কোরআনের আলোকে জীবনের সূচনা

কোরআনের আলোকে জীবনের সূচনা

ঠিক কোন্ উৎস থেকে পৃথিবীতে জীবন বা প্রাণের সূচনা ঘটেছে কোরআনে এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব বিদ্যমান। এই পরিচ্ছেদে কোরআনের যে সব বাণী ও বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেব, তাতে দেখা যাবে, জীবনের সূচনা ঘটেছে পানি থেকে। প্রথম উদ্ধৃত বাণীতে বিশ্বসৃষ্টির কথাও উল্লিখিত হয়েছে। যথা :

“অবিশ্বাসীরা কি ভাবিয়া দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিল? পরে, আমরা তাহাদের পৃথক করিয়াছি এবং আমরা প্রতিটি জীবন্ত জিনিসকে বাহির করিয়াছি পানি হইতে? তাহার পরেও কি তাহারা বিশ্বাস করিবে না?”-সূরা ২১ (আম্বিয়া), আয়াত ৩০ :

“একটা কিছু থেকে অন্য একটা কিছু সৃষ্টি করার” এই ধারণা বা মতবাদ সম্পর্কে সন্দেহের কিছু থাকতে পারে না। এখানে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে, তার একটা অর্থ এই হতে পারে যে, জীবন্ত সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে পানির দ্বারা (অর্থাৎ, সেই সৃষ্টির কাজে পানি হল অপরিহার্য উপাদান); অথবা এর আরেক অর্থ এই হতে পারে যে, প্রতিটি জীবন্ত কিছুর উৎপত্তি ঘটেছে পানি থেকেই। তবে, যে অর্থই করা হোক, দুটি অর্থই কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠিত-সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বস্তুত, জীবনের উৎপত্তি ঘটেছে পানি থেকেই; এবং পানিই হচ্ছে জীবন্ত জীবকোষ গঠনের প্রধানতম উপাদান। পানি ছাড়া জীবন আদৌ সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়, যখনই অন্য কোন গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন প্রথমেই যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হল, সেই গ্রহে জীবনরক্ষার উপযোগী পর্যাপ্ত পানি রয়েছে তো?

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণের দ্বারা এই সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত যে, পৃথিবীতে প্রাণ তথা জীবনের প্রাচীনতম নিদর্শনের প্রথম হচ্ছে উদ্ভিদজগৎ। পৃথিবীর প্রাচীনতম যুগ ‘ক্যামব্রিয়ান’ নামে পরিচিত। সেই ক্যামব্রিয়ান আমলেরও আগে এক ধরনের সামুদ্রিক শেওলা বা আগাছার অস্তিত্ব ছিল যেগুলো ‘অ্যালজে’ নামে পরিচিত। প্রাণী-জীবনের আবির্ভাব ঘটে এর কিছু পরে। আর সেই প্রাণী-জীবনেরও উদ্ভব ঘটেছিল সমুদ্র থেকেই।

উপরে কোরআনের আয়াতের অনুবাদে যেখানে ‘পানি’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে তার মূল আরবী হচ্ছে ‘মা’। এর দ্বারা যেমন আসমানের পানি বুঝায়, তেমনি বুঝায় সমুদ্রের পানিও। শুধু তাই নয়, এই ‘মা’ শব্দের দ্বারা যেকোন তরল পদার্থকেও বুঝানো হয়ে থাকে। সুতরাং, এখানে এই মা’ শব্দের দ্বারা প্রথম অর্থে যে ‘পানি’কে বুঝানো হয়েছে সে ‘পানি’ হচ্ছে, জীবনের অপরিহার্য উপাদান। (বিভিন্ন ভাষায় জন্মদাত্রীকে সন্তানেরা যে ‘মা’ নামে ডেকে থাকে–তার সূত্র বোধহয় এখানেই নিহিত।)।

“এবং (আল্লাহ্ তিনিই–যিনি) আসমান হইতে পানি বর্ষাণ এবং উহার দ্বারা আমরা জোড়ায় জোড়ায় উদ্ভিদ জন্মাই, একটা আরেকটা হইতে আলাদা।”–সূরা ২০ (ত্বাহা); আয়াত ৫৩ :

এই ‘পানি’ বা ‘মা’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থের দ্বারা শুধু তরল পদার্থ বুঝায় –যদিও কোন্ ধরনের তরল পদার্থ সে-সম্পর্কে এখানে কিছুই বলা হয়নি তাহলেও এর দ্বারা সেই ‘অজানা তরল পদার্থকেই বুঝানো হয়েছে–যা ছিল প্রাণী-জীবনের আদি উৎস।

“আল্লাহ সমস্ত প্রকারের প্রাণীকে সৃষ্টি করিয়াছেন পানি হইতে।”–সূরা ২৪ (নূর), আয়াত ৪৫ :

পরবর্তী আলোচনায় দেখা যাবে, ‘মা-’ অর্থে এই ‘তরল পদার্থ-টি’ ‘সেমিনাল ফ্লুড’ বা ‘মৌলিক তরল পদার্থ’ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। (বলা অনাবশ্যক যে, এটি হচ্ছে সেই বীর্য যা রিপ্রোডাকটিভ গ্ল্যান্ড বা প্রজনন রসস্রাবী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়, এবং যার মধ্যে থাকে শুক্রকীট।)

যাহোক, এই ‘মা-’ শব্দের দ্বারা জীবনের উৎপত্তিস্থল বা উৎস হিসেবে কিংবা উদ্ভিদের উৎপাদনকারী হিসেবে যেকোন তরল পদার্থ অথবা প্রাণীর শুক্র–যাই বুঝানো হয়ে থাকে, কোরআনের এসব আয়াতে জীবনের উৎস সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কোরআন যখন অবতীর্ণ হয়েছিল, তখন জীবনের উৎস বা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে নানাধরনের গালগল্প এবং উপকথা ও রূপকথার ছিল ছড়াছড়ি। কিন্তু কোরআনের বাণীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কোনও গল্পকথা বা কল্পকাহিনী স্থান পায়নি।

কোরআনের প্রচলিত তফসীরসমূহে দেখা যায়, সে-সবের বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ রচয়িতাবৃন্দ জীবজগতের প্রজনন-সংক্রান্ত আলোচনার চেয়ে উদ্ভিদজগতের আলোচনায় অধিক স্থান ব্যয় করেছেন। অথচ, বাস্তবে কোরআনে শুধু জন্তু জানোয়ার নয়, মানব-প্রজনন সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে।

এটা যখন সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত যে, উদ্ভিদজগতের বংশবিস্তার ঘটে থাকে দুভাবে–এক, যৌন প্রক্রিয়ায়; দুই, যৌন-বহির্ভূত প্রক্রিয়ায় (উদাহরণ, “একের বহু হওয়া”, যেমন, কাটিং বা কলম–যা এক গাছ থেকে আরেক গাছ উৎপাদনের বহুল-প্রচলিত পদ্ধতি)। লক্ষণীয় যে, কোরআনে উদ্ভিদজগতের জোড়া তথা পুং-জাতি স্ত্রী-জাতির অস্তিত্বের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। যথা :

“এবং (আল্লাহ তিনিই–যিনি) আসমান হইতে পানি বর্ষান এবং তদ্দারা আমরা পয়দা করি জোড়ায় জোড়ায় উদ্ভিদ–একটা আরেকটা হইতে আলাদা।”–সূরা ২০ (ত্বাহা), আয়াত ৫৩ :

‘একজোড়া’ শব্দটা এখানে আরবী ‘জাওজ’ (বহুবচনে ‘আজওয়াজ’) শব্দের তরজমা। এই শব্দের মূল অর্থ : যেখানে একজন আরেকজনের মিলিত সঙ্গী, মিলিতভাবে তৈরি করে জোড়া। এই জাওজ’ শব্দটি সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘বিবাহিত দম্পতি’ কিংবা ‘একজোড়া জুতার’ বেলায়।

“এবং যে সমস্ত ফল (আল্লাহ) দিয়াছেন (জমিনের বুকে) তাহাদের দুইটিতে মিলিয়া একজোড়া!”–সূরা ১৩ (রা’দ), আয়াত ৩ :

কোরআনের এই বক্তব্যে সকল জাতের ফলফলাদির মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গের অস্তিত্বের কথাই বুঝানো হয়েছে। অনেক পরে, একান্ত আধুনিক যুগে এসেই ফলফলাদির গঠনাকৃতি নিয়ে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, উদ্ভিদজগৎ থেকে নির্গত সকল কিছুর মধ্যেই রয়েছে যৌন প্রত্যঙ্গগত বিভাজন (এমনকি কলা বা ওই জাতীয় যে-সব ফল রয়েছে যাদের বংশবিস্তার সাধারণত ‘ফুল থেকে ফল’–এই প্রক্রিয়ায় হয় না, তাদের উৎপাদনকর্মেও সুস্পষ্ট যৌন প্রক্রিয়া বিদ্যমান)।

কোরআনে জন্তু-জগতের প্রজনন-প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত বর্ণনা অনুপুংখ হলেও মোটের ওপর সংক্ষিপ্ত। পক্ষান্তরে, মানব-প্রজনন সম্পর্কে কোরআনের আলোচনা সুবিস্তৃত। পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়টা নিয়ে বিশদ আলোচিত হবে।