০২. যতীনের পৈতৃক বাড়ীটা

যতীনের পৈতৃক বাড়ীটা নিতান্ত ছোট নয়। পূৰ্বপুরুষেরা এক সময়ে মনের আনন্দে ঘরদোর করে গিয়েচেন। এখন এমন দাঁড়িয়েচে যে সেগুলো মেরামত করবার পয়সা জোটে না। পূৰ্ব্বদিকের আসেটা কাঁঠালের ডাল পড়ে জখম হয়ে গিয়েছে বছর দুই হোল। মিস্ত্রী লাগানোর খরচ হাতে আসে নি বলে তেমনি অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে।

গত ত্রিশ বৎসরের কত পদচিহ্ন এই বাড়ীর উঠোনে। বাবা…মা… বউদিদি… মেজদিদি… পিসিমা দুই ছোট ভাই… আশা… খোকা-খুকীরা…

কত ভালবাসতো সবাই…সব স্বপ্ন হয়ে গেল…কেউ নেই আজ…

সে শিক্ষিত বলে আগে গ্রামের লোক তাকে খুব মেনে চলতো। এখন তারা দেখেচে যে শিক্ষিত হয়েও তার এক পয়সা উপার্জন করবার শক্তি নেই, এতে এখন সবাই তাকে ঘৃণা করে। তার নামে। যা-তা বলে।

আশা যখন প্রথম প্রথম বাপের বাড়ী গিয়েছিল, তখন লজ্জা ও অপমান ঢাকবার জন্যে যতীন গাঁয়ে সকলের কাছে বলে বেড়াতো– শাশুড়ী ঠাকরুণের হাতে অনেক টাকা আছে–কোন্ দিন মরে যাবেন, বয়েস তো হয়েছে। এদিকে বড় মেয়ে প্রায়ই মার কাছে থাকে, পাছে টাকার সবটাই বেহাত হয়ে যায় তাই ও বল্লে–দ্যাখো, এই সময়টা কিছুদিন মার কাছে গিয়ে থাকি গে। নইলে কিছু পাবো না।

এই কৈফিয়ৎ প্রথম প্রথম খুব কার্যকরী হয়েছিল বটে। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল, এখন লোকে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। কেউ বলে, অনেকদিন হয়ে গেল, এইবার গিয়ে বৌকে নিয়ে এসো গে যতীন। শাশুড়ীর টাকার মায়া ছেড়ে দাও, বুড়ী সহজে মরবে না।

পিছনে কেউ বলে–এই মোটর গাড়ীর শব্দ ওঠে দ্যাখো না! যতীনের বৌ টাকার পুঁটুলি নিয়ে মোটর থেকে নেমে বলবে–এই নাও পাঁচ হাজার টাকা। তোমার টাকা তুমি রাখো। কি করবে করো–আমি খালাস হই তো আগে! এই ধরো পুঁটুলি।

তা ছাড়া আরও কত রকমের কথা বলে সে সব এখানে ব্যক্ত করবার নয়।

এই সমস্ত ব্যঙ্গ-অপমান যতীনকে বেমালুম হজম করে ফেলতে হয়। সয়ে গিয়েছে, আর লাগে না–মাঝে মাঝে কষ্ট হয় মানুষের নিষ্ঠুরতা বর্বরতা দেখে। একটা সহানুভূতির কথা কেউ বলে না, কেউ এতটুকু দরদ দেখায় নাকি মেয়ে কি পুরুষ! সংসার যে কি ভয়ানক জায়গা, দুঃখে কষ্টে না পড়লে বোঝা যায় না। দুঃখীকে কেউ দয়া করে না, সবাই ঘৃণা করে।

মানুষ হয়ে মানুষকে এত কষ্ট দিতে পারতো না যদি একটু ভেবে দেখতো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের চিন্তার বালাই নেই তো!

এসব ভেবে কষ্ট হয় বটে, কিন্তু এসব সে গায়ে মাখে না। গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে মানুষের নিষ্ঠুরতা, মানুষের অপমান। এর পরেও সে লোকের বাড়ীতে ভাত চেয়ে খায়। কোনদিন লোকে দেয়, কোনোদিন দেয় না–বলে, বাড়ীতে অসুখ, রাঁধবার লোক নেই–বড়ই লজ্জিত হোলাম ভাই ইত্যাদি।

যতীনের বাড়ীর পেছনে খিড়কির বাইরে ছোট্ট একটু বাগান আছে, তাতে একটা বড় পাতিলেবুর গাছ আছে। যেদিন কোথাও কিছু না মেলে, গাছের লেবু তুলে সে বিনোদপুরের হাটে বিক্রী করতে নিয়ে যায়, আম কাঁঠালের সময় গাছের আম কাঁঠাল মাথায় করে হাটে নিয়ে যায়। এতেও লোকে নিন্দে করে–শিক্ষিত লোক হয়ে ভদ্রসমাজের মুখ হাসাচ্চে। রায়সাহেব ভরসারাম কুণ্ডু কেন তার বাড়ীর কাজকর্মে ব্রাহ্মণদের নেমন্তন্ন করতে সাহস না করবে?

এক সময়ে বড় বই পড়তে ভালবাসতো সে। অনেক ভাল ভাল ইংরিজি বই ছিল, সংস্কৃত বই ছিল তার ঘরে–কতক নষ্ট হয়ে গিয়েচে, কতক সে-ই বিক্রী করে ফেলেচে অভাবে পড়ে। এই সব নির্জন রাত্রে বইগুলোর জন্যে সত্যি মনে কষ্ট হয়।

এইরকম নির্জন রাত্রে বহুদিন আগেকার আর একজনের কথা মনে পড়ে। সে স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। ভুলেও তাকে গিয়েছিল, কিন্তু আশা চলে যাওয়ার পরে তার কথা ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে।

গত পাঁচ বছরে যতীন অনেক শিখেচে। মানুষের দুঃখ বুঝতে শিখেচে, নিজের দুঃখে উদাসীন হয়ে থাকতে শিখেচে, জীবনের বহু অনাবশ্যক উপকরণ ও আবর্জনাকে বাদ দিয়ে সহজ অনাড়ম্বর সত্যকে গ্রহণ করতে শিখেচে।

বর্ষার শেষে যতীন পড়ল অসুখে। একা থাকতে হয়, এক ঘটি জল দেবার মানুষ নেই। মাথার কাছে একটা কলসী রেখে দিত–যতক্ষণ শক্তি থাকতো নিজেই জল গড়িয়ে খেত–যখন না থাকতো শুয়ে চি চি করতো। গায়ের লোক একেবারেই যে দেখেনি তা নয়, কিন্তু সে নিতান্ত দায়সারা গোছের দেখা। তারা দোরের কাছে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখে যেতো–হয়তো ছেলেমেয়ের হাতে দিয়ে চিৎ এক বাটি সাবুও পাঠিয়ে দিতো–সেও দায়সারা গোছের। সে দেওয়ার মধ্যে স্নেহ-ভালবাসার স্পর্শ থাকতো না।

অনেকে পরামর্শ দিত–ওহে, বৌমাকে এইবার একখানা পত্র দাও। তিনি আসুন–না এলে এই অবস্থায় কে দেখে, কে শোনে, কে একটু জল মুখে দেয়। আমাদের তো সব সময় আসা ঘটে ওঠে না, বুঝতেই তো পারো, নানারকম ধান্ধাতে ঘুরতে হয়। নইলে ইচ্ছে তো করে, তা কি আর করে না? ইত্যাদি।

এ কথার কোনো উত্তর সে দিত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *