০১. আপনিই মিসির আলি

আপনিই মিসির আলি?

হ্যাঁ।

মেয়েটা এমনভাবে তাকাল যেন সে নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলা থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি ভীষণ জরুরি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিটা এই মুহূর্তে আপনাকে না দিয়ে একটু পরে দেই? নিজেকে সামলে নেই। আমি মনে মনে আপনার চেহারা যেমন হবে ভেবেছিলাম, অবিকল সে রকম হয়েছে।

মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। সরল ধরনের মুখ। যে মুখ অল্পতেই বিস্মিত হয়। বারান্দায় চড়ুই বসলে অবাক হয়ে বলে, ও মাগো কী অদ্ভুত একটা চড়ুই!

মেয়েটার সুন্দর চেহারা। মাথার চুল লালচে এবং কোঁকড়ানো না হলে আরো সুন্দর লাগত। বয়স কত হবে—পঁচিশ ছাব্বিশ। নাকি আরো কম? কপালে টিপ দিয়েছে, টিপটা ঠিক মাঝখানে হয় নি। বাঁ দিকে সরে আছে। মেয়েরা সাধারণত টিপ দেওয়ার ব্যাপারে খুব সাবধানী হয়। টিপ এক পাশে হলে কপালে সতীন জোটে—তাই বাড়তি সাবধানতা। এই মেয়েটা হয়তো তেমন সাবধানী নয়, কিংবা এই গ্রাম্য কুসংস্কারটা জানে না। মেয়েটা চোখে কাজল দিয়েছে। গায়ের রঙ অতিরিক্ত সাদা বলেই চোখের কাজলটা ফুটে বের হয়েছে। শ্যামলা মেয়েদের চোখেই কাজল মানায়, ফর্সা মেয়েদের মানায় না। তার পরেও এই মেয়েটিকে কেন জানি মানিয়ে গেছে।

সে পরেছে সবুজ রঙের শাড়ি। এখনকার মেয়েরা কি সবুজ রঙটা বেশি পরছে? প্রায়ই তিনি সবুজ রঙের শাড়ি পরা তরুণীদের দেখেন। আগে শহরের মেয়েরা সবুজ শাড়ি এত পরত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের রঙের পছন্দ কি বদলাচ্ছে? রঙ নিয়ে কোনো গবেষণা কি হয়েছে? র‍্যানডম স্যাম্পলিং করা যেতে পারে। প্রতিদিন পঞ্চাশটা করে মেয়ের শাড়ির রঙ দেখা হবে। একেক দিন একেক জায়গায়। আজ নিউমার্কেটে, কাল গুলিস্তানে, পরশু ধানমণ্ডি। পরীক্ষাটা একমাস ধরে করা হবে। তারপর করা হবে গসিয়ান কার্ভ।

মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। পরীক্ষাটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ হবে না। স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড় করানো কঠিন হবে। মূল গ্রুপের ভেতর থাকবে সাব গ্রুপ। বিবাহিত মেয়ে, অবিবাহিত মেয়ে। উনিশ বছরের কম বয়সী মেয়ে, উনিশ বছরের চেয়ে বেশি বয়সের মেয়ে, ডিভোর্সড মেয়ে, বিধবা মেয়ে

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, মনে হচ্ছে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন? কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?

মিসির আলি বললেন, দুশ্চিন্তা করছি না তো।

আপনি অবশ্যই দুশ্চিন্তা করছেন। দুশ্চিন্তা না করলেও চিন্তা করছেন। কেউ যখন গভীর কিছু নিয়ে চিন্তা করে—তখন বোঝা যায়।

তুমি বুঝতে পার?

হ্যাঁ পারি। ও আচ্ছা, আমি তো পরিচয়ই দেই নি। আপনি বসতে বলার আগেই বসে পড়েছি। আমার ডাক নাম লিলি। ভালো নামটা আপনাকে বলব না। ভালো নামটা খুবই পুরোনো টাইপ। দাদি নানিদের সময়কার নাম। এখন বলতে লজ্জা লাগছে।

মিসির আলি বললেন, পুরোনো জিনিস তো আবার ফিরে আসছে। পুরোনো প্যাটার্নের গয়নাকে এখন খুব আধুনিক ভাবা হচ্ছে।

যত আধুনিকই ভাবা হোক, আমার ভালো নামটাকে কেউ কখনো আধুনিক ভাববে না। আচ্ছা আপনাকে বলে ফেলি, আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।

আমি হাসব না। আমি খুব সহজে হাসতে পারি না।

আমার ভালো নাম হল মারহাবা খাতুন। নামটার একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা আরেকদিন বলব। ইতিহাসটা শুনলে এখন নামটা আপনার কাছে যতটা খারাপ লাগছে— তত খারাপ লাগবে না। তখন মনে হবে এই নামও চলতে পারে।

এখনো যে নামটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে তা না।

আপনার খারাপ লাগছে তো বটেই আপনি ভদ্রতা করে বলছেন খারাপ না। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনি অত্যন্ত ভদ্র। কাউকে মনে আঘাত দিয়ে আপনি কথা বলতে পারেন না।

কীভাবে বুঝলে?

এই যে আমি বকবক করে যাচ্ছি, আপনি মনে মনে খুবই বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই সেটা প্রকাশ করছেন না। আপনি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে অন্য কিছু ভাবছেন। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আমার বকবকানিতে বিরক্ত হচ্ছেন না?

মিসির আলি জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন। তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন।

একটা বয়স পর্যন্ত হয়তো মেয়েদের অকারণ অর্থহীন কথা শুনতে ভালো লাগে, তারপর আর লাগে না। এই মেয়েটি অকারণে কথা বলেই যাচ্ছে। মেয়েটার মনে গোপন কোনো টেনশন কি আছে? টেনশনের সময় ছেলেরা কম কথা বলে, মেয়েরা বলে বেশি। একটা ভালো দিক হচ্ছে মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। কথা শুনতে ভালো লাগে। এর গলার স্বর একঘেয়ে হলে এতক্ষণে মাথা ধরে যেত।

বেলা বারোটার মতো বাজে। মিসির আলিকে নিউমার্কেট যেতে হবে। একটা কেরোসিনের চুলা সেই সঙ্গে আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনবেন। সমুদ্রতীরে নিরিবিলিতে কিছুদিন থাকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর এক ছাত্র বিনোদ চক্রবর্তী টেকনাফে কী একটা এনজিওতে কাজ করে। সে দিন পনের সমুদ্রের পাড়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জায়গাটার নাম কাদাডাঙ্গা। এমন একটা জায়গা যার আশেপাশের দু’তিন মাইলের ভেতর কোনো লোকালয় নেই। সামনে সমুদ্র, পেছনে জঙ্গল। দিনরাত সমুদ্র দেখা, নিজে রান্না করে খাওয়া। ভাবতেই অন্য রকম লাগছে। সমুদ্র দর্শন উপলক্ষে কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। আজই তা শুরু করার কথা। মেয়েটির জন্যে সম্ভব হচ্ছে না। কারো মুখের উপর বলা যায় না, তুমি চলে যাও, আমার জরুরি কাজ আছে। মিসির আলির কাজটা তেমন জরুরিও না। কেরোসিনের চুলা বিকেলেও কেনা যায়। সন্ধ্যার পরেও কেনা যায়।

আপনাকে কি আমি চাচা ডাকতে পারি?

মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ডাকতে পার।

যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করেছেন, সবাই বোধ হয় আপনাকে স্যার ডাকে।

সবাই ডাকে না, তবে অনেকেই ডাকে।

লিলি ঝুঁকে এসে বলল, আমি অনেকের মতো হতে চাই না। আমি অনেকের চেয়ে আলাদা থাকতে চাই। আমি এখন থেকে আপনাকে চাচা ডাকব।

আচ্ছা।

না চাচা ডাকব না, চাচাজী ডাকব। চাচাজী ডাকের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। চাচা ডাকের মধ্যে নেই। তাই না?

হুঁ।

লিলি ঝুঁকে এসে বলল, জী লাগালেই যে আন্তরিক হয়ে যায় তা কিন্তু না। যেমন ধরুন বাবাজী, বাবাজী শুনতে ফাজলামির মতো লাগে না?

লিলি মুখ টিপে টিপে হাসছে। মেয়েটাকে এখন খুবই সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বেতের চেয়ারে একটা পরী বসে আছে। হঠাৎ মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন মিসির আলি বুঝতে পারলেন না। মানুষের চেহারাও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়? বদলাতে পারে। দিনের একেক সময় তার মুখে একেক রকম আলো পড়ে। সেই আলোর কারণেই চেহারা বদলায়। এনসেল আডামে’র একটা ফটোগ্রাফির বইতে পড়েছিলেন—তিনটা স্পট লাইট দিয়ে যে কোনো মানুষের চেহারা নিয়ে খেলা করা যায়।

চাচাজী পান মসলা খাবেন?

না।

একটু খেয়ে দেখুন খুব ভালো। আমি নিজে বানিয়েছি। আমার নিজের ফর্মুলা। আমি এই ফর্মুলার নাম দিয়েছি—লিলি’স পান পাউডার। কারণ আমার জিনিসটা পাউডারের মতো। মুখে দিয়ে কুটুর কুটুর করে চাবাতে হয় না। বুড়ো মানুষ যাদের দাঁতের অবস্থা ভালো না—তাদের জন্যে খুব সুবিধা। চাবাতে হবে না।

লিলি পান পাউডারের কৌটা বাড়িয়ে দিল। হাতের মুঠোর ভেতর রাখা যায় এমন কৌটা। দেখতে খুবই সুন্দর। কৌটার গায়ে ময়ূরের পালকের ডিজাইন। মনে হয় ছোট্ট একটা ময়ূর হাতের মুঠোয় শুয়ে আছে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কৌটাটা খুব সুন্দর।

আপনার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে।

কৌটাটা আমি আপনাকে দিয়ে দিতাম, কিন্তু দেওয়া ঠিক হবে না। আপনার কাছে এই কৌটা দেখলে সবাই হাসাহাসি করবে।

কেন বল তো?

কারণ কৌটাটা মেয়েদের। মেয়েরা এই ধরনের কৌটায় পিল রাখে। কোন ধরনের পিল বুঝতে পারছেন তো? বার্থ কনট্রোল পিল

ও আচ্ছা।

আপনি কি আমার কথায় লজ্জা পেয়েছেন? প্লিজ লজ্জা পাবেন না। আমার স্বভাব হচ্ছে—মুখে যা আসে বলে ফেলি। চিন্তাভাবনা করে কিছু বলি না। আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো না। আমার মনে হয় আপনি আপনার প্রতিটি কথা খুব চিন্তাভাবনা করে বলেন। ছাঁকনি দিয়ে কথাগুলি ছাঁকেন।

মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, লিলি তুমি তোমার জরুরি চিঠিটা আমাকে দিয়ে দাও। আমার আজ একটু বের হতে হবে। আমার কিছু কেনাকাটা আছে।

কেরোসিনের চুলা কিনবেন?

মিসির আলি খুবই চমকালেন, কিন্তু মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ করলেন না। তিনি কেরোসিনের চুলা ঠিকই কিনবেন, কিন্তু এই তথ্য মেয়েটির জানার কথা না। টেবিলের উপর কোনো কাগজের টুকরাও নেই, যেখানে কেরোসিনের চুলা লেখা। থট রিডিং জাতীয় কিছু? সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ইএসপির কথা খুব শোনা যায়। বাস্তবে দেখা যায় না।

মিসির আলি মনের বিস্ময় চেপে রেখে বললেন, হ্যাঁ একটা কেরোসিনের চুলা কিনব।

আমি যে বলে দিতে পারলাম এতে অবাক হন নি?

প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। এখন অবাক হচ্ছি না।

এখন অবাক হচ্ছেন না কেন? আমি কীভাবে কেরোসিনের চুলার ব্যাপারটা বলে ফেলেছি তা ধরে ফেলেছেন—এই জন্যে অবাক হচ্ছেন না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা বলুন, আমি কীভাবে বলতে পারলাম কেরোসিনের চুলা?

আমি লক্ষ করেছি তুমি কথা বলার সময় যতটা না আমার চোখের দিকে তাকাও তারচেয়ে বেশি তাকাও আমার ঠোটের দিকে। কথা বলার সময় ঠোঁটের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে না, কারণ শব্দটা আমরা কানে শুনতে পাই। তুমি ঠোটের দিকে তাকাচ্ছ তার মানে তুমি লিপ রিডিং জান। আমি নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় বিড়বিড় করে ‘কেরোসিনের চুলা’ বলেছি। তুমি ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝে ফেলেছ। লিলি হাসতে হাসতে বলল, আপনাকে আমি দশে সাড়ে নয় দিলাম। আসলেই আপনার বুদ্ধি আছে।

তোমার কি ধারণা হয়েছিল বুদ্ধি নেই?

আপনাকে তো আমি খুব ভালোমতো জানি না। যা জানি বইপত্র পড়ে জানি। বইপত্রে সব সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়। তাছাড়া চাচাজী আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার চেহারায় হালকা বোকা ভাব আছে। আপনি নিজে তো নিজেকে আয়নায় দেখেন। ঠিক বলছি না চাচাজী?

হ্যাঁ ঠিক বলছ।

আমি বুঝতে পারছি আমাকে বিদায় করতে পারলে আপনি খুশি হন। আমি আর মাত্র বারো মিনিট থাকব। তারপর চলে যাব।

হিসাব করে বারো মিনিট কেন?

লিলি হাসিমুখে বলল, একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরে আপনাকে আমি চিঠিটা দেব। এই চিঠি আগেও দেওয়া যাবে না, পরেও দেওয়া যাবে না। একটা বাজার ঠিক দশ মিনিট পরেই দিতে হবে। কারণটা হচ্ছে আজ মে মাসের ছয় তারিখ। এই তারিখে সূর্য ঠিক মাথার উপর আসবে একটা বেজে দশ মিনিটে। যিনি চিঠিটা আমার কাছে দিয়েছেন, তিনি এইসব বিষয় খুব ভালো জানেন। সূর্য মাথার উপর আসার ব্যাপারটা আমি তাঁর কাছ থেকে জেনেছি।

চিঠিটা কে দিয়েছে তোমার হাজবেন্ড?

জী।

তাঁর শখ কি আকাশের তারা দেখা? যারা আকাশের তারা দেখে এইসব ব্যাপার তারাই খুব ভালো জানে।

হ্যাঁ তিনি আকাশের তারা দেখেন। তাঁর তিন-চারটা টেলিস্কোপ আছে। আচ্ছা চাচাজী বইপত্রে পড়ি আপনার অবজারভেশন ক্ষমতা অস্বাভাবিক। দেখি তো কেমন? আমাকে দেখে আমার হাজবেন্ড সম্পর্কে বলুন। বলা কি সম্ভব?

না সম্ভব না।

কিছু নিশ্চয়ই বলা সম্ভব। এই যে আমি বললাম—তিনি আকাশের তারা দেখেন। এই বাক্যটায় আমি সম্মানসূচক ‘তিনি’ ব্যবহার করেছি। এখান থেকেই তো আপনি বলতে পারবেন যে, আমার স্বামীর বয়স বেশি। সমবয়সী হলে বলতাম, ও আকাশের তারা দেখে।

মিসির আলি নড়েচড়ে বসলেন। এই মেয়েটির সহজ সরল চোখের ভেতরে তীক্ষ্ণ চোখ লুকিয়ে আছে। এই চোখকে অগ্রাহ্য করা ঠিক না।

কেরোসিনের চুলা কিনতে চাচ্ছেন কেন?

আমি কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যাব। নিজে রান্নাবান্না করে খেতে হবে। তার প্রস্তুতি।

শুধু কেরোসিনের চুলা কিনলে হবে না। এর সঙ্গে আরো অনেককিছু কিনতে হবে। কী কী কিনতে হবে আসুন তার একটা লিস্ট করে ফেলি। এতে দ্রুত সময় কেটে যাবে।

লিলি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে কাগজ কলম বের করল। মিসির আলিকে অবাক করে দিয়েই টেবিলে ঝুঁকে দ্রুত লিখে ফেলল—

১. কেরোসিনের চুলা

২. চুলার ফিতা ৩. কেরোসিন

৪. ছুরি

৫. কাঠের বোর্ড (মাছ গোশত কাটার জন্যে)

৬. কেতলি

৭. সসপ্যান

৮. দুটি হাঁড়ি (ভাতের এবং তরকারির)

৯. চায়ের কাপ

১০. চামচ

১১. কনডেন্সড মিল্ক

১২. চা

১৩. কফি

মেয়েটা এমনভাবে লিখছে যেন মিসির আলি চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। মেয়েটার এই ভঙ্গিটা ভালো লাগছে। কাজের ভঙ্গি। কাজটা সে হেলাফেলার সঙ্গে করছে না, গুরুত্বের সঙ্গে করছে।

আপনি একা যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আমারও মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে একা কোথাও গিয়ে থাকতে। রবিনসন ক্রুশোর মতো একা কোনো দ্বীপে বাস করা। কী করব না করব কেউ দেখবে না। আমার মনে হয় আমি একা একা সারা জীবন কাটাতে পারব। আচ্ছা চাচাজী আপনি কি পারবেন?

বুঝতে পারছি না। আমি কখনো ভেবে দেখি নি।

কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষে একা একা সারা জীবন কাটানো সম্ভব না। পুরুষদের নানান ধরনের চাহিদা আছে। ভদ্ৰ চাহিদা, অভদ্র চাহিদা। ওদের চাহিদার শেষ নেই।

মেয়েরা কি তার থেকে মুক্ত?

মেয়েরাও তার থেকে মুক্ত না। তবে মেয়েরা ব্যক্তিগত চাহিদার কাছে কখনো পরাজিত হয় না। পুরুষরা হয়।

লিলি লেখা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, সব মিলিয়ে আটত্রিশটা আইটেম লিখেছি। এই আটত্রিশটা আইটেম সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনি একা একা থাকতে পারবেন। এর মধ্যে অষুধও আছে। চট করে অসুখবিসুখ হলে ডাক্তারখানা পাবেন না।

থ্যাংক য়্যু।

আমি কাল আবার আসব। এর মধ্যে যদি আরো নতুন কোনো আইটেমের নাম মনে আসে আপনাকে বলব।

আচ্ছা।

লিলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন একটা বেজে দশ মিনিট। এই নিন চিঠি। দয়া করে ঝুড়িতে ফেলে দেবেন না। পড়বেন। তবে আমার সামনে পড়বেন না। আমি চলে যাবার পর পড়বেন।

অবশ্যই পড়ব।

আমি বাজার করতে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি রাজি হন তাহলে কাল যখন আসব তখন আপনাকে নিয়ে কেরোসিনের চুলাটুলা কিনে দেব। আপনি যে দামে কিনবেন, আমি তার অর্ধেক দামে কিনে দেব। আর কিছু আইটেম আছে যা দোকানে গেলে মনে পড়বে। কাগজ কলম নিয়ে বসলে মনে পড়বে না। এই তো এখন একটা জরুরি আইটেম মনে পড়ল, ন্যাকড়া।

ন্যাকড়া?

হ্যাঁ ন্যাকড়া। ন্যাকড়াকে মোটেই তুচ্ছ মনে করবেন না। চুলা থেকে গরম চায়ের কেতলি নামাবেন কীভাবে? হাতের কাছে ন্যাকড়া না থাকলে হয়তো গায়ের শার্টের একটা অংশ দিয়ে নামাতে যাবেন—তারপর এ্যাকসিডেন্ট। সারা গা গেল পুড়ে। ভালো কথা অষুধের লিস্টে আমি বার্নল লিখে দিয়েছি। নিতে কিন্তু ভুলবেন না।

আচ্ছা ভুলব না।

চাচাজী বাজার করার সময় আমাকে কি আপনি সঙ্গে নেবেন?

তুমি কাল আস তখন দেখা যাবে। আমার সমস্যা কি জান? আমি আমার নিজের কাজগুলি নিজেই করতে ভালবাসি। কেউ আমাকে কোনো ব্যাপারে সাহায্য করছে এটা ভাবতেই আমার কাছে খারাপ লাগে।

এই জন্যেই কি বিয়ে করেন নি?

বিয়ে না করার পেছনে এটা কারণ হিসেবে কাজ করে নি। বউকে দিয়ে কাজ করাব—এই ভেবে তো আর কেউ বিয়ে করে না।

কাল আমি ঠিক এগারটার সময় আসব।

আচ্ছা!

আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আরো কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বসব?

না। আমি একনাগাড়ে কারো সঙ্গেই পঞ্চাশ মিনিটের বেশি গল্প করতে পারি না। দীর্ঘদিন মাস্টারি করেছি তো। মাস্টারদের ক্লাসগুলি হয় পঞ্চাশ মিনিটের। যে সব শিক্ষক দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তারা কখনো পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কোনো সিটিং দিতে পারেন না।

আমার নাম কি আপনার মনে আছে?

মনে আছে। ডাক নাম লিলি। ভালো নাম মারহাবা খাতুন।

আমার ভালো নাম আসলে মারহাবা খাতুন না। মাহাবা বেগম। আমি ‘মা’র পরে একটা ‘র’ বসিয়ে মাহাবাকে মারহাবা করেছি।

মাহাবা তো বেশ আধুনিক নাম। তুমি কেন বললে খুব পুরোনো ধরনের নাম? মিথ্যা করে বললাম। ছোট্ট একটা পরীক্ষা করলাম। মিথ্যা কথা বললে আপনি ধরতে পারেন কি না সেই পরীক্ষা। আমি আপনাকে নিয়ে লেখা একটা বইয়ে পড়েছি কেউ মিথ্যা কথা বললে আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেন। আসলে আপনি পারেন না।

তুমি নাম নিয়ে মিথ্যা বলতে পার এটা মাথায় আসে নি। কাজেই আমি সেইভাবে তোমাকে লক্ষ করি নি।

মেয়েদের সম্পর্কে আপনি আসলে খুব কম জানেন। নিজের নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে মেয়েরা খুব পছন্দ করে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ধরুন কোনো মেয়ে টেলিফোন ধরেছে। অপরিচিত একজন পুরুষ জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন? মেয়েটা তখন নিজের নাম না বলে ফট করে তার বান্ধবীর নাম বলে দেবে। আচ্ছা আমি যাই, আপনি তো আবার পঞ্চাশ মিনিটের বেশি কথা বলেন না। আমি যে বাড়তি কিছুক্ষণ কথা বললাম—কেন বললাম জানেন? পঞ্চাশ মিনিট পুরো করার জন্যে বললাম। আমি আপনার কাছে এসেছি সাড়ে বারোটায়। এখন বাজছে একটা বিশ। পঞ্চাশ মিনিট হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আপনি আমাকে দ্রুত বিদায় করতে চাচ্ছিলেন। আমি চলেই যেতাম কিন্তু পঞ্চাশ মিনিটের কথা বলে আপনি নিজেই নিজের ফাঁদে আটকে গেলেন। খুব বুদ্ধিমান মানুষদের এটা একটা সমস্যা। নিজেদের তৈরি করা ছোট ছোট ফাঁদে তারা নিজেরা ধরা পড়ে। চাচাজী যাই?

আচ্ছা যাও।

মিসির আলি মেয়েটিকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই কাজটা তিনি সচরাচর করেন না।

লিলি গেট পার হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। লজ্জিত গলায় বলল, চাচাজী আমি খুব দুঃখিত।

মিসির আলি বললেন, কেন বল তো?

আমি বুঝতে পারছিলাম আপনি আমার উপর খুব বিরক্ত হচ্ছেন, তারপরেও আমি চলে যাই নি। বরং আপনি যেন আরো বিরক্ত হন সেই চেষ্টা করেছি। আসলে আপনার সামনে থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করছিল না।

মিসির আলি বললেন, আমি যতটা বিরক্ত হয়েছি বলে তুমি ভাবছ, তত বিরক্ত কিন্তু আমি হই নি। বরং তোমাকে আমার ইন্টারেস্টিং একটি মেয়ে বলে মনে হয়েছে।

তাহলে চলুন আবার ঘরে ফিরে যাই। কিছুক্ষণ গল্প করি।

বলতে বলতে লিলি হেসে ফেলল। মিসির আলিও হাসলেন। লিলি বলল, আপনাকে ভয় দেখাবার জন্যে বললাম, আপনি কি ভেবেছিলেন আমি আরো ঘণ্টাদুই আপনার সঙ্গে বকবক করব? আপনার মাইগ্রেনের ব্যথা তুলে তারপর বিদেয় নেব?

লিলি হাসছে। এই মেয়েটার হাসি একটু অন্যরকম। সে যখন হাসে তার চোখে পানি জমে। এই হাসির একটা নামও আছে—অশ্রু হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *