১. সুঘরাই হারাইয়া যায়

জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো–জয় রামকৃষ্ণ

তখনই যে সময়ে সুঘরাই হারাইয়া যায় এই দিব্যমাল্য সাজান, ভাস্বর, হীরক-শোভাতে বিনিদ্র শহরে–ইহা শিবপুরী, ভক্ত ও মুক্তি প্রদায়িনী যাহা, সৌন্দৰ্য্য যাহা, যে শহর, তখনই সে আপনকার সীমা বুঝিয়া তীব্র আতান্তরে পড়িয়াছিল; যে তাহার শেষ অঙ্গুলিশীৰ্ষতেই ও অন্য প্রত্যঙ্গাদিতে যে ইহার পর হইতেই এবং বনস্থলী চমকপ্রদ হইয়া রহে, যে ইহার পর হইতেই দীপের জ্যোতির্ময়ী ঘটনার প্রবাহ! যে ইহার পর হইতেই আমি, হায়! আমি নারসিসস্‌-রে পথিক করিয়াছি।

ঐ সীমা ভাবিয়া, ও আমার মনিব! ও আমার মনিব! বলিয়া সে বড়ই উভরায় কান্দিয়া থাকে ইহা সত্য, অথচ আদতে তাহাতে প্রচ্ছন্ন ছিল কূট বিদ্বেষজনিত ক্রোধ, সে যেমন সেই সাধক–যে যিনি নির্ভীক তোয়াক্কাহীন দামাল, আকৰ্ণবিস্তৃত নেত্র যাঁহার হিঙ্গুল, চেহারা যাঁহার বৈরাগ্যসুন্দর দশাসই, গাত্র যাঁহার মসৃণ ও উজর তাম্রবর্ণের, যাঁহার পরনে কৌপীন, হস্তে যাঁহার সুমহৎ চিমটা; এখন যিনি এই লোকপ্রসিদ্ধ মন্দিরের দরজার চৌকাঠেতে অদম্য দুঃসাহসে ভীষণ রাগে ঐ চিমটা দ্বারা বারম্বার আঘাত করিতে উন্মাদ; ইহাতে ক্রমান্বয়ে তদীয় স্কন্ধ বলীবৰ্দের প্রায় স্ফীত হইতেছিল, ঘৰ্ম্মে তাঁহার কপালের হোমতিলক ঘুণাক্ষরে পরিণত হইল, হঁহার রুদ্রাক্ষমালা আন্দোলিত, আর যে তিনি মুহুর্মুহুঃ বীরবিক্রমে ত্রিভুবনের ত্রাসসঞ্চারী হুঙ্কার পাড়িতেছিলেন।

ঐ বিপুল হুঙ্কারমধ্যে ঐ অভিনব সাধক জলদগাম্ভীর্যে মা ভৈঃ উচ্চারণ করিয়াছিলেন, আবার কখনও বা ভগবান শিবকে বিকট আঁশটে বচনে গালি ও টিট্টিকার দিতে থাকিয়া ইহাও বলিতেছিলেন, শালা…অদ্য আমারে দর্শন দিতে হইবে, আমি কণ্ঠে ফিরিয়া আসিতে চাহি না, দে শালা অখণ্ডতা!

যে এবং ঐ সাধক এরূপ অহঙ্কারও প্রকাশ করেন, যে, আমি তোমার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছি…আর তুমি আমাকে ফাঁকি দিবে!

.

ঈদৃশ নানান অর্থপূর্ণ শব্দের সহিত চিমটা-প্রহারের সঘন আওয়াজ হইতে থাকিল, আশ্চৰ্য্য যে ইহাতে কুকুর ও পাখীরা রব তুলে নাই, নিকটে থাকিয়া সুঘরাই কিছু আড়ষ্ট, কিছু কৌতূহলী!

সে দেখিল, অনেক পূজার্থী ও ধার্মিকরা ঐ বীরের সমীপস্থ হইয়া বিস্ফারিত লোচনে, তাঁহার ঐ ভয়ঙ্কর উদ্ধত ক্রিয়াকলাপ দেখিতে থাকিয়া ভক্তিবিহ্বল হৃদয়ে, কেহ বা অশ্রু ভারাক্রান্ত ইতিমধ্যেই, অহরহ, অহরহ ‘জয় বৈদ্যনাথ শিবশম্ভ’ ধ্বনি দিতেছিলেন; তাই ইদানীংকার সমস্ত ভাবে আমাদিগের জীবন এক সুউচ্চ মহিমার অবস্থায়ে স্থায়ী হইয়াছিল।

সাধক ঘোর দম্ভে পুনরায় ঘোষণা করিলেন,…আমি মন্দিরে যাইব না…তুমি স্বরূপে আসিয়া দেখা দাও…। এবং যে ইহার পরক্ষণেই তদীয় বিপুল দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল, তিনি চেতনশূন্য হইলেন; তখনই, সমবেত প্রত্যেকে তাহার অবলোকনে মহা গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে সময়ে, ইহা বলিলেন,…হে নীলকণ্ঠ, হে ভগবান উমাপতি, তুমি অন্তর্যামী, আমাদের পুরুষানুক্রমে এবং পূৰ্ব্বজন্ম ও ইহকালের জন্য আমাদের যে অমরতা বরাদ্দ আছে…তাহা অচিরেই ঐ সাধকেরে দেওয়া হউক, কেন না তুমি তাহার (ঐ সাধকের) অবিনাশী প্রেম।

সাধকের অন্তর্দশা প্রাপ্ত দেহটির শুশ্রূষাকরণে অতীব শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেহ সাহস পর্যন্ত করেন না, এই জন্য যে ঐ পাঞ্চভৌতিক দেহ অধুনা কৃষ্ণাচতুর্দশীর পরমাশ্চৰ্য্য চন্দ্রকলা! এখন কেহ সাধকের কর্ণে অমৃত শিব নাম, কেহ ব্যজন, কেহ উহার মেরুদণ্ডে ঘৃত কর্পূর মালিশ করিতেছিলেন, অনেকক্ষণ পর সাধক খানিক সহজ অবস্থায় আসিলেন ও তাবিজড়িত স্বরে কহিলেন, জল…জল খাইব!

এইভাবে ইহজগতের সহিত সম্পর্ক গঠিত হইল।

সুঘরাই এহেন প্রহেলিকার কিছু, সরলতার এতটুকুন, বীরত্বের লেশমাত্র না বুঝিয়া শুধু সাধকের দুর্ধর্ষতা গ্রহণ করিয়াছিল। আর যে তেমন তেমন রোষে সেও জ্বলিতেছিল–সম্ভবত, কেন না তাহারই ছায়া বাঁচাইতে ব্রাহ্মণ্য শ্রীসম্পন্ন পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় ঈষৎ দিভ্রান্ত হওয়ত স্বীয় উড়নীতে সামাল দিয়াছিলেন; বিশেষই নিশ্চিত, কেন না সে বেচারী মন্দিরের দুয়ারের এই পার্শ্ববর্ত্তী স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়। তখনই, যখন ঐ সাধক অন্তর্হিত হইয়াছেন, যখন এরূপ সুদুর্লভ পবিত্রতার অর্থাৎ মন্দিরের নৈকট্যে আসাতে যে এক অনির্বচনীয় আহ্লাদে তাহাতে গোঁয়ার হইয়া উঠিয়াছে!

এবং তাই তৎক্ষণাৎ সুঘরাই, তদীয় স্নেহশীলা মনিব পত্নী আদিষ্ট, সেই মনোলোভা সার্থক কামনা জানাইতে পারে না। যে পরম ভক্তিমতী রমণী যে সূত্রে বলিয়াছিলেন,…এখন বাবা বোদ্দিনাথের ইচ্ছে যদি হয়, এমন যদি করেন, তুই তাঁর সামনে একেবারে…উঃ তাহালে! হ্যাঁরে তেমনতারা ভাগ্য কি আর ছোঁড়া তুই করেছিস!…সে নয় নাই হ’ল…তবু তুই দাঁতে দাঁত দিয়ে…জা যায় সেও ভি আচ্ছা, তুই তাঁকে ডাকবি, দেখবি তোর পাপ তিনি মুছে দেবেন!

এই পর্য্যন্ততে সুঘরাইএর রৌদ্রনিবাস আয়ত চক্ষুর্ধয় সর্ব সময়ে বড় হয়, যাহা প্রত্যক্ষে মনিবপত্নী আবার কহিলেন, হ্যাঁরে,…তিনি বড় দুখীর ঠাকুর…মা ঠাকরুণ (সারদাদেবী) বলেছেন, যে ছোট ছেলের ডাক তিনি ফেলতে পারেন না, তুই নির্ভয়ে ডাকবি, বলবি ঠাকুর আমি বড় অধম বড় দীন, তুমি ছাড়া আমার গতি কৈ…তখুনি, দেখবি বাবা বোদ্দিনাথ তোর পুবো জন্মের সব পাপ ধুয়ে মুছে দেবেন…আবাঃ ছোঁড়া গালে হাত দেয়…কতবার বলেছি না এ সব কথা কহনও গালে হাত দিয়ে শুনতে নেই…এসব ঠাকুরদের কথা!

ইহাতে সুঘরাই আপনকার গাল হইতে হাত নামাইতেই যারপরনাই অসহায় নির্জীব হইল; এমনই যে, ইদানীং সকল নির্ভরতা তাহার ঝটিতেই খোয়া গিয়াছে, যে সে সব গরু খেদাইতেও অপারগ; এবং তাই উপস্থিত এ দেহ কোথাও হেলান চাহিতেছিল–যাহা নির্ঘাত কৃতাঞ্জলিপুটে শুনিবার, পত্ৰউদগম ও কুম্ভকারের চাকের নিগুণ গূঢ় পদ্যতে; যাহা গ্রামাঞ্চলে অনাবৃষ্টির ছড়া বোধে ব্যবহৃত হয়, নবমবর্ষীয়া বালিকারা নগ্ন দেহে, শূন্য ঘট মস্তকে ধারণে ঈষৎ নৃত্যভঙ্গিমায় উহা গাহিতে থাকিয়া প্রথমে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করে।

এখন সুঘরাই যখন এহেন হেলান দিতে ইচ্ছুক, ঠিক সেই সময়তেই শুনিতে পাইল যে নিজ অভ্যন্তরে পাঠান দাপটে কিলকিলা রব ঘনাইয়াছে; তদীয় পেশীসকল তাহার স্বকীয় পূর্বজন্মটিকে বিনানুনে এক গ্রাসে খাইতে হাঁ হাঁ করিতেছিল, যাহাতে সে বিপদ গণিল; ইহাতে শঙ্কায় সে কিয়ৎ পিছু হটিল, সুতরাং সে নিরীহ, যে নির্বিবাদে সুতীক্ষ শীত সহিয়াছে নিজ বক্ষঃদেশে হস্ত রাখিয়া, যে নিজ হাতে কপালের ঘাম ও চোখের জল মুছিয়াছে, যে কোন লাটুঠার দড়ি (কুয়া দড়ি) স্পর্শ করে না, সে অন্য নহে। ফলে অতএব মোটেই আভাসিত তাহার মধ্যে হইল না, যে কোন একদিন কয়েকটি পালক উড়িয়া-হায়! কখনও বা মুক্তার বৈভব আতিশয্যকে প্রনষ্ট করিয়াছিল, এইহেতু যে সে আপনার ভালবাসা লইয়া ক্কচিৎ খেলা করে–তাহারে বিকট করিয়াছিল! এবং সে ন্যাংটো হইয়াও ছাড় পায় নাই।

যে স্থলে পালক উড়িয়াছে, পালক পড়িয়াছে, ধ্রুব যে ভগবান রামচন্দ্র যাবৎ না সেখানেতে পদার্পণ করেন, ততদিন সেখানে কিছুতেই দীপ জ্বালিবে না, যে ঐখানে পদক্ষেপমাত্রই সকলেই পথ ভুলিবে; এ কারণে যে, ঐ স্থলে সুঘরাইএর তর্জ্জনী কাটিয়া বেশ খানিক রক্তপাত ঘটে, এবং যে সে দেখিল ঐ রক্ত তাহার পাখীটিকে মহা সোহাগভরে পান করিতে; এখন আজব যে, ঐ দৃশ্যে সে দারুণ খুসী হওয়ার মুহূর্তেই দুর্দান্ত ক্রোধে ভৌতিক, তৎপ্রবর্ত্তীত সে তৎক্ষণাৎই পদাঘাত করিল মূদুল পক্ষীটিকে; কিছু পালক খসিল, ইহা উড়িতে থাকিয়া তাহার সম্মুখের–রিখিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত সুরম্য ডিগরিয়া পাহাড়কে ঢাকিয়াছিল। ২৬০

দেবস্থান যাত্রার মধ্যে এবং মন্দিরে আসিবার রাস্তাকে পূজার্থী ও ব্রাহ্মণ স্পর্শ বাঁচাইবার ইতঃমধ্যে মনিবপত্নী বর্ণিত প্রার্থনা, ইহা শ্রুতি বা দেশাচারে নহে, তিলেক সে বিস্মৃত হয় নাই, বরং উহাই তাহার সম্বল ছিল; তবে ইহা ঠিক, যে, ঐ সময়েতেই, নিষ্ঠাবান মনিব মহাশয় তাহার বিষয়ে যে অভিমত ঘোষণা করিয়াছিলেন, তাহাতেই সে, তাহার এক ছত্রে সে, কেবল দোমনা হইতেছিল; তিনি প্রকাশিয়াছিলেন,…যে সে নিষ্পাপ (মনিবপত্নীর উক্তিতে) সাতজন্মের পাপ!

এবং তবু ঐকথা যাহা উচ্চারণের সঙ্গেই বাস্তবতা কাদামাখা পদে মার্বেল অভিমুখে ছুটিতে আছিল, এইজন্য যে ঐ উক্তিতে মনিবপত্নী, যিনি এ যাবৎ মৌনী, এ যাবৎ নিছাড় মালাজপকারিণী, তথাপি তিনি সমধিক বাৎসল্যভরে সুঘরাইএর প্রতি চাহিয়া স্মিতহাস্য করেন।

কিন্তু যখন সে বেদময়ী অজস্র ধ্বনির মধ্যে, যখন আহ্লাদ তাহাতে থিতাইয়াছে, তখনই সুঘরাইএর আপনকার এতাবৎ মনস্থ কামনার পদবন্ধ মনিব-ব্যক্ত পদগুলিতে ঠেক্ খাইতেছিল; এখন সে যেহেতু প্রার্থনা জানে না ফলে ক্রমাগতই সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতেছিল।

অবশেষে পুনরায় মনিবের বিনীত কণ্ঠস্বর শুনিল, একটি শব্দ দেখিতে পাইল, ইহাতে সত্যই সে যেমন চানোয়ার বালিতে খোঁড়া গর্তের নিথর জলের চাকচিক্য সাক্ষাৎ করিয়াছিল, আশ্চর্য্য যে ঐ নিঃসঙ্গতায় থাকিবার সময়েই সুঘরাই বুঝিল তদীয় নিষ্পলক চাহনির সামনে–এই হাট দিনমানে মন্দিরের রাস্তায় এক অযুত দ্যুতিময়ী শোভাযাত্রা আসিতেছে।

সে প্রত্যক্ষ করিল এ শোভাযাত্রাতে সমস্ত পথ চারুবর্ণ ধারণ করিয়াছে, সে প্রত্যক্ষ করিল এক বহুমূল্যবান উৎকৃষ্ট কিংখাবের ছাঁদনা, যাহার চারিটি রৌপদণ্ড চারিজন বালক ব্রহ্মচারী কর্তৃক ধৃত, ইহাদের মস্তক মুণ্ডন করা, পরণে ইহাদের গৈরিক–আর ঐ ছাঁদনার নীচেতে কোন সৰ্বালঙ্কারভূষিতা, হস্তে যাঁহার ধান্যমঞ্জরী, ইনি গৌরী, ইনি সেই যিনি নৌকার অভিমানকে মান্য করিয়াছেন, ইনি সেই যিনি মরকতের গোপনতা!

ঐ শোভাযাত্রা দর্শনে পথিপার্শ্বের সকলেই ‘অহহ ভগবতীতনু! জয় জয় অপূৰ্ব্ব মিথুন! অহো। মহেশ্বরী’ বলিয়া গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছিল; ঐ সুমহৎ আওয়াজে দিকে দিকে পবিত্র অগ্নি স্থাপিত হইতেছিল। এই জোয়ারের ইতিমধ্যেই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব মনোরমত্ব দেখার প্রাণভরিয়া দেখার সৌভাগ্য হইতে বেচারী মন্দ কপাল সুঘাই বঞ্চিত হয়।

সে সর্বৈব বিচ্ছিন্ন হইল।

সে অনেক অনেক কান্দিল। সে অনেক অনেকবার ও আমার মনিব আমার মনিব, বলিয়া উথলিয়াছে। কিন্তু কান্দিলেও অন্তরে সে ঐ সাধকপ্রায় আস্ফালনে তৈয়ার; আপনার অঙ্গুলিশীর্ষ বারম্বার নজরে এক বিষমত্ব জানিয়া সে খ্যাপাটে, এতদিন তাহার যে সীমা গ্রাম্য ছিল, সম্প্রতি তাহা ভৌতিক হইয়াছে; এই শহর তাহাকে, নিজেকেই, তাহার স্বীয় গায়ের উপর ঢালিয়া দিয়াছে; এই শহরের উপর সে খঙ্গহস্ত, সে ব্রাহ্মণশ্রেণীর ন্যায় মোহিলিকে অভিশাপ দিয়াছে কারণ মোহিলি বলিয়াছে, ইহা মহিমান্বিত শহর, বহু জ্ঞানী এখানে, এখানে শিব বাস করেন, পঞ্চায়েত বিল্বপত্র হস্তে বিচার করে, এখানে বিস্কুটের কারখানা নাই।

ইহা মহিমান্বিত শহর! সুঘরাই বলিয়াছে, পাখীরাই তাহা জানুক; সে বলিয়াছে, মোহিলি ও যাহাদের ধারণা এ শহরে কুকুর হওয়াও পুণ্যের, তাহাদেরকে সে পদাঘাত করে এবং নিমেষেই এরূপ মনোভাবে সে ভীত; উচ্চবংশের বালকদের ন্যায় বলিতে এখনও পারে নাই যে, না বাবা বলিব না ভগবান শুনিতে পাইবেন।

সুঘরাই এই শহরকে খলযন্ত্ৰী সমঝে আপনার চোয়াল ঘর্ষণ করিতেছিল, এখানের কোথাও সে নিজেরে সম্প্রসারিত করিতে পারে না। অবিরত ঢাক বাদকের নৃত্যপদক্ষেপ তাহার পদচিহ্ন মর্পিত দেখিয়া, শান্ত তীর্থযাত্রীদের তাহার পদচিহ্নের উপর দিয়া যাইতে প্রত্যক্ষে সে মারাত্মক হইয়াছে! ইহা বড় বিষম দায়, কোন বিচারেরই সুযোগ নাই!

কখনও বালকস্বভাব বশত সুঘরাই রাস্তার এক পাশ বাছিয়াছে, এই নির্বাচনে একদা সে অহো বলিয়া ফুকারিয়াছে, সে খুসী, সে ইহাতে উচ্চবর্ণের স্পর্শ বাঁচাইয়াছে; ক্রমে তদীয় পদদ্বয় ধূলাতে বিশেষই গৈরিক যে তাহাও ঠিক কিন্তু সুরাহা হয় নাই! তাহার মনিবরা রাস্তার মধ্য দিয়ে যায় বা কখনও পথ ছাড়িতে পাশে, তবে! সে নিয়ত মনিবদের অন্বেষণও করিয়াছে, ইহারই ভিতরে যে সে অনেকবিধ কাঠামো, সুদারুণ পারিপার্শ্বিকতার সহিত আপনাকে সংযোজিত করিয়াছিল–সুতরাং এনতার অনভ্যস্ত সংস্থানের মধ্যে সে, সঙ্গে সে, এক হয়–এইরূপ বিশ্বাসে যে মনিবরা তাঁহাদের সত্ত্বগুণ বশত আকর্ষিত হইতে পারেন ঐ ঐ সংগঠনে।

এবং সুঘরাই ঐ ঐ পরিবেশ সকলের মধ্যে আপনাকে উপস্থাপিত করিয়া আবার অন্বেষণে থাকিয়া, খুবই তাজ্জব যে কখনও কখনও সে নিজেকে মনিবের চোখে নির্ধারণ করিতে মজবুত ছিল; ইহাতে, পর্য্যবেক্ষণ তাহার কি আশ্চৰ্য্য অমানুষী, বোধ কি অভাবনীয়! যে যেন বা সে কখনও জংলী নয়; ইদানীং এহেন ভিন্নতায় সে, মানে মনিবকে, দেখিল।

সে কল্পনায় দেখিল বিশৃঙ্খলতা, মসৃণতা, অনেক আবছায়া অনেক রক্তচন্দন ও তীর্থযাত্রীর দল ভেদ করত তিনি সুস্পষ্ট হইলেন; এবার তিনি মুখের পার্শ্বে হস্ত স্থাপনে ভীড়ের এখানে হঠাৎ, অন্যত্রে বারেক, সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন, যে ইহাতে মাতৃস্তন অরুণাভ, যে ইহাতে জনতা এই নিবিড় এই তরল হইল; এখন এবং সুঘাইএর প্রমাণের-কোনবালককে পশ্চাত হইতে দর্শনে–বালকের বস্ত্র ও গেঞ্জী ফর্সা যেহেতু ঐ সুঘরাই বিশ্বাসে অত্রাহি দৌড়াইলেন এবং চীৎকার করিলেন–এই হারামজাদা সুঘরাই!

হায় সে এক স্কুলগামী বালক!

নিরাশ হওয়ত বিষণ্ণ হৃদয়ে তিনি পূতসলিলা শিবগঙ্গার সুদৃশ চাতালে আসিলেন; এখানে কেহ কেহ যাহারা ঘুমায় তাহাদিগকে স্বীয় দেহ বাঁকাইয়া এমত নিবিষ্টতায় তিনি সমীক্ষণ করিলেন যে, যেমত বা ঘুমন্ত সকলের স্বপ্নের সুষুপ্তির অন্তরীক্ষে সুঘরাইএর খেই লুক্কায়িত আছে; যে মধুস্বরে তিনি সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন; ইহা নির্ঘাত অপ্রকৃতিস্থতার হইলেও আর যে, এই দেবস্থানের ধ্বনিত গভীর জয় জয় শিবশম্ভ বচনে ও স্নানের নির্মল শব্দে ঐ প্রিয় নাম ধূলিসাৎ, তীর্থকামীদের অগ্রবর্ত্তী মঙ্গল ঢাক বাদ্যে তাহা নয় ছয়!

সেখানে খুঁজিতে থাকিয়া মেঘমন্দ্রে অগণন কণ্ঠের মন্ত্রের প্রতি কখনও, সুললিত স্তবস্তোত্র আবৃত্তিসহ শিবগঙ্গাতে শুভ অবগাহনরতদের প্রতি কখনও তিনি সনাতন প্রবীণ ভঙ্গীতে চাহিয়া রহেন, কারণ যে বিবিধ ওষ্ঠের ফুটমান শব্দরাজিতে ও অবগাহনের মনোজ্ঞ রণনে ধ্রুবই যে তন্মাত্রা সমস্ত নিৰ্ব্বিকার, কোথাও অন্ধকার নাই; মাত্র যে শিখা ঊর্ধ্বগামিনী এই তত্ত্বে সবই জরিয়া আছে–তাহারাও কি সুঘরাইকে ডাকে!

আবার তিনি শ্বাস লইলেন, তিনি সহজ হইলেন, তিনি ঠিক করিলেন, এই ভাবিয়া যে সুঘরাই নিশ্চয়ই ক্লান্ত বোধ করিলেও মুষড়ায় নাই এবং আরও নিশ্চয়ই আমার খোঁজার সুবিধার্থে এখানেও সে ছিল; তাই যাহারা শিবগঙ্গায় অর্ধজলমগ্ন, করজোড়ে যাহাদের পৃথিবীর পার্থক্য, তাহাদেরই কাহারও পাঠ থামিলে এই সংবাদ লইবেন যে, যে বালক এতক্ষণ শুদ্ধাতিশুদ্ধ অবগাহন দেখিতেছিল এবং তাহাতে সে অপরোক্ষেই, যেন সে, ঐবালক, একাই সুদীর্ঘ সময়, যাহা বীজ বপন করিতে ব্যয়িত হইয়াছে এবং ঐভাবে অনেক দুরতিক্রম্য পথ বহি এখানেতে আসিয়া চমকৃত!

এবং আপনাদের স্নানের আওয়াজে সেই বালক একদা রিখিয়ার সন্ধ্যায় নীত হইল; ছোট ছোট পরিবার বেড়াইতেছে–ইহারা চেঞ্জার; ইহাদের সকলের মুখমণ্ডল, দৃষ্টি, আকাশ ও মাটির ইতিমধ্যে রক্ষিত–ইহাদের পিছনে পাহাড়, শাল ও মহুয়ার পুনরাবৃত্তিতে ন্যাংটো দিকসকল; ইহারা সমস্ত কিছুকেই গ্রাণ্ড বলিয়া প্রশংসা করে, তাহারা পেট্ররোমাক্স হাতে সুঘরাইকে দেখিয়া বলিয়াছে–ছেলেটি গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড! বেশ কালচার আছে!

এবং আপনাদের স্তবস্তোত্রের অনুরণনেও শিবগঙ্গার শীতলতায় উহার, সেই বালকের, দেহ মন পরিবর্তিত আর যে তাহাতে এই শুভ বুদ্ধি মনে হয় জন্মে যে শিবই প্রাকৃতজনের অদ্বিতীয় জ্ঞান এবং ইহাতে সে স্মিতহাস্য করিতে চেষ্টিত হইয়াছিল…আপনারা শাশ্বত ধর্মের, মন জানে, সূক্ষ্মগতি অভিজ্ঞ আপনারা, বলুন, তাহার ঐ ভাব যেন সত্য হয় এবং এখন ধর্ম্মপ্রাণ আপনারা এই লৌকিক খবর কি বলিবেন যে সে কোথায় গেল?

কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসিতদের উত্তর আন্দাজে, অনুৎসাহে যে সকল কুসুম শিবগঙ্গার পাপহারিণী জলস্তরে হতাদরে ভাসে অধুনা সেই সেইতে নেত্রপাত করিলেন, এখন তদীয় ক্ষুণ্ণ মানসে ফুলগুলি, ফুলগুলি, ফুলগুলি!

অনেক সন্ন্যাসীর মধ্যে এক তেজঃপুঞ্জ কলেবর ভস্মাবৃত সন্ন্যাসীর নিকট তিনি যাইয়া প্রণতি পুরঃসর কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদিলেন,–ভগবন, যে বালক অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে, স্বীয় মস্তকোপরি হস্ত রাখিয়া আপনাকে অবলোমাত্রেই থ হয়, সুতরাং আপনাদের মতন সন্ন্যাসীর সম্পর্কে মোহিলির উল্লেখ তাহার খেয়াল নাই; আবার ক্ষণেক পরেই সেই বালক এক আতঙ্ক দেখিল, সে দেখিল সমক্ষে থাকিয়াও নাই–এর মধ্যে আপনি আপনার ধুনির অমোঘ তর্জ্জনী আছে, সে দেখিল আপনার ধুনিতে সূর্যের যাত্রাপথ পুড়িয়া খা হইয়াছে।

সে নাসিকা কুঞ্চিত করে–আমরা জানি যে ঐ ধুনিতে পানপাত্রের কিনারের আঙুরলতা কেয়ারী করার সভ্যতা দাহ্যমান, মানুষ নিজেকে ভালবাসার নামে নিজেকে সজ্ঞানে যে তামাসা ব্যঙ্গ করিয়াছে– কত না ব্যঙ্গ উক্তি রচনা করিয়াছে–তাহারই পোড়া গন্ধ আপনার অনিৰ্ব্বাণ ধুনি হইতে নির্গত, ধূম্রজাল অনেক ঊর্ধ্বে উঠে, ইহাতে উজ্জ্বল হংসযুথ বহুদূর হইতে নিশানা পাইতেছে অথচ চন্দ্রসূর্য নক্ষত্রাদি বহুকাল হয় আপনার দিমণ্ডলে নাই–এই জটিল ঘটনা আবৰ্ত্ত কথা যেন সেই বালকও জানিয়াছে, কেন না সে নিশ্চিন্ত ছিল। অথবা এইজন্য সে স্থবির যে আপনার দর্শনে অবশ্যই সুদুর্লভ স্পন্দনরহিত যাতনা তাহাতে যেমন প্রভাবিত হইয়াছে!

অভ্রান্ত ইহা যে আপনার দিব্যদেহই পূৰ্ব্বদৃষ্ট সেই শোভাযাত্রার গূঢ়তম মন্ত্রগুপ্তি এবং যে আপনি অলৌকিক নগ্ন, আপনি অজর দুঃখবোধ, অলৌকিকী দুখের দুখী আপনি…হে মহাত্মন, হে ভেদজ্ঞানহীন, এখন যদিস্যাৎ অভেদজ্ঞান বিচারে সেই বালকটিরে নজর করিয়া থাকেন, আপনি লোকহিতকামী সৰ্ব্বজ্ঞ বলুন সেই অল্পবয়সী, যে বালকত্বে অপরিসীম, সে কোথায়?

.

ঐ মহাপুরুষের ধুনি গন্ধে সুঘরাই নাসিকা আবার কুঞ্চিত করিতেই সে শুনিতে পাইল তালপাতা পথের কাঁকরে ঘর্ষণে ভারী বিশ্রী আওয়াজ উঠে…পরক্ষণেই প্রতীয়মান যে ঐ তালপাতার উপরে একটি মৃত কুকুর বাঁধিয়া রাখা; এক অদ্ভুতদর্শন লোক, অনেকাংশে তাহার ভগ্নীপতির মতন দেখিতে, এক দীর্ঘ তালপাতার ডাঁটা ধরিয়া টানিতে থাকিয়া মন্থরে আসিতেছে, লোকটি চমৎকার কণ্ঠে গান গাহে এবং কোঁচড় হইতে মাঝে মাঝে যেন কি খাইতেছিল। পথচারিগণ মৃতের পচা দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিয়াছে, থুথু ফেলিতে ফেলিতে চলে।

ঐ বিষমত্বে অন্যপক্ষে সুঘরাই যেন জমিয়া উঠিল, ইহা তাহার নিকট অন্ন, ইহা জল! সে মুষ্টিবদ্ধ করিল, তাহার ক্রন্দনের কোনই কারণ নাই, সে নিবিষ্টচিত্তে ইহা লক্ষ্য করিল যে অনতিদূরে এক গাড়ঢ়ায়ে সেই মৃত কুকুরটিকে ফেলা হইল। তখনই সে যেমন বা নিজের সূত্র পাইল, তখনই দ্রুত পদসঞ্চালনে সে সেখানে–যেখানে আর কিছুকাল পরেই শকুন আসিবে; ধৰ্ম্মত সে আপনার অহঙ্কার ফিরিয়া পাইল, তাহার অজ্ঞানতা! পুনরায় লাভ করিল, পচাগলা পূতিগন্ধময় যাহা কিছু তাহার সহিত তাহার কি অবিচ্ছেদ্য যোগ! সে সুখী, সে হারাইবার নহে।

যেখানে, চাতালেই, কোন অতীব নিষ্ঠাবান আচারী ব্রাহ্মণ, সূৰ্য্যকে যিনি একাগ্র মনেতে জল-অর্ঘ্য দেন, ইহারই নিকট, ঐ কৰ্ম্মানুষ্ঠানশেষে ঐ সুঘরাই কল্পিত রীতিতে মনিব মহাশয় অবতারণা করিলেন–এক ছেলেমানুষ চপলমতি আপনকার অধরের প্রহেলিকাময়ী কম্পন হেরিয়া ও যুগপৎ সূৰ্য্য তথা নভোস্থল প্রতি নেত্রপাতে কিছু এক সমাধান উদ্দেশ্যে এতই অচেতন থাকে, যে তাই অসাবধানবশতই, আপনারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে; তৎকালে আপনি, হে মহানুভব, তাহার দিকে ঈষৎ তাকাইয়া ঝটিতিই আবার কৰ্ম্মানুষ্ঠানে ব্যর্থ হন; অন্যপক্ষে সেই বালক কৃশ হওয়ত, রুগ্নবদনে, কিছু এক বোধ তাহার এই বিচ্ছিন্নতায় নিতান্ত দরকার কেন না আপন অন্তঃস্থিত অন্ধকারকে সে ভয় পাইতেছিল এবং তাই অন্য বোধ অভাবে কিছু সময় নিজ দুষমনী বোধে নিশ্চল ছিল–কেন না যে সে হয় জাতিতে ডোম।

তবু সে এইটুকুন তাহার সপক্ষে বলিতে নিশ্চয়ই একশা, যে তাহার দিকের খবর নাই, এমনও যে, এখন দিনমান কিম্বা নহে ইহা, অথবা কোনটি তাহার বাম হাত তাহা, সারা কিছুই উহার জ্ঞানকাণ্ডবহির্ভূত অধুনা; যেহেতু সে আমাদিগকে আকুল হইয়া খুঁজিতে আছে; বেচারী দৈবদুর্বিপাকবশত আমাদের কাছ-ছাড়া, আমাদের সান্নিধ্য হইতে বিচ্ছিন্ন। সুঘরাই তাহার নাম, বেচারী হারাইয়াছে–হ্যাঁয় যে ষড়ৈশ্চৰ্য্যশালিনী নগরীতে মানুষ আপনারে ফিরিয়া পায় সেইক্ষেত্রে সে হারাইয়াছে, এখন যদি…।

এই অবধি ভাবিতেই সুঘরাইএর চোখে মোহিলির বহু পুরাতন শতচ্ছিন্ন জুতার ন্যায় মুখোনি প্রতিভাত হয়; এখন মোহিলি হয় একজন গো শকট চালক। যেটিতে সে এবং মনিবদ্বয় আরোহী ছিল, মুখ্যত ইদানীন্তন বিপর্য্যয় ও দুর্গতি মোহিলির নিমিত্তই।

যে যাহা এই যে, গরুর গাড়ী রিখিয়া হইতে বেশ আসিয়া উত্তরিল বিলাসীর চৌরাহাতে–যে স্থলে পুবে দুমকার রাস্তা, পশ্চিমে জসিডি বরাবর; যেখানে তাহারা সকলেই–যখন, হর হর মহাদেব, জয় বাবা বৈদ্যনাথ ধ্বনি দিতে যাইবে, তৎসহ গললগ্নীকৃতবাস মনিবপত্নী সন্নিহিত বেলবৃক্ষের পত্রোদগম শোভা দর্শনে ‘আহা বলিবেন, যথার্থ লকারী ধ্বনি সেইখানেতেই; অতর্কিতে কূৰ্ম্মপৃষ্ঠ জমির শীর্ষভাগে, দেখা গেল কে একজনা ভূমি ছাড়িয়া অনেকটা লাফ বারম্বার দিয়া উঠে; লম্ফকারী সেইজন আপন বক্ষঃদেশে ঘন ঘন চাপড় মারিতে একটি হস্ত দ্বারা আঘাতিছে, এবং সে বেদনায় চীৎকার পাড়ে, কান্না যেমন, কিন্তু চোখে জল নাই; আর ‘ওহহ সুঁই’ কম্পিত কণ্ঠে বলিয়া উঠে।

এতাদৃশ সংঘটনে ভোরের মনোলোভা সমীরণ স্তোভ ছিল; এতাদৃশ নাটকীয়তায় শহরগামিনী সারিবদ্ধ সাঁওতাল রমণীকুলের গতি ব্যাহত হইল, ঐ লোকটির কিম্ভুত ব্যবহারে দারুণ আকৃষ্ট যে উহারা, উহাদিগের সুমহান মুখমণ্ডলে অবিশ্বাস্য ত্ৰাসজনিত কাতরতা আছে, উহারা আতঙ্কে তাই, যে তদানীন্তন কালেও তাহাদের কবরীস্থ ফুলসকলে আপন আপন অঙ্গুলির মঞ্জুল সোহাগ দিতে থাকে।

যন্ত্রণায়ে উৎক্ষিপ্ত লোকটির ছায়া আরবী হরফকার কাটিতেছিল, তজ্জন্য প্রায়শ ভগ্নস্বরে তদীয় সুতীব্র নিনাদউও হো পুঁই!

কথাটি আরও বিভীষিকা হয়। পুঁই শব্দ শ্রবণেই মোহিলি অব্যর্থই যে উৎপাটিত, গরুর দড়ি ছাড়িয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদানিল; সৰ্ব্বনাশী আতঙ্কে উহার শিয়রে-বাঁধা গামছা খসিয়াছে, তথৈবচ অভিব্যক্তিতেই সে কহিল,–গে মাইরে হা মো কপহাড়! এবম্প্রকারে মহা আর্তনাদ করিল; এখন উহার খুদে চক্ষুদ্বয় হাঁইয়া হ্যাঁদা হইয়াছে, বুঝাইল, সে আর আগাইবে না।

সুঁই সুঁই রব চারিদিকে; ইহাতে সকালের আকাশে খরা, পথগুলি হইতে পরিপ্রেক্ষিত মুছিয়া গিয়া কোথাও নীলিমার ভাবান্তরে করবী ক্কচিৎ; সুঁই-এর ভয় মড়ক-অধিক, এ কারণ যে, তাহারা যে যারপরনাই কাঙাল; পুঁই এক ভয়ঙ্কর রক্তচোষা, যে যাহার ব্যথায় দিন কয়েক নির্ঘাত অপটু তাহারা হইবেক। ইহারা শহরের কৰ্ম্ম অন্বেষী; বেচারীরা প্রত্যেকেই ‘হা হতোস্মি!’ বিলাপে, ঐ শহরের প্রতি বড় গুঢ়তম বুক ভাঙা নয়নে চাহিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে এখনই।

জনৈক ঐ উজ্জ্বল শহরের প্রতি তাকাইয়া, যে যেমন লোকপ্রসিদ্ধ বিরাট সনাতন দেউল তাহাতে সম্যক বিম্বিত-সুতরাং, সে আপন হৃদয়াবেগ জ্ঞাপন করিল, পাপ! আমাদিগেরই পাপ, বাবা বৈদ্যনাথ দেবাদিদেব, কিন্তু কে সেই জন যে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল যাহাতে বহু কোল নিঙড়াইবে, বহু ছন্নছাড়া হইবে; হায় কে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল–সে কত বড় পামর! যে, সে যদি শহরবাসী হয়। তাহাকে ধিক্‌, সে যদি বাহিরের মফঃস্বলের তাহাকে শত ধিক; তুমি বাবা বৈদ্যনাথ থাকিতে এত পাপ! জানি শত কুঠার আঘাতেও সুমহৎ বৃক্ষ যেমন ছেদনকারীকে ছায়া দিতে নিস্তেজ নহে, তদ্রূপ তুমি…কিন্তু আর ক্ষমা নহে তুমি জাগ্রত, তুমি ইহাদের তোমার ত্রিশূল দ্বারা খণ্ডিত কর, সেই বিশ্বাসঘাতকের সমুচিত শাস্তি বিধান কর। আমরা শালা জাতে অধম ছোটলোক, আমরা আলেখ কীড়া, অনেক জন্মাই অনেক মরি, আমরা রোগের ঘর…কিন্তু অদ্য, সূৰ্য্য সাক্ষী, আমরা কোন রোগ বহন করি আনি নাই। আমরা দীন, আমরা অভুক্ত, শহরের যাহা অসৎ তাহা দূরে লই, আমরাই অসৎ…এ সময় ধান পাকিবে, বহু অচেনা পাখী আসিতেছে, কুয়ার জল যেক্ষণে স্বচ্ছ, এ সময় পুঁই! ভীতি আমাদের সম্বল, আমরা ভীত, আমরা কাঁদিয়া থাকি।

সুঘরাই উক্তিসকল যেমত দেখিল; আর মোহিলি এখন, মনিবদের পীড়াপীড়িতে, উপরন্তু ইত্যাকার আশ্বাসে যে–ইহা সুনিশ্চিত শ্মশানের অপর পার্শ্বে দুধ-কাড়া ভণ্ড সাধুর ডেরা, যে প্রতি গোয়ালার নিকট হইতে আদায় করে, আস্তানার কাছেই সুঁই-এর ডেরা পড়িয়াছে, ফলে এক রশি মতন রাস্তা মোহিলি অগ্রসর হয়; পথ নিঝুম, গাড়ী রুখিয়া মোহিলি নামিল; শনৈঃ অত্যধিক সন্তর্পণে, পদক্ষেপে, শ্মশানাভিমুখে সে চলিতে থাকে; এবার সে অনেক নিসিন্দাও আতা গাছের আবডালে, তদৃষ্টে সুঘরাই মেরুদণ্ড টান করিল।

অনন্তর কিছু সময় বাদে নিদারুণ বিকারগ্রস্ত মর্মন্তুদ নখিলা রোল শ্রুত হইল, যে যাহা ক্রমে পশ্চিমের নাবাল ক্ষেতে সরিয়া অল্প রেশ সম্প্রতি, কেহ সেখানেতে ছুটিয়া আছে, সে আপাতত থামিল, দেখা গেল সে হয় মোহিলি, যে এবং গরুর গাড়ীর দিকে মুখ করত জানাইল সে-শহরে যাইবে না, সুঁইওয়ালারা শ্মশানের এই দিকে, তাই ডরে আমি রাস্তা ত্যজিয়া ক্ষেতে, যে আমি মাটির যাতনা বটে, বড় কাঙাল বটে, আমি পলাইব, পলাইব হে!

.

মোহিলি না-বাগমানিতে মাথা দুলাইল, পরে মনিবদের যথোচিত ভদ্র সুসঙ্গত অভয়বাক্যে মোহিলি সতর্ক চলনে ক্ষেত হইতে এখানে সন্নিহিত হইল, তাজ্জব যে, আপন চুটা ধরাইতে মনিব মহাশয়ের কাছে দেশলাই মাগিল; পরক্ষণেই ভূতচালিতের রকমে সে বাঁচাল, আরম্ভিল–হে রে শাললোঁ হরিজনরা, যে বেটা দুষমনরা চিনি যে কি তাহা জানে না, যে শয়তানরা হাঁটুর নিম্নে কাপড় পরিতে ভয় পায়, যে হাজতীরা (হাজতে থাকে) বাপকে শালা, আপন পুত্রকে খচ্চড়, দিবানিশি সম্বোধন করে, যাহারা মহিষের মাংস খায়, যারা ভাগাড়চারী শকুনের সহিত দাঙ্গা করে, মরা পশু খায়, হা মরি তাহারা লইবে মন্দিরের দখল! ঐ শালো হরিজনদের জন্যই এই সুঁই।

হে বাবা বৈদ্যনাথ তুমি যদি সত্য, তাহা হইলে সুঁই-এর পরও তাহাদের কলেরা হউক, যে চিঠি তাহারা করিয়াছে তাহারও কলেরা হউক, সবংশে তাহারা নিধন হউক; এখন শালা চরকাবাজরা সুইবাচক। যাহাদের পাপে মেঘ অবধি বাঁজা হয়–ডোম চামার মেথর হাড়ি পাশি, যত শালা মাতাল ডুমনীখোর বদমায়েস, আংলিস খচ্চড়, গরুচোর ধানচোর, ও হো হো আমি জাত ভাঁড়াইলেও আমার সুরত দেখিয়া চিনিবে যে, ওহো সুঁই গে মাই, আমার আগে আমার ছায়া পর্যন্ত যাইতে–যাহার নামেই ডরে, দেখুন হে আমার ছায়া বটে কীদৃশী ভয় পাইয়াছে, দেখুন উহা আমার পিছে মুখ লুকায়। অহো বাবা বৈদ্যনাথ দেখ, আমার তরাস এখন আছে, তুমি ধন্য।

তথাপি যে মনিবরা অজস্র সাধ্যসাধনা করিলেন, হায় কোনই ফলোদয় ঘটিল না; সুঘরাইএর দেহে সিঞ্চি উপস্থিত, বধির কেরেট সাপ যেমন তাহার আশেপাশে, স্বীয় গ্রামের লোকের এরূপ ভীতি দর্শনে সে নিজেই দুর্বোধ্য হইয়াছিল; ইদানীং সে চামার মোহিলির মুখমণ্ডল পাঠে সম্যক উহারে বুঝিয়া লইতে ব্যগ্র থাকে; এই সেই চামার মোহিলি যাহার বাড়ীতে বিলাতী আমড়া গাছ আছে, যে হয় খুবই ঢ্যাঙ্গা, যে খুবই রোগা, যে হয় হাড়সার, সব তেমন তেমন আছে বটেই, তবে যে কি যেন উহাতে ছিল না।

যে তাহা ইহা, যথা যে–সেই যে চামার মোহিলি, যাহার বশে কত প্রেতাত্মা, যাহাকে কতবারই না দুর্বোধ্য ছড়া কাটিতে সঙ্গেই কুশ-পেয়ের ন্যায় পা করিয়া ইব্রাহিম মিঞার ভুটে ঘোড়ার মূত্র ঝিনুকে সংগ্রহ করিতে দেখিয়াছে; যাহাকে দেখিয়াছে ঐ মূত্রপূর্ণ ঝিনুক হাতে তদ্রূপ ছড়া উচ্চারণে, যে সদ্যজাতক-কে ইলড়া ভূতে পাইয়াছে অথবা যাহাতে না পায়, তাই উহা খাওয়াইতে গিয়াছে–ইহা তাহাদেরই মারণ ঐ জাতীয় ভূতের! যাহারা নবজাতককে বিকলাঙ্গ করে, দুমড়াইতে থাকে।

ঐ ঝিনুকসহ তাদৃশ কায়দায় মোহিলির মন্থর গমন, কি পর্য্যন্ত ভাব গম্ভীর, যে সে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ কিছুতেই করে না, উহার পিছনে তখন গাছে পায়ে ভীষণ ভূতুড়ে দৌরাত্ম্যর শব্দ ও কাণ্ড ঘটিতেছে; কি আশ্চর্য্য রহস্য সে! আর এই সুঁই ব্যাপারে নিজেই শঙ্কিত, বেপথু শরীর উহার! ইহাই কি সেই মোহিলি যে যাহার ঘুনসীতে সকলের শুভাশুভ বাঁধা নিশ্চিন্দি, যে যাহার চৰ্ম্মে জনাজাতের ঘুম লাগিয়া থাকে। রাত্র যাহার দাসানুদাস।

মোহিলির বহমানতা লুপ্ত হইতেই, এতক্ষণকার, সেই রিখিয়া হইতে যাত্রা প্রীতিময়, যাহা উদ্দীপনায় নিশ্চিহ্ন বিশেষত এই কারণে যে একদা মোহিলি জানাইয়াছিল, যে এক একজন সন্ন্যাসী মহাপুরুষ আছেন যাঁহারা তত্ত্বদর্শী, যে রহস্য তুমি শুনিয়াছ তাহার সবিশেষ তাৎপৰ্য্য জিজ্ঞাসুকে তাঁহারা বলিতে পারেন, বৈদ্যনাথে যখন যাইব তখন আমরা, তুমি আর আমি, তেমন তেমন মহাপুরুষ দেখিলে তাঁহার নিকট নিবেদন করিব, ইহাতে আমরা জন্মান্তরে উঁচু ঘরে জন্মাইব। আমরা নিশ্চয়ই জন্মাইব…।

ইহাতে কি যেন ভাবিয়া সুঘরাই কহিল,–যদি উহা শুনিয়া অচৈতন্য হয়!

মোহিলি উত্তর করিল–জানি তাঁহারা অজ্ঞান হইবার নহে।

যদিও মোহিলি এই কথার মধ্যে মধ্যে কাশিতেছিল তবুও সে আবছায়া সুঘরাইএর চোখে এবং ঐরূপ প্রস্তাবে তাহার, সুঘরাইএর দেহ নিয়মরহিত: এবং সুঘরাই অন্যত্রে, তখন সে প্রত্যক্ষ করিল, অদূরস্থিত সৌখীন টেবিল ল্যাম্পের আলো আশ্চৰ্য্য অহেতুক হঠাৎ বর্ধিত হইল। ইহাতে তাহার কণ্ঠস্বর ব্যাহত নয় যাহা একটানা ভিখারীবৎ ছিল; দ্বারদেশে থাকিয়া সে ঐ রহস্য কথা বলিতেছিল আর যে তাহার পশ্চাতে দরজায় উৎকৃষ্ট চিৎসের ফুলকারী পর্দা উড়িতে থাকে এবং বাহিরের সাঁওতাল পরগণার বিচিত্র অন্ধকার অনুভব হয়।

চিপ এণ্ড ডেল রীতিবিশিষ্ট ছোট লেখার টেবিলের সামনে মনিবপত্নী, যিনি এখন পুত্র ও কন্যাকে চিঠি লেখেন, হালকা ফলসা রঙের চিঠির কাগজের পাশেই তাঁহার বাঁ হাতখানি আড় করিয়া রাখা যেন কোন প্রসিদ্ধ আর্টিস্টের কাজের খানিক, কিন্তু অঙ্গুরীয়র চুনীর উজ্জ্বলতায় ঐ ভাবনা আর থাকে না, মনে হয় ইতিহাস একদা ভয় পাইয়াছিল; ডান হাতের কলমটির প্রান্ত তাঁহার সুমহৎ অধরে ছোঁয়ান; সামনে চমৎকার গিল্টকরা ফ্রেমে, নাবিক পোষাক পরিহিত কিশোর বালকের ছবি ও ইহারই পাশেই, একই ফ্রেমে, বালিকা কন্যা মেষপালিকার বেশে–এই কল্পনাকে তাহার জীবনপণ নৈতিকতায় বাঁচাইবে–আর তাহারা ঝরণা দেখিতে ছুটিয়াছে!

যেহেতু ইহাদের ঐ পুত্র কন্যাকে সুঘরাইএর পক্ষীবৃত্তান্ত জানাইবার জন্য মনিবপত্নী উন্মুখ ছিলেন। সুঘরাই বর্ণিত আছে, স্বরে তাহার জড়তা নাই, কিন্তু ছোট দেহখানি তাহার অস্বচ্ছন্দ, সে কহিল– মোহিলি অদ্ভুত গলায় বলিল, এখন তোমার পাখীতে যে রহস্য গোড়া বাঁধিতেছে সাবধান!–এবং তাহার জবানীর মধ্যেই টেবিলস্থ আলো কেমন করিয়া উঠিল।

মনিবপত্নী এই কথা শোনামাত্র চেয়ার ছাড়িয়া দণ্ডায়মানা, তাঁহার দেহ কোন প্রহেলিকা প্রভাবিত মৃদু টলিতেছিল, ফুলদানীর গোলাপগুলি, যেগুলি অনেক অনেকদিনই ভাবানুষঙ্গর সূত্র, তাহাদেরকে তিনি তদীয় সুষমামণ্ডিত বাম হস্তে আঁকড়াইতে চাহিলেন এবং শুধুমাত্র বলিয়া উঠিলেন, শুনছ শুনছ শিগগীর!

ইহাতে তখনই পাশের কক্ষে একটি কাঁচের গেলাসের আঘাতের আওয়াজ হইল; পরক্ষণেই মনিব। মহাশয় আসিলেন, আজ্ঞা করিলেন সুঘরাইকে, তুই যা। ইহা বলিয়া তদীয় সহধর্মিণীকে ধরিতেই যিনি অচৈতন্য হইলেন, সাবধানে চেয়ারে তাঁহারে বসাইয়াই তিনি স্মেলিং সল্টের শিশিটি আয়না দেরাজ হইতে তুলিয়াছিলেন; এবং অতঃপর ও-ডি-কোলনের এটমাইজারটি লইয়া কহিলেন, না না উঠিও না, মাথায় কাপড় দিবার কোন দরকার নাই…আবার সযত্নে তাহাকে বসাইয়া দিয়াছিলেন; পর্দায় ছায়া পড়িয়াছিল।

এবার এটমাইজারের শব্দ সহিত মাধব নাম উচ্চারণ করিতেছিলেন, কিছু বাদে মনিব মহাশয়ের ধীর আক্ষেপ শ্রুত হইল,…আমি ঐ ঘর হইতে সবই শুনিতেছিলাম, বুঝিয়া পাই না মধু ও রিলিকে এ খবর দিবার কি…অবশ্য সামান্য পাখীর পিছনে এ কথা থাকিবে তা তুমি বা কি করিয়া জানিবে…..মাধব তারা ব্রহ্মময়ী!

তন্দ্রাচ্ছন্ন মনিবপত্নী কহিলেন–আমি ভেবেছিলুম ছোঁড়া জঙ্গলের গল্পই বলে থামবে’খন! অতঃপর বলিয়াছিলেন, আ মোহিনী মায়া!

ক্রমে যে, পাখীর ব্যাপার সুঘরাইএর শুধুমাত্র অন্যমনা হওয়ার কারণ হইয়াছিল, সে এক কালো-র দিকে চাহিত, এক অচৈতন্যতার দিকে চাহিত; বৈদ্যনাথধামে আসিবার সুযোগে মন্দির দেখা ও বিবিধ অনুষ্ঠান প্রতি আগ্রহ ছাড়াও ইহা–এই মনোভার হাতে প্রচ্ছন্ন ছিল।

তাহা এই যে বহু পুরাতন সাধনলব্ধ আধ্যাত্মিকতাকে জড় তত্ত্বের উপর–যদিও যাহা এখনও বিস্ময়ের এবং আপাতত তাহা ভীতির–তাহার উপরই আবোরাপ করিতে পারিবে; যেমন শিল্প ধৰ্ম সরলতা প্রকৃতিতে আরোপিত হয়।

ভক্তিপ্লুত ভগবদারাধনায়ে তীর্থযাত্রার মধ্যে অনতিদূরস্থ ঐ বৈরাগ্যজননী অমৃতবর্ষী শহরবিষয়ক যে ধারণা তাহাতে, সুঘরাইতে, উথলিত ছিল, উহাই অধুনা অসহ্য ফোটকে পরিণত হইল; এখন যে মনিবরা নাই, আসমুদ্রহিমাচলখ্যাত মন্দিরের শীর্ষ দেখার মানসিকতা অবলম্বনহীন অব্যক্ত গোঙানি হইয়াছে; যে এবং সম্মুখের গোটা শহরই রিখিয়ার যে-সিজিনের বাড়ীর তুল্য ফাঁকা, যেখানে তাহার কণ্ঠস্বরের হরেক প্রতিধ্বনি হয়, এখানেও তেমনই হইতেও পারে।

অন্যদিকে মোহিলি ধাবনৌৎসুক্যে দড়বড়ি গরুগুলি ঘুরাইতেছিল এখন, তৎকালে সুঘরাই উহারে, মহাজন এরূপ, তাহার নাড়ী অর্থ, নির্ঞ্ঝাট আশ্রয় যথা, আত্মিক পারিবারিক কেহ ঈদৃশী সমঝে আছে; অথচ যুগপৎ সে নিজে এমত কোন প্রদেশে, যেখানে মৃত্তিকার জঠর নাই, বুদ্বুদের অন্তঃস্থল দিয়া কোন আহ্বান ভেদ করিতে অকেজো, সে বড়ই একা, ল্যাংট, তাহার ভয়ও তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে।

এবং মনিব বলিতেছিলেন–আজব বুনো, জংলী!

মোহিলি যাইতেছে; সুতরাং উপায়রহিত সুঘরাই এই বিচ্ছেদকালীন মুহূর্তে, চামার মোহিলির অবয়ব যেন খানিক রহস্য কুহক চরিত্র তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টি-দ্বারা সাহস টানিয়া লইতে বদ্ধপরিকর হইল, কিন্তু হা হন্ত মোহিলির যাবতীয় গোপনতা যে ধর্ষিত হইয়াছিল। অথচ মোহিলিকে এখন কি খাসা দেখিতে, ভয় তাহাকে সুন্দর করিয়াছে–আর সে তাহা প্রত্যক্ষে অবাক!

মনিব মহাশয় কহিলেন-তীর্থে আসিয়াছি তাই কিছু বলিতে চাহি না, নিশ্চয়ই বৈদ্যনাথের ইহা অভিপ্রেত! ও আপন পত্নীকে বলিলেন, তখনই বলিয়াছিলাম সহিসের জ্বর ছাড়ুক তখন না হয় বৈদ্যনাথে আসিব।

ইদানীং সুঘরাই, কাষ্ঠচ্যুত কূৰ্ম্মবৎ অবস্থায়ে যে সে, ইহা অনুমান তাহার হয়; তবু সে ভাবে ইতঃমধ্যে অবশ্য, যে মোহিলি, আপনার চমকপ্রদ ভীতি যাহার কণামাত্র খোয়া যায়, তাহা লইয়া ক্রমাগত আপনার রহস্যের অভিমুখে সেই গানখানি গাহিতে থাকিয়া হাল্লাঝুরি পার, মাঝে মধ্যে গরু জোড়া হাঁকানোর শব্দও হয়:

পিয়া যব যাওরে রিখিয়াকে হাটিয়া
কুছ কিন্‌ইহ নুন তামাকুল
কুছ কিন্‌ইহ ধন্‌ইয়া—বল্‌
হা পিয়া হা পিয়া হামরা খাতির মুখ মুছানির গামছা কিনি লিয়া
পিয়া পিয়া যব যাওবে…।

আঃ কি খাসা গীত, কাঁড়ার (মহিষের) গললগ্ন ঘণ্টির ধ্বনি, এ-গেননুয়ারে ডাক, শেষরাতের মোরগের ভাঙা স্বর, ছায়ার পরিবর্তন, শীতের কুয়ার জলের উষ্ণতা, সর্পের গতি সবই ঐ পদবন্ধের ভাবেতে আছে; এমনও কি ঐ গীত-জাত উদ্দীপনার মধ্যে-নোসটালজিতে; সান্ধ্যভ্রমণের চেঞ্জাররা, কমেডির ভুল উদঘাটনে–জানার হেতুতে যাহারা নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে এবং যাহাদের কর্তব্য আপনি স্থিরীকৃত, সুখে ভ্রমণ করে; স্থানীয় খুন খারাবী হওয়াতে তাহারা বীর।

ইহারাই, চেঞ্জার তাহারা, যাহারা আধো চন্দ্রালোকে নিঃসঙ্কোচে এক ইউক্যালিপটস গাছের নিম্নে সমবেত হইয়া দাঁড়াইয়া পাতার আওয়াজ শুনিয়াছে, সকলেই চুপ ছিল, একাগ্র থাকে; কেহ নিষ্ঠ হইতে কারণে চশমা মুছিয়াছিল; অল্পবয়সী ও শিশুতে চপলতা নাই; পাতার আওয়াজ হয়!—ধিক্‌ তাহাদেরকে যাহারা ইউক্যালিপটসের উপকারিতা বিনাইয়া থাকে! তাহারা অধৰ্ম্ম করে–এইরূপে চেঞ্জারদের অনেক সময় গিয়াছে।

একদা কেহ ঘড়ির রেডিয়ামের স্পষ্টতা লক্ষ্য করত কহিলেন,কবি বলিয়াছিলেন, প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও। ইহা হাস্য উদ্রেক করে নাই কারণ ইহা ব্যক্ত করিতে কুহক স্বরভঙ্গ ঘটিয়াছিল–যাহা মিনতি ও কাতরতা মিশ্রিত, ইহাতে সকলেই বহু ঊর্ধ্বে ইউক্যালিপটসের হাল্কা পাতাগুলির দিকে– এইগুলি গাছটির স্বদেশ, ঐদিকে চাহিয়া অনুভব করিলেন যে তাঁহারা সকলেই ক্লান্ত; ইহা কলিকাতার ক্লান্তি; অথচ ইহা ঠিক যে তাঁহারা এখন বৈদিক আত্মসমালোচনার বাহিরে, অতএব এই তত্ত্ব নিশ্চয়ই বিচারিত হয় না, যে অনাসক্তের বীজ লইয়া তাহারা কেবল দৌড়াইয়াছে। (দৌড়াইয়াছে শব্দটি কত কত মাটির, অথচ এ ক্ষেত্রে? আঃ মানুষের নশ্বরতা!)

ইহারাই কি-সেই যাহারা শূন্য-কে ছিল বলিয়াছে!…

পুনরায় শ্রুত হইল প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও! ইহাতে, এই বাক্যগঠনে চোরা রাজসিকতা আছে, দর্প রহিয়াছে, যে প্রকৃতির বাড়ী যেন আদিবক্তার নখদর্পণে! এবং এখন তাহারাও ঐ সকলেরা, আত্মম্ভরিতায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাদের প্রশ্বাসে পত্ররাজি শুষ্ক হয়।

তাহারা চরিত্রকে ছাড়াইতে পারে নাই, মানুষ কি আলেখ নেশা! ঐ গীতে এই সকল কিছু–যেই কেন উহা ঐ গীত হউক, যে চাঁদ অস্থির হইবেক; ঐ গীতের দিকেই সে বেচারী সুঘরাই আছে, তাহার পোষ মানা ভয় আছে, তাহার ঘর যে এবং, এখন এই ভাবনা প্রভাবিত হইয়া সে সুঘরাই অধিক হতাশায়ে সজল নেত্রে উত্তরের আকাশের ঠিক লইল, যে কেমনে সে যে বাড়ী ফিরিবে; এখানকার এই শহরের সমস্ত বস্তুই, ও যাহা যাহা কল্পনাসাপেক্ষ, শ্বাসরুদ্ধকারী বিরাট অহরহ, ভিখারী কুষ্ঠরোগীর ক্ষতে ক্ষিপ্ত কুকুরের মাড়ি দেখা যায়, প্রতি কিছুই করাল উত্তঙ্গ প্রাচীর; রিখিয়া চার ঘুমের পথ, হাটবারে ছাড়া চিঠি বিলি-না-হওয়ার দূরত্ব বৰ্ত্তাইয়াছে; সুঘরাই মাটির উপর চলিতে চাহিতেছিল, যে মাটিতে জেংগীল পাখী বসে, ডাকে; পায়ের তলায়ে সে চাহিয়াছিল মাটি, শহরে যাহা মাথার উপর; এ। শহরে মাথা ঠুকিয়া কান্দিবার সুযোগ নাই; হাস্য অনুমোদিত অথচ।

হঠাৎ এই বৈলক্ষণ্যের সময়েতে তাহার কানে গেল, কোন শুদ্ধাচারী বলিতেছে, যত শালার ঘোট জাতের মরণ, ছুঁইও না ছুঁইও না! তৎক্ষণাৎই সরিয়া দাঁড়াইবার মতন জন্মগত সৎ স্বাভাবিকতা তাহাতে কাজ করে নাই; যে যাহা, যদি সে বৃক্ষশীর্ষে থাকাকালীন অমন তাড়না শুনে, তবে ঝটিতিই সে মান্য করিতে উদ্যত হইতই; কিন্তু এখানে তাজ্জব এই, অচিরাৎ বেশ তিলেক পরেই, উক্ত তাড়না নিমিত্ত, দেখা গেল যে সে কান নাক মলিতেছে আর ছুটে। সে জানিতে চাহে না ঐ তাড়না কাহার উদ্দেশে, অবশেষে এবং যে সে বেসামাল, এবং সে পতিত। তদবস্থ সে পশ্চাতের পানে ত্রাসযুক্তলোচনে ও তৎক্ষণাৎ খুসীতে বারবারই নজর লইয়া থাকে।

আসলে, অপ্রাকৃতিক ভয় যে কি কারণে, খুসী যে কি জন্য, তদ্বিষয়ে ভ্রু কুঞ্চন এমনও যে ঘটে নাই, যেহেতু অদ্ভুত ঘোরে, রন্ধ্রগত সে ছিল, তাই যে সে খালি প্রতি পদক্ষেপেই বলিতেছিল—শাঁলো হারামজাদা চামার মোহিলি মানুষের জুতা হইতেও জাতিতে নীচু, তোমার জন্যই অদ্য আমার এই দুর্দৈব! ক্রমে এইরূপে সে নিজেরেও হতভাগ্য নরকের কীট কহে, নিজেকে অভিসম্পাতে নিপীড়নে। অবিরাম হেয় করিয়াছে। সে এইভাবে কোথাও দাঁড়াইতে চাহিতেছিল কেন না অনবরত সুঘরাই এর মনে হয় সে যেন বা মিলাইয়া যাইতেছে।

নিশ্চয়ই মোহিলির খবর বিভীষিকা হইয়া তাহারে আঁচড়াইতেছিল। যাহা যে শেষরাতে যখন বৃক্ষাদিও ঘুমায় তখন শিব নন্দীভৃঙ্গীসহ শিবগঙ্গায় স্নানে আসেন, যদিস্যাৎ কেহ তাহা দেখে সে। কামারের চুল্লীর স্ফুলিঙ্গের মত নস্যাৎ হয়। ইহা মোহিলি দারুণ অঙ্গভঙ্গীকরত ব্যাখ্যা করে, ফলে সুঘরাই দেখে সমস্ত প্রকৃতি পর্যন্ত ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, শুধু সে জাগিয়া আছে।

উপস্থিত-মোহিলিসুত্রে তাহার সমক্ষে অনেক কিছু আভাসিত হইল, যাহা যথা–মোহিলি গাড়ীর মুখ ফিরাইতে তখন হন্তদন্ত, আর যে সুঘরাই দণ্ডায়মান মনিবের জুতা জোড়া বুকে ধারণ করিয়া আছে–কেন না দেবদর্শন যাত্রায়, তীর্থে, উহা নিষিদ্ধ–এখন অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চিত বিধায় অসাবধানে একটি জুতা মাটিতে, অবশ্য সে তখনই তাহা কুড়াইয়াছে, কিন্তু এই কৰ্ত্তব্যবোধের মধ্যেও সে বিচাল্যমান ঈষৎ হইয়াছে; যে মোহিলির প্রত্যাখ্যানের নির্দিষ্ট মুহূৰ্ত্ত হইতে আপনারে মারাত্মক নিঃসঙ্গ বলি তাহার বোধ হয়; যদ্যপি সে হয় ডোেম, তৎসত্ত্বেও মোহিলি অনন্য থৈ আছিল।

এমত ঠিক যে সে নিঃসঙ্কোচে অনায়াসে মোহিলির হাত ধরিতে পারিত কোন কিছু ঔৎসুক্যে, কোন কৌতুকাবহতে, বিশেষত কিছুর নাম মাত্র আতঙ্কে, যাহা সে আর পারিবে না; সুঘরাই ইহা লইয়া পৰ্য্যালোচনা হয়ত নির্ঘাত করিয়া থাকে, যে এই শহরে কাহারই বা সে হাত ধরিবেক, মনিব মহাশয়ের শত আতঙ্কেও না, যদিও মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী অপ্রার্থিত হৃদয়বান সমস্তরূপে, সৰ্ব্বদা যত্নও করেন, তাহারে গেঞ্জী কাপড় সবই দিয়াছেন, তাহার নিমিত্ত সুঁইওয়ালাদের নগদ চার আনা পয়সা পান। খাইতে দিয়াছেন।

আশ্চৰ্য কতটুকু সময়ের মধ্যে যে সে নিখোঁজ হয়, এ কারণ যে সে জাতি ঘৃণ্য; যে অপিচ মনিব মহাশয় তাহারে যারপরনাই আড়াল করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন, কিন্তু পাণ্ডা ঠাকুর মহাশয় জিজ্ঞাসিলেন–সে নেয়া কি জাত ছিকোরে তোরা।

ইত্যাকার সুমিষ্ট ভাষণ, অতীব শীল যাহা, তাহাতে সুঘরাই তুষ্ট; পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের যথারীতি সম্বোধনে ইহা পরিষ্কার যে, তাহাকে বুনো, তাহাকে ডোম জাতীয় মনে হয় না, যেহেতু তাহার মাথায় অনেক তৈল, যে জন্মাবধি সে চিনি খায়, সে ডালিম কি জানে, বেশ সোহাগের চেহারা বটে তাহার।

তবে, এই ধরনের প্রথমকার আবেগ কাটিতেই সুঘরাই বানচাল, যেহেতু যে এবং বহুবারই সে অগ্নি পোহাইয়াছে, সুমহৎ শিখা তাই এখন তাহার সমক্ষে, তাই তদীয় স্বল্পায়তনের দেহ শতছিদ্র, স্বেদোদগমে গেঞ্জী পরিপ্লত,–এই স্বীকারে সে বাধ্য–যে সে হয় ডোম এই অপরাধ স্বীকারেই; কিন্তু, সম্ভবত ঐ সঙ্গে যেমন ইহাও যে, যাহার জন্য সে বেচারী দায়িক না, এবং যে সে বা তাহারা ও মহুয়া গাছ একই; কিন্তু তদ্ব্যতিরেকেও, তথাপি উহার সুঠাম অনার্য মুখশ্রী আরক্তিম কষায়িত ইত্যাকার মনোভাব তাহার পক্ষে অবিশ্বাসের।

এমনও যে কোন এক সত্য–অসাধনেই তাহার মস্তকে ঘোর করে, যে নানারূপ অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের, টিনকাটা চ্যরনার, বিটার ইত্যাদির পাশেই অনেক নানান আকারের চমকপ্রদ লেবেল আঁটা টিন, কোনটিতে কোনটিতে মাছের ছবি, হৃষ্টপুষ্ট শাদা শুয়ারের, কোথাও গরুর! কতবার না এইসব টিন সে মহা উৎসাহে সাজাইয়াছে, মনিবপত্নীর আজ্ঞায় কাটিয়াছে। এই ব্যাপারে এইজন্যই যে হয়ত বৈষম্য তাহাকে এতদূর ভয়ঙ্কর করে।

পাণ্ডাঠাকুর ব্রাহ্মণ স্বভাবসিদ্ধ অনুদ্বিগ্ন শান্ত, যেমত যে, আৰ্ত্ত সহিত আলাপনের স্বরক্রমে কহিলেন–তাহা হইল, তবে, কিন্তু।

ইহাতেই যে মনিব মহাশয় কিয়ৎ আত্মস্থ থাকেন, কেন না দিবালোককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করিতে তিনি চাহেন নাই; তিনি ধর্ম্মশীল, একদা আপন জায়ার প্রতি, যিনি অযুত শ্ৰীসম্পন্না ভক্তিমতী অধুনা মালাজপকারিণী যিনি পূজারিণী, তৎপ্রতি অবলোকনিয়াই উত্তম শুভবুদ্ধিচালিত উত্তর দিলেন–হে ঠাকুর মহাশয়, মকৃত ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, ইহা সত্য বটে, যে এই হতভাগ্যের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শনে অশাস্ত্রীয়, যে উহার জল চলে না, তথাপি, যদিও মাদৃশ জনের আমূল পরিচয় আপনাদের নখদর্পণে, আমি বলি, আমি গৌড়ীয় সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, বাঙলার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত প্রাচীন বংশ আমাদের, সেবাব্রত থাকা সত্ত্বে বহুজনকে অন্নদান করিয়া থাকি, (আমি প্রভূত বিত্তশালী ঠাকুরের কৃপায় হইয়াও) ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করি, মানুন, আমি ত বটেই, ও মদীয় ভাৰ্য্যা ইনি উচ্চ অভিজাত বংশসস্তৃতা, ইনি সত্ত্বগুণবিশিষ্টা বহু বহু জন্মের তপস্যা দেবারাধনাজনিত সুকৃতি নিবন্ধন ইহজন্মে মা জননীর রাঙাচরণ আশ্রয় লাভ করেন, ইনি মা জননীর শ্রীশ্রীমায়ের (শ্রীশ্রীসারদা দেবী) মন্ত্রশিষ্যা, ইনিও ঐ অধম দীনতম বেচারীকে অভাবনীয় স্নেহ করেন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাহা ছাড়া ভগবান রামকৃষ্ণ আমাদিগের সন্দেহ অজ্ঞানতা বিদূরিত করিয়াছেন যে, যথা–সব্রাহ্মণ, যার কোন কামনা নেই, সে হাড়ীর বাড়ীর সিধে নিতে পারে। আবার বলিয়াছেন যে, কৃষ্ণকিশোর অত বড় আচারী ব্রাহ্মণ কোন হীন জাতিকে তিনবার। শিব শিব বলাইয়া হৃষ্টচিত্তে উহার হাতে জলপান করেন। তাই আমাদিগের সবই জল-চল, অবশ্য। বিদেশ বলিয়া নহে, যাহা হউক সুঘরাই আমাদের সহিত চলুক, বালক কখনও শহরে আসে নাই, গাড়ীও নাই, শেষে কোথায় কি ঘটিবে, অনেক জন্মের পুণ্য অর্জনে অদ্য সে এখানে দেবস্থানে, আর যে মদীয় পত্নীর কল্যাণে ধৰ্ম্ম ধারণা উহাতে আছে জানি, উহাকে এখন বিফলমনোরথ হইতে দিবেন না; ঠাকুর মহাশয় দেখুন দেখুন উহারে দেখিতে নবীন কদলী কাণ্ডের ন্যায়, তেমনই মনোলাভা তেমনই নিষ্পাপ, সে কাহাকেও তিলমাত্র স্পর্শ করিবে না, এখন আজ্ঞা করুন।

এবং যে তদ্বিধ প্রসঙ্গ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় শুনিতে তদীয় ললাটস্থ হোমজাত রম্য শৈবতিলক দেদীপ্যমান হইল, হর হর মহাদেব বলিয়া আদেশ দিলেন–ভগবান শঙ্কর গৌরবমণ্ডিত হউন, বাবা বৈদ্যনাথের নামে ইহা হউক, বেশ, বাবার দুয়ার অবধি যাইতে পারে! ইহাতে মনিব মহাশয় উৎফুল্ল হওয়ত বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি করিলেন।

এতাদৃশ অনুমোদনে এবং জয়ধ্বনিতে সুঘরাই, আহ্লাদে তাহার মনে পড়িল, যে সে পদ্ম দেখিয়াছে, অথচ বন্য, সে গাত্রের গেঞ্জী খুলিয়া তখনই পরিতে চাহিল, পঞ্চতীর্থবারিতে সে শুদ্ধ, তাহার তৈলসিক্ত মস্তকে পূত নিৰ্মাল্য আছে; ক্রমে তাহারা সকলেই এক অভূতপূৰ্ব্ব মৰ্ম্মস্থলের নিকট, আর্ট যেখানে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করিয়াছে। যে সে এখন প্রাকৃতজনের চরম মনীষাদায়িকা শিবমন্দিরের দুয়ার সমীপস্থ আছে, যে সে ঐ পুনর্জন্মক্ষয়কারী শিবপুরীর প্রাচীরে, এই প্রথম বিবেক তাহাতে, আর যে সে বিবেকনিয়ন্ত্রিত, অনেক অনেকবার মাথা ঠুকিতেছিল; নানা মানুষের শ্লোকরাজি নানান প্রার্থনা, যথা ভগবান ইহার সুমতি দাও, ভগবান শঙ্কর অন্তিমে তোমার দর্শন পাই, তোমার শরণার্থী হে বৈদ্যনাথ।

তদীয় কানে আসে অথচ সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতে চাহিল এবং যখন আপনকার বক্ষঃদেশে এ মন্দির ছবি মুদ্রিত হউক এরূপ কামনায়ে যে সে আপন গেঞ্জী খুলিতে যাইবে, হরি হরি যে তৎক্ষণাৎই তাহার কাল হইল, দুর্ভাগ্য উপস্থিত!

ঐ সময়েতে, অশ্রুতপূৰ্ব্ব গোল ধিকিয়া দাবদাহ, ক্রমে, বিকট জিগীর গর্জিল; যে সে, সুঘরাই, গেঞ্জী তুলিয়া অস্পন্দ, তাহার মনে উপজায় যে কাছেই নিশ্চয় কোথাও লক্কড় আক্রমণ করিয়াছে; নিমেষেই এহেন অপ্রশস্ত সঙ্কীর্ণ গলিতে এক দারুণ সঙ্কটজনক অবস্থা ঘটিয়া উঠিল, অগণন নিরীহ তসর গরদ মটকা কেটে রেশম পট্টবস্ত্রশোভিতা রমণীগণ চকিত হইলেন, বাঁশুলী নয়ন কালীঘাট হইল, ইহারা সকলে সঙক্ষুব্ধ, নথ দুলিল, কর্ণভূষণ ব্যতিব্যস্ত, কঙ্কন বাজিল, গললগ্নীকৃতবাস শিথিলীকৃত, চোখে চোখে বিভ্রান্ত বিদ্যুৎ, পূজাউপচারসকল হস্তচ্যুৎ হওনে অবোদেশে মাটিতে, পাত্ৰভ্রষ্ট কর্পূর ভূমিতে জ্বলিতেছে, ধূপ যেখানে সেখানে, ফল গড়াইতেছে, দুগ্ধ পড়িয়াছে, ফুল ও মালা সমুদায় নয়ছয়, কচি বিশ্বদল ছত্রাকার, কতক কুৎসিতদর্শন পা ঐ সকল সৌন্দৰ্য্য মর্দন করিতে থাকিয়া আইসে; ইহারা হরিজন! ইহাদের প্রত্যক্ষে শুদ্ধাচারী পুরুষগণ যাঁহারা কেহ মহামহিঃস্তব, অন্য কেহ নিৰ্বাণঘটক, কেহ কৌপীনপঞ্চক, কেহ শিবস্তোত্র আবৃত্তি রুদ্ধ করিয়াছেন, কেন না অহিতকারীরা ভীমনাদে চীৎকার পাড়িতে লাগিল।

সুঘরাই যেমত হতচেতন, সে বিস্ফারিত নয়নে হেরিল, কীদৃশী ভয়ঙ্কর মদমত্ততা! এক সঙ্গে এতেক নোংরা আকৃতি সুঘরাই কদাচ দেখে নাই, প্রতিজনের মুখমণ্ডল বিশেষত কণ্ঠলগ্না মাল্যে অধিক জঘন্যদর্শন হইয়াছে, ইহারা যাহারা শাস্তির ভয় পায় অথচ কভু জিহ্বা দংশন করে না, ইহারা তাহারা ভক্তি যাহাদের বক্ষ হইতে তের নদী পার; ইহাদের বেচারীদের পরনে ঠেটি, কণ্ঠে জবা কুসুমাদি মাল্য, ইহারা বহু যুগ অভুক্ত, ইহাদের কাহারও কাগজ নাই, উহাদিগের গাত্রগন্ধ উৎকট যেন মহুয়ার খৈল পোড়া গন্ধ, উহারা অস্নাত, উহারা যাহারা সন্ধ্যায় স্থির হয় না, তাহারা মন্দিরে প্রবেশ করিতে উদ্যত, বহু শতকের ভীতিতে এখন তাহারা বিষধরজ্ঞানরহিত।

ইহারা বেচারীরা স্বার্থোদ্ধত পন্থ চালিত ধৰ্ম্মার্থে শহীদ হইবেক, ইহারা সকলেই মদ্যপ এবং যে নানাবিধ নেশা বিজড়িত, এখন ইহাদের নেশা আড়ান কণ্ঠে ইহারা যাহাদের ছন্দানুবর্ত্তী সেই দুষ্টমতি নেতৃবর্গের নাম ঝটিকা দিতেছিল, যেমন যাহা কুৎসিত অশ্লীল পদ, নামগুলির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে কি তাহা পাণিনি জানেন! এই ধুরন্ধরেরা নেতৃবর্গ আদতে নীচযোনি ফিরিঙ্গীপ্রসাদ, ইংরাজ শালাদের দাস, এই সকলের নামে আকাশে বাতাসে তড়কা লাগিতেছিল ঐ বেচারীদের প্রমত্ত রোলে, ইহারা নিম্নজাতিরা ঐ ধূৰ্ত্তদের প্ররোচনায় ভয়াল, তথাপি সত্য বটে ইহাদের কাহারও কাহারও চোখে অশ্রুধারা ছিল।

যে এবং ক্রমেই ইহাদিগের অপ্রতিরোধ্য চাপে বিপ্রকর্ষণে সকল কিছুই বিধ্বস্ত এমত, সকাল কুক্সটিকা হইল; বহু আৰ্ত্ত বহু বৃদ্ধ হা হা রব করিল, যে শিবের সহিত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করিতে যে সুলক্ষণা উমারূপিণী ষড়ৈশৰ্যময়ী সৰ্বালঙ্কারভূষিতা কন্যারে শঙ্খ মঙ্গলাচারে লাজবর্ষণে ঘন ঘন উলুধ্বনি ও গীত ও নৃত্যবাদ্য সহকারে আনয়ন করা হইতেছিল তাহাও রাবণিক পাশবিক কদৰ্য্যতায়ে লণ্ডভণ্ড, হায় অলৌকিক বিবাহ! হা লজ্জা! উহারা অলৌকিক কন্যার মস্তকোপরি কিংখাবের চন্দ্রাতপ অপহরণ করিল, আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়িতে যাহা শতচ্ছিন্ন হইল, কন্যা কিছুক্ষণ ন যযৌ ন তস্থে, ঝটিতি উন্মত্তের ন্যায় দ্রুত দৌড়াইয়া অর্গলবদ্ধ মন্দিরস্থ সদর দ্বারে আঘাত করেন।

যে সকল শিশুদেরকে ত্রিনয়নের চরণ বিধৌত বারি সিঞ্চনের বিধায়ে আনা হইতেছিল তাহাদের অবস্থা সঙ্গীন, কুকুর তারস্বরে ডাকিয়া উঠে, ইদানীং এক ভীমকৰ্ম্মা নৈরাজ্যের মথন হইল; যে, সব মহামূল্যবান মণিময় খচিত স্বর্ণভুজঙ্গ কোথাও বা স্বর্ণ রৌপ্য থালি পতিত, কখনও বা খোদাই করা অত্যুৎকষ্ট মৰ্মথালি চুর্ণীকৃত হইয়া রাস্তায়ে, বিভিন্ন দেশের স্মৃতি তুচ্ছ হইয়াছে; এবং হীরক সমন্বিত ও বিবিধ রত্ন মণ্ডিত ত্রিশূল, আরও যে অপরূপ-দর্শন নীলা পান্না অলঙ্কৃত বৃষ, এতদ্ব্যতীত যাহা যথা আশ্চৰ্য রাজসিক স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিক জপমালা যে এবং সর্বোপরি অলোকসামান্য মহাদ্যুতিময় চন্দ্রকলা যাহা মনন মাত্রই বহুপুণ্যে সৰ্বগুণযুক্ত জাতি শ্রেষ্ঠ হিন্দু জন্ম সার্থক হয়–যে। কোন-র নির্বিকল্প সমাধি হইতে পারে, এখন যতেক সম্ভার অর্ঘ্য ভূলুণ্ঠিত।

এখন সেই সেই লোকেরা কেহ কেহ ক্রন্দিত কেহ সভয়ে অগ্রসর হয়, আর কেহ কেহ ঐ অমূল্য নিদর্শনগুলি আত্মসাৎকরণে কিলকিলা রব করিল, এহেন বিবৃত্তপাকে অসংখ্য পায়ের ফাঁকে কশ্চিৎ কিম্ভুতদর্শন মুখোসধারীও লুণ্ঠনে ব্যগ্র, নেতৃবর্গের বিদেশী ঘড়ি শোভিত হাতও কর্মতৎপর, আর যাহাদের বাহুতে সুইবিদ্ধ ব্যথা তাহারা জিগীর আস্ফালন জেংগীল পাখীর ন্যায় আর্তনাদ করে।

এখন ঐ তাণ্ডব সঙঘটনে বেচারী সুঘরাই মহা বৈচিত্তে, যে সে কোনদিকে যাইবেক ভাবনায়ে বিশৃঙ্খলতা; নির্ঘাত ইহা, ঐ দেবস্থানের পবিত্র সৌরভ ত্যাগ করি যাইতে সে অভিলাষী না, কিন্তু বেচারী মন্দভাগ্য। কাছের এই পৈশাচিকতায়ে সে অসুখী, সে বিভীষিত অথচ অবলীলাক্রমে সুঘরাই বুঝিল যে সে উহাদের একজন, সেও নিশ্চয়ই উহাদের একজন! অতএব আপনারে বাঁচাইতে সুঘরাই নিয়তই। সরিতে পদক্ষেপ করে, অথচ তমুহূর্তেই সে যেন ভূতগ্রস্ত উহাদের মতই জিগীরও দেয়, এই সে কিলকিলা রব করিল, এই সে আর্তনাদে বিকট; নিজেই নিজের বাদ সাধিল, ঘোষিতে চাহিল যে আমি উহাদের একজন। খানিক বাদে দেখা গেল ক্রমাগত পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়রা নিজ নিজ ভৃত্যগণসহ দ্রুত। পদসঞ্চালনে এখানেতে আইসেন; সম্প্রতি যমের অরুচি বৈপ্লবিক নেতৃবর্গরা পিট্টান দিল, কেন না। অভিনব ধর্মার্থীদের উপর বেধড়ক দুরমুশ আরম্ভ হইয়াছে।

যে অবশ্য সে এই বৈগুণ্য, ঐরূপে নিজেকে কবুল করার বৃত্তি, একদা যে কাটাইয়া উঠিয়াছে ইহা সম্যক তাহার উপলব্ধি তখনই হইল, যখন সে বেশ ব্যবধানে; এবার পলায়নের কথা; এবং অজস্র জটিল গলি সে ঘুরিয়াছে, এক একটিকে সে উপর্যুপরি বেড় দিয়া থাকে, এ কি বিড়ম্বন। তাহার স্বভাবগত সরলতায় সে পতঙ্গের প্রায়; এই সঙ্কীর্ণ পথে কেহ কোথাও নাই; শুধু দেওয়াল পরম্পরা। পূর্বাহ্বের হিরণ্যকশিপুর দুঃস্বপ্ন তাহার হাসি কান্না শোষণ যেমন করিয়াছে; কেবল দুজ্ঞেয় অশ্লীল ভীতি তাহাতে অথচ, উপস্থিত এই ধন্ধ হইতে নিষ্কৃতি লাভ মানসে সে ছুটিয়াছিল।

হঠাৎ এক সময় সাহসভরে সুউচ্চ বাড়ীগুলির শীর্ষে নেত্রপাত করিল, সে সূৰ্য্যালোক দেখিলেক, নিম্নে গলিময় যে ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন যেমন তাহারও প্রত্যক্ষ হইল, বুঝে ইহা পাণ্ডা পাড়াই; আর খানিক অতিক্রমে যে সে স্তব পাঠের আওয়াজ পাইল, ইহাতে এবং সে যেন বহু দূরের শাল গাছের পিছনে; যে সে পায়রার কলরব বুঝিল, যাহাতে যেন কাহারও নাম; যে সে সদ্যঃস্নাতা স্তোত্রে কোন বিস্ফুরিতাধারা রমণীকে কলস কাঁকে আসিতে দেখিল, যুগপৎ অন্তরে বিঘোষিত হইল, আঃ জল! জল! এই বশম্বদ আপনাকে চিনিল যে এবং তদীয় সটান-বুনটে-থাকা প্রত্যঙ্গসকল শ্লথ হয়; আর তাহাতে সুপ্রতিষ্ঠিত ইহা ধ্রুবই যে সে আর অধম নয়–যেহেতু সে বাঁচিয়াছে।

কিন্তু তা সে অতিষ্ঠ এ কারণ যে, কুহকময় বাড়ীর ঘোর, গলির তির্যক গতি, হাই উঁচুতে গবাক্ষে লাখবন কাঞ্চন-জিনি যুবতীর আনন ক্কচিৎ দৃশ্যমান এবং বিশেষত পথিপার্শ্বের বীভৎস নর্দ্দমা ও পাইখানার নাড়ী-মোচড় গন্ধ–যেখানে ইতঃমধ্যেই তাহার বিগত সংজ্ঞা-বিঘাতক-অভিজ্ঞতা পচিয়া বিকট–ইহা সমুদয় মিশ্রিত হইয়া তাহার কায়িক অশান্তি ঘটায়; ও ইহাতে তাহার দৃষ্টি ঝাঁপসা, যদিও সে নবীভূত এক ঘটনা নিজেই, অধিকন্তু যে সে পথের ঠিকও পাইয়াছে যদিও। সহসা এক সময়ে যে সে আপনকার করতল নিরীক্ষণ করিল যাহা শূন্যই, যেমন কিছু ছিল, যেন কিছু খোয়া গিয়াছে এই বিবেচনায়, অনুভবে, পশ্চাতে অসহায়ভাবে তাকাইয়াছে; আর সে স্থানীয় ভৌতিক গন্ধকে অব্যাহতি লাভে মরিয়া যে কিন্তু সফলকাম নহে।

কোন রকমে সুঘরাই শিবগঙ্গার কাছে আসিল; প্রথমেই ইহা সহজ হয় যে সে এতাবৎ শ্বাস যাতনায় অত্রাহি ছিল, যে যেমন তাহার অন্তর বাহির কুশ্রী গন্ধের ঘর, তাহার সমগ্র দেহ সীসক পরিপূর্ণ; উপরন্তু সে হঠাৎ মৃগী রোগাক্রান্ত রাত্র, যাহা বিস্মৃত সম্প্রতি, ভেদ করত এখানে সে সহজ; সে পূতঃসলিল ঐ মহিমান্বিত জলাশয়ের পানে অনিমেষনয়নে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেক–আঃ কত কত পাহাড় পাহাড় জল, আঃ কত কত আমি। যে এবং ইদানীন্তন ‘আমি’ শব্দকে সে ডরিল না যাহা চমৎকার অনুরণন তাই।

এখানে ওতঃপ্রোত হইল কোন একজন ব্যক্তি এই পবিত্র জলে, অধোভাগ নিমজ্জিত যাহার, কৃতাঞ্জলিপুটে ঊর্ধ্বলোকের দিকে নিস্পলকদৃষ্টিতে ছিল, ইহা স্পষ্টই সে উদকক্রিয়ায় ব্যাপৃতা ঘাটেতে যাহার স্বজনরা, প্রায়ই স্ত্রীলোক শশাঙ্গীত গাহে।

এই ব্যাপারের নিকটে একজন সন্ন্যাসী সশিষ্য অবগাহন করিতে নামিয়াই ঐ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষে এবম্প্রকার উদ্বেলিত যে হা রাম হা রাম নিনাদে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইলেন, শিষ্যরা তাঁহাকে ধারণ করিয়াছে, এই সন্ন্যাসী তদ্ভাবাপন্ন আবৃত্তি করিতে থাকিলেন, হা রাম!…

বিশেষতঃ চতুর্দিকেই বিকশিত কানন, তাহাতে মন্দাকিনী মনোহারিণী মূর্তি ধারণ করিয়াছেন। সীতা সমভিব্যহারী পরম যশঃশালী রাজকুমারগণ সকলেই অতি কষ্টে তথায় গমন করিলেন অনন্তর তাঁহারা কর্দমশূন্য সুপ্রশস্ত ঘট্টে অবতরণ করিয়া ‘এতদভবতু’ বলিয়া পিতৃদেবের উদ্দেশে জলদানে প্রবৃত্ত হইলেন, রাম তৎকালে জলপূরিত অঞ্জলি গ্রহণ পূৰ্ব্বক, দক্ষিণাভিমুখে দণ্ডায়মান হইয়া রোদন করিতে করিতে কহিলেন–হে রাজশার্দুল পিতা! আপনি পিতৃলোকে গমন করিয়াছেন; অতএব এক্ষণে আপনার উদ্দেশে মদ্দত্ত সুনিৰ্ম্মল জল অক্ষয় হইয়া পিতৃলোকে উপস্থিত হউক!…

এখনই শিষ্যরা ‘ওঁ রাম’ ধ্বনি দিল।

অবশ্যই ইহারা রামায়েৎ। সুঘরাই এই রামকথার অনেকখানি ভাষাগত বাধা সত্ত্বেও অনুধাবন করে; সে এহেন প্রহেলিকার সূক্ষ্মতায় এতই বিক্ষিপ্ত যে ঊর্ধ্বে দেখিতে উহার ভরসা নাই, সামনের জলরাশি আর সে নহে; অদ্ভুত শেষ রাত্রি ঘনাইয়াছে, আবার ভয় উপজিল, সে অথবা বাষ্প হইয়া যাইতেছিল।

সে ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া এই বাগে আসিল, যেখান হইতে এখন পুনৰ্বার অতিক্রান্ত মহল্লা নজরেই তদীয় মন পাঙাশ হয়; যে মন্দির আগত অনৈসর্গিক সুবাস তাহারে, অভ্রান্ত যে রমণীয় ভাবপ্রসারতা দিয়াছে, যে গভীর কুয়া হইতে উত্তোলিত জলে-রৌদ্র-দেখার-অবাক তাহাতে আছে, তৎপ্রভাবে, এখানকার আলো সে অনুভব করিয়াছিল আর যে সে অশ্বথের বীজের তুল্য অসংখ্য হাটবার পার হইয়া কোথাও উদগত হইয়াছে।

যদ্যপি যে তদীয় শুদ্ধাস্পদ মাননীয় মনিবরা সেখানেই মন্দিরেই অপিচ গলির জটের মধ্যে, প্রবেশ করিতে জী চাহে নাই, তবু মনে হয় তাহার ইতস্তত হাল্লাঝুরির কালীবাড়ীর গেটে যেন সে আছে, সেখান হইতে সোজা এই শিবমন্দিরের এক চোরা পথ আছে, ইহাতে তাহার আশ্চর্য্য কম্পন দেখা দিল যে তাহার মধ্যে মনিবদের কম্পনও সঞ্চারিত, বুঝিল যাঁহারা একদা হাল্লাঝুরির কালী মন্দিরের গেটে থমকাইয়াছিলেন, কেন না বাগানের অপ্রশস্ত তিনটি পথের মুখে ফলকে লেখা ইড়া, পিঙ্গলা সুষুম্না এবং অবশেষে শ্রীশ্রীতারা ব্রহ্মময়ী বিগ্রহ-তদৃষ্টে যদিও তখন ভোরবেলা তবু দম্পতিদ্বয় মর্মরিত অবশ্য সুঘরাইএর আন্দাজ তাঁহারা একে অন্যের হস্ত ধারণ করেন।

উপস্থিত গলি সকল তাহারে অসম্ভব বিশুষ্ক করে, যে তাহাতে ঈদৃশ উদ্বেগ যে ঐখানকার অশরীরী হিমবাহ গন্ধতে নিঃশব্দে ঘটির মত ডুবাইতে পারে; অথচ না-যাইতে-পারার ক্ষোভে সে অধৈৰ্য্য; এবং সে ক্রন্দন নিমিত্ত স্বরবিকারের আয়াস পাইল–অবশ্য ধৰ্ম্মত ইহার কারণ এই হয় যে তাহাকে যাইতেই হইবে, এখনও সে পদচালনারহিত তবুও, এখানকার জনসঙেঘর ব্যস্ততার কেন্দ্রে সরল নিঃশ্বাস লওয়ার অস্বাচ্ছন্দ্য নাই যাহা তাহার ভাল লাগে, মানে পরোক্ষে মন্দিরের নিকটের হট্টকারিতা, যাহা স্মরণে আপাতত নাই, অথচ তাহাতে ক্রিয়াশীল অজ্ঞাতেই।

তৎসত্ত্বেও কোনরকমে সুঘরাই খানিক পথ অগ্রসর হইতেই কেমন এক উদ্দীপন তাহার অন্তরে পুনরায় সংগঠিত হইল; সে যেমন কোন শোভাযাত্রা দেখনের নিবন্ধন প্রমত্ত, নিম-হরিৎ ধান্যমঞ্জরী থরথরিত রতনচূড় শোভিত হস্তে নববধূ যেন স্মিত হাস্যে আসে; জনতা উথলিত-হর্ষোৎফুল্ল আঃ মিথুন আঃ মহেশ্বরী আঃ গিরিনন্দিনী! ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবী জননী পরা, বচনে বিস্ফুরিত, কেহ বলিল, রে চক্ষু ইহার পর তোর জ্যোতিঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হউক। এখন সুঘরাই ধাইয়াছে ঐ কাঁঠাল পত্রে তেল ও মেটে সিন্দুর অভিজ্ঞার লোভে; একদাও ভাবে নাই সেই গলির গন্ধের বিষয়ে; যেন শোভাযাত্রা এখনও, এই সংস্কার হয়, যে আছে, সে আবার দেখিতে পাইবে আর সে নির্ভীক চলিতেছে।

অচিরাৎ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের সহিত ভাগ্যশ সাক্ষাৎকার ঘটিল, যে এবং তিনি স্নেহপ্রযুক্ত কণ্ঠে আজ্ঞা করিলেন, দৌড়াও দৌড়াও তোমার বাবু ও মাতাঠাকরুন তোমার সন্ধানে গিয়াছেন, কেন তুমি ভয়ে স্থান ত্যাগ করিলে, শিব থাকিতে ভয়, নির্বোধ বড় তুমি হে ছিঃ ছিঃ।

তদনুবর্ত্তী সুঘরাই অসহ্য উৎকণ্ঠায় দৌড়াইল, যেন তাহার স্বকৃত জিগীর তাহার পশ্চাদ্ধাবন। করিয়াছে। নিরন্তর বিশ্রী গন্ধে সে ক্রমান্বয় কালো। সে, সুঘরাই গলিভেদে যেক্ষণে খোলামেলায় তখনই। তাহার মানসিক যন্ত্রণা সমুদ্ভূত হয়; কোন দিকে সে যে চাহিবে তাহার তাহাতে মতি ছিল না। মঙ্গল বাদ্যকারী ঢাকীদের নৃত্য, বিভিন্ন দেশীয় তীর্থযাত্রী প্রবাহ, যে পাছে-হারাইয়া যায় তাই একের সহিত অন্যের রমণীগণের আঁচল বাঁধা, এ সকলি তাহার চোখে; একদা সে অত্যন্ত অসহায় বোধে নিষ্পেষিত, দেখিল সামনের শিবগঙ্গার জলের কোন কিনারা নাই, শুধু জল আর জল, সূৰ্য্যকে ইস্তক খাইয়া সারিয়াছে!

তাই তৎকালেই বেচারী অসাধনেই কান্দিয়া উঠে; তীর্থযাত্রীরা তাহার পানে এলেবেলে দৃষ্টিপাতে শিব জয়ধ্বনি করত জলদে পা ফেলিয়াছে, সুঘরাই কৰ্ত্তব্য নির্ণয়ে অপারগ, সে মনিবদের কোথায়। খুঁজিবে, অনেক বাঙালী তীর্থকামী বা পথচারীকে সে এহেন ঘোরে, উদ্বস্ত করিল; ক্রমে তাহার অত্যুগ্র আশা যাতনা, যাতনা প্রস্তর হইল; এ সময়ে ইতিমধ্যে পাঁচটি জন্তু যেন তাহার গাত্র হইতে উদ্ভূত হইয়া দিকে দিকে দৌড়াইল; এখন সাইকেলের ঘণ্টি শুনিতে থাকিয়া যে সে ঘুমাইতে এলাইয়াছে; বুঝে যে তাঁহাদের তন্নতন্ন সন্ধানের ফলে নিজেই অবশেষে সে হারাইয়াছে; ক্রমাগতই সে হারাইয়া যাইতেছে।

তৎপ্রযুক্ত তাহার নিকট ঝটিতিই চমকেই সমস্ত কিছুই যেন ভিঞ্জাতীয় আলুনি, যে এই বিষমত্বে একবার, এবং সে সুমহান ত্রিকূটপৰ্বত দেখিলেক, ডিগরিয়ার দিকে তাকাইল; এখন উভয়ের বর্ণান্তর পরিলক্ষিত হইয়াছে, সে প্রত্যক্ষও করিল: চেঞ্জাররা সার বাঁধিয়া ডিগরিয়া-র মুখোমুখি দাঁড়াইয়া প্রশস্তি জানাইল, কহিল, গ্র্যাণ্ড! কি সুন্দর! এই ঘোষণার নিমিত্ত কত অন্ধকার তাহারা পরিত্যাগ করিয়াছে– এমনও যে অতীতকে নবকলেবর দিয়াছে–নিশ্চয়ই এতাবৎ কলিকাতার ঘিঞ্জি হইতে ছাড়া পাইয়াছে, তাহারা আপন কুটস্থ প্রতিবিম্ব দেখিল।

তাহাদের–এই উক্তিকে এই পদবন্ধ যেন হারমোনাইজ করে–যে অলিগলিতে বড়রাস্তায় আমরা প্রেমকে অস্বীকার করিয়াছি! পৰ্বত দুইটিই যেন সম্পূর্ণ অচেনা, এবং সে যুগ কুঞ্চিত করিল, বুক তাহার মোচড়ায়-হায় মোহিলির গ্লানিতেই ইহা ঘটিয়াছে–হায় অধম মোহিলিই ঐ বেচারীদের ঐ পাহাড় দুইটির সৰ্ব্বনাশ সংসাধন করিয়াছে।

যে উপলক্ষে ঐ পাহাড় দুটির বিদ্যমানতা সেই যন্ত্রটিই মূর্খ স্বার্থান্ধ চামার পুত্রদ্বারা ধূলিসাৎ হইয়াছে, হা দুঃখ! চরাচর তিমিরাচ্ছন্ন যেন এখন গোশাবক ও গাভী সকলের কোন দিক নাই, চারণ ভুমি হইতে কেমনে ফিরিবে, কোন এক গাভীর ললাটে সিন্দুর তিলকও দেখা যায় না, খুরখাত অদৃশ্য, দিক। তিমিরাচ্ছন্ন। সুঘরাইএর অন্তরে উপস্থিত এই ছবি প্রতিভাসিত। এখনও ঐ প্রাকৃতিক শোভাদ্বয় নিছক অপরিজ্ঞাত, তথাপি সে উহাদের স্মরণ মননে আছিল যেন যে নিজেরে হারাইয়া না ফেলে।

ইহা খুবই সাধারণ এবং নির্ঘাত যে তদীয় মনিব মহাশয় তাহারে খুঁজিতে, তিনি তাহারই আশপাশ দিয়া কতবারই না চলিয়া গিয়াছেন; ইহা সে ভাবিল যে স্নেহ-প্রাণা পরম পূজনীয়া মনিবপত্নী ঠাকরুন সাংঘাতিক উতলা, অধীর, বিবর্ণ; পতিরে অনুনয় করত কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদিলেন,বাবা বিশ্বনাথ, এ কি অঘটন! কি জ্বালা, কি পোড়ার, এমনতারা হবে জানলে ছোঁড়াকে…ওরে পুব জমে কি হেন পাপ করেছিলিস্ যে নিঘিন্নে জাতের পেটে এলি, ওরে অন্য হ’তে পালিনি, মাহাতো কিম্বা কাহার কত শত জাত ত ছিল; হায়রে কোথা রাম রাজা হবে, না, হায়রে! ছোঁড়া এখনও হয়ত উপসী, দাঁতে কিছুটি। কাটেনি গা, চন্নামেত্তর খাবে, বাবার পেসাদ পাবে বলে, আমারই মরণ দশা, তোমার কথা তখন হেলা না হলে করি, গোখুরি হয়েছে, এমন জানলে! আমার মাথা খাও, পায় পড়ি, জানি একে ছোঁড়া মূর্তিমান পাপ, তলাস করিতে তোমারও ভোগান্তির সীমা নেই, তবু দেখ, ইদিকে বেলা যায়।

তদ্বিধ খেদোক্তি মিনতি সুঘরাই সুস্পষ্ট অভিধানে শুনিতে যেমন পাইল। আর যে সেবকবৎসল মনিব মহাশয় সর্বক্লেশনাশিনী উদ্বিগ্ন পত্নীর ঈদৃশ উৎকণ্ঠা সমঝে ও রমণীর হিসটেরিয়া রোগনিমিত্তও বটে এখন দ্বিরুক্তি করেন না! অথচ স্বভাবতঃ তদীয় সত্তা আর একে পরিণত, সমস্ত অস্তিত্ব এখন আর্কিটেকটনিক ব্যঞ্জনা যাহা মন্দিরের ফুলচন্দন কর্পূরগন্ধ গম্ভীর অন্ধকার মিশ্রিত এবং কণ্ঠ এখন কাব্যবীজে স্ফীত হইয়াছিল এবং এহেন অবস্থা লইয়া নীচজন্মাকে তথা সেই পাপের পুনরপি অনুসন্ধান শুরু হইল।

সুঘারইএর মানসে সেই ঘোর শ্যাম গোচারণভূমি থাকে, এখন সেই ত্রস্ত গাভী একভাবে হম্বারবে আকাশকে অভয় দিতে আছে, যে তাহারা বিভ্রান্ত উত্তেজনায় পরমাদে একে অন্যরে সংঘর্ষে, বেচারীদের গললগ্ন ঘন্টি ক্ষিপ্তক্রমে বাজিতে অনবরত থাকিয়া উত্তপ্ত; ধ্বনিভেদ তাই, বহুদূর স্থিত সাঁওতাল পল্লীতেও শ্রুত, এরূপ অবাক ধ্বনিব্যঞ্জনায় উত্তেজিত হইয়া সাঁওতালরা মাদল বাজাইতেছে, হায় বেচারীদের গরু নাই! দাবদাহর সঙ্কেতেই খবরেই একে অন্যের হাত ধরে! ইদানীং অথৈ রিখিয়ার পথে পথে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার, চৌকিদার পথ লাঠি ঠুকিয়া হাতড়ার অন্ধ যেমন বা।

নিশ্চয়ই মনিব মহাশয় ঐ ছ্যাকড়া গাড়ীর সামনে যাইলেন, সেইটি স্থিতবান আছে, সেইটি কৌতূহলোদ্দীপক, যাহার আশেপাশে সার্কাসের খেলার তাকলাগান ছবি প্রলম্বিত, যে গাড়ীর ভিতর হইতে হ্যাঁণ্ডবিল বিলি হইতেছে, যাহার ছাদে কেলড্রাম, ক্লেরিওনেট, করনিট বাজিতেছে; গাড়ী মধ্যে দেখা যায়, তিনি যিনি বাঘের খেলা দেখান, যাঁহার বুকে বাঘনখ আঁটা রূপার ঘড়ির চেইন, ইঁহার মরদ গোঁফে দারুণ কেয়ারি; উনি ঘুমন্ত; মনিব মহাশয় উঁহার পানে চাহিলেন।

বাদ্য ঢক্কানিনাদ তীর্থযাত্রীরা মুহুর্মুহু জয় শম্ভু যোগেশ্বর, এইরূপ আপন ইষ্টর নাম তুলিতেছে, ইতিমধ্যে দ্বাদশ লিঙ্গের নাম গমক দিয়া উঠে, তন্মধ্যেও আপন অহঙ্কার ফেলিয়া তিনি, বাঘেরা খেলোয়াড়, ঘুমে কাদা; অথচ বক্ষের মৃত খবরে–কি জানি বাঘনখ বা কি, কি জানি ঘড়িই বা কি অদ্ভুত কামুক ভুবন্ধাই; নিশ্চয়ই সুঘরাই অনেক বালকের তর্জ্জনী নির্দ্দেশ নিয়ন্ত্রিত ইহারে অবলোকন করিতেছিল, অবশ্য সে চোখের জল মুছে নাই, সত্যই ইনি ভীতিপ্রদ ইনি আনন্দও!

ইত্যাকার পর্যালোচনাপূৰ্ব্বক মনিব মহাশয় হ্যাঁণ্ডবিল বিলিকারী, যিনি তারের খেলা দেখান– তাঁহারে সম্ভ্রান্তস্বরে জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়, আপনি সুবিখ্যাত ব্যক্তি, আপনার মধ্যে সরল রেখার বৈচিত্র্য, বহু বালকের হাতে আপনি হ্যাঁণ্ডবিল দিতেছিলেন, যে বালক আপনাদের কসরতের ছবি দেখিয়া থমকাইয়াছিল, পরক্ষণেই বড় পশ্চাতে চাহে আবার বাঘেরা খেলোয়াড়কে দেখে, রোমাঞ্চিত হওয়ত শিহরায় যে যেন এখনই খেলোয়াড় জাগিয়া হালুম করিয়া উঠিতে পারে, হঠাৎ সে স্থান ত্যাগ করিল, আপনার আহ্বান সত্ত্বেও সে কাছে আসে নাই।

অবশ্য পুনরায় ফিরিয়া আইসে, যখন কৌচম্যানের পার্শ্বে বসিয়া ক্লাউন নানান রঙ্গতামাসা দেখায়, বাহবা রুমালের খরগোস ও বাখানি ইন্দুর লইয়া খেলা এখানকার দুএকটি সবস্ত্র বালক, সুঘরাই না, ও কতিপয় পথচারী বুঝিত না; অবশ্য ক্লাউন যখন কপট শ্লেষ্ম ঝাড়িয়া এই অল্পবয়সী ভিড়ে নিক্ষেপ করে, যখন কপট তাড়নায় পাদানিতে পা দ্বারা আঘাতিয়াছে, চাবুক আস্ফালনে মজা করিয়া থাকে, সর্বোপরি কপট মূত্রত্যাগজনিত অঙ্গভঙ্গীতে ও তৎশব্দের অনুকরণ, যখন অন্যান্য বালকরা হাসে, যখন পালায়, সেই বালক সরিয়াছে পালাইয়াছে কিন্তু হাসে নাই।

যে এবং চিত্রিত কসরৎ সকল দূর হইতেই, ক্ষণেক আপন অঙ্গুলি যেন ঐগুলির উপর, সে বুলাইয়া বুঝিয়া লইতে চাহিয়াছে–সে চাতুৰ্য চাহিয়াছে, বিচক্ষণতা চাহিয়াছে; কিন্তু কসরৎ বুঝিতে তদীয় গেঞ্জী আট বোধ হয়; ও যে, হঠাৎ বাঘেরা খেলোয়াড়কে অদ্ভুত বুনো আলস্য ত্যাগ করিতে প্রত্যক্ষে যাহার গাত্রে পুলকমিশ্র তরাসে সিঞ্চিড়া উদগম হইল, তখনই সে যেন ধর্ম্মভীরু, একারণ যে তাহার মনে দংশিল যে আমি ডোমপুত্র সুঘরাই আমি ত ইহাকে, ইহা সব–সার্কাসের লোকদের খুঁজিতেছি না, আমি যে মনিব মহাশয়দের…এবং তাহাকে কি আপনি যেহেতু সে আপনার হস্তচ্যুত দেশলাই তুলিয়া দেয়, আপনি এখন…।

সুঘরাইএর দেহ হইতে যাহারা যে জন্তুরা একযোগে বাহির হইয়া নিমেষেই অদৃশ্য হয়, ইদানীং সেই পাঁচটিকে দেখিল, সে সাক্ষাৎ চিনিল; ইহাদের জিহ্বা লোল, ইহারা হাঁফায়, বেচারী কুকুরগুলি; যখন তাহার গাত্র হইতে সবে মাত্র জাত তখন মনোহর শ্বেতকায়া ছিল, এখন অত্যধিক হয়রানিতে উপস্থিত যারপরনাই মলিন ধূসর; ইহারা কুণ্ঠায় জড়সড়, তাহারই দূরে দূরে অবনত মস্তকে ঘুরে, ইতিমধ্যে অসহায়ভাবে তাকায় এবং কোন কৈফিয়তে ল্যাজ তাহাদের আন্দোলিত ছিল; সুঘরাই উহাদের প্রতি খিন্ন অলস চোখে তাকাইল; সে নিজে আজ্ঞাবাহক, অথচ আশ্চর্য এই ক্ষেত্রে তাহার চাহনি মাত্রই তখনই, উহারা কুকুর সকল উহারা মাটি আঘ্রাণ করত ছুটিল, ধূলা উড়িতেছে। এখন আবার পূর্বকথিত অন্ধকার; তীর্থযাত্রিদের ম্রিয়মাণ শ্রান্তস্বর শোনা গেল–তাহাদের টুকরো কথা আসিলভবভীতি, পাপ, কর্মক্ষয় হইতেছে! এখনও পূৰ্ব্বকথিত অন্ধকার, দিকসকল অন্তঃসত্ত্বা বিড়ালের ন্যায় মন্থর।

মনিব মহাশয়ের চিত্তে প্রসন্নতা নাই, বহুকালের পুঞ্জিত শুদ্ধতা বিশেষত শিব অর্চনার সুকৃতি লইয়া এক জংলীকে খুঁজিতে কাহিল। অনন্তর তিনি কয়েকজন মিস্ত্রীর সকাশে যাইলেন। ইহারা রাস্তার ধারেই এক মোটর গাড়ী সারাইতে ছিল, যে এবং ক্ষণে ক্ষণে তাহারা সারান ব্যাপার লইয়া যুক্তিতর্ক করে, যাহা অনর্গল ইতর মুখ খারাপ মিশ্রিত; সুতরাং কিছু তীর্থযাত্রী তাহাদের কাছের একটি গাছ তলায় বসিতে যাইতে থামিয়া বেশ দূরে চলিয়া গেল। মিস্ত্রীগণ কুলি কামারীরা যে নিদারুণ খলমতি ছোটনোক প্রকৃতির স্বভাবতই ইহা তিনি জ্ঞাত। ইহাও সম্যক বিদিত যে, ইহারা মৰ্য্যাদার কিছু বা কোন কাহাকেও, দেখিলে চোয়াল ঘর্ষণ করে, তাই তিনি ইতিমধ্যে একবার দ্বিধায় পড়িলেন, এ কারণ যে উহারা এক তীর্থ আগতদের মধ্যে কশ্চিৎ উড়িষ্যাবাসী প্রিয়দর্শনা ডাগর যুবতী রমণীকে লক্ষ্য কেমন যেন করিতেছিল–এই সূত্রে, বিদ্যুতে, হিজড়ারা আভাসিত হয়, এখন পুনৰ্বার হাতুড়ি ও অন্যবিধ শব্দ হইল।

মনিব মহাশয় প্রস্তুত, বিনীত, ইহা নিবেদিলেন,–ভায়া, এক দেশওয়ালী ছেলে, তাহার চোখে জল ছিল, অবশ্য আদতে সে অনুমান করে যে আমরা হয়ত গাড়ীভাড়া উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে আসিতেও পারি খোঁজ খবর করিবারে, তাই, এখানে আইসে; এঞ্জিনের কিয়দংশ নিরীক্ষণে মহাভয়ে সে বিচলিত, তত্রাচ উহার এঞ্জিনের কটু চেহারা তাহারে যথাক্রমে আকর্ষণও করে, ও যে তোমাদের কর্মকুশলতায় সে বিস্ময়াবিষ্ট, ও তদীয় জিহ্বা অনেক কিছু প্রশ্ন জন্য সরস হইতে আছিল বটে, যে বিরাট টায়ার উত্তোলনে সাহায্য করিতে চাহে এবং যাহারে তোমরা অশ্লীল বচনে খেদাইলে–ঠিক যখনই সে কলকজার বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতায় বিমোহিত, যখন উহা তাহার চমৎকার স্মৃতি হইতেছিল! এখন বলিতে পার সে কোথায় গেল।

এবং যে স্থলে অনেক মনোহারী পসরা-মেলান দোকান; সুঘরাই একদা চামেলীর মাতোয়ারা সৌরভে সচকিত, যে সে তির্যক নয়নে রকমওয়ারি শিশি সকল নজর করিল, ঐগুলি চাকচিক্য সমন্বিত, এতেক মধুর মনোজ্ঞ গড়নের যে যেন উহারা হেঁয়ালী গীত জানে! এহেন আতরের দোকান সাক্ষাতে সুঘরাই যেন রিখিয়াতেই, কোন ক্ষোভ নাই। অতএব মনিব মহাশয় বিচার করিলেন এমন যে, এখানে কিছু সময় হয়ত বা অতিবাহিত সুঘরাই দ্বারা হইয়াছে।

যে সে কতবারই না, মদীয় পত্নীর উৎকৃষ্ট আবলুস কাঠ নির্ম্মিত আয়না দেরাজের উপরে, জেডের সুলক্ষণা অতুলনীয় রূপের এক চৈনিক দেবীমূর্তি ও ইহারই আশেপাশে, মাইরি কি অভিরাম বোগদাদের গোলাপ পাশ, ব্যহেমীয় শিশি বাহার ও ইদানীংকার ফরাসী এসেন্সের আধার, একই কেয়ারিতে–আনারকলি-বাগিচা ছাঁদে সাজান, সুঘরাই যাহা দেখিতে মোহাচ্ছন্ন আজ্ঞাবহ দাস হইলেও সাড়হীন; যদিও হায় সে পদ্ম পাতায় খায়, সে প্রায়-জংলী, তারাময়ী অন্ধকার এখনও তাহার নিকট সুন্দর হয় নাই, পরীর গল্প সে শুনে নাই! শুধু স্মরিয়াছে ঐখানে সৌখীনতার মধ্যে কোথাও যেন ভোর হয়, আবার পাখীরা ফিরিয়া আইসে দারুণ পড়িমরি দৌড়ান যায়–তখনও সে লুপ্ত হইয়া যায় না!

তৎপ্রবর্ত্তীত, রাস্তার উপর এই বেলোয়ারী সম্ভারে গতিরহিত সুঘরাই সুনিশ্চিত হাতের কব্জিদ্বারা বিগলিত অশ্রুধারা মুছিয়াছে এখানে, জয় শিব শম্ভ ধ্বনি কানে আসে না। এখন এতদ্ভাবাপন্ন তিনি মনিব মহাশয় চুনটকৃত দোপাল্লী টুপী-পরা বিলাসী আতরওয়ালাকে প্রশ্ন করিতে যাইয়া অচিরাৎ মহা দ্বিধায়, কিসের তত্ত্ব করিবেন তাহা জ্ঞাত নহেন মুখ্যত; যেন তিনি আতরের খবর লইতে আসিয়াছেন, কেয়া গুলাব শামামা এবম্বিধ নাম তাহার স্মরণে আছে এবং যেমন ইহাদের মধ্যে একটি নাই তথা খোয়া। গিয়াছে; এখন তাহা সত্যই আতর না অন্য; না, অন্য কিছু নয় তাহা আতরই, তাহাই সুঘরাই অর্থাৎ।

অনেক শিশি দেখিতে তাহার স্থিরতা আসিল, কহিলেন,–যে বালক রক্তিম নয়নে মহাশয়ের পসরা বিদগ্ধভাবে পর্য্যবেক্ষণ করে, ফলে তাহার এই অপ্রত্যাশিত ভৌতিক সংগ্রাম হইতে নর্দ্দমা হইতে খানিক অব্যাহতি লাভ হইয়াছে ক্ৰমে বমি উদ্রেককারী গন্ধ তাহা হইতে সরিয়াছে যে এবং, সে যে অকথিত সান্ত্বনা পায়, যে, সে হারাইয়া যাইবার নহে; এবং সে এই বিশ্বাসেই, যে যদি ভগবান শিবের জয়ধ্বনির-নিকটে থাকিতে পারে তাহা হইলে কোনরূপেই সে হারাইতে পারে না–তাই সে ছুটিল, কিন্তু কোন ঢাকীর পশ্চাতে তাহা কি জানেন, সে কি ঐ সিন্ধু প্রদেশ আগত যাত্রীদের…পশ্চাতে!

অতঃপর মনিব মহাশয় আপনার পদক্ষেপ সংযত করিলেন, কেন না আশ্চর্য্য কথায় তিনি কেমন যেন, যে যাহা এই, তীর্থযাত্রিদের একজন বলিতেছিল,–যে তিনি আর ট্রেন হইতে নামেন নাই, বাবা বৈদ্যনাথকে গাড়ীতে বসিয়া প্রণাম করিয়া বলিলেন,-বাবা তুমি জান আমার মৃত্যু আসন্ন কল্য সন্ধ্যায় আমার ‘—’ ঘটিকায় কাল হইবে, আমি কাশীধামে যাই, আমি গঙ্গাতীরে শেষ নাম জপ করিব, আমি মুক্তি চাই, তুমি দেবাদিদেব তুমি লইয়া চল…তারক ব্রহ্ম নাম তুমি দিও!

সুঘরাই অদ্ভুত চোখ করি এহেন কথা শুনিতে জিহাদ্বারা অধর সিক্ত করে; সে আন্দাজে কিছু অনুধাবনে, ইহা ভাবে, যে উহা ঐ বক্তব্য এক দারুণ ষড়যন্ত্রের খবর, অন্যপক্ষে এরূপ স্বস্তিও তাহাতে জন্মায় যে ইহা ভাল, যে বৈদ্যনাথে নামিলে অব্যর্থই হারাইয়া যাইত; ঢাকীরা তাহাকে, সেই বৃদ্ধকে, পয়সার জন্য ত্যক্ত করিত, বুঝিতেই চাহিত না যে তীর্থে কাঞ্চন স্পর্শ করিবে না বলিয়া সেই বৃদ্ধের যথাসর্বস্ব তাহার সঙ্গীদের নিকট; ভাল যে কাশী গিয়াছে আর হারাইবার সম্ভাবনা নাই।

যুগপৎ ব্রত বিগ্রহ গরুটি, যাহার ললাটে চমৎকার সিন্দুর, বিশেষত সেইটির জন্য সুঘরাই ক্ষুগ্নমনা এখন দেখিল, সকল উদ্বিগ্ন কণ্টকিত গাভীর চক্ষুদ্ৰায় জাজ্বল্যমান, ইহারা ব্যথিত স্বরে হরব করে, যাহা সস্নেহ লেহনের শব্দের ব্যঞ্জনা অনুসারী, যে স্বর পদ্ম হইতে, দেবীর চরণ ন্যায় শুদ্ধ; ইহা চতুর্বিধ আকাশ, পরিক্রমণ, ভেদ করত, মহাব্যোমে পৌঁছায়, সেখানে সুস্পষ্ট অভিধানে ঐ ব্রত বিগ্রহ গাভী এই অভয় দেয়, যে, হে জ্যোতির্ময় তুমি বিকিরণ কর, অন্ধকার বিনষ্ট কর, শুন, মানুষে আর কোন অজ্ঞান নাই, বৈচিত্ত নাই, যে তাহারা ফুলে,কুঁড়ি উদগত হইতে দেখিয়াছে, প্রস্ফুটনে তাহারা উথলিত, বেশ কাল অন্তে উহার ঝরা প্রত্যক্ষে তাহার বাস্তব হইয়াছে এবং সুদীর্ঘতা ও বিপুল এই দুইকে আপেক্ষিক জানে! অগ্নিকে শপথাৰ্হ মান্য করিয়াছে, মদীয় হরবকে প্রস্তরে পর্যন্ত আরোপিত করিয়াছে। সুঘরাই গাভীসকলের কারণে চিন্তিত বিমর্ষ কেন না চৌকিদাররা ক্রমাগত রিখিয়ার পথের অন্ধকারে হাঁক পাড়িতেছে, সকল গ্রামবাসিরাও দিভ্রান্ত যে সে অনুমান করিল।

অতঃপর সে ভাবিয়াছে মনিব মহাশয় নির্ঘাত এখন সেই বদ্ধ উন্মাদের সম্মুখীন, যাহারে তিনি সমাহিতচিত্তে সংস্কারবশত পরিগণন করিলেন, যথা ইহা নির্দিষ্ট যে আত্মদর্শীরা উন্মাদবৎ রহেন, তাঁহারা জড়বৎ পিশাচবৎ বালকবৎ হয়েন, এবং যেহেতু কয়েকজন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী মালা জপিতে থাকিয়া সেই ব্যক্তিতে আকৃষ্ট রহে–এ কারণে তিনিও বিবেচনা করিলেন, ইঁহাকে দেখি বদ্ধ উন্মাদ, নিশ্চিত মহাপুরুষ, অবশ্যই পরহিতব্রতীও হয়ত; আর যদি ইনি তাহা না হইয়া থাকেন, যদি ইনি সাধারণ পাগল হন, সেই ক্ষেত্রে ইহা বিদিত যে, পাগলরা সত্যের সন্ধান, ব্যবহারিক সত্যের সন্ধান দিয়া থাকে; এখন যে কোন পক্ষে, আমি ইহাকে শুধাইতে ব্যাকুল, বিশেষত এই নিমিত্ত যে,বেশ ভালরূপেই জানি সুঘরাইএর পাগল খ্যাপাদের প্রতি প্রগাঢ় দরদ উৎসুক্য আছে, কতদিন সে তাহাদের ভাত দিবার জন্য পদ্মপাতা আনিয়াছে, নিজ অন্নদানে উৎসাহিত হইয়াছে, আবার ইহাও ধ্রুব যে, অন্যধারে যাহাদের মতিচ্ছন্নতা তাহারে প্রমোদিত করিয়া থাকে এবং যাহাদের জ্বালাতন করণে কি অবধি হৃষ্টতা তাহার, যে পরক্ষণেই উন্মাদদের প্রতি আক্রমণে পলায়ন তুল্য আহ্লাদন তাহার আর কৈ!

এতদপ্রবর্ত্তীত, সমীপবর্ত্তী মলিন চ্যাগড়া গাত্রে উন্মাদকে করজোড়ে এবং জানাইলেন, আপনি অনন্যসাধারণ, হে নরোত্তম আপনি ধন্য, আপনার নিঃসঙ্গতা ভাগবত কথিত, আপনি গোপনতা বহন করেন–গোপনতার গোপনতা! আপনকার বিচ্ছিন্নতা নজরে যে বালক নিজ অবস্থা সত্ত্বেও থ; যে, নির্ঘাত বুঝে সেও ক্রমশ গোপন হইয়া যাইতেছে, ক্ষণেক পাংশু হইয়াছে; কোনমতে সে সোজা ছিল, যদিও যে আপনার মুখে হাস্য ছিল তথাপি সে আপনাকে বেচারী বলিয়াছে, যে যেমন আপনিও হারাইয়া গিয়াছেন, হায় আপনি থানা পোস্ট অফিস ভুলিয়াছেন, মাঠে ঘাটে ষড়ঋতু খেলা আপনি ভুলিয়াছেন; বালক ইহা অবিদিত যে, মহা ব্যোম আপনকার বৈভব; এবং যে রোরুদ্যমান সেই রিখিয়ার ছেলেটি, আপনার দৃশ্যত-আধিভৌতিক দুঃখে বড়ই বিকল, যে আপনার কেহ নাই, এখন আপনার দিক বিচারও নাই; এরূপে সে নির্ভয়েই আপনাকে দেখিতে থাকে, হঠাৎ সে আতঙ্কিত হইল, সে ত্রিকূট পাহাড়ের দিকে চাহিল এবং স্থান ত্যাগ করে…তাহার বিষয়ে কিছু বলিবেন। আর যে সেই বদ্ধ উন্মাদের তর্জ্জনী সঙ্কেত আশায়ে ক্ষণকাল বিলম্ব করিলেন। সম্মুখের পাগলামী অন্তর্হিত হইল।

বেশ খানিক দূরের পথিপার্শ্বস্থিত উত্তম তিলক-সেবা মণ্ডিত গোখুর শিখাযুক্ত জনৈক গণৎকার দর্শনে মনিব মহাশয়ের ঔৎসুক্য উপজিল, তিনি নিকটে যাইলেন এ কারণ যে এই গণৎকার কিয়ৎ অভিনব পন্থীর, ইহার সমক্ষে বিচিত্র সাজ সরঞ্জাম, অক্ষ, চিত্র ইত্যাদি, নভোমণ্ডলে গ্রহনক্ষত্র পরিস্ফুট চিত্র, শনির পরমদ্ভুত সন্ত্রাসপ্রদ কুটিল শুধুমাত্র মুণ্ড অঙ্কিত, ও যন্ত্র সকলের ছক। যখন সুঘরাই এখানে সে ঐ গণৎকার ইনি এক বর্ষীয়সীর করকোষ্ঠি স্বাধ্যায়ে নিমগ্ন, চমকে তিনি খড়ি পাতিলেন, স্মিতহাস্যে ঊর্ধ্বে হস্তসঙ্কেতে মৌনভঙ্গ যেক্ষণে করিবেন, তৎকালেই–ইতিপূৰ্ব্ব হইতে যে অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ হেথা হইতে শোনা যাইতে আছিল, তাহার বেশ দূরে এক জনসমাবেশ দেখা গেল, সামনের কয়েকজন ঈষৎ ধীরগতি, পশ্চাতে বিক্ষুব্ধ অনেকেই।

কাহাদের পুলিশ ধরিয়া আনিতে আছে; বাম পার্শ্বে এক রোগা লোক, তদীয় হস্তষ্কৃত সাঁড়াশী কজায়ে একটি মুচি (সোনাগলানর আধার), ইহার গর্ভ হইতে একটি স্বর্ণ সর্পের মস্তক উত্তোলিত ত্রিশূলের শীর্ষ, এগুলি মুচিতে খানিক গলিত পিণ্ডে আটকান; দক্ষিণে একজনা সুবেশী পিছনে একজন গামলা-উনুন, কেহ হাফর ইত্যাদি বহিতেছে, কিছু অন্তরে মত্তমাতঙ্গপ্রায় জনতা যাহাদের দন্ত বিকট প্রকটিত, বলিতেছিল,–শালাদের আমাদের হস্তে অর্পণ কর।

কেহ কেহ প্রস্তরহস্তে রোষামর্ষ চক্ষু ঘুরাইয়া কহিতেছিল,–আমরা ঐ শনৈশ্চর নরাধমদিগের রক্তে কপালে ফোঁটা কাটিয়া পুণ্য অর্জন করি, কি ভয়ঙ্কর ইহারা!

কেহ বলিতেছিল,–ইহারা কাহারা ইহারা গাছকে গাছ জলকে জল বলে কি, ইহাদের ঘুম কি পাতাল প্রবেশ করিয়াছে!

কেহ বলিল,–আমাদের হাত কাজে অতীব শক্ত কড়া পড়িয়াছে, হৃদয় বুক আমাদের বাবার কৃপায়ে এখনও ছাগল ছানা!

কেহ, এবম্বিধ হট্টগোলে আকৃষ্ট হওয়ত, এরূপ ব্যাপার সাক্ষাতে বিভীষিত,পাপ! পাপ! বলিতে থাকিয়া কান নাক মলিয়া একটি করজোড় মস্তকে ঠেকাইয়া, সত্ত্বর শিবগঙ্গায় স্নান উদ্দেশ্যে, পাপমোচন উদ্দেশ্যে গেল।

অসমাপ্ত স্নানার্থীরাও পুনরায় স্নানে যায়, সেই দৃশ্যে রমণীমণ্ডল চক্ষু আনত করে দ্বিচারিণী হইবার ত্রাসে! এই বিবিধ উদ্বেগের মধ্যে হঠাৎ এক প্রস্তরখণ্ড আসিয়া লাগিল সুবেশী লোকটির ললাটে; রক্ত কিঞ্চিৎ পুলিশের জামায় ও স্বর্ণকারের মুচিস্থ রূপগুলিতে! রমণীরা চোখ ফিরাইল; এ সময় শহরের এক ডাক্তারবাবুর পাল্কী-গাড়ী এই ঘটনার সন্নিকট হয়, তিনি গাড়ী হইতে নামিয়া–উৎক্ষিপ্ত জনতা যাহারা বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি দেয়, আর মার মার বলে–তাহাদের ভেদ করত যাইলেন, আশ্চৰ্য্য মুচিস্থ অবস্থা দর্শনে তিনি সত্বর সেই দিকে হস্তের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুলিতে ক্কচিৎ থমকাইয়া এবার সুবেশধারী লোকটির সাহায্যের নিমিত্ত প্রস্তুত।

সুঘরাই এ সকল কিছু দেখিতে থাকিয়া উৎচকিত, তাহার কণ্ঠের শিরাউপশিরা কোন এক চীৎকার নিমিত্ত স্ফীত, এখানে সেখানে দৃষ্টি সঞ্চালন করিল, মনিব মহাশয় হয়ত কাছেই কোথাও–এই অসম্ভাবিত ব্যাপারে মর্মাহত তিনি অবশ্যই–এই জনপ্রবাহ বেশ দূরে যায় যখন সুঘরাই ইহা বিবেচনা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *