৪১. মুক্তির পথ

[১৯০০ খ্রীঃ ১২ মার্চ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যাণ্ডে প্রদত্ত বক্তৃতার বিবরণ।]

‘ওকল্যাণ্ড এনকোয়ারার’ (Oakland, Enquirer) পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্যসহ বক্তৃতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের মতে ‘মুক্তির পথ কি?’—এ বিষয়ে বক্তৃতা শুনিবার জন্য গত সন্ধ্যায় ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এর ওয়েণ্ড্‌টে হল-এ (Wendte Hall) বিপুল শ্রোতার সমাগম হইয়াছিল। স্বামী যে তিনটি ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়াছিলেন, এটিই সেগুলির শেষ বক্তৃতা। তিনি অংশতঃ বলেনঃ

কেহ বলে—ঈশ্বর স্বর্গে আছেন। আর একজন বলে—ঈশ্বর প্রকৃতিতে এবং সর্বত্রই বিদ্যমান। কিন্তু মহৎ বিপর্যয় উপস্থিত হইলে আমরা দেখিতে পাই, উদ্দেশ্য একই। আমরা সকলেই বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করি, কিন্তু পরিণাম ভিন্ন হয়।

প্রত্যেকটি মহান্‌ ধর্মের দুইটি মহৎ নীতিবাক্য—ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ। আমরা সকলেই সত্য চাই, এবং জানি যে, আমরা চাই বা না চাই সত্য আসিবেই। কিছু পরিমাণে আমরা সকলেই সেই সত্যের (শ্রেয়ের) জন্য চেষ্টা করিতেছি। সত্যলাভের প্রতিবন্ধক কি? আমরা নিজেরাই। আপনাদের পূর্বপুরুষগণ এই প্রতিবন্ধককে ‘শয়তান’ বলিতেন; কিন্তু ইহা আমাদের নিজেদের মিথ্যা ‘অহং’। আমরা দাসত্বের মধ্যে বাস করি, এবং দাসত্ব না থাকিলে আমরা মরিয়া যাইতাম। আমরা সেই লোকটির মত, যে নব্বই বৎসর ঘোর অন্ধকারে থাকার পর প্রকৃতির সূর্যালোকে আনীত হইলে পূর্বেকার সেই অন্ধকার কক্ষেই ফিরিয়া যাইবার জন্য কাতর প্রার্থনা জানায়। আপনারা এই গতানুগতিক পুরাতন জীবনযাত্রা ছাড়িয়া নূতন অধিকতর উন্মুক্ত স্বাধীনতায় যাইতে চাহিবেন না।

প্রকৃত ঘটনার গভীরে প্রবেশ করাই প্রধান সমস্যা। ব্যাপারগুলি হইতেছে—অমুক জ্যাকের ছোটখাট নিকৃষ্ট বিভ্রান্তিসকল, যে জ্যাক মনে করে, বিভিন্ন ধর্মবিষয়ে সে যতই সামান্য হউক না কেন, তাহার একটি অসীম আত্মা আছেন। ধর্ম-হিসাবে এক দেশের মানুষ বহুপত্নীক; অন্যদেশে একজন নারীর অনেক পতি আছে। সুতরাং কোন কোন লোকের উপাস্য দুই দেবতা, কাহারও উপাস্য এক ঈশ্বর, কেহ কেহ কোন ঈশ্বরেই বিশ্বাস করে না।

কিন্তু কাজ ও ভালবাসার মধ্যে আছে মুক্তি। আপনারা কোন একটি বিষয় সম্যক রূপে শিখিয়াছেন; যথাসময়ে হয়তো সেই বিষয় স্মরণ করিতে পারিতেছেন না, তথাপি জিনিষটি আপনাদের আন্তর চেতনায় ডুবিয়া গিয়াছে এবং আপনাদের অঙ্গীভূত হইয়া আছে। অতএব আপনারা যখন কাজ করেন, সেই কাজ ভালই হউক বা মন্দই হউক, তখন আপনারা নিজেদের ভাবী জীবন ধারা গঠন করেন। যদি আপনারা কর্মের ভাবে ভাবিত হইয়া—কর্মের জন্যই কর্ম হিসাবে—সৎ কর্ম করেন, তবে আপনাদের ভাব অনুযায়ী স্বর্গে গমন করিবেন এবং স্বর্গের স্বপ্ন দেখিবেন।

পৃথিবীর ইতিহাস মহাপুরুষ ও উপদেবতাদের ইতিহাস নয়, উহা সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মত, যেগুলি সমুদ্রের স্রোত-তাড়িত বস্তুখণ্ডসমূহ হইতে আপনা-আপনি মহাদেশ- রূপে গড়িয়া উঠে। তাহা হইলে প্রতি গৃহে অনুষ্ঠিত আত্মোৎসর্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যের মধ্যে নিহিত আছে পৃথিবীর ইতিহাস। মানুষ তাহার নিজস্ব বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভর করিতে ইচ্ছা করে না বলিয়াই ধর্ম গ্রহণ করে।

মানুষ ঈশ্বরকে যেরূপে গভীরভাবে ভালবাসে, সেরূপে ভালবাসার মধ্যেই তাহার মুক্তি নিহিত আছে। আপনার পত্নী বলেন, ‘জন, তোমাকে ছাড়া থাকিতে পারি না’। কেহ কেহ অর্থ হারাইলে তাহাদিগকে পাগলা-গারদে পাঠাইতে হয়। আপনারা কি আপনাদের ঈশ্বর সম্বন্ধে সেরূপ অনুভব করেন? আপনারা যখন অর্থ, বন্ধু, পিতা-মাতা, ভাই-ভগিনী ও ইহজগতের সব কিছু পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হন এবং শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যাহাতে তিনি তাঁহার প্রেমের কিঞ্চিৎ আপনাদিগকে দান করেন, তখনই আপনারা মুক্তিলাভ করিবেন।