2 of 2

ফাঁদ – আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন

ফাঁদ – আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন

টেলিফোনের রিসিভারটা মুখের কাছে এনে আস্তে আস্তে টেনে কথা বলছিল আতিক চৌধুরী। পা দুটো জুতো সমেত তুলে দিয়েছে টেবিলের ওপর। চকচকে নতুন জুতো। আগাটা বেশ চোখা। ব্যালি সু। হাঁটু নাচাচ্ছিল আরামের ভঙ্গিতে। চোখে মুখে ওর আনন্দের আভাস। উজ্জ্বল শীতের রোদের মত ঝলমলে আনন্দ। ভাবখানা, অফিসে কোনও কাজ নেই আজ।

স্যার, সোবহান সাহেব এসেছেন। এয়ার কন্ডিশন্ড অফিস ঘরের দরজাটা সামান্য খুলে মাথা ঢোকায় পিওন।

মৃদু গভীর আলাপে বাধা পড়ায় নাক কুচকে ওঠে আতিক চৌধুরীর। ফোনের রিসিভারটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে শুকনো স্বরে বলে, সোবহান সাহেব? হাঁ নিয়ে আসো।

এই শোনো। একজন ভিজিটর এসে গেছে।…পাকা আধ ঘন্টা একটানা কথা বললাম কবুতরের মতো, তাও তোমার মন ভরল না…ঠিক আছে পরে আবার ফোন করব।

…হাঁ ঠিক এগারোটার দিকে। টেলিফোনটা রাখতেই ঘরে এসে ঢুকল সোবহান। রুক্ষ সূক্ষ্ম মেটে রং চুল, মুখ ভর্তি শিমুল কাঁটার মতো খসখসে দাড়ি। শার্টের কলারে ময়লার দাগ। জুতোয় পালিশ পড়েনি দুতিন সপ্তাহ।

ঢুকতে ঢুকতে বলে সোবহান, আতিক ভাই দেখি আজ বেশ রিলাক্স মুডে আছেন। টেবিলের ওপর পা তুলে নিয়ে চ্যাংদোলা হয়ে টেলিফোনে জমিয়ে গল্প করছেন। কে ওপারে? ভাবী না তো?

হাঁ-না-র মাঝামাঝি শব্দ করে সোজা হয়ে বসল আতিক চৌধুরী। সোবহানের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

তুমি কোত্থেকে অসময়ে? আর অমন অগোছালো অবস্থা কেন তোমার? মনে হয় সাতদিন পেটে দানা পড়েনি।

ঠিকই বলেছেন আতিক ভাই। আগে ভাল করে চা খাওয়ান। খিদেয় আমার নাড়িভুড়ি পাক খাচ্ছে। ভোরে ব্রেকফাস্ট হয় নি আজ। মলিন পাংশু মুখে বলে সোবহান।

কলিং বেল টেপে আতিক চৌধুরী।

সাহেবের জন্যে কিছু স্যান্ডউইচ আর পটে চা নিয়ে আসো।

হাটখোলা রোডে একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি করত সোবহান। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু ড্যান্ট করে দেওয়া, টেলপিস লেখা, বিলের জন্য দৌড়াদৌড়ি করা, কাজটা বেশ ভালই লাগছিল। আতিক চৌধুরী ফোন করে জোগাড় করে দিয়েছিল। মাস আটেক আগে।

ওরা আমাকে ছাঁটাই করে দিয়েছে গত সপ্তাহে। মালিক বলল, ওরা নিজেরাই নাকি আমার কাজটা চালিয়ে নিতে পারবে। দুমাসের বেতনও বাকি পড়েছে। বলল আগামী মাসে দেখা করতে। বিরক্তি আর হতাশা সোবহানের কণ্ঠস্বরে, মেসের গতমাসের ভাড়াটা দিতে পারিনি। ওটাও ছাড়াতে হবে আজকের মধ্যে।

তারপর?

পাঁচ ছয় দিন এখানে ওখানে অনেক হাঁটাহাঁটি করলাম। ধর্ণা দিলাম অনেক অফিসে। মতিঝিল, সেক্রেটারিয়েট কোথাও বাদ রাখিনি। আমার মত আধা-সাহিত্যিক সাংবাদিককে কে চাকরি দেবে বলুন আতিক ভাই।

নখ দিয়ে মেহগনি টেবিলের ওপর মৃদু টোকা দিয়ে যোগ দেয় সোবহান, আপনার কাছে আসতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল। আপনি আমার কতবার উপকার করেছেন। অল্প অল্প করে কত টাকা যে ধার দিয়েছে, তার হিসেবও রাখিনি আমি। তাছাড়া এ চাকরিটাও

গম্ভীর মুখে চুপ করে থাকে আতিক চৌধুরী। একটা সোনালি টিপওয়ালা দামি সিগারেট ধরায়। তারপর উদাস চোখে জানালা গলিয়ে আকাশ দেখে। মঝিলের উঁচু বিল্ডিংয়ের দশতলায় অফিস। অনেকটা আকাশের কাছাকাছি। একটা লাল রঙের ঘুড়ি উড়ছে শীতের উত্তরে বাতাস কেটে কেটে। সেদিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবে মনে মনে তারপর চোখ নামিয়ে এনে খুঁটিয়ে দেখে সোবহানকে। সুন্দর সুপুরুষ সোবহানকে। উজ্জল গৌরবর্ণ, লম্বাটে চেহারা, চওড়া কপাল, চোখা নাক, বুদ্ধি ও মেধার প্রতীক যেন। ভাল খেতে পরতে পেলে গ্রিক মাইথোলজির দেবদূতের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করতে পারবে।

হঠাৎ যেন অকারণে কৌতুক খেলে গেল আতিক চৌধুরীর চোখের কেন্দ্রবিন্দুতে। ঘাড় কাত করে মৃদুস্বরে বলে, তা এখন কী করতে চাও? প্ল্যান কী তোমার? চেহারা তো লাওয়ারিশ বোহেমিয়ানের।

কিছু ঠিক করিনি এখনও। নিরুপায় হয়ে দেশের বাড়িতেই ফিরে যাব। গ্রামের স্কুলে একটা মাস্টরি,–

একটু থেমে যোগ দেয় সোবহান, আপাতত আপনি আমাকে কিছু টাকা যদি দিতেন তাহলে মেসের বিলটা চুকিয়ে দিতাম। ওদের পাওনা চুকাতে না পারলে ওরা আমার স্যুটকেস আর বিছানাটা আনতে দেবে না।

বলতে বলতে অধোমুখ হয়ে থাকে সোবহান। করুণার ভিখারি ও সোজা হয়ে তাকাতে পারে না আতিক চৌধুরীর মুখের দিকে।

একটা ফাইলে সই করছিল আতিক। আবুধাবিতে চিংড়ি এক্সপোর্ট করছে কয়েক টন। মেয়ে সেক্রেটারি ফাইলের পাতা উল্টিয়ে ধরছিল ওর চোখের সামনে। একটু চোখ বুলিয়ে সই করছে গম্ভীর মুখে।

জরুরি কাগজের গাদা নিয়ে সেক্রেটারি বেরিয়ে যেতেই কয়েকটা একশ টাকার নোট সোবহানের হাতে গুঁজে দিয়ে উদার হাসি হাসল আতিক চৌধুরী।

পাগল নাকি তুমি। গ্রামে গিয়ে মাস্টারি করবে কেন? লেখালেখিতে তোমার দারুণ হাত। একটা চাকরি গেছে আরেকটা পাওয়া যাবে।

কোথায় পাব চাকরি? ঝড়ে ভেজা কাকের মতো মাথা নিচু করে বলে সোবহান।

সে ব্যবস্থা পরে হবে। একটু থেকে আবার ওর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে আতিক চৌধুরী। সোবহানের চোখের কোণে অসহায়ত্বের কালি। আপাতত তুমি মেসের দেনা চুকিয়ে আমার বাসায় এসে ওঠ। যতদিন কাজ না পাও, আমার ওখানেই থাকবে তুমি। সায়মাকে ফোনে বলে দিচ্ছি, গেস্টরুমটা তোমার জন্য ঠিক করিয়ে রাখবে।

সোবহানের নিষ্প্রভ মলিন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে। কৃতজ্ঞতার নীরব ভাষা ওর গাঢ় দৃষ্টিতে।

উদারভাবে হাসে আতিক চৌধুরী, যুগবার্তা মোটা বিজ্ঞাপন পায় মাসে মাসে আমার ফার্মের। ওদের বলে দেখি, তোমার একটা ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। আরে জার্নালিস্ট, টেক হার্ট, নো ওয়ারি।

স্ফটিকের মতো নির্মল আর স্বচ্ছ হাসি সায়মার মুখে। ব্যস্ত যেন প্রজাপতি। ঘরময় ঘুরঘুর করে সারাদিন। ড্রইং রুমের জিনিসপত্র মোছে, রান্নাঘরে গিয়ে অকারণে আয়ার কাজের তদারকি করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে রং লাগায়। গুণগুণ করে আবার গান গায় ডায়নিং টেবিলের ন্যাপকিন বদলাতে বদলাতে।

পর্যাপ্ত অবসর সায়মার। সময় যেন কাটতে চায় না। বাইরে ঘুরঘুর করার অভ্যেস নেই ওর। গল্পের বই পড়তেও তেমন ভাল লাগে না।

রাতে পাশে শুয়ে আঙ্গুল দিয়ে সায়মার কানের লতি খুঁটতে খুঁটতে বলে আতিক চৌধুরী, সোবাহানটা আসাতে ভালই হল। কথা বলার লোক পাওয়া গেল একটা। তোমার বোরনেসও কাটবে।

বাইরের লোক। আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট হবে না বুঝি? আমার কেমন যেন সঙ্কোচ লাগে ওর সামনে বেরুতে।

ওমা সঙ্কোচ কীসের? ও তো আমার বন্ধু মানুষ, ছোট ভাইয়ের মতো। ইউনিভার্সিটিতে আমার এক ক্লাস নীচে পড়ত। চমৎকার কবিতা লিখত তখন। আবৃত্তিতে অনেকগুলো প্রাইজ পেয়েছে সোবহান। খুব ট্যালেন্টেড। ভাল একটা কাজ জুটাতে না পেরেই বেচারা বেশ দমে আছে। না হলে খুব হাসিখুশি ছেলে।

দিন দশেকের মধ্যে চাকরি জুটে গেল সোবহানের। যুগবার্তা পত্রিকায়। অবশ্য আতিক চৌধুরীর ফোনের জোরেই কাজটা পাওয়া গেল।

নাইট শিফটের কাজ। সন্ধ্যায় খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ে সোবহান। ফিরতে ফিরতে ভোর আটটা নয়টা। এসে নাকে মুখে নাস্তা খুঁজে বাদুরেরমতো লম্বা ঘুম। জাগতে জাগতে দুপুর গড়িয়ে যায়। কখনো কখনো সন্ধ্যা।

চোখ মুখ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সোবহানের। এত অল্প সময়ে একটা পছন্দসই চাকরি জুটে যাবে, ভাবতেও পারেনি ও। সাংবাদিকতায় ওর নেশা খুব সেদিক থেকে খুব খুশি। খাওয়া দাওয়াও ভাল করে জুটেছে এখানে।

ভোরে তড়িঘড়ি পোশাক পরে বেরিয়ে যায় আতিক চৌধুরী। চা-টা ভাল করে খাবারও সময় পায় না। একটু দেরি হলে অফিস থেকে ফোন আসতে থাকে। টেলেক্স যাবে জাপানে, মালের অর্ডার এসেছে অ্যামসটারডাম থেকে, ব্যাঙ্কে এল. সি. নিয়ে গোলমাল বেধেছে। আরো কত কী।

কনকর্ড প্লেনের মতো খাড়া উন্নতির শীর্ষে উঠছে আতিক। প্রথম বছর দুই স্ট্রাগল করেছে। কাজ রপ্ত করতে যা সময় লেগেছে। এখন তো ব্যবসার জারিজুরি ওর নখদর্পণে। অহংকার করে বলে সহযাত্রীদের, টাকা? টাকা তো বাতাসে ভাসছে লাখে লাখে। শুধু হাত বাড়িয়ে ধরতে জানলেই হল। এতদিন উর্দুওয়ালারা জানত ট্রিকসটা। এখন আমরা বাঙালিরা লাইন পেয়ে গেছি।

সোবহানের সঙ্গে কমই দেখা হয় আতিক চৌধুরীর। ও ফেরবার আগেই বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত নয়টা দশটায়। ততক্ষণে ডিনার খেয়ে সোবহান চলে গেছে। প্রেসে। প্রায় দুপুরের খাওয়া হালকা স্যান্ডউইচ দিয়ে অফিসেই সেরে নেয় আতিক। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর মতো মোটা হওয়ার ইচ্ছা নেই, ওর। চমৎকার ফিগার। যেমন লম্বা, তেমনি স্লিম। হাসতে হাসতে বলে, শরীর পাতলা আছে বলেই এত খাটতে পারি অসুরের মতো।

রোব্বার বার ছুটি। বাড়ি থাকে আতিক চৌধুরী। সোবহান একটা খদ্দরের চাদর জড়িয়ে বারান্দায় পায়চারি করে। কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় সায়মাকে। রাজনীতি নিয়ে দুই বন্ধু তর্কের তুফান তোল। ঘন ঘন চা আর চানাচুর খায়।

ছুটির দিন বলে আরও এক আধ জন বন্ধুবান্ধব আসে তাস খেলতে। রামি কি কাজু। খেলতে গিয়ে রোজ হারে আতিক চৌধুরী। হারে সায়মাও। খুব সিরিয়াস মুখ বানিয়ে খেলে সোবহান, যেন সংবাদপত্রের পুফ দেখছে অতি সাবধানে। জেতেও প্রায়ই।

নদীর ঢেউয়ের মতো কল কল করে হাসে সায়মা, সোবহান ভাই একটানা জিতেই যাচ্ছেন। লাকি ইন কার্ডস কিন্তু আনলাকি ইন লাভ।

সর চুরি করা বেড়ালের মতো মিটমিটিয়ে হাসে সোবহান। কৌতুকের দীপ্তি ওর চোখে, কী যে বলে ভাবী, প্রেমে যদি একবার কোমর বেঁধে ঝাঁপ দেই, হারব না আমি নিশ্চয়ই। আমার শকল সুরত তো আর শিম্পাঞ্জির মতো নয় যে, মেয়েরা দেখে ছুট দেবে। কলেজে রািজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করেছি আমি।

তাদের ওপর চোখ নিবদ্ধ রেখেই বলে আতিক চৌধুরী, শিম্পাঞ্জির মতো হতে যাবে কেন? অযোধ্যার নবাবের চেহারা আমাদের সোবহানের। চেষ্টা করলে নবাব পতৌদীর মতো আরেকটা শর্মিলা ঠাকুর বাগাতে পারবে ও।

আজকাল দুপুর না হতেই ঘুম ভেঙে যায় সোবহানের। শুয়েশুয়ে শোনে, ড্রইং রুমে পায়চারি করছে সায়মা। মিউজিক সেন্টারে ডিক্স চাপিয়ে ডিসকো মিউজিক শুনছে। তড়কপূজার ধূমধাড়াক্কা যেন সারা রময়। দালানটা যেন লাফাতে থাকে বাদের আওয়াজে।

অনেকক্ষণ ধরে সায়মার পদচারণা শোনে সোহবান। তারপর গেস্ট রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। একটা নীল পুলওভার বুনছে সায়মা। হলুদ আভা ওর চাপারং আঙ্গুলে। বোনার কাঁটা দুটো আলোতভাবে ধরা চিকন আঙুল দিয়ে। নিবিষ্ট মনে বোনা দেখে সোবহান। অজান্তেই বলে ফেলে, কী দ্রুত বুনতে পারেন আপনি ভাবী। অপূর্ব!

কী অপূর্ব?

আপনার আঙুলগুলো।

কথাটা বলে ফেলেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠ সোবহান। একটা মৃদু রোমাঞ্চ যেন ওর বুকের ভেক্স ধাক্কা দিতে থাকে। নিচু হয়ে বুনতে থাকে। শিথিল হয়ে আসে ওর হাতের গতি। বিষণ্ণ আকাশের ছায়া ওর অবয়বে মৃদু কাঁপন তোলে। রাতে ডিনার খেতে বসেছে আতিক চৌধুরী আর সায়মা। প্রায়ই বাইরে খেয়ে আসে আতিক। নানা পার্টি, ফাংশন। বিদেশি পার্টনারদের নিজে নিয়ে গিয়ে চাইনিজ খাওয়ায় দামি দামি উপঢৌকন দেয়। মাঝে মাঝে সন্দেহের বুদবুদ উঁকি দেয় সায়মার মনে। আতিকের মুখের দিকে নিবিষ্ট ভাবে চেয়ে থেকে বলে, এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকো তুমি। আমার দারুণ অস্বস্তি লাগে। আমাকেও পার্টি-টার্টিতে নিয়ে গেলেই পারো।

কী যে বলো সায়মা, ওসব বিজনেস ডিল উপলক্ষে যত ডিনার আর পার্টি। ওসবের সঙ্গে ঘরের বউকে জড়াতে চাই না আমি। ওতে গেলে ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো তড়পাবে তুমি। তার চেয়ে ঘরে বসে গান শোনো, বাটিক করো, বাগানের তদারক করো, দুএকটা ডিস রান্না করো। দু’এক বার মীনাবাজারে ঢু মারো। ফুর ফুর করে দিন কেটে যাবে।

একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরতে পুরতে যোগ দেয় আতিক, তাছাড়া দিনের বেলা সোবহান তো আছে কুঁড়ে লোকটা তো তেমন সোশাল নয়। ওর সঙ্গে গাল গল্প করে সময় কাটিয়ে দিলেই তো পারো। পাইথনটা বোধ হয় সারাদিন ঘুমোয়।

সোহান ভাই। ও তো বলেছে, আগামী মাসের পয়লা তারিখে অন্যখানে চলে যাবে। অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছে। ওর আগের মেসেও যেতে পারে। ওর একটা গতি করে দিয়েছ তুমি। তাতেই কৃতজ্ঞ। আর কত থাকবে আমাদের ঘাড়ে?

না না ও যাবে না। ও সঙ্কোচের কোন দরকার নেই আমাদের সঙ্গে। ও থাকলে রং বাসাটা পাহারার কাজও হবে। পেটে ভাতে চৌকিদার। ভোরে অফিস যাবার পথে আমিই সোবহানকে বলে দেব। কাল একটু দেরিতে বেরুলে ততক্ষণ ও প্রেস থেকে এসে যাবে।

চুপ করে খেতে থাকে সায়মা। টেপরেকর্ডারে একটা গজল হচ্ছিল ড্রইংরুমে। উৎকর্ণ হয়ে শোনে প্রেমের আকুতি মেহদি হাসানের ললিত কণ্ঠে। ভাবে, ভারী আমুদে লোক সোবহান ভাই। দারুণ আলাপি। ও আছে বলেই তো একটুও আলসেমি আসে না আমার। কবুতরের মতো বকম বকম করে দিন কেটে যায়।

রান্নাঘরে আলুর চপ ভাজছিল সায়মা। কপালে ওর কনক ঘাম। চুলোর আগুনে আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে ওর চেহারার সোনালি আভা। পাশে মাটিতে পা মেলে মটরশুটির খোসা ছাড়াচ্ছে আয়া মরি মা। দুপুরে রান্নার আয়োজন।

কখন যে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সোবহান, একটু টের পায়নি সায়মা। চমকে উঠল ছায়া দেখে।

আরে সোবহান ভাই, আপনি হেঁসেলে কেন? আপনি না ঘুমুচ্ছিলেন লেপের নীচে অজগরের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে?

আপনাকে খুঁজে না পেয়ে এদিকে এলাম। আমার ভারী খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবেন ভাবী?

খিদে পেয়েছে, এগারোটা না বাজতেই? বলেন কী? পত্রিকার অফিসে রাত জেগে কি হাডুডু খেলেন নাকি যে পেটে আগুন জ্বলছে।

আগুন তো জ্বলছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় সোবহান। কিচ্ছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়।

ওর পেছনে এক প্লেট আলুর চপ হাতে করে বেরিয়ে আসে সায়মা।

খান সোবহান ভাই। শরৎ চ্যাটার্জি বলেছেন, পুরুষকে খাওয়ানোতেই নারীর আনন্দ। পুরো প্লেটটা আমাকে শেষ করতে হবে।

একটা ক্ষীণ নিশ্বাস ফেলে সায়মা, আপনার বন্ধুতে সপ্তাহে তিন বেলাও বাসায় খায় না। শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা। জানিনা, কিরে পেছন ছুটছে লোকটা দিনরাত? টাকার পাহাড় দিয়ে কি হবে আমার? ওকে যে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াবো, সে কপালটা কোন দিনই হলো না আমার।

বাইরের লনে শীতের ফুল ফুটেছে। দেদার রঙের বাহার ওদের পাপড়িতে, রঙের বাহার ফুলে ফুলে উড়ে যাওয়া। প্রজাপতিদের পাখনায়। এক দঙ্গল চড়ুই শেফালি গাছের ডালে বসে একটানা লড়াই করছে।

বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে বাইরের সোনালি রোদ দেখছিল সায়মা। গায়ে ওর বুটিদার পশমি শাল। শেষের কবিতার লাবণ্য যেন।

আরে ভাবী, বাইরে কী দেখছে এত মন দিয়ে আমার মতো কবিতার রোগে ধরেনি তো আপনাকে? সোবহানের কথার জবাব দেয় না সায়মা। উদাস চোখ মেলে বলে, সোবহান ভাই, আমি আপনার কত ছোট। ‘ভাবী’ ‘ভাবী’ করে আপনি কি আমাকে দাদি বুড়ি বানিয়ে ছাড়কেন? আমাকে তুমি বলে ডাকবেন এখন থেকে। আদরের ধমক কণ্ঠে।

সায়মার চোখের ঝিলে অপলক চেয়ে থাকে সোহবান। গায়ে ওর বিদ্যাসাগরের মতো শাদা খদ্দরের চাদর। আঙ্গুল দিয়ে চাদরের কোণে গেরো দেয় অজান্তে।

‘সায়মা!’ চাদরের গিট খুলতে খুলতে বলে সোবহান, তুমি ঠিকই বলেছ, আমাদের মধ্যে আপনি সম্পর্কটা আরা নিজের অজ্ঞাতেই পেরিয়ে এসেছি। অনেক দূর যেন পাশাপাশি হেঁটে এসেছি মেঠো পথ ধরে। কচি কচি বুজ পাট খেরে মাঝদিয়ে দীর্ঘ মেঠো পথ। অনেক কাছাকাছি এসে গেছি সমান্তরাল হেঁটে।

আবেগের ভারে গভীর হয়ে ওঠে সোবহানের কণ্ঠ, চলো, আজ থেকে সম্ভাষণের শেষে ‘দন্ত্য ন’ উঠিয়ে দেই আমরা। কী বলো? কথাটা বলেই উদাস হয়ে ওঠে সোবহান। বাইরের চিল-ওড়া আকাশের দিকে অপলক চেয়ে থাকে চোখ মেলে।

চলো। ভেতরে চলো। কফি খাবে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে বলে সায়মা। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর বুক থেকে।

উচ্ছল চঞ্চল ঝর্নার মতো আজকাল কলকল করে সায়মা। বেদেরি মতো পাতলা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে কাজ করে। ঝাড়ামোছা করে, চেয়ার টেবিলের জায়গা বদল করে, গাদা গাদা কাপড় ধোয়, কখনো ঘর মুছতেও লেগে যায়। শোয়া থেকে উঠে আধ ঘন্টা যোগাসন করে। খুব ভোরে উঠে যায় আজকাল। আতিক চৌধুরী ওঠার ঘণ্টা দেড়েক আগে। নিজেই নাস্তা বানাতে লেগে যায় কিচেনে।

ওর কাণ্ড দেখে হাসে আতিক। হাসে সোবহানও। একলা পেয়ে বলে, এমনিতেই তো তোমার স্লিম ফিগার। অর্ডে হেপবার্নের মতো। তা আবার অত পরিশ্রম করে কমানোর চেষ্টা কেন? এমনিতেই ফেদার ওয়েট! আরো শুকোলে তো তুলো হয়ে যাবে।

রেশমী চুলে গোছা নাচিয়ে হাসে সায়মা, ফেদার ওয়েট না হাতির ওয়েট। তুমি বুঝলে কেমন করে সোবহান ভাই?

বুঝবো একদিন। বলতে বলতে প্রগাঢ় হয়ে উঠে সোবহানের স্বর। ঝকঝকে হাসিটা হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে ওর ঠোঁটের প্রান্তে। শ্রাবণের আকাশের মত বিষয়।

মাঝে মাঝে দোকানে ঘুরতে যায় সায়মা। ওর নতুন শখ। সঙ্গে সোহান। শাড়ির দোকান, চুড়ির দোকান, ফুটপাথের কাটা কাপড়, স্ব কিছুতেই এখন উৎসাহ সায়মার।

পারফিউমের দোকান থেকে একটা ছোট্ট শিশি কিনে ওকে উপহার দেয় সোবহান। খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে সায়মা। সুগন্ধিটার কাছে নাক নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে, একদম পাটনাই গোটের গন্ধ।

আর আমিই সেই পাটনাই গোট। উচ্ছলভাবে হাসে সোহবান। পারফিউমের শিশিটা তে গিয়ে সায়মার হাত ছুঁয়ে ফেলে আলগোছে। ওর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় দোকানির সামনে। কাকরা চুলের গন্দ শোঁকে শাস টেনে।

চন্দ্রায় পিকনিক করতে এসেছে আতিক চৌধুরীরা। একদঙ্গল বন্ধুবান্ধব, কাচ্চা বাচ্চা, খাবার-দাবার, গানবাজনার লটবহর নিয়ে। অনেককে চেনে না সোবহান, আসতে চায়নি সোহবান। হেসে বলেছে ভালই হল আতিক ভাই। আমি বাড়ির চৌকিদারি করি রোব্বারটা। আর একটা আর্টিকেল লিখব বিশ্ব রাজনীতির ওপর। বাসাটা খালি পেলে সিরিয়াসলি কাজ করতে পার সারাদিন।

আড়ালে একা পেয়ে সোবহানকে চেপে ধরে সায়মা, তুমি চলো আমাদের সঙ্গে। একটুও ভাল লাগবে না আমার তুমি না থাকলে।

ঘাড় কাত করে সায়মার চোখের দিকে অপলক চেয়ে বলে সোবহান, সত্যি?

সত্যি। সজল মেঘের ছায়া সায়মার চোখে।

চন্দ্রা ফরেস্টের গাছ-পালা কাপিয়ে গান বাজছে একটানা। শীতের আকাশে মিষ্টি নরম রোদ। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে শালিক পাখির পেছনে। নেট টাঙ্গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে পুরুষেরা, মেয়েরা কেরাম। তারে আসরে জমে বসেছে আতিক চৌধুরী। স্টেকের খেলা। দার্শনিকের মতো মুখ বানিয়ে খেলছে মাথা ঝুঁকিয়ে। দুনিয়ার হুঁশ নেই ওর।

এই চলো না জঙ্গলটা ঘুরে ঘুরে দেখে আসি। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে লাল মাটির অনেকগুলো কাঁচা পথ রয়েছে। হেঁটে বেড়াতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। আতিকের কাঁধের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলে সায়মা।

চোখ দুটো পাকা শিকারির মতো তারে ওপর নিবদ্ধ রেখে আতিক বলে, হু।

হুঁ কী? আতিকের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে কোমর দুলিয়ে বলে সায়মা, এ ডিলটা শেষ করে চলো ঘুরতে যাই।

ঘুরতে যাবে? মাথা একটু তোলে আতিক, সোবহানটাকে নিয়ে যাও। ওটাতো দেখলাম বাট্রেন্ড রাসেলের মোটা বই নিয়ে এসেছে পড়ার জন্য। ভাবখানা যেন কালকেই ওর অনার্স পরীক্ষা।

সত্যি বই পড়ছিল সোবহান মুখ গোমড়া করে। একটা গাছের ছায়ায় পা গুটিয়ে বসে। কারুর সঙ্গে যেন মিশতে পারছে না আজ।

শালবন পেরিয়ে একটা ছোট্ট নিচু ডোবা। তার পাড়ে কাটাবনের ঝোঁপঝাড়। গাছের ছায়া পড়ে ডোবার পানি কালো হয়ে উঠেছে কষ্টিপাথরের মতো। হাঁটতে হাঁটতে তার পাড়ে এসে বসল সায়মা আর সোবহান। শান্ত জলে ওদের ছায়া পড়েছে। কয়েকটা বেগুন খেত পেরিয়ে একটা গোপাট। তার কিনারে বসে হুঁকো ফুঁকছিল এক বুড়ো খেতমজুর। দূর থেকে লক্ষ্য করছিল সায়মাদের মিটি মিটি দৃষ্টি যেন ও পদ্মার চরে রোদপোহানো কুমিরের মতো।

লোকটা দেখছ কেমন হাঁ করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে? বলে সায়মা, যেন আস্ত গিলে খাবে।

তাকাতে দাও। ও গাঁও গেরামে তোমার মতো কয়টাই বা সুন্দরী দেখেছে? ও তো আর জঙ্গলের বাঘ নয় যে হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

বাঘ হলেই বা কী? তুমি তো পাশে আছ। তুমি বাঁচাবে না?

বাঁচাব? না। তোমাকে বাঘে খেলে আমার কী? অভিমানের বিষণ্ণতা সোবহানের কণ্ঠস্বরে! হাসতে হাসতে হঠাৎ গভীর হয়ে যায় আজকাল।

খাপছাড়া কথা বলতে বলতে সায়মার একটা হাত কোলে তুলে নেয় সসবহান। বাধা দেয় না সায়মা। হারে পাতা মেলে ধরে ওর লাভ লাইনটা নখ দিয়ে খুটতে থাকে আস্তে আস্তে। ওটাকে যেন খুঁটে গভীর আর দীর্ঘ করে ছাড়বে। বেলা বাড়ে। ডোবার জলেতে গাছের ছায়া খাটো হয়ে আসে। উঠি উঠি করেও উঠতে পারে না ওরা। দূরে একটা কই গাছে একটানা ডাকতে থাকে ক্লান্তিহীন একজোড়া ঘুঘুপাখি।

পেছন থেকে কথা শোনা যায় আতিক চৌধুরী আর অন্য কয়েকজরে। আলাদা হয়ে বসে সোবহান। সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে।

এই তোরা করছ কী এখানে? এঁদো ডোবার ধারে? দিল খোলা সরল হাসি আতিকের টোপ গেথে বড়শি ফেলছ না তো?

উঠে দাঁড়ায় সোবহান, সায়মা ভাবীকে সোনা ব্যাঙ দেখাচ্ছি। অসংখ্যা ব্যাঙ ডোবাটায়। কলমি দামের ফাঁকে ফাঁকে ভাসছে আরামসে। ডোবার ব্যাঙ শহরে দেখনি কখনো।

বলে কী? ব্যাঙ? ঝুঁকে পড়ে ব্যাঙ দেখে আতিক, বাহু, সত্যি তো অসংখ্য ব্যাঙ ডোবাটায়। গ্রামের লোকগুলো করে কী? ধরে ধরে আমাদের কাছে বেচলেই তে পারে। যা ডিমান্ড ব্যাঙের ঠ্যাংয়ের সারা দুনিয়া জুড়ে? ফ্রগ লেগ ডেলিকেসি।

হাসে সায়মা, আপাদমস্তক ব্যবসায়ী আমার হাসবেন্ড। মগজের প্রতে পরতে ব্যবসার ধান্দা। পিকনিকে এসেও পয়সা কামাইয়ের চিন্তা। বলতে বলতে হঠাৎ গভীর হয়ে ওঠে, একটা দীর্ঘশ্বাস টুকরো টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসে সায়মার বুক থেকে। আতিক দেখে না। সোবহান লক্ষ করে সেটা, আতিক চৌধুরীর ব্যবসায়ী মনে রোমান্সের নামগন্ধও নেই।

ড্রইংরুমে বসে কফি খাচ্ছিল ওরা। কাপড় পরে নিয়েছে সোবহান। পত্রিকার অফিসে যাবে। হঠাৎ সন্ধ্যার আকাশ আচ্ছন্ন করে কালবোশেখির মহাতাণ্ডব শুরু হল। ধন ঘন বিজলির চমক আর বজ্রপারে বিকট আওয়াজ। টি. ভি.টা অফ করে দিয়ে একটা মহিলা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসল সায়মা। কভার পৃষ্ঠায় গ্রিক দেবীর দীর্ঘাকার ছবি। সুন্দর নিটোল স্বর্ণাভ বক্ষ। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের প্রতীক। অকারণে ম্যাগাজিনটার পাতা ওল্টাতে লাগল নীরবে।

বাইরে ঝড়ের দাপট বাড়ছ। কফির পেয়ালা উঠিয়ে নিতে এলে আয়াকে বললো সায়মা, ওদের ঘরে গিয়ে জানালাগুলো বন্ধ করে আসো। নইলে ধুলো ঢুকে ব ভরে যাবে। বালির ঝড় উঠেছে বাইরে।

ভীষণ শব্দ করে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিজলি চলে গিয়ে সারা শহর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘন কালো অন্ধকার। অজন্তা গুহারনিবিড় অন্ধকারের মতো। সরীসৃপের গায়ের মতো ঠাণ্ডা অন্ধকার।

চুপ করে বসে আছে সোবহান আর সায়মা। যেন দুই বাত্যাহত নিশাচর পাখি। বাইরে অশনি বিধ্বস্ত গাছগাছালির আর্তনাদ। বাজ পড়ছে বার বার।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সোবহান। অন্ধকারে এগিয়ে গেল সায়মার দিকে। অসমঞ্জস পায়ে। বুকে ওর দেয়ালঘড়ির ঢিপঢিপানি।

শরতের শিউলির মতো ঝরার জন্যই তো ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল সায়মা। দিনে দিনে, রাতে রাতে। শিউলির মতো ছুতেই সোবহানের উষ্ণ বাহুতে ঝড়ে পড়ল ও। সারা শরীর কাঁপছে গভীর আবেগে। অন্ধকারে ওর উন্মুখ অধরের পাপড়ি খুঁজে নিল সোবহান। কালবোশেখির মহাতাণ্ডব সোবহানের পেশিতে স্নায়ুতে, রক্তের প্রতি কণিকায়। অশনির কঠিন প্রহরে যেন বিধ্বস্ত হচ্ছে তার শালবন, ডোবার পাড়ে ঘন সবুজ গাছের সারি। সোবহানের উন্মাদ পেষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল সায়মা।

দেড় ঘণ্টা পর আলো এল। সমস্ত শহর আবার ঝলমলিয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ সজ্জায়। ততক্ষণে অন্ধকারে পথ হাতড়ে অফিসে চলে গেছে সোবহান। ক্লান্ত, অবিন্যস্ত সায়মা। কোলে ফিল্ম ম্যাগাজিনটি আলতো করে ধরা। কভারে উন্নত গ্রীক দেবীর অপরূপ মূর্তি। সুঠাম সুডৌল স্তনযুগল তার। নত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সায়মা দেবমূর্তিটির দিকে। চোখে ওর হিজল ছায়ার গভীর স্নিগ্ধতা। তৃপ্তির নিবিড় আবেশ ওর সারা অঙ্গ জুড়ে। ঘুম ঘুম দৃষ্টি সায়মার। ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে একটা বড়ো হাই তুলল শব্দ করে।

শীতের পর গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মর র বর্ষা! মারে পর মাস পেরিয়ে গেল। গাছে গাছে এখন কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন। সবুজের সমারোহ পাতায় পাতায়। চন্দনার নাচন পার্কের কচি দূর্বাঘাসে। কাকেরা মিটিং করছে ইলেকট্রিক তারে।

দুপুরের অবেলায় লেকের ধারে এসে একাকি বসে পড়ে সোবহান। পত্রিকার অফিস থেকে আজ আর ঘরে ফেরেনি। কার ঘরে ফিরবে? আতিক চৌধুরীর সংসার। আর কত দিন পরগাছা হয়ে থাকবে ও।

আর যাবেই বা কেমন করে অন্যত্র। ওর সমস্ত স্নায়ু জুড়ে রয়েছে সায়মা। কী এক অদৃশ্য গ্রন্থি দিয়ে ওকে বেতলতার মতো বেঁধে রেখেছে সায়মা। আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। যাদুর সম্মোহন ওর চোখে, নাকের তিলে, দেহের প্রতিটি বাকে!

তবুও মাঝে মাঝে কথা তোলে সোবহান আতিকের সঙ্গে দেখা হলে, অনেক দিন তে থাকলাম আতিক ভাই আপনার ওপর। এবার একটা আলাদা বাসা করি।

ওর কথা শুনে মুখ শুকিয়ে কঠোর হয়ে যায় সায়মার। মাথা নিচু করে বসে থাকে চুপচাপ। অজানা ভয়ে বুকের ভেতর কেমন করে অকারণে জিভ ভেজায় স্যালাইভা দিয়ে। লম্বাটে নখ দিয়ে কপাল খোটে।

উদার হাসি হাসে আতিক চৌধুরী, অত ব্যস্ত হচ্ছো কেন সোবহান? যাবে আর কি আরে কিছুদিন থাকে না। বিনা বেতনে তুমি যে দিনের বেলা আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে, সেটা তো আমাদেরই ফাও লাভ।

কথা বলতে বলতে সোবহানের পিঠে আদরের সঙ্গে চাপড় মারে আতিকচৌধুরী। চোরা চোখে তাকায় সায়মা, উদ্বেগের ভার কেটে গিয়ে প্রশান্ত হয়ে ওঠে ওর মুখমণ্ডল। সোবহানকে থাকতে বলছে আতিক চৌধুরী। আরও কিছুদিন থাকবে ও।

লোহা কাঠের কাঠি আজ আতিক চৌধুরীর চেহারায়। হিমালয়ের মতো গম্ভীর মুখে অফিসের কাগজপত্র দেখছিল চুপচাপ। বেলা বারোটার দিকে বাসায় ফোন করল হঠাৎ করে। বেশ কিছুক্ষণ অপর দিক থেকে রিসিভার ওঠাল সায়মা।

হ্যালো, কে, সায়মা? কী করছ তুমি? এতক্ষণ ফোন ধরলে না যে?

ফোন? এতক্ষণ? এতক্ষণ কেথায়? ও বাথরুমে ছিলাম। শুনতে পাইনি।

কম্পিত কণ্ঠস্বর সায়মার। একটু নার্ভাস যেন।

কী করছো বাসায়? সোবহান নেই?

ততক্ষণে গলার আয়োজ সহজ হয়ে আসে সায়মার, কী আর করব? একা একা বোরড় হচ্চি। সোবহান ভাই? ও তো ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে গেছে। মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ওপর কী একটা ফিচার লিখবে।ওখানে গেছে ডাটা কালেক্ট করতে।

ও! আচ্ছা! আমি ফোন করলাম হঠাৎ সিঙ্গাপুর যাওয়ার দরকার হয়ে গেল। কাল আটটায় ফ্লাইট তুমি আমার স্যুটকেসটা গুছিয়ে রেখা। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে যাবে। ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে হবে। অফিরে অনেক কাগজপত্র গুছিয়ে সঙ্গে নিতে হবে।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে সোজা লিফট বেয়ে নীচে নেমে আসে আতিকচৌধুরী। নিজের গাড়িতে উঠে না। একটা স্কুটার ডেকে নেয় হাত বাড়িয়ে।

পা টিপে টিপে বাসায় ঢোকে। বেল টেপে আতিক। মৃদু টুং টুং শব্দ হয় বিলেতি কায়দার কলিং বেলের।

আয়া এসে দরজা খুলে দেয়। মাঝবয়সী আয়া। মাথায় ওর লম্বা ঘোমটা টানা। সাহেবের চোখাচোখি হতে চায় না মরি মা।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ড্রইং রুম পার হয়ে ওপর তলায় উঠে যায় আতিক চৌধুরী। তারপর শোবার ঘরে নক করে জোরে জোরে। বার বার।

ধরা পড়ে গেছ তোমরা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে আতিক, এত বড় ট্রেজারি এত জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সোবহান। অবিন্যস্ত ওর মাথার চুল। কপালে ঘামের কণা। হিমেল হাওয়ায় বটপাতা যেমন করে কাপে, তেমনি কাঁপছে সায়মা। ভয়ে মুখ রফের মত শাদা হয়ে গেছে। শাড়িটা গুছিয়ে নিতেও ভুলে গেছে। ব্লাউজের নিচে অৰ্বাস নেই। পিঠের বোম খোলা।

বিচারকের মতো গম্ভীর কণ্ঠস্বর আতিকের, ‘কেমন চমৎকার মিথ্যা’ গল্প ফাঁদলে তুমি, সোবহান ভাই বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেছে। আমি একা একা বোরড় হচ্ছি।

সায়মার দিকে না ফিরেই বলে গেল, ‘এরপর তো আর আমাদের একসঙ্গে ধ্ব করা চলে না। এত বড় স্ক্যান্ডালের পর। এ লোকটাকে আমি চাকরি দিয়েছি নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছি। আর সে কিনা’ ঘৃণায় নাক শিটকায় আতিক চৌধুরী।

সারা ঘরময় থমথমে নীরবতা। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে আতিক।দেয়ালের ঘড়িটা একটানা শব্দ করে যাচ্ছে টিক টিক টিক। সময় এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত তালে।

মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সোবহান। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন, এরপর এক সঙ্গে ঘর করতে পারবেন না আপনি সায়মাকে নিয়ে ওকে আমি ভালবাসি। ওকে আমি নিয়ে যেতে চাই। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।

একটু থেকে টেনে বলে, এ কলঙ্কের আঁচ একটুও আপনার গায়ে লাগবে না। ধ্ব দায়দায়িত্ব আমার আর সায়মার। সব স্ক্যান্ডাল মাথায় নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে চাই। এগুতে চাই। বলতে বলতে সায়মার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সোবহান। ওর গা ঘেঁষে।

হ্যাঁ, চলে যাও। তোমরা, আজই এক্ষুণি। ডাইভোর্সের ফরমালিটি আমি কালই সেরে ফেলব। আরও দ্রুত পায়চারি করছে আতিক চৌধুরী। রাগে দগদগে ঘায়ের মতো লাল হয়ে উঠেছে ওর চোখ দুটো।

.

আজ আর টেবিলের ওপর পা দুটোদুলে ঝুলন্ত বাদুড় হয়ে বসেনি আতিক চৌধুরী। লোদা হয়ে বসেছে টিল্টিং চেয়ারটা?। পায়ে আগের মতই চকচকে ব্যালি সু। দারুণ রিলা ওর চোখমুখ। টেলিফোন ডায়েল করে আস্তে আস্তে।

হ্যালো, ফাওজিয়া, আমি আতিক। …..এ কয়টা দিন ব্যস্ত ছিলাম। তাই ফোন করতে পারিনি। হাঁ চলে গেছে ওরা…..জানি না কোথায় উঠেছে…হয়তো সোবহানের দেশের বাড়িতে…আজ এসো সন্ধ্যার পর….বাসা তো খালি…আর কেউ নেই…ঠিক দাঁড়ানো পাবে আমাকে দরজার সামনে….আরে বাবা, ছয়টা মাস তো সময় দাও….নইলে লোকে আমাদের সন্দেহ করবে…হ্যাঁ, উইথ এ ক্লীন সেট…..।

ফোনটা নামিয়ে রেখে বলে আতিক, গুড।

2 Comments
Collapse Comments

Want to have more of this great writer’s book please.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *