চার্লস ডিকেন্স : বিস্ময়কর ও জনপ্রিয় লেখক

চার্লস ডিকেন্স : বিস্ময়কর ও জনপ্রিয় লেখক

ইংরেজি সাহিত্যে সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা ও সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক হওয়াটা ছিল তার ভাগ্যনির্ধারিত। অথচ যখন প্রথম লেখা শুরু করেন, পাছে লোকে ঠাট্টা তামাসা করবে এই ভয়ে অত্যন্ত ভীত ছিলেন। তাঁর প্রথম লেখাটা তিনি গভীররাতে গোপনে ডাক বাক্সে ফেলে আসেন যাতে কেউ জানতে না পারে। বাইশ বছর বয়সে যখন তার গল্প সত্যি ছাপা হল, তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় ছুটাছুটি শুরু করে দিলেন পাগলের মতো। অবশ্য ওই গল্পের জন্য তিনি একটি সেন্টও পারিশ্রমিক পান নি। তার পরবর্তী আটটি গল্পের জন্যও তিনি কিছু পেলেন না। একটা গল্পের জন্য তিনি পান মাত্র পাঁচ ডলারের একটি চেক। তার এ গল্পটি তাকে পাঁচ ডলার এনে দিয়েছিল, কিন্তু তার শেষ পাণ্ডুলিপি তাকে প্রতিটি শব্দের জন্য এনে দিয়েছে পনের ডলার। অর্থাৎ সর্বযুগের সকল লেখকের মধ্যে এটাই ছিল সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক।

এই বিশ্ববরেণ্য লেখকের নাম, চার্লস ডিকেন্স। আজ থেকে একশ বছর আগে বড়দিনের সময় লন্ডনে একটা ছোট বই প্রকাশিত হল তাঁর। এর গল্পটা তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল। অনেকে এটাকে পৃথিবীর অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র বই বলে অভিহিত করেছে। যেদিন এটা প্রকাশিত হল ওইদিনই এক হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল। এক পক্ষকালের মধ্যে আরো পনের হাজার কপি ছাপা হল। তখন থেকেই এই বইয়ের অসংখ্য সংস্করণ রেব হয়েছে এবং পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় তার অনুবাদ হয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের এই জগৎবিখ্যাত বইটার নাম হচ্ছে ‘ক্রিসমাস ক্যারল।

গত একশ বছরে চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলো অসাধারণ রকমের বিক্রি হয়েছে। কেবল বাইবেল আর শেক্সপিয়ারের গ্রন্থগুলো ছাড়া এ যাবৎ আর কোনো বই-ই এত বেশি বিক্রি ও বাজার পেতে সক্ষম হয় নি। তাঁর লেখা উপন্যাস মঞ্চে এবং রুপালি পর্দায়ও দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

চার্লস ডিকেন্স কিন্তু চার বছরের বেশি একদিনও স্কুলে যাননি। কিন্তু তিনিই ইংরেজি ভাষায় সতেরটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। চালর্সের বাবা-মা একটা স্কুল চালাতেন কিন্তু চার্লস কোনোদিন সে স্কুলে যান নি। এটা ছিল যুবতীদের একটা স্কুল। সামনের দরজায় পিতলের ফলকে লেখা থাকত মিসেস ডিকেন্সের প্রতিষ্ঠান। অবশ্য লন্ডনের একটা যুবতীও এখানে শিক্ষালাভ করতে আসে নি। দেনার দায়ে ডিকেন্সের বাবার জেল হয়েছিল।

ডিকেন্সের শৈশব ছিল অত্যন্ত নোংরা ও কদর্যপূর্ণ আর বিষাদময়। তার বাবা যখন জেলে গেলেন তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর। তাদের পরিবারে খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। প্রতিদিনই সকালবেলা অন্নসংস্থানের জন্য বাড়ির একটা আসবাবপত্র বিক্রি করতেন বন্ধকী কারবারের দোকানে। খেয়ে বাঁচার তাগিদে তার প্রিয় দশটি বইও তাকে বিক্রি করতে হয়েছিল। বইগুলো বিক্রি করার সময় তার মনের করুণ অবস্থাটার বর্ণনা করেছেন, আমি যখন আমার বইগুলি বিক্রি করতাম, মনে হত আমার অন্তরটা বুঝি ভেঙে যাচ্ছে। অবশেষে ক্ষুৎপিপাসায় অস্থির হয়ে মা মিসেস ডিকেন্স চার্লসহ তার চার সন্তানকে নিয়ে স্বামীর সাথে জেলে বাস করতে গেলেন। প্রতিদিন সকালে চার্লস জেলখানায় যেতেন এবং পরিবারের সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে রাত্রিতে ফিরে এসে বাড়ির চিলেকোঠায় ঘুমোতেন। অতঃপর একটা ইঁদুরভর্তি গুদামঘরে কালো রঙের বোতল লেবেল আঁটার কাজ পেলেন তিনি। উপার্জনের প্রথম কয়েকটি পেনি দিয়ে চিলেকোঠায় একটা অন্ধকার খুপড়ির মতো ঘর ভাড়া নিলেন। ডিকেন্সের মতে এ ছোট্ট খুপড়িটাই ছিল তাঁর কাছে বেহেশত। পরবর্তীতে চার্লস তাঁর শৈশবের দৈন্যদশার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ।একটি অবিস্মরণীয় চিত্র এঁকে।

ডিকেন্সের লেখায় ছিল সুখী-সচ্ছল গার্হস্থ্য জীবনের মূর্তমান প্রতিচ্ছবি। অথচ তার বিবাহিত জীবনটা ছিল ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। এমন এক স্ত্রীর সঙ্গে তিনি বসবাস করেছেন তাকে চার্লস ভালোবাসতেন না। তাঁর স্ত্রী দশটি সন্তান জন্মদান করেন, বছর বছর তাদের দুরবস্থা বাড়তে থাকে। সমস্ত পৃথিবী যখন তার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল তখনো তার নিজের গৃহ ছিল নৈরাশ্যপূর্ণ। কিন্তু নিজের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে চার্লস এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন–তিনি পত্রিকায় ঘোষণা করে দিলেন যে তিনি এবং তার স্ত্রী পৃথক হয়ে গেছেন, এবং সম্পূর্ণ দোষটা স্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। ডিকেন্স যখন মারা যান তখন তার শালিকাকে এক মিলিয়ন ডলারের এক-পঞ্চমাংশ দান করে যান কিন্তু স্ত্রীকে দিয়ে গেলেন সপ্তাহে মাত্র পঁয়ত্রিশ ডলার। ‘ চার্লস ডিকেন্স সমালোচনা পছন্দ করেতেন না। তিনি তার দারুণ আকর্ষণীয় চেহারা ও দৈহিক গড়নের জন্য অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন।

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম আমেরিকায় আসেন তখন তার উজ্জ্বল লাল রঙের ওয়েস্টকোট হালকা নীল রংয়ের ওভারকোট গায়ে দিয়ে সকলের চোখ ধাধিয়ে দিয়েছিলেন। চার্লস ডিকেন্স ছিলেন তার সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি যখন আমেরিকায় আসেন তখন তাকে দেখার জন্য দলে দলে লোক ঠাণ্ডা বাতাসে হাঁড়কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে টিকেট কাটার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্রুকলিনে লোকজন তুষারপাত ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও প্রত্যেক দিন তার কথা শোনার সুযোগলাভের জন্যে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে সমস্ত রাত রাস্তায় মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিল। আর যখন টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে গেল, তার ভক্তরা তাকে দেখার জন্য মারামারি বাধিয়ে দিল। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস বহু চরিত্রে পরিপূর্ণ, কিন্তু সর্বাদিক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে চার্লস ডিকেন্সই ছিলেন সর্বাধিক বিস্ময়কর ও জনপ্রিয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *