০১. উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন

উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন সালের এক শ্রাবণ-অপরাহ্নে জীবন মশায় এমনি করেই তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। পথের উপর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকলে।

–প্ৰণাম গো, ডাক্তার জ্যেঠা।

–কে? মতি! কোথায় যাবি রে?

মতি কর্মকার কয়লার ধুলোমাখা আটহাতি কাপড়খানা পরেই কোথায় হনহন করে চলেছে। গোষ্ঠ কর্মকারের ছেলে মতি। গোষ্ঠ ডাক্তারকে বড় ভক্তি করত। ডাক্তারও তাকে ভালবাসতেন। গোষ্ঠ অনেকগুলি ওষুধ জানত। সন্ন্যাসীদত্ত ওষুধ। রঘুবর ভারতী ছিলেন বড়দরের যোগী। এসব ওষুধ তার কাছ থেকে পেয়েছিল সে। ডাক্তারকে গোষ্ঠ ওষুধগুলি দিতে চেয়েছিল। ডাক্তার নেন। নি। তবে অনেক রোগীকে তিনি পাঠিয়ে দিতেন গোষ্ঠের কাছে। বিশেষ করে দুদিন অন্তর জ্বরের জন্য। বড় পাজি জ্বর ওটা। পালাজ্বর অর্থাৎ একদিন অন্তর জ্বর—তবু ওষুধ মানে। কিন্তু ওই দুদিন অন্তর জ্বর ও ওষুধ মানে না। মানাতে অন্তত দীর্ঘদিন লাগে। কুইনিন ইনজেকশনও মানতে চায় না। অথচ ওই রঘুবর ভারতীর ওষুধে একদিনেই বন্ধ হয়ে যাবে। আগে গোষ্ঠ দিত, এখন মতিই দেয়, জ্বরের নির্দিষ্ট দিনে একটা হলুদমাখা ন্যাকড়ায় একটা জলজ গাছের পাতা কচলে রস বার করে বেঁধে শুকতে দেয়। তাতেই জ্বর বন্ধ হয়। হবেই বন্ধ। বিচিত্র দ্ৰব্যগুণ রহস্য! অতি বিচিত্র। এই রোগী পাঠানো নিয়েই গোষ্ঠের সঙ্গে ডাক্তারের তরঙ্গতা হয়েছিল। এদেশের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা চিকিৎসা-প্রণালী প্রচলিত ছিল বিস্ময়কর ফলপ্রদ চিকিৎসায় একবার তার ইচ্ছা হয়েছিল এই চিকিৎসা-প্রণালী জান পর, কিন্তু—হুঁ। কিন্তু তাঁর গুরুর নিষেধ ছিল। তিনি বলেছিলেন ডাক্তারি যখন শিখেছ, তখন ওদিকে যেয়ো না। যার গুণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে জান না, তাকে প্রয়োগ কোরো না।

মতি কর্মকার বললে—একবার আপনার কাছেই এলাম জ্যেঠা।

বাঁচলেন মশায়। একজন কথা বলবার লোকের জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। এবার তক্তপোশে ভাল করে বসলেন তিনি, পুরনো তাকিয়াটাকে টেনে নিয়ে বললেন–আয় আয়। বোস। কী খবর বল?

—একবার আমার বাড়িতে যেতে হবে।

–কেন?

–মাকে একবার দেখতে হবে।

–কী হল মায়ের?

–আজ্ঞে, মাসখানেক হবে, পুকুরঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তাপরেতে খুবই বেদনা হয়, নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। তখন দেখে বেঁধেছেদে ছেড়ে দিয়েছিল, বলেছিল,–দিনকতক ওঠাহাঁটা কোরো না, সেরে যাবে। তাই গিয়েও ছিল। কিন্তু আবার আজ দিন আষ্টেক হল বেদনাটা চাগিয়ে উঠেছে; দিনরাত কনকন করছে। আবার নিয়ে গেলাম হাসপাতাল বললে, এক্স-রে করতে হবে, সে না হলে কিছু বলতে পারবে না। তা—সে তো অনেক খরচ–অনেক ঝাট! তাই বলি, যাই জ্যেঠার কাছে।

হাসলেন জীবন মশায়। বেচারি মতি! বুড়ো মা গলায় কাঁটার মত লেগেছে। মায়ের উপর মতির গভীর ভালবাসা। মায়ের প্রতি তার এই ভুক্তির জন্য লোকে বুড়ো খোকা বলে। মায়ের কষ্টও সে দেখতে পারছে না-আবার এক্স-রে করানোও তার পক্ষে অনেক ঝাট। অগত্যা। এসেছে তার কাছে। তা বেশ কাল সকালে যাব।

–আজ্ঞে না, একবার চলুন এখুনি। বুড়ি চিৎকার করছে আর গালাগাল করছে আমাকে। বলছে, নিজের মেয়ে হলে এমনি অচিকিৎসেতে ফেলে রাখতে পারতিস?

বলতে বলতে খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মতি। বললে—সারা জীবন মায়ের অযত্ন করি নাই, আজ মা আমাকে–কেঁদে ফেললে মতি।

ডাক্তার বললেন, চল হবে। দেখে আসি।

খালি গায়েই বেরিয়ে পড়লেন মশায়। মতি ব্যস্ত হয়ে বললে—আপনার ছাতা?

–ছাতা লাগবে না, চল। এই ফিনফিনে জলে—এতে ছাতা লাগে না। ভারী পায়ে ডাক্তার হটেন; গতি একটু মন্থর। মতি ছুটে চলে গেল।–আমি যাই জ্যেঠা, বাড়িতে খবরটা দিই গে।

—যা।

এগিয়ে গিয়ে মতি বাড়িটা একটু পরিষ্কার করে ফেলবে। ছেলেপুলেগুলোকে সামলাবে। বোধহয় মতির মা ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে আছে, সেখানা পালটে তাড়াতাড়ি একখানা ফরসা কাপড় পরাবে। ডাক্তারের অজানা তো কিছু নাই।

বাড়ির দোরে গিয়ে গলা ঝাড়লেন ডাক্তার। তারপর ডাকলেন–মতি!

মতি সাড়া দিলে—আজ্ঞে, এই যাই।

তার মানে–আরও খানিকটা অপেক্ষা করুন ডাক্তার জ্যেঠা। এখনও প্রস্তুত হতে পারি নাই। দাঁড়ালেন ডাক্তার, ভালই হল, বরাবর সামনে দেখা যাচ্ছে সোজা কাঁচা সড়কটা। এই পথেই সাদা কাপড়ের ছাউনি দেওয়া ছাতা মাথায় দিয়ে আসবে সেতাব মুখুজ্জে। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে নেভানো লণ্ঠন আর দাবার পুঁটুলি। কিন্তু কই সেতাব?

মতি ডাকলে—আসুন জ্যেঠা।

 

বৃদ্ধা কাতর হয়ে পড়েছে। মতি ঠিক বলেছে—জেরবার হয়ে পড়েছে বুড়ি। হাঁটুটা ফুলেছে। স্ফীত স্থানটার উপর হাত দিলেন ডাক্তার। রোগী কাতরে উঠল, ডাক্তার চমকে উঠলেন। জ্বরও হয়েছে যেন! হটু থেকে হাত তুলে বললেন–হাতটা দেখি।

নাড়ি ধরে বসলেন ডাক্তার।

–জ্বর কবে থেকে হল?

মতি বললে—জ্বর তো হয় নাই জ্যেঠা।

–হয়েছে। নাড়ি দেখতে দেখতেই বললেন– ডাক্তার।

মতির মা ঘোমটার ভিতর থেকেই ফিসফিস করে বললেও বেথার তাড়সে গা খানিক জ্বর-জ্বর করছে। বেথা সারলেই ও সেরে যাবে।

–হ্যাঁ, ব্যথা সারলেই জ্বর সারবে, জ্বর সারলেই ব্যথা সারবে।

–না-না, জ্বরের ওষুধ আমি খাব না। জ্বর আমার আপনি সারবে। আপুনি আমাকে পায়ের বেদনার ওষুধ দেন। জ্বরের চিকিৎসের দরকার নাই। ও কিছু নয়। কুনিয়ান খেতে নারব–ফোঁড় নিতেও নারব। ওপোস দিতে–বুড়ি থেমে গেল। না খেয়ে থাকতে পারব না বলতে বোধ করি লজ্জা পেল।

ডাক্তার হেসে বললেন–উপোস তোমাকে করতে হবে না। সে আমি বলব না তোমাকে। তুমি তো আমার আজকের রোগী ও গো। নতুন বই থেকে তোমাকে দেখছি আমি। সেবার পুরনো জ্বরসে তো আমিই সারিয়েছিলাম। গোষ্ঠ আমার কাছে কবুল খেযেছিল। রাতদুপুরে হেঁসেল থেকে মাছ ভাত বের করে তোমাকে খাওয়াত সে। সে আমি জানি। তাতেই আমি তোমার জন্যে পোরের ভাতের ব্যবস্থা দিয়েছিলাম।

হাসতে লাগলেন ডাক্তার।

ঘোমটার মধ্যে জিভ কেটে লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে গেল মতির মা। গোষ্ঠ তাকে চুরি করে খাওয়াত না, সে নিজেই চুরি করে খেত। একদিন স্বামীর কাছেই ধরা পড়েছিল। তার পরদিনই গোষ্ঠ ডাক্তারের কাছ থেকে পোরের ভাতের ব্যবস্থা এনেছিল।

ডাক্তার বললেন–তা বল না কী খেতে ইচ্ছে?

চুপ করে রইল মতির মা। এরপর আর কী উত্তর দিতে পারে সে? লজ্জায় তার মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছি!

–বল, লজ্জা কোরো না। যা ইচ্ছে হয় খেয়ো। যা খুশি। মতির দিকে তাকিয়ে বললেন– মায়ের যা খেতে ইচ্ছে খেতে দিবি, বুঝলি?

—আর ওষুধ? শঙ্কিতভাবেই প্রশ্ন করলে মতি। চাপান কি কিছু?

–কিছু না। খেতে দে বুড়িকে ভাল করে। কালীমায়ের স্থানের মৃত্তিকা লাগিয়ে দে। বাস।

মতির মা-ও মাথার ঘোমটা খানিকটা কমিয়ে দিলে। বললে—যাতনায় পরান যে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার।

—তবে আগুনের সেঁক। শত বৈদ্য সম অগ্নি, ওর চেয়ে বেদনার আর ওষুধ হয় না। নুনের পুঁটলি করে সেঁক দে। ওতেই যা হয় হবে।

—ওতেই যা হয় হবে? ওষুধ দেবেন না? যা খুশি তাই খাব? আমি তা হলে আর বাঁচব না? পরিপূর্ণভাবে ঘোমটা খুলে মতির মা এবার ডাক্তারকে প্রশ্ন করে নিম্পলক দৃষ্টিতেই তাঁর দিকে চেয়ে রইল। বিচিত্র সে দৃষ্টি! কঠিনতম প্রশ্ন সে দৃষ্টিতে সমুদ্যত হয়ে রয়েছে। জীবনের শেষ প্রশ্ন।

এমন দৃষ্টির সম্মুখে কেউ বোধহয় দাঁড়াতে পারে না। পারে তিন প্রকারের মানুষ। এক পারে বিচারক–যাকে প্রাণদণ্ড দিতে হয়। আসামি যদি তাকে প্রশ্ন করে–আমাকে মরতে হবে?–তবে বিচারক বলতে পারে–হ্যাঁ, হবে।

আর পারে জল্লাদ—যে ওই দণ্ড হাতে তুলে দেয়।

আর পারে চিকিৎসক।

জীবন মশায় সেকালে বলতে পারতেন। অবশ্য প্রবীণ রোগীকেই সাধারণত বলতেন–আর কী করবে বেঁচে? দেখলেও অনেক, শুনলেও অনেক, ভোগ করলেও অনেক, ভুগলেও অনেক। এইবার যারা রইল তাদের রেখে–। প্ৰসন্ন হাসি হাসতেন।

তাঁর বাবা জগৎমশায় শেষটায় বলতেন, গোবিন্দ! গোবিন্দ! হরিনাম কর, ইষ্টনাম কর। নামের তরী বাঁধা ঘাটে।

তাঁর ডাক্তারিবিদ্যার গুরু রঙলাল ডাক্তার ছিলেন বিচিত্র মানুষ। রোগীর সামনে সচরাচর মৃত্যুর কথা বলতেন না। তবে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন—Medicine can cure disease but cannot prevent death; বলেই লম্বা পা ফেলে রোগীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেন।

আজ জীবন ডাক্তার মতির মায়ের দিকে চেয়ে হেসে বললেন–তাতেই বা তোমার দুঃখ কিসের গো? নাতিপুতি ছেলে বউ রেখে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে। পার তো চলে যাও তীর্থস্থানে।

কথার মাঝখানেই মতি বলে উঠল—এই দেখুন ডাক্তার জ্যেঠা, কী বলছেন দেখুন। হাঁ গো, সে টাকা আমাদের আছে?

—কেন? এই তো দশ ক্ৰোশ পথ, ট্রেনে যাবি, বাড়ি ভাড়া করে রেখে আসবি। কী-ই-বা খরচ? কাটোয়াতে ভিড় বেশি, অনেক পূর্ববঙ্গের লোকজন এসেছে—তার চেয়ে উদ্ধারণপুর ভাল। পাড়াগা-গঙ্গাতীর, সারবার হলে এক মাস গঙ্গার বাতাস গায়ে লাগালেই সব ভাল হয়ে যাবে। নিত্য গঙ্গাস্নান করবে, দেখবি মায়ের নবকলেবর হয়ে যাবে। না হয়–

কথা অসমাপ্ত রেখেই ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হাত দুখানি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–মতি, জল দে হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *