০১. যখন যা প্রয়োজন

যখন যা প্রয়োজন তা হাতের কাছে পাওয়া গেলে কেমন হত এরকম চিন্তা ইদানীং মিসির আলি করা শুরু করেছেন। এবং তিনি খানিকটা দুশ্চিন্তায়ও পড়েছেন। মানুষ যখন শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল হয় তখনই এ ধরনের চিন্তা করে। তখনই শুধু মনে হয়—সব কেন হাতের কাছে নেই। তিনি মানসিক এই অবস্থার নাম দিয়েছেন— বেহেশত কমপ্লেক্স। এ ধরনের ব্যবস্থা ধর্মগ্রন্থের বেহেশতের বর্ণনায় আছে। যা ইচ্ছা করা হবে তাই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে, আঙুরের থোকা ঝুলতে থাকবে নাকের কাছে।

মিসির আলি খাটে শুয়ে আছেন। পায়ের কাছের জানালাটা খোলা। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। গা শিরশির করছে। এবং তিনি ভাবছেন—কেউ যদি জানালাটা বন্ধ করে দিত। ঘরে কাজের একটা ছেলে আছে ইয়াসিন নাম। তাকে ডাকলেই সে এসে জানালা বন্ধ করে দেবে। ডাকতে ইচ্ছা করছে না। তাঁর পায়ের কাছে ভাঁজ করা একটা চাদর আছে। ভেড়ার লোমের পশমিনা চাদর। নেপাল থেকে কে যেন তাঁর জন্য নিয়ে এসেছিল। ইচ্ছা করলেই তিনি চাদরটা গায়ে দিতে পারেন। সেই ইচ্ছাও করছে না। বরং ভাবছেন চাদরটা যদি আপনাআপনি গায়ের ওপর পড়ত তা হলে মন্দ হত না। নেপাল থেকে চাদরটা কে এনেছিল? নাম বা পরিচয় কিছুই মনে আসছে না। উপহারটা তিনি ব্যবহার করছেন, কিন্তু উপহারদাতার কথা তাঁর মনে নেই। এই ব্যর্থতা মানসিক ব্যর্থতা।

রাত কত হয়েছে মিসির আলি জানেন না। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। বসার ঘরে আছে। সময় জানতে হলে বসার ঘরে যেতে হবে, ঘড়ি দেখতে হবে। ইয়াসিনকে সময় দেখতে বললে লাভ হবে না। সে ঘড়ি দেখতে জানে না। অনেক চেষ্টা করেও এই সামান্য ব্যাপারটা ইয়াসিনকে তিনি শেখাতে পারেন নি। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে শিক্ষক হিসেবে তিনি ব্যর্থ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যর্থতাটাও তিনি নিতে পারছেন না। এটাও মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ। মানসিকভাবে দুর্বল মানুষ ব্যর্থতা নিতে পারে না। মানসিকভাবে সবল মানুষের কাছে ব্যর্থতা কোনো ব্যাপার না। সে জানে সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুই সহোদর বোন। এরা যে কোনো মানুষের চলার পথে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাফল্য নামের বোনটি দেখতে খুব সুন্দর। তার পটলচেরা চোখ, সেই চোখের আছে জন্ম কাজল। তার মুখে প্রথম প্রভাতের রাঙা আলো ঝলমল করে। আর ব্যর্থতা নামের বোনটি কদাকার, মুখে বসন্তের দাগ, চোখে অল্প বয়সে ছানি পড়েছে। সবাই চায় রূপবতী বোনটির হাত ধরতে। কিন্তু তার হাত ধরার আগে কদাকার বোনটির হাত ধরতে হবে এই সহজ সত্যটা বেশিরভাগ মানুষের মনে থাকে না। মানুষের মন যতই দুর্বল হয় ততই সে ঝুঁকতে থাকে রূপবতী বোনটির দিকে। এটা অতি অবশ্যই মানসিক জড়তার লক্ষণ।

‘স্যার ঘুম পাড়ছেন?’

মিসির আলি উঠে বসলেন। দাঁত কেলিয়ে ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স বার-তের। হাবাগোবা চেহারা। কিন্তু হাবাগোবা না। যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। শুধু বুদ্ধির ছাপ চেহারায় আসে নি। ঠোঁটে গোঁফের ঘন রেখা জাগতে শুরু করেছে, এতে হঠাৎ করে তাকে খানিকটা ধূর্তও মনে হচ্ছে। যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানেন ইয়াসিন ধূর্ত না। ইয়াসিনকে অনেকবার বলা হয়েছে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা অবস্থায় তাঁকে যেন কখনো জিজ্ঞাসা করা না হয়—’তিনি ঘুম পাড়ছেন না পাড়েন নি।’ কোনো লাভ হয় নি। বরং উল্টোটা হয়েছে, তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই ইয়াসিন তাঁকে ডেকে তোলাকে তার দায়িত্বের অংশ বলে মনে করা শুরু করেছে। এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে বেশ আনন্দিতও মনে হচ্ছে।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, ক’টা বাজে দেখে আয় তো। ইয়াসিন উৎসাহের সঙ্গে রওনা হল। তার যাবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হয়তো আজ সে সময়টা বলতে পারবে। গতকাল রাতেও তিনি ছবিটবি এঁকে ঘড়ির সময় বোঝানোর চূড়ান্ত চেষ্টা করেছেন। ইয়াসিনের ঘন ঘন মাথা নাড়া দেখে মনে হয়েছে সে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। দেখা যাক।

ইয়াসিন হাসিমুখে ফিরে এল। মিসির আলি বললেন, ক’টা বাজে?

ইয়াসিনের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। আনন্দময় গলায় বলল, বুঝি না। আউলা ঠেকে।

ছোট কাঁটা ক’টার ঘরে?

‘তিনের ঘরে।

‘আর বড়টা?’

‘ছোট জন যে ঘরে। বড় জনও একই ঘরে।’

মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। দশটার বেশি রাত হয় নি। ছোট কাঁটা তিনের ঘরে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ছোট কাঁটা বড় কাঁটার ব্যাপারটাই হয়তো ইয়াসিন বোঝে নি। গোড়াতেই গিট্টু লেগে আছে।

‘স্যার চা খাইবেন?’

‘না।’

‘দরজা বন কইরা দেন। কাইল সক্কালে আমুনে।’

‘আজ না গেলে হয় না?’

‘হয়। না গেলেও হয়। যাই গা। কাইল সক্কালে আমু।’

মিসির আলি উঠলেন। ইয়াসিন একবার যখন বলেছে যাবে তখন সে যাবেই। ইয়াসিনের বাবা—ফার্মগেট এলাকায় ভিক্ষা করে। ভিক্ষুক বাবার খোঁজখবর করার জন্য সে প্রায়ই যায়। মাঝে মধ্যে নিজেও ভিক্ষা করে। ইয়াসিনরা তিন পুরুষের ভিক্ষুক। তার দাদাও ভিক্ষা করতেন। মিসির আলি ব্যাপক চেষ্টা করছেন পুরুষানুক্রমিক এই পেশা ভাঙার। ইয়াসিনকে এনে কাজ দিয়েছেন। লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছেন। মাঝে মাঝে বক্তৃতা—মানুষ পৃথিবীতে দুটা হাত নিয়ে এসেছে কাজ করার জন্য ভিক্ষা করার জন্য না। আল্লাহ যদি চাইতেন মানুষ ভিক্ষা করবে তা হলে তাকে একটা হাত দিয়েই পৃথিবীতে পাঠাতেন। ভিক্ষার থালা ধরার জন্য একটা হাতই যথেষ্ট। মনে হচ্ছে না শেষ পর্যন্ত উপদেশমূলক বক্তৃতায় কোনো লাভ হবে। ইয়াসিনের প্রধান ঝোঁক ভিক্ষার দিকে। মিসির আলি নিশ্চিত আজ সে ভিক্ষা করার জন্যই যাচ্ছে। বিষ্যুদবার রাতে বাবার সঙ্গে সে আজিমপুর গোরস্থানের গেটে ভিক্ষা করতে যায়।

মিসির আলি বললেন, ভিক্ষা করতে যাচ্ছিস?

ইয়াসিন জবাব দিল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকাল।

‘সকালে কখন আসবি?’

‘দেখি।’

‘সকাল দশটার পরে এলে কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারবি না। আমি তালা দিয়ে চলে যাব। এগারোটার সময় আমার একটা মিটিং আছে। তুই অবিশ্যি দশটার আগে চলে আসবি।

‘দেখি।’

মিসির আলি লক্ষ করলেন, ইয়াসিন তার ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হচ্ছে। ভালো সম্ভাবনা যে সে আর ফিরবে না। নিজের সব সম্পত্তি নিয়ে বের হচ্ছে। এই ট্রাঙ্কটা সম্পর্কে মিসির আলির সামান্য কৌতূহল আছে। ইয়াসিন ট্রাঙ্কে বড় একটা তালা ঝুলিয়ে রাখে। গভীর রাতে শব্দ শুনে মিসির আলি টের পান যে তালা খোলা হচ্ছে।

‘তুই কি সকালে সত্যি আসবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘ট্রাঙ্ক নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

‘প্রয়োজন আছে।’

‘আচ্ছা যা।’

ইয়াসিন পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করল। এটা নতুন কিছু না। ইয়াসিন বাইরে যাবার আগে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে।

মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ঘড়ি দেখতে বসার ঘরে গেলেন। ঘড়ির দুটা কাঁটা তিনের ঘরে এই কথাটা ইয়াসিন মিথ্যা বলে নি। তিনটা পনেরো মিনিটে ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাটারি শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই। ঘরে একটা মাত্ৰ ঘড়ি। তাঁর নিজের হাতঘড়িটা মাস তিনেক হল হারিয়েছেন। কাজেই রাতে আর সময় জানা যাবে না।

মিসির আলি সূক্ষ্ম অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর মনে হল সময় জানাটা খুবই দরকার। ঘরে খাবার পানি না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি শুকিয়ে আসে। ঘরে পানি থাকলে কখনো এত তৃষ্ণা পেত না।

সময় জানার জন্য মিসির আলি উসখুস করতে লাগলেন। যদিও সময় এখন না জানলেও কিছু না। তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা। শরীর ভালো যাচ্ছে না। বুকে প্রায় সময়ই চাপ বোধ করেন। রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তখন মনে হয় বুকের উপর কেউ যেন বসে আছে। সেও স্থির হয়ে বসে নেই, নড়াচড়া করছে। তিনি উঠে বসেন। বিছানা থেকে নামেন। বুকের উপর বসে থাকা বস্তুটা কিন্তু তখনো থাকে। টিকটিকির মতো বুকে সেঁটে থাকে। এইসব লক্ষণ ভালো না। এসব হচ্ছে ঘণ্টা বাজার লক্ষণ। প্রতিটি জীবিত প্রাণীর জন্য ঘণ্টা বাজানো হয়। জানিয়ে দেওয়া হয় তোমার জন্য অদৃশ্য ট্রেন পাঠানো হল। এ তারই ঘণ্টা। ভালো করে তাকাও দেখবে সিগন্যাল ডাউন হয়েছে। ট্রেন চলে আসার সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। ট্রেন থামতেই তুমি টুক করে তোমার কমরায় উঠে পড়বে। না তোমাকে কোনো সুটকেস বেডিং নিতে হবে না। ট্রেনটা যখন তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তখন যেভাবে এসেছিলে যাবেও সেইভাবে। ট্রেন থামতে থামতে যাবে, নানান যাত্রী উঠবে—সবার গন্তব্য এক জায়গায়। সে জায়গাটা সম্পর্কে করোরই কোনো ধারণা নেই।

মিসির আলি দরজা খুললেন। বারান্দায় এস বসলেন। বুকে চাপ ব্যথাটা আবারো অনুভব করছেন। ফাঁকা জায়গায় বসে বড় বড় নিশ্বাস ফেললে আরাম হবার কথা। সেই আরামটা হচ্ছে না। মিসির আলির দু কামরার এই বাড়িটার আবার একটা বারান্দাও আছে। গ্রিল দেওয়া বারান্দা। বারান্দাটা এত ছোট যে দুটা চেয়ারেই বারান্দা ভর্তি। মিসির আলি এই বারান্দায় কখনো বসেন না। গ্রিল দেওয়ার কারণে বারান্দাটা তাঁর কাছে জেলখানার গরাদের মতো লাগে। বারান্দা থাকবে খেলামেলা। এবং অতি অবশ্যই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যাবে। জানালা মানে যেমন আকাশ, বারান্দা মানে ও আকাশ। গ্রিল দেওয়া এই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায় না।

বারান্দা থেকে বাড়িওয়ালা বাড়ির খানিক অংশ এবং নর্দমাসহ গলি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মিসির আলির খুব ইচ্ছা অন্তত জীবনের শেষ কিছু দিন তিনি এমন একটা বাড়িতে থাকবেন যে বাড়ির বড় বড় জানালা থাকবে। জানালার পাশ থেকে আকাশ দেখা যাবে। জীবনের শেষ সময় এসে পড়েছে বলেই তাঁর ধারণা—–জানালাওয়ালা বারান্দার কোনো ব্যবস্থা এখনো হয় নি। তবে তাঁর ধারণা তাঁর শেষ ইচ্ছাটা পূর্ণ হবে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর আত্মীয়স্বজনরা অবশ্যই তাকে কোনো একটা ভালো ক্লিনিকে ভর্তি করবে। সেই ক্লিনিকের ভাড়া তিনি দিতে পারবেন কি পারবেন না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।

ক্লিনিকে তাঁর বিছানাটা থাকবে জানালার কাছে। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারবেন। ডাক্তার এবং নার্সরা মিলে তাঁর জীবন রক্ষার জন্যে যখন ছোটাছুটি করতে থাকবেন, তিনি তখন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে। মৃত্যুর আগে আগে শারীরবৃত্তির সকল নিয়মকানুন এলোমেলো হয়ে যায়। কাজেই তিনি হয়তো তখন আকাশের কোনো অদ্ভুত রঙ দেখবেন। নীল আকাশ হঠাৎ দেখা গেল গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। কিংবা আকাশ হয়েছে বেগুনি। বেগুনি তাঁর প্রিয় রঙ।

‘স্যার স্লামালিকুম।’

মিসির আলি চমকে তাকালেন। বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের ভাগ্নে ফতে মিয়া। আপন ভাগ্নে না। দূরসম্পর্কের ভাগ্নে। ফতে মিয়া মিসির আলির ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তিনি তাকে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেন নি। যখন চোখ বন্ধ করে ছিলেন তখন এসেছে। ফতে মিয়ার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। মানুষটা মনে হয় বাতাসের ওপর চলে। মানুষটা বাতাসের ওপর দিয়ে চলাফেরা করার মতো ছোটখাটো না। তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো। শুধু শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। দেখে মনে হয় খুব রোগা কোনো মানুষের মাথা একজন কুস্তিগিরের শরীরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফতে মিয়ার গলার স্বর পরিষ্কার। ঝনঝন করে কথা বলে।

‘ফতে মিয়া কেমন আছ?’

‘স্যার আপনার দোয়া।’

‘সঙ্গে ঘড়ি আছে? ক’টা বাজে বলতে পার?’

‘দশটা চল্লিশ।’

মিসির আলি লক্ষ করলেন সময় বলতে গিয়ে ফতে ঘড়ি দেখল না। এটা তেমন কোনো ব্যাপার না। ঘড়ি হয়তো সে একটু আগেই দেখেছে। তার পরেও মানুষের স্বভাব হল সময় বলার আগে ঘড়ি দেখে নেওয়া। ফতে মিয়া সময় বলেছে দশটা চল্লিশ। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এভাবে সময় বলা সম্ভব না। মিসির আলির মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। একবার ইচ্ছা হল জিজ্ঞেস করেন ঘড়ি না দেখে এমন নিখুঁতভাবে সময়টা সে বলছে কীভাবে। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ফতে মিয়া বলল, ‘স্যার যাই?’

‘আচ্ছা।’

‘ঠাণ্ডা পড়েছে। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন। রেস্ট নেন। আশ্বিন-কার্তিক মাসের ঠাণ্ডাটা বুকে লাগে। পৌষ-মাঘ মাসের ঠাণ্ডায় কিছু হয় না।’

ফতে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল সেরকম নিঃশব্দেই চলে গেলেন। নিশাচর পশুরাই এমন নিঃশব্দে চলে। নিশাচরদের সঙ্গে ফতে মিয়ার কোথায় যেন খানিকটা মিল আছে। মিসির আলি বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের হইচই চিৎকার শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বদরুল সাহেব তার ভাগ্নেকে গালাগালি না করে ঘুমাতে যাবেন তা হবার না। ছ’মাসের ওপর হল মিসির আলি এ বাড়িতে আছেন। ছ’মাসে এ নিয়মের ব্যতিক্রম দেখেন নি। বদরুল সাহেবের মেজাজ এমনিতেই চড়া। বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন, হইচই চিৎকার গালাগালির মধ্যেই থাকেন। নিজের ভাগ্নের ক্ষেত্রে সব সীমা অতিক্রম করে। তিনি শুরুই করেন—’শুয়োরের বাচ্চা পাছায় লাথি মেরে তোমাকে আমি…’ দিয়ে। মাঝে মাঝে চড়থাপ্পড় পর্যন্ত গড়ায়। বদরুল সাহেব ছোটখাটো রোগা পটকা মানুষ। তাঁর নানান অসুখবিসুখ আছে। চুপচাপ যখন বসে থাকেন তখন বুকের ভিতর থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসে। এরকম একজন মানুষের ফতে মিয়ার মতো বলশালী কাউকে চড় মারতে সাহস লাগে। সেই অর্থে বদরুল সাহেবকে সাহসী মানুষ বলা যায়।

আশ্রিত মানুষকে নানান অপমানের মধ্যে বাস করতে হয়। সেই অপমানেরও একটা মাত্রা আছে। ফতে মিয়ার ব্যাপারে কোনো মাত্রা নেই। মিসির আলি একবার তাকে দেখলেন ঠোঁট অনেকখানি কাটা। স্টিচ দিতে হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ফতে?

সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, মামা রাগ করে ধাক্কার মতো দিয়েছিলেন। সিঁড়িতে পড়ে গেলাম। তেমন কিছু না। মামা প্রেসারের রোগী, রাগ সামলাতে পারেন না। তার ওপর মেয়েটা অসুস্থ। মেয়েটার জন্য মন থাকে খারাপ।

বদরুল সাহেবের একটাই মেয়ে। ছ’বছর বয়স—নাম লুনা। মেয়েটার মানসিক কোনো সমস্যা আছে। চুপচাপ একা বসে থাকে। তার একটাই খেলা—হাতের মুঠি বন্ধ করছে, মুঠি খুলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে এই খেলা খেলে পার করে দিতে পারে। মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর।

মিসির আলি প্রায়ই মেয়েটাকে সিঁড়ির গোড়ায় বসে থাকতে দেখেন। একমনে হাতের মুঠি বন্ধ করছে, খুলছে। দৃশ্যটা দেখে মিসির আলির মন খুবই খারাপ।

আজ অনেকক্ষণ বসে থেকেও ফতে মিয়ার প্রেসারের রোগী মামার কোনো হইচই শোনা গেল না। আজ হয়তো তিনি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। বাড়িওয়ালার চিৎকারটাও রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। কোনোদিন যদি শোনা না যায় তা হলে মনে হয় দিনটা ঠিকমতো শেষ হয় নি। কোথাও ফাঁক আছে।

মিসির আলি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। রাত কত হয়েছে বোঝার উপায় নেই। ঘড়ি বন্ধ। বিছানায় যাবার আগে এক কাপ গরম চা খেলে হত। বেশিরভাগ মানুষই কফি অথচা চা খেলে ঘুমাতে পারে না। অথচ গরম চা তাঁর জন্যে ঘুমের ওষুধের মতো কাজ করে। ইয়াসিন থাকলে চা এক কাপ খাওয়া যেত। তাঁর নিজের এখন আর চুলার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।

খুব হালকাভাবে কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ইয়াসিনই ফিরে এসেছে কি না কে জানে। বাবাকে হয়তো খুঁজে পায় নি, কিংবা ভিক্ষা করে আজ তেমন সুবিধা করতে পারে নি।

‘কে?’

‘স্যার আমি ফতে।’

‘কী ব্যাপার?’

‘আপনার জন্যে মোমবাতি নিয়ে এসেছি স্যার।’

মিসির আলি বিস্মিত হলেন। মোমবাতির কথা কি তিনি ফতে মিয়াকে বলেছেন? না বলেন নি। মোমবাতি নিয়ে তার উপস্থিত হবার কোনোই কারণ নেই।

ফতে মিয়া শুধু মোমবাতি আনে নি। ফ্লাস্কে করে চা এনেছে। আজকাল দুটা বিস্কুটের ছোট ছোট প্যাকেট পাওয়া যায়। এক প্যাকেট বিস্কুটও এনেছে। সে ঘরে ঢুকে ফ্লাস্কের মুখে চা ঢেলে মিসির আলির দিকে এগিয়ে দিল। প্যাকেট খুলে বিস্কুট বের করল। দুটা বড় বড় মোমবাতি সামনে রাখল। মোমবাতির পাশে রাখল দেয়াশলাই। কাজগুলো করল যন্ত্রের মতো। যেন প্রতিদিনই এরকম কাজ সে করে। যে কোনো অভ্যস্ত কাজ করায় যে যান্ত্রিকতা থাকে তার সবটাই ফতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, তোমাকে কি মোমবাতি আনতে বলেছিলাম?

ফতে লজ্জিত গলায় বলল, জি না বলেন নাই। দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। লোডশেডিং হবে। অন্ধকারে কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না, এই জন্য মোমবাতি নিয়ে এসেছি।

‘দশ মিনিটের ভেতর লোডশেডিং হবে।

‘জি। চা খান। আমি নিজে বানিয়েছি। চিনি ঠিক হয়েছে কি না একটু দেখেন।’ মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি চায়ে যতটুকু চিনি খান, ঠিক ততটুকু চিনিই আছে। তিনি কড়া একটু তিতকুট ধরনের চা পছন্দ করেন—এই চা কড়া এবং তিতকুট ধরনের।

‘ফতে।’

‘জি স্যার।’

‘তোমার চা খুব ভালো হয়েছে। আমি কোন ধরনের চা খাই তা তুমি জান?’

‘ইয়াসিনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।’

‘এখন ক’টা বাজে?’

‘এগারোটা পাঁচ।’

‘তোমার হাতে ঘড়ি আছে?’

‘জি না।’

‘আমার এখানে আসার আগে কি ঘড়ি দেখে এসেছ?’

‘জি না।’

‘তা হলে কী করে বলছ—এগারোটা পাঁচ বাজে?’

‘ঘড়ি না দেখেও আমি সময় বলতে পারি। ছোটবেলা থেকেই পারি। মৃত্যুঞ্জয় হাই স্কুলে যখন পড়ি তখন স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টার সাহেব এসেছিলেন, তাঁকে ঘড়ির খেলা দেখিয়েছিলাম। উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে একটা ভালো ঘড়ি পাঠিয়ে দেবেন। পাঠান নাই। ভুলে গেছেন হয়তো।’

‘ঘড়ির খেলাটা কী?’

‘ঘড়ি না দেখে বলা সময় কত।’

‘ও আচ্ছা।’

‘স্যারের শরীর কি খারাপ?’

‘সামান্য খারাপ।’

‘শরীরের যত্ন নিবেন স্যার। যত্ন বিনা কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। এই আমাকে দেখেন সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হই। চাইর থেকে পাঁচ মাইল হাঁটি। এই কারণে আমার কোনো অসুখবিসুখ হয় না। আপনে যদি অনুমতি দেন সকালে হাঁটতে যাবার সময় আপনাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

‘কোনো দরকার নেই কতে মিয়া। হাঁটাহাঁটি ব্যাপারটা আমার পছন্দ না। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ নানান কষ্টকর পদ্ধতির ভিতর দিয়ে যায়—ব্যায়াম করে, হাঁটাহাঁটি করে। আমার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কোনো বাসনা নেই।’

কথা শেষ করার আগেই কারেন্ট চলে গেল। ফতে মিয়া বলেছিল দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। তাই হয়েছে। চমকানোর মতো কোনো ঘটনা না। ঢাকা শহরে রাতে পাঁচ-ছ’বার করে ইলেকট্রিসিটি চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কেউ যদি বলে দশ মিনিটের মধ্যে লোডশেডিং হবে তার কথা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি। মিসির আলি ভেবেছিলেন ফতে বলবে, দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে বলেছিলাম দেখলেন সার কারেন্ট চলে গেছে।

ফতে তা করল না। সে সাবধানে মোমবাতি জ্বালাল। পাশাপাশি দুটা মোমবাতি। তার মুখ হাসি হাসি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে সে আনন্দিত। ফ্লাস্ক থেকে নিজের জন্যে চা ঢালতে ঢালতে বলল, স্যার আজ আমার মনটা খুব ভালো।

‘ভালো কেন?’

‘আমি একটা দোকান নিয়েছি। সেলামির টাকা ছাড়াই দোকান পেয়েছি। আঠারো হাজার টাকা শুধু দিতে হয়েছে।’

‘কিসের দোকান?’

‘দরজির দোকান। আমি দরজির কাজ কিছু জানি না। ইনশাল্লাহ শিখে ফেলব। তবে একজন কর্মচারী আছে। কাজ ভালো জানে। দোকান নেওয়ার খবরটা স্যার আপনাকেই প্রথম দিলাম। আপনি নাদান ফতের জন্যে খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।’

ফতের চোখ চকচক করছে। গলার স্বর ভারী হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদেই ফেলবে। ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দোকানের টাকাটা খুবই কষ্ট করে যোগাড় করেছি। মামার সঙ্গে দুবছর ধরে আছি। এই দুবছরে মামার বাজার করতাম। রোজ কিছু কিছু টাকা সরাতাম। কোনোদিন দশ টাকা কোনোদিন পনেরো টাকা। এই অনেক টাকা হয়ে গেল—ঐ কবিতাটা পড়েছেন না স্যার বিন্দু বিন্দু বালিকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে সাগর অতল। দৈনিক পনেরো টাকা সরালে দুই বছরে হয় দশ হাজার নয়শ পঞ্চাশ টাকা। আমার হয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা। কিছু টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমার আবার সিগারেট খাওয়ার বদভ্যাস আছে। নেশার মধ্যে সিগারেট আর জরদা দিয়ে পান। স্যার নেন আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নেন। বাংলা ফাইভ।

মিসির আলি সিগারেট নিলেন। ফতে আবারো কথা শুরু করল—একবার করলাম কি স্যার বেশ কিছু টাকা একসঙ্গে সরিয়ে ফেললাম। পঁচিশ হাজার টাকা। আমাকে ব্যাংকে পাঠিয়েছে জমা দিতে, আমি ফিরে এসে বললাম টাকা হাইজ্যাক হয়ে গেছে। মামা-মামি দুজনই আমার কথা বিশ্বাস করল। বিশ্বাস না করে উপায়ও নাই—আমার হাত-পা কাটা সারা শরীর রক্তে মাখামাখি।

‘নিজেই নিজের হাত-পা কেটেছ?’

‘জি স্যার। একটা ব্লেড কিনে, ব্লেড দিয়ে কেটেছি। নিজের হাতে নিজের শরীর কাটাকুটি করা খুবই কষ্টের কিন্তু কি আর করা এতগুলি টাকা। এত রক্ত বের হচ্ছিল যে আমার মামি পর্যন্ত মামার উপরে রেগে গিয়ে বলল—কেন তুমি তাকে একা একা এতগুলি টাকা দিয়ে পাঠালে। একে তো মেরেই ফেলত। স্যার আমার কথা শুনে কি আপনার খারাপ লাগছে?’

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছেন। ফতের গল্প বলার ক্ষমতা ভালো। গলার স্বরের উঠানামা আছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কথা বন্ধ করে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। এতে গল্পটা আরো জমে যায়।

‘স্যার বোধহয় আমাকে খুব খারাপ মানুষ ভাবছেন। স্যার আমি খারাপ না। মামার কাছ থেকে আমি কত টাকা নিয়েছি সব একটা খাতায় লিখে রেখেছি। ইনশাল্লাহ সব টাকা একদিন ফিরত দেব।’

‘দরজির দোকান দেওয়ার ব্যাপারটা তোমার মামা জানে?’

‘জি স্যার আজ বিকালে বলেছি।’

‘উনি জিজ্ঞেস করেন নাই এত টাকা কোথায় পেয়েছ?’

‘উনাকে বলেছি যে আমার এক বন্ধু আমাকে টাকাটা ধার দিয়েছে।’

‘বন্ধুর কথা উনি বিশ্বাস করেছেন?’

‘জি করেছেন। উনি জানেন আমার এক বন্ধু কুয়েতে কাজ করে। বাবুর্চি। সে আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে এটা মামাকে অনেক দিন থেকেই বলছিলাম। মামা এটা নিয়ে আমাকে অনেক ঠাট্টা-মশকরাও করতেন। প্রায়ই বলতেন—কই তোর বন্ধুর টাকা কবে আসবে?

আজ সন্ধ্যায় মামাকে পা ছুঁয়ে বলেছি টাকা এসেছে। মিষ্টি কিনে নিয়ে গিয়েছি। মামা খুশি হয়েছে। দরজির দোকানের কথা মামাকে বলেছি। মামা বলেছেন প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে। এটা অবশ্য মামার মুখের কথা। মামা মুখে অনেক কথা বলেন।

‘ফতে।’

‘জি স্যার।’

‘তুমি আমাকে যেসব কথা বললে তার সবই তো গোপন কথা। প্রকাশ হয়ে পড়লে তোমার সমস্যা। কথাগুলি আমাকে কেন বললে?’

‘আপনার কাছ থেকে কোনো কথাই প্রকাশ হবে না। আপনি গাছের মতো। গাছের কাছ থেকে কোনো কথা প্রকাশ হয় না।’

‘আমাকে কথাগুলি বলার কারণ কী?’

‘কাউকে বলার ইচ্ছা করছিল। আমার স্যার কথা বলার লোক নাই। বাবা-মা শৈশবে গত হয়েছেন। একটা বোন আছে মাথা খারাপ। বন্ধুবান্ধব কেউ নাই।’

‘কাউকে বলতে হয় বলেই কি তুমি আমাকে কথাগুলি বললে?’

‘জি স্যার।’

কারেন্ট চলে এসেছে। ফতে ফুঁ দিয়ে বাতি নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার যাই। আমার জন্যে একটু দোয়া রাখবেন স্যার। গরিবের ছেলে যদি দোকানটা দিয়ে কিছু করতে পারি। আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। যদি রাগ না করেন তা হলে বলি।

‘বল।’

‘দরজির দোকানের একটা নাম যদি দেন। সুন্দর কোনো নাম। আগে নাম ছিল বোম্বে টেইলারিং হাউস। আমি স্যার সুন্দর একটা নাম দিতে চাই। বাংলা নাম।’

‘নামটাম আমার ঠিক আসে না।’

‘আপনি যে নাম দিবেন সেটাই আমি রাখব। আপনি যদি খারাপ নামও দেন কোনো অসুবিধা নাই। আপনি যদি নাম দেন—’গু–গোবর টেইলারিং শপ’ আল্লাহর কসম সেই নামই রাখব।’

‘কেন?’

‘এটা আমা একটা শখ। মানুষের অনেক শখ থাকে। আমার শখ আমার দরজির দোকানের নামটা আপনি দিবেন।

‘আচ্ছা দেখি মাথায় কোনো নাম আসে কি না।’

‘এত চিন্তাভাবনা করার কিছু তো নাই সার। এখন আপনার মাথায় যে নামটা আসছে সেটা বলেন।’

‘এখন মাথায় কিছু নেই।

‘যা ইচ্ছা বলেন।’

‘সাজঘর।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার দোকানের নাম সাজঘর। স্যার উঠি?’

‘আচ্ছা।’

ফতে বিনীত গলায় বলল, ‘দুটা মোমবাতি আর একটা দেয়াশলাইয়ের দাম পড়েছে পাঁচ টাকা। আপনার কথা ভেবে কিনেছিলাম। ভাংতি পাঁচ টাকা কি আছে স্যার?’

মিসির আলি ড্রয়ার খুলে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করলেন। ফতের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে তিনি যতটা না অবাক হয়েছেন তারচে অনেক বেশি অবাক হয়েছেন পাঁচ টাকার ব্যাপারটায়।

ফতে চলে গেল। যাবার আগে অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করল। মিসির আলির মনে হল তিনি ছোট্ট একটা ভুল করেছেন। চলে যাবার আগে ফতেকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল—ক’টা বাজে? ঘুমাতে যাবার আগে সময়টা জানা থাকা দরকার। আধুনিক মানুষ যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছে। মানুষ যেমন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, যন্ত্রও মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছে।

মিসির আলি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলেন। ভালো শীত লাগছে। কোল্ড ওয়েভ হচ্ছে কি না কে জানে। কোন্ড ওয়েভের বাংলাটা ভালো হয়েছে—শৈত্যপ্রবাহ। কিছু কিছু শব্দ এমন আছে যে বাংলাটা সুন্দর—ইংরেজি তত সুন্দর না। যেমন Air condition বাংলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ। বায়ু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না—তাপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনি পায়ের ওপর চাদরটা দিয়ে দিলেন— তখনই মনে পড়ল চাদরটা যে তাকে উপহার দিয়েছিল তার নাম তিনি মনে করতে পারছেন না। শুধু নাম না, মানুষটার পরিচয়ও তাঁর মনে নেই। মস্তিষ্ক মানুষটার পরিচয় মুছে ফেলেছে। মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে এ ধরনের কাজ করে। খুব ঠাণ্ডায় মাথার বিশেষ বিশেষ কিছু স্মৃতির দরজা বন্ধ করে দেয়। মস্তিষ্ক মনে করে এই কাজটি করা প্রয়োজন, দরজা বন্ধ না করলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে। এমন কোনো পদ্ধতি কি আছে যাতে এই বন্ধ দরজা খোলা যায়?

কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের কিছু কিছু ফাইল হঠাৎ হারিয়ে যেতে পারে। সেই সব ফাইল উদ্ধারের প্রক্রিয়া আছে। মানুষের মস্তিষ্ক তো অবিকল কম্পিউটারের মতোই। স্মৃতি তো কিছু না সাজিয়ে রাখা ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল। কাজেই যে পদ্ধতিতে কম্পিউটারের হারানো ফাইল খোঁজা হয়—সেই পদ্ধতিতেই বা তার কাছাকাছি পদ্ধতিতে হারানো স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা কেন হচ্ছে না?

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বই নিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মন যে কোনো কারণেই হোক কিছুটা বিক্ষিপ্ত। মনকে শান্ত করতে না পারলে রাতে ভালো ঘুম হবে না। মন শান্ত করার একটি পদ্ধতিই মিসির আলি জানেন। বই পড়া। সেই বইও হালকা গল্প-উপন্যাস না, থ্রিলার না, জটিল কোনো বিষয় নিয়ে লেখা বই। তিনি যে বইটি হাতে নিলেন তার নাম—Dark days. অন্ধকার দিন। লেখক এই পৃথিবীর ভয়াবহ কয়েকজন অপরাধীর একজন, নাম David Bertzowitz. তাঁর লেখা আত্মজীবনী। তিনি লিখেছেন—

I have often noticed just how unobservant people are. It has been said that parents are the east to know. This may be true in my case, for I wonder how I at the ages of nine, eleven, thirteen manged to do so many negative things and go unnoticed. It is puzzling indeed. And I think it is sad.

‘আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো না। বলা হয়ে থাকে বাবা-মা’রা সবার শেষে জানতে পারেন। আমার জন্যে এটা সত্যি। আমি খুবই অবাক হই যখন ভাবি ন’ বছর, এগারো বছর এবং তেরো বছরে যেসব অন্ধকার কর্মকাণ্ড আমি করেছি তা কী করে কারোর চোখে পড়ল না। চোখে না পড়ার বিষয়টা রহস্যময় এবং অবশ্যই দুঃখের।’

মিসির আলি লক্ষ করলেন তাঁর মন শান্ত হয়েছে। মন নানান দিকে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল। একসঙ্গে অনেকগুলি পথে হাঁটছিল—এখন একটি পথে হাঁটছে। বইটির বিষয়বস্তুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। David Bertzowitz ঠিকই লিখেছে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিম্নমানের। সে দেখেও দেখে না।

ফতের মামার কথাই ধরা যাক। ফতের মামা বদরুল সাহেব নিশ্চয়ই কখনো ফতেকে ভালোভাবে দেখেন নি। তিনি নিশ্চয়ই ফতের মানসিকতা, তার চিন্তাভাবনা কিছুই বলতে পারবেন না। ফজরের নামাজ শেষ করে ফতে মর্নিং ওয়াক করতে যায় এই তথ্য তিনি জানেন। কিন্তু কোথায় যায় তা কি জানেন? তিনি কি জানেন যে ফতের অনিদ্রা রোগ আছে, সে মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে হাঁটে। এই কাজটা যখন করে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। ফতের মামা কি জানেন যে ফতে বাজারের ভারী ব্যাগ নিয়ে যখন ঢোকে তখন ব্যাগটা থাকে তার বাঁ হাতে। বাঁ হাতি মানুষরা এই কাজ করে। ফতে বাঁ হাতি না। তারপরেও ভারী কাজগুলি সে বাঁ হাতে করে। ডান হাত ব্যবহার করে না।

মিসির আলি চিন্তা বন্ধ করে হঠাৎ নিজের ওপর খানিকটা বিরক্তি বোধ করলেন। ছেলেমানুষি এই কাজটা তিনি কেন করছেন? কেন প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। যার পড়াশোনার বিষয় মানুষের মন তাকে তো মানুষ পর্যবেক্ষণ করতেই হবে। মানুষের দিকে তাকিয়ে তার আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে পৌঁছতে হবে মন নামক অধরা বস্তুতে। আচ্ছা মন কী?

মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। উত্তরটা তাঁর জানা নেই। গত পঁচিশ বছর এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। উত্তর পান নি। এখন বয়স হয়ে গেছে। যে কোনো একদিন অদ্ভুত ট্রেনে উঠে পড়তে হবে। ট্রেনে উঠার আগে কি উত্তরটা জেনে যাওয়া যাবে না?

বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের মেয়েটা কাঁদছে। শিশুরা ব্যথা পেয়ে যখন কাঁদে তখন কান্নার আওয়াজ এক রকম, আবার যখন মনে কষ্ট পেয়ে কাঁদে তখন অন্য রকম। লুনা মেয়েটার কান্না শুনে মনে হচ্ছে সে গভীর দুঃখে কাঁদছে।

মেয়েটা প্রায়ই এরকম কাঁদে। তখন কিছুতেই তার কান্না থামানো যায় না। বদরুল সাহেব কোলে নিয়ে হাঁটেন। তার স্ত্রী হাঁটেন। আদর করেন, ধমক দেন। কিছুতেই কিছু হয় না। একটা পর্যায়ে তারা মেয়েকে ফতের কাছে দিয়ে দেন। ফতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত করে ফেলে।

অনেকক্ষণ ধরেই মেয়েটা কাঁদছে। মিসির আলি বই বন্ধ করে বসে আছেন। বাচ্চা একটা মেয়ে গভীর দুঃখে কাঁদবে আর তিনি তা অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে যাবেন—তা কীভাবে হয়?

তিনি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এস দাঁড়ালেন। লুনাকে নিয়ে তার মা দোতলার বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে হাঁটছেন। এত দূর থেকেও ভদ্রমহিলাকে ক্লান্ত এবং হতাশ মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। লুনার কান্নাটা সহ্য করা যাচ্ছে না। তাঁর বিরক্তি লাগছে। কেন মেয়েটার বাবা-মা ফতেকে ডাকছেন না। ফতে নিমিষের মধ্যেই বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

বাচ্চা মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেই যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *