ক্লাইভ বিটি : সার্কাসশিল্পী

ক্লাইভ বিটি : সার্কাসশিল্পী

ক্লাইভ বিটির কাজ ছিল পৃথিবীর অন্যতম সর্বাধিক বিপজ্জনক কাজ। বিমা কোম্পানিগুলো নিশ্চিত জানে যে, যে-কোনো সময় তার দেহটা বন্যজন্তুর নখরাঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই তারা তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি হয় নি। তাকে বাঘে আঁচড়ে দিয়েছে এবং চিবিয়েছে। পায়ের হাড়ে সিংহ কামড় বসিয়ে দিলে কেমন লাগে তা তিনি অনুভব করেছিলেন। হাতিরা তাকে টেনে হিঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, একটা কালো চিতাবাধ তাঁকে কামড়ে রক্তাক্ত করেছে এবং শেষবার যখন তার সবচেয়ে বড় সিংহ ‘নিরোর সঙ্গে খেলা শেষ করলেন তখন তাঁকে দশ সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, তিনি একটা পা প্রায় হারাতে বসেছিলেন।

তিনি আমাকে বলেছেন যে, অনেকবার তিনি বাঘ-সিংহের খেলা দেখানো ছেড়ে দেবেন বলে ভেবেছেন। কিন্তু তিনি বলেন যে, একটা সাধারণ কাজ করে মরার চেয়ে বাঘ-সিংহের কামড়ে মরাটা তার কাছে অধিক শ্রেয়।

ক্লাইভ বিটি তার জীবনের রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনাপূর্ণ জীবনের সুদীর্ঘ পনেরটি বছর সার্কাসের তাঁবুতে কাটিয়েছেন। শিশু বয়স থেকেই ছিলেন সার্কাসপাগল। একদিন শহরে বার্নাম ও বেইলি সার্কাস দল এল। এক লন্ড্রিওয়ালা তাদের জানালায় একটা পোস্টার লাগিয়ে দিয়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন, কী সুন্দর লাল, বেগুনি ও হলুদ বর্ণের রঞ্জিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক বীরপুরুষ খাঁচাভর্তি একপাল ক্রুদ্ধ সিংহের সামনে চাবুক ঘোরাচ্ছে। তিনি দৌড়ে সেই লন্ড্রিওয়ালার কাছে গিয়ে অনুনয় করে বললেন সার্কাস পার্টি চলে গেলে ওই পোস্টার যেন তাকে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে তিনি পাঁচটা জেদি কুকুরকে বিভিন্ন রকম খেলা শিখিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করে তুলেছিলেন। তিনি প্রায়ই সার্কাসের সেই পোস্টারটি রাস্তায় ঝুলিয়ে দিতেন এবং পাড়ার ছেলেদেরকে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করতেন। এরপর যখনই শহরে কোনো সার্কাসদল আসত তিনি একটা চাকুরির জন্য আবেদন জানাতেন। কিন্তু তখন অত্যন্ত কম বয়স ছিল তাঁর।

তরপর এক গ্রীষ্মকালে সেই মস্তবড় যাত্রিকদল শহর ছেড়ে চলে যেতে লাগল, ক্লাইভ বিটিও কাউকে কিছু না বলে গাড়িতে চেপে বসলেন। মা-বাবা তিন দিন ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে নিরাশ হলেন। একদিন চিঠি এল, তিনি সার্কাসে খাঁচা পরিষ্কার করার একটা চাকুরি পেয়েছেন। মাসে মাত্র পাঁচ ডলার বেতন, তাঁকে বেহেস্তে বাস করার সুযোগ এনে দিল।

দশ বছরের মধ্য ওহিওর এই যুবক ইতিহাসের সকল ট্রেইনারদের ছাড়িয়ে গেল। তিনি এমন দুঃসাহসিক খেলা দেখানোর আয়োজন করলেন যে সার্কাস মালিকরা বলল এটা কোনোমতেই সম্ভব নয়। যখন দেখা গেল যে, কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন তখন তারা বলাবলি করতে লাগল যে। তিনি নিশ্চয়ই একটা পাগল এবং তার জীবনের মূল্য এক কানাকড়িও না। তিনি চল্লিশটা ক্রুদ্ধ সিংহকে এক খাঁচায় পুরে চাবুক ঘুরিয়ে খেলা দেখাতেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন কাজের আদেশ দিতেন। তার এই ঝুঁকিপূর্ণ খেলাটার প্রদর্শনী সার্কাসের লোকদের মধ্যেও অদ্ভুত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। তিনি পরস্পর বিরোধী দুটো জন্তু বাঘ আর সিংহকে এক খাঁচায় পুরে বিভিন্নভাবে প্রদর্শনী করতেন। আশ্চর্য ব্যাপার হল এই, তার মতে বাগে আনার ব্যাপারে সিংহ ও বাঘ সবচাইতে সাংঘাতিক জানোয়ার নয়। তিনি বাঘ, হাতি, সিংহ, হায়েনা, ভালুক সবরকম জন্তু জানোয়ারের খেলা দেখিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে বসবাস করেছেন। আপনারা অনেকেই হয়তো শুনেছেন, পশু প্রশিক্ষকরা সোজাসুজি কোনো পশুর চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে বশ করত। ক্লাই বিটি এটাকে নিছক বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিলেন।

তিনি বলেন, কোনো প্রশিক্ষকই কোনোদিন সিংহের মুখের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে রেখে দেয় নি। তাছাড়া সিংহের নিশ্বাস এমন দুর্গন্ধযুক্ত যে যারা সিংহ খুব পছন্দ করে তারাও গ্যাস মুখোশ না পরে তার। মুখে মাথা দিতে পারবে না। বিটিকে যদি কেউ কিছু বলে রাগাতে চায় তাহলে সিংহ পোষমানানেওয়ালা বললেই হয়। কারণ তিনি বলেন যে তিনি পোষমানানেওয়ালা নন; তিনি প্রশিক্ষক। তিনি বলেন, তার সিংহ ও বাঘেরা পোষা নয়, তারা বন্যই আছে।

তার মতে পোষা জন্তুর চেয়ে বন্য জন্তুরা বেশি কথা শোনে বা আদেশ পালন করে। তাঁকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটা করা হয়েছিল তা হচ্ছে কোনো বাঘ ও সিংহ একে অপরের গা চাটে কি না। উত্তরে তিনি জানালেন, তার চারপাশে সিংহ ও বাঘেরা মারামারি করছে, এমন অবস্থায় তিনি বহুবার খাঁচার ভেতর ঢুকেছেন এবং দেখেছেন যে সিংহরা সবসময়ই দলবদ্ধ হয়ে যায় আর বাঘ একা একাই মারামারি করে। যখন একটা সিংহ মারামারি করে তখন আশেপাশের সমস্ত সিংহ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, বিশেষ করে তারা যদি পরস্পর ভাই হয়। তারা হচ্ছে ছোট ছেলেদের মতো, ঠিক মারামারি দেখলেই তার মধ্যে না ভিড়ে পারে না। কিন্তু বাঘের তেমন কোনো নীতিবোধ নেই। যখন সে দেখল অন্য একটা বাঘকে হত্যা করা হচ্ছে তখন সে বসে বসে হাইও তুলতে পারে। ক্লাইভ বিটির আর একটা চমকপ্রদ খেলা হল একটা ভালুককে দিয়ে ডিগবাজি খাওয়ানো। তিনি এটা হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললেন।

একদিন তিনি এক খাঁচায় ঢুকলেন, এমন সময় একটা ভালুক হঠাৎ দাঁত বের করে উত্তেজিত হয়ে থাবা বাড়িয়ে খুনীর চোখে এগিয়ে এল তার দিকে। ভালুকটা তাকে হত্যা করার জন্যই এগিয়ে এসেছিল। তার আক্রমণ ছিল এত আকস্মিক যে ক্লাইভ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তিনি খুব দ্রুত চিন্তা করলেন, তারপর একটু পিছিয়ে এসে ভালুকটার নাকে জোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলেন। নাকে আঘাতের মতো ভালুকের কাছে আর কিছুই এত বেদনাদায়ক নয়। ঘুষিটা লাগার সাথে সাথে ভালুকটা মাটিতে পড়ে একটা ডিগবাজি খেল। তখনই ক্লাইভের মাথায় মতলবটা ঢুকল। ঐ ভালুকটাকেই পূর্ণ ডিগবাজি খাওয়াতে হলে তাকে যা করতে হয় তা হল হুইপ দিয়ে ভালুকটার নাকে আস্তে একটা টোকা মারা।

ক্লাইভ বীটি সব জন্তুকে মানুষের চেয়ে বেশি ভালোভাবে জানেন। তার সবচেয়ে প্রিয় জন্তু হল কুকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *