বাইচ

বাইচ

দুখানা চলেছিল পাশাপাশি; তিরের বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল। জলটা যেন বাতাসের মতো লঘু হয়ে গেছে। জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও আজ বাইচের নৌকোগুলো তাদের পিছনে ফেলে যেতে পারে।

নদীর দু-ধারে কাতারে কাতারে লোক। বিজলিবাতির আলোয় ঝলমল করছে জল। পটকা ফুটছে। আগুনের আঁকাবাঁকা রেখা এসে আকাশে উঠছে, হাউই ফেটে পড়ছে একরাশ জ্বলন্ত ফুল ছড়িয়ে। এপারে মেলা বসেছে, মানুষের হট্টগোল উঠছে তাল-মাপা দাঁড়ের আওয়াজকে চাপা দিয়ে।

এমন আনন্দের দিন কখনো আর আসেনি। আগে যখন দুর্গা পুজো হত, হত সরস্বতীর ভাসান, তখনও আশেপাশের গাঁ থেকে বাইচের নৌকো নিয়ে আসত মানুষ, বকশিশ পেত বাবুদের কাছ থেকে। কিন্তু তার সঙ্গে এর তুলনা! সে ছিল ওদের উৎসব। কিন্তু আজকের দিন আমাদের। আমার, তোমার, সকলের। এ হল আজাদির দিন, মুক্তির দিন। আজকের নদীর এই ঘোলাজলের দিকে তাকাও, আর কারও নৌকো বুক ফুলিয়ে এর উপর দিয়ে ভেসে যাবে না। প্রাণ ভরে টেনে নাও আজকের বাতাস, আর কারও নিশ্বাস একে আবিল করে দেয়নি। মাথার উপর যত তারা দেখছ ওরা সব তোমার, এই দিনটিতে একান্তভাবে ওরা তোমারই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

হালের মাঝি কয়েক বার সজোরে পা ঠুকল নৌকোর গলুইয়ে। ডুম ডুম করে দ্বিগুণ বেজে উঠল ডঙ্কার আওয়াজ। দোলা খেয়ে গেল রক্ত।

শাবাশ জোয়ান, হেঁইয়ো–

আগ বাড়ো ভাই, আগ বাড়ো–

পাশাপাশি দুখানা নৌকো। প্রতিযোগিতা চলছে এদেরই মধ্যে। বাকি যারা পিছিয়ে পড়েছে। তারা আর ধরতে পারবে না। সুতরাং, জীবন-মরণ পণ চলছে এই দুখানার ভিতর।

বাইশ বাইশ করে চুয়াল্লিশখানা দাঁড় দুই নৌকোয়। প্রত্যেকটি খেপের সঙ্গে প্রতি মাল্লার বাহু থেকে বুক পর্যন্ত পেশিতে পেশিতে ঢেউ খেলছে। ক্লান্তি নয়, অবসাদ নয়। হাতের শিরাগুলো ঢিলে হয়ে আসতে চাইলেই হালের মাঝি গলুইয়ে পা ঠুকে চেঁচিয়ে উঠছে বিকট গলায়। ডঙ্কার শব্দে কেটে যাচ্ছে ঘোর। আগ বাড়ো ভাই, আগ বাড়ো…

সামনের ওই বাঁক ঘুরে এক পাক। আরও এক পাক তারপরে। তারও পরে ওই বাঁধাঘাটে ভিড়তে পারলেই জিত। ইনাম, বকশিশ।

সামনে দুখানা চলছে গায়ে গায়ে। কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। সমানে সমানে!

এই, তোমার হইল কী? সাগু খাইয়া টান মার নাকি?

গলুইয়ের মাঝি এ নৌকোর তিন নম্বর দাঁড়ের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল।

তিন নম্বর ভাসা ভাসা চোখে তাকাল। কপালে টলটলে ঘাম। বাহু দুটো যেন ছিঁড়ে পড়ছে তার। পিছন থেকে কেউ যেন একটা আসুরিক চাপ দিয়ে তার পিঠ-পাঁজর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে।

ওই বাঁকের পর আরও এক পাক! তারও পরে ওই বাঁধাঘাট! তিন নম্বরের সমস্ত চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে একাকার হয়ে। সব ঝাপসা, সব অস্পষ্ট। কোনো অর্থ নেই চারপাশের ওই আকাশ-ফাটানো চিৎকারের। আলোগুলো সব লেপটে যাচ্ছে একসঙ্গে; উড়ন্ত হাউইয়ের জেল্লা চোখের মণিতে এসে বিঁধছে একরাশ কাঁটার মতো।

তবু প্রাণপণে সে দাঁড়ে টান মারল। টান মারল যন্ত্রের মতো। জিততেই হবে যেমন করে হোক। বকশিশ মিলবে, ইনাম মিলবে। আর মিলবে খাবার। তা ছাড়া শহরে কোথায় যেন বিনা পয়সায় খেতে দিচ্ছে আজ। আনন্দের দিন। বাজি পুড়ছে, হাউই উড়ছে। আলগা হয়ে গেছে বড়োলোকদের শক্ত মুঠো, দরাজ হয়ে গেছে দিল।

ডুম-ডুম-ডুম–

ডঙ্কার আওয়াজ। আরও জোরে টান মারো জোয়ান—আরও জোরে। পাশাপাশি চলেছে। দুখানা। প্রতিযোগিতা চলেছে সমানে সমানে। জিততেই হবে। দু-ধার থেকে চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে অগুন্তি লোক।

আগ বাড়ো, আগ বাড়ো…

এরই মধ্যে এক ফাঁকে বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে ফেলল তিন নম্বর।

চারিদিকে আলো, উৎসবের সমারোহ। এত তারা, এত বাতাস সব তোমার। খোদা মেহেরবান। কিন্তু ওই গ্রামে তো একথা মনে হয় না কখনো।

সেখানে এখন বাঁশঝাড়ের উপর রাত নামল। রাত, মহিষের পচা চামড়ার মতো দুর্গন্ধে-ভরা কালো রাত। খালের জল জাগ-দেওয়া পাটের গন্ধে আবিল। বাতাসে মশার গুঞ্জন। ভাগাড়ের হাড় নিয়ে টানাটানি করতে করতে তারায়-ছাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মড়াকান্না কেঁদে উঠছে কুকুর।

নারকেল বনের ছায়ার পিছনে তিন নম্বরের ঘর। গলে কালো-হয়ে-যাওয়া শণের ছাউনির ভিতর দিয়ে অজস্র জল পড়ছে এবারের বর্ষায়। টুপ টুপ করে ঘরের ভিতর পড়েছে সাদা সাদা একরকম খুঁয়োপোকা, পচা শণের মধ্যে ওরা জন্মায়। বাঁশের খুঁটিগুলো একেবারে ফোঁপরা, ফুটো দিয়ে কাচপোকা উড়ে যায়। খুঁটির গায়ে কান পাতলে শোনা যায় ঘূব ঘুর করে পোকার ডাক।

এবারের ধান পেলে হয়তো সুরাহা হবে কিছু। খড়ও মিলবে দু-চার কাহন। কিন্তু তারপর?

দুটো মাস—বড়োজোর দুটো মাস। গত বছর পর্যন্ত গোরুটা ছিল, দুধেল গাই। ধার করে খড় খাওয়াতে হয়েছে। এবার আর গোরুটা নেই কিন্তু ধার রয়ে গেছে। ওই খড় সে-ধার শোধ করতেই যাবে। যা বাকি থাকবে তাতে আর চাল ছাওয়া চলবে না।

দুটো মাস চলবে ধানে—ধার শোধ করে ওর পরে আর-কিছু থাকবে না। তারপর আবার যে-কে-সেই। মাইন্দার খাটতে হবে, ধার করতে হবে, জঙ্গলে জঙ্গলে খুঁজতে হবে তিত পোরোল আর বুনো কচুর মুখী। খালের কাদাভরা জলে নেমে খোড়লে খোড়লে হাত পুরে দিয়ে খুঁজতে হবে শোল আর বান মাছ—ঢোঁড়া সাপের কামড় উপেক্ষা করেই।

এত আলো এখানে, এত লোক! তবু কী অদ্ভুতভাবে খাঁ-খাঁ করে গ্রাম। মনে হয় মানুষ নেই কোথাও, সব ছায়া হয়ে লুকিয়ে গেছে বাঁশবনে, হারিয়ে গেছে নারকেল গাছের অন্ধকারে। ওদের ছাড়া-ভিটেগুলোতে আগে পালপার্বণে তবু কিছু লোকজন আসত, গ্যাসের লম্বা লম্বা নলে আলো জ্বলত, পুজো হত, কলের গান বাজত। কিন্তু এখন এক কোমর জঙ্গল গজিয়েছে সেসব জায়গায়। শেয়াল ঘোরে, ভিটের কোলে কোলে গজিয়ে-ওঠা থানকুনি পাতার বনে কুন্ডলী পাকায় চন্দ্ৰবোড়া। সকাল-সন্ধে-মাঝরাত্তির যখন-তখন আঁতকে আঁতকে ডেকে ওঠে তক্ষক।

মরুক গে। যারা গেছে তারা যাক। কিন্তু যারা আছে?

মাতব্বরেরা মুখে হাত চাপা দেন। শাসায় কেউ কেউ। দারোগা যখন আসেন তখন আর এক বার মনে করিয়ে দিয়ে যান— সব ঠিক হয়ে যাবে, দু-দিন সবুর করুন। বড়ো বড়ো সাহেবেরা কখনো কখনো পাশের গঞ্জে এসে সভা করেন, হবে, হবে—সব হবে…

মুহূর্তের ভাবনার মধ্যে এতগুলো কথা ভেসে গেল। উড়ে গেল বাইচের নৌকোর মতো।

ডঙ্কার শব্দ। চিৎকার। হালের মাঝির ভৎসনা।

কোনহান থিকা এইডারে আনল রে? সমানে ঝিমাইতে আছে। টানা টানো।

তিন নম্বর আবার চোখের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ মেলে ধরতে চাইল। তাকেই বলছে। বলবেই তো। সে তো নিজেও জানে দাঁড়ের প্রত্যেকটি টানের সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের শিরাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম করছে। সে তো বুঝতে পারছে তার পিঠের উপর যেন একটা তিনমনি বোঝার চাপ। সমস্ত হাড়-পাঁজরা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার।

সাগু খাও? সাগু খাও নাকি?

আবার ধিক্কার। কিন্তু সাগু! নিজের অজ্ঞাতেই এক টুকরো হাসি ফুটল ঠোঁটের কোনায়। আজ পাঁচ বছরের ভিতরে সাগুদানা চোখে দেখেছে না কি তিন নম্বর? শুনেছে শহরে নাকি পাওয়া যায়, আট টাকা করে সের!

শাবাশ জোয়ান, হেঁইয়ো…

পাশাপাশি চলেছে দুখানা। সমানে সমানে। এক ঝাঁকি দিয়ে ওদের গলুই দু-হাত এগিয়ে যায়, ওরা আর এক দমকে তিন হাত বেরিয়ে যায়। টানা টানো—প্রাণপণে টানো। ইনাম, বকশিশ, খাবার। দু-ধারের লোকগুলো আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আরও একাকার হয়ে যাচ্ছেআলোগুলো। হাওয়ার উড়ন্ত গতি ছুরির ধারের মতো কাটছে চোখ দুটো। অর্থহীন শব্দের গর্জন কানের মধ্যে ভেঙে পড়ছে জোয়ারের জলের মতো।

বাঁক আর দূরে নেই, এলাম বলে। তারপরে আর এক পাক। আরও এক পাক! ওরা সমানে সঙ্গে চলছে। আশ্চর্যভাবে শক্তির সমতা ঘটে গেছে একটা।

কিন্তু…

গোরুটা। দুধোল গাই। কালচে বাদামি রং, শুধু মাথার উপরে শিংয়ের তলায় খানিকটা সাদা। নাম ছিল চাঁদকপালি।

থাকার মতো ওটাই ছিল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ভাঙা কপালে আর সইল না চাঁদকপালি। মাত্র ত্রিশটা টাকার জন্যে বেচে দিতে হল।

তিন সের দুধ দিত দু-বেলায়। ঘন মিষ্টি দুধ, পাতার উপর ধরলে আঠার মতো লেগে থাকত। সেই গোরু বিক্রি করতে হল। যেতে চায়নি, শিং নেড়ে আপত্তি করেছিল প্রথমে–বসে পড়েছিল চার-পা ভেঙে। কিন্তু শেষপর্যন্ত একরকম হিচড়েই নিয়ে গেল লোকগুলো।

যাওয়ার আগে এক বার গভীর কালো দৃষ্টি মেলে চেয়েছিল তিন নম্বরের মুখের দিকে। অবলা জীবের সে-দৃষ্টি আজও সে ভুলতে পারেনি, মনে পড়লে এখনও কলজের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।

যাক, সবই গেছে ওটাও যাক। শুধু লুটিয়ে লুটিয়ে কেঁদেছিল মেয়েটা। এখনও ছেলেমানুষ, এখনও কাঁদে। কিন্তু…

তিন নম্বর কলের মতো দাঁড় ফেলতে লাগল। রোগা মেয়েটা। পাশের বাড়ির মাতব্বরের বউ-য়ের জিম্মায় রেখে এসেছে। দরদ আছে মাতব্বরের বউয়ের, মেয়েটাকে একটু ভালোও বাসে। কিন্তু হাজার হলেও পর পর। কতখানি সে করতে পারবে?

এত আলো, এত লোক, এত আনন্দ। সব ভুলে যেতে হয়। বাঁশবন নয়, পোকা-খাওয়া গলে-যাওয়া চালের শণ নয়, পাট-জাগানো খালের রাঙা জল থেকে নাড়িতে মোচড়-দেওয়া দুর্গন্ধ নয়, তারা-ছাওয়া আকাশের তলায় ভাগাড়ের হাড় নিয়ে কুকুরের মড়াকান্নাও নয়। মেলা বসেছে। বাজনার শব্দ উঠছে। নানা রঙের পোশাকের ঝিলিক। বিজলিবাতির আলোয় ঝলমলে নদীর জল।

এসব তোমার। আর কেউ নেই। অধিকার নেই আর কারও। বুক ভরে নিশ্বাস নাও। আনন্দে কানায় কানায় ভরে ওঠো। টান দাও বাইচের নৌকোর দাঁড়ে।

মেয়েটা! আট বছর বয়স। ওই এক বন্ধন। ওটা হওয়ার এক বছর পরে আকালে ওর মা গেল, বড় ভাই দুটো গেল। ওকে বুকে করে শহরে এসে এ-ঘাটায় ও-ঘাটায় ঘুরে কী করে যে বেঁচে রইল তিন নম্বর, তাই আশ্চর্য!

তারপর দিন বদলাল। শোনা যায় দুনিয়াও পালটাল। সব তোমার, আমার, সকলের। চারদিক থেকে তারই জয়ধ্বনি। কিন্তু…।

আকালে মরল না, আজ যেন বাঁচবার রাস্তা কোথাও পাচ্ছে না। উৎসব-আনন্দ। ওদিকে সাত দিন জ্বরে ভোগার পরে কাল দুটি ভাত পাবে মেয়েটা। অথচ কোথায় ভাত? পরশু পর্যন্ত পানতা ভাতের জল ছিল নিজের। আজ সকালে বিনা নুনে খেয়ে এসেছে সেদ্ধ কচুর গোড়া। এতক্ষণে টের পেল তিন নম্বর। অসহ্য ক্ষুধা। তাই চোখে ঝাপসা দেখছে, ম্লান হয়ে আসছে আলোগুলো, কানের কাছে ঝিঝির ডাক। হাতের শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে পিঠের পাঁজর।

সাঁ–

বেগে একটা মোড় ঘুরল বাইচের নৌকো, ঘুরে গেল চক্রাকারে। আবার ফিরে যেতে হবে এই তিন মাইল পথ—ফিরতে হবে এখানে; তারপরে ওই বাঁধাঘাটে। আনন্দের দিন, আমাদের দিন। দু-পাড় থেকে উৎসাহ দিচ্ছে লোক—হাততালি দিচ্ছে। কিন্তু কিছুই কানে যাচ্ছে না যেন তিন নম্বরের। দাঁড় টানছে—টেনে যেতেই হবে। সেদ্ধ কচুর গোড়াগুলো কখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পেটের মধ্যে। খাবার চাই, চাই চাল।

সাত দিন পরে ভাত খাবে মেয়েটা। শুকনো শীর্ণ মুখখানা ভাসছে চোখের সামনে। নিজের জন্যে সে আর ভাবে না, অনেককাল আগেই চুকিয়ে দিয়েছে সেসব। আকালে যাকে বুক দিয়ে বাঁচিয়েছিল—আজকের নতুন মাটিতে, নতুন হাওয়ায় তাকে সে কিছুতেই মরতে দেবে না।

হালের মাঝি পা ঠুকছে অস্থিরভাবে। এক বার ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালে তিন নম্বর। মাথায় গামছাবাঁধা, বাবরি চুলগুলো উড়ছে হাওয়ায়। টকটকে লাল দুটো চোখ—যেন নেশা করেছে। খুন চেপেছে ওর মাথায়, আগুন ঝরছে দৃষ্টিতে।

সে ছাড়া আরও একুশ জন দাঁড় ফেলছে। দাঁড় ফেলছে তালে তালে। গায়ে চকচক করছে। ঘাম। হাত থেকে বুক পর্যন্ত পেশি দুলছে টানে টানে। দাঁড়ের ঘায়ে ঘায়ে ছিঁড়ে-যাওয়া কচুরির গন্ধ, ছাপিয়ে উঠছে মানুষের ঘামের গন্ধ।

না, কচুসেদ্ধ খেয়ে আজ সে বাইচ খেলতে আসত না। ফেলে আসত না মা-মরা অসুস্থ মেয়েটাকে। পিছন থেকে এখনও যেন কান্না আসছে শহরে আমিও যামু, আমারে ফেইল্যা যাইয়ো না বা-জান।

অনেক দূর…অনেক দূর পর্যন্ত তার কানে ভেসে এসেছে সেই কান্নার শব্দ। নারকেলবন পেরিয়ে, বাঁশবন ছাড়িয়ে একেবারে খালের ঘাট পর্যন্ত। অস্পষ্ট থেকে আরও অস্পষ্ট। তারপর মিলিয়ে গেছে। একেবারেই কি মিলিয়ে গেছে? না না। তিন নম্বরের হাত অবশ হয়ে এল। দু-পাড়ের সমস্ত হট্টগোল ছাপিয়ে এখনও কানের ভিতর বাজছে শীর্ণ গলার সেই টানা সুরের আর্তি যাইয়ো না বা-জান, আমারে ফেইল্যা যাইয়ো না…।

কিন্তু খাবার চাই, চাই চাল। শহরে উৎসব। বাইচের প্রতিযোগিতা। কত রং ও বেরঙের পোশাকপরা মানুষ, খুশিতে আলো-হয়ে-যাওয়া মুখ। দিনের সেরা দিন। ধনীর প্রাণ আজ দরাজ হয়ে গেছে। চাল বিতরণ হচ্ছে, খাবার বিতরণ হচ্ছে।

সে তো আজকের জন্য। একটা দিনের জন্য খিদে মিটল। তারপর কাল? পরশু? দিনের পর দিন? কোথায় আলো, কোথায় কে! শুধু পচা মোষের চামড়ার গন্ধ উঠবে অন্ধকারে। মড়কের আভাস তুলে কেঁদে কেঁদে বেড়াবে কুকুর। আকাল এসেছিল; একটা দমকা হাওয়ায় ঝরা পাতার মতো উড়িয়ে দিয়েছিল সব। কিন্তু এখন ঘুণ। বাঁশ কাটছে, কাটছে দাওয়ার খুঁটি। সে-খুঁটির ওপর কান পাতলে ভিতরে ঘুরঘুর করে তাদের ডাক শুনতে পাওয়া যায়!

আরও জোরে দাঁড়…আরও জোরে…

এতক্ষণে—এতক্ষণে প্রতিদ্বন্দ্বীর নৌকোটা একটু পিছিয়ে পড়েছে। শাবাশ জোয়ান। জিতব আমরা; আমরাই নেব ইনাম-বকশিশ। শাবাশ।

কেউ কথা বলছে না। কথা বলার সময় নেই কারও। দাঁতে দাঁত চেপে সমানে টেনে চলেছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ ঝপ ঝপাস। নৌকোর তলা দিয়ে খঙ্গের মতো ছুটে যাচ্ছে জল। ফেনা ফুটছে—ঝিকিয়ে উঠছে বিজলির আলোয়।

এই হারামি সুমুন্দির হাত লড়ে না ক্যান? এই হালার লইগ্যাই আমরা হারুম!

রক্তঝরা চোখে তার দিকে তাকাল হালের মাঝি। কটু গালটা বর্ষণ করল তিক্ততম ভাষায়।

তিন নম্বর পিঠ চাড়া দিয়ে উঠে বসল। হারামি! ইচ্ছে করল লোকটার গলা টিপে ধরে গাঙের মধ্যে ফেলে দেয়।

কিন্তু না, চাল চাই তার। চাই খাবার, চাই ইনাম। মেয়েটার কান্না কানে বাজছে, বা জান…বা-জান? দু-পাড় থেকে হাততালি দিচ্ছে লোকে। জিততেই হবে…জিততেই হবে। অসুরের মতো দাঁড়ে একটা টান দিলে তিন নম্বর।

বাহারে জোয়ান! এই তো চাই।

এমন দিন আর কি হয়? আমার…তোমার…সকলের! আজাদির দিন! জেলার হাকিমের লঞ্চ থেকে হাত তুলে উৎসাহ দিলেন হাকিম স্বয়ং। চোখের উপর ছুরির ধার বুলিয়ে আর একটা হাউই উঠল আকাশে।

আবার আপ্রাণ চেষ্টায় দাঁড়ে ঝাঁকি মারল তিন নম্বর।

কিন্তু কতক্ষণ আর জোর বইবে পানতা ভাতের জল, আলুনি কচুসেদ্ধ। চড়াৎ করে বুকের মধ্যে কী ছিঁড়ে গেল একরাশ, মুখ দিয়ে গলগল করে নামল নোনা রক্ত। তারপর মিলিয়ে গেল সব আলো, সমস্ত কোলাহল, এমনকী রোগা মেয়েটার কান্না পর্যন্ত। টুপ করে একটা পাকা ফলের মতো নৌকো থেকে খসে পড়ল তিন নম্বর, মিলিয়ে গেল উৎসবের বিজলি ঝলমলে জলের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *