।–বলে একখণ্ড সিনেমার টিকিট সে ছিঁড়ে ফেলে দিল।

শুনলুম, আজ কলকাতায় এই ছবিটির নাকি শেষ শো হচ্ছে। এর টিকিট যোগাড় করা নাকি অত্যন্ত দুরূহ। পর্ণা অনেক পরিশ্রমে আজ সন্ধ্যার শোর একখানি প্রবেশপত্র কিনেছিল। আমার জন্য এইমাত্র সেই টিকিটখানি ও ছিঁড়ে ফেলে দিল।

বলি—বেশ তো রাতের শো তো আছে।

ও বলে–শো আছে, টিকিট নেই।

গাড়ি তখন চৌরঙ্গীতে পড়েছে। ডাইনে বাঁক ঘুরতেই ও বলে—এদিকে কোথায়? আমি থাকি মানিকতলায়।

উত্তর না দিয়ে লাইট-হাউসের সামনে গাড়িটা পার্ক করি। রাত তখন সাড়ে আটটা। সন্ধ্যার শো তখনও ভাঙেনি। রাত্রের শো-তেও হাউস-ফুল। কিন্তু রেডি মানি ইজ আলাদীন্স্ ল্যাম্প অল্প সন্ধান নিয়েই ফিরে এসে পর্ণাকে বলি একখানা টিকিট যোগাড় হয়েছে।

ও বলে-না, থাক, রাতের শোতে একা একা সিনেমা দেখতে সাহস হয় না আমার। বিশেষত এ পাড়ায়। মানিকতলা পৌঁছাতে রাত একটা বাজবে। অত রাতে একা ট্যাক্সিতে—না থাক।

কী করব ভাবছি।

শো-কেসে লাগানো ছবিগুলি পর্ণ দু-চোখ দিয়ে গিলছে। দুধের স্বাদ বেচারি ঘোলে মেটাচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি নিজে সিনেমা দেখতে ভালবাসি না। শুধু স্ত্রীকে সঙ্গদান করতে রবিবারের সন্ধ্যাটা কোনো অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে আসি। কিন্তু এই মেয়েটি তার স্বল্প-মাহিনার ভিতর থেকে কয়েকটি মুদ্রা কোনোক্রমে বাঁচিয়ে এই প্রবেশপত্রটি সংগ্রহ করেছিল। আমি তার সেই সান্ধ্য আনন্দটুকু দস্যুর মত কেড়ে নিয়েছি নিজের স্বার্থে। মেয়েটি আমার অশেষ উপকার করে গেছে দিনের পর দিন–অথচ প্রতিদানে আমি তাকে কী দিয়েছি? প্রতারণা ছাড়া?

পর্ণা বলে–এবার যাওয়া যাক, বৃষ্টিটাও থেমেছে।

বলি–একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।

অল্প পরে উচ্চতম মূল্যের দু-খানি কালোবাজারি টিকিট কিনে ফিরে এলুম। একখানি তার হাতে দিতেই বললে–একি! বললাম যে, একা একা রাতের শোতে সিনেমা দেখি না আমি।

–রোজ রোজ একা দেখ, আজ না হয় দোকাই দেখলে।

দ্বিতীয় টিকিটখানি ওকে দেখালাম।

–কিন্তু, কিন্তু মিসেস মুখার্জি হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়বেন আপনার দেরি দেখে।

–পড়বেন না। কারণ মিসেস মুখার্জি আজ বাড়ি নেই। আর আপনার নয়, তোমার।

–ও, তাই বুঝি আজ পাখা গজিয়েছে?

দুজনেই হেসে উঠি। রাত্রের শো শুরু হতে তখনও অনেকটা দেরি আছে। তাই দুজনে চৌরঙ্গীর একটা বারে ঢুকলুম। শেরি খেতেও আপত্তি ওর। অগত্যা ওর জন্যে খাবার অর্ডার দিতে হল। মাঝের হলে বসতে সাহস হল না। কী জানি, পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে। একটি ছোট কেবিনের নির্জনতায় আত্মগোপন করি।

পর্ণা বলে—আমার কিন্তু ভয় করছে।

—কেন?-এক পাত্র খেয়েই যদি মাতলামি শুরু করি?

–তা নয়। যদি আমাদের কেউ দেখে ফেলে? আমাদের সম্পর্কটা বাইরের লোক দেখলে কী ভাববে?

আমি বলি—বাইরের লোকে কী ভাববে সে বিষয়ে আমার কৌতূহল নেই। কিন্তু ভিতরের লোকে কী ভাবছে?

একটা তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পর্ণা বলে—এ কথার মানে?

—মানে, তুমি কী ভাবছ?

এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে পর্ণা বলে—যা ভাবা স্বাভাবিক তাই ভাবছি।

মনে মনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কী বলতে চায় পর্ণা? সে কি ভাবছে আমি তার প্রেমে পড়েছি? সেটাই কি স্বাভাবিক ওর কাছে? আমার আচরণ কি তাই বলছে নাকি ওকে? অথবা ও বলতে চায়, বড়লোকের ছেলে যেভাবে তার স্টেনোর সঙ্গে নিপ্রেম ফ্লার্ট করে, আমি তাই করছি? কিন্তু ওকে প্রশ্ন করে কী হবে? আমি নিজেকেই সেই প্রশ্ন করলে কী জবাব দেবো? সত্যি, কেন আজ এ রকম কাণ্ডটা করছি? বন্ধুত্ব? পর্ণা যদি আমার পুরুষ স্টেনো হত তাহলে এই অদ্ভুত কাণ্ডটা আজ করতে পারতুম? একসঙ্গে সিনেমা দেখা? এক সঙ্গে পানাহার? তা হলে? ওর নারীত্ব সত্তাই কি আমাকে টেনে এনেছে এখানে? কিন্তু আত্মসমীক্ষা পরে করা যাবে। আপাতত পর্ণা এই সিচুয়েশানটা কী ভাবে নিচ্ছে সেটা জানা দরকার। বললুম-হ্যাঁ, কিন্তু স্বাভাবিক কোনটা?

পর্ণা কাঁটা ও ছুরি ন্যাপকিনের প্লেটে ঠুকতে ঠুকতে বলে—আমিও তো ঠিক সে কথাই ভাবছি। স্বাভাবিক কোনটা। তোমার-আমার সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্যের, কিন্তু তোমার আজকের আচরণে মনে হচ্ছে যে, কথাটা তুমি ভুলে বসে আছ। সে কথাটা মনে করিয়ে দিলেও শুনতে পাবে না তুমি!

আমি বলি—ইফ দাউ আর্ট এ মাস্টার, সামটাইমস্ বি ব্লাইন্ড!—কার কথা?

পর্ণা বলে—পরের লাইনটা হচ্ছে—ইফ এ সার্ভেন্ট, সামটাইমস্ বি ডেফ!—তুমি আজ প্রভু হয়েও অন্ধ আর আমি দাসী হয়েও বধির!

আমি একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বলি—কিন্তু ঐ দাসী কথাটা ঠিক স্যুট করছে না।

–ও! ওটা বুঝি একমাত্র মিসেস মুখার্জির বলার কথা?

আমি বিরক্ত হয়ে বলি—তার কথা থাক।

—ও! কিছু মনে করবেন না!সামলে নেয় পর্ণা।

সুর কেটে যায়। ঠিক ঐ পরিবেশে কী জানি কেন সুনন্দাকে নিয়ে ওর ঠাট্টাটা আমার ভাল লাগেনি। আমার স্বরটা বোধহয় কড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই ওরও সুর গেল বদলে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বয়টা দিয়ে গেল পানপাত্র আর খাবার।

যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে আমি আবার আলাপটা শুরু করি-মানিকতলার বাসায় কে আছে। তোমার?

আমার দিকে আয়ত দুটি চোখ মেলে পর্ণা বলে–তার কথাও থাক!

বুঝি, অভিমান করছে ও। তাই ভিন্ন সুরে বলি–বেশ, তাহলে এস আমরা এমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে আলোচনা করি যাতে দুজনেরই ইন্টারেস্ট আছে।

–যথা?

—যথা দ্য গেম অফ কোটেশনস।

–বেশ বলুন।

পাত্রে পানীয় ঢালতে ঢালতে চালতে বললুম-ঠিক এই মুহূর্তে, বেন জনসনের একটা উদ্ধৃতি আমার মনে পড়ছে। কী উদ্ধৃতি বলতে পার?

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল পর্ণা। তারপর বলল—পারি!

—না, পার না। আচ্ছা বল দেখি।

চটুল হাস্যে পর্ণা বললে–নিশ্চিত পারি। কিন্তু বলতে পারব না।

–পারি, অথচ পারি না?

–মানে মুখে বলতে পারব না।

বেশ লিখে দাও। মানিব্যাগ খুলে একটা নাম-লেখা কার্ড আর কলমটা ওর দিকে এগিয়ে দিই। কলমটা খুলে ও বলল–একটা শর্ত, আজ রাত্রে এটি তুমি দেখতে পাবে না।

বললুম-বেশ।

সে শর্ত আমি রাখিনি। নির্জন সিনেমা হলে ওকে বসিয়ে দিয়ে আমি আবার বেরিয়ে এসেছিলুম। দুরন্ত কৌতূহল হচ্ছিল জানতে, বেন জনসনের কোটেশানখানা ও স্পট করতে পেরেছে কিনা। লাইট-হাউসের বারে দাঁড়িয়ে বার করলুম সেই কাৰ্ডখানা। আশ্চর্য মেয়ে! ঠিক স্পট করেছে সে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা আছে–ঠিক সেই মুহূর্তটিতে যে কথা আমার মনে পড়েছিল—লীভ বাট এ কিস্ ইন দ্য কাপ, অ্যান্ড আইল নট লুক ফর ওয়াইন।

 

সিনেমা দেখে রাত একটার সময় ওকে নামিয়ে দিলুম মানিকতলার মোড়ে বললুম—একটা কথা পর্ণা! কাগজখানা আমি দেখেছি! লোভ সামলাতে পারিনি।

পর্ণা কোনও জবাব দেয় না।

নির্জন পথের ধারে ওকে নামিয়ে দেবার সময় বলি–কেমন করে আন্দাজ করলে তুমি?

ও বললে—কিন্তু তুমি কথা দিয়েছিলে আজ রাতে ওটা দেখবে না।

–সেটা কথা নয়; কথার কথা।

ও নেমে যাবে বলে দরজাটা খোলে। আমি ওর হাতটা চেপে ধরে বলি—কিন্তু আমার মনের কথা কেমন করে জানতে পারলে তুমি?

মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে পর্ণা বলে—একটু চেষ্টা করলেই তা জানা যায়। এই মুহূর্তে কবি ডনের একটা উদ্ধৃতি আমার মনে জেগেছে—তাও কি তুমি আন্দাজ করতে পার না?

ও পাশ থেকে মোড়ের পুলিসটা এগিয়ে আসছে। আমি বলি—সেটা কি আমার প্রশ্নের জবাব?

—হ্যাঁ।

–কী? বল। আর সময় নেই। আমি হার স্বীকার করছি।

ও বললে–বেটার ডাই দ্যান কি উইদাউট লাভ।

হাতটা ছেড়ে দিলাম ওর।

এসব কথা সুনন্দকে বলা যায় না। ভেবেছিলুম ওকে শুধু বলব-শ্রমিক-বিদ্রোহ দমনের অস্ত্র হিসাবেই পর্ণাকে ব্যবহার করছি আমি। সেজন্য তার সঙ্গে বন্ধুত্বের অভিনয় করতে হচ্ছে আমাকে। তাকে খুশি রাখা প্রয়োজন। এর ভেতর অন্যায় কিছু নেই—কোনও নৈতিক সীমারেখা আমরা অতিক্রম করিনি। সুনন্দার প্রতি আমি কোনো কারণেই অপরাধী নই। একদিন যখন বিদ্রোহ মিটে যাবে তখন সুনন্দাকে সব কথা না হয় বুঝিয়ে বলব। আমি নিজের কাছে যখন খাঁটি আছি তখন সুনন্দাকে যেচে কৈফিয়ত দিতে যাবার কী প্রয়োজন? সাবধানে পর্ণাকে ব্যবহার করব। আগ্নেয়াস্ত্র সাবধানে, গোপনে রাখাই বিধি; কিন্তু ব্যবহারের পর নিক্ষিপ্ত বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কোন্ জঙ্গলে গিয়ে পড়ে কে আর তার সন্ধান রাখে? আর লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে? তখনও বুলেটের আর দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণের ক্ষমতা থাকে না।

কদিন ধরে এসব ভাবছিলুম। সুনন্দাকে কী বলব না বলব স্থির করার আগেই হঠাৎ সুনন্দা আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসল।

অগত্যা অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়াস্ত্রটির অস্তিত্ব অস্বীকার করা ছাড়া আমার আর পথ রইল না।

আর একটা কথা।

আমি কি সত্যিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে? আমার সব ব্যবহারই কি নৈতিক সীমারেখার ভেতরে ছিল? কবি ডনের চাবুক না পড়লে সে রাত্রে কি নিজেকে সংযত করতে পারতুম? আমি ভেবেছিলুম, ওর মনে যে উদ্ধৃতিটা জেগেছে সেটা লে হান্টের-স্টোল্‌ন কিসেস্ আর অলওয়েজ সুইটেস্ট! মনের অগোচরে পাপ নেই। অন্তত আমার মনে তখন এই উদ্ধৃতিটাই জেগেছিল।

এসব কথা নন্দাকে বলা যায় না। তবু কিছুটা ওকে বলতে হল। কারখানায় আমার ইনফর্মার আছে, তেমনি নন্দারও কেউ আছে নাকি? মিশির? রামলাল? পর্ণা সংক্রান্ত কয়েকটি বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই মত বদলালুম। লেট অল য়ু সে বি হাফ-টুথ! বললুম, পর্ণাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করব স্থির করেছি। দেওয়ালের লিখনের প্রুফ কেমন করে সে জোগাড় করেছিল তাও বললুম। শুনে ও গুম মেরে গেল।

কিন্তু গত শনিবার যে কাণ্ডটা ঘটেছে তারপর আমি নিজেই হালে পানি পাচ্ছি না। ঘরে-বাইরে কত দিকে নজর রাখতে পারে একটা মানুষ?

শনিবারে আমার আসানসোল যাবার কথা ছিল। বাড়িতে বলে গিয়েছিলুম রাতে আর ফিরব না। কিন্তু অফিসের গণ্ডগোলে মত বদলাতে হল। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজকর্ম করতে হল অফিসে বসেই। ছুটির পর পর্ণাকে বললুম–চল, কোথাও চা খাওয়া যাক।

ও বলে—না আজ থাক। আজও আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

–সিনেমা শো?

–না। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

–কোন পাড়ায়?

–বেলেঘাটায়।

—বেশ চল, আমার গাড়িতেই পৌঁছে দিই।

—চুল।

ওকে নিয়ে বেলেঘাটার মোড়ে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছি। ট্রাফিক পুলিস হাত দেখিয়েছে। গাড়িটা গীয়ারে রেখে অপেক্ষা করছি। আমার পাশেই এসে দাঁড়াল একটা দোতলা বাস। সেদিকে তাকিয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। লেডিস সীটে বসে আছে একটি মেয়ে। সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি-বেশ ময়লাই, গায়ে কোনো গহনা নেই। বসে আছে জানলার ধারে। তার পাশে একজন পুরুষও আছে মনে হল। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি একবার মাত্র তাকাল–আর চমকে উঠলুম আমি।

সুনন্দা!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বেলেঘাটার বাসে ময়লা শাড়ি পরে বসে আছে সুনন্দা! অলক মুখার্জির স্ত্রী! পেছনের গাড়ির প্রচণ্ড হর্নে যখন সংবিৎ ফিরে এল ততক্ষণে দোতলা বাসটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। ভুলে গেলুম গন্তব্যস্থল। ঐ বাসটার পিছনে ছুটতে থাকি আমি। কিন্তু বৃথাই। পরের মোড়ে সবুজ আলোর সঙ্কেত পেয়ে সে বেরিয়ে গেল; কিন্তু আমি সেখানে পৌঁছবার আগেই এল লাল বাতির নিষেধ। অল্প পরেই অবশ্য বাসটাকে ওভারটেক করলুম। সে সীটে বসে আছে অন্য দুজন।

কোথায় নেমে গেল ওরা? দ্রুত বেগে ফিরে এলুম বাড়িতে। যা ভেবেছি তাই। সুনন্দা অনুপস্থিত। সেই যে দুপুরে বেরিয়ে গেছে এখনও ফেরেনি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অপেক্ষা করতে হল। রাত নটা নাগাদ ফিরে এল সে। আমাকে দেখে সে যতটা চমকে ওঠে তার চেয়ে আমি চমকে উঠি অনেক বেশি। সুনন্দার পরিধানে একখানা মাইশোর জর্জেট, আভরণের কমতি নেই তার দেহে।

—এ কি, আসানসোল যাওনি তুমি?

–না। কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

–তুমি নেই, তাই একটু আড্ডা দিয়ে এলাম।

—ও! কোথায়?

–নমিতাদের বাড়ি! খেয়ে এসেছ, না খাবে?

খেয়ে আমি আসিনি; কিন্তু খাবার স্পৃহাও চলে গিয়েছিল। বললুম-খাব না, তুমি খেয়ে নাও।

পরদিন ফোন করেছিলুম নমিতাকে। আশ্চর্য! সে বলল-হ্যাঁ, নন্দা তো এসেছিল কাল। সারাটা দুপুর ছিল এখানে। কেন বলুন তো?

-না, এমনিই?

কিন্তু নিজের চোখকে আমি অবিশ্বাস করি কী করে?

পর্ণা আর নন্দা। ভেবেছিলুম দুজনকেই আমার আয়ত্তের মধ্যে পেয়েছি। দুজনেই আমার হাতের পুতুল মাত্র। আজ মনে হচ্ছে সেটা আমার ভুল ধারণা। আমিই বোধহয় ওদের হাতের পুতুল! ঠিকই বলেছেন ভিক্টর হুগো–মেন আর উইমেন্‌স্‌ প্লে-থিং; উয়োমান ইজ দ্য ডেভিলস!

« পূর্ববর্তী:
« ০২. কাজটা বোধ হয় ভালো করিনি
পরবর্তী: »
০৪. কোথায় যেন গল্প শুনেছিলাম »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ

Return to top