খেলা

খেলা

মতিলাল ছেলেকে বললে–বোসো বাবা, গোলমাল করো না। হিসেব দেখছি—

ছেলে বাবার কোঁচার প্রান্ত ধরে টেনে বললে–ও বাবা, খেলা করবি আয়–

-না, এখন টানিসনে—আমার কাজ আছে—

-–ও বাবা, খেলা কববি আয়—ঘোয়া খেলা কববি আয়—

—আঃ জ্বালালে—চল দেখি—

মতিলাল হিসাবের খাতা বন্ধ করে ছেলের পিছু পিছু চলল। ছেলে তার কোঁচার কাপড় ধরে টেনে নিয়ে চলল কোথায় তা সেই জানে।

–কোথায় রে?

—ওভেনে হাত তুলে খোকা একটা অনির্দেশ্য অস্পষ্ট ইঙ্গিত করে–ভালো বোঝা যায়। অবশেষে দেখা যায়, ভাঁড়ারঘরের পেছনে যে ছোটো রোয়াক আছে, বর্ষার জলে সেটা বেজায় পেছল, শ্যাওলা জমে বিপজ্জনক ভাবে মসৃণ—সেখানে নিয়ে এসে দাঁড় করালে মতিলালকে—

—এখানে কী রে?

—আউভাজা খা, আউভাজা খা–নে—

খোকা রোয়াকের নীচেকার কালকাসুন্দে গাছের পাতা এক-একটা করে ছিড়ে নিয়ে আসতে লাগল হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে, তারপর বাবার সামনে সেগুলো এক এক করে বসিয়ে দিলে।

—পড়ে যাবি, পড়ে যাবি, রোয়াক থেকে নীচে পড়ে গেল ইটে কেটে—আঃ।

—আউভাজা খা না–ও বাবা?

মতিলাল ছেলের হাত ধরে রোয়াকের ধার থেকে টেনে নিয়ে এল দেয়ালের দিকে। ছেলে ঘাড় বেঁকিয়ে চোখের তারা একপাশে নিয়ে এসে মতিলালের দিকে চেয়ে বললে—ঠিক বলে—

এ কথা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও অবান্তর। ওই কথাটা ছেলে সম্প্রতি শিখেচে সুতরাং স্থানে-অস্থানে সেটা বলতে হবেই। মতিলাল ছেলের কথার দিকে মন না-দিয়ে খড়ের চালার একটা বাঁশের রুয়োর দিকে চেয়ে আপন মনে বলতে লাগল—এ :, উই লেগেচে দেখো-বর্ষাকালে যেটা তুমি নিজে চোখে না-দেখবে, সেটাই লোকসান হবে—

খোকা এবারও বললে—ঠিক বলেচ—

অবিশ্যি খোকার উক্তির প্রয়োগসাফল্য এখানে সম্পূর্ণ আকস্মিক।

মতিলাল বললে—যাঃ যাঃ—ওই এক শিখেচে ‘ঠিক বলেচ’, তা ওর সব জায়গায় বলা চাই। তা খাটুক আর না-খাটুক—থাম—

খোকা ভাবলে, বাবা তাকে বকলে কেন? সে হঠাৎ বড়ো দুঃখিত হল। দেড় বছর মাত্র ওর বয়েস, নাম টুনু, যেমন দুষ্ট, তেমনি বাচাল। মুখের বিরাম একদণ্ড নেই। বিষম পিতৃভক্ত, বাবা ছাড়া জানে না। সর্বদা বাবাকে চায়। ওর মা বলে, কাকে তুমি বেশি ভালোবাসো খোকা?

—বাবা মতিলালকে।

—আর মা অন্নপুন্নোকে নয়?

—হুঁ-উ-উ।

—তবে?

—বাবা মতিলালকে।

—তা তো সবই বুঝলাম। আমি বুঝি ভেসে এইচি? আমি বুঝি ভালোবাসার যুগ্যি নই, হ্যাঁরে—এইবার বল, কাকে ভালোবাসিস?

—বাবাকে, বাবা মতিলালকে।

—বাঃ, বেশ ছেলে দেখচি। থোকন, সোনার খোকন, তুমি কার খোকন?

—বাবা মতিলালের!

—আর কার খোকন?

—মার।

—মার কী ভাগ্যি!

এই ধরনের কথা রোজই প্রায় হয়। এসব থেকে এইটুকুই বোঝা যায় যে, টুনু বাবার একটু বিশেষ রকমের ন্যাওটো। বাবা ছাড়া সে কাউকে চায় না বড়ো একটা, বাবার সঙ্গে নাওয়া, বাবার সঙ্গে খাওয়া, বাবার সঙ্গে ঘুমোনো।

মতিলাল এতে খুব সন্তুষ্ট নয়। তার হিসেবপত্রের খাতা মোটেই এগোয় না, এক দিনের কাজে তিন দিন লাগে।

বিকেলে মতিলাল হয়তো চাইচে নদীর ধারে কী কোনো বন্ধুর বাড়ি একটু বেড়িয়ে আসবে, ছেলে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেও বাবা, কী করছিস?

—কিছু করিনি। দাঁড়িয়ে আছি।

—বেরিয়ে চলো। আমি যাব।

—না।

—আমি যাব বাবা।

—না। যায় না।

খোকা ততক্ষণ মতিলালের কোঁচার কাপড় হাতের মুঠোর মধ্যে পাকিয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়েচে। চোখে তার করুণ আবেদন ও আশার চাউনি। কে পারে তার কথা না-শুনে? মতিলালকে সঙ্গে নিতেই হয়। বাবার কাঁধে উঠে স্ফুর্তি তার। তখন সে জেনেছে, বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্চে সে অনেক দূরে কোথাও। তার পরিচিত জগতের ক্ষুদ্র গণ্ডীর বাইরে।

মনের আনন্দে সে বলে যাবে—ও বাবা, ও মতিলাল, কী করচিস? বেরিয়ে চলো? আমি যাই।

—কোথায় যাচ্ছিস রে?

—মুকি আনতে।

—আর কী আনতে?

—চিনি আনতে।

—আর কী আনতে?

—মাছ।

—আর কী?

খোকা ভেবে ভেবে ঘাড় দুলিয়ে বলে–আউভাজা–

—বেশ।

খানিকদূর গিয়ে খোকা আর বাবার কাঁধে থাকতে রাজি হয় না। তাকে পথে নামিয়ে দিলে সে গুটি গুটি হেঁটে চলে। দু-একবার পড়ে যায়, আবার ঠেলে ওঠে। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে খোকা আর চলে না। সামনের দিকে কী একটা জিনিস সে লক্ষ করে দেখছে।

—চল এগিয়ে, দাঁড়ালি কেন?

খোকা ছোট্ট হাত দুটি প্রসারিত করে বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে—বিচন কাদা!

—কোথায় ভীষণ কাদা রে? কাদাই নেই রাস্তায়—চল—

—বিচন কাদা!…

—তবে নামলি কেন কোল থেকে? আয় আবার কোলে আয়—

আবার চলতে শুরু করল খোকা। বেশ খানিকটা গেল গুট গুট করে। একটা জায়গায় পথের পাশে একটা শুকনো কীসের ডাল পড়ে থাকতে দেখে থেমে গেল। আঙুল বাড়িয়ে বললে—বাবা—আটি—আমি নিই—

—যাতে তাতে হাত দিয়ো না—

—বাবা আমি নিই—

—নাও—

খোকার একটা গুণ, বাবার বিনা অনুমতিতে সে কোনো একটা কাজ হঠাৎ করতে চায় না। এইবার সে তুলে নিলে লাঠিটা। আশেপাশের গাছপালার গায়ে সপাসপ মারতে লাগল। ওর বাবা বলে—ফেলে দেও খোকা, এইবার ফেলে দাও লক্ষ্মীটি—

—ও মতিলাল?

—কী?

—কী করছিস?

—বেড়াতে যাচ্ছি বাবা। লাঠিটা ফেলে দে—লক্ষ্মী খোকা, লাঠি ফেলে দে—

খোকা লাঠিটা রাস্তার পাশে ফেলে রেখে আবার দিব্যি গুট গুট করে চলে। এক জায়গায় রাস্তার দু-পাশে ভাঁটুই গাছ বর্ষাকালে খুব বেড়েছে। রাস্তার দু-পাশে অনেক দূর পর্যন্ত ভাঁটুইবন।

খোকা হঠাৎ দু-হাত প্রসারিত করে বললে—কী ধান! কী ধান!

—ধান কই রে? ও হল—

—কী ধান! কী ধান! মতিলাল ভেবে দেখলে, অতটুকু ছেলে ধান এবং ভাঁটুইয়ের পার্থক্য কী করে বুঝবে।

-ও বাবা, কী ওতা?

—কই রে?

—ওই—বসে আছে—

মতিলাল খোকার আঙুলের দিগদর্শন অনুসরণ করে দেখলে, সামনের গাছের ডালে একটা কাঠবেড়ালি বসে আছে। খোকা আর যায় না, সে দাঁড়িয়ে গিয়েছে এবং ভয়ের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে একদৃষ্টে সেটার দিকে। বাবার দিকে দু-হাত বাড়িয়ে বললে—বাবা, কোলে—

—কোলে আসবি?

—ভয় কববে—

—কীসের ভয় রে? এটা হল কাঠবেড়ালি—ও কিছু বলে না। ভয় নেই—চল–

মতিলাল যে বন্ধুটির বাড়ি গেল, তারা ওকে এক পেয়ালা চা খেতে দিলে। মতিলালের ছেলেকে দিল একটুকরো মিছরি। খোকা মিছরি একটু মুখে দিয়েই মুখ থেকে বার করে নিয়ে মতিলালের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বললে—বাবা, খা—

এখন এ ব্যাপারটার ভেতরের কথা এখানে বলা এ সময়েই দরকার। ছেলের বয়স যখন আরো কম, দশ-এগারো মাস কী বছরখানেক, তখন থেকেই সে নিজের মুখে কোনো জিনিস মিষ্টি লাগলেই বাবার মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে বলবে

—বাবা, খা—

মতিলালেরও বিশেষ আপত্তি থাকত না তাতে।

অবশ্য একটিবার বাদে।

একবার মাতৃস্তন্য পান করতে করতে খোকা নিকটে উপবিষ্ট মতিলালকে বলেছিল—বাবা, মিস্ত খা—

মতিলালেরা স্বামী-স্ত্রী মিলে খুব হেসেছিল।

নিজের মুখে যা ভালো লাগবে, তাই সে দেবেই বাবার মুখে এবং মতিলাল তা খেয়েও এসেছে, মুশকিলে পড়ে যেতে হয় ওকে, লোকজন থাকলে।

এখানে যেমন হল।

মতিলাল সলজ্জভাবে বললে—না, না—আমি আবার কী, খাও না—

খোকা বাবার রাগের কারণ খুঁজে পেলে না, রোজ যে খায়, আজ খাচ্ছে না কেন? নিশ্চয়ই রাগ করেছে।

সে দ্বিগুণ উৎসাহে বাবার মুখের আরো কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বললে—বাবা, খা—

–না না। তুমি খাও—

–বাবা, খা না—

খোকার এবার কান্নার সুর। অমন মিষ্টি জিনিসটা বাবাকে সে খাওয়াবেই।

মতিলাল ধমক দিয়ে বললে—আঃ খাও না? আমার মুখে কেন?

-বাবা, খা না—

এবার বোধ হয় সে কেঁদেই ফেলবে। অগত্যা মতিলাল খোকার হাত থেকে মিছরির টুকরোটা নিয়ে খাবার ভান করে আবার ওর হাতে দিলে। খোকাকে ভোলানো অত সহজ নয়। সে বাবার মুখের দিকে চেয়ে বললে, মিট্টি?

—খুব মিষ্টি।

—আবার খা—

—না রে বাপু, বিরক্ত করলে দেখচি—

বন্ধুর বাড়িতে অনেকে বসে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললে—খোকা কী বলচে?

মতিলাল বললে, মিছরি দিচ্ছে খেতে—

ওর বন্ধু বললে—ও খোকা, বাবাকে কী দিচ্চ? মিছরি? তুমি খাও।

এইসব স্থূলবুদ্ধি লোকে কী বুঝবে—খোকা তাকে কতখানি ভালোবাসে বা সে খোকাকে কতখানি ভালোবাসে। এদের কাছে কিছু বলে লাভ নেই। পিতা-পুত্রের সেই সূক্ষ্ম অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার গূঢ় তত্ব, যা মুখে বলা যায় না, যার বলে এক বছরের শিশু তার অত বয়সে বড়ো বাপের মনের ভাব বুঝতে পারে, সে জিনিসের ব্যাখ্যা যার-তার কাছে করে কী হবে?

মতিলাল বললে—খাও তুমি—

খোকা হাত বাড়িয়ে বললে—খা না বাবা—

মতিলাল খোকাকে কোলে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে উঠল। খোকার মনে বার বার কষ্ট দেওয়াও যায় না, অথচ ওদের সামনে খোকার মুখ থেকে বের করা তার লালঝোলমাখা মিছরি খায়ই বা কী করে?

ওরা পথে নামল।

টুনুর ক্ষুদ্র জগতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আশেপাশের পথে, বনে, ভাঁটুইবনে অন্ধকার নেমেচে। জোনাকি জ্বলচে কালকাসুন্দে গাছের ঝোপের আশেপাশে, যাঁড়াগাছের নিবিড় পত্র-পুষ্পের মধ্যে, বনমরচে লতার চারু অগ্রভাগে। অন্ধকারের গহ্বর থেকে যেন ফুটে উঠচে একে একে জ্যোতির্লোক, নীহারিকালোক।

মতিলাল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে—ও কী জ্বলচে রে?

—জোনা পোকা। নিয়ে এসো বাবা—

—তুই নিবি একটা?

—হ্যাঁ।

খোকা হেঁটেই যাচ্ছিল, অন্ধকার বনঝোপের দিকে তাকিয়ে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ।

—কী হল রে?

—বিচন কাদা!

—না মোটেই কাদা নেই, শুকনো পথ—

—ছিয়াল!

—কোথায়? কোথাও নেই, চলো—

—কোলে কর—নে—ভয় কববে—

–এসো তবে—

খানিকটা গিয়ে খোকা বললে—বাবা!

—কী?

—ও বাবা—আমি মুকি খাব—

—বেশ।

—সন্দেশ খাব—

—বেশ।

—ও বাবা!

—বোকো না—চুপ করো। –ও বাবা মতিলাল!

—কী বাবা?

—কী করছিস?

—কী আবার করব, পথ হাঁটচি।

—মা কোথায়—মা?

—বাড়িতে আছে।

—মার কাছে যাই—

—সেখানেই তো যাচ্চি—

মতিলালের স্ত্রী ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। ছুটে এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললে–ও আমার সোনার খোকন, আমার রুপোর খোকন, আমার এতটুকু একটা খোকন—কোথায় গিইছিলি রে?

—খোকা হাত দিয়ে একটা অনির্দিষ্ট বস্তু দেখিয়ে বললে—ওখেনে—

—ওখেনে? বেশ রে বেশ। হ্যাঁগো, যা-তা খাওয়াওনি তো?

মতিলাল বললে—না না। কী দেবেই বা কে এসব জায়গায়। একটু মিছরি খেয়েছে।

অন্নপূর্ণা ওকে দুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলে। খোকা খানিকটা উশখুশ করে বললে— বাবা কোথায়?

-কেন?

—ঘুম দেবে।

—আমি ঘুম দিচ্ছি।

—বাবা দেবে—বাবা দেবে।

মতিলালকে খোকার শিয়রে বসে বসে ঘুম পাড়াতে হয়। প্রতি সন্ধ্যাতেই এ রকম। আজ নতুন কিছু নয়। খোকা বলে—বাবা, জন্তি গাছটি—

—কী? জন্তি গাছটি? তবে শোনো—

ওপারের জন্তি গাছটি জন্তি বড়ো ফলে—

গোজন্তির মাথা খেয়ে প্রাণ কেমন করে—

খানিকটা পরে খোকা নিস্তব্ধ ও নীরব হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে মতিলাল যেমন বাইরে এসে বসে তামাক ধরিয়েছে, খোকা এমন সময়ে কেঁদে উঠল—ও বাবা, কোথায় গেলি? ও বাবা—

মতিলাল তামাক খেতে খেতে হুঁকো নামিয়ে রেখে ছুটল ছেলের কাছে।

অন্নপূর্ণা হেসে বলে—ও ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে পেছন দিকে হাত দিয়ে দেখে তুমি আছ কিনা। যদি বোঝে নেই, তবে ওর ঘুম অমনি ভেঙে যায়—

বাইরের তামাকের ধোঁয়া পুড়ে পুড়ে শেষ হয়, মতিলালকে ঠায় বসে থাকতে হয় শিশুর শিয়রে।

 

পরদিন নাইতে যাচ্ছে তেল মেখে মতিলাল। খোকা বললে—আমি যাব—বাবা —নদীতে যাই।

সে রোজই যায়। তাকে তেল মাখিয়ে নিয়ে গিয়ে ডাঙায় দাঁড় করিয়ে রাখে। যে ঘাটে মতিলাল যায়, সেটাতে লোকজন বড়ো-একটা যায় না। বড্ড বনজঙ্গল। খোকা জলে নামবার জন্যে ব্যস্ত হয়।

মতিলাল ওকে কোলে করে জলে নামে। মহাখুশিতে দু-হাত দিয়ে খোকা খলবল করে জলে। কিছুতেই উঠতে চায় না। ওকে দুটো ডুব দেওয়ায় মতিলাল। এক-একটা ডুবের পর খোকা শিউরে আড়ষ্টমতো হয়, নাকে-মুখে জল ঢুকে যায়। খানিক পরে সামলে নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। নদীতে বর্ষার ঢল নেমেচে, বড়ো বড়ো শ্যাওলা, কচুরিপানা টোপাপানার দাম তির বেগে ভেসে চলেচে।

খোকা বলে—ও কী বাবা?

—শ্যাওলা।

-–ও বাবা, গান করি, গান কয়ি—

–করো।

—এ-এ-এ-এ, ঘটি বধনন—

খেলারাম বাবাজি বাবাজি—

—বেশ, বেশ গান। এবার জল থেকে ওঠো। হ্যাঁরে, তোকে ও গান শেখালে কে রে?

—ফুছু।

—হ্যাঁ—যতো সব কাণ্ড! আবার গান করো তো?

—ঘটি বধনন—

খেলারাম বাবাজি—

—বেশ গান শিখিচিস—জয় যদু-নন্দন, ঘটিবাটি-বন্ধন,
তুলোরাম খেলারাম বাবাজি—

খোকার বহু আপত্তি সত্বেও মতিলাল খোকাকে গা মুছিয়ে ঘাটের ওপরে কুলগাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে নাইতে নামল। ঢল-নামা বর্ষার নদীতে কামট-হাঙরের ভয়, জেলেরা প্রায়ই দেখতে পায়। কুমির তো কাল না পরশু একটা দেখা দিয়েছিল বেলেডাঙার বাঁকে। খোকাকে বেশিক্ষণ জলে রাখা ঠিক নয়। ডাঙার কুলতলা থেকে বাবাকে জলে ডুব দিতে ও হাত-পা ছুড়তে দেখে। খোকা খুব খুশি। ক্রমে খোকাকে খুশি করবার জন্য মতিলাল খরস্রোতা বর্ষার নদীতে সাঁতার দিতে শুরু করলে।

খোকা ডাঙা থেকে ডাকলেও বাবা–বাবা—

দূর থেকে মতিলাল উত্তর দিলে—কী?

—আমি যাই—

—না, আর নদীতে নামে না। ঠিক থাকো।

-–ও বাবা—

—থাক দাঁড়িয়ে ওখানে—

খানিকটা পরে বাবাকে আদৌ আর না-দেখতে পেয়ে খোকা ডাকতে লাগল— বাবা-–বাবা–

কোনো সাড়া নেই।

–-ও বাবা–ও মতিলাল—

কোনো দিকে মতিলালের দেখাও নেই।

—ও মতিলাল, ভয় কববে—

খানিকটা চুপ করে থেকে সে ভয়ের সুরে বললে—ছিয়াল! বাবা, ও বাবা–

অনেকক্ষণ পরে কে-একজন তরকারিওয়ালা নৌকো পার হবার জন্যে এসে দেখে, কুলতলায় একটা ছোটো ছেলে দাঁড়িয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কাঁদছে। অনেক দূর থেকেই সে শিশুকণ্ঠের আর্ত কান্না শুনতে পেয়েছিল। সে কাছে এসে বললে —কে গা? কী হয়েচে খোকা? তুমি কাদের ছেলে? এখানে কেন?

খোকা আকুল কান্নার মধ্যে হাত বাড়িয়ে নদীর দিকে দেখিয়ে বলে—বাবা মতিলাল—ভয় কববে—

এ আজ পাঁচ-ছ-বছরের কথা।

মতিলাল সান্যাল বাজিতপুরের ঘাটে বর্ষার নদীতে কুমির বা কামটের হাতে প্রাণ হারান, তখন তাঁর শিশুপুত্র একা নদীর ঘাটে কুলতলায় বসে ‘বাবা মতিলাল’ বলে কাঁদছিল, এ কথা অনেকেই জানেন বা শুনে থাকবেন। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত শুনে দেখতে এসেছিলেন জায়গাটা। কেউ কেউ খোকার ফোটো তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই ঘাটের সেই কুলতলায় তাকে আবার দাঁড় করিয়ে। তার পিতৃহারা প্রাণের আকুল কান্না বাইরে কতটুকু বা প্রকাশ হয়েছিল। তিনদিন পরে মতিলালের অর্ধভুক্ত দেহ পাওয়া যায় সর্ষেখালির বাঁকে মাছধরা কোমরজলে। পুলিশের হাতে দেওয়া হয় মৃতদেহ।

খোকা আজ কোথায়, এ প্রশ্ন অনেকে করবেন জানি।

টুনু নেই। এক বছর পরে সেও বাবার সন্ধানে অজানা পথে বেরিয়ে পড়ে।

অন্নপূর্ণা আছেন। গাঁয়ের লোকে দেখাশোনা করে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কলমের জোরে গবর্নমেন্ট মাসিক কিছু বৃত্তি দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *