৪.১০ আকাশে চাঁদ উঠল

রাত এগারোটার সামান্য কিছু পরে আকাশে চাঁদ উঠল। ক্ষয়প্রাপ্ত চাঁদকে মনে হলো ক্লান্ত। সমতল ভূমিতে এর অস্পষ্ট আলো ছড়িযে পড়ল। অস্পষ্ট আলোয় সব কিছু দেখা গেল কিছুটা ঝাপসাভাবে। ব্রিজের কাছে চাঁদের আলো খুব কম পড়ছিল। রেল লাইনের ধারে উঁচু বাঁধের জন্য এলাকাটি ঝাপসা দেখাচ্ছিল।

সিগন্যালের কাছে মেশিনগান রাখার জায়গাটি বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। রেল লাইনের দু’পাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বালির বস্তা পড়ে ছিল। সিগন্যালের খুঁটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন মনে হয়, অনেক প্রহরী এক সাথে এলাকাটি পাহারা দিচ্ছে। দু’টো বড় ডিম্বাকৃতি চোখের মতো-একটার ওপরে আরএকটা, বস্তু থেকে লাল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। সিগন্যালের দু’টো অংশ আড়াআড়ি সমান্তরাল অবস্থায় ছিল। নদী তীরের ঝোপ-ঝাড় জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছিল। নদীর পানি চকচক করছিল না। শান্ত নদীর পানিতে মাঝে মাঝে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল।

নদীর তীর থেকে সামান্য দূরে একটা ঝোপের পরে খালি জায়গায় একটা জীপ দাঁড়িয়ে ছিল। এর ইঞ্জিনের শব্দ হচ্ছিল। গাড়িতে কেউ ছিল না। জীপের লোকরা গাড়ি থেকে নেমে রেল লাইনের দুধারে কয়েক ফুট অন্তর ব্যবধানে বসে ছিল। দুপায়ের মাঝে রাইফেল ও বর্শা নিয়ে তারা অপেক্ষায় ছিল। ব্রিজের প্রথম লোহার খুটিতে আড়াআড়িভাবে একটা মোটা দড়ি বাঁধা ছিল। রেল লাইন থেকে প্রায় কুড়ি ফুট ওপরে দড়ি বাঁধা ছিল।

এলাকাটি এমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল যে, একজন অন্যজনকে চিনতে পারছিল। না। এ কারণে তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল। একজন আহ্বান জানাল:

চুপ কর! শোন!

তারা চুপ করে শুনল। কিছুই শোনা গেল না। শোনা গেল কেবল নলখাগড়া বনে বাতাসের শব্দ।

চুপ করে থাক, নেতার আদেশ শোনা গেল। এভাবে কথা বলতে থাকলে তোমরা সময়মতো ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবে না।

অতঃপর তারা চাপা গলায় কথা বলতে লাগল।

সিগন্যালের একটা অংশ ডাউন হওয়ার সময় ষ্টিলের তারের সঞ্চালনে শিন শিন আওয়াজ শোনা গেল। ডিম্বাকৃতি সিগন্যালের চোখ লাল রং থেকে সবুজে পরিণত হলো। চাপা গলায় কথা বলা থেমে গেল। লোকগুলো দাঁড়িয়ে রেল লাইন থেকে মাত্র দশ গজ দূরে অবস্থান নিল।

ট্রেনের শব্দ শোনা গেল। শোনা গেল হুইসেলের শব্দ। একজন রেল লাইনের ওপর কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল।

চলে এসো, বোকা কোথাকার, কৰ্কশ শব্দে চাপা কণ্ঠে নেতা বলল।

ট্রেন আসছে, নিশ্চিত হয়ে সে গর্বের সাথে বলল।

নিজের জায়গায় ফিরে যাও, আবার নির্দেশ এলো নেতার।

ধূসর শূন্যতার দিকে সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল। ঐদিক থেকেই ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরপর ওরা দড়ির কাছে চলে এলো। যেমন শক্ত তেমনি কাটার মতো লোকগুলোর দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। ভয়ে ওরা কেঁপে উঠল।

স্টেশন থেকে বেশ দূরে একটা আলো জ্বলছিল। হঠাৎ করে ওটা নিভে গেল। কিন্তু তার পাশেই আর একটা আলো জুলে উঠল। এরপর একে একে আরও আলো জ্বলে উঠল। ট্রেনটাও ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল। লোকগুলো আলো জ্বলার দিকে তাকিয়ে ট্রেনের শব্দ শুনতে লাগল। ব্রিজের দিকে কেউ আর খেয়াল করল না।

ইস্পাতের খিলানের ওপর একজন লোক ওঠার চেষ্টা করছিল। খিলানের ওপর দড়ির কাছে ওঠার পর তাকে ওদের কেউ দেখে ফেলল। ওরা লোকটিকে নিজের দলের লোক মনে করল। দড়ির বাঁধন ঠিক আছে কিনা তা বোধ হয় সে পরীক্ষা করে দেখছে। লোকটি দড়ি টেনে দেখল। বেশ শক্ত করেই বাঁধা। ইঞ্জিনের ধোঁয়া নির্গত হওয়ার উঁচু অংশ দড়িতে বেঁধে গেলে হয়ত দড়ি ছিড়ে যেতে পারে, কিন্তু গেরো খুলবে না। লোকটি দড়ির ওপর শুয়ে পড়ল। তার পা রইল গেরোর দিকে। তার হাত দড়ির প্রায় মাঝখানে পৌঁছে গেল। লোকটি বেশ লম্বা।

ট্রেনটি ক্রমেই নিকটে আসতে লাগল। দৈত্যের মতো ইঞ্চিনাটা এবং চিমনি দিয়ে নিৰ্গত আগুনের ফুলকি ট্রেন লাইন দিয়ে এগিয়ে আসছে। ট্রেনের বিকট শব্দের মধ্যে হুইসেলের শব্দ প্রায় শোনা যায় না। অস্তমান চাঁদের আলোয় পুরো ট্রেনটা এবার দেখা গেল। ইঞ্জিনের কাছে কয়লা রাখার বগি থেকে শেষ বগি পর্যন্ত ছাদের ওপর লোক এমনভাবে রয়েছে যে, ফাঁকা জায়গা বলতে কিছুই নেই।

লোকটা এখনও দড়ির ওপর শুয়ে আছে। নেতা পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, ওখান থেকে সরে এসো। গাধা কোথাকার, তুমি মারা পড়বে। এখনই সরে যাও।

লোকটি নেতার দিকে ঘুরল। সে তার কোমরবন্ধ থেকে ছোট একটা কৃপাণ বের করে দড়ির ওপর আঘাত করতে শুরু করল।

লোকটি কে? কে ঐ লোকটি….?

আর সময় নেই। ব্রিজ থেকে ওরা ট্রেনের দিকে তাকাল। ট্রেনের কাছ থেকে তাকাল ব্রিজের দিকে। লোকটি তার সব শক্তি দিয়ে দড়ি কাটার চেষ্টা করছে।

নেতা ঘাড়ের ওপর রাইফেল নিয়ে গুলি ছুঁড়ল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না গুলি। একটা পায়ে গুলি লাগল। আঘাতপ্রাপ্ত পা-টি দড়ি থেকে ছিটকে শুনো ঝুলতে লাগল। অন্য পা-টি তখনও দড়ির সাথে জড়িয়ে ছিল। পাগলের মতো সে দ্রুত আঘাত করতে লাগলো দড়ির ওপর তার ছোট কৃপাণ দিয়ে। ইঞ্জিনটা আর মাত্র কয়েক গজ দূরে। প্রতিটি হুইসেলের সাথে ইঞ্জিন থেকে নির্গত হচ্ছিল আকাশ ছোঁয়া গোলাকার ধোঁয়া। কেউ আবার একটা গুলি ছুঁড়ল। এবার লোকটির দেহ দড়ি থেকে ছিটকে পড়ল। কিন্তু সে হাত ও চিবুক দিয়ে দাঁড়িতে ঝুলে রইল। সে নিজেকে উচু করে বাম বোগালের নিচে দড়ি রাখতে সমর্থ হলো; ডান হাত দিয়ে সে শুরু করল দড়ি কাটা। ফালি ফালি হয়ে গেল দড়ি। দড়ির সামান্য একটা মাত্র গুণ অবশিষ্ট ছিল। সে কৃপাণ ও দাঁত দিয়ে তা ছেড়ার চেষ্টা করল। ইঞ্জিন তার কাছাকাছি চলে এসেছিল। আকস্মিক, তার ওপর এক সাথে অগুনতি গুলি বর্ষিত হলো। লোকটি কেঁপে উঠে নিঃসাড় হয়ে পড়ে গেল রেল লাইনের ওপর। শক্ত দড়িটাও ছিড়ে গেল। তার নিম্পন্দ দেহের ওপর দিয়ে ট্রেনটি অতিক্রম করল। চলল পাকিস্তানের দিকে।

1 Comment
Collapse Comments

দড়িটা কে কাটলো? জজ্ঞু?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *