২.৩ বর্ষাকালের শুরু

বর্ষাকালের শুরু কথাটার অন্য শব্দ বৃষ্টি নয়। এর মূল আরবী শব্দের অর্থ ঋতু বা কাল। সেই হিসাবে বলা যায় গরমকাল, শীতকাল। কিন্তু গরমকালের পর দক্ষিণপশ্চিম বায়ু শুরু হলে যে মৌসুমের সৃষ্টি হয়। সেই মৌসুমকে বলা যায় বর্ষা ঋতু। শীতকালেও সাধারণত বৃষ্টি হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে ঠাণ্ডা বৃষ্টির ধারা দেখা যায়। এতে মানুষ ঠাণ্ডা অনুভব করে এবং শীতে কাঁপতে থাকে। শস্যের জন্য শীতকাল উত্তম হলেও মানুষ এর সমাপ্তির জন্য প্রার্থনা করে। সৌভাগ্যবশত এর স্থিতিকাল বেশি দিন থাকে না।

গ্ৰীষ্মকালের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ পৃথক। এর আগে কয়েক মাস ধরে সব কিছু এমনভাবে শুকিয়ে যায় যে, বৃষ্টি আসলে গভীরভাবে এবং আরাম করে তা পান করে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে সূৰ্য ক্রমশ উত্তপ্ত হয় এবং বসন্তকাল বর্ষাকালের পথকে প্রশস্ত করে দেয়। ফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে। সেখানে সৃষ্টি হয় ফুল গাছের। প্রথমে জঙ্গলে দেখা যায় কমলা রঙের আভাযুক্ত বৃষ্টি, কোরাল গাছের সিঁদুরে রং এবং বীজ থেকে উখিত সাদা শ্যামল পাতা। তারপর শ্যামল পাতার ওপর লাল রঙের পোকা, আড়ম্বরপূর্ণ গোলমোহর গাছ ও সোনালী জলপ্রপাতের মতো নরম সোদাল ফুলের গাছের সমারোহ। এসব গাছের ফুল একদিন ঝরে পড়ে। পাতাও ঝরে পড়ে। পাতা-ফুলহীন এসব গাছের ডালপালা আকাশের দিকে উথিত থেকে যেন পানির প্রত্যাশা করে। কিন্তু পানি পাওয়া যায় না। অতি ভোরেই সূর্য যেন পূর্ব আকাশে উঠে মাটি চুষে নেয়ার আগেই ভোরের শিশির বিন্দুকে শুকিয়ে নেয়। মেঘশূন্য ধূসর আকাশে সারা দিন ধরে সূর্য তার প্রখর কিরণ ছড়িয়ে দেয়। ফলে শুকিয়ে যায় কুয়া, স্রোতধারা ও হ্রদ। ঘাস ও ছোট ছোট ঝোপ-জঙ্গল সূর্যের উত্তাপে উত্তপ্ত হয় এবং এক সময় তাতে আগুন ধরে যায়। এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং শুষ্ক বন পুড়ে ছাই হয়ে যায় দেশলাইয়ের কাঠির মতো।

দিনের পর দিন অবিরামভাবে সব কিছু ঝলসিয়ে দেয়ার ব্ৰত নিয়ে সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ে। মাটিতে ফাটল দেখা দেয়। বড় বড় ফাটল হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন পানির প্রত্যাশা করে। কিন্তু পানি নেই কোথাও। শুধু দেখা যায় দুপুরে মরীচিকোসম হ্রদের ওপর কুজুটিকার ঝিকিমিকি আভা-এক দিক থেকে অন্য দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়। গরিব গ্রামবাসীরা তাদের মৃতপ্রায় তৃষ্ণাৰ্ত পশুগুলোকে বাইরে নিয়ে যায় পানি খাওয়ানোর জন্য। ধনী লোকেরা চোখে সানগ্লাস পরে। তারা প্রখর সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আঁশযুক্ত চিকের পিছনে আশ্রয় নেয়। পরিবেশকে ঠাণ্ড রাখার জন্য ঐ চিকে তাদের ভৃত্যরা পানি ঢেলে দেয়।

সূর্যের সাথে মৃদু বায়ুর যেন একটা গভীর সম্পর্ক আছে। বাতাস গরম না হওয়া পর্যন্ত সূর্য তাতে তাপ দেয় এবং উত্তপ্ত বাতাসকে সূর্য পাঠিয়ে দেয় নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে। প্রশ্বর উত্তপ্ত আবহাওয়ায় এই লুহাওয়া কেমন যেন একটা আনন্দঘন অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। এই গরমে ঘামাচি হয়। দেহ অলস হয়ে পড়ে এবং ঘুমে চোখ বুজে আসে। এমন সময় স্ট্রোকও হতে পারে। আর তা হলে এমন নিঃশব্দে জীবন প্ৰদীপ নিভে যায়। যেমন কীটা গাছে আটকানো একটা নরম আঁশ মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ে নিচে পড়ে যায়।

এরপর মিথ্যা প্রত্যাশার কাল। বাতাস কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। লুহাওয়া অনুভূত হয় না। দক্ষিণ সীমান্ত বলয়ে দেখা যায় একটা কালো পাহাড় সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। মাথার ওপর শত শত ঘুড়ি ও কাককে উড়তে দেখা যায়। বৃষ্টি আসছে কি..? না, এটা ধূলিঝড়। আকাশ থেকে যেন বালি পড়তে থাকে। পঙ্গপালের দুৰ্ভেদ্য পাহাড় যেন সূর্যকে ঢেকে ফেলে। গাছে ও ক্ষেতে যা কিছু আছে, সব কিছুই তারা ধ্বংস করে দেয়। এর পরেই আসে ঘূর্ণিঝড়। একটা আঘাতেই বন্ধ দরজা ও জানালা খুলে যায়। বাতাসের ঘূর্ণায়মান গতির কারণে দরজা-জানালা বন্ধ হয়, আবার খুলে যায়। জানালা-দরজার কাঁচ ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। খড় বা টিনের চাল নিমেষে কাগজের টুকরার মতো আকাশে উড়ে যায়। গাছ শিকড় সমেত উপড়ে পড়ে ইলেকট্রিক লাইনের তারের ওপর। ছেড়া তারে ছোঁয়া লাগার কারণে মানুষ মারা যায়। বাড়িতে আগুনও লেগে যায়। এক বাড়ির আগুন ছড়িয়ে অন্য বাড়িতে লাগে। সব কিছু ঘটে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী-এই শব্দ কটা উচ্চারণ করার আগেই সব ঘটনা শেষ হয়ে যায়। আকাশে ভাসমান ধুলো আস্তে আস্তে বই, আসবাবপত্র ও খাদ্যের ওপর পড়ে। চোখ, কান, গলা ও নাকের মধ্যেও ধুলো ঢুকে যায়।

বৃষ্টির আশা ত্যাগ না করা পর্যন্ত এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলল। তাদের মোহমুক্তি ঘটল। তারা তৃষ্ণাৰ্ড, ঘর্মাক্ত ও বিষন্ন হয়ে পড়ল। তাদের ঘাড়ের ওপর ঘামাচিকে মনে হয় শিরিশ কাগজের মতো। এ সময় তাদের সান্ত্বনা পাওয়ার মতো আরও একটা ঘটনা ঘটল। সর্বত্র বিরাজ করল বিস্ময়কর নীরবতা। এ সময় শোনা গেল এক ধরনের পাখির অদ্ভুত ভীক্ষ ডাক। জঙ্গলের শীতল বাসা থেকে এ পাখি এখন সূর্যের আলোয় এলো কেন? ক্লান্ত দৃষ্টিতে লোকে জীবনহীন আকাশের দিকে তাকায়। হ্যাঁ, ঐ পাখির সাথে তার একটা সাখীও আছে। পাখি দু’টো দেখতে সাদা-কালো বুলবুল পাখির মতো, তাদের আছে উদ্ধত কুঁটি ও লম্বা লেজ। লোমশ ভরা উদ্ধত কুঁটির এই কোকিল উড়ে এসেছে সুদূর আফ্রিকা থেকে, বর্ষা আসার আগেই। কিছুটা কি ঠাণ্ড বাতাস অনুভূত হচ্ছে না? বৃষ্টি ভেজা সঁ্যাতসেতে মাটির গন্ধ কি পাওয়া যাচ্ছে না? মেঘের গর্জনে কি পাখির ডাক মিলিয়ে যাচ্ছে না? আকাশের অবস্থা দেখতে লোকেরা দৌড়ে ছাদে চলে গেল। একই ধরনের কালো মেঘ পূর্ব দিক থেকেও ভেসে আসতে দেখা গেল। এক ঝাক বক মেঘের পাশ দিয়ে উড়ে গেল। এক ঝলক বিদ্যুতের চমকে দিনের আলো নিম্প্রভ হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। কালো মেঘের একটা আস্তরণ সূর্ষের নিচ দিয়ে ভেসে গেল। ঘন ঐ মেঘের ছায়া বেশ স্পষ্টভাবেই এসে পড়ল মাটির ওপর। আর একবার বিদ্যুতের ঝালকানি এবং তার পরেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি শুকনো মাটিতে পড়েই শুকিয়ে গেল। শুকনো মাটিতে বৃষ্টি পড়ার পর বৃষ্টিভেজা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। আর একবার বিদ্যুতের ঝলক এবং ক্ষুধার্ত ব্যান্ত্রের মতো মেঘের ডাক। অবশেষে বৃষ্টি এলো। যেন বিস্তীর্ণ জলরাশি, ঢেউয়ের পরে ঢেউ। লোকগুলো মেঘের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রবল বৃষ্টির ফোঁটায় সারা দেহকে ভিজিয়ে নিল। স্কুল ও অফিস বন্ধ হলো। সব কাজ থেমে গেল। পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা পাগলের মতো রাস্তায় ছোটাছুটি করল। হাত তুলে হো হো শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করল।

বর্ষাকালের বৃষ্টি সাধারণ বৃষ্টির মতো নয় যে, এলো আর গেল। একবার বৃষ্টি শুরু হলে তা দুমাস বা তার বেশি সময় ধরে থাকে। বর্ষার বৃষ্টি সাদরে গৃহীত হয়। দলে দলে লোক বনভোজনের জন্য বেরিয়ে পড়ে, আমগাছের নিচে পাথর ও পাতার ওপর খড়কুটো বিছিয়ে দেয়। গাছের ডালে চড়ে মহিলা ও শিশুরা দোল খায়। সারাটা দিন খেলা করে, গান গেয়ে কাটিয়ে দেয়। ময়ূরাগুলো পেখম তুলে সদৰ্পে তার সঙ্গীদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভীষ্ম চিৎকার বনে প্রতিধ্বনিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পর উৎসাহের এই প্ৰাবল্যে ভাটা পড়ে। বিস্তীর্ণ এলাকা কাদা ও জলাভূমিতে পরিণত হয়। কুয়ো ও জলাশয় পানিতে পূর্ণ হয়ে ছাপিয়ে পড়ে। শহর এলাকার নর্দমা বন্ধ হয়ে পানির স্রোত উপচে পড়ে রাস্তার ওপর। গ্রামে মাটির দেয়াল দেয়া কুঁড়েঘর পানিতে গুলো গিয়ে ঘরের চাল ভেঙ্গে পড়ে ঘরের বাসিন্দাদের ওপর। গ্ৰীষ্মকালে সূর্যের প্রখর তাপে বরফ গলা শুরু হলেও বর্ষার সময় নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে কন্যা ঘটায়। রাস্তা, রেললাইন, পুল পানির নিচে চলে যায়। নদী তীরের ঘর-বাড়ি নদীতেই বিলীন হয়ে যায়।

বর্ষার মৌসুমে জীবন-মৃত্যুর প্রবাহও বৃদ্ধি পায়। প্রায় এক রাতেই জমিতে ঘাস গজায়, পাতাহীন গাছ ধারণ করে সবুজ রং। সাপ, বিছা, কাঁকড়া এমনিতেই জন্মে যায়। কেঁচো, গুবরে পোকা এবং ছোট ছোট ব্যাঙ মাটিতে ছড়িয়ে থাকে এলোমেলোভাবে। রাতে অসংখ্য পতঙ্গ আলোর চারপাশে ছড়িয়ে থাকে। খাবার জিনিস ও পানিতে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। পেট না ভরা পর্যন্ত টিকটিকি নানা ধরনের পতঙ্গ গিলতে থাকে এবং এক সময় তা সিলিং থেকে মেঝোয় পড়ে যায়। ঘরের মধ্যে মশার শুন শুন ধ্বনি মানুষকে পাগল করে দেয়। এসব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য লোকে কীটনাশক ছিটায়। ফলে মৃত পতঙ্গের স্তুপ পড়ে যায় মেঝের ওপর। পরদিন সন্ধ্যায় আলোর চারপাশে একই ধরনের পতঙ্গের উপস্থিতি দেখা যায়। আগুনের শিখায় ভোরা মৃত্যুকে বরণ করে।

বর্ষাকালে কোন আগাম নোটিস না দিয়েই বৃষ্টি শুরু হয় এবং তা আবার থেমে যায়। আকাশে মেঘ উড়ে বেড়ায়। হিমালয়ে যাওয়ার আগে ঐ মেঘ সমতল ভূমিতে খুশিমতো বৃষ্টি ঝরায়। পর্বতে ওঠার সময় মেঘ শীতল হওয়ার পূর্বে শেষতম পানির বিন্দুটিও ধারায় ফেলে দেয়। বিদ্যুতের চমক ও মেঘের গর্জন অবশ্য কখনও শেষ হয় না। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে। এরপর বর্ষাবিদায় নেয় শরৎ মৌসুমের জন্য।

অবিরাম মেঘের গর্জনে হুকুম চাঁদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি চোখ খুললেন। কামরার মধ্যে দেখলেন ধূসর আলো। ঘরের কোণায় একটা ল্যােম্প জ্বলছিল মিট মিট করে। চিমনি থেকে যে আলো বিজুব্রিত হচ্ছিল তা পুরো ঘরকে আলোকিত করার মতো যথেষ্ট ছিল না। একবার বিদ্যুতের ঝলকানি এবং ভার পরে মেঘের গর্জন শোনা গেল। ঘরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেল ঠাণ্ড ও ভেজা বাতাস। বাতাসের ঝাপটায় আলোর শিখা কেঁপে উঠে নিভে গেল। ছন্দায়িত শব্দে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরতে লাগল। অবিরামভাবে।

বৃষ্টি। অবশেষে সত্যি বৃষ্টি এলো। ভাবলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। বর্ষার এ মৌসুমে বৃষ্টি হয় নি। আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে কিন্তু তা ছিল অনেক ওপরে। তাও আবার জমাট বাঁধা মেঘ নয়। ফলে তা সহজেই বাতাসে উড়ে গেছে। তৃষ্ণার্তা পৃথিবী আরও তৃষ্ণার্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ার অর্থ বৃষ্টি খুব দেরিতে হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই এই বৃষ্টিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে। এই বৃষ্টির সুবাস ভাল, এর শব্দ ভাল, একে দেখতেও ভাল এবং সর্বোপরি এর উপকারিতা অনেক ভাল। কিন্তু সত্যি কি ভাই? হুকুম চাঁদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা গেল। মৃতদেহগুলো! হাজারখানেক মৃতদেহ পোড়ানোর শব্দ ও আগুনের ধোঁয়া বৃষ্টির পানিতে নিভে গেল। তাঁর কাছ থেকে মাত্ৰ শত গজ দূরেই রয়েছে মৃতদেহগুলো। তাঁর কপালে ঘাম দেখা দিল। তিনি শীত অনুভব করলেন। ভয়ও পেলেন। বিছানার অপর পারে গিয়ে দেখলেন, মেয়েটিও নেই। বাংলোয় তিনি একই ছিলেন। বালিশের তলা থেকে হাতঘড়ি নিয়ে ডায়ালের ওপর গোল করে হাত রাখলেন। রেডিয়াম দেয়া ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে ছটা বাজার নির্দেশ করছে। তিনি অনেক সময় বিশ্রাম নিয়েছেন। বেশ আগেই সকাল হয়েছে। আকাশ হয়ত মেঘে ঢাকা, তাই অনুমান করা যায়নি। বারান্দায় কে যেন একজন কেশে উঠল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে বসলেন।

তাঁর মাথা ব্যথা করছিল। চোখ বন্ধ করে তিনি দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন। আস্তে আস্তে মাথা ব্যথার উপশম হলো। তিনি হুইস্কি পান করেছিলেন অনেক, কিন্তু খাবার কিছুই খাননি। কয়েক মিনিট পরে চোখ খুলে তিনি কামরার চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। দেখলেন ঐ মেয়েটিকে। সে চলে যায়নি। হাতলযুক্ত বড় বেতের চেয়ারটায় সে ঘুমিয়ে রয়েছে, তার গায়ে জড়ানো জরি দেয়া কালো শাড়ি। হুকুম চাঁদ নিজের কাছেই অপরাধী বোধ করলেন। মেয়েটি দু’টো রাত এখানেই আছে এবং দু’টো রােতই সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে ঐ বেতের চেয়ারটায়। প্রায় মড়ার মতো পড়ে আছে সে। শুধু শ্বাস-প্ৰশ্বাসের সাথে বুকটা ওঠানামা করছে। তাঁর মনে হলো তিনি বৃদ্ধ এবং অপবিত্র। এই বালিকার সাথে তিনি কিভাবে ঐসব কাজ করতে পেরেছেন ঃ তাঁর মেয়ে বেঁচে থাকলে সেও প্রায় ঐ বয়সের হতো। স্বীয় অপরাধের জন্য তাঁর অনুশোচনা হলো। তিনি এ কথা জানেন যে, তাঁর এই অনুশোচনা ও উত্তম সিদ্ধান্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। সম্ভবত তিনি আবার মন্দ পান করবেন, ঐ মেয়েকেই তিনি কাছে ডাকবেন, তার সাথেই রাত কাটাবেন এবং সেজন্য আবার দুঃখ প্ৰকাশ করবেন। এটাই জীবন এবং এটাই হতাশা।

তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের ওপর রাখা এ্যাটাচি কেন্সটা খুললেন। এ্যাটাচি কেসের ঢাকনার ভিতর দিকে লাগানো আয়নায় তিনি নিজেকে ভাল করে দেখলেন। দুচোখের কোণায় তিনি দেখলেন হলদে রঙের পিচুটি। মাথার চুলের গোড়া সাদা ও বেগুনি রং ধারণ করেছে। শৌভ না করা থুতনির নিচে দেখা গেল মাংসের কয়েকটি ভাঁজ। সত্যি তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, দেখতেও তেমন সুশ্ৰী নন। তিনি। জিহ্বা বের করে দেখলেন। জিহ্বার মাঝ থেকে ওপরের দিকে দেখা গেল ফ্যাকাশে হলুদ রঙের আভা। জিহ্বার অগ্রভাগ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি টেবিলের ওপর এসে পড়ল। তিনি নিজের শ্বাস-প্ৰশ্বাসের গন্ধও অনুভব করলেন। মেয়েটির নাসিকা গর্জনও শুনলেন তিনি। তার নাসিকা গৰ্জনে বিস্ময়ের কিছু নেই। সারা রাত সে একটা চেয়ারে ঘুমিয়েছে, চেয়ারটা আরামদায়কও নয়। যকৃতের জন্য উপকারী লবণ জাতীয় ওষুধের একটা বোতল বের করে হুকুম চাঁদ বড় চা চামচের কয়েক চামচ, ওষুধ একটা গ্লাসে ঢাললেন। থার্মোফ্রাস্কের মুখ খুলে গ্লাসে পানি ঢাললেন। গ্লাসে পানি ঢালার সাথে সাথে বুদ্ধদে গ্লাস ভরে উপচে তা টেবিলের ওপর পড়ল। বুদুন্দ পানিতে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন এবং তারপর পুরো গ্লাসের ওষুধ পান করলেন। কিছু সময় ধরে তিনি মাথা কাত করে দাড়িয়ে রইলেন। টেবিলের ওপর হাত দু’টো ফেলে রাখলেন আলতোভাবে।

লবণাক্ত ঐ ওষুধ পান করে তিনি বেশ আরাম বোধ করলেন। বড় রকমের একটা ঢেঁকুর তোলার পর তাঁর আরামের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। মাথা ধরা ও ঘাড়ের ওপর চিন চিনা করে যে ব্যথা করছিল তাও আস্তে আস্তে সেরে গেল। এখন দরকার কয়েক কাপ গরম চা। তারপর তিনি তাঁর পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন। হুকুম চাদ বাথরুমে গিয়ে খোলা দরজার দিকে মুখ বাড়িয়ে বেয়ারার উদ্দেশে বললেন:

শোভিংয়ের পানি নিয়ে এসো। এখানেই নিয়ে এসো।

বেয়ারা আসলে হুকুম চাদ চায়েন্ন ট্রে ও শোভ করার জন্য গরম পানির মগটা বেড়ারুমে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। নিজে এক কাপ চা ঢাললেন এবং শেডিং করার জিনিসপত্র বের করলেন। তিনি থুতনিতে শোভিংক্রিম ঘষে শেড় করার সময় দুএক চুমুক চা পান করলেন। চায়ের কাপে চামচের শব্দ মেয়েটির ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটোল না। মুখটা সামান্য হয় করে সে ঘুমিয়ে রইল। তাকে প্রায় মড়ার মতোই দেখাচ্ছিল। শুধু নিশ্বাস নেয়ার সময় বুকটা উঁচু হচ্ছিল সামান্য। মনে হচ্ছিল তার স্তন দু’টো বডিসের খালি অংশ পূরণ করার লক্ষ্যে ওপরের দিকে উঠছিল। কিন্তু বৃথা তার ঐ চেষ্টা। তার সারা মুখে চুল এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। প্রজাপতির মতো দেখতে একটা চুলের ক্লিপ পড়ে রয়েছে চেয়ারের পায়ার কাছে। তার শাড়ির ভাঁজ এলোমেলো, শাড়িতে লাগানো চুমকি ছড়িয়ে রয়েছে মেঝের ওপর। হুকুম চাঁদ যখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে শেভ করছিলেন, তখন মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। ঐ মেয়ের জন্য নিজেকে তৈরি করা ছাড়া তিনি আর কিছু চিন্তা করতে পারছিলেন না। মেয়েটি যদি চায় তিনি তার সাথে ঘুমিয়ে থাকুন তাহলে তিনি তাই করবেন। এই চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তুলন। মেয়েটির যোগ্য করে তুলতে তাকে আকুণ্ঠ পান করতে হবে।

বারান্দায় কাশি ও পায়ের শব্দে হুকুম চাঁদের চিন্তা ভঙ্গ হলো। ঐ কাশি ছিল হুকুম চাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এবং ঐ কাজটা করলেন একজন সাবইন্সপেক্টর। হুকুম চাদ, চাপান শেষ করে কাপড় নিয়ে ঢুকলেন বাথরুমে, পোশাক পরিবর্তনের জন্য। কিছুক্ষণ পর বাথরুমের অন্য দরজা দিয়ে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব, খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিনি তাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে স্যালুট করলেন।

স্যার, এই বৃষ্টির মধ্যে, আপনি কি বাইরে হাঁটতে বেরুচ্ছেন?

না না। আমি সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের ঐ দিকটা একবার ঘুরে এলাম। বেশ সকালেই আপনি এলেন। আমার মনে হয় সব কিছুই ঠিক আছে।

এ সময় বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কোথাও শান্তি নেই। একটার পর একটা গণ্ডগোল লেগেই আছে…।

ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের হঠাৎ করে মনে পড়ল ঐ মৃতদেহগুলোর কথা।

রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? রেল স্টেশনের পাশে সব কাজ কি ঠিকমত হয়েছে?

সকালে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় আমি ওখানে ছিলাম। সব কিছু পুড়ে যেতে বেশি কিছু বাকি নেই। ছাইয়ের একটা বড় টিবি দেখা যায়, ওতে কিছু হাড় পুড়তে এখনও বাকি আছে। এখানে ওখানে কিছু মাথার খুলি ছড়িয়ে আছে। এসব নিয়ে এখন কি করা যায় বুঝতে পারছি না। গ্রামের মাতব্বরকে অবশ্য নির্দেশ দিয়েছি কাউকে যেন ব্রিজ বা ক্টেশনের কাছে যেতে না দেয়া হয়।

কতগুলো মৃতদেহ পুড়িয়েছেন? আপনি কি গুণে দেখেছেন?

না স্যার। শিখ অফিসারটি বলছিল এক হাজারের বেশি মৃতদেহ ছিল। আমার মনে হয়, একটা বগিতে যে কজন লোক বসতে পারে তার ভিত্তিতে সে ঐ হিসাব করেছে। ট্রেনের ছাদ, পাদানি ও দুই বগির মাঝে যারা ছিল তাদের সংখ্যা চার-পাঁচ শ হবে বলে সে বলেছে। আক্রমণের সময় তারা পড়ে গেছে বলে তার ধারণা। ছাদে শুকনো রক্তের দাগ আছে।

হরে রাম, হরে রাম। পনেরো শ নির্দোষ লোক। কলিযুগ আর কাকে বলে? দেশে একটা দুঃখজনক অধ্যায়ের সূচনা হলো। সীমান্তের এটা মাত্র একটা স্থান। অন্যান্য স্থানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটছে বলে আমার ধারণা। আমার বিশ্বাস, আমাদের লোকেরাও এ ধরনের কাজ করছে। আশপাশের গ্রামের মুসলমানদের অবস্থা কেমন?

ঐ কথা আমি আপনাকে জানাতে এসেছি স্যার। কয়েকটা গ্রামের মুসলমানরা উদ্বাস্তু ক্যাম্পে যেতে শুরু করেছে। চন্দননগর থেকে কিছু মুসলমানকে সরানো হয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র বেলুচি ও পাঠান সৈন্য ভর্তি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লরি তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানো মাজরা গ্রামের মুসলমানরা এখনও গ্রামে। আছে। আজ সকালে চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের একদল শিখ সীমান্তের নদী অতিক্রম করে গ্রামে এসে পৌঁছেছে। তাদের গুরুদুয়ারায় আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলে গ্রামের সর্দার আমাকে জানিয়েছে।

ওদের এখানে থামতে দেয়া হলো কেন? হুকুম চাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো ভাল করেই জানেন যে, আগত উদ্বাস্তুদের অবশ্যই জলন্ধর উদ্ধাস্তু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আছে। এটা খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। ওরা মানো মাজরায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিতে পারে।

না স্যার। অবস্থা এখনও পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে। ঐ উদ্বাস্তুরা পাকিস্তানে খুব বেশি কিছু হারায় নি এবং বাহ্যত তারা পথে হয়রানির শিকার হয়নি। মানো মাজরার মুসলমানরা গুরুদুয়ারায় তাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। যাদের আত্মীয়স্বজন গণহত্যার শিকার হয়েছে তাদের কেউ এলে পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন রকম হয়ে দাঁড়াবে। সীমান্তের নদী হেঁটে পার হয়ে উদ্বাস্তু আসতে পারে, একথা আমার মাথায় আসেনি। সাধারণত বর্ষার সময় নদী প্রায় এক মাইল চওড়া হয়ে যায়। নভেম্বরডিসেম্বর মাসের আগে কেউ হেঁটে নদী পার হওয়ার চিন্তা করে না। এ বছর বৃষ্টি প্রায় হয়নি। নদীর কয়েকটা পয়েন্ট থেকে হেঁটে পার হওয়া যায়। নদী-সীমান্ত পাহারা দেয়ার মতো যথেষ্ট পুলিশ আমার কাছে নেই।

হুকুম চাঁদ ডাকবাংলোর সামনে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। ছোট ডোবাগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ ধূসর হয়ে আছে।

ঠিক আছে। বৃষ্টি হতে থাকলে নদীর পানি বেড়ে যাবে এবং লোকে আর নদী অতিক্রম করতে পারবে না। ব্রিজের কাছে বসেই শরণার্থীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ कला यादि।

হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি এবং তার পরেই মেঘের ডাক। বৃষ্টির ধারাও যেন বেড়ে গেল। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটা বারান্দায় এসে পড়ল।

এই এলাকা থেকে মুসলমানদের অবশ্যই সরিয়ে নিতে হবে। তারা এটা পছন্দ করুক বা না করুক। যত শীগগির এ কাজ করা যায় ততই মঙ্গল।

আলোচনায় ছেদ পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেউ কোন কথা বললেন না। দুজনেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হুকুম চাঁদ আবার কথা বলতে শুরু করলেন।

ঝড় শুরু হলে তা না থামা পর্যন্ত মাথা নত করে থাকাই শ্রেয়। মাঠের ঘাসগুলো দেখুন। মৃদুমন্দ বাতাসে এর ডগা হেলে পড়ছে বাতাসের গতির দিকে। কিন্তু এর গোড়া শক্ত হয়ে আছে গর্বিতভাবে। কিন্তু যখন ঝড় আসে তখন সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়, বাতাসের গতির সাথে ঘাসের পাতাগুলোও ছড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক। একটু থেমে তিনি বললেন, জ্ঞানী লোকেরা স্রোতকে অনুসরণ করে সাঁতার দিয়ে কূলে ওঠে।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ মনোযোগ দিয়ে ঐ কথাগুলো শুনলেন। কিন্তু তাঁর সমস্যার সাথে ঐ কথার কোন তাৎপর্য আছে কিনা বুঝতে পারলেন না। তিনি যে কিছু বুঝতে পারেন নি সে কথা হুকুম চাঁদও তার শূন্য চাহনি দেখে বুঝে নিলেন। কথাগুলো তাঁর কাছে আরও সরলভাবে ব্যক্ত করা দরকার।

রামলালের খুন সম্পর্কে আপনি কি করেছেন? এজন্য আর কাউকে গ্রেফতার করেছেন?

হ্যাঁ স্যার। জুগ্‌গা বদমায়েশ গতকাল কয়েকজনের নাম বলেছে। এরা সবাই এক সময় তার দলের লোক ছিল। এরা হলো মাল্লি এবং আরও চারজন। এরা সবাই নদী থেকে প্রায় দুমাইল দূরে কাপুর গ্রামের বাসিন্দা। তবে জুগ্‌গা তাদের সাথে ছিল না। ওদের গ্রেফতার করার জন্য আজ সকালেই আমি কয়েকজন কনষ্টেবলকে পাঠিয়েছি।

হুকুম চাঁদ তাঁর কথা শুনলেন বলে মনে হলো না। বহু… বহু দূরে যেন তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল।

জুগ্‌গা ও অন্য লোকটার প্রতি আমরা অন্যায় করেছি। ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, একজন মুসলমান তাঁতীর মেয়ের সাথে জুগ্‌গার একটা সম্পর্ক আছে, এ কথা আগে আপনাকে বলেছি। প্রায় রাতেই সে ঐ মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ডাকাতির পর মাল্লি জুয়ার বাড়ির আঙ্গিনায় ঐ চুড়ি ফেলে যায়।

হুকুম চাঁদ তখনও ছিলেন অন্যমনস্ক।

স্যার, আপনি যদি মত দেন তাহলে আমরা জুগ্‌গা ও ইকবালকে ছেড়ে দিতে পারি মাল্লি ও তার সঙ্গীদের পাওয়ার পর।

মাল্লি ও তার সঙ্গীরা মুসলমান না শিখ? হুকুম চাঁদ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

ওরা সবাই শিখ।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুনরায় চিন্তামগ্ন হলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মনে মনে বললেন, ওরা যদি মুসলমান হতো তাহলে সুবিধা হতো সব দিক থেকে। লীগপন্থী ঐ লোকটা এবং ওদের দিয়ে মানো মাজরার শিখদের বোঝানো যেত তারা যেন গ্রামের মুসলমানদের চলে যেতে দেয়।

আরও কিছুক্ষণ আলোচনায় বিরতি। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের মনেও ঐ ধরনের একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। তিনি কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়ালেন। হুকুম চাঁদ কোন চান্স নিতে চাইলেন না।

শুনুন। তিনি বললেন, মাল্লি ও তার সঙ্গীদের ধরার প্রয়োজন নেই। খাতায় তাদের নামও তুলবেন না। তবে তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখবেন। প্রয়োজন হলে আমরা তাদের গ্রেফতার করব। ঐ বদমায়েশ বা অন্য লোকটাকে এখন ছেড়ে দেবেন না। ওদের প্রয়োজন হতে পারে।

ইন্সপেক্টর সাহেব স্যালুট করলেন।

দাঁড়ান, আমি এখনও কথা শেষ করিনি। হুকুম চাঁদ তাঁর হাত তুলে ইশারা করলেন। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আপনি মুসলমান উদ্বাস্তু শিবিরের কমান্ডারের কাছে খবর পাঠাবেন, মানো মাজরার মুসলমানদের সরিয়ে নেয়ার জন্য তিনি যেন ট্রাক পাঠিয়ে দেন।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব। আর একবার স্যালুট করলেন। একটা জটিল ও সঙ্কটপূৰ্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হুকুম চাঁদ যে একজন বিশ্বস্ত লোকের ওপর ভার দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তিনি বর্ষতি চাপিয়ে দিলেন গায়ে।

এই বৃষ্টির মধ্যে আমি আপনাকে যেতে দিতাম না। কিন্তু বিষয়টা এমনই জরুরী যে, আপনার সময় নষ্ট করা উচিত নয়। মাঠের দিকে তাকিয়ে হুকুম চাঁদ বললেন।

আমি জানি স্যার। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব। আবার স্যালুট করলেন। আমি এখনই কাজ শুরু করছি। তিনি তাঁর সাইকেলে উঠে কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে চলে গেলেন।

আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে হুকুম চাঁদ তাকিয়ে রইলেন। তখনও বৃষ্টি ঝরছিল আকাশ থেকে বিরামহীনভাবে। ঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত কোন সময় তাঁকে ভারাক্রান্ত করেনি। তিনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট-কোন মিশনারি কাজ তার নয়। প্রতিদিনের সমস্যার উত্তর তাকে খুঁজতে হয়। অজানা পরিপূর্ণ উত্তরের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করার প্রয়োজন তাঁর নেই। কি হতে পারে এমন ধরনের চিন্তার ঘটনা তার জানা নেই। কি ঘটছে। এটাই তিনি জানেন। জীবনকে তিনি নিয়েছেন স্বাভাবিকভাবে। একে নিজের মতো করে নিতে বা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে তিনি চান না। ইতিহাসের বিবর্তনে মানুষ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক অবদান রেখেছে। তার বিশ্বাস, তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে মানুষের সৎ প্রচেষ্টা থাকা দরকার। এসব তাৎক্ষণিক প্রয়োজন বলতে তিনি বোঝেন, বিপদে পড়লে কিভাবে জীবন রক্ষা করতে হয়, সামাজিক কাঠামো সংরক্ষণ, সমাজের রীতিনীতির প্রতি শ্ৰদ্ধা জ্ঞাপন ইত্যাদি। তার তাৎক্ষণিক কাজ হলো মুসলমানদের জীবন রক্ষা করা। যেভাবেই হোক তিনি সে কাজ করবেন। তাছাড়া এ যাবত তিনি কোন কাজই রাগের মাথায় করেন নি। তাঁর স্বাক্ষরে যে দুজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অন্য কোন কারণেও গ্রেফতার করা যেত। একজন আন্দোলনকারী এবং অন্যজন অসৎ চরিত্রের লোক। সঙ্কটের সময় তাদের আটকে রাখাই শ্ৰেয়। কোন বড় কাজে যদি তার সামান্য ভুল হয় তাহলে সেই ভুলকে ভুল বলা ঠিক হবে না। হুকুম চাদ আনন্দ অনুভব করলেন। তাঁর পরিকল্পনা মোতাবেক যদি সব কাজ সুষ্ঠুভাবে হয়! সাল কিছুর নির্দেশ যদি তিনি নিজে দিতে পারতেন, তাহলে কোন অঘটন ঘটত না। তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা তাঁর মনের কথা সব সময় বুঝতে পারে না বলেই তাঁকে মাঝে মাঝে জটিল অবস্থায় পড়তে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *