৪.১ জন্ম মৃত্যু বিবাহ

৪.১ জন্ম মৃত্যু বিবাহ

জন্ম মৃত্যু বিবাহ তিন ব্যাপারেই মালোরা পয়সা খরচ করে। পাড়াতে ধুমধাম হয়।

অবশ্য সকলেই খরচ করিতে পারে না। যাদের পয়সা কড়ি নাই তারা পারে না।

তবু প্রতি ঘরেই জন্ম হয়, বিবাহ হয়, মৃত্যু হয়। এ তিনটি নিয়াই সংসার। এ তিনের সাহায্যেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। জন্মের পরে দীর্ঘ ব্যবধান অস্তে বিবাহ এবং তারপরে দীর্ঘ ব্যবধান অন্তে মৃত্যু হইয়া থাকে। ইহাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু যে সমস্ত ঘরে জন্মের পরেই মৃত্যু হইয়া যায় তারা দুর্ভাগ। কারণ তিনটি ব্যাপারেই খরচপাতি করা হইলেও বিবাহ ব্যাপারের খরচই সবচেয়ে আনন্দ ও অর্থপূর্ণ। বিবাহে যৌবনের স্মৃষ্টির যে নিশ্চিত সম্ভাবনা রহিয়াছে, সে-লোকে পৌঁছানোর পথ যেমন খাটো, তেমনি পথের দুই পাশে থাকে ফুলের বন, প্রজাপতি আর রামধনু। সে পথের শুরু হয় বসন্তের হরিৎ উত্তরীয়-বিছানো রঙিন সিড়ির প্রথম ধাপে। শেষ যখন হয় তখন দেখা যায় সবুজ তরুর ফুলের সমারোহ শেষ হইয়া সে-তরুতে ফল ধরিয়াছে।

কিন্তু সে ফল পাকিয়া শুকাইয়াও তো যায় না। তখন তার ঝরিয়া না পড়িয়া উপায় কি। কালক্রমে সে তরু বন্ধ্যা হইয়া পত্রগুচ্ছ খসিয়া শিথিল হইয়াও তো যায়। তখন তার মূল উপড়াইয়া পড়িয়া না যাইয়া উপায় কি? সেরূপ ফলের জন্যও মানুষের ক্ষোভ নাই। সেরকম তরুর জন্যও মানুষের রোদন নাই।

কেন না, জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু এ তিন নিয়াই সংসার।

এ তিন বস্তু প্রতিঘরেই স্বাভাবিক ঘটনা হইলেও এমনও ঘর দেখা যায় যে-ঘরে কোনকালে হয়ত বস্তু তিনটিকে দেখা গিয়াছিল, কিন্তু বর্তমান হইতে দৃষ্টি করিয়া সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চোখ মেলিয়া যতক্ষণই চাহিয়া থাকি না কেন—তিনটিই পর পর আসিবে এমন সম্ভাবনা দেখিতে পাই না। অতীতকে নিয়া হাসিতে পারি র্কাদিতে পারি, স্বপ্ন সাজাইতে পারি, কিন্তু ফিরিয়া তাকে পাইতে পারি না। হাতের মুঠায় পাইতে চাই তো বৰ্ত্তমান, আশায় আশায় বুক বাধিতে চাই তো ভবিষ্যৎ। কোনকালে কি হইয়াছিল সে-কথা তুলিয়া লাভ দেখি না।

একবার যে জম্মিয়াছে সে একদিন মরিবেই। কাজেই যে ঘরে মানুষ আছে মৃত্যু সে ঘরে ঘটিবেই। কিন্তু ঘরে মানুষ আছে বলিয়াই এবং সে ঘরে মৃত্যু একদিন ঘটিবে বলিয়াই জন্ম এবং বিবাহও সে ঘরে ঘটিবেই এ কথার অর্থ হয় না। তবে এমন ঘর চোখে পড়ে খুব কম এই যা।

মালোপাড়ায় এই দুর্ভাগ্যের অধিকারী একমাত্র রামকেশবের ঘর। বুড়াবুড়ির এখন ঝরিয়া পড়ার পালা। এ শুষ্ক তরুতে কখনো ফল ধরিবে, পাগলেও এ আশা পোষণ করিতে দ্বিধাবোধ করিবে। আর বিবাহ? জন্মিয়া পরে বিবাহ না করিয়া যে ব্যক্তি পাগল হইয়া গিয়াছে তার বিবাহের কথা ভাবিতে দ্বিধাবোধ করিবে স্বয়ং পাগলেও।

কোনোকালে এঘরে না পড়িবে জন্মিবার উলুধ্বনি, না শোনা যাইবে গায়ে-হলুদের গান। কিছুদিন পরে হোক অধিকদিন পরে হোক সে-ঘরে শোনা যাইবে শুধু একটি মাত্রই ধ্বনি। সে ধ্বনি শুনিয়া কেবল বুক কাঁপিবে, মনে এক ফোঁটা আনন্দ জাগিবে না।

 

কিন্তু রামকেশবের ঘর লইয়াই মালোপাড়ার সব নয়। এখানে কালোবরণের ঘরও আছে। এ-ঘর অল্পদিনের ব্যবধানে তিনতিনটা বিবাহের চেলিপর মুখ দেখিয়াছি। তিন বৌ-ই ফলন্ত লতা। তিনজনেরই পাল্লা দিয়া ছেলেমেয়ে হইতেছে। এক একটি শিশুর জন্মের উৎসবও করে জাঁকজমকের সঙ্গে। অন্নপ্রাশন করে আরও জাঁকাইয়া।

কিছুদিন আগে মেজবে সন্তানসম্ভবা হইয়াছিল। কোনোদিন স্বামীর ও নিজের খাওয়ার পর এঁটোকাঁটা ফেলিবার জন্য যদি আস্তাকুড়ের নিকটে আসিত, সেখান হইতে অনন্তর মার ঘরের সবটা চোখে পড়িত। অনন্ত তখন কতকগুলি বাঁশ বেত, একটা দা, আরো কিছু নগণ্য খেলার সামগ্ৰী লইয়া নিবিষ্ট মনে তুচ্ছ বস্তুকে প্রার্থনাতীত মর্যাদা দিবার কাজে আত্মনিয়োগ করিয়া আছে।

মেজবৌর ক্লান্তিবিকৃত মুখ আর অস্বাভাবিক রকমের দৈহিক স্ফীতির কোনো কিনারা সে করিতে পারিত না।

একদিন কালোর মাকে খুব ব্যস্ত দেখা গেল। এক দৌড়ে অনন্তদের উঠানে আসিয়া হাক দিল, ‘অনন্তর মা, জোকার দিয়া যা?’

অনন্তর মা গেল। আরো পাঁচ বাড়ির পাঁচ নারী আসিয়া মিলিত হইল। একখানা ছোট ঘরের দরজার মুখে তারা সকলে মিলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকলের মুখেই উৎকণ্ঠা। তাদের মাঝে অনন্তর মাও গিয়া দাঁড়াইল। মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল গিয়া অনন্ত। কোথা দিয়া কি হইয়া গেল, অনন্ত জানিল না। একজনে মনে করাইয়া দিবার ভঙ্গিতে বলিল, ‘ছাইলা হইলে পাঁচ ঝাড় জোকার, মাইয়া হইলে তিন ঝাড়।‘ অনন্তর নিকট একথাও অর্থহীন।

কালোর মা ঘরখানার ভিতরে থাকিয়া কি সব হুলুস্কুলু করিতেছিল, গলা বাড়াইয়া বলিল, ‘বিপদ সাইরা গেছে সোনাসকল। মন খুশি কইরা জোকার দেও।‘

নারীরা উঠান ফাটাইয়া পাচবার উলুধ্বনি করিল।

নবাগতকে মাঙ্গলিক অভ্যর্থনা জানানো শেষ করিয়া নারীরা উকি দিয়া ঘরের ভিতরটা দেখিতে চেষ্টা করিতেছে। অনন্তও সকৌতুহলে দেখিল। মেজবৌর সে স্ফীতি আর নাই। শীর্ণ। উপুড় হইয়া মাটিতে পড়িয়া আছে। চুল আলুথালু। চূড়ান্ত সময়ের প্রাক্কালে তার মুখের ভিতর নিজের চুল পুরিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সে চুল এখনো কতক কতক মুখে করিয়া বে। বেহু স হইয়া পড়িয়া আছে। রক্তে একাকার। তারই মধ্যে রক্তের চেলির মত একফালি মানুষ। ননীর মত নরম, পুতুলের মত দুর্বল। বৌর পেট ফাঁড়িয়া এত দুর্বল ছোট মানুষটি বাহির হইল কি করিয়া!

একটা নেকড়ার সাহায্যে তুলিয়া কালোর মা দরজার কাছে আনিল সমাগতা নারীদিগকে দেখাইবার জন্ত। সকলেই দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িল। অনন্ত একবার দেখিয়া পিছাইয়া গেল।

ছয় দিনের দিন ঘরে দোয়াত কলম দেওয়া হইল। এই রাতে চিত্রগুপ্ত আসিয়া সেই দোয়াত হইতে কালি তুলিয়া সেই কলমের সাহায্যে শিশুর কপালে লিখিয়া যায় তার ভাগ্যলিপি।

অষ্টমদিনে আট-কলাই। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে অনন্তরও ডাক পড়িল। খই, ভাজ-কলাই, বাতাসা সেও কোচড় ভরিয়া পাইল।

তের দিন পরে অশৌচ-অন্ত। সব কিছু ধোঁয়া-পাখ্‌লার পর নাপিত আসিয়া কালোবরণাদি তিন ভাইয়ের তের দিনের খাপছাড়া দাড়ি কামাইয়া গেল। মন্ত্র পড়িয়া পুরোহিত উঠিয়া গেলে, উঠানে একটি চাটাই পাতিয়া তাতে ধান ছড়াইয়া দেওয়া হইল। নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, নূতন একটা রঙিন বড় রুমালে জড়াইয়া ছেলেকোলে মেজবে বাহির হইল! চাটাইর উপর উঠিয়া ধানগুলি পা দিয়া সারা চাটাইয়ে ছড়াইয়া দিল। এদিকে পুরনারীরা এক সঙ্গে গলা মিলাইয়া গাহিয়া চলিল, ‘দেখ রাণী ভাগ্যমান, রাণীর কোলেতে নাচে দয়াল ভগবান। নাচ রে নাচ রে গোপাল খাইয়া ক্ষীর ননী, নাচিলে বানাইয়া দিব হস্তের পাচনি। একবার নাচ দুইবার নাচ তিনবার নাচ দেখি, নাচিলে গড়াইয়া দিব হস্তের মোহন বাশি।‘

দক্ষিণা দিয়া বিদায় করিতে করিতে কালোবরণ পুরোহিতকে বলিল, দেখেন ত কর্ত, মুখে-পস্‌সাদের ভাল দিন নি আছে। দুই কাম এক আয়োজনেই সারা করতে চাই, কি কন।‘

পঞ্জিকা দেখিয়া পুরোহিত বলিয়া দিল, পরশুই একটা ভাল দিন অন্নপ্রাশনের।

ছোটবউর ছেলে বাড়িয়া উঠিতেছে। বসিয়া নিজের চেষ্টাতে মাথা ঠিক রাখিতে পারে। কিন্তু ইদানীং অত্যন্ত পেটুক হইয়া উঠিয়াছে। যাহা পায় খাদ্যাখাদ্য বিচার না করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়। কালোর মা বলে, মুখে-প্রসাদ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

কাজেই দুইদিন পরেই বাড়িতে আরো একটা উৎসবের আয়োজন হইল।

সেদিনও অনস্তর মার ডাক পড়িল। আরো অনেক নারীর ডাক পড়িল। গীত গাহিবার জন্য।

প্রথমে স্নানযাত্রা। ছেলেকোলে ছোটবোঁকে মাঝখানে করিয়া গান গাহিতে গাহিতে নারীরা তিতাসের ঘাটে গেল। ছোট বোঁ তিতাসকে নিজে তিনবার প্রণাম করিল, ছেলেকেও তিনবার প্রণাম করাইল। এক অঞ্জলি জল লইয়া তার মাথ৷ ধোঁয়াইল। শাড়ির আঁচল দিয়া মুছিয়া নদীকে আবার নমস্কার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

এক মুহূর্ত বিশ্রাম করিয়া তার চলিল রাধামাধবের মন্দিরে। সঙ্গে একথালা পরমান্ন। সেখানে পরমান্নকে নিবেদন করিয়া প্রসাদ করা হইল। ছোট বউ একটুখানি তুলিয়া ছেলের মুখে পুরিয়া দিল, বাকি সবটাই উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হইল।

 

মালোর বিবাহে সবচেয়ে বেশি উল্লাস পায়। বিবাহ করিয়া সুখ, দেখিয়া আনন্দ। বিবাহ যে করিতেছে তার তো সুখের পার নাই। পাড়ার আর সব লোকেরাও মনে করে, আজকের দিনটা অতি উত্তম।

যারা সবচেয়ে প্রিয়, যারা সবচেয়ে নিকটের, তাদের বিবাহ করিয়া বউ লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে দেখিলে মালোর খুব খুশি হয়। যে বিবাহও করিতে পারে না, সে রাত কাটায় নৌকাতে। এ পাড়ার গুরুদয়াল সেই দলের। বয়স চল্লিশের উপর।

তার সঙ্গে একদিন নৌকাতে কালোবরণের ছোট ভাইয়ের ঝগড়া হইয়া গেল।

গুরুদয়াল বলিয়াছিল সেদিন বাজারের ঘাটে, তিন বিবাহের তিন ছেলের বাপ হইয়া শ্যামসুন্দর বেপারি আবার যদি বিবাহ করে তো পুবের চাঁদ পশ্চিমে উদয় হইবে।

কালোর ভাই প্রতিবাদ করিয়াছিল, রাখিয়া দেও। কাঠের কারবার করিয়া অত টাকা জমাইয়াছে কোন দিনের জন্তে। শেষকালে স্ত্রী কাছে না থাকিলে বেপারি কি রাত কাটাইবে তুলার বালিশ বুকে লইয়া? একবার যখন মুখ দিয়া কথা বাহির করিয়াছে, তখন বিবাহ একটা না করিয়া ছাড়াছাড়ি নাই।

‘হ। কইছ কথা মিছা না। শেষ-কাটালে ইস্তিরি কাছে না থাকলে মরণ-কালে মুখে একটু জল দিবে কেডায়? পুত ত কুত্তার মুত।‘

কালোর ভাই সম্প্রতি একটি পুত্র লাভ করিয়াছে। সে এখন পুত্রগর্বে গর্বিত। পুত্র জাতটার উপর এই একচেটিয়া অপবাদ দিতে দেখিয়া সে চটিয়া উঠিল, “তুমি যেমুন আঁটকুড়ার রাজা, কথাখানও কইছ সেই রকম।

পিতৃত্বহীনতার অপবাদ। অসহ। গুরুদয়ালের মুখ দিয়া অভিশাপ বাহির হইল, ‘অখন থাইক্যা তোরেও যেন ঈশ্বরে আঁটকুড়া বানাইয়া রাখে।‘

‘দূর হ, শ্যাওড়াগাছের কাওয়া, এর লাগি-ঐ তোর চুল পাকছে, দাড়ি পাকছে, তবু শোলার মুটুক মাথায় উঠ্‌ল না।’

‘নইদার পুতে কি কয়! আমার মাথায় শোলার মুটুক উঠ্‌ল না, তার লাগি কি তোর মাথা মুয়ান লাগছে দশজনের বৈঠকে? আমি কি রাইতকালে গিয়া তোর ঘরের বেড়া ভাঙছি কোনোদিন, কইতে পারবে?’

‘খাড় হেই শালা গুরু-দাওয়াল, অখনই বাপের বিয়া মার সাঙ দেখাইয়া দেই।‘

এ নৌকা হইতে কালোর ভাই লগির গোড়া গুরুদয়ালের মাথা লক্ষ্য করিয়া ঘুরাইল। ও নৌকা হইতে গুরুদয়ালও একটি লগি তুলিয়া আঘাত করিতে উদ্যত হইল।

নৌকার অন্যান্য লোক ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। কেউ বলিল, ‘আরে রামনাথ ক্ষেমা দে।‘ কেউ বলিল, ‘ও গুরুদওয়াল, ভাটি দেও। রামনাথ অবুজ হইতে পারে, তুমি ত অবুজ না।‘

 

শেষে কালোর ভাইয়ের কথাই ঠিক হইল। শ্যামসুন্দর বেপারি উত্তর মুলুক হইতে কাঠ আনাইয়া এখানে কারবার করে। সেই মুলুক হইতে একটা লোক রেলগাড়িতে করিয়া বৌ-নিয়া তার বাড়িতে আসিল। শামসুন্দরের নিজে যাইতে হইল না। চিঠিপত্রেই সব হইয়া গেল।

যেদিন বিবাহ হইবে সেদিন বৈকালে কয়েকজন বর্ষীয়সী অনন্তর মার বাবান্দায় পাড়া-বেড়াইতে আসিল। তারা প্রথমেই তুলিল আজকের বিবাহের কথা।

একজন বলিল, ‘নন্দর-মা আছিল বেপারির পয়ল বিয়ার বৌ আমার বাপের দেশে আছিল তারও বাপের বাড়ি। এক বছরই দুইজনার জন্ম, বিয়াও হইছে একই গাওয়ে। সে পড়ল বড় ঘরে আমি পড়লাম গরীবের ঘরে। তার হাতে উঠল সোনার কাঠি আমার হাতে ভাতের কাঠি। থাউক সেই কথা কই না, কই ভইন এই কথা, আজ যার সাথে বিয়া হইতাছে—এযে নন্দর-মার নাতিনের সমান। এরে লইয়া বুড়া করব কি গো? এর যখন কলি ছিট্‌ব বুড়া তখন ঝইরা পড়ব।‘

অন্যমনস্ক অনন্তর মার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া অন্ত একজন বলিল, ‘কাকের মুখে সিন্দুইরা-আম লো মা।‘

তৃতীয়ার মনের বনে রঙের ছোঁয়া লাগিয়াছে। প্রবীনা হইলেও মন বুঝি তার মস্‌গুল। পরের বিবাহের বাজনা শুনিলেই নিজের বিবাহের দিনটির কথা মনে পড়ে। মনের খুশি চাপিতে না পারিয়া অনন্তকে লইয়া পড়িল, ‘কিরে গোলাম! বিয়া করবি?’

বিবাহের কথা অনন্ত তিন চার দিন ধরিয়া শুনিতেছে। কথাবার্তার ধরণ হইতে আসলবস্তু কিছু বুঝিতে না পারিলেও এটুকু বুঝিয়াছে বিবাহ করা একটা খারাপ কিছু নয়। অতি সহজভাবে সে উত্তর দিল, ‘করমু।’

‘ক দেখি, বিয়া কইরা কি করে।’

প্রশ্নটা একটু জটিল ঠেকিল। কিন্তু খানিক বুদ্ধি চালনা করিয়া বেশ সপ্রতিভ ভাবেই জবাব দিল, ‘ভাত রান্ধায়।’

‘হি হি হি, কইতে পারলি না গোলাম, কইতে পারলি না। বিয়া কইরা লোকে বৌয়ের ঠ্যাং কান্ধে লয়, বুঝলি, হি হি হি।’

উত্তরটা অনন্তর মনঃপুত হইল না মোটেই। ভাবিল উহু, এ হইতেই পারে না। কিন্তু সত্য হইলে ত বিপদ।

‘আমারে বিয়া করবি?’

মোটা মোটা ঠ্যাং দুটির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাইয়া অনন্ত বলিল, ‘না।’

 

সন্ধ্যার পর মার সঙ্গে বিবাহ দেখিতে গিয়া অনন্ত বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া গেল। সে যেন বিবাহ দেখিতেছে না, একটা চমৎকার গল্প শুনিতেছে। প্রভেদ শুধু এই, গল্প যে বলিতেছে তাকে দেখা যাইতেছে না, আর তার কথাগুলি শোনা যাইতেছে না। সে যা যা বলিতেছে অনন্ত সে-সব চোখের সামনে দেখিতেছে।

সামনে যে টোপর মাথায় চুপ করিয়া বসিয়া আছে, সে বিরাট এক দৈত্য। ছোট মেয়েটাকে তার দলের লোকেরা ধরিয়া আনিয়া তার গুহার মধ্যে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েটা চাহিয়া দেখে চারিদিকে লোকজন, পালাইবার চেষ্টা করিয়া কোন ফল হইবে না। তার চেয়ে এই ভাল। আপাততঃ দৈত্যকে ঘুরিয়া প্রদক্ষিণ করিতে করিতে তার মাথায় ফুল ছড়াইয়া তাকে তুই রাখা চলুক। তার লোকজন অন্যমনস্ক হইলে যেই একটু ফাক পাওয়া যাইবে অমনি মেয়েটি এখান হইতে পলাইয়া যাইবে। কোথায় যাইবে? যেখানে তার জন্য খেলার সার্থীরা প্রতীক্ষা করিয়া আছে। পালাইয়া অনন্তদের বাড়ীতে গিয়া উঠিলে মন্দ হয় না। মা তাকে কিছুদিন লুকাইয়া রাখিবে। দৈত্যটা তাকে পাড়াময় বৃথাই খুঁজিয়া মরিবে। পাইবে না। অবশেষে একদিন মনের দুঃখে তিতাসের জলে ডুবিয়া মরিবে।

অনন্তর ধ্যান ভাঙ্গিল তখন, যখন বড় বাতাসার হাঁড়ি হাতে একজন একমুঠা বাতাসা তুলিয়া তার হাতের কাছে নিয়া বলিল, ‘এই নে, বাতাসা নে। কোন দিকে চাইয়া রইলি?’

অনন্ত হাত পাতিয়া বাতাসা লইল। ততক্ষণে বিবাহ শেষ হইয়া গিয়াছে এবং বিবাহ সমাপ্তির মধু-চিহ্ন রূপে নাপিত ভাই ‘গুরুবচন’ বলিতেছে—

শুন শুন সভাজন শুন দিয়া মন,
শিবের বিবাহ কথা অপূর্ব কথন।
কৈলাস-শিখরে শিব ধ্যানেতে আছিল,
উমার সহিতে বিয়া নারদে ঘটাইল।
শিবেরে দেখিয়া কাঁদে উমাদেবীর মা,
এমন বুড়ারে আমি উমা দিব না।…
শিবেরে পাইয়া উমা হরষিত হইল,
সাঙ্গ হইল শিবের বিয়া হরি হরি বল।

গুরুবচনের মাঝখানটায় শ্যামসুন্দর চমকাইয়া উঠিয়াছিল : এ সব কথা ঠিক তাহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিতেছে না ত! যা হোক, বচনের শেষের দিকটা আশাপ্রদ। উমার মা যাহাই মনে করুক না কেন, উমা নিজে খুশি হইয়াছে।

বিবাহবাড়ি খালি হইবার আগেই অনন্তর মা অনন্তকে হাত ধরিয়া বাড়ির পথে পা দিয়াছিল। পথে চলিতে চলিতে হাতের বাতাসাগুলিকে অনন্তর অকিঞ্চিৎকর মনে হইতে লাগিল। মনের দিক দিয়া সে এই একটি দিনের অভিজ্ঞতাতেই অনেকখানি আগাইয়া গিয়াছে। কয়েকটা অজানার আগল ধীরে ধীরে খুলিয়া গিয়াছে।

এই বিবাহেও শ্যামসুন্দর অনেক টাকা খরচ করিয়াছে। মালোপাড়ার সবাইকে পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইয়াছে।

কিন্তু কালীপূজাতে হয় সব চাইতে বেশী সমারোহ। বিদেশ হইতে কারিগর আসে। পূজার একমাস আগে মূর্তি বানানো শুরু হয়।

প্রকাণ্ড বাঁশের কাঠামটা ছিল অনন্তর চোখে পরম বিস্ময়। তৈরী করিতে পাঁচদিন লাগিল। এক বোঝাই খড় আসিলে, পাটের সরু দড়ি দিয়া খড় পেঁচাইয়া তৈরী হইল নির্মস্তক সব মূর্তি। সেগুলি কেবল বাঁশের উপর খাড় করা; খাড়া কাঠামে পিঠ-লাগানো। মানুষের আকার নিয়াছে হাত পা শরীরে, নাই কেবল মাথা।

একদিন এক বোঝাই মাটি তিতাসের ঘাটে লাগিল। ছোট করিয়া কাটা পাটের কুচি সে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া জল ঢালিয়া মালোর ছেলেদের জিন্মায় দেওয়া হইল। তারা নাচিয়া কুদিয়া পাড়াইয়া মাড়াইয়া সে মাটি নরম করিল। এই মাটিতে আকাশ-ছোঁয়া মূৰ্তি তৈয়ার হইবে। সে মাটির কাজ করা বড় গৌরবের, বিশেষ ছেলেদের পক্ষে।

কারিগরেরা সে মাটি লাগাইয়া দেহ সংগঠন করিল। মূতির গলার উপর যেদিন মাথা পরান হইল সেদিন মনে হইল এত বড় মূর্তি যেন কথা কহিতে চায়।

মূর্তির গায়ে খড়িগোল লাগাইয়া পালিশ করাতেই অনন্ত ভাবিল কারিগরের কাজ ফুরাইয়াছে, এই মূর্তিরই পূজা হইবে।

‘মূর্তি ত বানান হইল, পূজা কোন দিন?’

‘দূর বলদ, মূর্তির অখনো মেলাই বাকি। সাদা খড়ির উপরে রঙ লাগাইব, নানান রঙের রঙ। যেদিন চক্ষুরদান হইব, সেইদিন কাম সারা। পূজা হইব সেইদিন রাইতে।‘

সুবিজ্ঞ সাথীর আশ্বাস অন্তরে নিয়া অনন্ত পরের দিন গেল। কিন্তু নিরাশ হইল। পাল খাটাইয়া মণ্ডপের সামনাটা ঢাকিয়া দিয়াছে। কারিগরদের যাওয়া-আসার জন্য একটুখানি ফাক আছে এক কোণে। সেখানে চোখ ডুবাইয়া দেখা গেল ছোট ছোট অনেক বাটিতে অনেক জাতের রঙ গোল রহিয়াছে। সেই রঙে তুলি ডুবাইয়া কারিগরের দ্রুত বেগে চালাইতেছে, আর প্রতিমা প্রতিক্ষণে নব নবরূপে বিচিত্র হইয়া উঠিতেছে।

 

কালোর-মা-ই নির্দিষ্ট করিয়া দিল, কাল যে কালীপূজা হইবে, তাতে কালোর-মা, অনন্তর-মা আর বৃন্দার-মা সংযমী থাকিবে। সংযমী যারা থাকে তারা আগের দিন নিরামিষ খায়, পূজার দিন প্রাতঃস্নান করে। পূজার জল তোলে, ফুল বাছাই করে, ভোগ নৈবেদ্য সাজায় আর ফুলের মালা গলায় নামাবলী গায়ে যে পুরোহিত পূজায় বসে তার নির্দেশ মতো নানা দ্রব্য আগাইয়া দেয় এবং প্রতিমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত নানা কাজ করে। কম গৌরবের কথা নয়। তারা পুরোহিতের সাহায্যকারিণী। অর্ধেক পূজা তারাই সমাধা করে। পুরোহিত তো কেবল মন্ত্রের জোরে। অনন্তর মার গৌরব বাড়িল। কিন্তু সুবলার বৌয়ের জন্য দুঃখ পাইল। সে এসব কাজে কত পাক অথচ কালোর মা তাকেই কিছু বলিল না।

সারাদিন এক ফোঁটা জল মুখে না দিয়া কারিগরেরা তুলির শেষ পোঁচ লাগাইয়া যখন পরদা সরাইল, আকাশের আলো ফুরাইয়াছে বলিয়া তখন পালের নিচে গ্যাসের আলোর আয়োজন চলিতেছে।

মা বলিয়া দিয়াছে, অত বড় প্রতিমা, প্রথমে পায়ের দিকে চাহিও, তারপর ধীরে ধীরে চূড়ার দিকে। একেবারেই মুখের দিকে চাহিলে ভয় পাইবে। সে-কথা ভুলিয়া গিয়া অনন্ত একেবারেই মুখের দিকে চাহিল কিন্তু ভয় পাইল না।

একটু পরেই দেখা গেল নৈবেদ্য হাতে করিয়া মা পূজারিণীর বেশে মণ্ডপে ঢুকিতেছে। শুদ্ধ শান্ত ধবলী বেশ। নূতন একখানা ধবধবে কাপড় পরিয়াছে মা। কোথায় পাইয়াছে কে জানে! কিন্তু এই বেশে মাকে যা সুন্দর দেখাইতেছে। মণ্ডপের বাহিরে একটা বাঁশবাঁধা। তার ওপাশে কাহাকেও যাইতে দেয় না। কেউ গেলে ধমক খাইয়া ফিরিয়া আসে। এ অভিজ্ঞতা তার নিজেরও হইয়াছে। আর তারই মা কিনা অত সব পূজাসামগ্ৰী লইয়া মণ্ডপের ভিতরে একেবারে প্রতিমার গাঁ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়াছে! এত কাছে যারা যাইতে পারিয়াছে তারা সামান্ত নয়। অনন্তর মত এত সামান্ত ত নয়ই, তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেবতার কথাবার্তা চলে। মার প্রতি অনন্তর অনির্বচনীয় শ্রদ্ধা জন্মিল। অথচ এই মা’ই তাহাকে কোলে তুলিয়াছে, খাওয়াইয়াছে পরাইয়াছে। একান্ত ইচ্ছা করিতেছে মা একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করুক। তার দৃষ্টির প্রসাদ ঝরিয়া পড়ুক অনন্তর চোখেমুখে। কিন্তু না, বড় দুর্ভাগা সে। মা কোনোদিকে না চাহিয়া চলিয়া গেল। একবার চাহিয়াও দেখিল না, তারই ছেলে অনন্ত দীনহীনের মত দূরে দাঁড়াইয়া। মার জন্য অনন্ত খুব গর্ববোধ করিল।

 

তারপর অনেকক্ষণ মাকে আর দেখা গেল না। বোধ হয় বাড়ি চলিয়া গিয়াছে।

বাহিরে অমাবস্যার অন্ধকার। পালের বেড়া দেওয়া তীব্র আলোর রাজ্য হইতে বাহির হইয়া একেবারে অন্ধকারের সমুদ্রে গিয়া পড়িল। কোনমতে পথ চিনিয়া বাড়িতে আসিয়া দেখে দ্বার বন্ধ। মা আসে নাই। এত রাত। এত অন্ধকার। সে এখন যায় কোথায়। আবার সেখানে একা একা ফিরিয়া যাওয়া। একথা যে ভাবাও যায় না। তবু যাইতে হইবে। দুঃসাহসের জয়যাত্রা তাকে এখনই শুরু করিতে হইবে। তুর্জয় সাহসে বুক বাঁধিয়া অনন্ত কোনো দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া চলিল। গল্পের মধ্যে যাদের কথা সে শুনিয়াছে এখন তাদের সঙ্গে যদি দেখা হইয়া যায়। না তাদের কারো সঙ্গেই পথে দেখা হইল না। তার বোধ হয় জানে না অনন্ত আঁধারে একা এপথ দিয়া যাইতেছে। জানিলে আসিত। অনেক লোক লইয়া তাদের কারবার। অনন্তর মত এত ছোট মানুষ কাউকে ভুলিয়া যাওয়া তাদের অসম্ভব নয়। তার আত্মসন্মানে আঘাত পড়িল। সে তাদের কথা আত জানে, অথচ অনন্তর কথা তারা জানে না।

এই বাড়িতেই পূজার সবকিছু দ্রব্য রাখা হইয়াছে। তার মা এই বাড়িতেই কোনো একটা ঘরে আছে হয়ত। অনেকগুলি পুজার উপকরণ সামনে লইয়া প্রদীপের পাশে বসিয়া আছে প্রতিমার মত। কাছে দেখিতে পাইয়া অনন্তকে তাড়াইয়া দিবে না ত? পূজার জন্য মা তার কাপড়খানা পরিষ্কার করিয়া দিলেও, মার মত অত পরিষ্কার নয়। আর তাকে অত সুন্দর কোনোকালেই দেখাইবে না। তবে ত এখন মার কাছে যাওয়া ঠিক হইবে না। কিন্তু আজ অন্ধকারে যে দুরন্ত সাহসের কাজ সে করিয়া ফেলিয়াছে, মা যদি তাহ। জানে তবে নিশ্চয় তাকে কাছে ডাকিয়া নিয়া কোলে ঠিক না বসাইলেও পাশে বসাইয়া বলিবে, তুমি অমন ভাবে আঁধারে এক পথ চলিও না। সে বলিবে, তাতে কি মা, আমার তেমন ভয় করে নাই ত। মা বলিবে, তোমার ভয় না করিতে পারে কিন্তু আমার ভয় করে। তুমি আঁধারে হারাইয়া গেলে তোমার মত এমন আর একটি অনন্তকে আমি কোনকালে পাইব না। মা তাহা হইলে সত্য কথাই তো বলিবে। কোথায় পাইবে আমার মত আরেকটিকে। তেমন কাউকেও দেখি না ত। না, মাকে কথাটা বলিতেই হইবে।

একটা ঘরের দিকে আগাইয়া গেল। দরজা খোলা। ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। তার আলোয় উঠানটাও কিঞ্চিৎ আলোকিত। এই আলোতে একটি ছেলেকে সন্দিগ্ধভাবে ঘুরিতে দেখিয়া কারো মনে সন্দেহ ঢুকিয়া থাকিবে, ছেলেট পূজার কোনো দ্রব্য চুরি করিবার তালে আছে। সে খুব জোরে এক ধমক দিল। অনন্ত মাকে খুঁজিতেছে একথা বলিবার অবসর পাইল না। লোকটা আগাইয়া আসিয়া সরিবার পথ দেখাইলে অনন্ত নীরবে পূজামণ্ডপে চলিয়া আসিল।

তাকে অসহায়ের মত দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া কে একজন দয়াপরবশ হইয়া তার দিকে চাহিল।

‘এই, তুই কার ঘরের?’

অনন্ত এ প্রশ্নের অর্থ বুঝিল না।

‘ও পুলা, তোর বাপ কেডা?’

বাপ নামক পদার্থটা যে কি, অনন্ত তাহা কিছু কিছু বুঝিতে পারে। এই পাড়ার সমবয়সী অনেক ছেলেরই বাপ নামক এক একটি লোক আছে। বাজারের ঘাট হইতে ছোলাভাজা মটরভাজা বিস্কুট কমলা কিনিয়া দেয়। সকালে রাতের জাল বাহিয়া আসিয়া কারে বা কোলে নেয়, কারে বা চুমু খায়, কারে বা মিছিমিছি কাদায়। দুপুরে নিজহাতে তেল মাখাইয়া তিতাসের ঘাটে নিয়া স্নান করায়। পাতে বসাইয়া খাওয়ায়। মাছের ডিমগুলি বাছিয়া বাছিয়া মুখে তুলিয়া দেয়। এসব অনন্তর একদিনের দেখা অভিজ্ঞতা নয়। অনেকদিন দেখিয়া, মনে মনে পর্যালোচনা করিয়া তবে সিদ্ধান্তে আসিয়াছে যে, বাপের এইসব করে। আরো দেখিয়াছে মালো-পাড়ার ছেলেদের গায়ে যে লাল-নীল জামা, এসবও ঐ বাপেরাই কিনিয়া দেয়। যাদের বাপ আছে তারা শীতে কষ্ট পায় না। অনন্ত শীতে কষ্ট পায় তার বাপ নাই বলিয়া। এ ঠিক মার কাজ নয়। কিন্তু তারও বাপ থাকিতে পারে বা কেউ একজন ছিল এ প্রশ্ন কোনোদিন তার মনে জাগে নাই। মাও কোনোদিন বলিয়া দেয় নাই। অথচ মা কত কথা বলিয়া দেয়। বড় অদ্ভূত প্রশ্ন। আগে কেউ এ প্রশ্ন করে নাই। অনন্ত এর কোনো জবাব খুঁজিয়া পাইল না।

‘তুই কার লগে আইছস্?’

এইবারের প্রশ্নটি সোজা। একটু আগেই সে আঁধার জয় করিয়া আসিয়াছে। সঙ্গে তার কেউ ছিল না। জানাইল, একলা আসিয়াছে।

‘এ বলদটা কার ঘরের রে বিপিন?’

বিপিন নামক যুবকটি প্রশ্নকর্তার কৌতুহল এই বলিয়া নিবৃত্ত করিল, তুমি থাক পরের গ্রামে, নিজের গ্রামে কে গেল কে আসিল তুমি কি করিয়া জানিবে। এর মা বিধবা। গায়ে নূতন আসিয়াছে। কালোবরণ বেপারির বাড়ির কাছে বসতি নিয়াছে। রাত পোহাইলে দেখিয়া যাইও ছোট ঘর খানাতে থাকে খায়।

বিপিন একটা পাতলা কাঁথা গায়ে জড়াইয়া উত্তর দিতেছিল। লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়া বলিল, ‘ছোট ঘরে বসত করে বড় গুণবতী। হি হি হি।’

অনন্ত কি ভাবিয়া প্রতিবাদ করিল, না না।

কিন্তু তাকে শীতে কাঁপিতে দেখিয়া একজন নিজের দিকে হাতছানি দিয়া ডাকিল।

 

মণ্ডপের সামনে টিনের চাল বাঁশের খুঁটি দিয়া একখানা ঘরের মত খাড়া করিয়া সামনের দিক খোলা রাখিয়া আর তিনদিক চটে মুড়িয়া দিয়াছে। পূজা হইবে অনেক রাতে। ছেলে বুড়া অনেকেই কাথা নিয়া আসিয়া সেই ঘরের চটের ঢাল বিছানার উপর এখনই শুইয়া পড়িয়াছে। সেই ঘর আর মণ্ডপের মাঝামাঝি স্থানে মোটা মোটা আমের কাঠ দিয়া সারা রাতের মত আগুনের ধুনি করিয়াছে। ইহাকে ঘিরিয়া দশ বার জনে গায়ে গাঁ ঠেকাইয়া বসিয়াছে। হাঁড়ি ভরা তামাক টিকা কাছেই আছে। পাঁচ ছটা হুঁকা জ্বলিতেছে নিবিতেছে। আগুনের তাপে আর তামাকের ধকে তারা একসঙ্গে উত্তাপিত হইতেছে।

এদের সকলেরই দেহে বয়সের ছাপ। কান পর্যন্ত ঢাকিয়া মাথা বাঁধা। কারো কারো গায়ে স্থতি-কম্বল, অনেকের গায়ে কথা। তার উপর মুখে দাড়ি-গোফের জঙ্গল। এই তীব্র আলোকের উজ্জ্বলতায় তাহাদিগকে অপার্থিব দেখাইলে তাহা অনন্তর চোখের দোষ নয়। তাদেরই একজনের আহবানে অনন্ত ধীরে ধীরে দ্বিধা-সঙ্কুচিত চিত্তে তার কাছে গিয়া দাঁড়াইল।

‘শীত করে?’

অনন্ত ঘাড় কাত করিয়া জানাইল, ‘করে।’

‘পিরাণ নাই?’

মাথা নাড়িয়া জানাইল, ‘নাই।‘

‘ইখানে বইয়া পড়্‌। শরতকাকা, একটু ঘুইরা বও। জাগা দেও। কাঁপ্‌তাছে।

অনন্ত ঠিক তাদেরই মত করিয়া বসিল। তাদেরই মত করিয়া হাত বাড়াইয়া আগুনের উষ্ণতা ছিনাইয়া আনিয়া গালে মুখে মাখাইতে লাগিল।

সুবলার-বৌ পূজার আয়োজন দেখিতে আসিয়াছিল। ভাড়ার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া ডাকিল, ‘অ দিদি, অ অনন্তর মা, দেইখা যাও তোমার অনন্তর কাণ্ড। বুড়ার দলে মিশ্যা তোমার পুলা বুড়া হইয় গেছে।’

পূজার নৈবেদ্যগুলি সাজাইবার পর এই এখন তার ছেলের কথা মনে পড়িয়াছিল। মনে করিয়াছিল হাতে যখন কাজ নাই তখন ছেলেটাকে একবার তালাস করিয়া আসি। এমন সময় সুবলার বৌর ডাক। দেখিয়া তারও হাসি পাইল। বড় করুণও জাগিল ছেলের উপর। ছেলের কেবল আধখানা পিঠ তখন দেখা যাইতেছে। সাতপরতা মেঘে যেমন চাঁদ ঢাকা পড়ে, অনন্তর দেহখানাও বুড়াদের জবর-জঙ্গিমার আড়ালে তেমনিভাবে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। মা কতক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল। একসময়ে দেখা গেল, একখানা ছোট হাত দুইপাশের বুড়া দুইজনার কথা-কাপড় সরাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টা করিতেছে। কারণ, এই সময় ঠাণ্ডা বাতাস অনুভব করিয়া বুড়ার আগুনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করিতেছিল। যাই হোক, চকিতের মধ্যেই মেঘের রাশি অপসারিত করিয়া ছোট মুখখানা জাগিয়া উঠিল। মা এদিকে আছে তারই জন্য বোধ হয় চাঁদ এদিকে ফিরিয়া দেখা দিল।

সে-চাঁদ অগৌণে আবার মেঘে-ঢাকা পড়িল। ভাল মানুষের দলেই গিয়া মিশিয়াছে, এই কথা বলিয়া মাও আগৌণে কার্যান্তরে চলিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *