ওয়েন্ডেল পরিবার : নিউইয়র্কের সবচেয়ে অদ্ভুত ধনী পরিবার

ওয়েন্ডেল পরিবার : নিউইয়র্কের সবচেয়ে অদ্ভুত ধনী পরিবার

ওয়েন্ডেল পরিবার ছিল নিউইয়র্কের সবচেয়ে ধনী পরিবার। হিসেব করে দেখা গেছে ওয়েন্ডেল পরিবারের সম্পত্তির মূল্য দশ কোটি ডলারেরও বেশি।

একজন অবিবাহিত ভাই ও তার চিরকুমারী বোনেরা একটি প্রাসাদোপম বাড়িতে বাস করত। বাড়িটা যখন তৈরি হয় তখন আব্রাহাম লিঙ্কন ইলিনয়ের একজন অখ্যাত আইনজীবী। নিইউয়র্কের সর্বাধিক আলোচিত বাড়িটি ছিল ৩৯ নং স্ট্রিটের ফিফথ অ্যাভিনিউতে। লোকে এটাকে রহস্যময় বাড়ি বলে আখ্যায়িত করেছিল। এ বাড়িকে কেন্দ্র করে জমে উঠত বহু রহস্যময় গল্প, প্রবন্ধ, নাটক এমনকি চলচ্চিত্রও। আপনারা যদি কখনো বাসে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে ফিফথ অ্যাভিনিউতে গিয়ে থাকেন তা হলে আপনার চোখে পড়বে ওয়েন্ডেলদের বাড়িটি আর তার সামনে কুকুরদের খেলা করার জন্য দশ লক্ষ ডলার মূল্যের একটি মনোরম উদ্যান।

ওয়েন্ডেল পরিবারের সদস্যরা ছিল রক্ষণশীল স্বভাবের এবং সনাতন পদ্ধতি অবলম্বন করে জীবন নির্বাহ করত। বিদ্যুতের আলোর পরিবর্তে গ্যাসের আলো ব্যবহার করত, রেডিও আর মোটরগাড়ি ব্যবহারের প্রয়োজন মনে করত না। তাদের পরিবারে আধুনিক উপকরণ ছিল শুধু একটি টেলিফোন সেট। সেটা কেনা হয়েছিল পরিবারের শেষ ব্যক্তিটির মুত্যুর দুদিন আগে–প্রয়োজন হলে ডাক্তার হলে ডাকার জন্য।

এত সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও ওয়েন্ডেল পরিবারের লোকেরা অতীত যুগেই বাস করত।

জন গটলিয়ার ওয়েন্ডেল ১৯১৪ সালে মারা যান। তার সবকটি পোশাক ছিল গৃহযুদ্ধের শেষে ক্রয় করা তার একপ্রস্থ পোশাকের অনুকরণে তৈরি। চল্লিশ বছর আগে তিনি যে বাক্সে করে পোশাকটা এনেছিলেন সেটাতেই ওই পোশাকটা রাখতেন। তিনি রং করা কোনো পোশাক পরতেন না। যখন কালো পোশাক পরতে চাইতেন তখন স্কটল্যান্ডের কোনো ফার্ম থেকে কালো রঙের ভেড়ার পশম আনিয়ে নিতেন। কি বৃষ্টি, কি রোদ, কি শীত, কি গ্রীষ্ম সব সময়ই একটা ছাতা থাকত তার হাতে। একটা খড়ের টুপি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওটাকে বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করতেন। ঋতুর শুরুতে তা রাঙিয়ে নিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সব রকমের রহস্যময় রোগের সংক্রমণ ঘটে পায়ের তলা দিয়ে। তাই নিজের দেহ এবং মাটির জীবাণুর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য এক ইঞ্চি পুরু গাটাপার্চা দিয়ে জুতোর সোল তৈরি করিয়ে পরতেন। ঐ সময় তিনিই ছিলেন নিউইয়র্কের শ্রেষ্ঠ জমিদার। তিনি গ্যাট হয়ে বসে থেকে তার চারপাশে শহর গড়ে উঠতে দিয়েই বড়লোক হয়ে গেলেন। ওয়েন্ডেল বোনেরা মদ্যপান অপছন্দ করতেন। জন গটলিয়ার ওয়েল্ডেলের সাতজন বোন ছিল এবং তাদের যাতে বিয়ে না হয় তজ্জন্য তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল, যদি তাদের বিয়ে হয় ও সন্তান সন্ততি হয় তা হলে ভূ-সম্পত্তি খণ্ডিত হয়ে যাবে। তিনি বোনদের সাবধান করে দিতেন যে সবাই তাদের টাকার পিছনেই ছুটছে এবং যখন পুরুষরা তাদের সাথে দেখা করতে আসত গটলিয়ার সরাসরি তাদেরকে আবার আসতে নিষেধ করতেন। এই সাত বোনের একজন মাত্র বিয়ে করেছেন ষাট বছর বয়সে। অন্যান্যারা বুড়ো হয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। অর্থ যে কত অর্থহীন হতে পারে তার করুণ দৃষ্টান্ত তাদের ব্যর্থ জীবনকাহিনী। বোনদের মধ্যে সবচেয়ে তেজস্বী ছিলেন জর্জিয়ানা। তিনি পরিবারে সনাতন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে কুড়ি বছর মানসিক হাসপাতালে রাখা হল। তিনি পাঁচ মিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন; কিন্তু এই অর্থ তাকে পাঁচ সেন্টের সুখও এনে দিতে পারে নি।

ওয়েন্ডেল পরিবারের বোনেরা যখন মারা পড়লেন, একে একে তাদের ঘরে জানালাগুলি বন্ধ করে। দেয়া হল এবং দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হল। সর্বশেষ বোন মিস এলা ওয়েন্ডেল তার শোবার ঘর, নিচতলার খাবার ঘর এবং উপর তলার খালি বড় ঘর যেখানে তিনি বোনদের সাথে স্কুল জীবন দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলেন–

তিনি কয়েকটি ঘর খোলা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে রাখতেন। অনেক বছর তিনি ওই ভয়াবহ চল্লিশ কামরাওয়ালা ভুতুড়ে বাড়িতে একাকী বাস করছেন। আর তার সাথী ছিল হাতে গোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত চাকর, কয়েকটি ফরাসি কুকুর, টবি।

এই অদ্ভুত ধনী পরিবারে শেষ উত্তরাধিকারী এলা ওয়েন্ডেল যখন মারা যান তখন তিনি মিশনারি কাজের জন্য মেথাডিস্ট চার্চকে লক্ষ লক্ষ ডলার দান করে যান। মারা যাওয়ার পূর্বে তাদের পরিবারে কোনো আত্মীয় জীবিত ছিল বলে তিনি জানতেন না। কিন্তু মৃত্যুর একবছরের মধ্যেই হঠাৎ করে ছাতার মতো প্রায় দুহাজার তিনশ আত্মীয় নামধারী অংশীদার গজিয়ে উঠল। তাদের সবাই অংশীদারিত্ব দাবি করে বসল-কেবলমাত্র টেনেসিতেই দুশো নব্বই জন তথাকথিত আত্মীয় তার পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তির এক একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দাবি করে বসল। জার্মান দূতাবাস চারশ জার্মানের পক্ষ থেকে এক ঢালাও দাবি জানাল আর চেকোশ্লোভাকিয়া এত বেশি উত্তরধিকারিত্ব দাবি করে বসল যে ফরেন অফিসের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হল। দুব্যক্তি তো সম্পত্তির লোভে নিজেদেরকে জন ওয়েন্ডেলের ছেলে বলে দাবি করল এবং প্রচার করতে লাগল যে জন ওয়েন্ডেল তাদের মাকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন।

জন গটলিয়ার ওয়েন্ডেল কখনো উইল করেন নি। কারণ তিনি চান না কোনো উকিল তার সম্পত্তি থেকে দু-পয়সা করে নিক। কিন্তু তার ফল হয়েছিল বিপরীত। ওই সম্পত্তির ভাগ বণ্টন হওয়ার আগেই আড়াইশো জন উকিল ওয়েন্ডেলদের বিশাল সম্পত্তি থেকে তাদের সঠিক পাওনা পকেটে পুরে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *