1 of 3

লজ্জা

লজ্জা

“লজ্জা হয় না! … যে শরীর থাকবে না—যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্মা, যত প্রকার অপবিত্র জিনিস—সেই শরীর নিয়ে আনন্দ! লজ্জা হয় না!”

এই লজ্জাটুকুই বারে বারে ঠাকুর জাগাতে চেয়েছিলেন গৃহীদের মনে। গৃহী হও সংসারী হও; কিন্তু নির্লজ্জ হয়ো না। সংসারীরও একটা আদর্শ থাকা চাই। ঈশ্বর শুধু সাধুর সম্পত্তি নয়, সাধনার প্রাপ্তি। যে সাধন করবে সেই পাবে। ঠাকুর বলেছেন : “তুমি তাঁর দিকে এক পা এগোলে তিনি তোমার দিকে একশ পা এগিয়ে আসবেন।“

এখন প্রশ্ন হতে পারে, তিনি কে? মাস্টারমশাই প্রশ্ন করছেন ঈশ্বরকে দর্শন কি এই চোখে হয়?

ঠাকুর বলছেন : “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধন করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ, সেই চক্ষে তাঁকে দেখে সেই কর্ণে তাঁর বাণী শোনা যায়।”

এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো—কিভাবে কি হবে? এ তো বললে হবে না। শুনলেও হবে না। পড়লেও হবে না। একটিমাত্র উপায়—ভালবাসা। ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা এলে তবেই তো চারিদিকে ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিকে হলদে দেখা যায়। তারপর কি হয়? ধরে রাখতে পারলে—তিনিই আমি এইটি বোধ হয়। যেমন মাতালের নেশা বেশি হলেই বলে—আমিই কালী। গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলত— আমিই কৃষ্ণ। ঠাকুর বলছেন : “তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন—প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক তবে খানিকক্ষণ পরে চারদিকে শিখাময় দেখা যায়।”

ভালবাসা বললেই তো আর ভালবাসা আসবে না। একটু বিচার চাই। বিচার হলো—মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছেন পথের শেষে—রাজা, উজির, ফকির, আমির- সকলেরই ঐ এক গতি। ঠাকুর বলছেন : “মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখা উচিত। মরবার পর কিছুই থাকবে না। এখানে কতকগুলি কর্ম করতে আসা। বড় মানুষের বাগানের সরকার বাগান যদি কেউ দেখতে আসে, তা বলে—’এ- বাগানটি আমাদের,’ ‘এ-পুকুর আমাদের পুকুর’। কিন্তু কোন দোষ দেখে বাবু যদি ছাড়িয়ে দেয়, তার আমের সিন্দুকটা লয়ে যাবার যোগ্যতা থাকে না। দারোয়ানকে দিয়ে সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেয়।”

বাবুর বাগান এই সংসার। রেখেছেন, বেশ ভাল কথা। আছি। থাকব ততদিন, যতদিন না তিনি আমাকে তুলে নিচ্ছেন। ‘আমি’ ‘আমি’ ততটুকুই করব যতটুকু না করলে নয়। এক ধরনের অহঙ্কার আছে যা বড়ই লজ্জার। চিটচিটে আমি। অন্ধ আমি। সেই আমি-র হাঁকডাকে নিতান্ত সাধারণ মানুষও হাসে। নিচে আমি। জ্ঞানীর আমি মশামারা ধূপের মতো ধোঁয়া ছাড়ে না। সে আমি ধূপের মতো। সেই আমি কিঞ্চিৎ ভীত এই ভেবে-কোথায় আমি— ‘আমি, আমার’ করছি। জীবনের কাছাটি খুলে দিলে সব হম্বিতম্বির অবসান। এই বোধ থেকে আসে জ্ঞান। ঠাকুর বলছেন : “জ্ঞান কাকে বলে; আর আমি কে? ঈশ্বরই কর্তা, আর সব অকর্তা। এর নাম জ্ঞান। আমি অকর্তা–তাঁরই হাতের যন্ত্র। তাই আমি বলি, মা, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; তুমি ঘরণী, আমি ঘর; আমি গাড়ি, তুমি ইঞ্জিনিয়ার; যেমন চালাও, তেমনি চলি, যেমন করাও, তেমনি করি; যেমন বলাও, তেমনি বলি। নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু। তুমিই সব।” ঠাকুর বলছেন : “মার কাছে কেবল ভক্তি চেয়েছিলাম। ফুল হাতে করে মার পাদপদ্মে দিয়েছিলাম; বলেছিলাম—এই নাও তোমার অজ্ঞান, মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।”

সব সমর্পণ করে দাও। তবেই মিলবে তাঁর কৃপা। সব ছাড়লে, তবেই সব পাবে। জ্ঞানী থেকে ক্রমে বিজ্ঞানী। ঠাকুর বলছেন : “বিজ্ঞানী কেন ভক্তি নিয়ে থাকে; এর উত্তর এই যে, আমিত্ব যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের অহং যায় না। অশ্বত্থ গাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁকড়ি বেরিয়েছে। জ্ঞানলাভের পরও আবার কোথা থেকে ‘আমি’ এসে পড়ে। স্বপনে বাঘ দেখেছিলে, তারপর জাগলে, তবুও তোমার বুক দুড়দুড় করছে; জীবের আমি নিয়েই তো অত যন্ত্রণা।”

ঠাকুর এইবার একটি উপমা দিচ্ছেন—”গরু ‘হাম্বা’ ‘হাম্বা’ (‘আমি’ ‘আমি’) করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। লাঙলে জোড়ে, রোদ-বৃষ্টি গায়ের উপর দিয়ে যায়, আবার কসাইয়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়, ঢোল হয়—তখন খুব পেটায়। তবুও নিস্তার নেই। শেষে নাড়িভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈরি হয়। সেই তাঁতে ধুনুরির যন্ত্র হয়। তখন আর ‘আমি’ বলে না, তখন বলে তুঁহু তুঁহু। যখন ‘তুমি, তুমি’ বলে তখন নিস্তার।”

‘আমি’ই হলো মহাকাল। আমার সংসার, আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার চাকরি, আমার নাম, আমার যশ, আমার খ্যাতি। ছোট্ট একটা আমি হাঁচড়- পাঁচড় করে সবকিছু ধরতে চায়। আর প্রতিপদে জীবন তাকে চাবকায়। তাহলে কোন্ ভাবটা নিয়ে চলতে হবে? সেই লজ্জা—আরে ছি ছি, আমি একটা বুড়ো দামড়া, এই পরবাসে এসে আমি আর আমার করে মরছি। ধক করে হৃৎপিণ্ডটা একবার তালকাটা ছন্দে লাফ মারল। হাত থেকে খসে পড়ল চায়ের কাপ। চোখ কপালে। কান্নার সানাই বেজে উঠল চারপাশে। তারপরের দৃশ্য ঠাকুরই এঁকে দিয়ে গেছেন—বদ্ধজীব যখন মরে তার পরিবার বলে—’তুমি তো চললে? আমার কি করে গেলে?’ ঠাকুর বলছেন : “আবার এমনই মায়া যে প্রদীপটাতে বেশি সলতে জ্বললে বদ্ধজীব বলে, ‘তেল পুড়ে যাবে, সলতে কমিয়ে দাও।’ এদিকে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রয়েছে, বদ্ধজীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না।” ঠাকুর বলছেন : “সংসারে হনুমান হয়ে থাক—দেখ, হনুমানের কি ভাব! ধন, মান, দেহসুখ কিছুই চায় না; কেবল ভগবানকে চায়! যখন স্ফটিকস্তম্ভ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে পালাচ্ছে তখন মন্দোদরী অনেক রকম ফল নিয়ে লোভ দেখাতে লাগল। ভাবলে ফলের লোভে নেমে এসে অস্ত্রটা যদি ফেলে দেয়; কিন্তু হনুমান ভুলবার ছেলে নয়।” হনুমান কি বলেছিল, ঠাকুর গানে বললেন :

“আমার কি ফলের অভাব।
পেয়েছি যে ফল, জনম সফল;
মোক্ষ-ফলের বৃক্ষ রাম হৃদয়ে।।
শ্রীরামকল্পতরুমূলে বসে রই
যখন যে ফল বাঞ্ছা সেই ফল প্রাপ্ত হই।”

রাম জিজ্ঞাসা করলেন : “হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ?” হনুমান বললে : “রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পূর্ণ আমি অংশ, তুমি প্রভু আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।”

ঠাকুর বলছেন : “সেব্য-সেবকভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা—দাস আমি হয়ে।” ঠাকুর বলছেন : “লজ্জা! একটু লজ্জা বোধ কর—আমির দাসত্ব কর না। দাস আমি হও। আমির দাসত্ব মানে, ‘আমি তোমাকে বাঁদর-নাচ নাচাবে। ‘আমি ও আমার’—এই দুটি অজ্ঞান। এই অজ্ঞানে যেন লজ্জা আসে। আমার বাড়ি, আমার টাকা, আমার বিদ্যা। আমার এইসব ঐশ্বর্য, এই যে ভাব, এটি অজ্ঞান থেকে হয়। ‘হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর এসব তোমার জিনিস—বাড়ি, পরিবার, ছেলেপুলে, লোকজন, বন্ধুবান্ধব—এসব তোমার জিনিস’–এ-ভাব জ্ঞান থেকে হয়। সংসারই মায়া। ওর ভিতর অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায়—মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয়—বইতে বইতে আর ঘেন্না থাকে না।” এই বেহুঁশ হয়ে থাকাটাই লজ্জার। বেহুঁশ অবস্থার প্রতি বিষম ঘৃণাই আনে ঈশ্বরে ভক্তি। তাই প্রথম উপপাদ্যটি হলো লজ্জা। বড় লজ্জা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লজ্জা

লজ্জা

দক্ষের কন্যা ও ধর্ম্মের স্ত্রী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *