তারাবাঈ ১১ পরিচ্ছেদ

গভীর রজনী। চতুর্দিক নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। পশ্চিমঘাট গিরিগহবরের একটা মনোহর কক্ষ বিশেষরূপে সজ্জিত। এই নির্জন রাজা অশোকের সময় শ্রমণদিগের নির্বাস জন্য নির্মিত হইয়াছিল।

গভীর নির্জনে বাস করিবার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত কৃত্রিম গুহা খোদিত করা হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে তিনি শক্রর অনুসরণ অব্যাহতি এবং যুদ্ধ হইতে বিশ্রাম লাভ করিবার জন্য এই নির্জন গিরিহুহার বাস এবং স্বকীয় ভোগলালসা পরিতৃপ্তি করিতেন।

এইখানেই ভীষণ হত্যা এবং লুণ্ঠনের গুপ্ত পরামর্শ হইত। গভীর বনরাজিপূর্ণ এই দুর্গম পর্বতের পাদমূলে ভীষণ অরণ্যের সম্মুখে একটি পরিখা খোদিত ছিল। লোকে তাহাকে পার্বত্য নদী বলিয়াই মনে করিত।

পরিখার উভয় পার্শ্বে উচ্চ গড়; তাহা নানাজাতীয় বৃলতা বিশেষতঃ বৃহৎ বৃহৎ শাল ও তালবৃক্ষে সমাচ্ছন্ন হইয়া স্বাভাবিক ক্ষুদ্র পর্বতের স্তুপ বলিয়া ভ্রম জন্মাইত! গড়ের উপরে নানা স্থানে বৃরাজির পাদমূলের অন্তরালে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তোপ সজ্জিত ছিল।

এতদ্ব্যতীত বনের নানা স্থানে অদৃশ্যভাবে তোপ সজ্জা ছিল। বনের মধ্যে মৃত্তিকার নীচে কয়েকটি পাতালপুরী বা গুপ্ত-কক্ষ ছিল। এই সমস্ত পাতাল-গৃহে নানাবিধ যুদ্ধের উপকরণ, লুণ্ঠিত সামগ্রী এবং ধন-ভান্ডার সংস্থাপিত ছিল। এই গোপনীয় গুহাবলীর একটি প্রশস্ত এবং অধিকতর রমণীয় গুহাতে ললনাকুল ললাম-ভূতা এক ষোড়শী রূপসী রূপের ছটায় কক্ষ আলোকিত করিয়া একখানি পালঙ্কোপরি অর্ধহেলিত অবস্থায় অবস্থিত!

রমণীর ঈষৎ কুঞ্চিত সুচিক্কণ ঈষন্নী লাভ কেশকলাপ ললাট এবং গন্ডে পতিত হওয়ায় তাহার মুখখানি শৈবালে ঈষদাচ্ছন্ন প্রভাত-প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় অথবা মেঘ-কিরীট-চন্দ্রমায় ন্যায় শোভা পাইতেছে। সে মুখের ও চক্ষুর ছটায় তেজস্বিতা, দৃঢ়তা এবং পবিত্রতার আভাই কেবল বিকীর্ণ হইতেছে।

গৃহস্থিত প্রদীপের আলোক, রমণীর বিশ্ববিমোহন রূপের ছটায় যেন মলিন বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। উন্নত বিশাল বক্ষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বাত্যাহতা স্ফীত বা তরঙ্গায়িত পদ্মার ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে উন্নত এবং অবনত হইতেছে।

রমণীর নেত্রকুবলয়ের প্রশান্ত এবং স্থির দৃষ্টি হইতে উন্নত চিন্তার ইঙ্গিতই সূচিত হইতেছে। রমণী যুবতী-প্রস্ফুটিত-যৌবনা এবং অসাধারণ সৌন্দর্যশালিনী হইলেও, তাঁহাকে দর্শন করিয়া কাম-গন্ধী প্রেমের উদ্রেক না হইয়া সশ্রদ্ধ ভালোবাসারই সঞ্চার হয়।

রমণী অলৌকিক সুন্দরী। তাহার মুখমন্ডলে তরুণ অরুণের অরুণিমা, নয়নে বর্ষণ-মুক্ত শারদাকাশের নীলিমা, গঠন-বৈচিত্র্যে কাফ-কৌশলের অপূর্ব মহিমা পরিদূশ্যমা! রমণী নির্বাতি সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় তরল সৌন্দর্যে ভরপুর হইয়াও অচঞ্চল! সুতরাং, তাঁহাকে দর্শন করিলে আনন্দ এবং শ্রদ্ধারই উদ্রেক হয়। সে সৌন্দর্য-সে লাবণ্য কেবল কবিত্বময়, রসময় এবং আনন্দময়! তাহাতে স্বপ্নের আবেশ এবং মদিরার বিহবলতা নাই, তাহা স্পষ্ট, মুক্ত এবং ব্যক্ত; সুতরাং সহসা তাহাতে মনশ্চাঞ্চল্য ঘটে না।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এই গরীয়সী সুষমা-সম্পন্ন মহিমময়ী রমণী আমাদেরই সেই মালেকা আমেনাবানু। রমণী অর্ধশায়িতাবস্থায় বাম হস্ত বাম কপোলে রাখিয়া দক্ষিণ হস্তে “দেওয়ান হাফেজ” ধারণ করিয়া পড়িতেছিলেন।

এমন সময় শিবাজী তথায় আসিয়া একাকী উপস্থিত হইলেন। মালেকা আমেনা তখন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বসিলেন। শিবাজী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিকটবতী একখানি সোফাতে উপবেশন করিলেন। ক্ষণকাল নীরবে যাপন করিবার পরে বলিলেন, “মালেকা! মালেকা! আমার প্রাণের মালেকা! একবার তুমি আমার দিকে মুখ ফিরাও। একটিবার মাত্র কথা শুন। আমি তোমার জন্যই উন্মুত্ত হয়েছি। তোমার প্রেমামৃত পানের জন্যই মানস-চকোর চঞ্চল হয়েছে। কিছুতেই তোমাকে পরিণয় পাশে আবদ্ধ করতে স্বীকৃতা করতে না পেরে অবশেষে তোমাকে হরণ করতে বাধ্য হয়েছি।

“তোমাকে বশীভূত করবার জন্যই অপহরণ করে এই নিভৃত নির্জন গিরিগুহায় নিয়ে এসেছি। তোমার প্রেমে প্রমত্ত হয়ে রাজ্য, ধন-সম্পদ নিসর্জন দিয়েছি। তোমাকে লাভ করতে না পারলে, জীবনের আর কোনও প্রয়োজন নাই।

“হে সুন্দরী! হে মানসি! নব-বসন্তের নব-বিকাশোন্মুখ অবস্থায় অভিমান-ভরে তোমার এই প্রেমদাসকে তুচ্ছ করে উভয়ের অকল্যাণ ও অমঙ্গল আনয়ন করো না। বসন্ত এসেছে, তবে সৌরভ-সুধা বিতরণে বিলম্ব কেন?

“হ মানিনী! শিবাজী দস্যু হলেও রাজা, মারাঠী হ’লেও বীর-পুরুষ, কাফের হলেও প্রেমিক এবং মূর্খ হলেও কৃতজ্ঞ। সুতরাং একেবারে তোমার অযোগ্য নহে। তোমার প্রেম-প্রবাহের রসসিক্ত হ’লে, শিবাজী ভারত-সিংহাসনে সমারূঢ় হ’বারও কল্পনা করে।
“হে বীর্যবতী! তোমার বীরত্ব এবং সাহস সহায় হ’লে, এ বাহু আরও বলশালী হবে, এ মস্তিস্কে আরও উচ্চ উচ্চ রাজনৈতিক চিন্তা-স্রোত প্রবাহিত হবে। তাই বলি, মালেকা! তুমি আমার হৃদয়রাজ্যের মালেকা হ’য়ে মালেকা নামের সার্থকতা সম্পাদন কর। নিশ্চয় জানিও, তোমার প্রেমে হতাশ করলে এ জীবন-তরু অকালে শুঙ্ক হবে। এস মালেকা! এস, আমার বক্ষে এস। নতুবা এই বক্ষে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করে এ বিদগ্ধ জীবনের অভিনয় শেষ কর।

“ক্রমাগত আজ দু’মাস কাল তোমার সাধনা করে মন বড়ই চঞ্চল এবং বিধুর হয়েছে, আর ধৈর্যধারণ অসম্ভব। মনের স্থৈর্য ক্রমশঃ নষ্ট হচ্ছে। এস তুমি! এস, আমার মরুভূমিতুল্য দগ্ধবক্ষে তুমি মিত্রাপ-জ্বালা-নিবারণী মন্দাকিনীর ধারার ন্যায় প্রবাহিত হও।

“এস মালেকা! এস, তা’তে কোন কলঙ্ক নেই। আমি তোমাকে কলঙ্কিনী করব না। আমি তোমাকে রাজ-আড়ম্বরে যথারীতি বিবাহ করব। ভগবান রামদাস স্বামী আমার অনুকূলে। বাহুবল, অর্থবল, বুদ্ধিবল সমস্তই আমার পদতলে।

“মালেকা! একবার তুমি সম্মতি প্রকাশ কর। আজ দীর্ঘ দু’টি মাস ধরে তোমার সাধনা করছি! তোমার রূপবহিৃতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মবিসর্জন করতে বসেছি। হায়! তবুও কি তুমি পাষাণী হয়ে থাকবে? মালেকা! আজ সাধনার শেষ দিন!

“আজ যেমন করেই হউক মনের বাসনা পূর্ণ করব। আজ আর তোমার সম্মতি-অসম্মতির অপো করতে পারি না। এস রূপসি! এস, এস, বক্ষে এস!”

এইরূপ উন্মত্ত প্রলাপ বকিতে বকিতে শিবাজী দুই বাহু প্রসার করিয়া মালেকাকে সহসা আবেষ্টন করিয়া অধর-চুম্বনে উদ্যতপ্রায়। রোষেন্মত্তা মালেকা আমেনাবানু সহসা ক্রুদ্ধা ব্যাঘ্রীর ন্যায় ভীষণ বলে উত্থিত হইয়া শিবাজীকে দূরে ঝটকাইয়া ফেলিলেন। দেওয়ালে আহত হইয়া শিবাজী কতলে ঘূর্ণিত হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন, উঠিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু শক্তিশালীনী মালেকা সহসা ভীমবলে পদতলে শিবাজীকে চাপিয়া ধরিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে শাণিত ছুরিকা বক্ষ-লক্ষে উদ্যত করিয়া বলিলেন, “বল দুরাত্মন। বল জাহান্নামী কাফের! বল কাম-কুক্কুর! পাষন্ড শয়তান। আর কখনও নারী হরণ করবি? পাষন্ড, আজ হ’তে তোর জীবনের পাপভিনয়ের শেষ করব।”

মালেকা ভীষণ ক্রুদ্ধ মূর্তিতে ক্রকুটি-কুটিল আঁখিতে বিকীরণ করিয়া এবং ক্রোধাবেগে কম্পিত হইতে হইতে ভীষণ গর্জন করিয়া শিবাজীকে পদতলে আরও ভীষণভাবে চাপিয়া ধরিলেন। ছুরিকার শাণিত মৃত্যুর করালী জিহবার ন্যায় শিবাজীর চক্ষে প্রতিভাত হইল!

শিবাজী ভীতি-বিহবলচিত্তে রূদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “মালেকা! আমায় মাফ কর। আর না, যথেষ্ট হয়েছে। দোহাই তোমার, প্রাণবধ করো না! আর কখনও পরনারী হরণ করব না! আর কখনও তোমার প্রতি লালসার দৃষ্টিপাত করব না। আজ হ’তে বুঝলাম, মুসলমান রমণী সতী। সতীত্বের এবং ধর্মের সন্মান মুসলমান রমণীর মত আর কোনও জাতীয়রা রমণীর কাছে আদৃত এবং রতি নহে।”

মালেকার তর্জন-গর্জনে এবং শিবাজীর করুণ প্রার্থনায় সমস্ত গিরিগুহা শব্দায়মান হইয়া উঠায়, ভিতরের প্রহরী এবং দাস-দাসীগণ ব্যস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল। তাহার আসিয়া দেখিল যে, মালেকা আমেনাবানু ভীষণ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ভ্রুকুটি-কুটিল নেত্রে শিবাজীকে পদতলে চাপিয়া দন্ডায়মান! একজন দাসী আনন্দ-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ঠিক হয়েছে, মা! এ যে, উগ্রচন্ডী কালী করালী মূর্তি! পদতলে কাম-কুক্কুর শিবাজী! আজ নরাধমের উপযুক্ত প্রতিশোধ হয়েছে। কি বলব, মা! এই নরাধম কাম-কুক্কুরই আমাকে পাপ-লালসায় ভাসিয়ে স্বকীয় ঘৃণিত পাপ-লিপ্সা চরিতার্থ করেছে। আমি এক্ষণে পুরাতন হয়েছি। তাই নূতন রস ভোগের জন্য নবীনা তোমাকে হরণ করে এনেছে। বেশ হয়েছে, মা! পাষন্ডের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ কর!”

এই বলিয়া দাসী আনন্দে করতালি দিয়া অট্র হাস্যে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। মালেকা ভীষণ গর্জনে, দন্তে দন্ত সংঘর্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, “বল নরাধম কুক্কুর! আর কখনও পরনারীর প্রতি কুভাব পোষণ করবি কি-না?” এই বলিয়া মালেকা আমেনাবানু ছুরিকাখানি বক্ষের দিকে আরও বিনত করিলেন।

শিবাজী ভীত এবং আর্তকণ্ঠে বলিলেনঃ “মালেকা! মালেকা! রক্ষা কর! দোহাই তোমার! আজ হইতে তুমি আমার মাতা! তোমার মাতৃ সম্বোধন করছি। রক্ষা কর, মা! সত্যই তুমি দানবদলনী পাপ-তাপ-নাশিনী দুর্গা। এতদ্ব্যতীত নারীতে কখনও এমন তেজঃ ও সাহসের সঞ্চার সম্ভব নহে।

“মা কর, মা! আমায় মা কর! আজ হ’তে তোমাকে পরম পূজনীয়া জননী বলেই পূজা করব। ধন্য সতী! তুমি শত ধন্য! তোমায় ও পবিত্র পদাঘাতেই কাম-বিকারের নেশা আজ হতে ছুটে গেল। কিন্তু মা! এই পাপী সন্তানের বক্ষ হতে পাদপদ্ম অপসারিত কর, মা! আমার শ্বাস রুদ্ধ হয় আসছে!”

প্রহরী ও দাসদাসীগণ মালেকাবানুর ভীষণ প্রলয়ঙ্কারী মূর্তি সন্দর্শনে সকলেই স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিল। এতক্ষণে তাহাদের মোহ ভঙ্গ হওয়ায় সকলেই “একি কান্ড, মা! ছাড় ছাড়! মহারাজার প্রাণ বধ করে না”-বলিয়া সমস্বরে করুণ চীৎকার করিয়া উঠিল।
মালেকা বক্ষ হইতে দণি পদ তুলিয়া লইয়া একটু দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া আলুলায়িতকেশা মালেকা আমেনাবানুর পাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া যুক্ত করে বলিলেন, “মা! অধম সন্তানের অপরাধ মার্জনা কর। তোমার পূত পদস্পর্শে আমার দিব্যজ্ঞানের উদয় হয়েছে। আমি মহাপাতকী সন্তান, তুমি পুণ্যবতী সাক্ষাৎ জগন্মতা ভবানী। আমার অপরাধ লইও না। আমার ধর্ম-বুদ্ধি সঞ্চারের জন্যই তুমি ও মায়া-প্রপঞ্চ বিস্তার করেছ।” সকলেই দেখিল, শিবাজীর চক্ষু অশ্রুপ্লুত। সত্যই তাঁহার প্রাণে তীব্র অনুতাপের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে।

গভীর অন্ধকার ভেদ করিয়া বিশ্বপ্রহলাদিনী ঊষার মৃদু হাস্য যেমন বিশ্ববক্ষে নবজীবনের সঞ্চার করে, তেমনি অদ্যকার এই ভীষণ পাপলিপ্সা এবং কামাসক্তির সূচীভেদ্য অন্ধ তসমা ভেদ করিয়া দিব্যজ্ঞানের কিরণ শিবাজীর কলুষিত অন্তঃকরণে পদ্মের নির্মল সৌন্দর্য এবং বিমল সৌরভ ফুটাইয়া তুলিল। অকস্মাৎ যেন মেঘরাশি বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রমার বিমল জ্যোতিঃ গগনবক্ষে ফুটিয়া উঠিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *