বার্ট্রান্ড রাসেল

বার্ট্রান্ড রাসেল

বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন ও মনীষার এক অংশ মাত্র সাধারণের চোখে পড়েছে। অপর অংশ চাঁদের অপর পিঠের মতো লোকলোচনের অন্তরালে রয়ে গেছে। গোটা পৃথিবীর মাত্র চল্লিশজন বিশারদ লোক নাকি ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়েছেন। তাদের সকলে যে রাসেলের সূক্ষ্ম চিন্তাপদ্ধতির সূক্ষ্ম তন্তু পুরোপুরি অনুধাবন করতে পেরেছেন এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেননি। দর্শনে তার নিজস্ব অবদান ‘থিয়োরি অফ ডেসক্রিপশন’ প্রসঙ্গেও এ কথা অতটা না হলেও অল্পবিস্তর খাটে। জনপ্রিয় রচনাসমূহ সাধারণ মানুষের কাছে এনেছে তাকে- একথা সত্য বটে। কিন্তু আসল রাসেল মানুষটিকে তার মধ্যে পাওয়া যাবে না। রচনারীতির সরল ভঙ্গি এবং ঋজু বক্তব্যের মতো মানবিক ভাবাবেগের শূরণের মাধ্যমে যেন জনসভায় জানান দিতে চেয়েছেন তাদেরই একজন তিনি। মনের গুঞ্জরণশীল ভাবনাগুলো আলাদা করে হেঁকে হেঁকে সঠিকভাষায় অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতাসহকারে তরজমা করতে পেরেছেন বলেই তিনি মোটামুটি ভাবনা চিন্তা করতে সক্ষম মানুষের মনেও একটা আসন অনেকটা জোর করে আদায় করে নিয়েছেন। লোকমনরঞ্জনের অভিপ্রায়ে তিনি লিখেননি। বরং বলা চলে অনেক সময়েই বেশির ভাগ মানুষের সংস্কার বিশ্বাস এবং চিন্তন পদ্ধতির উপর খুব তীক্ষ্ণ আক্রমণ চালিয়েছেন।

এখানে ধরা পড়ে রাসেলের লক্ষ্য করবার মতো একটি বিশেষত্ব। আক্রমণ করার যে একটা পালোয়ানী বা খেলোয়াড়ী উল্লাস থাকে, তা রাসেলের নেই। ব্যথিত হয়েছেন অনেক সময়, কিন্তু ধৈর্য হারিয়েছেন কম সময়। তার পছন্দ এবং অপছন্দের সীমানাও তিনি টানেন নিজের ভঙ্গিতে। কোনো কিছু মনঃপূত না হলে তিনি কারণ বলে দেন। বিষয়টি তার মনঃপূত নয়, যেহেতু তার ধারণাতে বিষয়টি মানুষের শরীর মনের সুস্থ বিকাশের অনুকূল নয়, যুক্তিগুলো থরে থরে সাজিয়ে বিন্যাস করে দেখাবেন। রাসেলের উইট হীরার ছুরি। ইচ্ছে করে কথা বলেন না, হঠাৎ কথা বলবার ঝেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। প্রচলিত অর্থে চমৎকার ধারালো ভারালোর কোনোটাই নয়। বার্নার্ডশ’র মতো ক্ষোভ মেশানো জ্যাঠামি দিয়ে লোক হাসানোর ইচ্ছা রাসেলের আদৌ নেই । তিনিও কিন্তু লোককে শিক্ষা দিতে চান। তাই বলে আগ্রহাতিশয্য তার নেই। মানুষের জানা প্রয়োজন, ইচ্ছে করলে মানুষ সত্যকে গ্রহণ করতে পারে। তাই রাসেলীয় উইট ঝিলিক দিয়ে বুকে বেঁধে কিন্তু মুখে হাসি আসার আগে মনে চিন্তার শিকড় বাড়িয়ে দেয়। তার অপছন্দবোধ আছে সেটা কঠিন এবং হিমশীতল, মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত স্পর্শ করে। কিন্তু ঘৃণা? সম্ভবত তা তিনি করেন না।

তার মতের পুরোপুরি বিরোধিতা করেছেন এমন মানুষও তার রচনারীতির প্রতি আকর্ষণ চেপে রাখতে পারেননি। তার বক্তব্য চতুর্মাত্রিক; তাতে স্পষ্টতার সঙ্গে তীক্ষ্ণতার মিলন ঘটেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই অর্জুনের মতো পাখির চোখ দেখে ফেলেন। কেউ তাকে গ্রহণ করুন না করুন ইচ্ছে- তার কাজ বিষয়টি ধরিয়ে দেয়া। তিনি কর্তব্যমাত্র পালন করছেন। অঙ্কবিদের নিখুঁত পরিপাট্যের সঙ্গে আরেকটি দুর্লভ গুণের মিশেল দিয়েছেন তিনি। যে গুণটি ধ্রুপদ সঙ্গীতের রস। বস্তুত সংখ্যার রোমাঞ্চ গাণিতিকের মনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমশ্রেণীর নিষ্কাম আবেগের জন্ম দেয়। কিন্তু তাদের অনেকেই এই গভীরতা সন্ধানী জাফরানের ঘ্রাণ এবং অনুভূতির লাবণ্য অপরের কাছে তুলে ধরতে পারেন না। কিন্তু রাসেলের পারঙ্গমতা সন্দেহের অতীত। তার মানবিক আবেগের স্পর্শলাগা রচনাগুলো পাঠের পর মনে রসিয়ে ওঠে ধ্রুপদ সঙ্গীতের করুণ মূৰ্ছনা। মন চারধারে আপনা থেকেই প্রকাশিত করে শান্তশীতল এলানো ছায়া। মরুভূমির মধ্যে উদ্যানকুঞ্জের মতো। বলতে সাধ হয় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, অঙ্কবিদ যাই হোক না কেন এই ঋজুরেখ চিন্তার অধিকারী ধাতব কঠিন মানুষটির মধ্যে এমন কেউ কোথাও একজন আছেন, যাকে সেক্সপীয়র, শেলীর জাতভাই বলতে পারি।

শুধু রচনারীতির উপর যাদের নাম ধাম খ্যাতি, রাসেল সে জাতীয় পুরুষ নন। সংসারের ঝড় ঝঞ্ঝায় প্রবল সামুদ্রিক তিমির মতো যুঝেছেন। তার অস্ত্রলেখা বীরত্বের প্রতাঁকের মতো সকল গতরে ছড়ানো রয়েছে। অর্ডসওয়ার্থ নিউটন সম্বন্ধে যা বলেছেন Voyazing alone in the Ocean of thought, রাসেলের ব্যাপারেও কথাটা লাগসই। তা ঠিক, রাসেলের আরেকটি দিকও রয়েছে। নিষ্ক্রিয় চিন্তাবিদের জীবন রাসেলের নয়। একা মহাসমুদ্রে পাড়ি দিয়ে মুক্তো মানিক তুলেছেন এমন অনেকে আছেন। শিগগির কিংবা দেরিতে তাদের অবদান মানব সমাজ গ্রহণ করেছে। রাসেল চিন্তানায়ক, একাকীত্বের বিষণ্ণ বেদনা অনেক চিন্তানায়কের প্রিয়তম সুহৃদ। চিন্তাভাবনার জগতে ক্ষ্যাপার পরশপাথর সন্ধান করেছেন তিনি। কিন্তু নিজে তিনি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন এমন একটা স্বর যা শুধু অরণ্যে আর্তনাদ করবে না। লোকালয়ে, নগরে-জনপদে, মানুষের নিবাসকুঞ্জে ধ্বনিত হবে সে স্বর নিটোল নিঝর আওয়াজের মতো এবং মানুষ দেবে তার সানন্দ উত্তর। মানুষের আবেগে চিন্তায় আসার আকুল আকুতি রাসেলকে প্যাচালো বিতর্কের পানে ঠেলে দিয়েছে।

মানুষ মাত্রেই কতেক সীমিত নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার চৌহদ্দী ডিঙানোর আকুতি যার মধ্যে যত বেশি প্রবল, পশুর সঙ্গে তার প্রভেদও তত স্পষ্ট অর্থাৎ তিনি অনেক বেশি মানুষ। ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করার এ অনিভন্ত উদ্দীপনাকে বলা যেতে পারে মানুষী সত্তার প্রমিথিয়ান রশ্মি । যারা অসাধারণ তাদের মধ্যে এ আগুন অনেক বেশি তেজোময়। চেতনার বলয়ে অন্তর্জানের বেশে যে শিখা অবস্থান করে তার আলোতে বস্তুজগৎ, সমাজ-জগৎ এবং মনোজগতের উত্তরণের ভাবী কটি ধাপ আগাম প্রতিফলিত হয়। বদ্ধ দরজার ফুটো দিয়ে তেরছা হয়ে যে কটি আলোকরেখা চোখে পড়েছে তার ওপাশে কি জানার জন্য, দেখার জন্য, অনুভব করার জন্য অন্তরাত্মা আকুল হয়ে ওঠে। শরীরের সমস্ত রক্ত পরামর্শ করে উজান যেতে চায়। এক ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর অস্থিরতা লোমকূপে রি-রি করে কাঁপে। কিন্তু মানুষ সবসময় তালা খুলতে পারে না। সব সময় রহস্যভেদ করতে পারে না, সমস্ত জীবনের উদ্যম প্রচণ্ড ব্যর্থতার অপঘাতে ধুলোকাদায় গড়াগড়ি করে। সুন্দরীর এলোকেশের মতো রহস্য জট পাকিয়ে যায়- অন্তরালের সুন্দরী ডাকে আয় আয়। মানুষ ছোটে তুরঙ্গম গতিতে। সীমিত বুদ্ধির পুঁজি নিঃশেষিত হয়, পথরেখার দুপাশে পড়ে থাকে সাদা হাড়, মাথার খুলি। সে পথে আবার যায় যাত্রী।

বস্তুত রহস্য ভেদ করবার জন্য যে ধরনের বলবান শীলিত বুদ্ধির প্রয়োজন তা অনেকের থাকে না, নানা কিছুই বুদ্ধির সতীত্ব হরণ করে। বংশক্রম, শ্রেণী, পেশা, জলবায়ু, দেশ, কাল, ধর্ম এবং রাষ্ট্র সবকিছু একযোগে বুদ্ধিবৃত্তির সতীত্ব নাশ করার মানসে ওঁত পেতে রয়েছে। সেগুলো চেকন চেকন লতার নাগপাশের মতো বুদ্ধির শীর্ষ এপাশে না হয় ওপাশে হেলিয়ে রাখে। স্বাস্থ্যপ্রদ সূর্যালোকে অভিসার করতে পারে না। এসব কিছুর দড়াদড়ি ছিঁড়ে বুদ্ধিকে প্রাকৃতিক সত্যের মতো করে বিকশিত করাই হলো বিজ্ঞানবুদ্ধি। মানুষ কি বিজ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী হতে পারে? প্রখর ইচ্ছে দিয়ে চেষ্টা করলেও পরিশীলন সে আনতে পারে? জন্ম এবং মৃত্যুর পরাক্রান্ত সীমানা মেনে নিয়ে কাজে নামতে হয়। তার জন্মের জন্য সে নিজে দায়ী নয়। যে মানুষের খেয়াল খুশিতে তার জন্ম তাদের কাছ থেকে পাওয়া রক্তধারার মধ্য দিয়ে সে তাদেরই সংস্কারের বীজাণু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে অসহায় মানব শিশু মা বাপ সমাজ সংস্কৃতি থেকে স্নেহ, প্রেম, রাগ, অনুরাগ, ক্ষোভ-দ্বেষ, বিদ্রোহ বিপ্লবের মাধ্যমে যা গ্রহণ করে, যেসব সংস্কারের জাল তাকে আটকে ধরে । জীবনকে বলা যেতে পারে চলিষ্ণু উদ্ভিদ। আবার আরেক নামেও ডাকা যায়- চিন্তান্বিত কামনা। এখন কথা দাঁড়ালো চিন্তান্বিত কামনা তরুর গতিবিধি কতদূর পর্যন্ত স্বকীয় চেষ্টা উদ্যম এবং শ্রমে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে মানুষ। শিয়রে তো মৃত্যু পরোয়ানা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীর্ঘ দিন সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে মেজে ঘষে অবচেতনকে চেতনের স্তরে এনে সত্য মিথ্যা পরখ করে দেখবে সে ফুল্ল অবসর কই? তবু মানুষ এ সংকীর্ণ সময়সীমার বাঁধনের মধ্যে নিজের বুদ্ধি এবং বোধির স্বরূপ যতদূর উপলব্ধি করতে পারে, সিদ্ধি ততদূর।

বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সীমিতি কতদূর এবং তা ভাঙার জন্য তার চেষ্টা কত বেশি শানানো এবং পরিকল্পনা কতদূর নিখুঁত– উপলব্ধির জন্য আশা করি উপরের কথা কটির প্রয়োজন আছে।

রাসেল জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের এক বনেদী পরিবারে। তার পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ কীর্তিমান ছিলেন। তার বাবা এবং এক জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়া পরিবারের সকলে ছিলেন আচারনিষ্ঠ খ্রিস্টান। খুব ছোট বয়সে রাসেল মা বাবা দুজনকে হারান। তাই পিতামহ এবং পিতামহীর আশ্রয়ে তাকে শৈশবকাল অতিবাহিত করতে হয়। তারা প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের শিক্ষায় তাকে শিক্ষিত করে তোলেন। রাসেলের চরিত্রে এবং ব্যক্তিত্বে খাঁটি খ্রিস্টানের কিছুটা রেশ রয়ে গিয়েছে তাই। সে সময়টা ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার আমল। ঐতিহাসিকেরা রাণী এলিজাবেথের যুগ থেকে ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকাল পর্যন্ত প্রসারিত সময়কে ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময়ে বাকি চারটি মহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। ইংল্যান্ডের যা গর্বের বস্তু শিল্পকলা, দর্শন এবং যন্ত্রশিল্প ঐ সময়েই বিকশিত হয়। অভিজাত শ্রেণীর ইংরেজ ভদ্রলোক যে জাতিক ও শ্ৰেণীক বীরত্বের ব্যঞ্জনা মধ্যদিনের অলস স্বপ্নে, বলনাচের আসরে অনুভব করতেন সে পরিবেশেই মানুষ হয়েছেন রাসেল। বুর্জোয়ার উন্মেষ যুগের স্বপ্ন কল্পনার উদ্দামতা যার শিল্প সংস্কৃতির শিরায় উপশিরায় তাজা শোণিতের মতো প্রবাহিনী ছিল; বর্তমান যুগে পটের স্থির চিত্রের মতো স্থবির নিশ্চল হতে পারে, কিন্তু তারও ছিল যৌবন দিন। রাসেল সম্পর্কে আরেকটি তথ্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। নইলে তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের আসল চেহারাটি ধরা নাও পড়তে পারে। তার বাবা ছিলেন নাস্তিক। তিনি উইলে লিখে গিয়েছিলেন, তার সন্তানদের শিক্ষা যেন ধর্মনিরপেক্ষভাবে দেয়া হয়। পরে এ সম্পর্কে অবহিত হলে রাসেলের মনে ঘোর প্রতিক্রিয়া হয়। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি নাস্তিকতা পেয়েছিলেন।

উনবিংশ শতকের শেষ দশকে অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজে রাসেল ছাত্র হয়ে আসেন। তার পাঠ্য বিষয় দর্শন। তিনি জার্মান ক্লাসিক্যাল দর্শনের শিরোমণি হেগেলের রচনার সংস্পর্শে আসেন। নব্য হেগেলীয়দের বিশিষ্ট একজন হিসেবে খুব শিগগির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন মার্কস এঙ্গেলসের উদ্ভাবিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের রূঢ় কঠোর আঘাতে গোটা মহাদেশে হেগেলীয় দর্শন অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছিল। মার্কসীয় চিন্তার প্রভাবে জার্মানি প্রভৃতি দেশে সংঘবদ্ধ শ্রেণীভিত্তিক আন্দোলন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। রাসেল যেহেতু শৈশবে খুবই নিঃসঙ্গ থেকেছেন, সম্ভবত সে কারণে শিগগিরই হেগেলের দর্শনের বাক সর্বস্বতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন। ঝুঁকলেন অঙ্কের দিকে। তখন কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকায় নতুন যান্ত্রিক দর্শন এবং মরমী দর্শনের স্ফুরণ হতে লেগেছে। রাসেলের যৌবনেই কাইজারের জার্মানি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাবৎ ইউরোপীয় শক্তি সে যুদ্ধে এপক্ষ ওপক্ষে অংশ নিয়েছে। লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা জারের রাশিয়ায় সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এ সমস্ত বিষয় একযোগে রাসেল মানুষটির অন্তর্লোকে রেখেছে গভীর অনপনেয় স্বাক্ষর।

উপরের ঘটনাপ্রবাহ ও ভাবনাস্রোতের নিরিখে রাসেল চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তার মহত্ব বিরাটত্ব বুঝতে পারব এমনকি তার অসঙ্গতিগুলোও বিচার করতে পারব। প্রথমত তিনি ইংরেজ। ইংরেজরা বিপজ্জনক রকমের প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। সম্ভবত ভুয়োদর্শনের প্রতি অধিক ঝোঁকের কারণেই সমস্ত ইংরেজ জাতি একজন প্রথম শ্রেণীর চিত্রকর এবং এক হবস্ বাদে কোনো বিশাল কল্পনার দার্শনিক সৃজন করতে পারেনি। বস্তুর প্রতি মোহ এবং অবারিত কল্পনার প্রতি সন্দেহসূচক দৃষ্টিভঙ্গি ইংরেজ জাতের একচেটে রাসেলেরও তা আছে। আত্মকথার গোড়ার দিকে তিনি তা স্বীকার করেছেন; ভিক্টোরিয়া যুগের বনেদী ইংরেজের রুচি তার চরিত্রের গড়নে রেশমী বস্ত্রের সুন্দর কারুকর্মের মতো ফুটে রয়েছে। নানা পরিবর্তন রূপান্তরের মধ্যেও রঙছুট হয়নি। আর সে যুগে দার্শনিকেরা মনে করতেন যুক্তির মাধ্যমে সমস্ত কিছুর সমাধান সম্ভব। তাকে তাও প্রভাবিত করেছে। শ্ৰেণীগতভাবে তিনি অভিজাত ছিলেন, কতেক কোমল মানবিক অনুভূতি এবং মানুষোচিত হৃদয়বৃত্তির অধিকারী হতে পেরেছিলেন। বুর্জোয়ার নগদ টাকার সম্পর্কে এ সম্বন্ধের উপর প্রচণ্ড একটা আঘাত হেনেছে। অভিজাত কুলে জন্ম চিরকালের জন্য তার বিপজ্জনক বিপ্লবী হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই দেখা গেছে চূড়ান্ত সময়ে যখন ঘটনাস্রোত অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করা অপরিহার্য করে তুলেছে তখনো রাসেল দুরূহ পরিশ্রম করে যুক্তি বের করে আনছেন। যে যুক্তি রাসেলের জন্য সত্য ছিল পৃথিবী তা গ্রহণ করেনি। ঘটনা ঘটেছে নিজের নিয়মে। রাসেলকে পুরনো যুক্তি আবার নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়েছে। ঘটনাস্রোতের বেগ বার বার যুক্তির গোছালো সুতো আউলা করেছে। বুদ্ধির ভাষা বোঝেন এমন সব মানুষও বিভ্রান্তিতে পড়েছেন, এখানেই রয়েছে তাকে ভুল বোঝার উৎস।

কৈশোরের নিঃসঙ্গতা নিঃসন্দেহে তার মনে প্রশ্নশীলতার বীজ বপন করেছিল। ট্রিনিটি কলেজের জ্ঞানের উত্তাপিত আবেষ্টনীর মধ্যে তার সবল অঙ্কুরণ লক্ষ্য করার মতো। রাসেলের সৌভাগ্য তিনি অনেকগুলো যুগান্তকারী প্রতিভার সঙ্গে মানসিক আলিঙ্গন করতে পেরেছিলেন। দার্শনিক জি. ই. মুর, অর্থনীতিবিদ কিস্ এবং আরো অনেক যুগন্ধর প্রতিভা তার বন্ধু ছিলেন।

আশ্বস্ত প্রতিবেশ যুবকের লজ্জা কেড়ে নিল, সে সঙ্গে নিল আল্লাহ এবং খ্রিস্টধর্মের প্রতি আস্থা। ভেতরের স্বেচ্ছাচারী শক্তি নিজের পথ কেটে প্রবাহিত হলো। হেগেলের ইতিহাসের দর্শনকে তো অগ্রাহ্য করলেনই এমনকি অন্যান্য দার্শনিকের ওভারকোটেও আত্মগোপন করলেন না। তার অন্দ্ৰি সন্ধান শিগগির জগতকে দেখার, বোঝার, বিচার করার, ঘটনা ব্যাখ্যা করার নিজস্ব একটা ভঙ্গি উদ্ভাবন করল।

আনাড়ির চোখেও ধরা পড়বে জার্মান ক্লাসিক্যাল দর্শন থেকে তিনি কতটুকু সরে এসেছেন। রাসেলের দর্শনে মৌলিক অবদান, থিয়োরি অব ডেসক্রিপসনের বিবরণ অল্প কথায় দেয়া সম্ভব নয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়ের একটা প্রাথমিক ধারণা মাত্র দেয়া যেতে পারে। ধরুন, একটা চোখ। তার বিশেষ আকার, বিশেষ গড়নভঙ্গি আর রয়েছে যান্ত্রিক নির্মাণশৈলী । সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির প্রভাবে বাইরের আলোকের প্রতিফলনে সক্ষম। যে যন্ত্রটির মাধ্যমে সম্পাদন করে এ প্রতিফলন কর্ম তাকে বলা যেতে পারে অক্ষিগোলক। এর প্রতিফলন কর্মকেই আমরা বলি দেখা। কিন্তু হেগেলীয় দর্শন চোখকে দেখবে অন্যভাবে। চোখের কোনো আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার না করে বলবে চোখ মানব শরীরের একটা অংশ। ব্যক্তি মানুষ আবার সমাজ মানুষের একটি অংশ। সমাজ যখন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় তখনই আসে সাবালকত্ব। তার মতে রাষ্ট্র মানুষের হাতে গড়া ঐশী প্রেরণার শ্রেষ্ঠ প্রতীক। ওখানে তিনি থামেননি। বিষয়টি অনেকদূর গড়িয়ে নিয়ে গেছেন। জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ ক্ষতিকর নয় বরং লাভজনক। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমেই ঐশী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবে । হেগেল জীবনে প্রাশিয়ার বাইরে যাননি, তাই জার্মান রাষ্ট্রকেই বিশ্বরাষ্ট্র বুঝতেন। এখনো হয়নি হওয়ার পথে। প্রমাণ করার জন্য বিরাট বিরাট কেতাব লিখেছিলেন। তার একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশ ছিল দর্শনের অন্তরালে, সম্রাট অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে যদি যুদ্ধ ঘোষণা করেন তাহলে শিগগির বিশ্বরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। বলা বাহুল্য, সে কর্মটি কাইজার এবং হিটলার উভয়ে করেছিলেন। হেগেলের দর্শন নিঃসন্দেহে প্রকাণ্ড মানব চিন্তার প্রকাশ। কিন্তু রাসেলের সে চোখের ব্যাপারটির কোনো সমাধান নেই তাতে।

বিষয়কে ধরে দেখা, ছুঁয়ে দেখার ইংরেজসুলভ প্রাকটিক্যালিটি তাকে হেগেলের দর্শনের স্বর্গীয় উন্মাদনা থেকে রক্ষা করেছে। বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক তত্ত্বের নিরিখে বার বার প্রায়োগিক দিকটি যাচিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। বলতে হয় তার দর্শনের এই ভঙ্গিটি তাকে করে তুলেছে সংশয়বাদী। প্রশ্ন না করে বিচার না করে কোনো কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নন। শুরুতে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখেছেন বলে লোকে ভুল বুঝেছে, কিন্তু মনটা বাঁকা ছিল না। রাসেলের দর্শনটি নমনীয় নয়। মানুষকে জ্ঞানী, বিচারশীল এবং সহনশীল করার মোক্ষম অস্ত্র। জ্ঞানী করা এবং হয়ে ওঠা এক নয়। শুধু কেতাবের বিষয় হলে দর্শন এবং দার্শনিক দুয়ের সম্মান অটুট থাকে। দৈনন্দিন জীবনের বাঁকাচোরা, ব্যক্তিক, জাতিক, আন্তর্জাতিক সমস্যার সামনে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকতে হলে দর্শন এবং দার্শনিক দুয়েরই ভাগ্যে গালমন্দ এমনকি শাস্তি পর্যন্ত জোটে। রাসেলেরও তা জুটেছে। তার দেখার দৃষ্টিতে যা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন রকম। তাই রাসেলকে মত বদলাতে হয়েছে। তার অভিপ্রায় ছিল মানুষের অন্তরের সত্য এবং জগতের সম্বন্ধে একটা স্থির সিদ্ধান্ত টেনে আনা। তাতে করে সাধারণ মানুষ তার চিন্তার সূত্র ধরতে পারেনি। অনুরাগী এবং বন্ধুজনের কাছেও রাসেলকে বিদঘুঁটে মনে হয়েছে। বস্তুত তিনি অঙ্ক, নীতিশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র এবং মনোবিজ্ঞানের নীতি মাংসল মানুষের জগতে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। ঐ সকল শাস্ত্রে রাসেলের সিদ্ধান্ত অনেক বেশি সময় কার্যকরী। দলমত নির্বিশেষে অনেকেই মনে করেন, বিশেষ বিষয়ে তার মতামত অনেক বেশি মূল্যবান এবং তা যে টেকসই হবে দ্বিমত পোষণ করার মানুষ খুবই স্বল্প । উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে উদারনৈতিক রাসেল স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে ধারণায় এসেছেন মার্কসবাদী ক্রিস্টোফার কডওয়েলও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।

এখানে একটা জিনিস ভেবে দেখার রয়েছে। অন্যান্য নামকরা ব্রিটিশ মার্কিন বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক যেখানে আপোস করে খানাখন্দের মধ্যে অঘোষিতভাবে তলিয়ে গেলেন, অনুরূপ অবস্থায় রাসেল এগিয়ে আসতে পারলেন কেন? ডি.এইচ. লরেন্সের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি খনি মজুরের ছেলে। লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিতজনের প্রতি তার সমবেদনা অনেক বেশি বাস্তব এবং ঘনীভূত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি হলেন, ফ্যাসীবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং হাতুড়ে সুলভ যৌন সর্বস্বতাবাদের প্রবক্তা। আমাদের গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। সে সন্দেহ রাসেলকে সহজ বিশ্বাসী হতে দেয়নি- কঠিনের পূজারী করেছে তার বলেই রাসেল বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। পক্ষান্তরে লরেসের মধ্যে চিন্তা ছিল না, ছিল সংবেদনা অনর্গলিত পথেই তীব্র বেগে গ্যাসের মতো বেরিয়েছে। রাসেলের ভুলচুক আছে কিন্তু তিনি চলমান মানব। তার জীবনপথের ধ্রুব নক্ষত্র দুটি। এক সত্য, অন্য স্বাধীনতা। সত্য বলতে চ্যাপ্টা এবং গোলাকার যুগপৎ, সে রকম কোনো পদার্থ নিশ্চয়ই রাসেল মনে করতেন না। সত্য চলমান, সত্য সজীব, সত্য বাঁচার আনন্দে কবির কাব্যে, বিজ্ঞানীর গবেষণায়, শ্রমজীবী মানুষের ঘাম শ্রম সংগ্রামে নিত্য মুকুলিত হচ্ছে।

জ্ঞান এবং জীবনকেও তিনি দেখেছেন একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষের জীবনের চারধারে যে অদেখা অন্ধকার কুহক সৃষ্টি করে, জ্ঞানের শাণিত তলোয়ারে হত্যা করে জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন প্রবাহিনী নদীরূপে। জীবন সুন্দর হবে, সুখী হবে, বলিষ্ঠ, ভাবনাসমৃদ্ধ হবে এবং আকাশের আয়তনে মাথাতোলা সবল ওকগাছের মতো বাড়বে; তাই তিনি জ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে কারাগার থেকে লেখা একটি চিঠিতে তা কিভাবে ধ্বনিত হয়েছে তার অংশবিশেষ উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

I want to stand at the rim of the world and peer into the darkness behind and see a little more than others have seen of the strange shapes of mystery that inhabit behind that unknown night. I want to bring back into the world of men some little bit of wisdom. There is a little bit of wisdom in the world. Heraclitus, Spinoza and a saying here and there. I want to add to it, even if only ever so little.

এই কথা কটির মধ্যে রেনেসাঁ যুগের শিল্পী মিকালেঞ্জেলোর আদম মূর্তির সম্মোহিত তরুণের স্বপ্নময়তার সঙ্গে যে বলিষ্ঠ বাসনা ফুটে বেরিয়েছে- তেমন একজন মানুষের বুকের হৃদ্স্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়। যার কামনা প্রথম মানুষটির মতো অবশ্য বাইবেলীয় অর্থে নয়। তিনি পুরনো কোনোকিছুতে নির্ভর করতে চান না। অতীতের জ্ঞানীরা ধ্যান-দৃষ্টিতে যা দেখেছেন তার বাইরে দেখতে চান, বাড়াতে চান নিজের পৃথিবীর সীমানা। সে দেখা শুধু রাসেলের দেখা নয়- তার যুগ, তার জেনারেশনের দেখা। তাই যতই দিন যাবে রাসেল স্বচ্ছ হয়ে উঠবেন।

রাসেলের আত্মকথার পাঠকের দুটি নেহায়েত মামুলি টুকিটাকির প্রতি দৃষ্টি পড়তে পারে। প্রথম যৌবনে তিনি খ্যাতি, প্রতিপত্তি কিছু কামনা করেননি। শুধু চেয়েছিলেন সন্তানের জনক হতে। একেবারে আদিম কামনা। জুলু হটেন্টটের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। প্রথম সন্তানের জনক হওয়ার সংবাদ এমন বিভোর আনন্দে পরিবেশন করেছেন নেহায়েত জৈবকর্মে বিরক্ত মানুষের মনেও একঝলক দখিনা হাওয়া সমীরিত হয়। এই মানুষী আবেগটিই রাসেলের অমরত্বের কারণ। তিনি বিশাল পুরুষ, বিখ্যাত মানুষ। কণ্ঠস্বর আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পাঁচ মহাদেশের কানে কানাকানি করে। এমন বিখ্যাত মানুষের আনন্দিত হওয়ার জন্য সুগায়কের গানের একটি কলি, জাতশিল্পীর ছবির একটু দর্শন, সবুজ বনানীর একটু অন্তরঙ্গ নিবিড় ছোঁয়া এই-ই যথেষ্ট। হাসি পাওয়ার মতো সাধারণ। সমস্ত অসাধারণেরাই অতিবেশি সাধারণ, কথাটি বোধকরি সত্য।

১৯৭০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *