ঢং থাকলেই দমকল হয় না

ঢং থাকলেই দমকল হয় না

আগুনটা লাগতেই গোবর্ধন ক্যাশবাক্সটা হাতিয়ে আর হর্ষবর্ধন ভাইকে বগলদাবাই করে বেরিয়ে এসেছেন কারখানাব থেকে।

কী সর্বনাশ হলো বল দেখি! প্রজ্জ্বলন্ত কারখানার দিকে চেয়ে বললেন হর্ষবর্ধন।

আরো সর্বনাশ হতো যদি ক্যাশবাক্সটা না বাগাতে পারতাম দাদা! দাদার কথায় সায় দেয় ভাই।

আরো সর্বনাশ হতে পারত যদি তোকে হাতের কাছে না ওয়া যেত সময়মত, জানালেন শ্রীহর্ষ : অকালে ভ্রাতৃহারা হতে হতো আমায়।

কী করা যায় এখন? গোবরার জিজ্ঞাসা। আগুন না নেভাতে পারলে গোটা কারখানাটাই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

ওর গোটা মুখটাই যেন একটা প্রশ্নপত্র হয়ে ওঠে।

কে নেভাতে আসবে আগুন এখানে? দাদা বলেনঃ একি তোর সেই দেশ পাড়াগাঁ পেয়েছিস যে আগুন লাগলো আর অমনি চারধারের যতো লোক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল, হোস্টেল ইস্কুলের সবাই ছুটে এল, পুকুর থেকে হাতাহাতি করে বালতি বালতি জল এসে পড়ল আর সকলে মিলে নিভিয়ে দিলো আগুন! এ হচ্ছে শহর কলকাতা, এখানে কি তোর পুকুরটুকুর আছে রে? তাছাড়া আগুন নেভাতেই বা আসছে কে হেথায়!

শহরের লোকরা বেজায় একলাফেঁড়ে হয় দাদা! সব সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত তারা।

এখানে আগুন নেভাতে কেউ আসে না। এমনকি গায়ে পড়ে আগুন লাগাতেও নয়। হর্ষবর্ধন বিরক্তি প্রকাশ করেন।

তাহলে কী করে নেভে আগুন এখানে?

দমকলরা এসে নেভায়। সেই যে দেখিসনি, ঢং ঢং করে ছুটে যায় রাস্তা দিয়ে?

দেখেছি। সেই সঙ্গে আরো দেখেছি…তোমার কথায় মনে পড়ে গেল দাদা! কিন্তু ঢং থাকলেই কিন্তু দমকল হয় না। অনেক মেয়ের তো ঢং আছে, তারা কিন্তু দমকল নয়।

নয়ই তো। কথাটা দাদা মেনে নেন নির্বিবাদে, নিজের বাড়িতেই দেখছি দুবেলা,

সে আর তোকে বেশি করে দেখাতে হবে না।

আমি অন্য বাড়ির কথা বলছিলাম কিন্তু…

সব বাড়িতেই আছে রে…দুবেলাই দম দিচ্ছে কর্তাদের… বেদম-করা কল সব। কিন্তু এখন, দমকলকে তো খবর দিতে হয় আমাদের। কী করে দেয়া যায় বলতো?

কেন, ফোন করে, কী করে আবার? গোবর্ধন বাতলায় পাড়াগাঁর ডাকাডাকিতে যেমন হ্যালো হ্যালো, মেয়েদের কোতেই অবশ্যি…এখানে কলকাতায় কাউকে ডাকতে হলে তেমনি ওই ফোনে কান পেতে যালো হ্যালো!

তাতো বুঝলাম। কিন্তু ফোন করবি কোথা থেকে? আমাদের ফোনটা তো আপিস ঘরেই…কারখানার ভেতরেই আবার…।

ক্যাশবাক্সের পাশেই তো ছিল ফোনটা…বুদ্ধি করে তখুনি তখুনি যদি ফোনটা করে দিয়ে আসতাম…

বুদ্ধিটা খরচ করিসনি যে, কী ভাগ্যি! তাহলে তুইও খর্চা হয়ে যেতিস এতক্ষণ। খর্চা হয়ে যেতাম? বললেই হলো?

অবিশ্যি, আরো একটু বুদ্ধি খরচ করে দমকলের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সকেও ফোন করে আসতিস যদি…।

অ্যাম্বুলেন্সকে? কেন, অ্যাম্বুলেন্সকে যেন আবার?

আধ-ঝলসে শিককাবাব হয়েই বেরিয়ে আসতিস তো দেরি করলে আরেকটুখানি। অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে চলে যেতে পারতিস সঙ্গে সঙ্গে তখুনিই।

শিকাকাবাব-এর দৃষ্টান্ত দ্বারা ভাইয়ের শিক্ষাভাব মোচনের প্রয়াস দাদার।

দাদার শিক্ষাদানে ভাই কিন্তু বিচলিত হয় না—ছুটে গিয়ে খবরটা দিলে হয় না? জিজ্ঞেস করে সে।

হয়; দমকলের মতই ছুটতে পারিস যদি, তাহলে হয়। ঘাড় নাড়েন দাদা–কিন্তু তা কি তুই পারবি? না, তা হয় না, দমকলকেই খবর দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই তাছাড়া। ফোন করেই দিতে হবে খবরটা। কিন্তু ফোন এন পাওয়া যায় কোথায়। শহরতলীর এই এলাকায় কি ফোন রাখে কেউ? মনে তো হয় না?

আগুনের লেলিহান ছটায় আকৃষ্ট হয়ে কিছু লোক এসে জমেছিল আশে পাশে। তাদের প্রশ্ন করেও হর্ষবর্ধন সেই একই জবাব পেলেন।

বস্তির ভেতর ফোন রাখবে কে? তবে হ্যাঁ, সামনের এই বাগানওয়ালা বাংলো বাড়িতে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, ফোন আছে সেখানে। জানালে একজন।

মালিক কে বাড়ির? নাম কী তাঁর?

মালিক যে কে, কেউ জানে না। তাকে কেউ দ্যাখেনি কখনো তবে গিন্নী একজন আছেন বটে বাড়ির। জানালে একজন।

জানি আমি। গোবরাও বলল—তোমর ঢং-এর বথাতেই মনে পড়েছিল কথাটা। ফোন আছে বটে তার। দেখেছিও ভদ্রমহিলাকে কিন্তু তার ঢং বেজায়।

তাহলে যা না তুই। ফোনটা করে আয় সেখান থেকে। হর্ষবর্ধন বলেন।

কিন্তু ঐ যে বললাম, ঢং তার খুব।

তার ঢং তার ঢং-তোর কী! তুই ফোন করবি চলে আসবি। ছেলেমানুষই তে বলা যায় তোকে এখনও—অনায়াসেই লোকের, মানে যে কোনো স্ত্রীলোকের বাড়ির মধ্যে যেতে পারিস তুই।

না বাবা! বলেই জিভ কেটে গোবরা ভুলটা শুধরে নেয়—না দাদা! অমন আঁদরেল মেয়ের সামনে এগুবার সাহস হয় না আমার। তুমি যাও বরং।

দাদাকেই যেতে হলো অগত্যা।

গেট পেরিয়ে ফুলবাগান ভেদ করে ঝোপঝাড় লতাপাতার কেয়ারি ধরে এঁকে বেঁকে নানাজাতের ফুলের সুরভি শুকে শুকে রাজ্যের গোলাপের অট্টহাসির ভেতর দিয়ে বাংলোর সম্মুখে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন।

সামনের ড্রইংরুমেই বসেছিলেন ভদ্রমহিলা। হর্ষবর্ধন তাঁর সমীপে গিয়ে নমস্কার করে বললেন-আমি হর্ষবর্ধন। আপনার এই বাগানবাড়ির সামনেই আমাদের কাঠচেরাইয়ের করাতি কারখানা। এখন যেজন্য এসেছি এখানে…আমাদের কাঠগুদামে আগুন লেগেছে হঠাৎ…

অ্যাঁ? আগুন? আঁতকে উঠলেন ভদ্রমহিলা, কী সর্বনাশ!

আজ্ঞে হ্যাঁ, সর্বনাশ তো বটেই…

হর্ষবর্ধনের দ্বিরুক্তিতে কর্ণপাত না করে ভদ্রমহিলা ততক্ষণে ফোন তুলে ধরেছেন…হ্যালো, দমকল…দমকল আপস? হ্যালো…

মেঘ না চাইতেই জল! বলতে না করতেই দমকল। এমন দয়াবতী সহানুভূতিপরায়ণা মহিলার ঢং-এর কথা বলছিল নাকি গোবরা? কিন্তু ঢং কোথায় ওঁর? ঢং তো কোনো দেখা যায় না। শোনাই যায় বরং। হবির্ধন নিজের দিব্যকর্ণে ঢং ঢং যেন শুনতে পান দমকলের…তার কাঠগুদামের সামনেই…

হ্যালো, দমকল আপিস? হ্যালো হ্যালো…শুনছেন?

হ্যাঁ বলুন। সাড়া এলো দমকলের থেকে।

দেখুন, অনেক সখ করে বাগানটা করা আমার। অনেক খর্চা হয়েছে এই বাগান করতে..।

কী বলছেন?

বাগানের কথাই বলছি। যতো দুর্লভ জাতের ফুল টুল, লতা পাতা এনে এনে লাগিয়েছি আমার বাগানে।

আগুনটা কোথায়? তাই বলুন!

এমন সব গোলাপের চারা এনে বসিয়েছি এখানে, যা আপনি আর কোথাও পাবেন …তার ওপর এমন করে কেয়ারি করা…এতখানি কেয়ার নেওয়া…

আগুন কি আপনার বাগানেই নাকি?

না, বাগানে কেন আগুন লাগবে?…কতকগুলো চারা এনে বসিয়েছি সুদূর অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড নিউগিনির থেবে, এসব আনাতে বসাতে অনেক পয়সা গেছে আমার…

কিন্তু আগুনটা কোথায় বাগলো বলছেন না তো?

এই ফুলবাগানই আমার দিনের কাজ, রাতের স্বপ্ন…আমার অবসরের বিলাস…আমার বাগানের ফুল যদি আপনারা দ্যাখেন তো দু চোখ জুড়িয়ে যাবে আপনাদের—অবশ্যি যদি ফুল দেখবার চোখ আপনাদের থাকে…ঝোঁক থাকে আপনাদের।

শুনুন মশাই… সঙ্গে সঙ্গেই দমকলওয়ালার প্রুফ সংশোধন শোনা গেল…শুনুন ম্যাডাম, আপনাকে বলি, ভুল জায়গায় ফোন করেছেন আপনি। ফুলের সখ থাকলে আপনার ফোন করা উচিত গ্লোব নার্সারি কি হটিকালচারের আপিসে, কিংবা সেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে। নাকি, কোনো ফুলের দোকানের খবর পেতে চান আপনি? ফুল যদি বেচতে চান তাহলে…

মোটেই না। ফুল বেচবার দরকার নেই আমার। তার প্রয়োজন কী বলুন? ফুল কি বেচবার বস্তু? তার কখনো দাম হয় নাকি? ফুল হচ্ছে আরাধনার জিনিস।…

আচ্ছা ফুলের পাল্লায় পড়া গেল তো, হর্ষবর্ধন আওড়ান আপন মনে। তারপর স্বগতোক্তির থেকে সম্ভাষণে আসেন…আগুন লাগার কথাটা জানান না একবারটি দয়া করে?

হর্ষবর্ধনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তিনি বলেই চলেন…আর আপনারা যে সামনের বাড়ি আগুন নেভাতে এসে আমার সাধের বাগান লণ্ড ভণ্ড করে দেবেন, ফুলের গাছ-টাছ মাড়িয়ে কেয়ারি টেয়ারি সব তছনছ করে দেবেন সেটি হচ্ছে না…।

কিন্তু আগুনটা কোথায় লেগেছে বললেন না তো? ঠিকানাটা দিন না! দমকলের থেকে তথাপি শুধালো। হর্ষবর্ধনের মনের প্রশ্নটাই পাড়লো যেন।  কোথায় আগুন? কোথায় না! হাটে আগুন, বাজারে আগুন, চালে আগুন, ডালে আগুন, পটলে আগুন, বেগুনে আগুন, আলুতে আগুন…আগুনকে আলুলায়িত করেও, তিনি ক্ষান্ত হলেন না… আমার মাথায় আগুন! আপনাদের ক্যাথায় আগুন! বলে রিসিভাব নামিয়ে রাখলেন অবশেষে।

বিরস মুখে ফিরে এলেন হর্ষবর্ধন। কী হলো দাদা? শুধালো গোবরা।

তুই যা বলেছিস…. বেজায় ঢং মেয়েটার…

বলেছিলাম তো! ঢং থাকলেই দমকল হয় না।

হলোও না। হলো না দমকল। বলে পথের ওপরেই বসে পড়লেন হর্ষবর্ধন। বসে বসে আগুনের ঢং দেখতে লাগলেন চোখের সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *