গন্ধ

গন্ধ

কলকাতায় আবার বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়েছে। রাস্তাঘাট এবং সব সবুজ মাঠ যদি কোথাও থাকে প্রায় খালবিলের মতো। উত্তর থেকে হাওয়া এলে জানালা দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ থেকে হাওয়া এলে জানালা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের সময় দক্ষিণের হাওয়া প্রবল। গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রাম ভিজতে ভিজতে চলে যায়। কখনও সার সার থেমে থাকে। বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশ চুরমার করে দিয়ে বজ্রপাতের শব্দ নেমে আসে। তখন কেউ হুইসকি গলায় ঢেলে বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনতে ভালবাসে। ক্যাবারেগুলোতে মধ্যযামিনীতে উদ্দাম নৃত্যমালা। কলকাতায় যে বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়ে গেল, একেবারেই তখন তা বোঝা যায় না।

দেবদারু গাছটা ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে ভিজছে। সকাল থেকে বৃষ্টি। সারারাত বৃষ্টি গেছে। রাস্তায় জল জমছে। বাড়ছে। লোকজন হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, মেয়েরা শাড়ি তুলে, ছেলেরা প্যান্ট ভিজিয়ে জল ভেঙে যাচ্ছে। কলকাতার এ-সময়ের চেহারা কেমন পাল্টে যায়। নরকের মতো হয়ে যায়। এবং দেবদারু গাছটার নীচে যে সংসারটা ছিল সেটা থাকে না। কোথাও উধাও হয়ে যায়। এবং জল নামতে শুরু করলে, হাইড্রেন খুলে ফেললে দেখা যায় শহরের ওপর সব কাক উড়ছে। এ-সময়টাতে শহরে বোধ হয় কাকের উপদ্রব বাড়ে।

সকালে বিকেলে এভাবে বৃষ্টিপাতের ভেতর যখন কলকাতা ভিজছিল, যখন রাস্তায় মানুষের ভিড় উপছে পড়ছে এবং যখন সূর্য আর দেখা যাবে না বলে সবাই কোলাহল করছে তখন ফ্ল্যাট বাড়ির জানালায় একটা দুঃখী মুখ দেখা গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে। দেবদারু গাছটার নীচে জল উঠে এসেছে। ছেঁড়া নেকড়া, হাঁড়িপাতিল ভাঙা এবং দূরে সে টের পেল গাড়িবারান্দার নীচে সেই সংসারের বুড়ো মানুষটি হাঁটু মুড়ে পরিত্যক্ত রোয়াকে বসে শীতে কাঁপছে।

দুঃখী মেয়েটা বেশ সুখে ছিল। বাবা এই সুন্দর ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে। মা এখন আরও যুবতী হয়ে উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে রোজ সেই দেবদারু গাছ। একেবারে পরিপাটি সংসারের বাইরে বিশ্রী সাংঘাতিক কিছু। সে যে প্রথম দেখছে এমন, সে যে আর কখনও ভিখিরী অথবা ফুটপাথবাসিনীদের দেখেনি তা নয়। কিন্তু এখানে সে রোজ সকালে উঠে যখন স্কুলে যায়, দেখতে পায় বছর দু বছরের বাচ্চাটা পড়ে থাকে গাছের নীচে। ঘুমোচ্ছে। কিংবা কখনও বসে বসে খেলা করছে। ওর বড় বোনটা বসে বসে উকুন মারছে। এবং যখন স্কুল থেকে সে বেণী দুলিয়ে ফেরে, দেখতে পায়, কোত্থেকে সেই মেয়ে এবং মা সংগ্রহ করে এনেছে রাজ্যের পচা পটল, পেঁয়াজ, কুমড়ো, মাছের পচা নাড়ি-ভুঁড়ি, পাঁঠার মাথার কঙ্কাল। ভীষণ দুর্গন্ধে ওর পেট গুলিয়ে ওঠে। সিঁড়ি ভাঙার সময় সব সুখ কারা এভাবে কেড়ে নেয় তার। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বাথরুমে ঢুকে যায়। জল বমি করে ফেলে।

মা দৌড়ে আসে। রাণু আবার বমি করছিস।

—পেটটা আবার গুলিয়ে উঠল।

এভাবেই মেয়েটার অসুখটা আরম্ভ হয়ে যায়। ডাক্তার হাসপাতাল, হাসপাতালে গেলে কমে যায়, এবং বাড়ি ফিরে এলেই আবার কেমন তার অসুখ।—মা তুমি পাচ্ছ না।

—কি পাব।

—কেমন একটা গন্ধ!

—না তো।

সত্যনারায়ণ বাড়ি ফিরে শুনতে পায়, মেয়েটা আবার খাচ্ছে না। খাবার দেখলেই বমি করে ফেলে।

কি গন্ধরে বাবা! জানালাটা মা বন্ধ করে দাও।

সত্যনারায়ণ মোটামুটি হিসেবী মানুষ, সামান্য ক্লার্ক থেকে বড়বাবু অফিসের। এবং টাকা লেনদেনের ব্যাপারে চতুর। স্ত্রীর অভাব অনটন সে একেবারেই রাখে নি, যা যা চাই ফ্ল্যাট বাড়ি এবং ফ্রিজে নতুন, গোদরেজের আলমারি, এবং হিসেবী বলে একমাত্র মেয়ে রাণু। সংসারের কোথাও সে হিসেবের বাইরে নয়। পুত্রসন্তানের যে ইচ্ছে ছিল না, এমন নয়, কিন্তু যা হয়ে থাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে সে আর যায় নি। সে একটি হবার পরই সব থামিয়ে রেখেছে। এবং গতকাল এই শহরে বৃষ্টিপাতের ঠিক আগে সে দেখে এসেছিল, দেবদারু গাছটার নীচে, বৌটা আবার একটা বাচ্চা দিয়েছে। এই নিয়ে কটা বাচ্চা। সে ঠিক গুনে বুঝতে পারে না। ওদের কটা বাচ্চা, সে টের পায় না। বৌটার সঠিক স্বামী কোনটা। সে দেখতে পায়, তিন-চারজন পুরুষ, পরনে লুঙ্গি, কানে বিড়ি গোঁজা, গলায় তাবিজ, এবং সূর্যাস্তের মুখে তারা কোথায় চলে যায়। আবার সে কখনও দেখে বেশ আরামে বৌটার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে একটা বুড়ো মতো মানুষ। শহরের বাস ট্রাম তেমনি যায়। রাস্তায় লোকাভাব থাকে না, কলেজ এবং স্কুল ছুটি হলে সব সুন্দর সুন্দর দিদিমণিরা কত সব ফিসফাস কথা বলতে বলতে চলে যায়। সত্যনারায়ণ ভেবে পায় না তখন বৌটার কটা বাচ্চা! একটা দুটো না সহস্র। এবং যা হয়, সে রাস্তায় কোন অপোগণ্ড দেখলেই ভেবে ফেলে সেই বৌটার পেট থেকে বাচ্চাটা বের হয়েছে।

সত্যনারায়ণ দরজা জানালা সব বন্ধ করে রাখে। বলে, পাচ্ছিস।

—হ্যাঁ বাবা।

—কোথা থেকে আসে!

রাণু তখন চুপচাপ শুয়ে থাকে। আর কিছু বলে না।

এক টুকরো আপেল, ক’দানা আঙুর এবং নাসপাতি এনে দেয় মালতী। বলে, খা। খাতো মা। না খেলে বাঁচবি কি করে!

এই খাওয়া নিয়ে সংসারে এখন কত অশান্তি। মেয়েটা কিছুতেই কিছু খেতে চায় না। কেমন ভেতর থেকে তার দুর্গন্ধ উঠে আসে তখন। বাবার এত আয়াস, মার এমন যত্ন, তার কাছে তখন অত্যাচার মনে হয়। সে চিৎকার করে ওঠে কখনও, তোমরা সবাই মিলে কেন আমাকে মেরে ফেলতে চাও। আমি কি করেছি!

মালতী আর পারে না। ডাক্তার মজুমদার বললেন, খাওয়াতেই হবে। অসুখটা কি ঠিক তো ধরা যাচ্ছে না। সবই তো করালেন। ট্রপিকেলে রেখে দেখলেন। কোথাও কেউ শরীরে কোন ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছে না।

এবং এভাবে দিনে দিনে মেয়েটা যখন শুকিয়ে যাচ্ছিল, এবং সংসারে সত্যনারায়ণ যখন চতুর কথাবার্তা বলতে আর একদম সাহস পায় না, অথবা কোন বিল পাস করে দেবার ব্যাপারে একটা মোটা অঙ্কের টাকা হাতে এসে যায়, সে আর আগের মতো মালতীর হাতে দিতে ভরসা পায় না। কেবল মনে হয় কোথাও কোন দুর্গন্ধ উঠছে, সে ভেতো মানুষ বলে, মালতীর চর্বি জমেছে বলে টের পাচ্ছে না। মেয়েটার ভেতর এখনও সে-সব দুর্গন্ধ জমা হয় নি, বাইরের সামান্য অন্ধকার চেহারা তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।

সত্যনারায়ণ বলল, রাণু তোমার কিছু হয় নি। ওটা তোমার ম্যানিয়া।

রাণু ও-পাশ ফিরে শুয়ে আছে। পাখা ঘুরছে। কোথাও রেডিওতে বিবিধভারতী হচ্ছে, কোথাও কেউ পেট ভরে খেয়ে বড় ঢেকুর তুলছে এবং জানালা দিয়ে সেই অতীব দুর্গন্ধটা সারা বাড়ি ছেয়ে ফেলছে কেউ টের পাচ্ছে না। ওর হাই উঠছিল। জানালাটা বন্ধ করে দিলে ভাল হত। অথচ বন্ধ করে দিলেই কেমন দমবন্ধ ভাব। সে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। কপাল ঘামে। শরীরের সুচিতা কেমন নষ্ট হয়ে যায় তার। তখন চিৎকার করতে থাকে, মা আমাকে কোথাও নিয়ে চল। এ-ভাবে এখানে থাকলে মরে যাব।

মালতী হতাশ গলায় তখন বলে, রাণু তোমাকে নিয়ে পুজোর ছুটিতে গোপালপুর চলে যাব, আর কটা দিন, বাবার ছুটি হলেই আমরা চলে যাব। চলে গেলেই তুমি আর গন্ধটা পাবে না! তুমি নিরাময় হয়ে যাবে।

রাণু আবার চুপ করে থাকে। কথা বলে না। এমন সুন্দর মেয়েটা, কি ভারী চোখ তার, আর হাত-পা লম্বা হয়ে যাচ্ছিল, চুল বড় হয়ে যাচ্ছিল। শরীরে সব অমোঘ নিয়তিরা বাড়ে দিনে দিনে। তখন কিনা এই অসুখ। কিছুই খাওয়ানো যায় না। যতটা খায় তার চেয়ে বেশী বমি করে দেয়। উগরে দেয় যেন। ভেতরে কোন দৈত্য বাসা বেঁধেছে। সুখী মেয়েটাকে এমন দুঃখী করে রেখেছে এবং একদিন চোখের ওপর বুঝতে পারে মেয়েটা মরে যাবে।

সত্যনারায়ণ সেদিন দেবদারু গাছটার নীচে এসে থমকে দাঁড়াল। একটা মরা পায়রার ছাল ছাড়ানো হচ্ছে। পায়রা না ডাহুক, না কাক, সে আর এখন সঠিক কিছু বুঝতে পারছে না। বাতাসে সব পালক উড়িয়ে নিয়েছে। কেমন একটা পচা দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগতেই ওপরে জানালায় দেখল রাণু দাঁড়িয়ে দেখছে। আর তখনই কেন জানি ওর ইচ্ছে হচ্ছিল, লাথি মেরে এই বৌটির হাঁড়ি পাতিল, ছেঁড়া কাঁথা কাপড়, পলিথিনের বাকস সব ফেলে দেয়। দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। কতদিন পর ওর চোখের ওপর এই সব বেআইনী ইতর মনুষ্যকুলের নোংরা তৈজসপত্র তাকে গিলে খাচ্ছিল। রাণু কোন দিন বলে নি, বাবা, ওখানে গন্ধটা আছে। তুমি ওদের দূর করে দাও।

আর সত্যনারায়ণের মাথায় কেমন রক্তপাত আরম্ভ হয়ে যায়। সে চিৎকার করে উঠল, রাণু তুমি ওখানে। দাঁড়িয়ে কি দেখছ, যাও ভিতরে যাও! অথচ সে দেখছে, পাঁচ-সাতটা অপোগণ্ড শিশু সেই ছেঁড়া পায়রার মাংস ভারী যত্নের সঙ্গে ভাঙা এনামেলের প্লেটে কেটে কেটে রাখছে। সাদা ফ্যাকাসে মাংসের টুকরো। পচা গন্ধটা অবিরাম সুখ দিচ্ছিল যেন। সামান্য হলুদ লঙ্কা বাটা মাখিয়ে, একটু আগুনের দরকার, কোথা থেকে প্লাইউডের একটা ভাঙা বাকস টানতে টানতে নিয়ে আসছে। বুড়ো মানুষটা দা দিয়ে কোপাচ্ছে কাঠ, আর দু-তিনটে ইটের ওপর হাইড্রেনের জল তুলে সেদ্ধ করছে বৌটা, ওরা নোংরা শালপাতা এনে বাসি রুটি ভাগ করে বসে আছে। মাংসটা পোড়া সেদ্ধ। পচা গন্ধটা ওদের পেটে খিদের উদ্রেক করছিল। জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে সব কটা জীব। সামান্য হলেই হামলে পড়বে। পোড়া চিমসে মাংস পোড়া গন্ধ। মেয়েটা তখন জানালায় নেই। অবিরাম গন্ধবাহী বাতাস দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় সে যেন কোন শ্মশানে। মানুষের পোড়া মাংসের চামসে গন্ধের মতো উঠে এলে একদণ্ড সত্যনারায়ণ আর দাঁড়াতে পারল না! সে সোজা সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে দরজা জানালা বন্ধ করে দেবার সময় দৌড়ে গেল বাথরুমে। তারপর অক্ করে বমি করে দিল সবটা।

মালতী দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখছে। সহসা এই বমি সত্যনারায়ণের, সে কেমন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটা কথা বলতে পারছে না। রাণুর মতো একেবারে সোজা এমন একটা ঘটনা, ফের আর একজনকে আক্রমণ করবে এ-সংসারে সে কখনও ভাবে নি।

চোখে মুখে জল দিয়ে সত্যনারায়ণ বের হয়ে এলে বলল, কি হয়েছে! তুমিও শেষ পর্যন্ত? সংসার কি যে হবে!

সত্যনারায়ণ বলল, গন্ধ!

—কিসের গন্ধ!

—বারে পাচ্ছ না!

—না তো।

ঠিক রাণু যে-ভাবে বটিটমি করে চোখে-মুখে জল দিয়ে দাঁড়াত, কথা বলত, এবং শূন্যতা ফুটে উঠত চোখে, সত্যনারায়ণ ঠিক ঠিক হুবহু একইভাবে কথা বলছে।

মালতী বলল, তোমরা আমাকে পাগল করে দেবে? কিসের গন্ধ—আমি তো পাচ্ছি না।

—পাবে। বলে সে বসার ঘরে সোজা ঢুকে ডায়াল করল, হ্যালো, সুকুমার আছে?

—সুকুমার? আছে ধরুন।

সুকুমার বলল, কি দাদা, আমি সুকুমার বলছি।

—তোমার দাদাকে একটা খবর দিতে পার? যাতে একটা ব্যবস্থা হয়।

—কেন কি হয়েছে?

—আর বলো না, নীচে আমাদের দেবদারু গাছটার নীচে যা সব হচ্ছে না! দেশে কি কোন শাসন নেই! তোমার দাদা তো একজন কর্তাব্যক্তি।

—কি হচ্ছে বলবেন তো!

—পঙ্গপাল!

—পঙ্গপাল! কোথাকার!

—জানি না। বাড়িতে টেকা যাচ্ছে না। আমরা সবাই এবার মরে যাব। হতাশ গলায় বলে যেতে থাকল সত্যনারায়ণ।

—এই তো সেদিন ফ্ল্যাট কিনলেন! এত তাড়াতাড়ি হুজ্জোতি আরম্ভ হয়ে গেল। বুঝিয়ে বলুন না ওদের।

—কোন লাভ হবে না। তুমি একবার অবশ্যই আসবে! ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।

—কি হয়েছে বলবেন তো।

—না এলে বলা যাবে না।

সুকুমার এল সন্ধের একটু আগে। সারাক্ষণ সুকুমার আসবে ভেবে সত্যনারায়ণ জানালায় মুখ রেখে দাঁড়িয়েছিল। দেবদারু গাছটার নীচে এখন সেই বৌটা তার পঙ্গপাল নিয়ে বসে রয়েছে। একটা খঞ্জনী বাজিয়ে বুড়ো লোকটা গান ধরেছে। ছোট দুটো ছেলে বুড়োটার চার পাশে টুইস্ট নাচছে। রাস্তায় গাড়ি রিকশা তেমনি, নির্বিকার মানুষজন, এমন একটা পোড়া চামসে গন্ধ কারো নাকে লাগছে না। ওর তো সেই গন্ধটা সেই যে নাকে লেগে রয়েছে আর যাচ্ছে না। শনিবার বলে সকাল সকাল ছুটি! বেশ বড় রকমের দাঁও মেরে উল্লসিত, একদণ্ড অফিসে সে দেরি করে নি। সোজা বাড়ি ফিরে মালতীর হাতে গোছা গোছা টাকা দিয়ে কোন একাউন্টে কিভাবে জমা দিতে হবে, এবং মালতীর জন্য আর দুটো নতুন ডিজাইনের অলংকার এ-ভাবে ভেবেছিল, হাতে মুখে চুমো খেয়ে রাতে একটা থিয়েটার সেরে আসবে। রান্নার মেয়েটা বাড়ির পাহারায়। রাণু শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়বে। রাণু আজকাল একটু একটু খেতে পারছিল। বেশ নিরাময়ের ছবি আবার যখন ফুটে উঠেছিল চার পাশে, তখনই সে একটা পোড়া চামসে দুর্গন্ধে বমি করে দিল। সিঁড়ির গোড়ায় যারা থাকে, অর্থাৎ একতলার ফ্ল্যাটে, ওরা গন্ধটা পাচ্ছে না। পেলেও বোধ হয় আসছে যাচ্ছে না খুব একটা। সে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল, গন্ধটা আপনারা পাচ্ছেন না! ওরা কেমন নির্বিকার মুখে তাকিয়ে দেখছিল, সত্যনারায়ণকে। লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মেয়েটা তার কতদিন থেকে একটা গন্ধ পাচ্ছিল, এবার সে পেতে শুরু করেছে।

সে বলেছিল, পাবেন, আপনারাও পাবেন। বাড়ির সামনে এই সব বেওয়ারিশ মাল, অখাদ্য কুখাদ্য এনে জড়ো করছে, না পেয়ে যাবেন কোথায়।

এবং বৌটার খোলা বুকে একটা নতুন বাচ্চা, এই মনে হয় দু-চার দিনও হয় নি, একেবারে বুকের ভেতর মুখ লাগিয়ে রেখেছে। হাত-পা কাঠি কাঠি, সবুজ শরীরটা, আজ কি কাল, যেমন রাণু হবার সময় সে হাসপাতালে গিয়ে একদিনের বাচ্চা রাণুকে দেখেছিল চামড়া কোঁচকানো, এবং চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। আর তখনই জানালার নীচে সুকুমার, সে প্রায় স্বর্গ পাবার মতো চিৎকার করে বলল, এলে সুকুমার! পাশে দেখেছ?

সুকুমার চারপাশে তাকাল। সে এমন কিছু দেখতে পেল না। কোথাও কোন গণ্ডগোল নেই, কেউ বাস চাপাও পড়ে নি, কোন মৃতদেহ বাড়ির পাশে কেউ ফেলে রেখে যায় নি, বরং বুড়োটা তার দুই নাতি নিয়ে, দুজন যুবক ছোঁড়া, এবং কিছু বেশী বয়সের দু-তিনটে মানুষ গোল হয়ে কলকাতার আকাশ পরিষ্কার দেখে খঞ্জনী বাজিয়ে গান ধরেছে। পাশে পোস্টাফিসে আলো জ্বালা হয়ে গেছে। আকাশের মাথায় ভাঙা চাঁদ। দেবদারু গাছটা ভারী সজীব। সুন্দর মতো এক যুবতী স্বামীর সঙ্গে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। পান খেয়ে রাঙা ঠোঁট উল্টে পাল্টে দেখছে। কোথাও কিছু সে অস্বাভাবিক দেখতে পেল না। সত্যদার মেয়েটার ক’মাস থেকে কি একটা অসুখ, কখনও ভাল হয়ে যায়, কখনও বিছানা থেকে একেবারে উঠতেই পারে না—এসব খবর সে পেয়েছে। দু-চারবার সে দেখেও গেছে। কি একটা গন্ধ পায় সংসারে। মেয়েটা আসলে ভারী আদরে মানষ, ন্যাকা। একটুতেই ঘাবড়ে যায়। এমন একটা বয়সে বালিকারা ভারী কৌতূহলী হয়ে যায়। সংগোপনে সব কিছু দেখে বেড়াবার স্বভাব। আর কিনা মেয়েটা রুগ্ন বালিকার মতো জানালায় দাঁড়িয়ে থাকছে! ভেতরে আসলে সেই অসুখ হয়তো, বড় হতে গেলে কিছু অসুখ শরীরে আসবেই—সে এই সব ভেবে সিঁড়ি ভেঙে যত উঠছিল তত মনে হচ্ছিল, সত্যনারায়ণদা, ভারী মুসিবতে পড়ে গেছে।

সুকুমার বলল, কিছু তো দেখলাম না!

—কিছু না?

—না তো!

—তোমাদের চোখ নেই! তোমরা এত ভোঁতা মেরে গেছ।

সুকুমার অবাক। চোখ মুখ ভয়ঙ্কর রকমের ভীতু, ভূতটুত দেখলে এমন চোখ মুখ হবার কথা! সুকুমার মনে মনে বলল, তোমার মাথাটা গেছে। চুরি করে ফাঁক করে দিচ্ছ—ধরা পড়ে যাবে ভয়ে শালা তুমি এমন মুখ করে রেখেছ। পাগলামি করলেও রেহাই নেই। এবার চাঁদ সত্য কথাটা বলে ফেল।

সুকুমার বলল, রাণু কেমন আছে দাদা?

—দু দিন বেশ খাচ্ছিল, আজ আবার খেতে পারছে না গন্ধে!

—অনেক তো করলেন।

হঠাৎ কেমন অসহায় মানুষের মতো চেপে ধরল সুকুমারের হাত। বলল, তুমি বাঁচাও। তুমিই পার।

সুকুমার বলল, আপনি বসুন তো! উতলা হবেন না। বৌদি বৌদি! সে দরাজ গলায় ডাকলে, মালতী এসে দাঁড়াল সামনে। ওরও চোখ মুখ কেমন শুকনো। সেই নির্মল হাসিটুকু নেই।

—আপনাদের কি হয়েছে?

—জানি না ভাই। আর ভাল লাগছে না।

সত্যনারায়ণ বলল, থানায় তোমার দাদাকে একটু খবর দিতে হবে।

—কেন?

—দেবদারু গাছটা সাফ করা দরকার।

—গাছে কি হয়েছে?

—গাছের নীচে সব পঙ্গপাল। অখাদ্য কুখাদ্য খায়।

—খাচ্ছে খাক না। আপনার কি তাতে?

—নীচে যা তা সেদ্ধ করে খাবে, আর ওপরে আমরা থাকব। সে কখনও হয়? গন্ধ! বলেই যেন ছুটে বের হয়ে গেল সত্যনারায়ণ।

মালতী বলল, বুঝলেন।

—হুঁ বুঝছি। দেখি। এদের সরানো যায় কিনা।

সত্যনারায়ণ ফিরে এসে বলল, যা হয় কর একটা ভাই। আমরা না হলে মরে যাব। দু’দিন বাদে ঠিক মালতীও বমি করে দেবে। তখন আমরা তিনজন, আমি বলছি, কেউ বাদ যাবে না, পাশের ফ্ল্যাট, নীচে সবাই। আস্তে আস্তে সবাই পাবে। সবাই মরবে। একটা কিছু করো।

সুকুমার প্রথমে ওর দাদার কাছে গেল। ওর দাদা বলল, আইনে নেই। তাড়াবার কোন আইন নেই। শেষে স্মরণ নিতে হল ছেলেদের।

ওরা বলল, সরে পড়।

—কোথায় যাব বাবু!

—আমরা কি জানি কোথায় যাবে!

বুড়ো লোকটা বলল, চলে যাব বাবু। সকালে চলে যাব।

—এক্ষুনি। তোমাদের জন্য ভদ্রলোকেরা আর শহরে থাকতে পারবে না। সব অকর্ম-কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে, আমরা বুঝি জানি না।

ছেলেগুলো সব পোঁটলাপুঁটলি মাথায় নিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। হাঁড়ি-পাতিল বুড়ো মানুষটা। চুল সাদা, কানি পরনে, নাকের ভেতরে বড় গর্ত, কান বড় এবং লোমে ভর্তি। বুড়ো মানুষটা, দু বছরের বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলে আরও দু-চারজন এসে ঘিরে দাঁড়াল। এবং যা হয়ে থাকে বেশ সোরগোল পড়ে গেল। আর তখন যায় কোথায়। দৌড়ে পালাতে পারলে বাঁচে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওরা দৌড়ে কোথায় চলে যাচ্ছে। নিমেষে দেবদারু গাছটার চার পাশ কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। কিছু ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল, পোড়া ইঁট, দুর্গন্ধময় কিছু ছেঁড়া কানি, আর সব পচা জীবজন্তুর উচ্ছিষ্ট হাড় মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সত্যনারায়ণ জমাদার ডেকে জায়গাটা সাফ করে ফেলল, গঙ্গা জলে ধুয়ে দিল। শরীরে এবং চারপাশে যা কিছু আছে তার ওপর ওডিকোলন ছড়িয়ে এবং রাম রাম বলতে বলতে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল। তারপর দরজা জানালা খুলে দিল সব। রাণুকে নিয়ে জানালায় একবার দাঁড় করিয়ে বলল, পাচ্ছিস?

রাণু নাক টেনে বলল, না বাবা।

—এখানে?

—না বাবা।

—এদিকে আয়। দ্যাখ তো…?

—না বাবা।

তারপর সত্যনারায়ণ ভাল করে ঘর বারান্দা ধুয়ে দিতে বলল রান্নার মেয়েটাকে। যেখানে যা কিছু আছে সব তাতেই গন্ধটা লেগে আছে ভেবে জল দিয়ে একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলল। মাছ মাংস রান্না হল না। নিরামিষ আহার করল সত্যনারায়ণ। সত্যনারায়ণ এবং রাণু আজ কত দিন পর যেন পেট ভরে ভাত খেল।

আর আশ্চর্য সে রাতে শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ল। এবং নাক ডাকতে থাকল। কিছুক্ষণ পর নাক ডাকা বন্ধ হয়ে গেল। কেউ যেন তাকে ডাকছে।—অমা দেখ এসো কি ব্যাপার। সে উঠে গেল জানালায়। আবার নতুন কারা আসছে। এবার একজন দুজন নয়। সে দেখল, গাছটার নীচে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। চার পাশ থেকে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসছে। মাথায় হাঁড়ি-পাতিল, বৌ একটা নয়, একেবারে সার দিয়ে এবং সবার কোলে বাচ্চা। পাঁচটা সাতটা করে অপোগণ্ড, উলঙ্গ প্রায় তারা সব, চুল শণের মতো, এবং অভাবী মানুষ। ওদের সঙ্গে আছে সব পচা শাকসব্জি, উচ্ছিষ্ট খাবার। পচা পরিত্যক্ত মাছ-মাংসের হাড়। মাছি ভনভন করছে। কত দিন চান করে না এরা, যেন এরা শহরের সবকিছু অধিকার করে নিতে আসছে। এবং সে দেখতে পেল, অফিস কাছারী করতে পারছে না মানুষ, রাস্তা পার হতে পারছে না। ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছে। পার হতে সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মানুষেরা চার পাশে যারা আছে অক্ অক্ বমি করছে। চোখের ওপর একটা বেড়াল ছানা আগুনে লোহার শিকে সেঁকে নিচ্ছে আদিম বন্য হিংস্র এক মানুষ এমন সুসময়ে কলকাতার সব জুড়ে বসতে চাইছে সে। রাণু, মালতী সে পাশের ফ্ল্যাটে, নীচের ফ্ল্যাটে এবং সর্বত্র সেই অক অক জল বমি। প্রায় মহামারীর মত সব শহরকে গ্রাস করছে। এক প্রাগৈতিহাসিক জীবের মত ওদের সার। সে রাণু মালতীর হাত ধরে শহর লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। প্রায় আধমরা হয়ে আসছে। চোখ মুখ ছিটকে বের হয়ে যাবার মত। যেন এবার তারা কোণঠাসা করে মারবে তাকে। সব কলকাতা এ-ভাবে পঙ্গপালে ছেয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, সুকুমার বাঁচাও।

ওর ঘুম ভেঙে গেল। সে গলা শুকনো বোধ করল। জানালা খোলা। ভয়ে জানালার পাশে যেতে সাহস হচ্ছে না। জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মালতী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ও ঘরে রাণু। সে পা টিপে টিপে এগোতে থাকল। ওরা এখনও ঘুমোচ্ছে। তার চিৎকার পর্যন্ত শুনতে পায় নি। শহরের ফুটপাথে এত মানুষ যাচ্ছে টের পাচ্ছে না। সে কোন রকমে পা টিপে টিপে জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। আশ্বিনের বাতাস। দূরে ঢাকের বাদ্যি বাজছে। আর চাঁদের মরা আলোতে সে দেখতে পেল ভূতুড়ে দেবদারু গাছটা একাকী। নীচে একটা রাস্তার কুকুর শুয়ে আছে। গাছটার নীচে কেউ চলে আসে নি। কলকাতা আবার নিরিবিলি নিজের ভেতর ডুবে আছে। কলকাতা আছে কলকাতাতেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গন্ধ

গন্ধ

গন্ধ

দূরে সরে বসলে কেন?

এমনি।

এমনি? আমায় ভয় করো? আমার স্পর্শ বাঁচাচ্ছ? অচ্ছুত আমি?

না তো।

তাহলে কি আমি উঠে যাব?

প্লিজ না।

তাহলে? কাছে এসে বোসো। দেখছ না কী সুন্দর সবুজ জল টলটল করছে, জলের ভেতর পদ্মপাতা, পদ্মপাতার মধ্যে পদ্মের নাল, তার ওপর পদ্ম ফুটেছে, লাল পদ্ম, যাকে বলে কোকনদ!

তার ভেতরে মধু, মধুতে ভোমরা, ভোমরায়…

ঠাট্টা করছ? ঠাট্টা করে আসল কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইছ।

আসল কথা আবার কী?

ওই—এমন দিনে কাছে আসা যায়।

আচ্ছা, সঞ্জু তুমি কি সত্যিই জানো না কেন তোমার কাছে বসছি না?

না সত্যিই না, কেন? জিজ্ঞেস করছি তো?

কস্তুরীমৃগ তো শুনেছি আপন গন্ধে পাগল হয়।

হঠাৎ? কস্তুরীমৃগ?

সঞ্জু সঞ্জু। ডোন্ট মাইন্ড, তুমি এই টেরিলিনের শার্ট পর কেন? ভয়ানক দুর্গন্ধ বেরোয় ঘামের। তুমি কি সত্যিই পাও না?

এই কথা? টিভির বিজ্ঞাপন? ঘামের গন্ধ পৌরুষের গন্ধ তা জানো?

তুমি কি তাই ভেবে সান্ত্বনা পাও? ঘাম, রক্ত, স্বেদ, এইসব এইভাবে ভাবো?

আমি কিন্তু ওভাবে ভাবি না। পৌরুষ হল নিজেকে শুদ্ধ সুরভিত করা।

অর্থাৎ আফটার শেভ লোশন। চামড়ায় গন্ধঅলা পারফুম, ও ডি কোলন…

না সঞ্জু, নিজেকে শুদ্ধ সুরভিত করা মানে এই গরমের দিনে অন্তত চারবার অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে চান, সুতির পোশাক পরা, গায়ে কষে প্রিকলি হিট পাউডার…

আবার টিভির বিজ্ঞাপন? স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য রক্ষায় লিভোসিন, ট্রিংলিং।

সঞ্জু, ঘামের গন্ধ মানে কিন্তু সত্যিই ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ! সত্যিই কিন্তু তার থেকে বাঁচতে হলে চান চাই, সাবান দিয়ে, লেবু-গন্ধ-অলা হলে ভালো হয়।

সামান্য ঘামের গন্ধের জন্যে আমাদের প্রেম আটকে থাকবে?

গন্ধকে তুমি সামান্য বলছ সঞ্জু? রক্তের গন্ধে লেডি ম্যাকবেথ যে পাগল হয়ে গেলেন। বারবার ধুয়েও সে রক্তের গন্ধ তাঁর অন্তঃনাসা থেকে কিছুতে গেল না।

সে তো আসলে রক্তের গন্ধ নয়। পাপের গন্ধ।

ঠিকই। কিন্তু পাপের চেতনা প্রকাশ পাচ্ছিল রক্তের গন্ধের ভেতর দিয়ে। সঞ্জু আমি আজ যাই। …

টিলটিল এত দ্রুত চলে গেল যে সঞ্জু তাকে নিবৃত্ত করবার উদ্যোগই নিতে পারল না। খোলামেলা পার্ক-জাতীয় জায়গায় কারও পশ্চাদ্ধাবন করাটা খুব গণ্ডগোলের দেখাবে—এটা তার খেয়ালে ছিল। কিন্তু মনে মনে সে দৌড়াচ্ছিল। মরিয়ার মতো। ওই টিলটিল চলে যায় টিয়ে রঙের বসন গায়ে। চলার তালে টিলটিলের একটা হাত দুলছে, যেন হাতির দাঁত দিয়ে গড়া। না হাতির দাঁত নয়, সে তো শক্ত ব্যাপার, ময়দা—ধুর সে তো সাদা থ্যাসথেসে। তবে? তবে? তবে? নাঃ পাওয়া গেল না। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে টিলটিলের দোল-খাওয়া চুল। সোজা, প্রপাতের মতো নেমে এসেছে মুসৌরির কেম্পটি ফলস। ধ্যাত কেম্পটি দুটো সরু সরু বিনুনির মতো। টিলটিলের বিধাতা কি অত কৃপণ নাকি? তবে কি উশ্রী? না বাবা উশ্রীর মধ্যে একটা বন্য উদ্দামতা আছে, যাই বলো। এ কেমন কেশ, যাকে কেশ বলে মনে হয় না? ধুনুচির ধোঁয়ার মতো! শীতের ভোরের কুয়াশার মতো! এ যেন টিলটিলের টিলটিলত্বেরই একটা নাটবল্ট।

এমন করে বুঝি টিলটিলকে কখনও দেখেনি সঞ্জীবন। যেন তার জীবনের, তার সমস্ত সত্তার, সমস্ত প্রার্থনার নির্যাস একটি আঁকাবাঁকা টিয়া রঙের রেখা হয়ে চলে যায়। ঝুলির ভেতর থেকে দ্রুত স্কেচবুক বার করে সে, বেছে বেছে একটা দশ! বারো নম্বরের নরম পেন্সিল। ক্ষিপ্র আঙুলে এঁকে ফেলে তার প্রার্থনার প্রস্থানরেখা। দুটো তিনটে স্কেচ করে। তাই টিলটিল যে পুব ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল, এক ঝিলিক হাসল, সেটা সে দেখতে পেল না। পেলে হয়তো স্কেচ কয়েকটা বাড়ত। এগুলো বাড়ি গিয়ে জলরং আর ক্রেয়ন মিশিয়ে আঁকতে হবে। ক্রেয়নে জল ধরবে না। কিন্তু ক্রেয়ন আর জল রঙের সম্মিলনই হবে সেই মাধ্যম এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে যায় বাগানের ঘাসের দিকে চেয়ে। কেন না ওই ঘাসগুলোর মধ্যে যেমন একটা খাড়া খাড়া ব্যাপার আছে, গোটা গোটা গোছা-গোছা ব্যাপার আছে, তেমনি আবার আছে একটা দ্রবীভূত ছাপকা ছাপকা ব্যাপার, যেন ব্লটিং পেপারের ওপর কালি ছেপে উঠেছে। টিলটিলের চুল জলরঙের। তার শাড়িটা জলরঙের। দুলন্ত হাতটি ক্রেয়নের কিন্তু হাতের ভঙ্গিতে জলরং কিছু নেমে এসেছে। এই আর কি?

তা এখন তৃতীয়বার সঞ্জু চান করছে। চতুর্থটা শোবার আগে করবে। চান করে সঞ্জু সাদা টার্কিশ তোয়ালে দিয়ে ভালো করে গা মুছে পাউডার ঢালে অকৃপণ হাতে। ঘাড় থেকে পাউডার মুছে নেয় সযতনে। ঘাড়ে-পাউডার-তরুণ সে দেখতে পারে না। খাদির এই পাঞ্জাবিটা নতুন কিনেছে সে, বেশ আলগা আলগা, জিনস, পায়জামা, পপলিনের, নতুন। বউদিকে অনেক খোশামোদ করে এই পোশাকটা জুটেছে, শেষ মাসে পকেটে কিছু বিশেষ ছিল না।

দাড়ি ধুয়েছিস?–বউদি।

হ্যাঁ।

আঁচড়েছিস?

আজ্ঞে।

বউদি ফট করে একটা কী যেন তার সারা গায়ে স্প্রে করে দিল। এত দ্রুত যে সে নিবৃত্ত করবার সময় পেল না।

লাইফটা হেল করে দিলে।

নিজের বুকে হাত দিয়ে বল। হেল-হেল লাগছে না হেভন-হেভন লাগছে?

যাও যাও, বেশি দিক কোরো না।

বড়ো ভালো লাগছে দিনটা আজ। বিকেলটি হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। অবিরল—মাইটি ট্রেড উইন্ডস ব্লোয়িং। সেই হাওয়া পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকে সদ্যস্নাত ত্বককে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এত আরাম যে খলবলিয়ে হেসে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটা সিগারেট ধরায় সঞ্জীবন। প্রচুর মানুষের বিপরীতমুখী স্রোতের উজানে চলে যায় সে স্বেচ্ছায়। ঘাম, স্বেদ, রক্ত, যদিও ঘাম আর স্বেদ একই তবুও কেমন একটা জোর আসে যেন দুটোকে আলাদা আলাদা ব্যবহার করলে, এসব আপাতত তার উলটো দিকে। কে কাকে খিচিয়ে উঠল,

কী দাদা, চোখে দেখতে পান না? পেল্লাই জুতোপরা পা-টা আমার হাঁটুতে তুলে দিলেন! ছি ছি!

দেখে দেখে দিয়েছি বোধহয়? ভিড়টা এমনই যে আপনিও কাজটা করতে পারতেন।

আবার উলটো চাপ দিচ্ছেন…

সঞ্জীবন পেরিয়ে যায়। বাসে সে উঠবে না। রবীন্দ্রসদন চত্বরে সে হেঁটে হেঁটেই যাবে। তারও পা একজন মাড়িয়ে দিল। বেশ লাগল। চটিতে যথেষ্ট ধুলোও। সে শুধু বলল, এ হে হে হে।

আরে দাদা, মাফ করে দিন। বড্ড ভিড়।

সঞ্জীবন পেরিয়ে যায়—পার্কস্ট্রিটের মোড়ে তো লালবাতির জন্যে আধঘন্টা দাঁড়াতে হল। এপারে অপেক্ষারত একটা গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত এক ভদ্রলোক, মানে বেশ টাই পরা ভদ্রলোক, বললেন, শ শালা! চান করেছেন কোন সকালে। বড়ো বড়ো অফিসে তো ভালো টয়লেট থাকে। শাওয়ার থাকে না? চানটা করে বেরোলেই পারতেন ভদ্রলোক, একটা চেঞ্জ রেখে দিতেন অফিসে–চান করে টাটকা জামা-কাপড় পরে এক কাপ চাফি খেয়ে নিয়ে বেরুলে এই ট্রাফিক জ্যামটার মোকাবিলা করতে পারতেন। থিয়েটার রোডের ওখান থেকে রাস্তাট ক্রস করে নিল সঞ্জীবন। ও-ফুট দিয়ে গেলে আর মোড়ে অসুবিধে হবে না। কেমন ইচ্ছে করল চার্চের পাশ দিয়ে, চার্চ নয় ক্যাথিড্রাল, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর পাশ দিয়ে যাবে। একটু ঘুর হবে-টিলটিলকে হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে। তা হোক। টিলটিল সে সময়টা রাগ-টাগ না করেই কাটিয়ে দেবে এখন। অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সঞ্জীবনের মনে পড়ল বছর তিনেক আগে এখানেই তাদের বিপ্লবী শিল্পী সংঘের প্রদর্শনী হয়েছিল। খুব সফল হয়েছিল সেটা। তার পাঁচটা ছবির একটা সিরিজ ছিল। সব বেনারসের বিভিন্ন ঘাট। সুষ্ঠু রঙের ফুচকি (ফুটকি বেশ গোল একটি বিন্দু, কিন্তু বিন্দুটা যদি সুগোল না হয় ব্লচ মতো হয়, ত্যাড়াব্যাঁকা বা রং ছেটকানো, তাহলে সেটা ফুচকি < সঞ্জীবন) দিয়ে আঁকা দশাশ্বমেধ ঘাটের ছবিটা খুব প্রশংসা পেয়েছিল। বিক্রি হয়েছিল সবারই দু-একটা করে, শুধু অনন্ত ঘড়াইয়ের একটাও বিক্রি হয়নি। ঘড়াই বিড়ি খেত, ভাঁড়ে চা পছন্দ করত, তার গুরু-পাঞ্জাবির কলার সদাই ফাটা। এবং বোতামপটির ফাঁকা লম্বাটে ত্রিভুজ দিয়ে তার আশ্চর্য ঘন নোম বিশিষ্ট সরু বুক এক চিলতে দেখা যেত। সেই থেকে ঘড়াই তাদের বিপ্লবের প্রতীক হয়ে গেল। হাতে চায়ের গনগনে গরম ভাঁড় নিয়ে যে চা না চলকে হা-হা অট্টহাস্য হাসতে পারে, যার পায়জামার বড়ো বড়ো ঘেরের মধ্যে পা কোথায় বোঝা যায় না, অথচ যে না-ঠো কর খেয়ে যেন শূন্যে ভেসে যাওয়ার মতো চলে যেতে পারে, সে নেতা হবে না তো কী? ঘড়াইয়ের ডেরায় ঘাম, স্বেদ, রক্ত, আবার সেই ঘাম স্বেদ, তা ছাড়া গাঁজা-বিড়ির ধোঁয়ায় একটা ক্রিয়েটিভ নরকস্বর্গ কি তৈরি হত না?

বাঃ। তুমি তো এসে গেছ?

গেলাম। কোনো অসুবিধে হল?

না অসুবিধে কী? ফোয়ারা দেখছিলাম।

এখানেই বসব, না কী?

এখানে আধঘন্টা বসেছি, একটু ঘোরা যাক না।

একটু বসা যাক না, সেই ব্লকম্যান স্ট্রিট থেকে এই অবধি হেঁটে এলাম।

সে কী? কেন?

এই সময়ে কি বাসে ওঠা যায়? যা ঠেসাঠেসি! গরম! ঘাম! দুর্গন্ধ!

ও মা, তুমি তো আজ চান করে এসেছ মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ কাছে বসতে না পারো, পাশাপাশি হাঁটতে অন্তত পারো। মানে বোধহয়।

ও মা কী সুন্দর চুল পাট করে আঁচড়ানো। দাড়িতে কি শ্যাম্পু দিয়েছ? ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে, পাঞ্জাবিটা কি নতুন?

ইয়ার্কি হচ্ছে?

ও মা, ইয়ার্কি হবে কেন? জ্যাঠাবাবুর সঙ্গে কেউ ইয়ার্কি করে? দাদু হলেও বা কথা ছিল। তোমার বসা হয়েছে?

নাহ। তবে তোমার যখন হয়ে গেছে তখন আমার হতেই হবে।

এ কথার মানে?

মানে তো বোঝাই যাচ্ছে। কীর ইচ্ছায় কর্ম।

বাবা! বাবা! বসছি। তোমার বিশ্রাম হলে বলবে। ওমা লেবু লেবু গন্ধও তো বেরোচ্ছে? দাঁতও যেন সদ্য সদ্য মাজা।

নখও কাটা। হাতের এবং পায়ের।

যাতে হেমচন্দ্রের মতো লাথি কষালে নখের খোঁচা টোঁচা লেগে গিয়ে টেল-টেল টিট্যানাস না হয়!

টেল-টেল টিট্যানাসটা কী?

আঁচড়ের দাগটাই তো লাথির গল্পটা বলে দেবে, টিট্যানাসের কারণ নির্ণয়ের জন্যে ডাক্তারকে বেশি খোঁচাখুঁচি করতে হবে না। কবে পড়ে গিয়েছিলেন? কোথায় লাগল? কীসে কেটে গিয়েছিল? ইত্যাকার।

অফ অল থিংস হেমচন্দ্রের লাথিটাই মনে পড়ল কেন এ রহস্যটা…

এমনি। ওটা আমৃণালিনী নারীসমাজের মনের মধ্যে এমন একটা ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে যে প্রেমিক দেখলেই মনে পড়ে।

অ! সঞ্জীবন টিলটিলের প্রেমিক বুঝি?

আমার তো তাই ধারণা!

সেইজন্যেই সঞ্জীবন টিলটিলের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসুক এবার।

তা বসুক, কিন্তু দাড়ি-অলা মুখখানা অত এগিয়ে আনবার কী দরকার?

এইজন্যে যে তাক বুঝে টুক করে একটু খেয়ে নেব।

টিফিন এনেছ পকেটে করে? তা খাও না! খেতে আবার লজ্জা কী? মেয়েরাও আজকাল পাবলিকে খেতে লজ্জা করে না।

খাব? খাব?…খাই?

কী খাবে? সর্বনাশ! আমি চললাম।

টিলটিল দিস ইজ ভেরি ভেরি আনফেয়ার।

লোক দেখিয়ে খাবে?

সেটুকু সেন্স আমার আছে, ওই কর্নারটা টার্ন নেবার সময়ে এদিক ওদিক দেখে ছোট্ট একটু।

ওটা একটা সাংস্কৃতিক জায়গা, সেটাকে অশুচি করার কথা তোমার মনে এল? অশুচি? আই বেগ টু ডিফার দিদিমণি। কত সাহিত্য কত গান এই চুম্বন বেজড। সেইসব সাহিত্যের গানের চর্চা হচ্ছে এখানে…

তাই চুম্বন-চর্চাও হবে?

না, তা আমি বলছি না। অতটা বলতে পারা যাবে না। তাহলে আরও অনেক রকম চর্চাও হবে। তা নয়, অশুচি কথাটাতে আমার আপত্তি।

অশুচি কথাটা তুলে নিচ্ছি, আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম অনৈতিক, অসামাজিক।

প্রত্যেকেটা শব্দই বেশ প্রগাঢ় তর্কের মধ্যে এসে যাচ্ছে। ও পথে হেঁটে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং চলো তোমায় পৌঁছে দিই। একটি নির্জন ট্যাক্সি করে।

তার চেয়ে চলো একটা হোটেলে ঘর বুক করি।—রাগে, শ্লেষে, ক্ষোভে কষকুটে শোনাচ্ছে টিলটিলের গলা।

দিস ইজ ভেরি ভেরি অনফেয়ার টিলটিল। আমি যদি ওই লোকেদের দলে পড়তুম, তুমি তাহলে অনেক আগেই টের পেতে। আ অ্যাম আ ম্যান অব অনারেবল ইনটেনশনস।

তা হলে চলো ট্যাক্সি করো।

তোমার কাছে কত টাকা আছে টিলটিল?

আমার কাছে? আমার কাছে টাকা থাকবে কেন?

ট্যাক্সির জন্যে।

তুমি আমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দেবে, তার জন্যে টাকা দেব আমি? কী বলছ। সঞ্জু? আমার তো…আমার তো মনে হবে তুমি আমার একজন রক্ষিত।

আমি ভাড়া দিলেই তা হলে তুমি রক্ষিতের স্ত্রীলিঙ্গ?

না, কখনোই না, কখনো না। ছেলেদের দায়িত্ব হল মেয়েদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া। চিরদিনের সামাজিক দায়, নটউইথস্ট্যান্ডিং নারীমুক্তি। আমি চললাম। বাসে মিনিবাসে। ন্যাচর‍্যালি।

খুব ক্ষিপ্রপদে টিলটিল চলে যায়। অন্ধকারে তার শাড়ির হলুদ সামান্য চমকায়। রেখা আপাদমস্তক দেখা যায় না যেন একটা ঝিলিক, তারপর অন্ধকার। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নন্দন। চারপাশে সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের ভিড়। প্রাকৃতিক অন্ধকারের সঙ্গে বৈদ্যুতিক আলোর মেশামেশিতে বেগুনি কুয়াশা।

সঞ্জীবন দৃশ্যটির দিকে মুখ করে স্থাণু থাকে।

রাত।

সিগারেটের টুকরোর পর টুকরো জমে যাচ্ছে। পায়চারি করে করে চটির তলা ক্ষয়ে গেল। অন্ধকারে জ্বলছে নিভছে ও কী? সিগারেটের মুখ? না সঞ্জীবনের চোখের আগুন?

আমি যেমন আমাকে তেমনিই নিতে হবে।
আমি স্বেদে স্বেদে দুর্গন্ধ
রাজপথ ছেড়ে বেছে নিই খানাখন্দ
দাড়িতে দাড়িতে দাড়িয়াল
আমি কাটি না নখর রাখি স্বাক্ষর
কাদাতে মাটিতে মাটিয়াল
আমি চলি না কারুর মতে
হাত বুলোই না নিজেরও হৃদয়ক্ষতে
আমি ধি ক্কার হানি, ধিক! ধিক!
বিদ্রোহী আমি নির্ভীক
আমার দাড়ি ওড়ে ঝোড়ো বাতাসে
আমি পড়েছি এবার সাতাশে
আমি শ্রেণি-সংগ্রাম মানি
পাতিবুর্জুয়া মাস্টারদের ঘোরাবই আমি ঘানি
যাব না তোদের মঞ্চে
আমার ক্যানভাস গ্রামে গঞ্জে
আমি যেমন আমাকে পারলে তেমনই নিক
শত টিলটিল গারদের
আমি পালাব বাঁকায়ে শিক।

একদম শেষরাতে যখন সন্ধ্যাতারা ভোরের শুকতারা হয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারছে তখন ইজেলে ক্যানভাস চড়ায় সঞ্জীবন। টেম্পারায় অন্ধকার। অন্ধকারে বেগুনি আভাস, কেমন আভাসিত অন্ধকার। অন্ধকারে নন্দনের সত্যজিৎকৃত অলংকৃত পাপেন্ডিকুলার। ফ্রস্টেড লাইটের আয়োজন সব যেন ইউফোর মতো ঘুরছে। তাদের ডাঁটি নেই। অন্ধকারে ভূতেদের আনাগোনা, কালোর মধ্যে আরও কালো, কিংবা ছাই-ছাই, কিংবা ধুপছায়া, কিংবা বেগুনির মধ্যে অতিবেগুনি বিন্দু সব। খালি একটা হলুদ বিদ্যুৎ চমকাতে চমকাতে যাচ্ছে। সাত দিনের একটু বেশি লাগল শেষ হতে। সোয়া সাত দিন ধরো। এ কদিনে চৰ্য্য শুধু পাঁউরুটি আর ডিম, চোষ্য শুধু নিজের হাতের আঙুল, লেহ্য সিগারেট, পেয়—চা এবং দিশি।

শেষ হয়ে গেলে চান করে, ভাত খেয়ে, ঘুম।

ঘুমের মধ্যে কোন দূর বিদেশ থেকে যেন আই, এস. ডি এসেছে। বউদি ডাকছে সঞ্জু, সঞ্জু, ফোন, ফোন।

খুনখারাবি চোখ মেলে সঞ্জু বলে—আহ!

কী মুশকিল, ফোনটা তোমার, টিলটিল।

ঘুমের মধ্যে আমরা অতীতে থাকি। কিংবা ভবিষ্যতে। সেই অনাগত বিধাতার দেশ থেকে এক ঝাপটা আকুলতার বৃষ্টির মতো টিলটিল নামটা এল।

আধঘুমন্ত সঞ্জু লাফিয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। বউদি উঠতে সাহায্য করে। গা হাত-পা যেন প্যারালাইজড হয়ে ছিল।

কে?

বউদিকে তো বললাম আমি টিলটিল। তোমার গলা এত ভারী কেন? আবার গাঁড়ি খাচ্ছ?

গাঁড়ি হল গাঁজামেশানো বিড়ি।

দুম করে অন্ধকার ভেদ করে টর্চলাইটের মতো বর্তমান ফিরে এল। ফোনটা রেখে দিতেই যাচ্ছিল সঞ্জীবন কিন্তু ওদিক থেকে ভেসে এল, কতদিন তোমায় দেখি না।

ব্যস্ত ছিলাম।

তা তো থাকবেই। নতুন কিছু কাজ হল?

হচ্ছে।

আমাকে একটুও সময় দিতে পারবে না?

সময় চিনেবাদাম বা ঝালমুড়ি নয়।

সে তো জানি। আসলে আমার ভীষণ হিট ফিভার হয়েছিল। এখন জ্বরটা গেছে কিন্তু খুব দুর্বল। তাই।

ব্লাড-প্রেশার কত?

ষাট-একশো।

যাঃ।

অন গড। সুগার সত্তর। পুরো এক মাসের ছুটি নিয়েছি।

আচ্ছা রেস্ট নাও, আসছি। …

বিদ্যুৎ আর নেই। আকাশ থেকে নেমে এসে এখন মাটিতে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। করুণ বিভঙ্গে। মাচা নেই, কোনো বনস্পতি নেই যার খাঁজটাঁজ আশ্রয় করে দাঁড়াবে। আরামচেয়ারে সেই ছিন্নভিন্ন আলোকলতা রক্তহীন, তেজহীন, নিঃস্ব পলকা পড়ে রয়েছে। আরামচেয়ারের হাতলে এক কাপ দুধ।

সঞ্জু তুমি দেখো তো যদি খাওয়াতে পায়। কখন নিয়েছি। এখনও যেমন কে তেমন।-অনাথা লতার দিদি বলছেন।

খেতে কি আমার অসাধ? বমি পায় যে!

একটু একটু করে খাও।–সঞ্জীবন কাপটা মুখের কাছে ধরে।

চুমুক দেবার একটা মৃদু শব্দ হয়। পেটের মধ্যেটা কেমন শিরশির করে সঞ্জীবনের সেই শব্দে। একটু দুধ যে চলকে পড়ল? যাঃ গলার কাছে ছাপা কাফতানের বেশ খানিকটা ভিজে গেল।

ওই যে কুঁজো রয়েছে, গেলাসে করে জল আনো, এখুনি এটা ধুয়ে ফেলি, নইলে চটচট করবে।

জ্বরের ওপর জল?

এ তো হিট ফিভার? জলেই তো নিরাময়।

তুলো নাও, হ্যাঁ তুলোটা ভিজিয়ে দাও। … তুলো ভিজিয়ে সঞ্জীবন নিজেই দুধেভেজা কাফতানের গলা মুছে নেয়।

ওয়ার্ক, ওয়া, ওয়াক—

মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল সঞ্জীবন, সোজা হয়ে যায়।

কী হল?

দাও, শিগগিরই।

প্লাস্টিকের একটা গামলা দেখতে পায় সঞ্জীবন। ধরে মুখের কাছে।

হোয়াক, হোয়া হোয়ক।

নাঃ, কোঁতানিই সার, বড়ো ভয় হচ্ছিল দুধটা না বেরিয়ে যায়। তা বেরোল না।

দুধ খেলেই কি তোমার এমন হচ্ছে?

কাঠ-বমির কষ্টে চোখ দুটো ছলছল, টিলটিল বলল, সব সময়ে না। এখন তো নাই-ই।

তবে?

কী জানি, এমনি।—বড্ড দুর্বল গলা। চোখ বুজে আসে টিলটিলের। কিছুক্ষণ পর করুণ চোখের পাতা খুলে যায়। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, তুমি কি…তুমি কি গাঁড়ির সঙ্গে তাড়িও— আর বলতে পারে না, চুপ করে যায়, চোখ দুটো আবার বুজে আসে।

আমি কাছে এলেই যদি এত গন্ধ লাগে টিলটিল তাহলে…

টিলটিল চুপ।

কাজ করার সময়ে এগুলো তো আমার খেতেই হবে টিলটিল।

টিলটিল চুপ।

আর খেলে তো গন্ধ আসবেই, যতই চান করি আর পাউডার মাখি আর এলাচ চিবোই।

হোয়াক—একটা তীব্র বমির শব্দ কোনোক্রমে ঠেকায় টিলটিল। তারপর কোনোমতে বলে, সরি সঞ্জু। বমি একটা বিশ্রী ব্যাপার। এই অসুখবিসুখ এসব বিশ্রী, তুমি যাও। তোমার সামনে আমার কেমন লজ্জা করছে।—এতটা কথায় সে হাঁপায়।

আমি কিন্তু বাস্তবকে ঘৃণা করি না টিলটিল। অসুখ আমাদের সবারই করে। অসুখ করলে বমিটমি খারাপ ব্যাপার থাকেই। সেগুলো থেকে পালাবার মুখ ফিরিয়ে থাকবার বিন্দুমাত্র কাপুরুষতা আমার নেই। এগুলো জীবনের মৌলিক কষ্ট। মৌলিক বিপদ।

কিন্তু তোমার গন্ধগুলো তো তোমার মৌলিক গন্ধ নয় সঞ্জু।

আচ্ছা আমি যাচ্ছি।

এবার অন্যরকম প্রস্থানপর্ব। যে সাধারণত প্ৰস্থিত হয় সে শুয়ে আছে, তার অসুখে রোগা সাদা শরীরে একটা আতুর সমর্পণ, একটা ঘুমন্ত জেহাদ, আবার একটা বাধ্যতামূলক আত্মত্যাগের উদ্যোগ। যে যাচ্ছে সে পুরুষ, তার জীবনের প্রয়োজন অপ্রয়োজনগুলোর একটা সঠিক হিসেব-নিকেশ সে এইমাত্র পেশ করেছে। সেই ঔদ্ধত্য, সেই রিলিফ তার চলায় ফেরায়। শুধু একটু ভুল হল। ঘরটা পার হবার পর সঞ্জীবন একবার, একটিবার মাত্র মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

টিলটিল তাকিয়ে আছে। তার দিকে। অপলক। দু চোখ দিয়ে সরু ধারা।

আলো জ্বলছে। সারারাত। এ বিলাসিতা তাদের মানায় না। সঞ্জীবন জানে। দাদা কয়েকবার দেখে গেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল শেষবার। বউদি একটা ফ্লাস্ক দিয়ে গেছে তাতে চা।

একটা দীর্ঘ গাঁড়ি ধরাল সঞ্জীবন। ক্যানভাসের দিকে চাইল। অমনি ক্যানভাসের ওপর একজোড়া বোজা চোখ ফুটে উঠল। গাঁড়িটা টিপে নিবিয়ে দিল সঞ্জীবন। জল ঢেলে দিল অ্যাশট্রেতে। ফ্লাস্ক থেকে অস্থির হাতে চা ঢালল। কাঁপছে আঙুলগুলো। ভেতরের কী একটা ছবির আবেগ তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এক চুমুক চা, আর এক চুমুক, গুল পাকানো চায়ের কেমন একটা বদ্ধ ডোবার গন্ধ, তার মধ্যে মাদার ডেয়ারির দুধ ভেসে আছে। না মাদার ডেয়ারি না, বহু চর্চিত বহু বিজ্ঞাপিত এভরি-ডে-টে হবে। তেলে জলে যেমন মিশ খায় না তেমনি। তৃতীয় চুমুকের পর চায়ের কাপটা সরিয়ে রাখল সঞ্জীবন। প্রথম টান—সুদীর্ঘ এক চোখের ওপরপাতা। লাইফ সাইজকে অন্তত দশ গুণ করে দিলে যতটা হয়।

ক্ষীণ অতি ক্ষীণ একটি ঢেউতোলা রেখা। তার ওপর দিকে সেই চোখ বা চোখের পাতা, যার মণি নেই, পাপড়ি নেই, মুখের রেখা নেই, দিগন্ত-ছোঁয়া এক আঁখি শুধু একটি মাত্রই এবং ক্যানভাসের বাকি অংশটা প্রায় সবটাই সাদাটে ধোঁয়াটে এক মুখ যার মধ্যে কোথাও না কোথাও কানের অস্পষ্ট রেখা বোঝা যায় আবার সেগুলো অর্থহীন তালগোল পাকানো রঙের পুঁটলিও। আবার প্যানডোরার বাক্সের মতো তার থেকে বেরিয়ে পড়ে দুধের গ্লাস, চলকে পড়া দুগ্ধ ধারা, ফিনকি দিয়ে যেন সাদা রক্ত বেরোচ্ছে, ওষুধের শিশি, প্ল্যাস্টিকের গামলা…।

ভোর রাতে ওয়াশ করে করে, ওয়াশ করে করে যেন নিজের অস্পষ্ট অনভবকে ধরে রাখতে চাইল সে। তারপর চান, পাটভাঙা জামাকাপড়, কেমন যেন অস্বস্তি লাগে না হলে। বোতলটা আজকে শেলফের এক কোণে পড়ে রয়েছে। মার্জারিন দিয়ে ছ স্লাইস পাঁউরুটি আর দুটো শুটকে কাঁটালি কলা দিয়ে বোতলটা শেষ করে মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সঞ্জু সঞ্জু ওঠো। তোমার কাছে লোক এসেছে দেখা করতে। ওঠো। সঞ্জু।

জাহান্নমে যাও…।

প্লীজ সঞ্জু। অনন্ত ঘড়াই আর…

হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে সঞ্জীবন ধপাস করে পড়ে যাচ্ছিল। বউদি ধরল।

এইজন্যে তোমাকে নাম বলতে চাই না। নাম বললেই ধপাস। আশ্চর্য। …

ঘড়াই ঢুকে আসছে।

আর্টিস্টের স্টুডিয়ো আর ব্যাচেলরের ডেন এ দুটোর কোনো প্রাইভেসি নেই বুঝলেন দুনিবাবু।

তক্তাপোশ—তাতে বাসি বিছানা। শূন্য বোতল গড়াগড়ি। অ্যাশট্রে জলে ভাসছে। আধ খাওয়া চায়ের কাপ। মুখ-খোলা ফ্লাস্ক। ইজেলের ওপর ছবি চড়ানো। চোখ লাল, দাড়িয়াল, কুঁচকোনো পায়জামা গেঞ্জির শিল্পী, চোখ কচলাচ্ছে। হাই চাপছে।

বাহ—দুনিবাবু বললেন—তা এটা দুই-ই। সোনায় সোহাগা। একটা স্টিল লাইফ করে নেবেন সঞ্জুবাবু।

সঞ্জু, তোর দশাশ্বমেধটা ইনি কোন ফিলম প্রডিউসারের বাড়িতে দেখেছেন ওঁকে একটা করে দিতে হবে।

ইনি কে?

ইনি? ইনি দুনিলাল বাজাজ। চিনতে পারছিস না?

ফেমাস আর্ট-ডিলার-বউদি চৌকাঠ থেকে বলল, সঞ্জীবন কটমট করে তাকাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি চলে গেল। এবার বোধহয় সেই মজা ডোবার গন্ধ-অলা চা-টা আনবে।

সাদা ভুড়ির ওপর ফিনফিনে সাদা ধুতি। মোটা সোনার চেন। মাথার দু চারগাছি পাতলা চুল ছাড়া সারা শরীরে আর কোথাও কোনো চুল নেই।

সঞ্জীবন বলল, নিজেরই ছবির কপি করতে হবে?

কপি কেন করবেন। ফ্রেশ আঁকবেন, যেমন হবে তেমনি নেব।

হয় না। দশাশ্বমেধ মুড আমার চলে গেছে।

এটা? ফিনিশড? ইজেলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বাজাজ।

আপনার কী মনে হয়?

কোথাও কিছু একটা বাকি আছে। ছোট্ট কিছু। এই স্যাডনেসের কারণ যদি লিউকিমিয়া হয়, সুষ্ঠু লিউকিমিয়া—তা হলে কেমন ক্লিনিক্যাল হয়ে যায় ছবিটা।

লিউকিমিয়া নয়, লিউকিমিয়া কেন? হিট ফিভার…মাথার চুল আঁকড়াতে আঁকড়াতে সঞ্জীবন বলল।

কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন বাজাজ। তারপরে বললেন, আই সি, পার্সন্যাল লাইফ? তা আরও কিছু আছে?

বাকিগুলো সে বার করে দিল।

গোটা চারেক বেছে নিলেন দুনিলাল। দশ হাজার করে এক একটা।

ইনি আমাদের বিপ্লবী শিল্পী সংঘকে প্রোমোট করছেন।

বউদি ভারী বুদ্ধিমতী। চা আনেনি।

ক্যাশ চল্লিশ হাজার কোলে নিয়ে বসে রইল। বউদি ঢুকতে বলল, নাও।

সমস্ত নিয়ে নেব?

আমাকে হাতখরচটা দিয়ো।

টিলটিল যে রাগ করবে?

টিলটিল রাগ করে একমাত্র গন্ধ পেলে—বলতে যাচ্ছিল সঞ্জীবন, সামলে নিল।

বলল, আপাতত তুমিই আমার টিলটিল, তুমিই আমার ক্যাশ, আমার ক্যাশিয়ার। বউদির গালে একটা চকাস করে চুমু খেল সঞ্জীবন।

তারপর তাড়াতাড়ি চান, তাড়াতাড়ি দাড়ি গোঁফ ছাঁটা, তাড়াতাড়ি পাউডার, তাড়াতাড়ি পায়জামা পাঞ্জাবি। সাতবার করে মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি। এবং দৌড়।

না লিউকিমিয়া নয়। না লিউকিমিয়া নয়। না…

টিলটিল স্কুলে গেছে। বাঁচা গেল। তবু একবার থরো চেক-আপ।

দিদি, টিলটিলের ফ্যাকাশে ভাবটা গেছে?

নাইন্টি পার্সেন্ট বাঙালি মেয়ে অ্যানিমিক সঞ্জু, ফ্যাকাশে ভাব কি চট করে যায়?

কী কী যেন খেতে হয়?

মাটন লিভার, বিটরুট, গাজর, বেদানা, অভাবে ডালিম, লিভার এক্সট্র্যাক্ট ইঞ্জেকশন, চিকেন স্যুপ, টনিক আয়রন-অলা। খিদে বাড়াবার কিছু। হাওয়া বদল মনের স্ফূর্তি।…

মাটন লিভার থেকে খিদে বাড়াবার কিছু পর্যন্ত দিদি আপনি ব্যবস্থা করবেন, বাকি দুটো আমি দেখছি।–বলে পাঁচশো টাকার দুটো নোট দিদির হাতে খুঁজে দিতে যায় সঞ্জু।

এ কী? এ কী? আমার হাতে কেন?

তবে কি আপনার পায়ে দেব?

ইয়ার্কি হচ্ছে? খুব যে ফুর্তি? চাকুরি পেলে? না ছবি বিক্রি হল?

চাকুরি তো আগেই পেয়েছি দিদি, ও চাকুরি হামি করবে না।

তবে ছবি?

আবার কী?

হাতে পেয়েই সব খরচ করে দেবার ধান্দা? উড়নচণ্ড একেবারে।

উড়নচণ্ডী নয় দিদি উড়ন শিব, মানে নটরাজ, মানে শিল্পী। …

ধাঁ করে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে সঞ্জীবন।

দিদি তাড়াতাড়ি পথ আটকায়।—না, না সঞ্জু আমার কাছে টাকা দেবে না। তোমাদের অসীমদা ভীষণ রাগ করবেন তাহলে। তুমি এগুলো কিনে এনে দিয়ো বরং।

আমি যে চিনি না, দিদি।

চিনতে তো হবেই একদিন না একদিন সঞ্জু—

তাহলে আপনি চলুন সঙ্গে।

আচ্ছা চলো, বারোটার সময়ে মিনি ফিরবে। তার আগে কিন্তু ফিরতে হবে।

ওরে বাবা, এখনই তো সাড়ে দশ। শিগগিরই চলুন।

এত কিনছ কেন সঞ্জু? এত তো লাগবে না।

বাঃ, টিলটিল কি একা খেতে চাইবে নাকি? আপনি খাবেন, অসীমদা খাবেন, মিনি খাবে।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

মাথাটি আমার ঠিক হয়ে গেছে। এই দেখুন না দাদা বউদির জন্যেও নিচ্ছি। আপনাদের সবার কাছ থেকে তো খালি নিয়েই গেছি, নিয়েই গেছি …

উড়নচণ্ডী।

চণ্ডী নয় চণ্ডী নয়, চণ্ড, চণ্ড ভৈরব—সঞ্জীবন সংশোধন করে দেয়। আর অমনি চণ্ডভৈরব তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। সে কী রং? কী অসম্ভব সব দেহভঙ্গি। চোখে যদি ওজঃ মুখে তবে হাসি, হাতে যদি বরাভয়, পায়ে তবে সব দলিত মথিত করবার মহামুদ্রা। কেশে তার ঝড়, বুকে তার প্রেম, উদরে ক্ষুধা, কে এই চণ্ডভৈরব? এঁকে কি কোনো শাস্ত্রে পাওয়া যাবে? দেখবে কী? পুরাণ খুলে খুলে? নাঃ চণ্ডভৈরব ভেতরে নাচছেন, উলটোচ্ছেন, পালটাচ্ছেন, তাঁকে এক্ষুনি লিপিবদ্ধ করতে না পারলে তিনি উবে যাবেন। দিদিকে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে সেই ট্যাকসিতেই ছুটল সঞ্জীবন। একের পর এক চণ্ডভৈরব এঁকে যায় সঞ্জীবন। সব ভঙ্গি এক ক্যানভাসে ধরা। যায় না। সব রং কী করে এক জায়গায় উজাড় করে? অনেক আয়োজন চাই। জলে তেলে মোমে, পেনসিলে, স্টেনসিলে, এচিং-এ, অ্যাক্রিলিকে। শুধু ভৈরব তো নয়, ক্রমে তাঁর বুকের পাঁজর থেকে তৈরি হয় ভৈরবী। তাঁর হাতের মুদ্রা থেকে আসে সাঙ্গোপাঙ্গ। তাঁর লিঙ্গোত্থান থেকে আসতে থাকে শিশুভৈরব শিশুভৈরবীরা। সে বুঝতেও পারে না কবে তার ঘরে উত্তরের মহার্ঘ আলো অফুরান প্রবেশ করে, কবে পালটে যায় শয্যার আস্তরণ, ঠান্ডা ঘরে অজস্র গাছের টবের বিন্যাসের মধ্যে বসে সে অনিয়ন্ত্রিত ভৈরব-পরিবার এঁকে যায় আর আনমনে টিলটিলের গালে, অধরে উদরে চিবুকে চুমু খেয়ে যায়। এক সময়ে হাতের তুলির মতো সযতনে শুইয়ে দেয় টিলটিলকে। আর চোখে স্বেদ, টিলটিলের গালে রক্ত। ক্যানভাস ঘামতে থাকে। কেন না এখন কোনো গন্ধ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *