৩য় পর্ব : অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে

তৃতীয় পর্ব

অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে আশেপাশের সবকিছু এমনকি শহরের প্রতিটি মানুষের জীবনও গ্রাস করে ফেলল প্লেগ। একদিন উঠল প্রচণ্ড ঝড়, এবং প্লেগ-উপদ্রুত শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলল সেই ঝড়। ওরাওঁ-এর অধিবাসীরা ঝড়কে ভীষণ ভয় পায়, কেননা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ঝড়ের গতিপথে বাধা দেয়ার মত প্রাকৃতিক কোন প্রতিবন্ধক নেই শহরে। গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় সবকিছুর ওপর ধুলোর একটা পুরু আস্তর জমে উঠেছিল। ঝড়ে সেগুলো হালকা মেঘের মত ওপরে উঠে উড়তে লাগল বাতাসের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল ধুলার ধূসর মেঘে। মানুষের চারপাশে ঘুরতে লাগল অসংখ্য কাগজের টুকরো। এই দুই কারণে ক্রমেই জনশূন্য হয়ে পড়তে লাগল রাস্তাঘাট। কদাচিৎ কেউ বেরোলেও, রুমাল বা হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তড়িঘড়ি হাঁটছে। রাত নামলে আগে যেমন চারদিকে মানুষের সমাগম হত, নিজেদের তারা। ডুবিয়ে দিত আনন্দ ফুর্তির ভেতর, এখন আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না .এখন জনশূন্য রাস্তায় ঝড়ের একটানা ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। ঝড়ে আন্দোলিত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র থেকে ভেসে আসে লবণাক্ত পানি আর পচা আগাছার গন্ধ। শহরটাকে মনে হয় অভিশপ্ত মানুষের বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ।

এতদিন প্লেগ তার শিকার খুঁজছে শহরতলির ঘিঞ্জি অঞ্চলে। কিন্তু এবার হামলা চালাল বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয়, এবং সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জাকিয়ে বসল। মানুষ বলল, বাতাস রোগের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, এইসব এলাকাকে শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলা হবে, হাতে গোনা কিছু লোককে ছাড়া কাউকে আর বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হবে না।

ঠিক এই সময় থেকে পশ্চিম ফটক সংলগ্ন অঞ্চলগুলোয় আগুন লাগাটা অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল যে সব মানুষকে সংক্রমণ এলাকার বাইরে রাখা হয়েছিল তাদের কেউ কেউ সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল, এবং তারাই এইসব আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রিয়জন বিয়োগের শোকে এরা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। ভাবছে, আগুন জ্বালিয়ে প্লেগের জীবাণু মেরে ফেলা যাবে। শহরে ঝড় বইতে থাকায় এই আগুন মানুষের মনে এক ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ এই অপরাধের জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান জারি করলেন। শেষে ওই অপ্রকৃতিস্থ লোকগুলো শান্ত হয়ে এল। অবশ্য ওরা যে হাজতবাসের ভয়ে এই কাজ ছাড়ল, তা নয়। জেলখানায়ও এখন মৃত্যুর হার অকস্মাৎ বেড়ে গিয়েছে, বস্তুত এই ভয়েই কেউ জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিল না।

যেসব মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করে-যেমন সৈনিক, কয়েদি, পাদ্রি এবং নান-প্লেগ প্রথমে তাদেরকেই আক্রমণ করে। জেলখানাগুলোয় সাধারণ কয়েদি মারা পড়ছে যে পরিমাণে, ওয়ার্ডাররাও পটল তুলছে সেইভাবে। প্লেগের কাছে ছোট-বড় কোনরকম ভেদাভেদ নেই। শহরে যে দুটো মঠ আছে, সেখান থেকে ধর্মযাজকদের সরিয়ে এনে ধার্মিক কিছু পরিবারের সঙ্গে সাময়িকভাবে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হলো। ব্যারাক থেকেও কিছু সৈনিককে নিয়ে এসে রাখা হলো বিভিন্ন স্কুল এবং সরকারি অফিসে।

এইসব পরিবর্তন এবং একটানা ঝড়ো হাওয়ার কারণে কারও কারও মনে দেখা দিল দাঙ্গাবাজ মনোভাব। শহরের বিভিন্ন ফটকে প্রায়ই হামলা হতে লাগল। যারা আক্রমণ করে তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। দুপক্ষের ভেতর রীতিমত গুলি বিনিময় হয়। তাই বাড়িয়ে দেয়া হলো গার্ডপোস্টের সংখ্যা। এর ফলে আস্তে আস্তে আক্রমণও থেমে গেল।

ফটকে আক্রমণ থেমে গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে ছোট আকারে বল প্রয়োগের ঘটনা আরম্ভ হয়ে গেল। স্যানিটারি কর্তৃপক্ষ যে-সব বাড়ি সাময়িকভাবে বন্ধ করে রেখেছিলেন, সেসব বাড়িতে লুটতরাজ শুরু হলো। সাময়িক উত্তেজনার ঝোঁকে এইসব কাজে মেতে উঠল মানুষ। মাঝে মাঝে আজকাল হতবাক হয়ে যাবার মত দৃশ্য চোখে পড়ে। হয়তো একটি বাড়ি দাউদাউ আগুনে জ্বলছে, পাশে দাঁড়িয়ে শোকে দুঃখে মুহ্যমান মালিক তাকিয়ে আছেন আগুনের লেলিহান শিখার দিকে; এমন সময় কেউ সাময়িক উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে সেই জ্বলন্ত বাড়ির ভেতর। আশেপাশের অনেক দর্শক তখন সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পিছু নেয় লোকটার। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, অন্ধকার রাস্তা জুড়ে অসংখ্য মানুষ দাপাদাপি করছে; তাদের মাথার ওপর অথবা কাঁধে সংসারের আসবাবপত্র।

কর্তৃপক্ষ সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হলেন। একদিন লুণ্ঠনে ব্যস্ত দুজন লোককে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হলো। রাত এগারোটা থেকে বলবৎ করা হয় সান্ধ্য-আইন। অন্ধকারে নিমজ্জিত ওরাওঁ শহরকে তখন মনে হয় একটা বিশাল কবরস্থান। চারদিকে কোথাও পায়ের শব্দ কিংবা কুকুরের ডাক শোনা যায় না। সবখানে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। শহরের দীর্ঘ রাস্তা আর তার দুপাশের আধা-মলিন দেয়াল, মনে হয় যেন সামনের দিকে যেতে যেতে এক সময় হঠাৎ হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। মোড়ে মোড়ে যেসব জঁদরেল মহাপুরুষের প্রস্তর মূর্তি আছে, মনে হয় প্রাণহীন এই শহরে তারাই এখন একমাত্র। প্রতিনিধি।

এখন প্লেগে কারও মৃত্যু হওয়ার অর্থ, সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে তার পরিবারের সবার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। লাশের পাশে আত্মীয়-স্বজনের আসা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সন্ধ্যায়, মারা গেলে সারারাত ধরে কেউ আর তার শিয়রে বসে থাকে না। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকে শব। আর রাতে মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যারা পরিবারের সঙ্গে বাস করা অবস্থায় মারা যায়, সেসব পরিবারকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। আর যেসব রোগী আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দূরে মারা যায়, তাদের বেলায় পরিবারপরিজনদের লাশ দেখার সুযোগ দেয়া হয় নির্দিষ্ট একটা সময়ে-গোসল করানোর সময়। এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো ঘটে, ধরে নেয়া যাক, রিও-র অস্থায়ী হাসপাতালে। যে-স্কুল ভবনকে এই হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে, তার পিছনের দিকে বাইরে বের হবার একটা পথ আছে। কফিনে শোয়ানো লাশটা রাখা হয় বড় একটা গুদাম ঘরে। মৃত ব্যক্তির আপনজনেরা এসে দেখতে পায় আগেই পথের ধারে পেরেক মারা কফিন নামিয়ে রাখা হয়েছে। তারা সই দেন কতকগুলো সরকারি কাগজপত্রে। এরপর কফিনটাকে তুলে দেয়া হয় কোন শবযান বা অ্যাম্বুলেন্সে। অপেক্ষমাণ কোন ট্যাক্সিতে গিয়ে ঢোকে শোকাচ্ছন্ন পরিবারের লোকজন। শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে পাশ কাটিয়ে অন্য একটা পথ ধরে কবরস্থানের দিকে ছুটে যায় শবযান। শহরের বাইরে যাবার ফটকে পৌঁছে থামে সবাই। একজন পুলিস অফিসার বাইরে যাবার অনুমতিপত্রের ওপর সীলমোহর লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ চলার পর আবার থেমে পড়ে শবযান। এটাই কবরস্থান। আগেই কবর খুঁড়ে রাখা হয়। ওদের দেখে এগিয়ে আসেন একজন পাদ্রি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় শবকে গির্জায়। নিয়ে যাবার চিরন্তন রীতি এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কফিন শবযান থেকে নামিয়ে কবরের পাশে রাখা হয়। দড়ি খুলে দিতেই সশব্দে গর্তে পড়ে যায় লাশ। কবরের ওপর মন্ত্রপূত পানি ছিটিয়ে দেন। ধর্মযাজক। শবযান আগেই চলে যায়। কবর ভরাট হতে না হতেই। ট্যাক্সিতে গিয়ে ওঠে আত্মীয়স্বজন। পনেরো মিনিটের ভেতর বাসায় ফিরে যায় সবাই।

অর্থাৎ, গোটা ব্যাপারটাই সম্পন্ন হয়ে যায় অত্যন্ত দ্রুতোর সঙ্গে অথচ প্রায় ঝুঁকিহীনভাবে। স্বাভাবিকভাবেই, এরকম বিদ্যুৎগতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেরে ফেলার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় শুরুতে মৃত ব্যক্তির পরিবারের অনেকেই ক্ষুব্ধ হলো মনে মনে। কিন্তু এটাও ঠিক প্লেগের মত ভয়াবহ একটা সঙ্কট মোকাবিলায় তুচ্ছ ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলে না, এবং সেজন্যেই জলাঞ্জলি দেয়া হলো আর সব মানবিক অনুভূতিকে। এর ফলে শহরবাসীদের কারও কারও মনোবলও ভেঙে পড়ল। তবে সৌভাগ্যক্রমে, ঠিক সে-সময়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় সবার নজর পড়ল গিয়ে আশু সমস্যার দিকে। বিভিন্ন রকমের ফরম পূরণ করা, কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যাবে তা খুঁজে দেখা, প্রতিদিন দোকানের সামনে লাইন দেয়া-এইসব কাজে এত সময় নষ্ট হতে লাগল যে, এরপরে আশেপাশে, কে কোথায় কিভাবে মরছে বা নিজেদেরও একদিন কিভাবে মরতে হবে–এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার মত অবসরই আর পেল না কেউ।

যতই দিন যেতে লাগল, দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠতে লাগল কফিন, কাফনের কাপড় আর গোরস্থানে কবর দেয়ার জায়গা। এবার, অগত্যা, ঠিক করা হলো, একগর্তে যত বেশি সম্ভব লাশকে দাফন করা হবে।

রিও-র হাসপাতালে কফিনের মজুত নেমে এল পাঁচে। সেগুলো যখন ভর্তি হয়ে গেল, একসঙ্গে তুলে দেয়া হলো অ্যাম্বুলেন্সে। কবরস্থানে পৌঁছার পর লাশগুলো বের করা হলো বাক্স থেকে, তারপর স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কাছেরই একটা চালাঘরে। আরও কিছু লাশ আসার পর একসঙ্গে কবর দেয়া হবে, সে-পর্যন্ত এখানেই থাকবে এগুলো। এরপর শূন্য কফিনগুলোয় জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়ে আবার সেগুলো ফেরত পাঠানো হলো হাসপাতালে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিয়মকানুনেও রদবদল করা হলো কিছু। কবরস্থানের পিছনের একটা খোলা জায়গায় দুটো প্রকাণ্ড গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। এর চারপাশে আছে গাছের সারি। একটা গর্ত রাখা হলো পুরুষদের জন্যে, অন্যটা মেয়েদের। কিছু জায়গায় সমস্যা দেখা দেয়ায় এখন থেকে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নিক্ষেপ করা। হতে লাগল ওই গর্ত দুটোয়। এবং মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-পরিজন যাতে মনোকষ্ট না পায় সেজন্যে আইন জারি করা হলো, কবর দেয়ার সময় কর্তৃপক্ষীয় লোকজন ছাড়া অন্য কেউ ওখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না। আত্মীয়স্বজন শুধুমাত্র কবরখানার ফটক পর্যন্ত যেতে পারবে।

তবে, স্ত্রী পুরুষকে আলাদাভাবে শনাক্ত করার ব্যবস্থা বলবৎ রইল এখনও, এবং কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেন। প্রতিটা গর্তের তলায় চুন ছিটিয়ে একটা পুরু আস্তরণ তৈরি করা। হলো, সেখান থেকে সব সময় ধোঁয়া ওঠে। অনেকগুলো লাশ একসঙ্গে গর্তে নামানোর পর তাদের ওপর ছিটিয়ে দেয়া হয় আর এক প্রস্থ চুন আর এর ওপরে সামান্য মাটি, তবে কখনোই ইঞ্চি কয়েকের বেশি পুরু নয় যাতে পরে আরও লাশ এলে সেগুলোকে এর ওপর শোয়ানো যায়। পরদিন, আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে মৃত ব্যক্তিদের জন্যে যে রেজিস্টার আছে সেটা সই করিয়ে নেয়া হয়-যাতে মানুষ এবং অন্য কিছু, ধরা যাক, কুকুরের মধ্যে। পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। মানুষের মৃত্যু খাতায় লিপিবদ্ধ করা। হত।

কাজকর্মের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক লোকের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, অথচ রিওকে সাহায্য করার মত মানুষের তখন ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে। গোরখোদক, স্ট্রেচার বাহক, এবং এই ধরনের ছোটখাট কাজের জন্যে অন্যান্য যেসব সরকারি কর্মচারি থাকে, প্রথম তারা, এবং পরে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। যত কঠোর সাবধানতাই অবলম্বন করা। হোক না কেন, দুদিন আগে বা পরে, ছোঁয়াচে ঠিকই তার থাবা, বসাল।

অবশ্য মহামারী আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ার ফলে রোগ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন লোক পাওয়াটা একটু সহজ হলো। শহরের অর্থনৈতিক জীবনে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় অনেকেই বেকার হয়ে পড়ল। ফলে, ভয়ের চেয়ে দারিদ্রই এখন থেকে অধিকতর শক্তিশালী তাড়না হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, এবং বিশেষ করে, মুর্দা দাফনের কাজে ঝুঁকি থাকায়, মজুরি বেশি দেয়া হয় বলে, এ ধরনের তুচ্ছ কাজের লোকের সমাগম গেল বেড়ে।

অগাস্ট মাস পর্যন্ত মৃতদের কবরস্থানে নেয়ার জন্যে মানুষের কোন অভাব হলো না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য চেহারায়। এরপর মৃত্যুর হার হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেল, এবং এ অবস্থাই বজায় রইল। ছোট কবরস্থানটায় এত লাশের জায়গা দেয়া এবার সত্যিই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। কবরস্থানের চারপাশের দেয়ালগুলো ভেঙে আশেপাশের জমিতেও কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হলো না।

এই সমস্যা সমাধানের জন্যে শুধুমাত্র রাতের বেলায় কবর দেয়া চালু হলো। এর ফলে সম্ভব হলো দাফনের শিষ্টাচারগুলোকে কমিয়ে ফেলা। এবার নিয়ম হলো, সবগুলো মৃতুদেহকে ঠেসে তুলে দেয়া হবে একটা অ্যাম্বুলেন্সে। রাতে ঘোরাফেরা যাদের অভ্যাস, হামেশাই পরিচিত একটা দৃশ্য চোখে পড়তে লাগল তাদের। সাদা অ্যাম্বুলেন্স বোঝার ভারে এগিয়ে চলেছে টলতে টলতে। আশেপাশের রাস্তায় শোনা যায় তাদের একঘেয়ে ঢং ঢং আওয়াজ! গোরস্থানে পৌঁছানোর পর, মৃতুদেহগুলোকে কোনরকমে গর্তের মধ্যে ঢেলে দেয়া হয়। গর্তের নিচে সেগুলো ঠিকমত পাশাপাশি পড়ল কিনা সেটা দেখার অবকাশও তখন থাকে না কারও। তারপর কোদালে কোদালে চুন ছিটানো হয় লাশগুলোর ওপর, সঙ্গে সঙ্গে মৃত মুখগুলো ঝলসে বিকৃত হয়ে যায়। এরপর ওদের ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয় মাটি। অনেক সময় লাশগুলো ঠিকমত ঢাকাও পড়ে না। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততই ভরাট হতে থাকল অগণিত কবর। ফলে দেখা দিল আর এক সমস্যা।

কর্তৃপক্ষ এবার সিদ্ধান্ত নিলেন পুরানো যত কবর আছে, খালি। করতে হবে। গলিত দেহাবশেষগুলোকে কবর থেকে তুলে পাঠানো হলো শ্মশানে। আর সেই থেকে, প্লেগে মরা লাশগুলোকে সরাসরি শ্মশানে পাঠানো হতে লাগল। সেখানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় ওদের। ওরাওঁ-এ একটাই শ্মশান আছে, শহরের পুব ফটকের বাইরে। শ্মশান ব্যবহারের সুবিধার্থে, পুব ফটকের গার্ডপোস্টটাকে আগের জায়গা থেকে খানিকটা তফাতে সরিয়ে নেয়া হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শ্মশানে পৌঁছানোর যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে।

এ-সময় এক মিউনিসিপ্যাল কর্মচারির মাথা থেকে অভিনব এক বুদ্ধি বের হলো, এবং এর ফলে কর্তৃপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সাগর-উপকূলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ট্রাম লাইনটা এতদিন অকেজো অবস্থায় পড়েছিল; ওই কর্মচারি সেটাকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিল। নয়া উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজনীয় রদবদল করা হলো ট্রামগুলোকে। ছোট ছোট ট্রলির ভেতরটাও বদলে ফেলা হলো যথাসম্ভব। শ্মশানে যাওয়ার জন্যে নতুন একটা লাইনও খোলা হলো। এখন থেকে ট্রাম আর ট্রলির গন্তব্য হলো ওই শ্মশান।

সেবার গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং সারাটা শরঙ্কাল ধরে প্রতিদিন একই দৃশ্য চোখে পড়ল সকলের। সাগর-উপকূল থেকে খাড়া ওপরে উঠে গেছে যে-পাহাড়ের চূড়া আর তার চারপাশের ঘোরানো রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে অবিরাম ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সব ট্রাম, যাত্রীশূন্য অবস্থায়। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল। তখন থেকে কিছু কিছু লোক ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে লুকিয়ে থাকতে শুরু করল পাহাড়ের আশেপাশে। চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকা সত্ত্বেও এটা বন্ধ করা সম্ভব হলো না। ট্রামগুলো যখন পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগোয়, তখন ওরা আড়াল থেকে ট্রামের ওপর ছুঁড়ে দেয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। এ-ভাবে মৃতদেহ আর ফুলে ভর্তি ট্রামগুলো গ্রীষ্মের উত্তপ্ত অন্ধকারে একটানা ঝপঝপ শব্দ করতে করতে একটার পর একটা চলে যায় শ্মশানে।

এই বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রকৃতিও উন্মত্ত হয়ে উঠল। শহরের পুব আকাশে এবার দেখা দিল ধোঁয়াটে বিশ্রী গন্ধভরা তেলতেলে একটা আনত মেঘ। ডাক্তাররা বলল গন্ধটা বিশ্রী হলেও এই মেঘ স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষরা ধরে নিল ওই মেঘ সারাক্ষণ ওদের ভেতর রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে। ওরা কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখাল, কেউই এ-অঞ্চলে থাকবে না। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ মেঘটাকে সরানোর নানারকম যন্ত্রপাতি বসাবার আয়োজন করলেন। এরপর দেখা গেল যখন জোরে বাতাস বয়, পুবদিক থেকে একটা আঠাল গন্ধ ভেসে আসে; আর শহরবাসীদের তখন মনে পড়ে যায় ওরা এখন নতুন এক পরিবেশে বাস করছে, যার নাম প্লেগ।

কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে লাশগুলোকে সরাসরি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হবে। এটা ভাবতেই রিও-র চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য: পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে বীভৎস চেহারার সব শব। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যাই ভাবুন, মৃত্যুর হার আর একটু বাড়লে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। হয়তো গাদা গাদা মানুষ মরে রাস্তায় পচতে শুরু করবে। অথবা হয়তো শহরের এমন দৃশ্যও চোখে পড়বে: মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ ঘৃণা কিংবা আশায় জীবিত মানুষদের জড়িয়ে ধরার জন্যে অধীর আগ্রহে ছুটছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *