১.১২ উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)

আগে বলেছি যে, আমাদেরগ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। বৃটিশ সরকারের বদৌলতে প্রতি ইউনিয়নে প্রাইমারী স্কুল ছিল একটি করিয়া (ডিঃ বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হত বলে ওর নাম ছিল-“বোর্ড স্কুল”)। আমাদের ইউনিয়নের “বোর্ড স্কুল”ট চর বাড়ীয়া মৌজায় অবস্থিত, দূরত্ব আমাদের গ্রাম হতে প্রায় ৫ মাইল। আর বরিশাল শহর ছাড়া হাইস্কুল ছিল না এ অঞ্চলে একটিও। কাজেই ১৩৩৪ সালের পূর্বে আমাদের গ্রামের কোন ছেলে-হাই স্কুল তো দূরের কথা, প্রাইমারী স্কুল ও চিনতো না।
১৩৩৪ সালে বরিশালের টাউন (হাই) স্কুলে ভর্তি হ’ল স্থানীয় ছাত্ৰ-আঃ আজিজ মাতুব্বর ও ফজলুর রহমান মৃধা যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে এবং এ শ্রেণী অতিক্রম করল ১৩৩৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসে। এ সময় আমার স্বাস্থ্যের অনেকটা উন্নতি হয়েছে। পরীক্ষার পর ওদের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর যাবতীয় পাঠ্য পুস্তক এনে আমি পড়তে শুরু করলাম। দিনের বেলা পড়বার সময় অল্পই পেতাম, বিশেষ ভাবে পড়তে হত রাত্রে। কেননা তাত তৈরীর কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বিশেষত- জীবনে যতটুকু পড়াশুনা করেছি, তা অধিকাংশই রাত্রে ।
চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ্য বই গুলো একবার পড়ে দেখে রেখে দিলাম এবং পঞ্চম শ্রেণীর -সাহিত্য, পড়বার জন্য একটা “রুটিন” করে নিলাম। কিন্তু ইংরেজী নিলাম না। তার কারণ ইংরাজী পড়ায় আমার একটা অসুবিধে হচ্ছিল এই যে, কতিপয় ইংরেজী শব্দের “উচ্চারণ” সাধারণ নিয়ম মত হয় না, হয় এক অভিনব রূপে। আবার কতগুলো শব্দের কোন কোন “বর্ণ” লুপ্ত রেখে উচ্চারণ করতে হয়। যদিও এ অনিয়মটাও একটা “নিয়ম”, তথাপি প্রাথমিক শিক্ষার্থীর পক্ষে কোন শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া এ অসুবিধে কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। বাংলা ভাষায় ওরূপ উচ্চারণ বিভ্রাট নেই, তা নয়। তবে মাতৃভাষা বলে তা কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে ততটা কঠিন বোধ হয়নি, যতটা হচ্ছে ইংরেজীতে। একজন ইংরেজী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতে “রাজভাষা” নামক একখানা বই কিনলাম। বই খানায়ে-নিত্যাবশ্যকীয় যাবতীয় ইংরাজী শব্দের বঙ্গানুবাদ এবং উহার “উচ্চারণ” ভঙ্গি বাংলায় লিখিত ছিল। ওখানা পড়তে থাকলাম, রুটিন করে নয়; ইচ্ছাধীন রূপে।
নিয়মিত ভাবে পড়তে লাগলাম এবং ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও (১৩৩৬ সালের অগ্রহায়ণ মাসে) বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে (৫ম শ্রেণীর) পাঠ্য বইগুলো পড়া সমাপ্ত করলাম। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি কি-না তা জানিনে। কারণ আমার পরীক্ষক-আমিই, অন্য কেউ নয়। আমার পরীক্ষার স্বরূপটি এই-বই গুলো ভাল ভাবে পড়ে পরীক্ষার জন্য তারিখ ধার্য করেছি এবং প্রত্যেক বিষয়ের পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখের এক মাস (ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক পরীক্ষার ১৫ দিন) পূর্বে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর দশটি করে প্রশ্ন লিপিবদ্ধ করে বইয়ের পড়া বন্ধ করেছি, এমন কি হাতে লওয়াও। অতঃপর-নির্ধারিত তারিখে শুধু স্মৃতির সাহায্যে প্রশ্নের উত্তর লিখেছি। পরীক্ষার পরে প্রশ্নোত্তরের সহিত বই মিলিয়ে দেখেছি যে, আমার উত্তর সমূহ কতটুকু ভুল বা নির্ভুল হয়েছে এবং তদনুপাতে নম্বর দিয়েছি। এতে কোন কোন বিষয় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি, সব বিষয়ে পারিনি। তবে ওর জন্য আর স্বতন্ত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করিনি, স্থির করেছি ও সব বিষয় পরে শোধরে নেব। যা হোক এভাবে আমার পড়া চালাতে লাগলাম।
(আঃ আজিজ ও ফজলুর রহমানের পুরোনো পাঠ্য বই গুলো যত্ন সহকারে এনে আমি A নিয়মিত ভাবে পাঠ করেছি-১৩৩৫-১৩৪১ সাল পর্যন্ত (১০ম শ্রেণী)। ১৩৪০ সালে – ? আঃ আজিজ তার পিতৃ বিয়োগ হেতু পরীক্ষা না দিয়ে পড়া বন্ধ করে এবং ফজলুর রহমান মেট্রিক পাশ করে বরিশাল বি, এম কলেজে ভর্তি হয়। অতঃপর আমি ১৩৪২ ও ১৩৪৩ সাল পর্যন্ত ফজলুর রহমানের “আই, এ” শ্রেণীর ১ম ও ২য় বছরের পুরোনো পাঠ্য বই গুলো অধ্যয়ন করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তার “বি, এ” শ্রেণীর পাঠ্য গুলো কোন কারণে আমার হস্তগত না হওয়ায়, তখন উহা পাঠ করিতে পারিনি। তবে উহা পাঠ করবার সুযোগ পেয়েছিআমার সেজ ছেলে আঃ খালেক (মানিক) এর- ঢাকা টিএনটি কলেজে “বি,এ” পড়বার প্রাক্কালে-১৩৮০-১৩৮১ সালে। ১৩৪৩ সালের পর হতে পাঠ্য পুস্তক পড়বার সুযোগ হারিয়ে ১৩৪৪ সালে হতে শুরু করি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে ওখানে পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা)।