কাহিনীর কাহিনী

কাহিনীর কাহিনী

আমি এ বইয়ের যে কাহিনী বলতে যাচ্ছি তা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ভূমিকার জন্য বিশিষ্ট কোনো মানুষের আত্মকাহিনী নয়;এটি দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনামূলক কোনো কাহিনীও নয়-কারণ আমার জীবনে বহু বিস্ময়কর এ্যাডভেঞ্চার ঘটে থাকলেও সেগুলি আমার ভেতরে যা ঘটে চলছিল তারই অনুষাঙ্গিক মাত্র, তার বেশি কখনো ছিলো না, ধর্ম-বিশ্বাস অনুসন্ধানে সচেতন প্রয়াসের কাহিনীও এ নয়-কারণ সে বিশ্বাস বহু বছরে আমার জীবনে এসেছে, আমার পক্ষ থেকে তা অর্জনের কোনো চেষ্টা ছাড়াই। আামার কাহিনী হচ্ছে-একজন ইউরোপীয়’র ইসলাম আবিষ্কার এবং মুসলিম সমাজের মধ্যে তার মিশে যাওয়ার সাদামাঠা কথা।

আমি কখনো এ বই লেখার কথা ভাবিনি। কারণ আমার কখনো মনে হয়নি, আমার জীবন আমি নিজে ছাড়া অন্য কারো কাছে বিশেষ কোনো আকর্ষনের কারণ হতে পারে। কিন্তু যখন পাশ্চাত্য জগত থেকে পঁশিচ বছর বাইরে কাটানোর পর আমি প্যারিসে এলাম এবং সেখান থেকে এলাম নিউইয়র্ক ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে, তখন আমি আমার এ মত পাল্টাতে বাধ্য হই। আমি তখন জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে কাজ করছিলাম বলে স্বভাবতই সকলের চোখ ছিলো আমার উপর; আমার ইউরোপীয় ও মার্কিন বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনের মধ্যে আমি বিপুল ঔৎসুক্যের কারণ হয়ে উঠি। প্রথমে ওদের মনে হয়েছিলো আমার কাজ হচ্ছে একজন ইউরোপীয় ‘বিশেষজ্ঞের’, যাকে প্রচ্যে দেশের একটি সরকার একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেছে, আর আমি যে জাতির চাকরি করছি তাদের চালচলনের সঙ্গে আমার সুবিধার খাতিরেই মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানে আমার কার্যকলাপ যখন স্পষ্ট হয়ে উঠলো,আমি কেবল ‘কাজের দিকে’ দিয়েই নয়, বরং আবেগ-অনুভূতি এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়েও সাধারণভাবে মুসলিম জাহানের রাজনৈতিক এবং তামুদ্দিনক লক্ষ্যের সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছি তখন ওরা কিছুটা বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পড়ে। যতই দিন যেতে লাগলো, ক্রমবর্ধমান হারে বেশি বেশি লোক জিজ্ঞাসা করতে লাগলো আমার অতীত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। ওরা জানতে পেলো, আমি আমার জীবনের একেবারে প্রথমদিকে কাজ শুরু করেছিলাম কন্টিনেন্টাল পত্র-পত্রিকাগুলির এক বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র কয়েক বছর ব্যাপক সফরের পর আমি ১৯২৬ সালে মুসলমান হই; ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর প্রায় ছ’বছর আমি আরব দেশে বাস করি এবং বাদশাহ ইবনে সউদের বন্ধত্ব লাভে সমর্থ হই; এরপর আমি আরব দেশ ছেড়ে যাই ভারতে, আর সেখানে আমার সাক্ষাৎ ঘটে পাকিস্তান চিন্তার আধ্যিাত্মিক জনক –এবং মহান মুসলিম কবি-দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবালের সংগে। তিনিই আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করান। আমার পূর্ব তুর্কিস্তান, চীন এবং ইন্দোনেশিয়া সফরের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে এবং ভাবী ইসলামী রাষ্ট্র, যা তখনো ইকবালের স্বাপ্নিক মনের স্বপ্নের বেশি কিছু ছিলো না, তার বুদ্ধিবৃত্তিক সূত্রগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য ভারতে থেকে যেতে। আমার কাছে, ইকবালের মতোই এ স্বপ্ন ছিলো ইসলামের সমস্ত ঘুমন্ত আশাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার একটি পথের, বস্তুত, একমাত্র পথের প্রতীকঃ একটি জনগোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক সত্তার সৃষ্টি, যার সংহতির  ভিত্তি একই রক্ত-বংশ নয়, বরং একটি আদর্শের প্রতি সাধারণ আনুগত্য। বহু বছর আমি নিজেকে নিবেদিত রাখি এই লক্ষ্যে অধ্যয়ন, রচনা ও বক্তৃতায় এবং কালক্রমে ইসলামী আইন ও তমুদ্দনের ব্যাখ্যাতা হিসাবে আমি বেশ কিছুটা খ্যাতি অর্জন করি। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত হলো, আমাকে তখন ঐ রাষ্ট্রের সরকার ‘ইসলামী পুনর্গঠন বিভাগ’ নামক একটি ডিপার্টমেন্ট গড়ে তোলা এবং পরিচালনার জন্য আহবান করলেন; এর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে আদর্শগত ইসলামী ধ্যান-ধারণাগুলিকে বিশদভাবে তুলে ধরা, যার উপর নবজাত রাজনৈতিক সংগঠনটি তার আদর্শিক দিক-নির্দেশের জন্য নির্ভর করতে পারে। দু’বছর ধরে এই অত্যন্ত উদ্দীপনাময় কাজটি চালিায়ে যাওয়ার পরি আমি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরে আমাকে মধ্যপ্রাচ্য ডিভিশনের প্রধান ‍নিযুক্ত করা হয়। এখানে আমি পাকিস্তান এবং অবশিষ্ট মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বন্ধন ও সম্পর্ক মজবুত করে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করি; আর এ সময়েই একদা আমি নিউইয়র্কে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠনে পাকিস্তানী মিশনে নিযুক্ত হই।

এ সবই একজন ইউরেপীয় যে-মুসলিম সমাজের মধ্যে ঘটনা ক্রমে বাস করছে তার সংগে নিছক বাহ্যিক খাপ খাইয়ে নেয়ার চাইতে অনেক বেশী গভীরতরো কিছুর দিকে ইংগিত করেঃ বরং এতে করে একটি সাংস্কৃতিক পরিবারের প্রতি আনুগত্য সজ্ঞানে সর্বান্তকরনে প্রত্যাহার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা বোঝায়। আমার বহু পাশ্চাত্য বন্ধুর কাছে এটা খু্বই বিস্ময়কর ঠেকে। তারা তাদের মনে এই চিত্র আনতে সক্ষম হলো না-যে মানুষ জন্মেছে পাশ্চাত্য জগতে এবং সেখানে বড় হয়েছে ও শিক্ষা-দীক্ষা পেয়েছে সে কেমন করে এমন সম্পূর্ণভাবে এবং বাহ্যত, মনে কোন কিছু চেপে না রেখে  মুসলিম জগতের সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছে; তার পক্ষে কী করে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বদলে সম্ভব হলো ইসলামী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার গ্রহণ, এবং কী সেই জিনিস যা তাকে বাধ্য করেছে অমন একটি ধর্মীয়-সামাজিক আদর্শ গ্রহণ করতে, যা আমার মনে হয়, সকল ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা থেকেই অতি ব্যাপকভাবে নিকৃষ্টতরো বলে ওরা স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে ধরে নিয়েছে।

কিন্তু কেন, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, আমার পাশ্চাত্য বন্ধুরা এ বিষয়টিকে এমন একটা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিচ্ছে? ওরা কি কখনো সত্যি সত্যি সরাসরি ইসলামের মর্মে পৌছানোর চেষ্টা করার প্রয়োজন বোধ করেছে? অথবা ওদের মতামতের ভিত্তি কি পূর্ববর্তী পুরুষ পরস্পরায় পাওয়া বিকৃত ধ্যান-ধারণ এবং কতিপয় ধরাবাধাঁ বুলি? হতে পারে কি যে সনাতন গ্রীক ও রোমান চিন্তা –পদ্ধতি পৃথিবীকে একদিকে গ্রীক ও রোমান এবং অন্যদিকে বারব্যরিয়ান্স তথা বর্বর জাতিপুঞ্জ, এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলো তা পাশ্চাত্য মানসে আজো এতো পরিপূর্ণভাবে মিশে আছে যে তার নিজের সাংস্কৃতিক কক্ষপথের বাইরে যা কিছু পড়ে তার কোন স্পষ্ট নির্দিষ্ট মূল্য আছে বলে তত্ত্বগতভাবেও সে স্বীকার করতে অক্ষম?

গ্রীক এবং রোমানদের আমল থেকে, ইউরোপীয় চিন্তাবিদ এবং ঐতিহাসিকেরা ইউরোপীয় ইতিহাস ও কেবল পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এবং অর্থেই পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা করতে উন্নুখ ও ইচ্ছুক। এ চিত্রে অপাশ্চাত্য সভ্যতাগুলি কেবল তখনি প্রবেশ করে যখন ওদের অস্তিত্ব অথবা ওদের মধ্যে থেকে উত্থিত বিশেষ বিশেষ আন্দোলন পাশ্চাত্য মানুষের ভাগ্যের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছে বা করে থাকে; আর এ কারনে, পাশ্চত্যবাসীর দৃষ্টিতে পৃথিবীর ইতিহাস এবং তার বিভিন্ন সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত একটা সম্প্রসারিত পাশ্চত্য ইতিহাসের বেশি নয়!

স্বভাবতই এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ একটি বিকৃত পরিপ্রেক্ষিতের জন্ম দিয়ে থকে। পাশ্চাত্যের মানুষ যেহেতু সেই সব লেখার সাথেই পরিচিতি যা তার নিজের সংস্কৃতিকে চিত্রিত করে অথবা নিজের সভ্যতার সমস্যাগুলি আলোচনা করে তার খুঁটিনাটি সমেত এবং উজ্জ্বল রঙে, আর বাকি বিশ্বের প্রতি এখানে-ওখানে ঘাড় বাঁকিয়ে মাঝে মাঝে তাকানোর বেশি কিছু করে না; এজন্য গড়পড়তা একজন ইউরোপীয় অথবা আমেরিকান সহজেই এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হ’য়ে পড়ে যে, পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা বাকি বিশ্বের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার চাইতে কেবল উৎকৃষ্টতরোই নয়, বরং আয়তনেও এতো বিপুল যে, দু’য়ের  মধ্যে কোন তুলনাই  হয় না; আর এ কারণে, পাশ্চত্য জীবন পদ্ধতি হচ্ছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য আদর্শ যার মনদন্ডেই কেবল অন্যান্য জীবন-পদ্ধতিকে বিচার করা যেতে পারে। এর দ্বারা অবশ্য এ কথাই বোঝানো হয় যে, যে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যান-ধারণা, সামাজিক অনুষ্ঠান অথবা নৈতিক মূল্যায়ন, যা এই পাশ্চাত্য আদর্শ বা নমুনার সংগে মিলে না, তা বস্তুতই একিট নিম্মস্তরের জীবনের বস্তু। গ্রীক এবং রোমানদের পায়ের চিহ্ণ অনুসরণ করে পাশ্চাত্য জগত ভাবতে পছন্দ করে যে, ঐসব ভিন্ন সভ্যতা, এককালে যা বিদ্যমান ছিলো বা বর্তমানে আছে সে সবই প্রগতির যে-পথ পাশ্চাত্য অভ্রান্তভাবে অনুসরণ করে চলেছে সে পথে প্রতিবন্ধকস্বরূপ কতকগুলি পরীক্ষণ –নিরীক্ষণ মাত্র;অথবা, বড় জোর একথা বলা যায় (যেমন জনক সভ্যতাগুলির ক্ষেত্রে, যা সরাসরিভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার পূর্বে বিকাশ লাভ করেছিলো একই রেখায়) এগুলি একই পুস্তকের পরপর কয়েকটি অধ্যায় মাত্র-অবশ্যই সভ্যতা হচ্ছে এর শেষ অধ্যায়।

আমি যখন আমার এই মতের কথা আমার কোন এক মার্কিন বন্ধুর নিকট ব্যক্ত করি-বন্ধুটি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে বেশ কৃতিত্বের অধিকারী এবং মানসিক প্রবণতার দিক দিয়ে তাঁকে পন্ডিত বলা যায়-তিনি প্রথমে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেন।

‘মেনে নিলাম’, তিনি বললেন, ‘প্রচীন গ্রীক এবং রোমকরা বিদেশী সভ্যতার বিচার করতে গিয়ে সীমিত দৃষ্টিভংগির পরিচয় দিয়েছিলো; কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা কি ওদের এবং বাকি দুনিয়ার মধ্যে যোগাযোগের অসুবিধারই অনিবার্য ফল নয়? আর এই অসুবিধা কি আধুনিককালে অনেকখানি কাটিয়ে ওঠা যায়নি? যা-ই হোক, আমরা, পাশ্চাত্যবাসীরা আজকাল আমাদের আপন সাংস্কৃতিক কক্ষপথের বাইরেও যা ঘটছে তার সংগে অবশ্যই নিজেদেরকে সম্পর্কিত রাখি । গত সিকি শতকে প্রাচ্য শিল্পকলা ও দর্শন সম্পর্কে এবং প্রাচ্যের বিভিন্ন জাতির মনকে যেসব রাজনৈতি চিন্তাধারা করে আছে সেসব বিষয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে যে বহু সংখ্যক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে আপনি কি সেগুলির কথা ভুলে যাচ্ছেন না? অন্যান্য সংস্কৃতির কী দেবার থাকতে পারে তা বোঝার জন্য পাশ্চাত্যবাসীর এ আকাংখাকে উপেক্ষা করা নিশ্চয় সুবিচার হবে না!’

‘হয়তো আপনার কথা কিছুটা সত্য’, আমি জবাব দিই, ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সেই আদি গ্রীক-রোমক দৃষ্টিভংগি আজকাল আর সম্পূর্ণ সক্রিয় নয়। এর কঠোরতা তার ধার উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়ে ফেলেছে, অন্য কোন কারণে নয়, কেবল এ কারণে যে, পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণের মধ্যে যাঁরা অধিকতরো পরিণতি চিন্তাশক্তির অধিকারী তাঁরা তাদের নিজেদের সভ্যতার বহু দিক সম্পর্কেই হতাশ এবং সন্ধিগ্ধ হয়ে উঠেছেন। ওঁদের কারো কারো মনে এই উপলদ্ধির সূচনা হতে শুরু করেছে যে, মানব প্রগতির কেবল একটিমাত্র কিতাব এবং একটিমাত্র কাহিনী না-ও থাকতে পারে, বরং বহু কিতাব এবং বহু কহিনী থাকা সম্ভবঃ আর এর কারণ কেবল এই যে, ঐতিহাসিক অর্থে মানবজাতি একটি সমজাতীয় সত্তা নয়, বরং বিভিন্ন গ্রুপের এক বিচিত্র সমবায়, যাদের মধ্যে মানব জীবনের অর্থ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে অনেক দূর ব্যবধানের ভিন্ন ভিন্ন ভাবধারা রয়েছে। তবু আমি মনে করি না যে, পাশ্চাত্য জগত গ্রীক ও রোমকদের চাইতে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি কৃপাশীল পৃষ্ঠপোষকের মনোভাব সত্যি কম পোষণ করতে শুরু করেছেঃ বলা যায়, পাশ্চাত্য কেবল অধিকতর সহনশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু মনে রাখবেন-এ সহনশীলতা ইসলামের প্রতি নয়-কেবল কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি যা পাশ্চাত্যের অধ্যাত্ম ক্ষুধায় পীড়িত মানুষের জ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক আকর্ষণ যোগায় এবং একই সাথে তা পাশ্চাত্য বিশ্বদৃষ্টি থেকে অতো বেশি দূরের যে, এর মূল্যগুলির বিরুদ্ধে কোন সত্যিকার চ্যালেঞ্জ বলে তা গন্য হয় না।’

‘আপনি এর দ্বারা কি বোঝাতে চান?’

‘দেখুন’, আমি জবাব দিই, ‘যখন একজন প্রতীচ্যবাসী, ধরা যাক, হিন্দু ধর্ম অথবা বৌদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করে তখন সে ব্যতিক্রমহীনোভাবেই এ –সব মতবাদ ও তার নিজের মতবাদের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে সতর্ক থকে। এ –সব মতবাদের এটা-ওটা তার প্রশংসা পেতে পর, কিন্তু স্বভাবতই সে কখনো তার নিজের ভাবধারার বদলে এগুলি গ্রহণ করার সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখতে রাজী হবে না। যেহেতু সে পূর্ব থেকেই এ অসম্ভব্যতা স্বীকার করে নেয় সে কারনে এসব বিজাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে মানসিক স্থৈর্য এবং প্রায়ই সহানুভূতিপূর্ণ  সমঝদারের মনোভাব নিয়ে সে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। কিন্তু ইসলামের প্রসংগ যখন আসে, যা হিন্দু অথবা বৌদ্ধ দর্শনের মতো পাশ্চাত্য মূ্ল্যগুলির মোটেই ততটা বিরোধী নয়, তখন এ পাশ্চাত্য মানসিক স্থৈর্য প্রায় সব-সময় এবং অনিবার্যভাবেই আবেগাত্মক পক্ষপাত দ্বারা বিচলিত হয়ে পড়ে। এর কারণ কি সম্ভবত এই যে, মাঝে মাঝে আমি সবিস্ময়ে ভাবি, ইসলামী মূল্যবোধগুলি পাশ্চাত্য মূল্যবোধের খুব কাছাকাছি বলেই তা আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনের বহু পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার প্রতি প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ বিশেষ?

এবং আমি তাঁকে আমার একটা থিওরীর কথা বলতে আরম্ভ করি, যা আমার চিন্তায় এসেছিল কয়েক বছর আগে; এটি এমন এক থিওরী, যা আমার মতে, পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সমসাময়িক চিন্তাধারায় ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায়ই যে গভীর মূল বিদ্বেষ দেখতে পাওয়া যায় তা স্পষ্টতরোভাবে বোঝার সহায়কও হতে পারে।

‘এই বিদ্বেষের একটা সত্যিকার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পেতে হলে’, আমি বললাম, ‘আপনাকে তাকাতে হবে অনেক পেছনদিকে, ইতিহাসের অভ্যন্তরে-এবং পাশ্চাত্য ও মুসলিম জগতের মধ্যকার প্রথমদিকের সম্পর্কগুলির মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকা বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। পাশ্চাত্যের লোকেরা আজকের দিনে ইসলাম সম্পর্কে যা চিন্তা এবং অনুভব করে তার শিকড় রয়েছে সেইসব গভীর প্রভাবের চাপ এবং স্মৃতির ছাপের মধ্যে যা জন্ম নিয়েছিলো ক্রসেডের সময়’।

‘ক্রসেড!’ আমার বন্ধু বিস্মিত কন্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আপনি নিশ্চয় বলতে চান না যে প্রায় হাজার বছর আগে যা ঘটেছিলো তা এখনো, এই বিশ শতকের লোকের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে?’

‘কিন্তু তা অবশ্যই করে থাকে। আমি জানি, এ অবিশ্বাস্য শোনাবে। কিন্তু আপনার কি স্মরণ নেই মনোবিকলনকারীদের প্রথমদিকের আবিস্ক্রিয়াগুলিকে কী অবিশ্বসের সংগে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিলো, যখন ওঁরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করছিলেন একটা বয়স্ক মানুষের আবেগময় দিকের বহুলাংশেরই –এবং ইডিওসিনক্রেসিস বা ‘বিশেষ মেজাজ-মর্জি’ শব্দটিতে যেসব আপাত অহেতুক প্রবণতা, রুচি ও সংস্ককার নিহিত রয়েছে তার ও প্রায় সবটারিই –উৎস খুঁজে পাওয়া  যেতে পারে তা শৈশবের প্রথমদিকের

, তার বয়সের সবচাইতে ফর্মেটিভ সময়টির বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে? আচ্ছা, জাতি এবং সভ্যতা কি যৌথ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কিছু ? ওদের ক্রমবিকাশও ওদের শৈশবের প্রথমদিকের অভিজ্ঞাতর সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি ওদের শৈশবের এসব অভিজ্ঞতাও হয়তো আনন্দদায়ক ছিলো অথবা ছিলো পীড়াদায়ক;ঐসব অভিজ্ঞতা হতে পারে সম্পূর্ণ যুক্তিসম্পন্ন, অথবা বিপরীত পক্ষে, সেগুলি হতে পারে কোনো ঘটনার শিশুসুলভ সরল ভুল ব্যাখ্যার ফলঃ এ ধরনের প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতারই মন-মানস বদলে দেয়ার ক্ষমতা প্রধানত নির্ভর করে সেই অভিজ্ঞতার সূচনাকালীন তীব্রতার উপর। ক্রসেডের অব্যবহিত পূর্বের শতকটিকে, অর্থাৎ খ্রিস্টীয় সনের প্রথম হাজার বছরের সমাপ্তটিকালটিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার শৈশবের প্রথম দিক বলে সহজেই বর্ণনা করা যেতে পারে .. .. .

আমি আমার বন্ধুকে স্মরণ করিয়ে দিই-তিনি নিজেও একজন ইতিহাসবিদ-এ হচ্ছে সেই যুগ রোম সাম্রাজ্যেরে ভাঙনের পরবর্তী অন্ধকার শতাব্দীগুলির পর এই প্রথম ইউরোপ তার নিজস্ব সাংস্বৃতির পথ দেখতে পশুর করেছে। প্রায় বিস্মৃত রোমন ঐতিহ্যের-সাথে কোন সম্পর্ক না রেখেই ঠিক সেই মুহুর্তে ইউরোপের জনসাধারণের বিভিন্ন মাতৃভাষায় নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি শুরু  হয়েছেঃ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে গথ, হূন এবং অভরদের স্থান হতে স্থানান্তরে বিচরনের ফলে যে মানসিক অবসাদ এসেছিলো, তা কাটিয়ে উঠে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টধর্মের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রেরণায় চারুকলা ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মধ্যুগের প্রথমদিকের অপরিণত অবস্থার মধ্য থকে জন্ম নিচ্ছিলো এক নতুন সাংস্কৃতিক জগত। ঠিক সেই সন্ধিক্ষনে, ক্রসেড থেকে তার আত্মবিকাশের সেই চরম নাজুক সংবেদময় মুহর্তটিতে পেলো তার জীবনের সবচেয়ে প্রচন্ড আঘাত-আধুনিক ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘ট্রওমা’ বা আবেগজনিত আঘাত, যা হয়ে উঠতে পারে মানসিক ব্যাধির হেতু.. .. .. .

ক্রসেডগুলি হচ্ছে এমন এক সভ্যতার উপর প্রচন্ড সমষ্টিগত চাপ, যা সবেমাত্র  আত্মসচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে বলতে গেলে, ক্রুসেডের যুদ্ধগুলি হচ্ছে এটা সাংস্কৃতিক সংহতির আলোকে নিজেকে দেখার জন্য ইউরোপের প্রথমতম এবং সম্পূর্ণ সফল এক প্রয়াস। প্রথম ক্রসেড যে উৎসাহ –উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছেো তার আগে কিংবা পরে ইউরোপ আর এতমন কোন অভিজ্ঞতাই অর্জন করেনি, যা এর সাথে  তুলনীয় হতে পারে। ইউরোপ মাহদেশের উপর দিয়ে উন্মাদনার এক প্রবল ঢেউ বয়ে গেলো-এমন এক  আনন্দ-উল্লাস যা এই প্রথম বিভিন্ন রাষ্ট্র, গোত্র ও শ্রেণীর মধ্যকার সকল প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে গেলো। এর আগে ছিলো ফ্রাঙ্ক, স্যাক্সন, জার্মান, বুর্গান্ডীয়, সিলিলীয়, নরম্যান এবং লুম্বার্ডেরা-বিভিন্ন গোত্র ও জাতের এক জগাখিচুড়ি, যাদের মধ্যে সাধারণ কিছু ছিলো না বললেই চলে, কেবল একটি বিষয় ছাড়াঃ ওদের প্রায় সবকটি সামন্ততন্ত্রী রাজ্য ও প্রদেশ ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, আর ওরা সকলেই ছিলো খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসীঃ কিন্তু ক্রুসেডের যুদ্ধগুলিতে, এবং এসব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই ধর্মীয় বন্ধন উন্নীত হয় এক নতুন সমতলে, যা সকল ইউরোপীয়রই সাধারণ লক্ষ্যঃ ‘খ্রিষ্টান রাজ্যের’ রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয় ধারণা। পরিণামে তা-ই জন্ম দেয় ইউরোপ –ভিত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনার। ১০৯৫ সালের নভেম্বরে পোপ দ্বিতীয় আরবান তাঁর ক্লারমন্টের বিখ্যাত বক্তৃতায় যখন পবিত্র ভূমি দখল করে রাখা ‘পাষন্ড জাতির’ বিরুদ্ধে খ্রিষ্টানদরকে যুদ্ধের জন্য উদ্ধুদ্ধ করেন তখনি তিনি সম্ভবত তাঁর নিজের অজান্তেই পাশ্চাত্য সভ্যতার চার্টার বা সনদ ঘোষণা করেন।

ক্রুসেডের যুদ্ধের ফলে আবেগজনিত প্রচন্ড আঘাতের যে অভিজ্ঞতা হয় তা-ই ইউরোপকে দেয় তার সাংস্কৃতিক সচেতনতা এবং তার ঐক্য; কিন্তু পরিণামে এই একই অভিজ্ঞতাই তখন থেকে সেই মিথ্যা রঙের পোঁচ দিতে থাকরো, যে –রঙে পা্শ্চাত্যবাসীর চোখে ইসলাম প্রতিভাত হয়েছে পরবর্তীকালে-কেবল এ কারনে নয় যে, ক্রুসেডের অর্থই হচ্ছে যুদ্ধ এবং রক্তপাত। বিভিন্ন জাতির মধ্যে অমন কত যুদ্ধই তো সংঘটিত হয়েছে-যার কথা পরবর্তীকালে বেমালুম ভুলে গেছে সে-সব জাতি-এবং কতো শত্রুতা ও বৈরিতা, যা তাদের কারে মনে হয়েছিলে অনপনেয়, পরবতীকালে রূপান্তরিত হয়েছে বন্ধুত্বে! বিভিন্ন ক্রুসেডে যে ক্ষতি হলো তা অস্ত্রের ঝনঝনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনিঃ প্রথমত এবং সর্বাগ্রে এ হচ্ছে মনোজাগতিক ক্ষতি-ইসলামের শিক্ষা এবং আদ- র্শের একটি ইচ্ছাকৃত অপব্যাখ্যার মাধ্যমে পাশ্চাত্য মনকে মুসলিম জগতের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলাই সেই ক্ষতি; কারন ক্রুসেডের আহবানের যুক্তিযুক্ততা যদি বজায় রাখতে হয় তাহলে মুসলমানদের নবীকে অপরিহার্যভাবেই চিহ্ণিত করতে হবে খ্রিস্ট-বিরোধীরূপে এবং তাঁর ধর্মকে জঘন্যতম ভাষায় চিত্রিত করতে হবে, লাম্পট্য ও বিকৃত রুচির উৎসরূপে। ইসলাম যে এটি স্কুল ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এবং পাশবিক হানাহানির ধর্ম, চিত্ত শুদ্ধির ধর্ম নয়, আনুষ্ঠানাদি পালনের ধর্ম, ক্রুসেডের আমলেই এ হাস্যকর ধারণা প্রবেশ করে পাশ্চাত্য মানসে এবং তখন থেকেই তা ওখানেই রয়ে গেছে; আর সেই সময়ে নবী মুহাম্মদের নাম-সেই একই মুহাম্মদ যিনি তাঁর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন-অন্যান্য ধর্মের নবীগণকে শ্রদ্ধা করতে-ইউরোপীয়রা ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের সংগে রূপান্তরিত করে ‘মাহৌন্দ’ –এ, ইউরোপে স্বাধীন অনুসন্ধিৎসা সূচিত হওয়ার যুগ তখনো অনেক সুদূর ভবিষ্যতের ব্যাপার। তখন যেসব শক্তি বিদ্যমান ছিলো তাদের পক্ষে পাশ্চাত্য ধর্ম এবং সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ধর্ম ও সভ্যতার বিরুদ্ধে হিংসা –বিদ্ধেষের কালো বীজ বপন করা ছিরো খুবই সহজ। কাজেই, এ কোন আকস্মিক ব্যাপার নয় যে, এই সব যুদ্ধ যখন চলছিলো তখন জ্বালাময়ী শ্যাজো দ্য রোঁলা-যাতে দক্ষিণ ফ্রান্সে মুসলিম বে-দ্বীনের উপর খৃষ্টান রাজ্যের অলীক বিজয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে-রচিত হয়নি, রচিত হয়েছিলো তিন শতাব্দী পরে-অর্থাৎ প্রথমে ক্রুসেডের ঠিক কিছু আগে-এবং সংগে সংগেই তা হয়ে দাঁড়ালো ইউরোপের ‘জাতীয় সংগীত’-স্বরূপ; এবং এ-ও আকিস্মিক ব্যাপার নয় যে, এই যুদ্ধ নিয়ে রচিত মাহকাব্য হচ্ছে এক ‘ইউরোপীয়’ সাহিত্যের আরম্ভ যা আগেকার আঞ্চলিক সাহিত্য থেকে সুস্পষ্টভঅবে স্বতন্ত্রঃ কারণ ইউরোপীয় সভ্যতার শৈশবাবস্থার উপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের প্রতি নিদারুণ বিদ্বেষ।

এই ইতিহাসেরই একটা পরিহাস বলে মনে হয় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতীচ্যে যুগ যুগ লালিত শত্রুতা, যা আদিতে ছিলো ধর্মীয় আজো, এমন এক সময়েও টিকে আছে তার অবচেতন মনে যখন পাশ্চাত্য মানুষের কল্পনার উপর ধর্ম তার কর্তৃত্ব প্রায় সবটাই হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য, আসরে তা বিস্ময়কর নয়। আমরা জানি, মানুষকে তার শৈশবে যেসব ধমীয় বিশ্বাস জীবনব্যাপী-‘আর এই ই’, আমি আমার বক্তব্য শেষ করে বলি, ‘ঠিক এ-ই ঘটেছিলো সেই সমষ্ঠিগত ব্যক্তিত্ব পাশ্চাত্য সভ্যতার জীবনে। ক্রসেডের ছায়া আজো পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে আছে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর;আর ইসলাম এবং মুসলিম জগতের প্রতি তার সকল প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে সেই মরেও-মরে না প্রেতের.. .’

আমার বন্ধু কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে থাকেন। আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি লম্বা হালকা-পাতলা সেই মানুষটি কামরার ভেতর পায়চারী করছেন। তাঁর হাত দুটি তাঁর কোটের পকেটে, মাথা ঝাঁকাচ্ছেন যেন কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে এবং অবশেষে তিনি বললেনঃ

‘আপনি যা বলছেন তাতে কিছু সারবস্তু থাকতে পারে-সত্যি হয়তো থাকতে পারে-যদিও, হঠাৎ করে আমি আপনার এই থিওরী বিচার করে দেখতে পারছি না, সে অবস্থা আমার নেই। তবে যা-ই হোক, আপনার জীবন, যা আপনার কাছে খুবই সরল এবং জটিলতা মুক্ত, পাশ্চাত্যের লোকদের কাছে অবশ্যই পরম বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ঠেকবে? আপনি আপনার আত্মজীবনী লিখছেন না কেন? আমি নিশ্চিত যে, এটি খুবই চমকপ্রদ এবং আক র্ষণীয় পুস্তক হবে।’

উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে আমি জবাব দিইঃ হ্যাঁ, এ ধরণের একটি বই লিখতে গিয়ে আমি হয়তো ফরেন সার্ভিস ত্যাগের জন্য মানিয়ে নিতে পারি নিজেকে। মোদ্দা কথা, লেখাই তো আমার মূল পেশা.. .

আমি রসিকতা করে যে জবাব দিয়েছিলাম পরবর্তী কয়েক হপ্তা এবং মাসে আস্তে আস্তে আমার অজান্তেই তা উবে গেলো। আমি আমার জীবনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং এতে ক’রে, যত তুচ্ছভাবেই হোক না কেন, যে ‍পুরু যবনিকা ইসলাম এবং তার সংস্কৃতিতে প্রতীচ্য-মন থেকে আড়াল করে রেখেছে তা সরাতে সাহায্য করার জন্য চিন্তা করতে শুরু করি, গভীরভাবে। ইসলামে আমার প্রবেশ অনেক দিক দিয়ে একটি একক, অতুলনীয় ব্যাপারঃ মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘকাল বসবাস করেছি বলেই আমি মুসলমান হইনি, পক্ষান্তরে আমি তাদের মদ্যে বাস করার সিদ্ধান্ত নিই এ কারণে যে, আমি ইসলাম কবুল করেছি। আমি কি আমার একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাশ্চাত্য পাঠকদেরকে অবগত ক’রে ইসলামী জগত ও পাশ্চাত্য জগতের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বেশি অবদান রাখতে পারি না, সেই কুটনৈতিক পদে অবস্থান ক’রে যা করতে পারি, তার চেয়ে যে পদ আমরা দেশের অন্য লোকদের দ্বারা পূরণ করা যেতে পারে একই রকম প্রকৃষ্টরূপে! মোদ্দাকথা যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি পাকিস্তানের মন্ত্রী হতে পারেন জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানে-কিন্তু আমার পক্ষে পাশ্চাত্যের লোকদের নিকট ইসলাম সম্পর্কে যেভাবে কথা বলা সম্ভব ক’জন লোক তা করতে সক্ষম? আমি মুসলমান, কিন্তু এ-ও সত্য যে, আমার জন্ম পাশ্চাত্য জগতেঃ কাজেই ইসলাম এবং পাশ্চাত্য জগত, দু’য়েরই সুধীজনের ভঅষায় কথা বলতে পারি আমি…

আর এ কারনে, ১৯৫২ সালের শেষের দিকে আমি পদত্যাগ করি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস থেকে এবং এ বইটি লিখতে শুরু করি। আমার আমেরিকান বন্ধুটি যে রকমটি আশা করেছিলেন এটি সে রকম ‘চিত্তাকর্ষক বই’ হয়েছে কিনা আমি বলতে পারি না। কেবল কিছু পুরানো নোট, বিচ্ছিন্ন রোজনামচা এবং সে সময়ে আমি সংবাদপত্রের জন্য যে সব প্রবন্ধ লিখেছিলাম তারই কয়েকটি সাহায্যে, স্মৃতি থেকে-এক ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের জটিল রেখাগুলি ধরে ফের অতীতের দিকে যাত্রা করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না- যে বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছে বহু বছর এবং ভৌগলিক স্থানের এক বিশাল বিস্তার জুড়ে।

আর এই যে কহিনীঃ আমার সমগ্র জীবনের কাহিনী নয়, কেবল সেই বছরগুলির কাহিনী, ভারতের পথে আরবদেশ ছেড়ে বের হওয়ার আগেকার বছরগুলির কাহিনী-সেই উত্তেজনাময় বছরগুলি, যা আমি সফরে কাটিয়েছি লিবিয়ার মরুভূমি থেকে পামীর মালভূমির বরফ-ঢাকা পর্বত শৃংগগুলি মধ্যবর্তী এবং বসফরাস ও আরব সাগরের মধ্যকার প্রায় সকল দেশের ভেতর দিয়ে। এ কাহিনী বলা হয়েছে একটি পটভূমিতে-এবং মনে রাখতে হবে, আরবের অভ্যন্তর থেকে মক্কায় ১৯৩২-এর গ্রীষ্মের শেষের দিকে, আমার সর্বশেষ মরু সফরের প্রেক্ষিতেঃ কারণ ঐ তেইশ দিনের মধ্যেই আমার জীবনের প্যাটার্ন সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো আমার কাছে।

পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে যে আরবের  বর্ণনা করা হয়েছে তা এখন আর নেই। এর নির্জনতা এবং সংহতি ধ্বসে পড়েছে অকস্মাৎ প্রবল বেগে উৎক্ষিপ্ত তেলের প্রচন্ড ধাক্কায় এবং তেল যে স্বর্ণ নিয়ে এসেছে তারই চাপে। এর মহৎ সরলতা হারিয়ে গেছে এবং তার সংগে হারিয়ে গেছে মানবিকতার দিক যা ছিলো একক অনন্য তা-ও। মানুষ যখন মহামূল্য কোন কিছুর জন্য বেদনা অনুভব করে না, যা এখন হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য, যা ফিরে পাওয়া যাবে না আর কখনো, সে বেদনার সাথে আমার মনে পড়েছে সেই শেষ দীর্ঘ মরুপথে চলার কথা-যখন আমরা দুজন, সওয়ারী হাঁকিায়ে চলেছি; আর চলেছি, দুজন দুটি উটের উপরে, সাঁতরে চলা আলোর ভেতর দিয়ে.. .