০২. আদালত চত্বরে

এ দেশের অন্যান্য আদালত চত্বরের সঙ্গে এই আদালত চত্বরের কী আর এমন তফাৎ! প্রায় কোনওই তফাৎ নেই আবার একটু আধটু হয়তো আছেও। আর কোথাও চত্বরের চারদিকে এত নারকেল গাছ নেই, অথবা নেই সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বর্ষীয়ান মেঘনিশ। তার পাশে একটি দুটি মেহগনি, সে-গাছে পাখির আনাগোনা নেই। বট কি অশখ প্রায় প্রতিটি কোর্ট চত্বরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সেখানে আর যেন কোনও কিছুরই প্রায় তুলনা চলে না।

কিছুদিন আগেও এটি সাবডিভিশন কোর্ট, হাকিমি আদালত। জজ কোর্ট ছিল খুলনায়। এখন এটিও জজ কোর্ট। পাশেই জেলা প্রশাসকের দপ্তর। এই কয়েক বছরে এই আদালতের কাজের পরিধি বেড়েছে, একই সঙ্গে তোক বেড়েছে সমাগমও। কিন্তু অতীতের চেহারা বলো আর সুরতই বলল, সে আদলে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। হওয়ার সুযোগ এখনই কোথায়। সেই অতীতও তেমন কোনও সুদূর অতীত নয়। প্রায় শ-খানেক বছর আগে, এই দেশের তখনকার রাজা ইংরেজ সওদাগর কি মহারানি ভিক্টোরিয়ার অনুগত মানুষজনদের কৃপায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ইতিহাস যতদূর জানা যায়, প্রায় প্রতিটি মহাকুমার সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠান বৃত্তান্ত প্রায় একই। সেখানে তেমন কোনও তরতম হয়তো নেই। শুধু একটি বিষয়ই হয়তো আলাদা, অন্য মহকুমা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যে মানুষগুলোর তৎপরতা যুক্ত ছিল, তাদের নাম সচরাচর মনে থাকে না, কিন্তু এইখানে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম যুক্ত থাকায়, অনেকেই পিছনের ইতিহাসের অনেক কিছুই। মনে করতে পারে।

যেমন, মোড়েলগঞ্জ নামক এলাকায় পত্তনি নিয়ে আসেন রবার্ট মোড়েল নামের জনৈক ইংরেজ সাহেব। তার সঙ্গে স্থানীয় ভূস্বামী রহিমুল্লাহ শেখের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে রহিমুল্লাহ প্রাণ হারান। মামলা কোর্টে গড়ায়। বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্যে তৎকালীন যশোর জেলাধীন খুলনা মহকুমার ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র মোড়েলগঞ্জ আসেন। তিনি ফিরে গিয়ে এই দুর্গম, সুন্দরবনের কোল-ঘেঁষা মোড়েলগঞ্জে একটি থানা স্থাপনের সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশেই বাগেরহাট মহকুমায় পরিণত হয়, মোড়েলগঞ্জে থানা। আবার বাগেরহাট মহকুমার প্রথম প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন গৌরদাস বসাক। তিনি যশোরের মধুকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অভিন্নহৃদয় বন্ধু হিসেবে পরিচিত।

এই সবই আজ ইতিহাসের অংশ। তবে, কোথাও যেন সেই শতবর্ষী আদর্শের পদচারণা এখনও বিদ্যমান। যারা এই কোর্ট চত্বরে আসে, তাদের প্রায় কেউই সে ইতিহাস জানে না হয়তো, কিন্তু ওই ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলে প্রতিদিন। আইনজীবীরা তাদের পোষাকে, বিচারিক হাকিম এজলাসে বসবার সময়ে যে সব নিয়ম মানেন, তা যেমন এক ঔপনিবেশিক ইতিহাসের অংশ, একই রকম এখানে বিচারের প্রার্থী হয়ে যাদের আগমন ঘটে তারও তো জ্ঞাতে আর অজ্ঞাতে ওই ইতিহাসেরই পরম্পরার ভাগিদার। এমনকি যে ক্যানভাসাররা আজও মজমা মিলিয়ে জীবনধারণ করছে, তারাও আজ থেকে শতবর্ষ আগে এই চত্বরে একদিন যারা বিচারপ্রার্থী মানুষদের কাছে পণ্য বিক্রি থেকে অন্যান্য কারণে হাজির হয়েছিল, তাদেরও অজ্ঞাতে অথবা জ্ঞাতে একপ্রকার মিল থাকতেই পারে, আছেও। আজ তা কেউ জানলেও আছে, না-জানলেও আছে।

যেমন, সুকুমার এ সবের প্রায় কিছুই জানে না। আবার, আজগর কি ইব্রাহিম শেখের তুলনায় একটু বেশিই জানে। আবার জরিনা কি ঝিলিক এসবের কিছুই জানে না, জানে অন্যকে অবলম্বন করে জীবনকে ধারণ করার কৌশল। আর, বারিক কি মোসলেম তাদের তুলনায় অনেক নির্বিরোধ মানুষ, বয়েসে বড়ো। এই চত্বরে পাকিস্তান জামানার শুরুর দিকে কি তার আগের ইংরাজ জামানার শেষের দিকের কায়দা-কৌশল তাদের কিছুটা হলেও জানা আছে। তারা সেকথা বলে। কিন্তু সেইসমস্ত কথায় তাদের প্রাত্যহিক দিনযাপনের কৌশলে কোনও বদল হয় না, বদল যদি কিছু হয় তা রাজনৈতিক কারণে। অন্য কোনও কারণে তেমন নয়। দেশের শাসক বদলায়, কোর্ট চত্বরের আচার আচরণ তো তেমন বদলে না। কিন্তু কোর্ট ভেঙে উপজেলায় চলে যায়, তাদের আয় রোজগার কমে। আবার, এত দিন মুন্সেফ আদালতে যা লোক সমাগম হত, জজ কোর্ট হওয়ায় তা বেড়েছে। লোক সমাগম বাড়লে আদালতে ক্যানভাসার বাড়ে। তাতে আয় রোজগার বাড়ে ঠিকই, পাশাপাশি জায়গা নিয়ে কিছু কামড়াকামড়িও সৃষ্টি হয়। কেননা, মানুষ তো সীমিত। এমনিতেই এই জেলার লোকজন বলে, মাত্রর তিন উপজেলার জেলা এটা, যদিও কাগজে কলমে উপজেলা নয়টা। কারণ, পুব-দক্ষিণের মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলার মানুষ সব কাজে যায় পিরোজপুরে। পশ্চিমের মোংলা-রামপাল-ফকিরহাটের মানুষ যায় খুলনায় আর উত্তরের মোল্লাহাটের লোকজন যায় গোপালগঞ্জ, এমনকি কেউ কেউ একথাও বলে, গোপালগঞ্জে চিতলমারির মানুষও যায়। তাহলে জেলা সদরে আসে শুধু কচুয়া উপজেলার মানুষ। একমাত্র কোর্টে-কাছারিতেই আসে সব উপজেলার মানুষ। যদি কোর্টে তাদের কোনও কাজ না-থাকত, সদরের জল কোনওদিন কোনও কারণে তাদের পেটে পড়ত কি না সন্দেহ?

ফলে, কোর্ট চত্বরই যা গোটা জেলার প্রতিনিধিত্ব করে। সে জায়গাকে কেন্দ্র করে এই ক্যানভাসারদের জীবনযাপন, বেঁচে থাকা, তাদের ভিতরে ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাইরে থেকে ভোলা চোখে কোনওভাবে বোঝা না গেলেও, ভিতরে বিষয়টি আছে। থাকবে। তাই স্বাভাবিক।

এই যেমন, কিছুক্ষণ আগে আজগরের সঙ্গে সুকুমারের এক পশলা বসচা হয়ে গেল। এমন তো কতই হয়, কিন্তু এবারের ঘটনাটা হয়তো স্থায়ী হবে। আপাতভাবে বিষয়টা চত্বরে ক্যানভাসের জায়গা নিয়ে হলেও ভিতরে অন্য কোনও কারণ আছে কি না, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। যদিও আছে। ইব্রাহিম শেখ তাই বলে। সে মোসলেম আর বারিককে জানিয়েছে ভিতরে কারণ ওই জরিনা। মোসলেমের অবশ্য এমন মনে হয়নি যে, জরিনার জন্যে সুকুমারের সঙ্গে আজগরের কিছু হতে পারে। ইব্রাহিম জানিয়েছে, পিছনের ঘটনা আরও বেশ কয়দিন আগের। সেটা মোসলেমের বিস্তারিত জানলে চলে, না জানলেও চলে। কিন্তু ঘটনাটা সে যখন ইব্রাহিমের কাছে শুনেছে, তাকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত জানবে, তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ইব্রাহিম হোক আর মোসলেমই হোক, তারা তো ঘটনার মাঝখান থেকে দেখছিল।

আজকের মতো ক্যানভাস শেষ করে মোসলেম উদ্দিন গিয়ে টাইপিস্টের ঘরের সামনে বসেছে। এখন সে একটুক্ষণ জিরোবে। একটার পর একটা বিড়ি খাবে। মন চাইলে এক কাপ চা খেতে লঞ্চঘাটের দিকে যেতে পারে। এই সময়, মোসলেম একটা বিড়ি ধরিয়ে দেখে, তার জায়গায় মজমা মিলিয়েছে আজগর। আজগর কী-কী করে তা তার জানা আছে। বৃত্তটা বড়ো করে দিতে একটা বানরের গলার দড়ি একটু ঢিলে দিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে আনবে। ওটা মর্দা বানর। মাদি বানরটা তখন তার কোলের কাছে।

এ সময় বারিকের দোকানের কাছে দাঁড়িয়েছিল সুকুমার। তার সামনের ফাঁকা জায়গায় ইব্রাহিম শেখ। ইব্রাহিম এখনও আসর জমিয়ে পারেনি। সবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এইটুকু দেখে মোসলেম নিজের পোটলাটা টাইপিস্টদের ঘরের কাছে রেখে, চা খেতে লঞ্চঘাটের দিকে যায়। মোসলেম রওনা দেয়ার পরপরই তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আসে জরিনা। মোসলেম জরিনাকে দেখে একটু অবাক। জানতে চাইল, তুই ছিল কোতায়?

জরিনা বলল, নদীর কূলে গেইলাম, হাওয়া খাতি। আইজকে যে গরম পড়িছে, তাতে মাইনষির জিন্ধে বাইড়োইয়ে যাবে। দুপুরের মদ্যি কোর্ট ফাঁকা।

হয়। তুই কলিই হল, দুই দিন আগেও পড়িল, সেদিন ফাঁকা হইল? গরম পড়িলই কোর্ট ফাঁকা হইয়ে যাবে নানে, আইজকে বিশেষ কোনও কেসের তারিখ, দেহিসনি সহলদে কী ভিড়!

জরিনা একটু অবাক, বড়ো কেসের তারিখ থাকলি সেদিন ভিড় বাড়ে?

তুই দেখি কিছু জানিস না, ভিড় বাড়ে না তয়?”

আপনি এইহেনে কতদিন ধইরে?

তা প্রায় প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর। তারও আগে আসতাম, তখনও ক্যানভাসার হইনি

মোসলেম একথা বলে একটু সরু চোখে জরিনার দিকে তাকায়। মেয়েটা এত নাদান ভাব করে কী জন্যে? মনে হয় তো যেন বেবোধ পাবলিক! ভাজা মাছ উলটোইয়ে খাতি জানে না। কিন্তু আজগরের সাথে ফেউর মতন জুইড়ে আছে।

জরিনা জানতে চাইল, ও কা, আপনি যাতিচেন কোহানে?

মোসলেম একবার ভাবে বলে কোথায় যায়, আবার ভাবে, বলবে না। মেয়েটা তাকে জ্বালিয়ে মারছে। আধ ঘণ্টা পোনে এক ঘণ্টা ক্যানভাস করার পর একটু নিজের মতন থাকবে, সেই উপায় নেই। ফেউর মতন এই জরিনা তার পিছনে লেগেছে। এই ছেমড়ি পারেও। আজগরের জীবনটা প্রায় ঝুরঝুরা বানাইয়ে ফেলিচে। কিন্তু যাই হোক, হঠাৎ জরিনার মুখোনার দিকে তাকিয়ে মোসলেমের মনে হয়, মেয়েটার মুখোনায় বড়ো মায়া। চেয়ে পড়লে চোখে ভাসে, যেন তার সেই বড়ো বোনের আদল। তবে বোনটা জরিনার মতন এত কালো ছিল না। মোসলেম এই ফাঁকে বিড়িতে বার দুয়েক টান দিয়েছে। ধোঁয়া ছাড়ল আকাশে। দুপুরের রোদে প্রায় হাওয়াহীন রাস্তায় সে ধোয়া একটু উপরে উঠে খানিকক্ষণ দলা পাকিয়ে থাকে। তারপর হাতের লাঠিখানায় আবার ভর দিয়ে একবারই জরিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, যাই চা খাতি, যাবি?

কোথায়? লঞ্চঘাটের দিক?

হয়। কেন যাবি না?

না, আমি ভাবলাম আপনি আবার ওই বারের সামনে আলম ভাইর দোকানে যান নাই (নাকি? ওই জায়গায় তো সব সাউয়োর ভদ্দরলোকরা চা খায়, ওহানে আমি যাই না। আপনি আবার ওই আলমের দোকান ছাড়া চা খান না!”

তোরে কল কেডা? তোর জন্মের আগের তে এই লঞ্চঘাটে চা খাই। আলমের দোকানডা হল বছরখানেক।

না, আমি আপনারে লঞ্চঘাটের দিক সেরম আসতি দেহি না তো—

তুই এইহেনে আসলি সেদিন, তার দেকপি কোয়ানদে?

জরিনা মোসলেমের সঙ্গে হাঁটে। মেইন রোড ধরে দক্ষিণে একটু এগোলেই বামে লঞ্চঘাটের গলি। দু-পাশে ভাতের হোটেল। সেখান থেকে লঞ্চের যাত্রীদের অনবরত ডাকার কোনও বিরাম নেই। এখন মোড়েলগঞ্জ, হেড়মা, কচুয়া এসব জায়গার লঞ্চ ছাড়ার সময়। এক-আধ ঘণ্টার ভিতরে ছাড়বে। এই লঞ্চঘাটে লঞ্চ আসার ও ছাড়ার সঙ্গে কোর্টের সময়ের সম্পর্ক আছে। প্রতিদিন সকালে এমন সময়ে বিভিন্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চল থেকে এমন লঞ্চগুলো এসে ভেড়ে যাতে যাত্রীরা কোর্ট কাছারিতে তাদের কাজ সারতে পারে। আবার একে একে ছেড়েও যায় এমন সময়, যখন ওই সব জায়গার মানুষের সেদিনের মতন কোর্টের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তখনও যারা যেতে পারে না অথবা যাদের কোর্টের কাজ শেষ হয় না, তারা অনেকেই লঞ্চঘাটের এসব হোটেলে থাকে। এগুলো বেশির ভাগ ছাঁচলাছা হোটেল। দোতলায় শোয়ার ব্যবস্থা। বালিশ-চাদর কোনও রকমের। গরমের দিনে হয়তো একটা বালিশই দেয়। আব্রু বলতে নেই। নীচতলায় খাবার জায়গা, বেঞ্চি লাছা, তারপর পিছনের দিকে ফাঁকা জায়গায় কোনও রকমে একটু টিন দিয়ে ঘেরা পায়খানার জায়গা। গোসলাদি করার জন্যে সামনে নদী।

লঞ্চঘাট রেখে মেইন রোড ধরে নাগের বাজারের দিকে একটু এগোলেই রাহাতের মোড়ে পাশাপাশি তিনটি হোটেল। এই তুলনায় ভালো। রাহাত হোটেল, রহমত হোটেল আর হোটেল বিলাশ। সেই হোটেলগুলোয় একটু অবস্থাপন্ন মানুষজন রাতে থাকে। আরও এগোল মাঝিঘাটের কাছাকাছি আছে হিন্দু হোটেল। সেখানেও ওই চাঁচ লেছে থাকার ব্যবস্থা। যারা শুধু খেতে সেখানে যায়, তারা খেয়ে এসে এই রাহাত, রহমত কি বিলাশ হোটেলে থাকে।

লঞ্চঘাটের দিকে যেতে যেতে মোসলেমকে এক হোটেলের সামনে বসা ম্যানেজার ডাকল, ও মোসলেম ভাই, আইজকে কোর্টে কত লোক–বাণিজ্য খারাপ হইনি–আসেন, ভেটকির মাথা দিয়ে খাইয়ে যান!

মোসলেমকে চেনে সবাই। তাই স্বাভাবিক। একটা পা লুলো মোসলেমকে না চিনে উপায় আছে। এমনকি তার সঙ্গে যে জরিনা, তাকেও চেনে অনেকে। তা মোসলেম তাকে যতই বলুক সে এখানে সেদিন এসেছে, আজগরের সঙ্গে তাকে তো এই লঞ্চঘাটে দেখে সবাই। কেউ কেউ আজগর থাকলে জরিনার সঙ্গে এক আধবার রংঢং-ও করেছে। মোসলেম একবার ভাবে, এই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে না আসাই ছিল ভালো। কোনওদিন তাকে এইসব হোটেল থেকে কেউ ডাকেনি অথবা ডাকার সাহস পায়নি, আজ মনে হয় জরিনার কারণেই তাকে ডাকছে।

মোসলেম হাসে! জরিনা মোসলেমের গা ঘেঁষে এসে বলে, ফটকা এক-একটা মাইয়ে মানুষ দেকলি এহেবারে!

মোসলেম পাশ ফিরে জরিনার মুখ দেখে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে। বুঝে ফেলছে এখন সে তার সঙ্গে আছে তাই তাকে ডাকছে। মোসলেম বলল, হয়। এমনি আমারে ডাহে না কোনওদিন, আইজকে তোরে সাতে দেইহে তারপর ডাকল।

সেইয়ে? তালি দেতাম কয়ডা কতা শুনেইয়ে–

বাদ দে। তোর যা চোপা–এই বয়সে এইরাম চোপা বানালি কী কইরে?

তাই নাই (নাকি)? ও কা, মনে হয় বাড়ির দে বাইরোনের সমায় শাড়ির আঁচলে আমার এই চোপাডারে বাইন্দে নিয়ে আইচি!

মোসলেম পাশ ফিরে আবার জরিনাকে দেখে। সামনে লঞ্চঘাট। সেদিকে যাওয়ার আগে পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবে। সব কটা চায়ের দোকানের সামনে উপরে পলিথিন অথবা দোকানের ঝাঁপ উঁচু করে দেয়া। এমন রোদ, ওই ঝাপের নীচে দাঁড়াতে পারলে হয়। মোসলেম জরিনাকে দেখতে দেখতে ভাবে। অবাক করা মেয়ে। সে কোর্টের সামনে ক্যানভাস কইরে জীবন পার করল, কত পদের মেয়েমানুষ দেখল এই জায়গায়, কিন্তু এমন সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা মেয়ে কম দেখেছে। চোপা নাকি শাড়ির আঁচলের সাথে বাড়ি দিয়ে বাইরোনোর সময় বাইন্দে নিয়ে আইচে, নাকি এই চোপার জন্যেই বাড়ি টিকতে পারেনি।

চায়ের ছোট্ট গেলাস হাতে নিয়ে, চুমুক দিয়ে মোসলেম জরিনার দিকে চোখ বড়ো করে তাকায়। তার ছোটোছেলের চেয়ে বয়সে খুব বড়ো হবে না। চোখ দেখলে বোঝা যায় বুদ্ধি আছে। জীবনের কোন ফেরে পড়ে যে আজ এইখানে এসে জুটেছে, কে জানে।

মোসলেম বলল, তা কী কতিলি চোপা নিয়ে, বাড়িরদে ওই চোপা তোর শাড়ি আঁচলে বাইন্দে নিয়ে আইচিস! কতা জানিস ছেমড়ি, ভালোই কতা জানিস।

জানতি হয় কাকা, জানতি হয়। ভাবেন আপনেরা কোর্টের সামনে মানুষের পকেটদে ফাটকি দিয়ে টাহা নেন, আপনারই কতা জানেন, এই জীবন চালাতি হলি কিছু কতা তো জানতি হয়।

হয়। হইচে আর বুড়ো কতা কইসে না।

জরিনা শব্দ করে হাসে, এইডেরে বুড়ো কতা কলেন?

হয়, নালি কী? কদেহি আজগর তোরে সামলায় কী কইরে?

সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখের তারায় ঝিলিক খেলে। পাপড়িগুলো কাঁপল। একই সঙ্গে সে মোসলেমের আশেপাশের মানুষজনেরও চোখ নিরিখ করল। কেউ মোসলেমের একথা শুনেছে নাকি! তারপর বলল, কেডা যে কারে সামলায়? তারে আমি সামলাতি যাব কোন দুখ্যে? আমার খাইয়ে কাজ নেই?

হইচে। আর ভণিতা করিস না।

যা কলেন? ওই দাঁত নেই, বান্দর নাচানো, খাতি পায় না মানুষটা সামলাবে আমারে। এক দুই দিন সাতে ঘুরলি অমনি সামলানো হইয়ে গেল। ওয়ার ধারে যাওয়া যায় গোন্দে? শেষ কথাটা জরিনা একটু গলা নামিয়ে বলল। সঙ্গে নিজের মতো করে আরও যোগ করে, ও লোক নায় ধোয়? বান্দরগুলোর সাতে থাকতি থাকতি নিজেও হইয়ে গেইচে বান্দরচোদা পদ।

তোর মুহে কিছু আটকায় না, না? চল যাই—

ও খোদা, পান খাবেন না? চা খাইয়ে পান না খালি হয়?

আমি দুপুরে খাইয়ে তারপর পান খাই, এহোন খাব না। তুই খালি নে, আমি পয়সা দিতিচি

জরিনা চায়ের দোকানের পাশে পানের দোকানে পান আনতে যায়। মোসলেম ভাবে, সত্যি মেয়ের ঠোঁট দুটো পানে সব সময় লাল। পানই তো চাবায় সারাদিন। মনে হয়, পান খাওয়ার জন্যে চা খায়, ভাত খায়। হয়তো পান খাওয়ার জন্যে যার-তার সঙ্গে কোথায় কোথায় চলে যায়।

জরিনা এলে মোসলেম একটু আগে হাঁটে। একটা হোটেলের টিনের বেড়ায় জরিনা হাতের চুন। মোছে। পানের পিক ফেলে। তারপর মোসলেম প্রায় কাছে এসে আবার কোর্ট চত্বরে ঢুকে পড়ে। চত্বর আগের তুলনায় একটু যেন ফাঁকা। আদালত ভবনে মানুষের তেমন ভিড় নেই। হঠাৎ মানুষজন গেল কোথায়?

মোসলেম ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাঁ-দিকে যায়। সেদিকে টাইপিস্টদের বড়ো ঘরখানা। এ সময় মোসলেম খেয়াল করে জরিনা যেন তার পাশ থেকে সরে গেছে। সে দাঁড়ায়। পিছনে তাকায়। দেখে জরিনা কী করে। না জরিনা আসছে। পাশের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে কী যেন দেখছিল। তারপর মোসলেমের কাছে এসে বলে, মনে হয় ঝিলিক আইচে। ওই হোটেলে বইসে খায়।

মোসলেম জানতে চাইল, ঝিলিক কেডা?

পরে কবানে–

জরিনা এইটুকু বলতে পেরেছে অথবা পুরোপুরি বলে শেষও করতে পারেনি, এ সময়ে মোসলেম খেয়াল করে, টাইপিস্টদের ঘরের সামনে ছোটোখাটো জটলা। ভিড় তেমন না, কিন্তু উঁচু গলায় ঝগড়া হচ্ছে। কোর্ট চত্বরে ভিড় কম, তার মানে এই নয় মানুষের কোলাহল থেমে গেছে। ডানে তাকালে আজকের অসহনীয় গরমের কারণে চত্বর ফাঁকা ঠিকই, কিন্তু বুড়ো বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে লোক আছে। তার পাশে একটা ছোটো বাক্সমতন নিয়ে ডেমা না শ্রীফলতলার সেই ছোঁকড়া বসছে। আজকালকার ছোঁকড়ারা পারেও। কোথায় না কোথায় দিয়ে বানানো এক যন্ত্র এনে বসে বলে, এতে বাত নিরাময় হয়। নাম যে কী এই ছোঁকড়ার? মনে পড়েছে, দিলদার। নামের বাহার। পাশে ইব্রাহিমের মজমা এখনও চলছে।

যা হোক, ভিড় কমে গেলেও কোলাহল একটু কম, কিন্তু দুইজন মানুষ টাইপিস্টদের বড়ো একচালার সামনে বেশ চেঁচিয়ে কথা বলছে, তা বোঝা যায়। জরিনা তার পাশ থেকে আগেই এগিয়ে গেছে। মোসলেম দেখে, সুকুমার আর আজগরের প্রায় হাতাহাতি হওয়ার দশা। হয়তো জরিনা একটু আগে দেখতে পেয়েছে। তাই মোসলেমের পাশ থেকে আগেই গেছে। মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে যথাসাধ্য দ্রুত এগোয়। শোনে :

সুকুমার ॥ হইচে হইচে, তুই আর কথা কইস নে, শালার মোড়েলগইঞ্জে পদ।

আজগর ॥ মোড়েলগঞ্জ তোরে করচে কী? চোদ্দচে না পোন্দাইচে?

সুকুমার ॥ ফাও কতা কইস নে–

আজগর ॥ ফাও কতা কই কইলাম, কতায় কতায় খালি মোড়েলগঞ্জে মানুষ বুইলগা আমারে খোডা দাও। আমার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ না রায়েন্দা সেয়া দিয়া তোর দরকার কী?

সুকুমার ॥ দরকার আছে। তোরা হলি ডাকাইত, খাতি ডাকাতি কইরে, এহোন এইহেনে আইসে বান্দর চড়াইয়ে খাতিচিস–

আজগর ॥ তাতে হইচে কী? বান্দর চড়াইয়া খাই আর যাই করি–ডাহাতি করচি নাকি?

সুকুমার ॥ ডাকাতিই। বালের ডাকাইতে পদ, এহোন এইহেনে আইসে জুটিচে!

মোসলেম চারদিকে তাকায়। পরিচিত কাউকে খোঁজে। তাদের এই ঝগড়ার কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। বেশির ভাগ দিন তো সুকুমার আর আজগরের দোস্তিই দেখে। আজ সকালেও তাই দেখেছে। মোসলেম যখন একবার এদিকে এসেছিল, তখন দেখেছে, তারা দুজন লঞ্চঘাটের দিক থেকে আসছে। জরিনা সঙ্গে ছিল না। আজগরের বাঁদর দুটো তখন ট্রেজারির পাশে কুল গাছতলায়। সুকুমারের খেলা দেখানোর জিনিসপত্র এপাশের মেহগনি গাছটার নীচে। এখনও সেখানেই আছে। মোসলেম প্রায় তার কাছেই দাঁড়ানো। তারপর লঞ্চঘাটের দিক থেকে এসে তারা মোসলেমেকে বলেছে, কী আপনি এই জায়গায়, এহোন যাননি? নাকি আইজ সারা কোর্ট চত্বরের মানুষজনের জামা-কাপুড় সব পরিষ্কার। কোথায় নেই কোনও মলিনতা। সব শুভ্র সমুজ্জ্বল।

কথাগুলো বলেছিল সুকুমার। ছেলেটা কথা জানে। চটপটেও। প্যান্ট পরে। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে কে জানে? মোসলেম তা জানতে চেয়েছে, তুই মনেও মেট্রিক-ট্রেট্রিক পড়িচিস? হাই স্কুলে গেইলি নাকি?

সুকুমার বলেছে, ধইরে নেন, মেট্রিক ফেল।

ধইরে নেন না। ক দেহি—

আজগর বলেছে, ও মোসলেম কা, ওর কথায় কান দিয়েন না। ও বাড়া এক সেয়ান পাগল।

সেয়ান পাগল? এ আজগর ওর মদ্যি তুই পাগলামির কী দেকলি? ছেমড়াডা কী সুন্দর কইরে কতা কয়?

তাই নাকি? আজগর বলে, ও সুন্দর কইরগা কতা কয়? ওর মুখ শোনচেন আপনে? শোনলে আর ওই কতা কইতেন না।

এই যে এট্টু আগে কী সুন্দর করে আমার ধারে জিগল?

তখন সুকুমার একবার আজগরের শরীরে খোঁচা দিয়েছে, ফাও কতা কইয়ে না। মুরব্বি গুরুজন মান্য কইরও!

ওই দেখিছেন- আজগর বলেছে, আসলে কতা জানে, আপনার সামনে ভক্ত কতা কয়।

মোসলেম হেসেছে। হেসেছে তারা দুজন। তবু কিন্তু মোসলেমের জানতে চাওয়ার সেই রহস্য শেষ হয় না। সত্যি সুকুমার ছেলেটা কিছু হলেও শিক্ষিত, একটু হলেও স্কুল-কলেজে গেছে। যদি কলেজে নাও যায়, হাই স্কুলে গেছে নিশ্চয়। মোসলেম সেকথা আবার তুলেছে, ক দেহি, তুই কোন পর্যন্ত পড়িচিস?

বাদ দেন। বাদ দেন দি ওইসমস্ত। এহোন খেলা দেহাই, পেট চালাই–বাড়িঘর কোথায়ও তাও ভুলে যাতি চাই–এই কোর্টর সামনে জীবন। এই জায়গায়ই একদিন জীবন শেষ হবে। তারপর গলা না-তুলে গান গায়, এই পথেই জীবন, এই পথেই মরণ আমাদের, সবকিছু পথেই যে হায়

মোসলেম শুনল, সুকুমার ছেলেটার গলায় সুরও আছে। এমন ছেলে, কার ছেলে, কোথায় বাড়িঘর, দেখো এইখানে এভাবে জীবন চালায়। মোসলেম একটু বিস্ময়ের সঙ্গে সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

সেই সুকুমার আর আজগরের ভিতরে এক প্রহর বেলা না যেতেই কী আর এমন ঘটল যে এইরকম ঝগড়া হবে। হয়তো আর একটু হলে প্রায় হাতাহাতিই হত। আবার তা নাও হতে পারত। আজগর শারীরিকভাবে দুর্বল, বয়সে সুকুমারের চেয়েও বড়ো। সুকুমার দীর্ঘদেহী, আজগর সে তুলনায় খাটো। এক্ষেত্রে সুকুমার যদি গায়ে হাত না তোলে, আজগরের দিক থেকে সেই সম্ভাবনা কম। আবার সুকুমার সে কাজ করবেও না। কেননা, এই কয়েকদিন হল সে এসেছে এখানে, এখনই এমন কাজ করে এই কোর্ট চত্বর থেকে চলে যাবে নাকি? তারপর যাবে কোথায়? রেল স্টেশনে? স্টেশনে একেবারে পুব কোনায়, যেখানে পুরনো কাপড়ের কলের কাঠামো এখনও আছে, তার পাশে যতটুকু জায়গা, সেই ফাঁকা জায়গায় বিকেলের আগে লোক জমায়েত তেমন হয় না। একমাত্র ইব্রাহিমই সেখানে মজমা মিলিয়ে যদি দুই-চাইর পয়সা কামাতে পারে, সুকুমারের খেলা দেখার লোক সেখানে কোত্থেকে আসবে। মোসলেম এই কদিনে ভেবেছে একবার কোনও সুযোগে সুকুমারের কাছে জানতে চাবে, সে সার্কাসে যায় না কেন? কিন্তু তেমন সুযোগ ঘটেনি।

এখন জরিনাসহ সেই ছোট্ট জটলার পাশ ফুড়ে মোসলেম ঢুকে যায়। বলে, তোগে হইচে কী? এই বিলে চেঁচাতিস কী জন্যি?

আজগর বলল, হবে কী বাড়া? এই চোদ্দনা কোহানদে আইসে জুটিচে?

কেন হইচে কী?

আমারে কয় বেলা চইড়ে যায়, তুমি যাও, যাইয়ে ইব্রাহিমের পাশে এহোন বান্দর নাচাও! তাতে সমস্যা কী?

আপনে আবার বাতাস দিয়েন না। হবে কী জানেন না? ইব্রাহিমের ক্যানভাসের সোমায় কার বালের দায় পড়চে আমার খেলা বান্দরের খেলা দেকপে?

কথা সত্যি! ইব্রাহিম যখন সাপে-কাটা মানুষকে কীভাবে বাঁচানো যায়–এই ক্যানভাস করে, সেখানে ভিড় উপচে পড়ে, তখন কি বানরের খেলা দেখানোর একটা সময় হল? বরং সে সময় চত্বরের পশ্চিম পাশের জায়গা ফাঁকাই থাকে। বারিকও প্রায় ঝিমায়। তার একটু সামনে ইব্রাহিমের মজমা। যত ধরনের বই-ই বারিকের কাছে থাক, সহজ সবজি চাষ কি বেয়ানের সঙ্গে একটি মাধবী রাত আর চন্দ্রনাথ কি দেবদাস, চিতা বহ্নিমান কি বাংলাদেশ রক্তের ঋণ কিংবা আমি মেজর জিয়া বলছি–কোনওটাই কেউ হাতায় না। ফলে, বারিকের ঝিমানো ছাড়া আর কী উপায় থাকে?

তালি সমস্যা কী? তুই গেলি না। সেই জন্যি ঝগড়া বিবাদ করতি হয়?

আজগর বলে, কইলাম, ইব্রাহিমের খেপ শেষ হইলে সেইয়ার পর আমি যাই। বেশিক্ষণ থাকপ। বান্দর দুইটে কহোন বাইন্দে রাহিচি ওই ট্রেজারির ধারে কুল গাছে। সেইয়ার পর সুকুমার যাবে। ও কয়, না, ও যাবে। ইব্রাহিম সইরে যাইতে যাইতে মানুষ থাকপে ভালো, তখন ওর খেলা দেহাইতে সুবিধা। শোনেন কতা?

মোসলেম আজগরের খেপার কারণ বুঝতে পারে। সে সুকুমারের মুখের দিকে তাকায়। আশেপাশে যেসব লোক, তারা কেউই ক্যানভাসার গোত্রের না। তবে, কোর্ট চত্বরে বিভিন্ন কাজে আসে এমন অনেকেই আছে। তারা কেউ কেউ ঝগড়াটা শুরু থেকেই দেখেছে। অথবা তারা ঝগড়াটা দেখেই গেছে, হয় বুঝতে পারেনি কী নিয়ে ঝগড়া অথবা এই বিবাদের কোনও শালিস করতে চায়নি। এমনিতে বেশির ভাগ মানুষেরই এই এক সমস্যা, কাজিয়া-বিবাদ দেখলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, ফ্যাল ফেলিয়ে হাসে, কোনও ধরনের সমাধানের দিকে তারা যায় না। ঝগড়া ফ্যাসাদ কার পছন্দ? কিন্তু এইসব মানুষের অনেকেই তাতে যেন বেশ উৎসাহ পায়। তাছাড়া এই কোর্ট চত্বরে আজগর বানরঅলা আর সুকুমার খেলাঅলা হিসেবে কিছুটা হলেও পরিচিত। তাদের দুজনের এই ঝগড়া অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?

মোসলেম এই পহেলা হাঁক দিল। গলা তার তেমন ওঠে না। সে তো কোর্টের সামনের এক ক্যানভাসার। একেবারেই গলা ওঠে না, একথা কীভাবে বলা যায়? হাঁকটা দিল ভিড়টা পাতলা করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু অনেকেরই পরিচিত এই দুজন মানুষের কাজিয়ার কোনও সমাধান না-হলে তারাও-বা সরে যায় কী করে? তবু, প্রায় ঘণ্টাখানেক ক্যানভাস করার পর গলায় আর জোর থাকুক কি চাই নাই থাকুক, মোসলেম সবাইকে জানাল, দেহি তফাৎ যান, তফাৎ যান, এই দুজনের ঘটনাডা আমারে এট্টু বুঝদি দেন–

তাতেও কিন্তু জনতার কোনও ভাবলেশ দেখা গেল না। তারা সরল না। এক একজন প্রায় কারেন্টের খাম্বার মতন দাঁড়িয়ে থাকল। মোসলেম আর গলা তুলল না। বরং, উলটো ঠেলা দিল। সে জরিনাকে বলল, এ জরিনা, তুই আজগররে নিয়ে এইহেনদে সইরে ওই বারিকের দোকানের ওইদিক যা, আর নয় ওই হোটেলে যা। ওই জায়গায় তোর চেনা আর এক ছেমড়ি আছে আসার সময় কতিলি, সেইহানে যাইয়ে বয়।

না, কোনও জায়গায় যাতি হবে না। আজগর বলে, আপনার ধারে এট্টা বিড়ি থাকলি দেন। এই আবালের কাটাবাড়া সুকুমারের সাতে এহোন এট্টা বোঝাঁপড়া কইরগা সেইয়ার পর এইহানদা যাব–

হইছে। জরিনা আজগরকে বলল, হইচে সুকুমারদার সাতে আর অত বোঝাঁপড়া দিয়ে কাজ নেই?

কেন? বালডা কয়দিন আইসেই এহোন এইসব উলটো পালটা কইতেছে, এইয়ার পর আমাগো সবাইর মাতায় হাগবে। শালা রামপাইলে মাল, ও পদই আলাদা

মোসলেম বুঝল, কথাবার্তা উলটো পালটা হচ্ছে। সুকুমার এমনিতেই একটু মিইয়ে গেছে। বিষয়টা যে সে ঠিক বলেনি, তা বুঝতে পারছে হয়তো। অথবা, ভিতরে ভিতরে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে, যেজন্যে সুকুমার ইচ্ছে করেই আজগরকে ওই কথা বলেছে। সুকুমার চারদিকে লোকজন দেখে আর জরিনা আজগরের কাছে এলে, একটু গলা নামিয়ে সেই কথা বলল; আসলে মোসলেমের দিকে তার নজর, যেন এই কথাগুলো মোসলেমকেই বলা যথাযথ, আমি আসলে ওরে কতি চাইলাম, ইব্রাহিম ভাই হইয়ে গেলি ও যেন এট্টু ডুগডুগি বাজাইয়ে উইঠে যায়। তারপর আমি খেলা দেখাব, আসলে আইজকে কোর্টে ওই রেল লাইন নিয়ে কে এইসমস্ত আছে, শহরের লোকজন সব গাদানো, এট্টু বাদে সব ফাঁকা হইয়ে যাবে।

তুই সেইয়া কইস নাই, তুই কইচিস এহোন ইব্রাহিমের ওই পাশে যাইয়ে, এহোনই খেলা দেহাইতে

তুমি আমার কতা শুনিছো? পাত্তা দিচো আমার কতায়? সেয়ার আগেই তো আমারে প্রায় এইহেনদে বাইর কইরে দেয়ার দশা!

তা তুই ওইরাম কতা কইচিস কে?

আমি কী কতি চাইচি আর তুমি কী কইচো, এট্টু ভাইবে দেইহো–

হইচে–দেহিচি–তুই জানো না, ইব্রাহিম যখন ক্যানভাস করে, তহোন আর কোনও খেলা চলে না, তা কোর্টে যতই ভিড় থাউক। বলে সে সামনের দিকে নির্দেশ করে, দে, চাইয়ে দেখ্‌, ইব্রাহিমের ওই জায়গায় কী ভিড়! যদিও মোসলেমের জানা আছে সুকুমার খেলা দেখানোর সময়ও দারুণ ভিড় হয়।

জটলা ইতিমধ্যে ফেটে গেছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যতই ফাটুক, মোসলেমের কাছে সুকুমার আর আজগরের বিষয়টার আসলে কোনও সমাধান হল না। ইব্রাহিম শেখের ক্যানভাস আর কিছুক্ষণের ভিতরে শেষ হবে। তখন কে যাবে? তাছাড়া এই মনমালিন্য কাজিয়া-বিবাদ নিয়ে এক জায়গায় কাজ করা যায়? প্রতিদিন সকাল হলে একে অন্যের মুখ দেখো, বিকেলে দেখো, নিজেরদের হিসেব নিজেদের মিলিয়ে নিয়ে চলতে হয়। রাত হলেও তো পরস্পরের মুখ দেখে আজগর আর সুকুমার। মোসলেমের নাহয় মুনিগঞ্জে বাসা আছে, নদীর ওপার বাদোখালি গ্রামে বাড়িও আছে, কিন্তু আজগর আর সুকুমারের রাত্রে মাথা গোঁজার ঠাঁইও তো এই চত্বর। নাকি অন্য কোথাও থাকে তারা। দেখেছো, এতদিন একসাথে চলেও মোসলেমের যেন জানা হয়নি কে কোথায় থাকে। না, আজগর থাকে ওই লঞ্চঘাটের দিকে নদীর কূল বেয়ে কিছু দূর হেঁটে গেলে একখানা দোকানঘরের পিছনে ছাপড়ায়, কিন্তু সুকুমার? সত্যি মোসলেম তা জানে না।

মোসলেম পাতলা হওয়া ভিড়ে এবার সুকুমারের কাছে এগোয়। এদিকে জরিনা আজগরের পাশে দাঁড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটতে শুরু করেছে। আজগর বসা। মোসলেমের কাছে থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরিয়েছে সে। সামনের দুটো দাঁত নেই। চুলগুলো উসকোখুসকো, যেন কতকাল ওখানে কোনও সাবানের ছোঁয়া পড়েনি। পড়লেও ওই চুলের তেমন কোনও পরিবর্তন নিশ্চিত হবে না। দাঁত নেই তাতেও আজগরকে মানিয়ে যেত অথবা মানিয়ে গেছে, কিন্তু সেই দাঁতের যা ছিরি! লাল হয়ে আছে, দুটো দাঁতের মাঝখানের ফাঁকগুলো কালো, কোথাও কোথাও খাবারের কণা। আরও আছে। গায়ের রং। একেবারে তেঁতুলের বিচি! হতেই পারে, কিন্তু মানুষ তা একটু ধোয় মোছে যত্ন করে। দিনের ভিতরে একবার নদীতে ডুব দিলে নাওয়া হল, সেইটুকু করতেই যেন আজগরের কত কষ্ট। না, তাও বলা ঠিক হল না, আজগর আসলে অমনই। মানুষ নয়, সেও নায়। সেই কাজটি কখনও মনোযোগ দিয়ে করেছে বলে মনে হয় না। সে তুলনায় তার বানর দুটো পরিষ্কার। ওখানে তার যত্নআত্তি ষোলোআনা। এই লোকের সঙ্গে জরিনা যে কী করে থাকে? মোসলেম অবশ্য অত শত ভাবে না। তবে এটা ভাবে, জরিনা মেয়েটা রং-ঢং জানে ভালো। সাজে সুন্দর করে। দেখো, এতক্ষণে প্রায় দুপুর এগিয়ে আসছে, মানুষের গালেমুখে ঘাম, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অথচ জরিনার চেহারা দেখলে কে তা বলবে। মনে হবে একটু আগে আজগরের ছাপড়া থেকে সেজেগুঁজে বেরিয়েছে। তারপর জানে, কোন সময় তারে কেমন দেখায়। এই যে একটু আগে মোসলেমের সঙ্গে খাওয়ার পর এক খিলি পান মুখে দিল, এখন ঠোঁট দুটো কেমন রাঙা লাল। যদিও যে আজগরের জন্যে ওই ঠোঁটখানা সে লাল করেছে, সে কিন্তু সুকুমারের সঙ্গে ঝগড়ার পরে ওই যে বসেছে, তারপর আর একবারও মাথা তুলে দেখেনি।

তবে, জরিনার একটা বিষয়ে মোসলেম খুব অবাক! দাঁড়িয়ে আজগরের মাথায় হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটছে ঠিকই, কিন্তু একবারও সুকুমারের দিকে তাকিয়ে চোখে কোনও কটাক্ষ করছে না। বরং, মাঝখানে একবার বলেছে, নতুন মানুষ, এই জায়গার নিয়মকানুন এট্টু জাইনে চলতি হয়, হু। তারপর সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বেশ মুচকি এক হাসি।

মোসলেম বলল, তা কী সিদ্ধান্ত হল?

আজগর বলে, সিদ্ধান্ত আর কী? ওর কথায় হবে নাকি?

সুকুমার সরে যেতে থাকে। যেন, এখন এখান থেকে যেতে পারলে হয়। আবার দাঁড়াল। যেন, মোসলেম গুরুজন, মুরুব্বির সিদ্ধান্তের এক সম্মান আছে। কিন্তু সুকুমার তো তার ভুল স্বীকার করেই নিয়েছে। বলেছে, ইব্রাহিমের পর পর আজগর একটুক্ষণ যদি ডুগডুগি বাজায় তাহলে লোকজন আর যাবে না, তখনই সুকুমার সেই আসরে ঢুকে পড়বে। আজগরের আজ আর খেলা দেখাতে হবে না। তার বিষয়টা সুকুমার পুষিয়ে দেবে। কিন্তু সেই কথাটাও যেন আজগরের সামনে। তোলা যায়নি, তার আগেই খেঁকিয়ে উঠেছে। এখন আর ওই কথা বলে লাভ কী? সুকুমার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, আজ আর সে যাবে না ওই চত্বরে। মনে কোনও উচাটন টেনশন আর দোটানা অথবা মন খারাপ নিয়ে কোনওভাবে তিন ফলকের খেলা দেখানো যায়?

এবার, এতক্ষণে সুকুমার একটু চঞ্চলতা দেখাল, মোসলেম কাকা, যা কবেন, তাড়াতাড়ি কন। যাই, একদিক দে ঘুইরে আসি

না, কব আর কী? এই জায়গায় নিজেগো এট্টু মিলেমিশে থাকতি হয়, নিজেগো মদ্যি ভুল বোঝাবুঝি হলি মানষি কবে কী?

তা সত্যি।

এ সময় একটু আগে জরিনার হোটেলে দেখা সেই মেয়েটি আসে। মোসলেম মেয়েটিকে চেনে। আগে দেখেনি। মেয়েটি এখানে এসে সুকুমারের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটাও তার লক্ষ করা হত, যদি জরিনা আজগরের চুলে একটা টান না দিয়ে বলত, ওই যে ঝিলিক আইচে!

তাহলে এই মেয়ের নাম ঝিলিক। এই চত্বরে নতুন। কার কাছে এসেছে, কেন এসেছে, কোথা থেকে এসেছে, মোসলেমের জানা নেই। কিন্তু জরিনার ওই কথা বলায় সে বুঝল, সে আগে থেকেই চেনে। শাড়ি পরা, আঁচল ঘাড়ের কাছে যত্নে তোলা, বেণি দুই দিক দিয়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে বেশ ঝুলিয়ে দেয়া, পায়ে মোগল চপ্পল। এ মেয়েও পান খায়!

ঝিলিকের গলার স্বরে একটু মোটা ধাঁচ। শরীরও বয়েসের তুলনায় ভারি। কোথায় যেন দেখানোপনাও আছে। এই এসেই বলল, এহানে হইচে কী?

জরিনা বলল, হবে কী? এমন ভাব করো যেন দারোগা?

শুনে ঝিলিক গলা খুলে হাসল। তারপর বলল, সুকুমার বাঁধাইচে? আজগর ভাইর সাথে? ও যে জায়গায় যাবে!

সুকুমার চারদিক তাকাল। যেন ঝিলিক এখানে না আসায় তার জন্যে ভালো ছিল। সে মোসলেমকে বলল, ও কা, যাই এট্টু অন্য দিক। কাজ আছে, ঘুরে আসি। বারিকদার ওই জায়গায় আমার যন্ত্রপাতি থাকল, আসপ এহোনই

মোসলেম নীচু স্বরে বলল, আচ্ছা।

এবার সুকুমার ঝিলিককে বলল, তুমি যাবা? চলো–

সুকুমারের চলে যাওয়ায় বোঝা গেল, ভিতরে ভিতরে সে নাখোশ। এ নিয়ে অবশ্য মোসলেমের কী-ই বা করার আছে। সে আজগরকে কিছু একটা বলবে ভাবে, কিন্তু কী বলবে। আজগর উঠে জরিনাকে নিয়ে গেল বারিকের দোকানের দিকে। মোসলেম সেদিকে তাকিয়ে থাকল। এখন, আজগর ওখানে গিয়ে বুঝবে আর কতক্ষণে শেষ হবে ইব্রাহিমের মজমা। তারপর একবার তার বাঁদর দুটোর কাছে যাবে। জরিনা হয়তো বসে থাকবে বারিকের সামনে কি পাশে। বারিককে পটাবে, সে পান খাবে কি না। এতক্ষণে জরিনার মুখের পান প্রায় শেষ। কিন্তু ঝিলিক নামের এই মেয়েটিকে কোনওভাবেই চিনল না মোসলেম। এখানে কয়দিন হল এসেছে? সে জানে না। সুকুমারের সঙ্গে তার সম্পর্কে কী? গেল তো একসাথে। ওদিকে জরিনা চেনে ওই মেয়েকে। চিনুক। একটু আগের ঘটনায় মোসলেমের মনটা একটু খারাপ। সুকুমার আর আজগর পরে আবার এনিয়ে এক চোট লাগবে না তো। সুকুমারের ভঙ্গিতে মনে হল, আজ সে আর যাবে না চত্বরে। অথচ যতই গরম পড়ক, এর ভিতরে মোসলেমের যথারীতি একটি দিন শুরু হয়েছিল। কোর্টে উপচানো ভিড়ে সেই মজমার জমায়েতে মানুষও হয়েছিল ভালো। আলেকজান আজ বাজার-সদাইর কথা বলেছে। সে বিকেল হলেই যাবে। যথারীতি শুরু হওয়া একটি দিন হঠাৎ, এত রোদের ভিতরে মরে গেল কেন? পাশ থেকে দুজন মানুষ ট্রেনের কেসের আবার হিয়ারিঙের ডেট পড়িচে বলতে বলতে চলে যায়। সব কথার অর্থ মোসলেম বোঝে না। কিন্তু কোর্টচত্বরে চলে এমন শব্দ কোনটা কোনটা বোঝে। সে ডানে গিয়ে একবার বারিকের বট গাছের নীচে তাকায়। তারপর সোজা মেইন রোড ধরে আবার উকিল বারের সামনে আলমের চায়ের দোকানের দিকে হাঁটে। সেখানে গেলে ট্রেনের ঘটনা জানতে পারবে।

এই পথটুকু যেতে যেতে মোসলেম আবার তার মজমা মিলানোর কথা ভাবে। সেই উঠে যেতে যেতেই তো ইব্রাহিম শুরু করেছিল। তারপর কোন ফাঁকে এসব হল। মোসলেম ভাবে, গোল হয়ে বসে সে আবার আউ-আউ-আউ করার জন্যে ডান হাতের তালু মুখের কাছে ছোঁয়াল। জমায়েত বাড়ছে। অনেকেই জানে মোসলেম কী করে, কী করবে। সঙ্গের পোটলাটা পায়ের কাছে। ধীরে ধীরে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত বলল। তার ভিতরে কোনও কথায় নিজেই হেসে উঠল। কোথায় কোন খান সেনা কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে জামা কাপড় কালো করেছিল, তারপর সে জানতে চেয়েছিল এই দেশে জামা কাপড় কেন পরিষ্কার হয় না। তাই নিয়ে ব্যঙ্গ করল। যদি সে জানত, কবি মাইকেল মধুসূদন বিলাত থেকে জামা কাপড় কাঁচাতেন, কারণ বাংলাদেশে তখনও কাপড় জামা কাঁচার ভালো সাবান ছিল না। সব সোডায় ক্ষারে ধোয়া হত, তার মতন কবি এইসব ক্ষারে কাঁচা জামা-কাপড় পরলে মান ইজ্জত থাকে। সেই যশুরো পাবলিক যদি একদিন এই মোসলেমের পাউডারের খোঁজ পাত, তালি আর যাই হোক কোনওদিন বিদেশে জামা কাপড় পাঠাত না।

এই পর্যন্ত জানিয়ে সে তার কেরামতি দেখানোর জন্যে পোটলায় হাত দিল। বেরুল একটি ছোটো গামলা, এক বোতল পানি, একটি কাগজের ঠোঙায় পরিষ্কার এটেল মাটি। এই মাটি নদীর ওপারের চরগাঁ থেকে আনা। এরপর দর্শকদের কাছে জানতে চাইল, আছে কারও পকেটে পরিষ্কার পাঁচ টাকার নোট। না, থাকুক। মোসলেমের পকেটে মজুদ। কোর্ট মসজিদ রোডের সোনালী ব্যাংক থেকে সপ্তায় সপ্তায় সে আনে, কোনও দোকানে পেলে সংরক্ষণ করে। সেই টাকার একটি এবার মোসলেম তার পকেট থেকে বের করে। প্রায় চতুর্দিক ঘুরিয়ে সবাইকে দেখায়। বসা থেকে লাঠিভর দিয়ে উঠে দুই-একজনকে ধরে দেখতে বলে, টাকাটা আসলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কি না। আর কী পরিষ্কার, একেবারেই নতুন। সে জমায়েতকে জানায়, কিছুক্ষণ আগে সে কোর্ট মসজিদ রোডের সোনালী ব্যাংক থেকে এনেছে।

এরপর মোসলেম হাঁটুমুড়ে বসে। ঠোঙা থেকে অর্ধেক পরিমাণ মাটি ঢালে তার সামনের ঘাস ওঠা মাঝখানে দুই-একখানা খোয়াময় ভূমিতে। সেই মাটিতে আধ বোতলের মতন পানি ঢালে। মাটিটা ভালোমতো কচলায়। হাতে চটকে চটকে একেবার কুমরোর মাটি ডলার মতো একেবারে মণ্ড করে ফেলে। আঠালো মাটি, মোসলেমের দীর্ঘদিনের মাটি ডলার অভিজ্ঞতায় সে মাটি বেশ জুতের হয় যেন একতাল ময়দা সে সামনে রাখছে। এবার আবারও দু-হাতের চার আঙুলে টাকাটা উঁচু করে সবাইকে দেখায়।

এ সময়ে মোসলেমের মুখে কথা চলতেই থাকে। কেন টাকাকে সে এমন মাটিতে দিচ্ছে। টাকার ময়লা আসল ময়লা, চোদ্দজনের হাতের ছোঁয়া লাগে প্রতিদিন টাকায়। টাকা যে পরিমাণে ময়লা হয়, এর চেয়ে আর কোনও কিছু এত বেশি ময়লা হয় না। কিন্তু ময়লা টাকারও দাম থাকে। একই। এই টাকাটাকে সে এখন আরও ময়লা করতে মাটির সঙ্গে এইভাবে চটকে দিচ্ছে।

মোসলেম এবার টাকাটাকে ভাঁজ করে মাটির সঙ্গে কচলায়। ভঁজ করতে করতে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণে করে ফেলে। তারপর ওই মাটির গহ্বরে সেধিয়ে রাখে। এমন থাকে টাকাটা কিছুক্ষণ। এই সময় মোসলেম তার জীবনের গল্প বলে। অভিজ্ঞতার কথা বলে। বাম হাত মুছে ঝোলা থেকে বের করে দড়ি-বাঁধা এক তাড়া চিঠি। কারা কারা তাকে প্রশংসা করে চিঠি লিখেছে। চিঠিগুলোর বেশির ভাগই পোস্টকার্ড। যদি সামনের কেউ চায় তো সে পড়ে শোনাতে পারে।

তা কি কেউ চায়? সবাই অপেক্ষা করছে মোসলেমের কাপড় ধোয়া পাউডারের কেরামতি দেখতে! সে ডান হাতটা বোতলের পানিতে থোয়। সামনের ছোটো গামলাটায় পানি ঢালে। এরপর ঝোলা থেকে বের করে মাত্র একটি প্যাকেট। প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া সাদা পাউডার। মোসলেম উদ্দিনের কাপড় ধোয়ায় গুড়ো সাবান! গামলার পানিতে সেই পাউডার ছড়িয়ে দেয় সে। ভালো করে গোলায়। গামলার তলায় এক টুকরো ইটের ঠেক দিয়ে কাৎ করে রাখে। আবার টাকাটা মাটিতে চটকায়। তারপর গামলার পানিতে ছাড়ে। সবাইকে বলে, মাত্তর দুই মিনিট। দুই মিনিট বলে, মোসলেম নিজের বাঁ-হাতে বাঁধা পুরনো ছোট্ট হাতঘড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু সমবেত জনতাকে জানায়, এখন দু-মিনিট রাখার প্রয়োজন নেই। এই যে ভালো করে ধুইলাম। ধুতে ধুতে ভাঁজ করা টাকাটা মেলে দেয়। মেলে পানিতে খলবলায়। টানটান করে। ততক্ষণে টাকাটা সত্যি পরিষ্কার। এবার অপরিষ্কার পানি ফেলে দিয়ে, সেখানে আর-একটু পরিষ্কার পানি ঢালে। টাকাটা নাড়ে। অথবা, টাকাটা সেখানে সাঁতরায়। তারপর ঝাড়ে। টাকার গা থেকে পানি ঝাড়ে। তারপর পরনের পরিষ্কার লুঙ্গিখানায় উরুর কাছে কিছুক্ষণ চেপে রাখে। পরিষ্কার লুঙ্গি টাকা গায়ের জল টানে।

এরপর মোসলেম সেই টাকা আবার দুই হাতের চার আঙুলে উঁচু করে দেখায়। সত্যি টাকাটা একেবারে চকচকে পরিষ্কার। একটু ভিজে ভাব আছে, কিন্তু সেই আগেরই টাকা। একেবারে নতুন।

এবার সমবেত জনতার মুখের দিকে তাকানোর পালা। মোসলেম জানাল, তার বলা কওয়া শেষ; যদি আপনাদের বাড়িঘরে জন্যে লাগে, যদি লাগে অফিস আদালতে, সামনের দুজনকে বলল, অপরিষ্কার লুঙ্গি পরলে কী-কী রোগ হতে পারে। কেন তারা এই কাজ করে? মাত্র দুই টাকার একটি প্যাকেটে এক বালতি কাপড় ধোয়া যায়। ক্ষারে সোডায় কাপড়ের চেহারা ভালো থাকে না। যার লাগে জায়গায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিলেই হবে।

অনেকেই দু-টাকা বের করে। কেউ হাতে নেয় চারটি পঞ্চাশ পয়সার রেজগি। মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেয় পাউডার। এই সময়টাই তার সবচেয়ে আনন্দের। আলেকজানের হাতে কেরামতি আছে। সেই আনন্দে মোসলেমের ল্যাংচে-চলা পায়ে একজন থেকে একজনের সামনে যায়।

আজও তো এমন একটি দিনই ছিল। ওই আজগর আর সুকুমার মোসলেমের সেই আনন্দে খচখচানি। নিজেগে মদ্যি কেউ বাধায়? ঝিবুতপালা (ছোটো ছেলেমেয়ে) বেবোধ, বোধ যে কবে হবে। এ কথা ভাবতে ভাবতে সে আলমকে চা দিতে বলে। আর কানখাড়া করে রাখে যদি আশেপাশে কেউ ট্রেনের কেসের কী হল, তা নিয়ে কথা বলে।

সে ভাবে, ট্রেন উইঠে গেলি খবর আছে। সবাই তহোন বাসঅলাগো হাতে জিম্মি! আর কোনওদিন ষাটগম্বুজ যাত্রাপুর মূলঘর ফকিরহাট বাহিরদিয়া সামন্তসেনায় ক্যানভাস কইরে পেটের ভাত জোটাতি হবে না। কোর্ট তো কত কত দিন বন্ধ থাকে, কিন্তু ট্রেন তো চলে সারা সময়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *