০১. ভীতু মানুষ বলতে যা বোঝায়

ভীতু মানুষ বলতে যা বোঝায় আমি তা না। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে আমার বুকে ধক করে ধাক্কা লাগে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যদি শুনি বাথরুমে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে—কে যে হাঁটছে, গুন গুন করে গান গাইছে, কল ছাড়ছে-বন্ধ করছে, তাতেও আতঙ্কগ্রস্ত হই না। একবার ভূত দেখার জন্যে বাদলকে নিয়ে শ্মশানঘরে রাত কাটিয়েছিলাম। শেষরাতে ধুপধাপ শব্দ শুনেছি। চারদিকে কেউ নেই, অথচ ধুপধাপ শব্দ। ভয়ের বদলে আমার হাসি পেয়ে গেল। আমার বাবা তাঁর পুত্রের মন থেকে ‘ভয়’-নামক বিষয়টি পুরোপুরি দূর করার জন্যে নানান পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। পদ্ধতিগুলি খুব যে বৈজ্ঞানিক ছিল তা বলা যাবে না, তবে পদ্ধতিগুলি বিফলে যায়নি। কাজ কিছুটা করেছে। চট করে ভয় পাই না।

রাতবিরেতে একা একা হাঁটি। কখনো রাস্তায় আলো থাকে, কখনো থাকে না। বিচিত্র সব মানুষ এবং বিচিত্র সব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি—কখনো আতঙ্কে অস্থির হইনি। তিন-চার বছর আগে এক বর্ষার রাতে ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। রাত দুটা কিংবা তারচে কিছু বেশি বাজে। আমি কাঁটাবনের দিক থেকে আজিজ মার্কেটের দিকে যাচ্ছি। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চারপাশ জনমানবশূন্য। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছি। খুবই মজা লাগছে। মনে হচ্ছে সোডিয়াম ল্যাম্পগুলি থেকে সোনালি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি—প্যান্ট এবং সাদা গেঞ্জি-পরা একজন মানুষ আমার দিকে ছুটে আসছে। রক্তে তার সাদা গেঞ্জি হাত-মুখ মাখামাখি—ছুরিতেও রক্ত লেগে আছে। বৃষ্টিতে সেই রক্ত ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে। মানুষটা কি কাউকে খুন করে এদিকে আসছে? খুনি কখনো হাতের অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে পালায় না। ব্যাপার কী? লোকটা থমকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। স্ট্রিট-লাইটের আলোয় আমি সেই মুখ দেখলাম। সুন্দর শান্ত মুখ, চোখ দুটিও মায়াকাড়া ও বিষণ্ন। লোকটির চিবুক বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। লোকটা চাপাগলায় বলল, কে? কে?

আমি বললাম, আমার নাম হিমু।

লোকটা কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে রইল। এই কয়েক মুহূর্তে অনেককিছু ঘটে যেতে পারত। সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। অস্ত্র—হাতে খুনি ভয়ংকর জিনিস। যে-অস্ত্র মানুষের রক্ত পান করে সেই অস্ত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। সে বারবার রক্ত পান করতে চায়। তার তৃষ্ণা মেটে না।

লোকটি আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি একই জায়গায় আরও কিছুক্ষণ

৪৭৩

দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আমি খবরের কাগজ পড়ি না—পরদিন সবক’টা কাগজ কিনে খুঁটিয়ে পড়লাম। কোনো হত্যাকাণ্ডের খবর কি কাগজে উঠেছে? ঢাকা নগরীতে নিউ এলিফ্যান্ট রোড এবং কাঁটাবন এলাকার আশেপাশে কাউকে কি জবাই করা হয়েছে? না, তেমনকিছু পাওয়া গেল না। গতরাতে আমি যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই জায়গায় আবার গেলাম। ছোপ-ছোপ রক্ত পড়ে আছে কিনা সেটা দেখার কৌতূহল। রক্ত দেখতে না পাওয়ারই কথা। কাল রাতে অঝোরে বৃষ্টি হয়েছে। যেসব রাস্তায় পানি ওঠার কথা না সেসব রাস্তাতেও হাঁটুপানি।

আমি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম—না, রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই। আমার অনুসন্ধান অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বাঙালির দৃষ্টি বড় কোনো ঘটনায় আকৃষ্ট হয় না, ছোট ছোট ঘটনায় আকৃষ্ট হয়। একজন এসে অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন, ভাইসাহেব, কী খুঁজেন?

‘কিছু খুঁজি না।’

ভদ্রলোক দাড়িয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার অনুসন্ধান দেখতে লাগলেন। তাঁর দেখাদেখি আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেল। এরপর আর রক্তের দাগ খোঁজা অর্থহীন। আমি চলে এলাম। ঐ রাতের ঘটনা ভয় পাবার মতো ঘটনা তো বটেই—আমি ভয় পাইনি। বাবার ট্রেনিং কাজে লেগেছিল। কিন্তু ভয় আমি একবার পেয়েছিলাম। সেই ভয়ে রীতমিতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছিল। ভয়াবহ ধরনের ভয় যা মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। যে-ভয়ের জন্ম এই পৃথিবীতে না, অন্য কোনো ভুবনে। ভয় পাবার সেই গল্পটি আমি বলব।

আমার বাবা আমার জন্যে কিছু উপদেশ লিখে রেখে গেছেন। সেই উপদেশগুলির একটি ভয়-সম্পর্কিত।

‘একজন মানুষ তার একজীবনে অসংখ্যবার তীব্র ভয়ের মুখোমুখি হয়। তুমিও হইবে। ইহাই স্বাভাবিক। ভয়কে পাশ কাটাইয়া যাইবার প্রবণতাও স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমি অবশ্যই তা করিবে না। ভয় পাশ কাটাইবার বিষয় নহে। ভয় অনুসন্ধানের বিষয়। ঠিকমতো এই অনুসন্ধান করিতে পারিলে জগতের অনেক অজানা রহস্য সম্পর্কে অবগত হইবে। তোমার জন্য ইহার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তোমাকে বলিয়া রাখি, এই জগতের রহস্য পেঁয়াজের খোসার মতো। একটি খোসা ছাড়াইয়া দেখিবে আরেকটি খোসা। এমনভাবে চলিতে থাকিবে—সবশেষে দেখিবে কিছুই নাই। আমরা শূন্য হইতে আসিয়াছি, আবার শূন্যে ফিরিয়া যাইব। দুই শূন্যের মধ্যবর্তী স্থানে আমরা বাস করি। ভয় বাস করে দুই শূন্যে। এর বেশি এই মুহূর্তে তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।’

আমার বাবা, মহাপুরুষ তৈরির কারখানার চীফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদিও আমাকে বলেছেন ভয়কে পাশ না-কাটাতে, তবুও আমি ভয়কে পাশ কাটাচ্ছি। সব ভয়কে না—বিশেষ একটা ভয়কে। আচ্ছা, ঘটনাটা বলি।

আমার তারিখ মনে নেই। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হতে পারে। শীত তেমন নেই। আমার গায়ে সুতির একটা চাদর। কানে ঠাণ্ডা লাগছিল বলে চাদরটা মাথার উপর পেঁচিয়ে দিয়েছি। আমি বের হয়েছি পূর্ণিমা দেখতে। শহরের পূর্ণিমার অন্যরকম আবেদন। সোডিয়াম-ল্যাম্পের হলুদ আলোর সঙ্গে মেশে চাঁদের ঠাণ্ডা আলো। এই মিশ্ৰ আলোর আলাদা মজা। তার উপর যদি কুয়াশা হয় তা হলে তো কথাই নেই। কুয়াশায় চাঁদের আলো চারদিকে ছড়ায়। সোডিয়াম-ল্যাম্পের আলো ছড়ায় না। মিশ্র আলোর একটি ছড়িয়ে যাচ্ছে, অন্যটি ছড়াচ্ছে না—খুবই ইন্টারেস্টিং!

সে-রাতে সামান্য কুয়াশাও ছিল। মনের আনন্দেই আমি শহরে ঘুরছি। পূর্ণিমার রাতে লোকজন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা সত্যি। অল্পকিছু মানুষ সারারাত জাগে। তারা ঘুমুতে যায় চাঁদ ডোবার পরে।

ইংরেজিতে এই ধরনের মানুষদের একটা নাম আছে—Moon Struck. এরা চন্দ্রাহত। এদের চলাফেরায় ঘোর-লাগা ভাব থাকে। এরা কথা বলে অন্যরকম স্বরে। এরা কিন্তু ভুলেও চাঁদের দিকে তাকায় না। বলা হয়ে থাকে চন্দ্রাহত মানুষদের চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ে না। এদের যখন আমি দেখি তখন তাদের ছায়ার দিকে আগে তাকাই।

অনেকক্ষণ রাস্তায় হাঁটলাম। একসময় মনে হলো সোডিয়াম-ল্যাম্পের আলো বাদ দিয়ে জোছনা দেখা যাক। কোনো-একটা গলিতে ঢুকে পড়ি। দুটা রিকশা পাশাপাশি যেতে পারে না এমন একটা গলি। খুব ভালো হয় যদি অন্ধগলি হয়। আগে থেকে জানা থাকলে হবে না। হাঁটতে হাঁটতে শেষমাথায় চলে যাবার পর হঠাৎ দেখব পথ নেই। সেখানে সোডিয়াম-ল্যাম্প থাকবে না—শুধুই জোছনা।

ঢুকে পড়লাম একটা গলিতে। ঢাকা শহরের মাঝখানেই এই গলি। গলির নাম বলতে চাচ্ছি না। আমি চাচ্ছি না কৌতূহলী কেউ সেই গলি খুঁজে বের করুক। কিছুদূর এগুতেই কয়েকটা কুকুর চোখে পড়ল। এরা রাস্তার মাঝখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল—আমাকে দেখে সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সব মিলিয়ে চারটা কুকুর। কুকুরদের স্বভাব হচ্ছে সন্দেহজনক কাউকে দেখলে একসঙ্গে ঘেউঘেউ করে ওঠা। ভয় দেখানোর চেষ্টা। এরা তা করল না। এদের একজন সামান্য একটু এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। বাকি তিনজন তার পেছনে। সামনের কুকুরটা কি ওদের দলপতি? লীডারশিপ ব্যাপারটা কুকুরদের আদিগোত্র নেকড়েদের মধ্যে আছে—কুকুরদের নেই। তবে সামনের কুকুরটাকে লীডার বলেই মনে হচ্ছে। আমি ভাব জমাবার জন্য বললাম, তারপর, তোমাদের খবর কী? জোছনা কুকুরদের খুব প্রিয় হয় বলে শুনেছি, তোমাদের এই অবস্থা কেন? মনমরা হয়ে শুয়ে আছ? Is anything wrong?

কুকুরদের শরীর শক্ত হয়ে গেল। এর কেউ লেজ নাড়ছে না। কুকুর প্রচণ্ড রেগে গেলে লেজ নাড়া বন্ধ করে দেয়। লক্ষণ ভালো না।

এদের অনুমতি না নিয়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়া ঠিক হবে না। কাজেই বিনয়ী গলায় বললাম, যেতে পারি?

আমার ভাষা না বুঝলেও গলার স্বরের বিনয়ী অংশ বুঝতে পারার কথা। অধিকাংশ পশুই তা বোঝে।

এরা নড়ল না। অর্থাৎ এরা চায় না আমি আর এগুই। তখন একটা কাণ্ড হলো—আমি স্পষ্টই শুনলাম কেউ-একজন আমাকে বলছে—তুমি চলে যাও। জায়গাটা ভালো না—তুমি চলে যাও। চলে যাও।

অবচেতন মনের কোনো খেলা? কোনো কারণে আমি নিজেই গলিতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি বলে আমার অবচেতন মন আমাকে চলে যেতে বলছে? না, ব্যাপারটা তা না। আমি না-ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলেই গলির ভেতর ঢুকতে চাচ্ছি। আমাকে গলির ভেতরের জোছনা দেখতে হবে। তারচে বড় কথা হচ্চে আমি কোনো দুর্বল মনের মানুষ না যে অবচেতন মন আমাকে নিয়ে খেলবে। আর যদি খেলেও থাকে সেই খেলাকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। ধরে নিলাম অবচেতন মনই আমাকে চলে যেতে বলছে—অবচেতন মনকে শোনানোর জন্যেই স্পষ্ট করে বললাম, আমার এই গলিতে ঢোকা অত্যন্ত জরুরি। কুকুরগুলি একসঙ্গে আমাকে কামড়ে না ধরলে আমি অবশ্যই যাব।

তখন একটা কাণ্ড হলো। সবক’টা কুকুর একসঙ্গে পেছনের দিকে ফিরল। দলপতি কুকুরটা এগিয়ে গিয়ে দলপতির আসন নিল। তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেও সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পরিবর্তনটা কী বোঝার চেষ্টা করছি তখন অস্পষ্টভাবে লাঠির ঠকঠক আওয়াজ কানে এল। লাঠি-হাতে কেউ কি আসছে? গ্রামের মানুষ সাপের ভয়ে লাঠি ঠকঠক করে যেভাবে পথে হাঁটে তেমন করে কেউ-একজন হাঁটছে। পাকা রাস্তায় লাঠির শব্দ। কুকুরদের শ্রবণেন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, তারা কি শব্দের মধ্যে বিশেষ কিছু পাচ্ছে? এদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা দেখা গেল। অস্থিরতা সংক্রামক। আমার মধ্যেও সেই স্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। আর তখনই আমি জিনিসটা দেখলাম। লাঠি ঠকঠক করে একজন ‘মানুষ’ আসছে। তাকে মানুষ বলছি কেন? সে কি সত্যি মানুষ? সে কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়াল। চারটা কুকুর একসঙ্গে ডেকে উঠে থেমে গেল। তারা একটু পিছিয়ে গেল।

আমি দেখলাম রাস্তার ঠিক মাঝখানে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখ, নাক, মুখ, কান কিছুই নেই। ঘাড়ের উপর যা আছে তা একদলা হলুদ মাংসপিণ্ড ছাড়া আরকিছু না। সেই মাংসপিণ্ডটা চোখ ছাড়াও আমাকে দেখতে পেল, সে লাঠিটা আমার দিকে উঁচু করল। আমি দ্বিতীয় যে-ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম তা হচ্ছে চাঁদের আলোয় লাঠিটার ছায়া পড়েছে, কিন্তু ‘মানুষটা’র কোনো ছায়া পড়েনি। ধক করে নাকে পচা মাংসের গন্ধ পেলাম। বিকট সেই গন্ধ। পাকস্থলী উলটে আসার উপক্রম হলো।

আমার মাথার ভেতর আবারও কেউ-একজন কথা বলল, এখনও সময় আছে, দাঁড়িয়ে থেকো না, চলে যাও। এই জিনিসটা যদি তোমার দিকে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তুমি আর পালাতে পারবে না। কুকুরগুলি তোমাকে রক্ষা করছে। আরও কিছুক্ষণ রক্ষা করবে। তুমি দৃষ্টি না ফিরিয়ে নিয়ে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করো। খবর্দার, এক পলকের জন্যেও দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবে না। এবং মনে রেখো আর কখনো এই গলিতে ঢুকবে না। কখনো না। এই গলি তোমার জন্যে নিষিদ্ধ।

আমি আস্তে আস্তে পেছনদিকে হাঁটছি—কুকুরগুলিও আমার হাঁটার তালে তাল মিলিয়ে পেছন দিকে যাচ্ছে।

জিনিসটার কোনো চোখ নেই। চোখ থাকলে বলতাম—জিনিসটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য, চোখ ছাড়াও তা হলে দেখা যায়!

মাথার ভেতর আবারও কেউ-একজন কথা বলল, তুমি জিনিসটার সীমার বাইরে চলে এসেছ। জিনিসটার ক্ষমতা প্রচণ্ড। কিন্তু তার ক্ষমতার সীমা খুব ছোট। এই গলির বাইরে আসার তার ক্ষমতা নেই। তুমি এখন চলে যেতে পার।

আমি চলে গেলাম না। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তার লাঠি নামিয়ে ফেলেছে। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। তার গায়ে কাঁথার মতো একটা মোটা কাপড়। এই কাপড়টাই শরীরে জড়ানো। সে হাঁটছে হেলেদুলে। একবার মনে হচ্ছে বামে হেলে পড়ে যাবে, আবার মনে হচ্ছে ডানে হেলে পড়ে যাবে। জিনিসটাকে এখন আগের চেয়ে অনেক লম্বা দেখাচ্ছে। যতই সে দূরে যাচ্ছে ততই লম্বা হচ্ছে। জিনিসটা আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কুকুরগুলি ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। ওদের দলপতি শুধু একবার আমার দিক তাকিয়ে ঘেউঘেউ করল। মনে হয় কুকুরের ভাষায় বলল, যাও, বাসায় চলে যাও।

ডিসেম্বর মাসের শীতেও আমার শরীর ঘামছে। হাঁটার সময় লক্ষ্য করলাম ঠিকমতো পা ফেলতে পারছি না। রাস্তা কেমন উঁচুনিচু লাগছে। নতুন নতুন চশমা পরলে যা হয় তা-ই হচ্ছে। বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাচের জগভরতি একজগ ঠাণ্ডা পানি এক চুমুকে খেতে পারলে হতো। কার কাছে পানি চাইব? কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো আমার দিক-ভুল হচ্ছে। আমি কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। কোনদিকে যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছি না। রিকশা চোখে পড়ছে না যে কোনো-একটা রিকশায় উঠে বসব। হোঁসহোঁস করে কিছু গাড়ি চলে যাচ্ছে। হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকলে এরা কেউ কি থামাবে? না, কেউ থামাবে না। ঢাকার গাড়ি-যাত্রীরা পথচারীর জন্যে গাড়ি থামায় না। নিয়ম নেই। আমি ফুটপাতেই বসে পড়লাম। আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে বমি চেপে রেখেছিলাম। বসামাত্রই হড়হড় করে বমি হয়ে গেল।

‘আফনের কী হইছে?’

মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ফুটপাতে বস্তা মুড়ি দিয়ে যারা ঘুমায় তাদের একজন। বস্তার ভেতর থেকে মাথা বের করেছে। তার গলায় মমতার চেয়ে বিরক্তি বেশি।

আমি বললাম, শরীর ভালো না।

‘মিরগি ব্যারাম আছে?’

‘না। পানি খাওয়া যাবে? পানি খাওয়া দরকার।

‘রাইতে পানি কই পাইবেন?’

‘রাতে পানির পিপাসা পেলে আপনারা পানি কোথায় পান?’

লোকটা বস্তার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিল। আমার উদ্ভট প্রশ্নে সে হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। প্রশ্নটা তেমন উদ্ভট ছিল না। এই যে অসংখ্য মানুষ ফুটপাতে ঘুমায়, রাতে পানির তৃষ্ণা পেলে তারা পানি পায় কোথায়?

ক’টা বাজছে জানা দরকার। রাত শেষ হয়ে গেলে রিকশা, বেবিট্যাক্সি চলা শুরু করবে—তখন আমার একটা গতি হলেও হতে পারে। বিটের পুলিশও দেখছি না। পূর্ণিমরাতে বোধহয় বিটের পুলিশ বের হয় না।

আমি বস্তা মুড়ি-দেয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, ভাইসাহেব! এই যে ভাইসাহেব! এই যে বস্তা-ভাইয়া!

একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। বমি হয়ে যাওয়ায় শরীরটা একটু ভালো লাগছে, তবে ভয়টা মাথার ভেতরে ঢুকে আছে। কারও সঙ্গে কথাটথা বলতে থাকলে হয়তো-বা তাকে ভুলে থাকা যাবে। আমি গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, এই যে বস্তা-ভাই, ঘুমিয়ে পড়লেন?

লোকটা বিরক্তমুখে বস্তার ভেতর থেকে মুখ বের করল।

‘কী হইছে?’

‘এটা কোন জায়গা? জায়গাটার নাম কী?’

‘চিনেন না?’

‘জি না।’

‘বুঝছি, মাল খাইয়া আইছেন। আরেক দফা গলাত আঙ্গুল দিয়া বমি করেন—শইল ঠিক হইব। আরেকটা কথা কই ভাইজান, আমারে ত্যক্ত করবেন না।’

‘রাত কত হয়েছে বলতে পারেন?’

‘জ্বে না, পারি না।’

লোকটা আবার বস্তার ভেতর ঢুকে গেল। লোকটার পাশে খালি জায়গায় শুয়ে পড়ব? গায়ে চাদর আছে। চাঁদরের ভেতর ঢুকে পড়ে বাকি রাতটা পার করে দেয়া যায়। রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে অনেক রাত কাটিয়েছি। গাছের তলায় ঘুমিয়েছি। ফুটপাতে ঘুমানো হয়নি।

বস্তা-ভাইয়ের পাশে শুয়ে পড়ার আগে কি তার অনুমতি নেয়ার দরকার আছে? ফুটপাতে যারা ঘুমোয় তাদের নিয়মকানুন কী? তাদেরও নিশ্চয়ই অলিখিত কিছু নিয়মকানুন আছে? ফুটপাতে অনেক পরিবার রাত কাটায়—স্বামী-স্ত্রী ছেলেমেয়ের সোনার সংসার। সেইরকম কোনো পরিবারের পাশে নিশ্চয়ই উঠকো ধরনের কেউ মাথার নিচে ইট বিছিয়ে শুয়ে পড়তে পারে না?

‘বস্তা-ভাই। এই যে বস্তা-ভাই!’

‘আবার কী হইছে?’

‘আপনার পাশের ফাঁকা জায়গাটায় কি শুয়ে পড়তে পারি? যদি অনুমতি দেন।’

বস্তা-ভাই জবাব দিলেন না, তবে সরে গিয়ে খানিকটা জায়গা করলেন। এই প্রথম লক্ষ করলাম-বস্তা-ভাই একা ঘুমাচ্ছেন না, তাঁর সঙ্গে তাঁর পুত্রও আছে। তিনি পুত্রকেও নিজের দিকে টানলেন এবং কঠিন গলায় বললেন, বস্তা-ভাই বস্তা-ভাই করতেছেন কেন? ইয়ারকি মারেন? গরিবরে লইয়া ইয়ারকি করতে মজা লাগে?

‘না রে ভাই, ইয়াকি করছি না। গরিব নিয়ে ইয়ারকি করব কী, আমিও আপনাদের দলে। মুখভরতি বমি। মুখ না ধুয়ে ঘুমুতে পারব না। পানি কোথায় পাব বলে দিন। একটু দয়া করুন।’

বস্তা-ভাই দয়া করলেন। আঙুল উঁচিয়ে কী যেন দেখালেন। আমি এগিয়ে গেলাম। সম্ভবত কোনো চায়ের দোকান। দোকানের পেছনে জালাভরতি পানি। মিনারেল ওয়াটারের একটা খালি বোতলও আছে। আমি পানি দিয়ে মুখ ধুলাম। দুই বোতলের মতো পানি খেয়ে ফেললাম। এক বোতল পানি ঢেলে দিলাম গায়ে। ভয়-নামক যে—ব্যাপারটা শরীরে জড়িয়ে আছে—পানিতে তা ধুয়ে ফেলার একটা চেষ্টা। তারপর শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। আমি তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। কোনো এক পর্যায়ে কেউ-একজন সাবধানে আমার গায়ের চাদর তুলে নিয়ে চলে গেল। তাতেও আমার ঘুম ভাঙল না। সারারাত আমার গায়ে চাঁদের আলোর সঙ্গে পড়ল ঘন হিম। যখন ঘুম ভাঙল তখন আমার গায়ে আকাশ-পাতাল জ্বর। নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছি না। দিনের আলোয় রাতের ভয়টা থাকার কথা না, কিন্তু লক্ষ্য করলাম ভয়টা আছে। গুটিসুটি মেরে ছোট হয়ে আছে। তবে সে ছোট হয়ে থাকবে না। যেহেতু সে একটা আশ্রয় পেয়েছে সে বাড়তে থাকবে।

জ্বরে আমার শরীর কাঁপছে। চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার। সবচে ভালো বুদ্ধি হাসপাতালে ভরতি হয়ে যাওয়া। হাসপাতালে ভরতির নিয়মকানুন কী? দরখাস্ত করতে হয়? নাকি রোগীকে উপস্থিত হয়ে বলতে হয়—আমি হাসপাতালে ভরতি হবার জন্যে এসেছি? আমার রোগ গুরুতর। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখুন। চিকিৎসার চেয়ে আমার যেটা বেশি দরকার তা হচ্ছে সেবা। ঘরে সেবা করার কেউ নেই। হাসপাতালের নার্সরা নিশ্চয়ই সেবাও করবেন। গভীর রাতে চার্জ-লাইট হাতে নিয়ে বিছানায় বিছানায় যাবেন, রোগের প্রকোপ কেমন দেখবেন। স্যার, দয়া করে আমকে ভরতি করিয়ে নিন!

হাসপাতালে ভরতি হওয়া যতটা জটিল হবে ভেবেছিলাম দেখা গেল ব্যাপারটা মোটেই তত জটিল না। একজনকে দেখলাম দুটাকা করে কী-একটা টিকিট বিক্রি করছে। খুব কঠিন ধরনের চেহারা। সবাইকে ধমকাচ্ছে। তাকে বললাম, ভাই আমার এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভরতি হওয়া দরকার। কী করতে হবে একটু দয়া করে বলে দিন।

সে বিস্মিত হয়ে বলল, হাসপাতালে ভরতি হবেন?

‘জি।’

‘নিয়ে এসেছে কে আপনাকে?’

‘কেউ নিয়ে আসেনি। আমি নিজে নিজেই চলে এসেছি। আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে যাব।’

‘আপনার হয়েছে কী?’

‘ভূত দেখে ভয় পেয়েছি। ভয় থেকে জ্বর এসে গেছে।’

‘ভূত দেখেছেন?’

‘জি স্যার।’

‘আমার কাছে এসেছেন কেন? আমি তো আউটডোর পেশেন্ট রেজিস্ট্রেশন স্লিপ দিই।’

‘কার কাছে যাব তা তো স্যার জানি না।’

‘আচ্ছা, আপনি বসুন ঐ টুলটায়।’

‘টুলে বসতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে যাব। আমি বরং মাটিতে বসি।’

‘আচ্ছা বসুন।’

‘থ্যাংক য়্যু স্যার।’

‘আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। যাঁদের স্যার বললে কাজ হবে তাঁদের বলবেন।’

‘আপনাকে বলাতেও কাজ হয়েছে। আপনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।’

‘আমি ব্যবস্থা করব কী? আমি দুই পয়সার কেরানি। আমার কি সেই ক্ষমতা আছে? যাঁরা ব্যবস্থা করতে পারবেন তাঁদের কাছে নিয়ে যাব—এইটুকু।’

‘স্যার, এইটুকুই-বা কে করে!’

এই লোক আমাকে একজন তরুণী-ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। খুবই ধারালো চেহারা। কথাবার্তাও ধারালো। আমি এই তরুণীর কঠিন জেরার ভেতর পড়ে গেলাম।

‘আপনার নাম কী?’

‘ম্যাডাম, আমার নাম হিমু।’

‘আপনার ব্যাপার কী?’

‘ম্যাডাম, আমি খুবই অসুস্থ। আমার এক্ষুনি হাসপাতালে ভরতি হওয়া দরকার। ভূত দেখে ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

‘আপনি অসুস্থ। আপনার চিকিৎসা হওয়া দরকার—আপনি হাসপাতলে ভরতি হতে চান—খুব ভালো কথা। দরিদ্র দেশের সীমিত সুযোগ-সুবিধার ভেতর যতটুকু করা যায়—আপনার জন্যে ততটুকু করা হবে। হাসপাতালে সিট নেই। আপনার কি ধারণা হোটেলের মতো আমরা বিছানা সাজিয়ে বসে আছি! আপনাদের জ্বর হবে, সর্দি হবে—আপনারা এসে বিছানায় শুয়ে পড়বেন—নার্সকে ডেকে বলবেন, কোলবালিশ দিয়ে যাও। এই আপনার ধারণা?’

‘জি না ম্যাডাম।’

‘আপনি কি ভেবেছেন উদ্ভট একটা গল্প বললেই আমরা আপনাকে ভরতি করিয়ে নেব? ভূত দেখে জ্বর এসে গেছে? রসিকতা করার জায়গা পান না!’

‘ম্যাডাম, সত্যি দেখেছি। আপনি চাইলে আমি পুরো ঘটনা বলতে পারি।’

‘আমি আপনার ঘটনা শুনতে চাচ্ছি না।’

‘ম্যাডাম, আপনি কি ভুত বিশ্বাস করেন না?’

‘আপনি দয়া করে কথা বাড়াবেন না।’

‘শেকসপীয়ারের মতো মানুষও কিন্তু ভূত বিশ্বাস করতেন। তিনি হ্যামলেটে বলেছেন—There are many things in heaven and earth. আমার ধারণা তিনি ভূত দেখেছেন। এদিকে আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন—’

‘স্টপ ইট!’

আমি ‘স্টপ’ করলাম।

তরুণী-ডাক্তার আমাকে যে-লোকটি নিয়ে এসেছিল (নাম রশিদ) তার দিকে কঠিন চোখে তাকালেন। রশিদ বেচারা জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো মিইয়ে গেল।

‘রশিদ!’

‘জি আপা?’

‘একে এখান থেকে নিয়ে যাও। ফালতু ঝামেলা আমার কাছে আর কখনো আনবে না।’

আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। জ্ঞান যখন ফিরল তখন দেখি আমি হাসপাতালের একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তরুণী-ডাক্তার আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছেন। চোখ মেলতেই তিনি বললেন, হিমু সাহেব, এখন কেমন বোধ করছেন?

‘ভালো।’

এইটুকু বলে আমি দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারালাম, কিংবা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

.

হাসপাতালের তৃতীয় দিনে আমাকে দেখতে এলেন বড় ফুপা—বাদলের বাবা। তাঁর হাতে এক প্যাকেট আঙুর। একটা সময় ছিল যখন মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখতে যাবার সময় আঙুর নিয়ে যাওয়া হতো। ফলের দোকানি আঙুর বিক্রির সময় মমতামাখা গলায় বলত—রুগির অবস্থা সিরিয়াস?

এখন আঙুর একশো টাকা কেজি—বরই বরং এই তুলনায় দামি ফল।

বড় ফুপা আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, অবস্থা কী?

আমি জবাব দিলাম না। কেউ রোগী দেখতে এসে যদি দেখে রোগী দিব্যি সুস্থ, পা নাচাতে নাচাতে হিন্দি গান গাইছে—তখন সে শকের মতো পায়। যদি দেখে রোগীর অবস্থা এখন-তখন, শ্বাস যায় যায় অবস্থা, তখন মনে শান্তি পায়—যাক, কষ্ট করে আসাটা বৃথা যায়নি। কাজেই ফুপার প্রশ্নে আমি চোখমুখ করুণ করে ফেললাম, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এরকম একটা ভাবও করলাম।

‘জবাব দিচ্ছিস না কেন? অবস্থা কী?’

আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, ভালো। এখন একটু ভালো।

তোকে খুঁজে বের করতে খুবই যন্ত্রণা হয়েছে, কোন ওয়ার্ড, বেড নাম্বার কী কেউ জানে না।

‘ও আচ্ছা।’

‘একবার তো ভেবেছি ফিরেই চলে যাই। নেহায়েত আঙুর কিনেছি বলে যাইনি। আঙুর খেতে নিষেধ নেই তো?’

‘জি না।’

‘নে, আঙুর খা।’

আমি টপাটপ আঙুর মুখে ফেলছি আর ভাবছি—ব্যাপারটা কী? আমি যে হাসপাতালে, এই খোঁজ ফুপা পেলেন কোথায়? কাউকেই তো জানানো হয়নি। আমি বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না যে খবরের কাগজে নিউজ চলে গেছে—

হিমুর সর্দিজ্বর

জনদরদি দেশনেতা প্রাণপ্রিয় হিমু সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় তাঁকে দেখতে যান। কিছুক্ষণ তাঁর শয্যাপার্শ্বে থেকে তাঁর আশু আরোগ্য কামনা করেন। মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বনমন্ত্রী, তেল ও জ্বালানি মন্ত্ৰী, ত্ৰাণ উপমন্ত্রী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন—হিমু সাহেবের শারীরিক অবস্থা এখন ভালো। হিমু সাহেবের ভক্তবৃন্দের চাপে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন তাঁরা যেন হিমু সাহেবকে বিরক্ত না করেন। হিমু সাহেবের দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম। তাঁর শরীরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বুলেটিন প্রতিদিন দুপুর বারোটায় প্রকাশ করা হবে।

আমি যে হাসপাতালে এই খবর তো আমার কাঁধের দুই ফেরেশতা ছাড়া আর কারোরই জানার কথা না! ধরা যাক খবরটা সবাই জানে, তার পরেও ফুপা হাসপাতালে চলে আসবেন এটা হয় না। এত মমতা আমার জন্যে বাদল ছাড়া আর কারোরই নেই। অন্যকোনো ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা কী?

‘ফুপা, আমি যে হাসপাতালে এটা জানলেন কীভাবে? পেপারে নিউজ হয়েছে?’

‘পেপারে নিউজ হবে কেন? তুই কে? হাসপাতাল থেকে আমাকে টেলিফোন করেছে।’

‘আপনার নাম্বার ওরা পেল কোথায়?’

‘তুই দিয়েছিস।’

আমার মনে পড়ল কোনো একসময় হাসপাতালে ভরতির ফরম তরুণী-ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন। তিনি নিজেই ফিলআপ করেছেন এবং আগ বাড়ায়ে অসুখের খবর দিয়েছেন।

‘খুব মিষ্টি গলার একজন মেয়ে-ডাক্তার আপনাকে খবর দিয়েছে, তা-ই না?’

‘হুঁ। তোর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিল।’

‘কী জানতে চাচ্ছিল?’

‘তুই কী করিস না-করিস এইসব। তোর হলুদ পাঞ্জাবি, উদ্ভট কথাবার্তা শুনে ভড়কে গেছে আর কি। তুই আরকিছু পারিস বা না-পারিস মানুষকে ভড়কাতে পারিস।’

‘ডাক্তাররা এত সহজে ভড়কায় না। তারপর বলুন ফুপা, আমার কাছে কেন এসেছেন।’

‘তোকে দেখতে এসেছি আর কি।’

‘আমাকে দেখতে হাসপাতালে চলে আসবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য না। ঘটনা কী?’

‘বাদলের ব্যাপারে তোর সঙ্গে একটু কথা ছিল।’

ফুপা ইতস্তত করে বললেন।

আমি শান্ত গলায় বললাম, বাদলকে নিয়ে তো আপনার এখন দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সে কানাডায় আমার প্রভাববলয় থেকে অনেক দূরে। আমার হাত থেকে তাকে রক্ষা করার কোনো দায়িত্বও আপনাকে পালন করতে হচ্ছে না। নাকি সে কানাডাতেও খালিপায়ে হাঁটা শুরু করেছে?

ফুপা চাপাগলায় বললেন, বাদল এখন ঢাকায়।

‘ও আচ্ছা।’

‘মাসখানিক থাকবে। তোর কাছে আমার অনুরোধ, এই এক মাস তুই গা-ঢাকা দিয়ে থাকবি। ওর সঙ্গে দেখা করবি না।’

‘গা-ঢাকা দিয়েই তো আছি। হাসপাতালে লুকিয়ে আছি।’

‘হাসপাতালে তো আর এক মাস থাকবি না, তোকে নাকি আজকালের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।’

‘আমাকে বাদলের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকতে হবে, তা-ই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘নো প্রবলেম।

‘শোন হিমু, আমরা চাচ্ছি ওর একটা বিয়ে দিতে। মোটামুটি নিমরাজি করিয়ে ফেলেছি। এখন তুই যদি ভুজংভাজং দিস তা হলে তো আর বিয়ে হবে না। সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে হাঁটা দেবে।’

‘আমি কেন ভুজংভাজং দেব?’

‘তোকে দিতে হবে না। তোকে দেখলেই ওর মধ্যে আপনা-আপনি ভুজংভাজং হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে তাকে নরম্যাল করেছি, সব জলে যাবে।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকুন।’

‘কথা দিচ্ছিস?’

‘হুঁ।’

‘বাদল এয়ারপোর্টে নেমেই বলেছে—হিমুদা কোথায়? আমি মিথ্যা করে বলেছি, সে কোথায় কেউ জানে না।’

‘ভালো বলেছেন।’

‘মেসের ঠিকানা চাচ্ছিল—তোর আগের মেসের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি।’

‘খুবই ভালো করেছেন, আগের ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে ঠক খাবে।’

‘খোঁজ নিতে এর মধ্যেই গিয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে কী যে দুশ্চিন্তায় আছি! বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। চিন্তাভাবনা যা করার বৌমা করবে।’

‘বিয়ে ঠিকঠাক করে ফেলেছেন?’

‘কয়েকটা মেয়ে দেখা হয়েছে—এর মধ্যে একটাকে তোর ফুপুর পছন্দ হয়েছে। মেয়ের নাম হলো—চোখ।’

‘মেয়ের নাম চোখ।’

‘হ্যাঁ, চোখ। আজকাল কি নামের কোনো ঠিকঠিকানা আছে! যার যা ইচ্ছা নর্মি রাখছে।’

‘চোখ নাম হবে কীভাবে! আঁখি না তো?’

‘ও হ্যাঁ, আঁখি। সুন্দর মেয়ে—ফড়ফড়ানি-টাইপ। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তিনটা কথা বলে। বাদলের সঙ্গে মানাবে। একজন কথা বলে যাবে, একজন শুনে যাবে।’

‘মেয়ে আপনার পছন্দ না?’

‘তোর ফুপুর পছন্দ। পুরুষমানুষের কি সংসারে কোনো say থাকে? থাকে না। পুরুষরা পেপার-হেড হিসেবে অবস্থান করে। নামে কর্তা, আসলে ভর্তা। তুই বিয়ে না করে খুব ভালো আছিস। দিব্যি শরীরে বাতাস লাগেিয় ঘুরছিস। তোকে দেখে হিংসা হয়। স্বাধীনতা কী জিনিস, তার কী মর্ম—সেটা বোঝে শুধু বিবাহিত পুরুষরাই। উঠিরে হিমু।’

‘আচ্ছা।’

‘বাদলের প্রসঙ্গে যা বলেছি মনে থাকে যেন।’

‘মনে থাকবে।’

‘ও আচ্ছা। তোর অসুখের ব্যাপারটাই তো কিছু জানলাম না! কী অসুখ?’

‘ঠাণ্ডা লেগেছে।’

‘ঠাণ্ডা লাগল কীভাবে?’

‘ফুটপাতে চাদর-গায়ে শুয়েছিলাম। চোর চাদর নিয়ে গেল।’

‘ফুটপাতে ঘুমুচ্ছিলি?’

‘জি।’

‘ঘরে ঘুমুতে আর ভালো লাগে না?’

‘তা না—’

‘শোন হিমু, বাদলের কাছ থেকে দূরে থাকবি। মনে থাকে যেন।’

‘মনে থাকবে।’

টাকাপয়সা কিছু লাগবে? লাগলে বল, লজ্জা করিস না। ধর পাঁচশো টাকা রেখে দে। অষুধপত্র কেনার ব্যাপার থাকতে পারে।’

আমি নোটটা রাখলাম। ফুপা চিন্তিত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলেন। ছেলে আমার ফাঁদে পড়ে যদি আবার ফুটপাতে শয্যা পাতে! কিছুই বলা যায় না।

হাসপাতাল আমার বেশ পছন্দ হলো। হাসপাতালের মানুষগুলির ভেতর একটা মিল আছে। সবাই রোগী। রোগযন্ত্রণায় কাতর। ব্যাধি সব মানুষকে এক করে দিয়েছে। একজন সুস্থ মানুষ অপরিচিত একজন সুস্থ মানুষের জন্যে কোনো সহমর্মিতা বোধ করবে না, কিন্তু একজন অসুস্থ মানুষ অন্য একজন অসুস্থ মানুষের জন্যে করবে।

হাসপাতালে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে না। সকালে নাশতা আসছে। দুবেলা খাবার আসছে। দুনম্বরি ব্যবস্থাও আছে। জায়গামতো টাকা খাওয়ালে স্পেশাল ডায়েটের ব্যবস্থা হয়। ডাক্তারদের অনেক সংস্থাটংস্থা আছে। করুণ গলায় তরুণ ডাক্তারদের কাছে অভাবের কথা বলতে পারলে ফ্রি অষুধ তো পাওয়া যায়ই, পথ্য কেনার টাকাও পাওয়া যায়।

রোগ সেরে গেছে, তার পরেও কিছুদিন হাসপাতালে থেকে শরীর সারাবার ব্যবস্থাও আছে। খাতাপত্রে নাম থাকবে না—কিন্তু বেড থাকবে। এক-একদিন এক-এক ওয়ার্ডে গিয়ে ঘুমুতে হবে।

ছেলেমেয়ে নিয়ে গত সাত মাস ধরে হাসপাতালে বাস করছে এমন একজনের সন্ধানও পাওয়া গেল। নাম ইসমাইল মিয়া। স্ত্রীর ক্যানসার হয়েছিল, তাকে হাসপাতালে ভরতি করিয়ে মাসখানিক চিকিৎসা করাল। সেই থেকে ইসমাইল মিয়ার হাসপাতালের সঙ্গে পরিচয়। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার নিয়ে সে হাসপাতালে পার হয়ে গেল। স্ত্রী মরে গেছে। তাতে অসুবিধা হয়নি। বাচ্চারা হাসপাতালের বারান্দায় খেলে। এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ঘোরে। কেউ কিছু বলে না। ইসমাইল মিয়া দিনে বাইরে কাজকর্ম করে (মনে হয় দুনম্বরি কাজ—চুরি, ফটকাবাজি)। রাতে হাসপাতালে এসে ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করে। ঘুমানোর একটা ব্যবস্থা করে।

ইসমাইল মিয়ার সঙ্গে পরিচয় হলো। অতি ভদ্র। অতি বিনয়ী। হাসিমুখ ছাড়া কথা বলে না। তার মধ্যে দার্শনিক ব্যাপারও আছে। আমি বললাম, হাসপাতালে আর কতদিন থাকবে?

ইসমাইল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ক্যামনে বলি ভাইজান? আমার হাতে তো কিছু নাই।

‘তোমার হাতে নেই কেন?’

‘সব তো ভাইজান আল্লাহ্পাকের নির্ধারণ। আল্লাহ্পাক নির্ধারণ করে রেখেছে আমি বালবাচ্চা নিয়া হাসপাতালে থাকব—এইজন্যে আছি। যেদিন নির্ধারণ করবেন আর দরকার নাই—সেইদিন বিদায়।’

‘আল্লাহ্পাকের হুকুম ছাড়া তো ভাইজান কিছুই হওনের উপায় নাই।’

‘তাও ঠিক।’

‘সামান্য যে পিপীলিকা—আল্লাহ্পাক তারও খবর রাখেন। আপনার পায়ের তলায় পইরা দুইটা পিপীলিকার মৃত্যু হবে তাও আল্লাহ্পাকের বিধান। আজরাইল আলাইহেস সালাম আল্লাহ্পাকের নির্দেশে দুই পিপীলিকার জান কবজ করবে।’

‘ও আচ্ছা।’

‘এইজন্যেই ভাইজান কোনোকিছু নিয়া চিন্তা করি না। যার চিন্তা করার কথা সে-ই চিন্তা করতেছে। আমি চিন্তা কইরা কী করব।’

‘কার চিন্তা করার কথা?’

‘কার আবার, আল্লাহ্পাকের!

ইসমাইল মিয়া খুবই আল্লাহ্ভক্ত। সমস্যা হচ্ছে তার প্রধান কাজ—চুরি। চুরির পক্ষেও সে ভালো যুক্তি দাঁড় করিয়েছে—

‘চুরিতে আসলে কোনো দোষ নাই ভাইজান। ভালুক কী করে? পেটে খিদা লাগলে মৌমাছির মৌচাক থাইক্যা মধু চুরি করে। এর জন্যে ভালুকের দোষ হয় না। এখন বলেন মানুষের দোষ হইব ক্যান।’

বগার মা নামের এক বৃদ্ধার সঙ্গেও পরিচয় হলো। তিনি ঝাড়ফুঁক করেন। ঝাটার কাঠি নিয়ে রোগীদের ঝাড়েন। তাতে নাকি অতি দ্রুত রোগ আরোগ্য হয়। হাসপাতালে সর্বাধুনিক চিকিৎসার সাথে সাথে চলে ঝাড়ফুঁক

এই বৃদ্ধা দশ টাকার বিনিময়ে আমাকেও একদিন ঝেড়ে গেলেন। আমি দশ টাকার বাইরে আরও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ঝাড়ার মন্ত্র খাকিটা শিখে নিলাম।

“ও কালী সাধনা
বিষ্ট কালী মাতা।
উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিম
রও নাও—ঈশানে যাও।
…”

বগার মা’র সঙ্গে অনেক গল্পগুজবও করলাম। জানা গেল বগা বলে তাঁর কোনো ছেলে বা মেয়ে নেই। তাঁর তিনবার বিয়ে হয়েছিল। কোনো ঘরেই কোনো সন্তান হয়নি। কী করে তাঁর নাম বগার মা হয়ে গেল তিনি নিজেও জানেন না।

আমি বললাম, মা, ঝাড়ফুঁকে রোগ সারে?

বগার মা অতি চমৎকৃত হয়ে বললেন, কী কও বাবা! ঠিকমতো ঝাড়তে পারলে ক্যানসার সারে।

‘আপনি সারিয়েছেন?’

‘অবশ্যই—ত্রিশ বছর ধইরা ঝাড়তেছি। ত্রিশ বচ্ছরে ক্যানসার ম্যানসার কতকিছু ভালো কইরেছি। একটা কচকা ঝাড়া দশটা ‘পেনিসিলি’ ইনজেকশনের সমান। বাপধন, তোমারে যে ঝাড়া দিলাম এই ঝাড়ায় দেখবা আইজ দিনে-দিনে সিধা হইয়া দাঁড়াইবা।’

হাসপাতালে আমি অনেক কিছুই শিখলাম। হাসপাতালের ব্যাপারটা সম্ভবত আমার বাবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। নয়তো তিনি অবশ্যই তাঁর পুত্রকে কিছুদিন হাসপাতালে রেখে দিতেন। এবং তাঁর বিখ্যাত উপদেশমালার সঙ্গে আরও একটি উপদেশ যুক্ত হতো—

‘প্রতি দুই বৎসর অন্তর হাসপাতালে সাতদিন থাকিবার ব্যবস্থা করিবে। মানুষের জরা-ব্যাধি ও শোক তাহাদের পার্শ্বে থাকিয়া অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিবে। ব্যাধি কী, জীবজগৎকে ব্যাধি কেন বারবার আক্রমণ করে তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিবে। তবে মনে রাখিও, ব্যাধিকে ঘৃণা করিবে না। ব্যাধি জীবনেরই অংশ। জীবন আছে বলিয়াই ব্যাধি আছে।’

‘কেমন আছেন হিমু সাহেব?’

‘জি ম্যাডাম, ভালো আছি।’

‘আপনার বুকে কনজেশন এখনও আছে। অ্যান্টিবায়োটিক যা দেয়া হয়েছে—কনটিনিউ করবেন। সেরে যাবে।’

‘থাংক য়্যু ম্যাডাম।’

‘আপনাকে রিলিজ করে দেয়া হয়েছে, আপনি চলে যেতে পারেন।’

‘থ্যাংক য্যু ম্যাডাম।’

‘প্রতিটি বাক্যে একবার করে ম্যাডাম বলছেন কেন? ম্যাডাম শব্দটা আমার পছন্দ না। আর বলবেন না।’

‘জি আচ্ছা, বলব না।’

‘আপনার হাতে কি সময় আছে? সময় থাকলে আমার চেম্বারে আসুন। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।’

‘জি আচ্ছা।’

আমি তরুণী-ডাক্তারের পেছনে পেছনে যাচ্ছি। তাঁর নাম ফারজানা। সুন্দর মানুষকেও সবসময় সুন্দর লাগে না। কখনো খুব সুন্দর লাগে, কখনো মোটামুটি লাগে। এই তরুণীকে আমি যতবার দেখেছি ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। অ্যাপ্রন ফেলে দিয়ে ফারজানা যদি ঝলমলে একটা শাড়ি পরত তা হলে কী হতো? ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কপালে টিপ। হালকা নীল একটা শাড়ি—কানে ঝুলবে নীল পাথরের ছোট্ট দুল। এই মেয়ে কি বিয়েবাড়িতে সেজেগুজে যায় না? তখন চারদিকে অবস্থাটা কী হয়? বিয়ের কনে নিশ্চয়ই মন-খারাপ করে ভাবে—এই মেয়েটা কেন এসেছে। আজকের দিনে আমাকে সবচে সুন্দর দেখানোর কথা। এই মেয়েটা সেই জায়গা নিয়ে নিয়েছে। এটা সে পারে না।

‘হিমু সাহেব!’

‘জি?’

‘বসুন।’

আমি বসলাম। আমার সামনে পিরিচে ঢাকা একটা চায়ের কাপ। ফারজানার সামনেও তা-ই। চা তৈরি করে সে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি তার ভেতরে সামান্য হলেও কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পেরেছি।

‘হিমু সাহেব!’

‘জি?’

‘আপনি কি সিগারেট খান?’

‘কেউ দিলে খাই।’

‘নিন, সিগারেট নিন। ডাক্তাররা সব রোগীকে প্রথম যে-উপদেশ দেয় তা হচ্ছে—সিগারেট ছাড়ুন। সেখানে আমি আপনাকে সিগারেট দিচ্ছি—কারণ কী বলুন তো?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘কারণ, আমি নিজে একটা সিগারেট খাব। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সিগারেট ধরেছিলাম। ছেলেরা সিগারেট খাবে, আমরা মেয়েরা কেন খাব না? এখন এমন অভ্যাস হয়েছে এর থেকে বেরুতে পারছি না। চেষ্টাও অবিশ্যি করছি না।’

ফারজানা সিগারেট ধরাল। আশ্চর্য—সিগারেটটাও তার ঠোঁটে মানিয়ে গেল! পাতলা ঠোটের কাছে জ্বলন্ত আগুন। বাহ্, কী সুন্দর! সুন্দরী তরুণীদের ঘিরে যা থাকে সবই কি সুন্দর হয়ে যায়!

‘হিমু সাহেব!’

‘জি?’

‘এখন গল্প করুন। আপনার গল্প শুনি।’

‘কী গল্প শুনতে চান?’

‘আপনি অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছিলেন। ভয় পেয়ে অসুখ বাধিয়েছেন। সেই অস্বাভাবকি দৃশ্যটা কী আমি জানতে চাচ্ছি।’

‘কেন জানতে চাচ্ছেন?’

‘জানতে চাচ্ছি—কারণ এই পৃথিবীতে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটে না। পৃথিবী চলে তার স্বাভাবিক নিয়মে। মানুষ সেইসব নিয়ম একে একে জানতে শুরু করেছে—এই সময় আপনি যদি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখতে শুরু করেন তা হলে তো সমস্যা!’

‘মানুষ কি সবকিছু জেনে ফেলেছে?’

ফারজানা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, সবকিছু না জানলেও অনেককিছুই জেনেছে। ইউনিভার্স কীভাবে সৃষ্টি হলো তাও জেনে গেছে।

আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসিমুখে বললাম, ইউনিভার্স কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে?

‘বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু। আদিতে ছিল প্রিমরডিয়েল অ্যাটম যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কিছুই নেই। সেই অ্যাটম বিগ ব্যাং-এ ভেঙে গেল—তৈরি হলো স্পেস এবং টাইম। সেই স্পেস ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এক্সপানডিং ইউনিভার্সে।’

‘সময়ের শুরু তা হলে বিগ ব্যাং থেকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বিগ ব্যাং-এর আগে সময় ছিল না?’

‘না।’

‘বিগ ব্যাং-এর আগে তা হলে কী ছিল?’

‘সেটা মানুষ কখনো জানতে পারবে না। মানুষের সমস্ত বিদ্যা এবং জ্ঞানের শুরুও বিগ ব্যাং-এর পর থেকেই।’

‘তা হলে তো বলা যেতে পারে—জ্ঞানের একটা বড় অংশই মানুষের আড়ালে রেখে দেয়া হয়েছে।’

‘আপনি কি আমার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছেন?’

‘না, সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আমি তর্ক করি না। তারা যা বলে তা-ই হাসিমুখে মেনে নিই।’

‘সস্তা ধরনের কনভারসেশন আমার সঙ্গে দয়া করে করবেন না। ‘সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আমি তর্ক করি না’ এটা বহু পুরাতন ডায়ালগ। বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে। শুনলেই গা-জ্বালা করে। আপনি খুব অল্প কথায় আমাকে বলুন—কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন, তারপর রিলিজ-অর্ডার নিয়ে বাসায় চলে যান।’

‘আমি আপনাকে বলব না।’

ফারজানার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তার ঠোটের সিগারেট নিভে গিয়েছিল—সে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, কেন বলবেন না?

আমি শান্তগলায় বললাম, আপনাকে আমি বলে ব্যাপারটা বোঝাতে পারব না। আপনাকে দৃশ্যটা দেখাতে হবে। ঘটনাটা কী পরিমাণে অস্বাভাবিক তা জানার জন্যে আপনাকে নিজের চোখে দেখতে হবে। আমি বরং আপনাকে দেখাবার ব্যবস্থা করি।

‘আপনি আমাকে ভূত দেখাবেন?’

‘ভূত কি না তা তো জানি না—যে-জিনিসটা দেখে ভয় পেয়েছিলাম সেটা দেখাব।’

‘কবে?’

‘কবে তা বলতে পারছি না। কোনো-একদিন এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’

ফারজানা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, আচ্ছা বেশ, নিয়ে যাবেন। আমি অপেক্ষা করে থাকব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *